পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । শেষ পর্ব ।

(ঞ) আপোস-মীমাংসা করা : সমাজ ও সংগঠনবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে গেলে ব্যক্তি বা সংগঠনের মধ্যে কখনো কখনো পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি, মন কষাকষি বা ঝগড়া-ঝাটি হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে শয়তান মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। এমতাবস্থায় তৃতীয় একটি পক্ষকে এগিয়ে এসে তাদের মধ্যকার বিবাদ-বিসম্বাদ মিটিয়ে দিতে হবে। এটা তার ঈমানী দায়িত্ব। আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوْا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ. ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমাদের ভাইদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আশা করা যায় তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হবে’ (হুজুরাত ৪৯/১০)। এর আগের আয়াতে মহান আল্লাহ এ ব্যাপারে সীমা অতিক্রমকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করারও নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,

وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ اقْتَتَلُوْا فَأَصْلِحُوْا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِيْ تَبْغِيْ حَتَّى تَفِيْءَ إِلَىْ أَمْرِ اللَّهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوْا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوْا إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِيْنَ.

‘মুমিনদের দুই দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হ’লে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে; আর তাদের একদল অপর দলের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করলে যারা বাড়াবাড়ি করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করবে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি তারা ফিরে আসে, তাহ’লে তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে ফায়ছালা করে দিবে এবং সুবিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালবাসেন’ (হুজুরাত ৪৯/৯)।

বিবাদ মীমাংসার বিষয়টি ইসলামী শরী‘আতে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَفْضَلَ مِنْ دَرَجَةِ الصِّيَامِ وَالصَّلاَةِ وَالصَّدَقَةِ؟ ‘আমি কি তোমাদেরকে ছিয়াম, ছালাত ও ছাদাক্বার চেয়ে উত্তম মর্যাদাকর বিষয় সম্পর্কে খবর দেব না? ছাহাবীগণ বললেন, অবশ্যই আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, إِصْلاَحُ ذَاتِ الْبَينِ. ‘বিবাদমান বিষয়ে মীমাংসা করা’।[1] কেননা সামান্য ভুল-ভ্রান্তির কারণে মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হ’লেও অনেক ক্ষেত্রে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। তাই বিবাদ মীমাংসার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ যেমন যুদ্ধের অনুমতি দিয়েছেন, তেমনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও ঝগড়া-বিবাদ নিরসনের লক্ষ্যে প্রয়োজনে যৎসামান্য মিথ্যা বলার অনুমতি দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন,

لَيْسَ الْكَذَّابُ الَّذِىْ يُصْلِحُ بَيْنَ النَّاسِ وَيَقُوْلُ خَيْرًا وَ يَنْمِىْ خَيْرًا.

‘যে ব্যক্তি মানুষের মধ্যে আপোস-মীমাংসা করে দেয়, সে মিথ্যাবাদী নয়। বস্ত্ততঃ সে ভাল কথা বলে এবং উত্তম কথাই আদান-প্রদান করে’।[2] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, لاَ يَحِلُّ الْكَذِبُ إِلاَّ فِىْ ثَلاَثٍ، يُحَدِّثُ الرَّجُلُ امْرَأَتَهُ، وَالْكَذِبُ فِى الْحَرْبِ، وَالْكَذِبُ لِيُصْلِحَ بَيْنَ النَّاسِ. ‘তিনটি ক্ষেত্র ব্যতীত মিথ্যা বলা জায়েয নয়। ১. কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীর সাথে কথাবার্তা বলার সময় ২. যুদ্ধের ময়দানে এবং ৩. মানুষের মাঝে মীমাংসা করার জন্য’।[3] এরূপ প্রশংসনীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে যখন দু’টি বিবদমান দল পারস্পরিক ভুল-ভ্রান্তি নিরসনের মাধ্যমে পুনরায় ভাই ভাই হয়ে যায়, তখন যাদের মধ্যস্থতায় এই মহৎ কাজটি সংঘটিত হয়, উভয় দলই তাদের প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে থাকে।

(ট) সুপরামর্শ ও সদুপদেশ দেওয়া : কোন ব্যক্তি যখন কারো কাছ থেকে কোন যরূরী প্রয়োজনে ভাল পরামর্শ বা সদুপদেশ পায়, তখন ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে তার অন্তরে সহানুভূতি সৃষ্টি হয়। যা ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে সকল ক্ষেত্রে একজন মানুষের সমান অভিজ্ঞতা থাকে না। সেক্ষেত্রে কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যারা অভিজ্ঞ তাদের পরামর্শ যরূরী হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় তাকে সুপরামর্শ ও সদুপদেশ দেওয়া উচিত। এ বিষয়ে নবী করীম (ছাঃ) বলেন,

إِنَّ اللهَ لَمْ يَبْعَثْ نَبِيًّا وَلاَ خَلِيْفَةً إِلاَّ وَلَهُ بِطَانَتَانِ، بِطَانَةٌ تَأْمُرُهُ بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَى عَنِ الْمُنْكَرِ، وَبِطَانَةٌ لاَ تَأْلُوْهُ خَبَالاً، وَمَنْ يُّوْقَ بِطَانَةَ السُّوْءِ فَقَدْ وُقِىَ.

‘আল্লাহ কোন নবী বা খলীফাকে প্রেরণ করেননি, যার সাথে দু’টি অন্তরঙ্গ পরামর্শক দেননি। একটি তাকে ভাল কাজে প্রেরণা যোগায় এবং মন্দ কাজ হ’তে বারণ করে। আর অপরটি তার সর্বনাশ সাধন করে। যে ব্যক্তি মন্দের প্ররোচনাদানকারী হ’তে রক্ষা পেয়েছে, সে প্রকৃতই বেঁচে গেছে’।[4]

(ঠ) দোষ-ত্রুটি সংশোধন করে দেওয়া : একজন মুমিন অপর মুমিনের ভাই (হুজুরাত ৪৯/১০)। সুতরাং ভাই ভাইয়ের সকল প্রকার ভুল-ভ্রান্তি, দোষ-ত্রুটি সংশোধন করে দিবে এটাই স্বাভাবিক। এর মাধ্যমে ভাইয়ের দুনিয়াবী চলার পথ সুগম হয়, পরকালীন হিসাব সহজ হয়, সাথে সাথে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি পায়। এ বিষয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ সর্বদা স্মরণ রাখা উচিত। তিনি বলেন, اَلْمُؤْمِنُ مِرْآةُ الْمُؤْمِنِ، وَالْمُؤْمِنُ أَخُو الْمُؤْمِنِ. ‘এক মুমিন অপর মুমিনের দর্পণ ও ভাই’।[5]

(ড) মনের কথা মুখে প্রকাশ করা : একজন মানুষ নানা কারণে আরেকজন মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হ’তে পারে। কারো আলাপ-ব্যবহারে, আচার-আচরণে, ব্যক্তিত্বে বা অন্য কোন ভাল গুণের কারণে নিজের অজান্তেই কারো অন্তরে স্থায়ী আসন করে নেওয়া বিচিত্র নয়। সেক্ষেত্রে ইসলামী শরী‘আতের বিধান হ’ল- কোন ব্যক্তিকে যখন কেউ কেবল পরকালীন স্বার্থে ভালবাসে বা মুহাববত করে, তখন সে যেন তার মনের কথাটা তার ভাললাগা লোকের কাছে মুখে প্রকাশ করে। এতে করে ঐ ব্যক্তিও বুঝতে পারবে যে, আমার অমুক দ্বীনী ভাই আমাকে মুহাববত করে। তখন তার অন্তরেও ঐ ব্যক্তির প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হবে। এ বিষয়ে হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ كَرِيْمَةَ الْمِقْدَادِ بْنِ مَعْدِيْكَرَبَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِذَا أَحَبَّ الرَّجُلُ أَخَاهُ فَلْيُخْبِرْهُ أَنَّهُ يُحِبُّهُ.

আবু কারীমা মিক্বদাদ ইবনু মা‘দীকারাব (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘যখন কোন ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইকে মুহাববত করে, তখন সে অবশ্যই তাকে অবহিত করবে যে, সে তাকে মুহাববত করে’।[6]

(ঢ) ব্যক্তিগত ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ : ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির একটি অন্যতম দিক হ’ল দ্বীনী ভাইয়ের ব্যক্তিগত ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া তথা ঔৎসুক্য প্রকাশ করা। ভাইয়ের সঙ্গে যখন সাক্ষাৎ হবে, তখন কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি তার পরিবারের অন্যদের অবস্থা জানতে চাওয়া উচিত। এর মাধ্যমে আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পায়। তবে প্রথমে দ্বীনী ভাইয়ের সার্বিক অবস্থা যেমন- নাম, ঠিকানা, বংশ-পরিচয়, পরিবারের সদস্য সংখ্যা, আর্থিক অবস্থা, পিতা-মাতা ইত্যাদি সম্পর্কে জেনে নেওয়া প্রয়োজন।

(ণ) উৎকৃষ্ট নামে ডাকা : মানুষমাত্রই নিজেকে অন্যের নিকটে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে চায়। এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ এটাও চায় যে, অন্যে তাকে উপযুক্ত ও উৎকৃষ্ট ভাষায় সম্বোধন করুক। কাউকে যত প্রীতিপূর্ণ ভাষা ও আবেগময় ভঙ্গিতে সম্বোধন করা হবে, এর মাধ্যমে সম্বোধনকারীর আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বের ভাব ততবেশী প্রকাশিত হবে। এতে করে যাকে ডাকা হবে, তার অন্তরও ঐ ব্যক্তির প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় হবে।

বাস্তবে দেখা যায়, কাউকে ডাকার সময় তার নামের প্রথম বা শেষাংশ উল্লেখ করে ডাকা হয়। এতে একদিকে যেমন শ্রুতিমধুর হয় না, অন্যদিকে অনেক ক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তির নামের অর্থও বিকৃত হয়ে যায়, যা পাপের কারণ হ’তে পারে। যেমন কারো নাম যদি হয় ‘আব্দুর রাযযাক’ যার অর্থ ‘রিযিকদাতার বান্দা’, কিন্তু তাকে যদি শুধু ‘রাযযাক’ বলে ডাকা হয়, তার অর্থ দাঁড়াবে ‘রিযিকদাতা’, যা বলা শিরকের পর্যায়ভুক্ত। আবার অনেককে দেখা যায়, কোন ব্যক্তি হয়তো কখনো কোন অন্যায় কাজ করেছে, পরবর্তীতে তার নামের আগে বা পরে ঐ অপকর্মের বিষয়টি জুড়ে দিয়ে তাকে ডাকা হচ্ছে। যা ঐ ব্যক্তির জন্য অবশ্যই কষ্টদায়ক। কাউকে লাঞ্ছিত করা, হেয় প্রতিপন্ন করা বা লজ্জা দেয়ার উদ্দেশ্যে এরকম কোন খারাপ নামে ডাকা ইসলামী শরী‘আতে নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَنَابَزُوْا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَ الْإِسْمُ الْفُسُوْقُ بَعْدَ الْإِيْمَانِ. ‘তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। ঈমান আনার পরে কাউকে মন্দ নামে ডাকা পাপ’ (হুজুরাত ৪৯/১১)। একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বনী সালিমাহ গোত্রে আসেন। তাদের প্রায় প্রত্যেকের দু’টো বা তিনটি নাম ছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ডাকা শুরু করলেন, হে অমুক! তখন তারা বলতে লাগল, থামুন হে আল্লাহর রাসূল! সে এই নাম শুনলে ক্রদ্ধ হয়। তখন উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।[7]

সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা উপনামে সমধিক প্রসিদ্ধ। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি উক্ত নামে ডাকার ক্ষেত্রে কোন প্রকার মনে কষ্ট না পায় বা তার আপত্তি না থাকে, তাহ’লে তাকে উপনামে ডাকা দোষের নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সময় এমনটি অনেকের ক্ষেত্রে ঘটেছে। যেমন প্রসিদ্ধ ছাহাবী ‘আবু হুরায়রা’-এর প্রকৃত নাম আব্দুর রহমান। অনুরূপভাবে লম্বা হাতওয়ালা জনৈক ছাহাবীকে ‘যুল ইয়াদায়ন’ বলা হ’তো ইত্যাদি। তাঁরা যেহেতু এরকম উপনামে ডাকার বিষয়ে আপত্তি প্রকাশ করেননি বা অসন্তুষ্ট ছিলেন না, বরং সন্তুষ্টই ছিলেন, সেহেতু তাদেরকে ঐ নামে ডাকায় কোন দোষ নেই। বন্ধুত্ব কিসের দ্বারা সুদৃঢ় হয়? এমন এক প্রশ্নের উত্তরে ওমর (রাঃ) বলেন, ‘বন্ধুকে উৎকৃষ্ট নামে সম্বোধন কর’।[8] তাই সর্বাবস্থায় মানুষকে তার উৎকৃষ্ট নামে সম্বোধন করা উচিত।

(ত) প্রশংসা বা কৃতজ্ঞতা স্বীকার : কৃতজ্ঞতা দুই প্রকার। এক- আল্লাহর কৃতজ্ঞতা। দুই- বান্দার কৃতজ্ঞতা। মহান আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকে প্রতি মুহূর্তে তাঁর সৃষ্টি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নানাভাবে যে অফুরন্ত নে‘মত ও সহযোগিতা করে যাচ্ছেন, এজন্য আজীবন তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেও শেষ করা যাবে না। সেকারণ সর্বাবস্থায় বলতে হবে ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ (যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য)। মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে বলেন, وَقُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ ‘(হে নবী!) আপনি বলুন, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর’ (বনী ইসরাঈল ১৭/১১১)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا أَنْعَمَ اللهُ عَلَى عَبْدٍ نِعْمَةً فَقَالَ: اَلْحَمْدُ لِلَّهِ، إِلاَّ كَانَ الَّذِىْ أَعْطَاهُ أَفْضَلَ مِمَّا أَخَذَ. ‘আল্লাহ কোন বান্দাকে কোন নে‘মত দিলে সে যদি ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ বলে, তাহ’লে যা সে পেয়েছে, তার চেয়ে উত্তম আল্লাহ তাকে দান করে থাকেন’।[9]

অন্যত্র আল্লাহ কৃতজ্ঞতা স্বীকারের প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন, فَاذْكُرُوْنِيْ أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُواْ لِيْ وَلاَ تَكْفُرُوْنِ. ‘অতঃপর তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদের স্মরণ করব। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর এবং আমার আদেশ লঙ্ঘন কর না’ (বাক্বারাহ ২/১৫২)। তিনি আরো বলেন, لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيْدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِيْ لَشَدِيْدٌ. ‘তোমরা যদি আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর, তোমাদেরকে আমি আরো অধিক দিব। আর অকৃতজ্ঞ হ’লে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর’ (ইবরাহীম ১৪/৭)। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও কঠোর নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করারও সুসংবাদ দিয়েছেন। যেমন-

عَنْ أَنَسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ اللهَ لَيَرْضَى عَنِ الْعَبْدِ يَأْكُلُ الْأَكْلَةَ فَيَحْمَدُهُ عَلَيْهَا وَ يَشْرَبُ الشَّرْبَةَ فَيَحْمَدُهُ عَلَيْهَا.

আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তাঁর সেই বান্দার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন, যে খাদ্য গ্রহণের সময় আল্লাহর প্রশংসা করে এবং পানীয় পানের সময়ও তাঁর প্রশংসা করে’।[10] সুতরাং সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রশংসা করা উচিত।

পক্ষান্তরে কোন ব্যক্তি যদি কাউকে সামান্য পরিমাণও কোন উপকার বা সহযোগিতা করেন, তখন তার প্রতি সানন্দচিত্তে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা অবশ্যই কর্তব্য। এতে একদিকে যেমন উক্ত ব্যক্তির অন্তরে আরেকজনকে সাহায্য করার ব্যাপারে উৎসাহ সৃষ্টি হবে; অপরদিকে যিনি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলেন, তার প্রতিও একটা আন্তরিক টান বা মুহাববত সৃষ্টি হবে। এজন্য রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ صُنِعَ إِلَيْهِ مَعْرُوْفٌ فَقَالَ لِفَاعِلِهِ : جَزَاكَ اللهُ خَيْرًا، فَقَدْ أَبْلَغَ فِى الثَّنَاءِ. ‘কারো যদি উপকার করা হয় আর সে যদি উপকারকারীকে ‘জাযাকাল্লাহু খায়রান’ (আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন) বলে, তাহ’লে সে চূড়ান্ত প্রশংসা করল’।[11] তিনি আরো বলেন, مَنْ أُعْطِىَ عَطَاءً فَوَجَدَ فَلْيَجْزِ بِهِ، فَإِنْ لَّمْ يَجِدْ فَلْيُثْنِ بِهِ، فَمَنْ أَثْنَى بِهِ فَقَدْ شَكَرَهُ، وَمَنْ كَتَمَهُ فَقَدْ كَفَرَهُ. ‘কাউকে কোন কিছু দান করা হ’লে সে যদি তা পায় তাহ’লে যেন তার বিনিময় প্রদান করে। যদি প্রতিদান দেয়ার কিছু না পায়, তাহ’লে যেন দাতার প্রশংসা করে। কারণ যে দাতার প্রশংসা করল, সে তার শুকরিয়া আদায় করল এবং যে তা গোপন করল, সে তার প্রতি অকৃজ্ঞতা প্রকাশ করল’।[12]

তবে প্রশংসা করার ক্ষেত্রে কোন অবস্থাতেই বাড়াবাড়ি করা ঠিক হবে না। অতিমাত্রায় প্রশংসা করাকে খোশামোদ বা তোষামোদ বলে, যা নীচতা ও লজ্জাহীনতার নামান্তর। এর সাথে প্রচ্ছন্নরূপে মিথ্যা লুক্কায়িত থাকে। এহেন অতিমাত্রায় প্রশংসাকারী একসাথে তিন ধরনের গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ১. তোষামুদে লোকেরা নিজের মতলব হাছিলের জন্য এমন প্রশংসা করে, যা বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এটা নির্লজ্জ মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। ২. প্রশংসাকারী এমন প্রশংসাসূচক বাক্যাবলী উচ্চারণ করে, যার প্রতি সে নিজেও বিশ্বাসী নয়। এটা স্পষ্ট মুনাফেকী। ৩. এভাবে প্রশংসা করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজেকে অন্যের চোখে হেয় প্রতিপন্ন করে। এতে পারস্পরিক হৃদ্যতাও বিনষ্ট হয়। অপরদিকে এরূপ কাজে প্রশংসিত ব্যক্তির তিন ধরনের ক্ষতি হয়। ১. এর মাধ্যমে প্রশংসিত ব্যক্তির অন্তরে অহংকার পয়দা হয়, যা তার জন্য ক্ষতির কারণ ২. সে অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের নযরে দেখতে থাকে এবং ৩. সে সর্বক্ষণ অন্যের নিকট থেকে এরূপ প্রশংসাবাণী শুনার জন্য সদা উদ্গ্রীব থাকে। এধরনের নির্লজ্জ প্রশংসাকারীর পরিণাম সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

لاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ يَفْرَحُوْنَ بِمَا أَتَوْا وَّيُحِبُّوْنَ أَنْ يُّحْمَدُوْا بِمَا لَمْ يَفْعَلُوْا فَلاَ تَحْسَبَنَّهُمْ بِمَفَازَةٍ مِّنَ الْعَذَابِ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ.

‘যারা নিজেরা যা করেছে তাতে আনন্দ প্রকাশ করে এবং যারা নিজেরা যা করেনি এমন কাজের জন্যও প্রশংসিত হ’তে ভালবাসে, তারা শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে-এরূপ কখনও মনে কর না। তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি রয়েছে’ (আলে ইমরান ৩/১৮৮)। প্রশংসার বাড়াবাড়ি সম্পর্কে নিম্নের হাদীছটি প্রণিধানযোগ্য।

عَنْ أَبِىْ بَكْرَةَ قَالَ أَثْنَى رَجُلٌ عَلَى رَجُلٍ عِنْدَ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ وَيْلَكَ قَطَعْتَ عُنُقَ أَخِيْكَ ثَلاَثًا، مَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَّادِحًا لاَّ مَحَالَةَ فَلْيَقُلْ أَحْسِبُ فُلاَنًا وَّاللهُ حَسِيْبُهُ، إِنْ كَانَ يُرَى أَنَّهُ كَذَالِكَ وَلاَ يُزَكِّىْ عَلَى اللهِ أَحَدًا.

আবু বাক্রা (রাঃ) বলেন, একদা এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সম্মুখে অপর এক ব্যক্তির প্রশংসা করল। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, ‘তোমার অমঙ্গল হোক। তুমি তো তোমার ভাইয়ের গলা কেটে দিলে’। কথাটি তিনি তিনবার বললেন। তারপর বললেন, ‘যদি তোমাদের কেউ কারো প্রশংসা করতে চায়, সে যেন বলে, অমুককে আমি এরূপ মনে করি। তবে প্রকৃত অবস্থা আল্লাহই ভাল জানেন। যখন প্রকৃতভাবে বিশ্বাস করবে যে, ঐ ব্যক্তি এরূপ তখনই কেবল এরূপ বলবে। আর কারো পূত-পবিত্রতা বর্ণনায় আল্লাহ আ‘আলার উপর বাড়াবাড়ি করবে না’।[13] অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِىْ مُوْسَى، قَالَ: سَمِعَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ رَجُلاً يُثْنِيْ عَلَى رَجُلٍ، وَيُطْرِيْهِ فِى الْمِدْحَةِ فَقَالَ: لَقَدْ أَهْلَكْتُمْ، أَوْ قَطَعْتُمْ ظَهْرَ الرَّجُلِ. আবূ মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক ব্যক্তিকে অপর এক ব্যক্তির মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করতে শুনে বললেন, তোমরা তাকে ধ্বংস করে দিলে অথবা ব্যক্তিটির মেরুদন্ড ভেঙ্গে ফেললে’।[14] এরপরও কিছু মানুষ আছে যারা আপন স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষ্যে তোষামোদস্বরূপ অতিমাত্রায় প্রশংসা করে থাকে। এই প্রকৃতির লোক সম্পর্কেও ইসলামের বিধান নিম্নরূপ-

عَنْ مِقْدَادِ بْنِ الْأَسْوَدِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا رَأَيْتُمُ الْمَدَّاحِيْنَ فَاحْثُوْا فِىْ وُجُوْهِهِمُ التُّرَابَ.

মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন তোমরা অত্যধিক প্রশংসাকারীদেরকে দেখবে, তখন তাদের মুখে মাটি নিক্ষেপ করবে’।[15] সুতরাং কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ক্ষেত্রে কোন অবস্থাতেই শরী‘আতের সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না।

এছাড়াও কোন অজানা বিষয়ে জানতে চাইলে সুন্দরভাবে তার উত্তর দেওয়া, কোন অভিযোগ থাকলে যুক্তি ও প্রমাণ সহকারে তা খন্ডন করা, দ্বীনী ভাইয়ের প্রতি সর্বদা ক্ষমার মানসিকতা পোষণ করা, মাঝে-মধ্যে দাওয়াত করা, সময়-সুযোগ মত একত্রে বসে আহার করা, বন্ধুর মন-মানসিকতা বুঝে তার পসন্দনীয় কোন জায়গায় বেড়িয়ে আসা ইত্যাদির মাধ্যমে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি পায় ও সুদৃঢ় হয়।

ভ্রাতৃত্ব বিনষ্টের কারণসমূহ :

ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির যেমন বহুবিধ উপায় আছে, তেমনি ভ্রাতৃত্ব বিনষ্টেরও নানা কারণ রয়েছে। শয়তান মানব জাতির চিরশত্রু। সে কখনই চায় না মানুষ পরস্পর মিলেমিশে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এ ধরাপৃষ্ঠে শান্তিতে বসবাস করুক। শয়তানের মূল কাজই হ’ল ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া-ফাসাদ, বিবাদ-বিসম্বাদ লাগিয়ে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করা। তাই একজন মুসলমানকে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে শয়তান যেসব বিষয়ে কুমন্ত্রণা দিয়ে মানুষকে বিপথগামী করে এবং মুসলিম ভাইয়ের মধ্যে পারস্পরিক আন্তরিকতা বিনষ্ট করে, সেসব বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। নিম্নে ভ্রাতৃত্ব বিনষ্টের কিছু কারণ উল্লেখ করা হ’ল-

(ক) গীবত : ‘গীবত’ আরবী শব্দ, যার অর্থ পরনিন্দা, দোষ চর্চা ইত্যাদি। কোন ব্যক্তি সম্পর্কে তার অনুপস্থিতিতে এমন কথা বলা, যা শুনলে সে মনে কষ্ট পায় তাকে গীবত বলে। ইসলামী শরী‘আতে গীবত অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এর মাধ্যমে মানব মনে পারস্পরিক আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ঘটে, ফলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে ফাটল ধরে। কোন মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু কেউ চায় না যে, তার দোষ-ত্রুটি নিয়ে অন্যে তার অগোচরে সমালোচনায় লিপ্ত হেŠক। এর দ্বারা একদিকে যেমন সমালোচিত ব্যক্তি মনঃপীড়ায় দগ্ধ হয়, অনুরূপ সমালোচনাকারী সম্পর্কে তার হৃদয়ে ঘৃণার উদ্রেক হয়। পরিণামে পারস্পরিক আস্থা ও নির্ভরশীলতার সমুদ্রে ভাটার টান পড়ে। পবিত্র কুরআনে গীবতকে আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, وَلاَ يَغْتَبْ بَّعْضُكُمْ بَعْضاً أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَّأْكُلَ لَحْمَ أَخِيْهِ مَيْتاً فَكَرِهْتُمُوْهُ، وَاتَّقُوَا اللهَ إِنَّ اللهََ تَوَّابٌ رَّحِيْمٌ. ‘আর তোমরা একে অপরের গীবত কর না। তোমরা কি কেউ আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পসন্দ কর? অবশ্যই তা ঘৃণা করবে। আর তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর, নিশ্চয়ই তিনি তওবা কবুলকারী ও দয়ালু’(হুজুরাত ৪৯/১২)। গীবতের পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ আরো বলেন, وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ. ‘দুর্ভোগ সম্মুখে ও পশ্চাতে লোকের নিন্দাকারীদের’ (হুমাযাহ ১০৪/১)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও গীবতের বিভিন্ন দিক ও ধরন উল্লেখপূর্বক এর ভয়াবহ পরিণতি এবং এ থেকে বেঁচে থাকার জন্য ছাহাবায়ে কেরামকে কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করে গেছেন। যেমন-

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ أ َتَدْرُوْنَ مَا الْغِيْبَةُ قَالُوْا اَللهُ وَ رَسُوْلُهُ أَعْلَمُ، قَالَ ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ، قِيْلَ أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِىْ أَخِىْ مَا أَقُوْلُ، قَالَ إِنْ كَانَ فِيْهِ مَا تَقُوْلُ فَقَدِ اغْتَبْتَهُ وَإِنْ لَّمْ يَكُنْ فِيْهِ مَا تَقُوْلُ فَقَدْ بَهَتَّهُ.

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবীদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জান গীবত কি? তাঁরা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক জানেন। তখন তিনি বললেন, তোমার কোন ভাই সম্পর্কে তার অগোচরে এমন কথা বলা যা সে অপসন্দ করে। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, আমি যা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তাহ’লে? তখন তিনি বললেন, তুমি যা বল তা যদি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তাহ’লে তুমি তার গীবত করলে। আর তুমি যা বল তা যদি তার মধ্যে না থাকে, তবে তুমি তার নামে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করলে’।[16] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ أَكَلَ بِرَجُلٍ مُسْلِمٍ أَكْلَةً فَإِنَّ اللهَ يُطْعِمُهُ مِثْلَهَا مِنْ جَهَنَّمَ. ‘যে ব্যক্তি কোন মুসলিম ভাইয়ের একবার গোশত ভক্ষণ (গীবত) করবে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে তার অনুরূপ শাস্তি আস্বাদন করাবেন’।[17]

অন্য হাদীছে এসেছে,إِنَّ مِنْ أَرْبَىْ الرِّبَا الْاِسْتِطَالَةَ فِىْ عِرْضِ الْمُسْلِمِ بِغَيْرِ حَقٍّ. ‘সবচেয়ে জঘন্য সূদ হচ্ছে অন্যায়ভাবে মুসলিম ভাইয়ের মর্যাদাহানী (গীবত) করা’।[18]

সুতরাং কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে তার দোষ-ত্রুটি তার অবর্তমানে অন্যের নিকটে বলে বেড়ানো মারাত্মক গোনাহের কাজ। এর মাধ্যমে পারস্পরিক বন্ধুতব নষ্ট হয়, সামাজিক ঐক্যে ফাটল ধরে।

(খ) অশালীন কথাবার্তা বলা : মানুষের মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হ’ল ভাষা। যা নিসৃত হয় মুখ দিয়ে। ভাষা তথা কথার মাধ্যমে যেমন পরস্পর বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়, তেমনি কথার দ্বারাই মানুষে মানুষে শত্রুতা সৃষ্টি হয়। কথা বলার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে জিহবা। সেই অর্থে মানব দেহের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জিহবার উপর নির্ভরশীল। এ প্রসঙ্গে হাদীছের বাণী নিম্নরূপ-

عَنْ أَبِىْ سَعِيْدٍ رَفَعَهُ قَالَ إِذَا أَصْبَحَ ابْنُ آدَمَ فَإِنَّ الْأَعْضَاءَ كُلَّهَا تُكَفِّرُ اللِّسَانَ فَتَقُوْلُ إِتَّقِ اللهَ فِيْنَا فَإِنَّا نَحْنُ بِكَ فَإِنِ اسْتَقَمْتَ اِسْتَقَمْنَا وَإِنِ اعْوَجَجْتَ اِعْوَجَجْنَا.

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘যখন আদম সন্তান ভোরে উঠে তখন তার অঙ্গসমূহ জিহবাকে বিনয়ের সাথে বলে, আমাদের সম্পর্কে আল্লাহকে ভয় কর। কেননা আমরা সবাই তোমার সাথে জড়িত। সুতরাং তুমি ঠিক থাকলে আমরাও ঠিক থাকব। আর তুমি বাঁকা হ’লে আমরাও বাঁকা হয়ে পড়ব’।[19] এজন্যই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ يَّضْمَنْ لِىْ مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الْجَنَّةَ. ‘যে ব্যক্তি আমাকে তার জিহবা ও লজ্জাস্থানের হেফাযতের গ্যারান্টি দিবে, আমি তার জন্য জান্নাতের গ্যারান্টি দিব’।[20]

অশ্লীলতা দু’ভাবে হ’তে পারে। ১. কথার মাধ্যমে এবং ২. কর্ম বা আচরণের মাধ্যমে। উভয় প্রকার অশ্লীলতাই সর্বৈব অপসন্দনীয় এবং নিন্দনীয়। অশ্লীল ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ)-এর ঘোষণা সু্স্পষ্ট। তিনি বলেন,

لَيْسَ الْمُؤْمِنُ بِالطَّعَّانِ وَلاَ اللَّعَّانِ وَلاَ الْفَاحِشِ وَلاَ الْبَذِىءِ.

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘উদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মুমিন ব্যক্তি ঠাট্টা-বিদ্রূপকারী, ভৎর্সনাকারী, লা‘নতকারী, অশ্লীলভাষী ও বদ-স্বভাবের হ’তে পারে না’।[21] এরূপ স্বভাবের ব্যক্তিকে কেউ পসন্দ করে না। এমনকি মহান আল্লাহও তাদের ঘৃণা করেন। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِى الدَّرْدَاءِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِنَّ اللهَ يَبْغَضُ الْفَاحِشَ الْبَذِىءَ.

আবুদ দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা অশ্লীলভাষী, নির্লজ্জ ইতরকে ঘৃণা করে থাকেন’।[22] অপর হাদীছে আছে-

وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا كَانَ الْفُحْشُ فِىْ شَىْءٍ اِلاَّ شَانَهُ، وَمَا كَانَ الْحَيَاءُ فِىْ شَىْءٍ اِلاَّ زَانَهُ.

আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘অশ্লীলতা যে কোন বস্ত্তকে কলুষিত করে দেয় এবং লজ্জাশীলতা কোন বস্ত্তকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে’।[23] তিনি আরো বলেন,

إِنَّ الرَّجُلَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنَ الْخَيْرِ مَا يَعْلَمُ مَبْلَغَهَا يَكْتُبُ اللهُ لَهُ بِهَا رِضْوَانَهُ إِلَى يَوْمِ يَّلْقَاهُ وَ إِنَّ الرَّجُلَ لَيَتَكَلَّمُ باِلْكَلِمَةِ مِنَ الشَّرِّ مَا تَعْلَمُ مَبْلَغَهَا يَكْتُبُ اللهُ بِهَا عَلَيْهِ سُخْطَهُ إِلَىْ يَوْمِ يَّلْقَاهُ.

‘কোন ব্যক্তি উত্তম কথা বলে, কিন্তু সে তার মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত নয়। তার জন্য আল্লাহ তাঁর সাথে সাক্ষাৎ লাভের দিন পর্যন্ত নিজের সন্তুষ্টি লিখে রাখেন। আবার কোন বান্দা মন্দ কথা বলে, কিন্তু সে জানে না যে, উক্ত কথা তাকে কোথায় পৌঁছাবে। তার জন্য আল্লাহ তাঁর সাথে সাক্ষাৎ লাভের দিন পর্যন্ত নিজের অসন্তুষ্টি লিখে রাখেন’।[24]

রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন,إِنَّ الْعَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مَا يَتَبَيَّنُ فِيْهَا يَزِلُّ بِهَا إِلَى النَّارِ أَبْعَدَ مِمَّا بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ. ‘বান্দা যখন ভালমন্দ বিচার না করেই কোন কোন কথা বলে, তখন তার কারণে সে নিজেকে জাহান্নামের এতদূর গভীরে নিয়ে যায়, যা পূর্ব ও পশ্চিমের দূরত্বের সমান’।[25] তিনি আরো বলেন, إِنَّ الرَّجُلَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ سُخْطِ اللهِ لاَيَرَى بِهَا بَأْسًا فَيَهْوِىْ بِهَا فِىْ نَارِ جَهَنَّمَ سَبْعِيْنَ خَرِيْفًا. ‘যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর অসন্তুষ্টিসূচক কোন কথা বলে আর তাকে কিছুই মনে করে না, তাহ’লে সেজন্য তাকে জাহান্নামের আগুনে সত্তর বছরের দূরত্বে নিক্ষেপ করা হবে’।[26] তাই না বুঝে বা ভালমন্দ বিচার-বিশ্লেষণ না করে কোন কথা বলা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হ’তে পারে।

অশ্লীল কথাবার্তা খারাপ চরিত্রের লক্ষণ। কাম-প্রবৃত্তি তাড়িত হয়ে মানুষ সাধারণত অশ্লীল কথা বলে থাকে। আবার ক্রোধের বশবর্তী হয়েও মানুষ এধরনের অশালীন কথাবার্তা বলে থাকে। ইসলামী শরী‘আতে অশালীন ও অশ্লীল কথাবার্তা বলা নিষিদ্ধ। এহেন ঘৃণ্য কর্মে যারা অভ্যস্ত নিরীহ জনসাধারণ তাদেরকে অন্তর থেকে ঘৃণা করে এবং পারতপক্ষে তাদেরকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। কেননা আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَىْ عَائِشَةُ! إِنَّ شَرَّ النَّاسِ مَنْ تَرَكَهُ النَّاسُ- أَوْ وَدَعَهُ النَّاسُ- اِتِّقَاءَ فُحْشِهِ. ‘হে আয়েশা! নিকৃষ্টতম লোক হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যাকে তার অশ্লীলতার জন্য লোকে পরিত্যাগ করে বা বর্জন করে’।[27] তাই আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং মানুষের ভালবাসা প্রাপ্তি এবং পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় রাখার লক্ষ্যে প্রত্যেক মুমিনের সকল প্রকার অশ্লীলতা পরিহার করা অত্যন্ত যরূরী। একদা কতিপয় ইহুদী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে এসে বলল, ‘আস-সামু আলায়কুম’- ‘তোমার মৃত্যু হোক’। আয়েশা (রাঃ) তখন বলেন, তোমাদেরই মৃত্যু হোক। আল্লাহ তোমাদের উপর লা‘নত করুন এবং তোমাদের উপর ক্রদ্ধ হোন। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, مَهْلاً يَا عَائِشَةُ، عَلَيْكِ بِالرِّفْقِ، وَإِيَّاكِ وَالْعُنْفَ وَالْفُحْشَ. ‘থাম হে আয়েশা! তোমার নম্রতা অবলম্বন করা উচিত। রূঢ়তা ও অশ্লীলতা থেকে বেঁচে থাক’।[28]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ. ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস পোষণ করে সে যেন ভাল কথা বলে অথবা চুপ থাকে’।[29]

অশ্লীলতা পরিহার করে ভাল কথা বলার ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ فِى الْجَنَّةِ غُرَفًا تُرَى ظُهُوْرُهَا مِنْ بُطُوْنِهَا وَبُطُوْنُهَا مِنْ ظُهُوْرِهِا. ‘জান্নাতে এমন কতগুলো ঘর রয়েছে যার বহির্দেশ ভিতর থেকে এবং অভ্যন্তরভাগ বাইরে থেকে দেখা যাবে’। একজন বেদুঈন একথা শুনে জিজ্ঞেস করল, সেগুলো কার জন্য হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, لِمَنْ أَطَابَ الْكَلاَمَ، وَأَطْعَمَ الطَّعَامَ، وَأَدَامَ الصِّيَامَ، وَصَلَّى بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ. ‘যে ভাল কথা বলে, (দরিদ্রদের) খাদ্য দান করে, ধারাবাহিকভাবে ছিয়াম পালন করে এবং মানুষ তন্দ্রাবিভোর থাকা অবস্থায় রাতের গভীর নির্জনতায় ছালাত আদায় করে তার জন্য’।[30]

(গ) মিথ্যা কথা বলা : মিথ্যাবাদী ব্যক্তি মাত্রই সমাজে নিন্দিত, ঘৃণিত ও উপেক্ষিত। মানুষ পারতপক্ষে এ ধরনের ব্যক্তি থেকে সর্বদা দূরে থাকার চেষ্টা করে। কেননা মিথ্যাবাদীর সাথে চলাফেরা বা তাকে অনুসরণ করতে স্বয়ং আল্লাহই নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, فَلاَ تُطِعِ الْمُكَذِّبِيْنَ ‘আর তোমরা মিথ্যাবাদীদেরকে অনুসরণ কর না’ (কালাম ৬৮/৮)

সত্য ও মিথ্যার সুফল ও কুফল উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

عَلَيْكُمْ بِالصِّدْقِ فَإِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِىْ إِلَىْ الْبِرِّ وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِىْ إِلَى الْجَنَّةِ وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَصْدُقُ وَيَتَحَرَّى الصِّدْقَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ صِدِّيْقًا، وَإِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ فَإِنَّ الْكَذِبَ يَهِدِىْ إِلَىْ الفُجُوْرِ وَإِنَّ الْفُجُوْرَ يَهْدِىْ إِلَى النَّارِ وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَكْذِبُ وَيَتَحَرَّى الْكَذِبَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ كَذَّابًا.

‘তোমরা সত্যকে আঁকড়ে ধর। কেননা সত্য পুণ্যের পথ দেখায়। আর পুণ্য জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। আর যে ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বলে এবং সত্য বলতে চেষ্টা করে, আল্লাহর কাছে তাকে ‘ছিদ্দীক্ব’ বলে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর তোমরা মিথ্যা হ’তে বেঁচে থাক। কেননা মিথ্যা পাপাচারের পথে নিয়ে যায় এবং পাপাচার জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। যে ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা কথা বলে এবং মিথ্যা বলতে চেষ্টা করে, আল্লাহর দরবারে তাকে ‘কাযযাব’ (মহা মিথ্যাবাদী) বলে লিপিবদ্ধ করা হয়’।[31]

আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, সর্বোত্তম ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, كُلُّ مَخْمُوْمِ الْقَلْبِ، صَدُوْقُ اللِّسَانِ، قَالُوْا: صَدُوْقُ اللِّسَانِ نَعْرِفُهُ، فَمَا مَخْمُوْمُ الْقَلْبِ؟ قَالَ: هُوَ التَّقِىُّ النَّقِىُّ، لاَ إِثْمَ فِيْهِ وَلاَ بَغْىَ وَلاَ غِلَّ وَلاَ حَسَدَ. ‘প্রত্যেক ‘মাখমূমুল ক্বলব’ ও সত্যবাদী। ছাহাবীগণ বললেন, সত্যবাদীকে আমরা জানি। কিন্তু ‘মাখমূমুল ক্বলব’ কে? তিনি বললেন, সে হচ্ছে মুত্তাক্বী ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি। তার মধ্যে কোন পাপ নেই, সীমালংঘন নেই এবং হিংসা-বিদ্বেষ নেই’।[32]

মিথ্যা কথা বলা মুনাফিকের লক্ষণ। যেমন হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ آيَةُ الْمُنَافِق ثَلاَثٌ، إِذَا حَدَّثَ كَذِبَ وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ.

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘মুনাফেকের লক্ষণ তিনটি। যখন সে কথা বলে, মিথ্যা বলে, যখন ওয়াদা করে খেলাপ করে এবং যখন আমানত রাখা হয় তখন খেয়ানত করে’।[33]

অনেকে নিতান্ত ঠাট্টা বা রসিকতার ছলে মিথ্যা বলে থাকে। কিন্তু ইসলামী শরী‘আতে তারও কোন অনুমোদন নেই; বরং তা আত্মবিধ্বংসী কাজ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَيْلٌ لِّمَنْ يُّحَدِّثُ فَيَكْذِبُ لِيُضْحِكَ بِهِ الْقَوْمَ وَيْلٌ لَّهُ وَيْلٌ لَّهُ. ‘সে ব্যক্তির জন্য ধ্বংস যে কথা বলে এবং জনতাকে হাসানোর জন্য মিথ্যা কথা বলে। তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধ্বংস’।[34] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَنَا زَعِيْمٌ بِبَيْتٍ فِىْ رَبَضِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْمِرَاءَ وَإِنْ كَانَ مُحِقًّا، وَبِبَيْتٍ فِىْ وَسَطِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْكَذِبَ وَإِنْ كَانَ مَازِحًا، وَبِبَيْتٍ فِىْ أَعْلَى الْجَنَّةِ لِمَنْ حَسَّنَ خُلُقَهُ. ‘যে ব্যক্তি ন্যায়ের ওপর থাকা সত্ত্বেও ঝগড়া-ফাসাদ পরিহার করে তার জন্য জান্নাতের এক প্রান্তের একটি ঘরের আমি নেতা হব, কৌতুকচ্ছলে হ’লেও যে মিথ্যা পরিহার করে তার জন্য জান্নাতের মাঝখানের একটি ঘরের আমি নেতা হব এবং চরিত্রবান ব্যক্তির জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানের একটি ঘরের আমি নেতা হব’।[35] হযরত সামুরা ইবনু জুনদুব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীছে এক রাতের স্বপ্নের বিবরণ দিতে গিয়ে এক পর্যায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

... فَأَتَيْنَا عَلَى رَجُلٍ مُسْتَلْقٍ لِقَفَاهُ وَإِذَا آخَرُ قَائِمٌ عَلَيْهِ بِكَلُوْبٍ مِّنْ حَدِيْدٍ وَإِذَا هُوَ يَأْتِىْ أَحَدَ شِقَّىْ وَجْهِهِ فَيُشَرْشِرُ شِدْقَهُ إِلَى قَفَاهُ وَمَنْخِرَهُ إِلَى قَفَاهُ، وَعَيْنَهُ إِلَى قَفَاهُ ثُمَّ يَتَحَوَّلُ إِلَى الْجَانِبِ الْآخَرِ فَيَفْعَلُ بِهِ مِثْلَ مَا فَعَلَ بِالْجَانِبِ الْأَوَّلِ، فَمَا يَفْرُغُ مِنْ ذَالِكَ الْجَانِبِ حَتَّى يَصِحَّ ذَالِكَ الْجَانِبُ كَمَا كَانَ ثُمَّ يَعُوْدُ عَلَيْهِ فَيَفْعَلُ مِثْلَ مَا فَعَلَ فِىْ الْمَرَّةِ الْأُُوْلَى... فَاِنَّهُ الرَّجُلُ يَغْدُوْ مِنْ بَيْتِهِ فَيَكْذِبُ الْكَذْبَةَ تَبْلُغُ الْاَفَاقَ.

... আমরা এক ব্যক্তির কাছে পৌঁছলাম। সে ঘাড় বাঁকা করে শুয়ে আছে। অপর ব্যক্তি তার কাছে লোহার আঁকড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার চেহারার এক দিক হ’তে মাথা, নাক ও চোখকে ঘাড় পর্যন্ত চিরে ফেলছে। পুনরায় তার মুখমন্ডলের অপর দিক দিয়েও প্রথম দিকের মত মাথা, নাক ও চোখ ঘাড় পর্যন্ত চিরছে। চেহারার দ্বিতীয় পার্শ্বের চেরা শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রথম পার্শ্ব পূর্ববৎ ঠিক হয়ে যাচ্ছে। পুনরায় লোকটি এপাশে এসে আবার আগের মত চিরছে। এ হচ্ছে সে ব্যক্তি যে সকাল বেলা ঘর হ’তে বের হয়েই এমন সব মিথ্যা কথা বলত, যা সাধারণ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ত’।[36]

উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, দুনিয়া ও আখেরাত উভয় ক্ষেত্রেই মিথ্যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। দুনিয়াবী জীবনে যেমন মিথ্যাবাদী ব্যক্তিকে কেউ পসন্দ করেন না, অনুরূপ পরকালেও এর জন্য চরম লাঞ্ছনার শিকার হ’তে হবে। অতএব এ বিষয়ে আমাদের আরো সাবধান হ’তে হবে।

(ঘ) অহেতুক কু-ধারণা করা : প্রমাণ ব্যতিরেকে কোন মুসলমান সম্পর্কে কু-ধারণা বা অহেতুক খারাপ ধারণা পোষণ করা অন্যায়। ধারণাভিত্তিক বলা ও চলা অধিকাংশ বিভ্রান্তি ও বিবাদের মূল কারণ। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের বর্ণনা মতে ধারণা করে কথা বলা বা ধারণার অনুসরণ করা ইহুদী-নাছারা তথা বিধর্মী বা বেদ্বীনদের কাজ। কোন হক্বপন্থী মুসলমানের স্রেফ ধারণার উপর ভিত্তি করে কিছু বলা বা করা সমীচীন নয়। মহান আল্লাহ মুশরিকদের স্বভাব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, إِنْ يَتَّبِعُوْنَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَخْرُصُوْنَ. ‘তারা তো শুধু ধারণারই অনুসরণ করে এবং তারা শুধু মিথ্যাই বলে’ (ইউনুস ১০/৬৬)। তিনি আরো বলেন,وَمَا يَتَّبِعُ أَكْثَرُهُمْ إِلاَّ ظَنًّا إِنَّ الظَّنَّ لاَ يُغْنِيْ مِنَ الْحَقِّ شَيْئاً. ‘তারা অধিকাংশ অনুমানেরই অনুসরণ করে। কিন্তু সত্যের বিপরীতে অনুমানের কোন মূল্য নেই’ (ইউনুস ১০/৩৬)। এবিষয়ে মহান আল্লাহ স্বয়ং তাঁর নবীকে সতর্ক করে বলেন, وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوْكَ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ إِنْ يَتَّبِعُوْنَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَخْرُصُوْنَ. ‘যদি তুমি দুনিয়ার অধিকাংশ লোকের কথামত চল, তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তারা তো শুধু ধারণার অনুসরণ করে এবং অনুমানভিত্তিক কথা বলে’ (আন‘আম ৬/১১৬)। বিশেষ করে কোন ব্যক্তি সম্পর্কে না বুঝে বা না শুনে কু-ধারণা করা মহা পাপ, যা কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اجْتَنِبُوْا كَثِيْراً مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ.

‘হে মুমিনগণ! তোমরা অধিক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয়ই কতক ধারণা পাপ’ (হুজুরাত ৪৯/১২)। একই ভাবে হাদীছে এসেছে-

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيْثِ.

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা অহেতুক ধারণা থেকে দূরে থাক। কেননা ধারণা জঘন্যতম মিথ্যা’।[37]

কোন ব্যক্তি যখন কারো সম্পর্কে নিছক অনুমানের উপর ভিত্তি করে কোন বিষয়ে সন্দেহ করে, তখন তাদের মধ্যে আস্থা ও নির্ভরশীলতা কমে যায়। ফলে মনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। যা কোন মুসলমানের জন্য কাম্য নয়। তাই অহেতুক কু-ধারণা থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেক মুমিনের অবশ্য কর্তব্য।

 [চলবে]


[1]. আবুদাঊদ হা/৪৯১৯, তিরমিযী হা/২৬৪০, হাদীছ ছহীহ

[2]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪৮২৫, ৫০৩১ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়।

[3]. তিরমিযী হা/১৯৩৯, হাদীছ ছহীহ

[4]. তিরমিযী; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/২৫৬, হাদীছ ছহীহ।

[5]. আবূদাঊদ হা/৪৯১৮; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৯২৬, হাদীছ হাসান।

[6]. আবূদাউদ, তিরমিযী হা/২৩৯২, মিশকাত হা/৫০১৬, হাদীছ ছহীহ।

[7]. আবুদাঊদ হা/৪৯৬২, ইবনু মাজাহ হা/৩৭৪১, হাদীছ ছহীহ ‘লকব’ অনুচ্ছেদ

[8]. খুররম জাহ্ মুরাদ, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক (ঢাকা : ১৯৯৯), পৃঃ ৯০।

[9]. ইবনু মাজাহ হা/৩৮০৫, হাদীছ হাসান

[10]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪২০০; বঙ্গানুবাদ রিয়াযুছ ছালেহীন, হা/১৩৯৭ ‘আল্লাহর প্রশংসা’ অধ্যায়।

[11]. তিরমিযী হা/২০৩৫, হাদীছ ছহীহ, ‘ভাল কাজের প্রশংসা’ অনুচ্ছেদ।

[12]. আবূদাঊদ হা/৪৮১৩, হাদীছ হাসান, ‘ভাল কাজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ’ অনুচ্ছেদ।

[13]. মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত, হা/৪৮২৭।

[14]. বুখারী হা/২৬৬৩; মুসলিম হা/৩০০১

[15]. মুসলিম, মিশকাত, হা/৪৮২৬।

[16]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪৮২৮।

[17]. আবুদাঊদ হা/৪৮৮১, ‘গীবত’ অনুচ্ছেদ, হাদীছ ছহীহ

[18]. আবূদাঊদ হা/৪৮৭৬, ‘গীবত’ অনুচ্ছেদ, হাদীছ ছহীহ

[19]. তিরমিযী হা/২৪০৭, মিশকাত, হা/৮৩৮, হাদীছ হাসান।

[20]. বুখারী হা/৬৪৭৪

[21]. তিরমিযী হা/১৯৭৭, মিশকাত হা/৪৮৪৭, হাদীছ ছহীহ।

[22]. তিরমিযী হা/২০০২, মিশকাত হা/১৯৪৭, হাদীছ ছহীহ।

[23]. তিরমিযী হা/১৯৭৪, মিশকাত হা/৪৮৫৪, হাদীছ ছহীহ।

[24]. মওয়াত্ত্বা মালেক, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ হা/৩৯৬৯, শরহে সুন্নাহ, মিশকাত, হা/৪৮৩৩, হাদীছ ছহীহ।

[25]. মুত্তাফাক আলাইহ, বঙ্গানুবাদ রিয়াযুছ ছালেহীন, হা/১৫১৪, ‘গীবত ও পরনিন্দা নাযায়েয’ অধ্যায়।

[26]. ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭০, হাদীছ ছহীহ

[27]. বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী হা/১৯৯৬, আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/১৩১১।

[28]. বুখারী হা/৬০৩০ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩৮

[29]. বুখারী হা/৬৪৭৫

[30]. তিরমিযী হা/১৯৮৪, হাদীছ হাসান

[31]. মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/৪৮২৪

[32]. ইবনু মাজাহ হা/৪২১৬, হাদীছ ছহীহ

[33]. মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/৫৫।

[34]. আহমাদ, তিরমিযী হা/২৩১৫, আবুদাউদ হা/৪৯৯০, দারেমী, মিশকাত হা/৪৮৩৪, হাদীছ হাসান।

[35]. আবূদাঊদ হা/৪৮০০, সিলসিলা ছহীহা হা/২৭৩, হাদীছ ছহীহ

[36]. বুখারী হা/৭০৪৭, ‘স্বপ্নের ব্যাখ্যা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৮।

[37]. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৫০২৮।






বিষয়সমূহ: নীতি-নৈতিকতা
মাদ্রাসার পাঠ্যবই সমূহের অন্তরালে - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হাদীছের অনুবাদ ও ভাষ্য প্রণয়নে ভারতীয় উপমহাদেশের আহলেহাদীছ আলেমগণের অগ্রণী ভূমিকা (২য় কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
মানব জাতির সাফল্য লাভের উপায় (৪র্থ কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
মানব সৃষ্টির ইতিহাস - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
এক নযরে হজ্জ - আত-তাহরীক ডেস্ক
এক নযরে হজ্জ
ওযূর আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ)-এর সাথে একটি শিক্ষণীয় বিতর্ক - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
আহলেহাদীছ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম (৬ষ্ঠ কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
নববী চিকিৎসা পদ্ধতি - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ইসলামে ভ্রাতৃত্ব (শেষ কিস্তি) - ড. এ এস এম আযীযুল্লাহ
আরও
আরও
.