ভূমিকা : রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রামাযান। এ মাসে মুমিন-মুত্তাক্বী নেকীর ডালি ভরে নেয় এবং পাপ- পঙ্কিলতা হ’তে মুক্ত হয়। মুমিন জীবনে এ মাস এক অনন্য সুযোগ, যাতে সে ছিয়াম, ক্বিয়াম, ছালাত, যিকির-আযকার, তাসবীহ-তেলাওয়াত, দান-ছাদাক্বা ইত্যাদির মাধ্যমে দিন-রাত অতিবাহিত করতে পারে। নীল আকাশে রামাযানের নতুন চাঁদ উঠার সাথে সাথে মুমিন হৃদয়ে যেন এক নতুন স্রোত প্রবাহিত হয়, যাতে সে যাবতীয় পাপ ছেড়ে ছওয়াব অর্জনের প্রচেষ্টায় মশগূল হয়। আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য হাছিলে হয় তৎপর। কিন্তু দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, রামাযানের গুরুত্ব ও মাহাত্ম না জানার কারণে মুসলমান হয়েও আমাদের অনেকেরই রামাযান আশানুরূপ ভালো কাজে কাটে না। বরং হেলায়-খেলায় ও পাপ-পঙ্কিলতায় জীবন অতিবাহিত হয় শয়তানের পথে। আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা রামাযানকে সুন্দরভাবে অতিবাহিত করার কিছু দিক তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।-
১. পূর্বপ্রস্ত্ততি গ্রহণ করা : যে কোন ভালো কাজ পূর্ব প্রস্ত্ততি ছাড়া সুচারুরূপে সম্পাদন করা সম্ভব হয় না। তাই তাক্বওয়া অর্জনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মাস রামাযান ভালোভাবে অতিবাহিত করার জন্য বিশেষ প্রস্ত্ততি প্রয়োজন। সালাফে ছালেহীন রামাযান আগমনের ছয় মাস পূর্ব থেকে দো‘আ করতেন, যেন রামাযানের ইবাদত তাঁরা ভালোভাবে করতে পারেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), ছাহাবীগণ ও সালাফে ছালেহীন শা‘বান মাসে অধিক ছিয়াম পালনের মাধ্যমে রামাযানের প্রস্ত্ততি নিতেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, وَمَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اسْتَكْمَلَ صِيَامَ شَهْرٍ قَطُّ إِلاَّ رَمَضَانَ وَمَا رَأَيْتُهُ فِى شَهْرٍ أَكْثَرَ مِنْهُ صِيَامًا فِى شَعْبَانَ- وَفِى رِوَايَةٍ عَنْهَا : كَانَ يَصُومُ شَعْبَانَ إِلاَّ قَلِيلاً، ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে রামাযান ব্যতীত অন্য মাসে শা‘বানের ন্যায় এত অধিক ছিয়াম পালন করতে দেখিনি। তাঁর থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ছাঃ) পূর্ণ শা‘বান মাস ছিয়াম রাখতেন কয়েক দিন ব্যাতীত’।[1] তাই আমাদের উচিত রামাযানের আগের মাস হিসাবে শা‘বান মাসে রামাযানের প্রস্ত্ততির জন্য সুন্নাত হিসাবে অধিকহারে ছিয়াম পালন করা। তবে শবেবরাতের নিয়তে নয়। কেননা শবেবরাত কোন ইসলামী পর্ব নয়।
২. সঠিক নিয়তে ছিয়াম পালন : মুমিনগণ তাদের সকল সৎকর্মে স্রেফ আল্লাহর নিকটে ছওয়াব ও পুরস্কার কামনা করে। পৃথিবীতে যে কোন সৎ আমলই আমরা করি না কেন, তাতে যদি ছওয়াবের আকাঙ্ক্ষা না থাকে, তাহ’লে তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে না। তেমনি রামাযানে ছিয়াম পালন ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে হ’তে হবে। অন্যথা তা গৃহীত হবে না। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ومَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ، ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রামাযানের ছিয়াম পালন করে, তার বিগত সকল গোনাহ মাফ করা হয় এবং যে ব্যক্তি রামাযানের রাত্রিতে ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রাত্রির ছালাত তথা তারাবীহর ছালাত আদায় করে, তার বিগত সকল (ছগীরা) গোনাহ মাফ করা হয়’।[2]
৩. ফরয ছালাত জামা‘আতে আদায় করা : রামাযানে অধিক কল্যাণ লাভের অন্যতম মাধ্যমে হল- পাঁচ ওয়াক্ত ফরয ছালাত জামা‘আতের সাথে আদায় করা। কেননা একাকী ছালাত আদায়ের চাইতে জামা‘আতে আদায় করলে ২৫ বা ২৭ গুণ বেশী নেকী পাওয়া যাবে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ঘরে অথবা বাজারে একাকী ছালাতের চেয়ে মসজিদে জামা‘আতে ছালাত আদায়ে ২৫ বা ২৭ গুণ ছওয়াব বেশী’। তিনি বলেন, ‘দুই জনের ছালাত একাকীর চাইতে উত্তম। ...এভাবে জামা‘আত যত বড় হয়, নেকী তত বেশী হয়’।[3]
৪. তারাবীহর ছালাত জামা‘আতে আদায় করা : রামাযানে নেকীর পাল্লা ভারী করার একটি উল্লেখ্যযোগ্য ইবাদত হ’ল ক্বিয়ামুল লায়ল বা তারাবীহর ছালাত। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ، ‘যে ব্যক্তি রামাযান মাসে ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় ক্বিয়ামুল লায়ল আদায় করবে, তার পূর্বের সকল পাপ ক্ষমা করা হবে’।[4] আল্লাহর কাছ থেকে জীবনের সকল গুনাহ মাফ করিয়ে নেওয়ার এক সুবর্ণ সুযোগ তারাবীহর ছালাত। যারা নেকীর আশায় এটি আদায় করবে তারাই এ সৌভাগ্যের অধিকারী হবে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, أَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ صَلاَةُ اللَّيْلِ، ‘ফরয ছালাতের পরে সর্বোত্তম ছালাত হ’ল রাত্রির (নফল) ছালাত’। এখানে ‘রাত্রির ছালাত’ বলতে তারাবীহ বা তাহাজ্জুদ দু’টিকেই বুঝানো হয়েছে। কেননা রাসূল (ছাঃ) এক রাতে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ দু’টিই পড়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। যদিও দু’টির প্রকৃতি ভিন্ন। অর্থাৎ তারাবীহ প্রথম রাতে একাকী বা জামা‘আত সহ পড়া হয়। কিন্তু তাহাজ্জুদ শেষ রাতে পড়া হয়। আর তারাবীহ রামাযানে পড়া হয়। কিন্তু তাহাজ্জুদ সারা বছর পড়া হয়’।[5]
উল্লেখ্য যে, তাহাজ্জুদ, তারাবীহ, ক্বিয়ামুল লায়ল, ক্বিয়ামু রামাযান সবকিছুকে এক কথায় ‘ছালাতুল লায়ল’ বা ‘রাত্রির (নফল) ছালাত’ বলা হয়। ক্বিয়ামুল লায়ল আদায় করা পূর্ববর্তী নেককার বান্দাদের চিরায়ত অভ্যাস ছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,عَلَيْكُمْ بِقِيَامِ اللَّيْلِ؛ فَإِنَّهُ دَأَبُ الصَّالِحِينَ قَبْلَكُمْ، وَهُوَ قُرْبَةٌ إِلَى رَبِّكُمْ، وَمَكْفَرَةٌ لِلسَّيِّئَاتِ، وَمَنْهَاةٌ لِلْإِثْمِ، ‘তোমরা অবশ্যই রাতের ইবাদত করবে। কেননা এটা তোমাদের পূর্ববর্তী সৎকর্মশীল বান্দাদের অভ্যাস, আর এটা তোমাদের রবের নৈকট্য লাভের উপায়, গুনাহসমূহের কাফফারা এবং পাপের প্রতিবন্ধক’।[6]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই ছালাতকে এত বেশী গুরুত্ব দিতেন যে, তিনি কখনো তা পরিত্যাগ করতেন না। যদি অসুস্থ থাকতেন তবে বসে হ’লেও ক্বিয়ামুল লায়ল আদায় করতেন। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন,لَا تَدَعْ قِيَامَ اللَّيْلِ فَإِنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ لَا يَدَعُهُ وَكَانَ إِذَا مَرِضَ أَوْ كَسِلَ صَلَّى قَاعِدًا، ‘তুমি ক্বিয়ামুল লায়ল পরিত্যাগ করো না। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কখনো এটা ছাড়তেন না। তিনি অসুস্থ থাকলে বা অলসতা লাগলে বসে হ’লেও ক্বিয়ামুল লায়ল আদায় করে নিতেন’।[7] ছাহাবায়ে কেরাম জামা‘আতের সাথে তারাবীহ শেষ না করে বাড়ী ফিরতেন না।[8] কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّهُ مَنْ قَامَ مَعَ الإِمَامِ حَتَّى يَنْصَرِفَ كُتِبَ لَهُ قِيَامُ لَيْلَةٍ ‘যে ব্যক্তি তারাবীহ শেষ করা পর্যন্ত ইমামের সাথে থাকল, সে সারা রাত্রি ইবাদতের নেকী পেল’।[9]
৫. ছায়েমকে ইফতার করানো : ছায়েমকে ইফতার করানো অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ কাজ। এতে ছিয়াম পালনের সম পরিমাণ ছওয়াব অর্জিত হয়। যায়েদ বিন খালেদ আল-জুহানী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِمْ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَّنْقُصَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا- ‘যে ব্যক্তি ছায়েমকে ইফতার করাবে, তার জন্য ছায়েমদের সমপরিমাণ ছওয়াব রয়েছে। অথচ তাদের ছওয়াবে কোন কমতি করা হবে না’।[10]
ছাহাবী ও সালাফে ছালেহীন অপরকে ইফতার করানোকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। তাঁরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন অপরকে ইফতার করাতে। একদিন রাসূল (ছাঃ) আউস গোত্রের নেতা প্রখ্যাত ছাহাবী হযরত সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ)-এর বাড়ীতে ইফতার করলেন। ইফতার শেষে তিনি তার জন্য দো‘আ করলেন, أَفْطَرَ عِنْدَكُمُ الصَّائِمُونَ وَأَكَلَ طَعَامَكُمُ الأَبْرَارُ وَصَلَّتْ عَلَيْكُمُ الْمَلاَئِكَةُ، ‘ছায়েমগণ তোমাদের নিকট ইফতার করুন। নেককার ব্যক্তিগণ তোমাদের খাদ্য ভক্ষণ করুন ও ফেরেশতাগণ তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন’।[11] কি সৌভাগ্যবান ছিলেন সা‘দ বিন মু‘আয! তিনি এমন একজন মহান ব্যক্তিকে ইফতার করিয়েছেন, যার ছিয়ামের নেকীর সমপরিমাণ নেকী তিনি পেয়ে গেলেন। কেননা তিনি বলেছেন, যত ছায়েমকে তিনি খাওয়াবেন, ততজনের নেকী তিনি পাবেন।[12]
৬. কুরআন তেলাওয়াত করা : রামাযান মাস কুরআন নাযিলের মাস। এ মাসে বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করতে হবে। এর মাধ্যমে প্রতি হরফে দশটি করে নেকী লাভ করা যায়।[13] শুধু তাই নয় কুরআন তার পাঠকারীর জন্য ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট সুফারিশকারী হবে। আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,اَلصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، يَقُولُ الصِّيَامُ أَيْ رَبِّ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِي فِيْهِ وَيَقُولُ الْقُرْآنُ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ قَالَ فَيُشَفَّعَانِ- ‘ছিয়াম ও কুরআন ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকটে সুফারিশ করবে। ছিয়াম বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি তাকে দিনের বেলায় খানা-পিনা ও প্রবৃত্তি পরায়ণতা হ’তে বিরত রেখেছিলাম। অতএব তার ব্যাপারে আমার সুফারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতের বেলা ঘুম থেকে বিরত রেখেছিলাম। অতএব তার ব্যাপারে আপনি আমার সুফারিশ কবুল করুন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, অতঃপর তাদের উভয়ের সুফারিশ কবুল করা হবে’।[14]
আমাদের নিজেদের আমল বৃদ্ধির জন্য রামাযানে সালাফদের আমলের দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। যাতে আমরা তাঁদের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের জীবন আলোকিত করতে পারি। যেমন-(১) প্রসিদ্ধ আছে যে, ক্বাতাদাহ (রাঃ) অন্য সময় প্রতি সাত দিনে এক খতম এবং রামাযানে প্রতি তিন দিনে এক খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন। (২) ইমাম মালেক, যুহরী ও সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) রামাযানে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে কুরআন তেলাওয়াতে রত হ’তেন।[15]
তবে আমাদের উচিত অনুধাবনের সাথে কুরআন তেলাওয়াত করা। আল্লাহ বলেন,كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوْا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ- ‘এটি এক বরকতমন্ডিত কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি। যাতে লোকেরা এর আয়াত সমূহ অনুধাবন করে এবং জ্ঞানীরা উপদেশ গ্রহণ করে’ (ছোয়াদ ৩৮/২৯)।
৭. দানের হাত প্রসারিত করা : রামাযান মাস দানের মাস। এ মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রবাহিত বায়ুর চাইতেও অধিক দান করতেন। ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, كَانَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم أَجْوَدَ النَّاسِ بِالْخَيْرِ، وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِى رَمَضَانَ، حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ، وَكَانَ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ، يَلْقَاهُ كُلَّ لَيْلَةٍ فِى رَمَضَانَ حَتَّى يَنْسَلِخَ، يَعْرِضُ عَلَيْهِ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم الْقُرْآنَ، فَإِذَا لَقِيَهُ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَانَ أَجْوَدَ بِالْخَيْرِ مِنَ الرِّيحِ الْمُرْسَلَةِ ‘ধন-সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সকলের চেয়ে বেশী দানশীল ছিলেন। রামাযানে যখন জিব্রীল (আঃ) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি আরো বেশী দান করতেন। রামাযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত জিব্রীল (আঃ) প্রতি রাতেই তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। আর নবী করীম (ছাঃ) তাঁকে কুরআন শোনাতেন। জিব্রীল (আঃ) যখন তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি প্রবাহিত বায়ুর চেয়ে অধিক দান করতেন’।[16] তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত রামাযান মাসে সাধ্যমত বেশী বেশী দান করা।
৮. ই‘তিকাফ করা : রামাযানে ই‘তিকাফ আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের এক বড় মাধ্যম। এতে লায়লাতুল ক্বদর সহজে লাভ করা হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদে নববীতে রামাযানের শেষ দশকে নিয়মিত ই‘তিকাফ করতেন। এমনকি তিনি মৃত্যুর বছর বিশ দিন ই‘তিকাফ করেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন,كَانَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعْتَكِفُ فِى كُلِّ رَمَضَانَ عَشْرَةَ أَيَّامٍ، فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الَّذِى قُبِضَ فِيهِ اعْتَكَفَ عِشْرِينَ يَوْمًا ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রতি রামাযানে দশদিন ই‘তিকাফ করতেন। কিন্তু যে বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন, সে বছর বিশ দিন ই‘তিকাফ করেন’।[17]
ই‘তিকাফে দীর্ঘ ক্বিরাআত, রুকূ ও সিজদার মাধ্যমে বিতরসহ ১১ রাক‘আত তারাবীহর ছালাত আদায় করবে। প্রয়োজনে একই সূরা, তাসবীহ ও দো‘আ বারবার পড়ে ছালাত দীর্ঘ করা যাবে। তারাবীহ শেষে খাওয়া-দাওয়া ও কিছুক্ষণ কুরআন তেলাওয়াতের পর ঘুমিয়ে যাবে। অতঃপর শেষ রাতে উঠে প্রয়োজন সেরে তাহিইয়াতুল ওযূ ও তাহিইয়াতুল মসজিদ বা অন্যান্য ছালাত যেমন ছালাতুত তওবাহ, ছালাতুল হাজত, ছালাতুল ইস্তিখারাহ ইত্যাদি নফল ছালাত শেষে ১, ৩ বা ৫ রাক‘আত বিতর পড়বে। অতঃপর সাহারী শেষে ফজরের দু’রাক‘আত সুন্নাত পড়বে। তারপর জামা‘আতে ফজরের ছালাত আদায় করে ঘুমাবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে মসজিদে প্রবেশ করে দু’রাক‘আত তাহিইয়াতুল ওযূ ও দু’রাক‘আত তাহিইয়াতুল মাসজিদ আদায় করবে। এভাবে যতবার টয়লেটে যাওয়া হবে, ততবার করা ভালো। অতঃপর বেলা ১২-টার মধ্যে ২ অথবা দুই দুই করে সর্বোচ্চ ১২ রাক‘আত পর্যন্ত ছালাতুয যোহা বা চাশতের ছালাত আদায় করবে এবং প্রতি ছালাতে সকলের জন্য দো‘আ করবে।
৯. দো‘আ করা : ছায়েমের দো‘আ কবুল হয়। তাই প্রত্যেক ছায়েমের উচিত আল্লাহর নিকট দু’জাহানের কল্যাণ কামনা করে বেশী বেশী দো‘আ করা। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,ثَلاَثُ دَعَوَاتٍ مُّسْتَجَابَاتٌ: دَعْوَةُ الصَّائِمِ، وَدَعْوَةُ الْمُسَافِرِ، وَدَعْوَةُ الْمَظْلُومِ- ‘তিনটি দো‘আ কবুল করা হয়। (১) ছায়েমের দো‘আ (২) মুসাফিরের দো‘আ ও (৩) মযলূমের দো‘আ।[18] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,ثَلاَثَةٌ لاَّ تُرَدُّ دَعْوَتُهُم : اَلصَّائِمُ حَتَّى يُفْطِرَ، وَالْإِمَامُ الْعَادِلُ، وَدَعْوَةُ الْمَظْلُومِ- ‘তিন জনের দো‘আ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। (১) ছায়েম যতক্ষণ না সে ইফতার করে (২) ন্যায়নিষ্ঠ নেতা এবং (৩) মযলূমের দো‘আ’।[19]
১০. তওবা-ইস্তিগফার করা : রামাযান আল্লাহর নিকট থেকে ক্ষমা লাভের মাস। তাই এ মাসে সকলের উচিত বেশী বেশী তওবা-ইস্তিগফার করা। কেননা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কিছু না কিছু ভুল আছে। আর ভুল করার পর কেউ খালেছ অন্তরে তওবা করলে আল্লাহ ভুলগুলি ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ বলেন, يَآ أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوآ إِلَى اللهِ تَوْبَةً نََّصُوحًا عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ يُّكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর বিশুদ্ধ তওবা। নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত’ (তাহরীম ৬৬/৮)। পাপ করার পর কেউ সেই পাপ থেকে বিরত থেকে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইলে সে নিষ্পাপ হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,اَلتَّائِبُ مِنَ الذَّنْبِ كَمَنْ لاَّ ذَنْبَ لَهُ- ‘পাপ থেকে তওবাকারী ব্যক্তি নিষ্পাপ ব্যক্তির ন্যায়’।[20]
তওবা করার নিয়ম হ’ল, আল্লাহর সাথে সংশ্লিষ্ট হ’লে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করা, সে কাজ থেকে ফিরে আসা এবং কখনোই সে কাজ না করা। আর বান্দার হক হ’লে প্রথমে বান্দার নিকট থেকে দায়মুক্ত হওয়া ও তার ক্ষমা নেওয়া এবং উপরের তিনটি কাজ করা। নইলে তওবা যথার্থ হবে না এবং সে তওবা কবুল হবে না।[21]
রামাযান মাসে যারা ঈমান ও ইহসানের সাথে ক্ষমা প্রার্থনা করে তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু যারা নিজেদের পাপগুলো মাফ করে নিতে ব্যর্থ হয়, তারা বড়ই দুর্ভাগা। হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন,أَكْثِرُوا مِنَ الِاسْتِغْفَارِ فِيْ بُيُوْتِكُمْ، وَعَلَى مَوَائِدِكُمْ، وَفِيْ طُرُقِكُمْ، وَفِيْ أَسْوَاقِكُمْ، وَفِيْ مَجَالِسِكُمْ أَيْنَمَا كُنْتُمْ، فَإِنَّكُمْ مَا تَدْرُوْنَ مَتَى تَنْزِلُ الْمَغْفِرَةُ، ‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন বেশী বেশী ক্ষমাপ্রার্থনা কর; তোমাদের বাড়ি-ঘরে, রাস্তা-ঘাটে, হাট-বাজারে এবং মজলিসগুলোতে। কারণ তোমরা তো জানো না কখন ক্ষমা অবতীর্ণ হবে’।[22]
তওবার দ্বারা আমাদের অন্তরের ময়লা দূর হয়ে যায়। কারণ মানুষের হৃদয়টা সাদা কাপড়ের মত, যখন সে পাপ করে সেই কাপড়ে কালো দাগ পড়ে। পাপ যত বেড়ে যায়, হৃদয়ের দাগও তত বেশী হয়। এক পর্যায়ে অন্তরটা মরিচা ধরে যায়। তওবার দ্বারা সেই মরিচা দূর হয়।
১১. লায়লাতুল ক্বদর পালন করা : রামাযান মাসের সবচেয়ে মর্যাদামন্ডিত রাত হ’ল লায়লাতুল ক্বদর। এটি হাযার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতের মর্যাদা বর্ণনায় আল্লাহ একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল করেছেন।
রামাযানের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ মোট পাঁচটি বেজোড় রাতে লায়লাতুল ক্বদর তালাশ করতে হয়। হযরত আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِى الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَّمَضَانَ- ‘তোমরা রামাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলিতে ক্বদরের রাত্রি তালাশ কর’।[23] রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণ এ রাতে জেগে জেগে ইবাদত করতেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন,إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ، وَأَحْيَا لَيْلَهُ، وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ- ‘রামাযানের শেষ দশক উপস্থিত হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কোমর বেঁধে নিতেন। রাত্রি জাগরণ করতেন ও স্বীয় পরিবারকে জাগাতেন’।[24] তিনি বলেন, يَجْتَهِدُ فِى الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مَا لاَ يَجْتَهِدُ فِى غَيْرِهِ- ‘শেষ দশকে রাসূল (ছাঃ) যত চেষ্টা করতেন, অন্য সময় তত করতেন না’।[25]
রামাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলিতে বেশী বেশী তওবা-ইস্তেগফার করতে হবে। বিশেষভাবে যে দো‘আটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে ক্বদরের রাত্রিতে পড়ার জন্য শিক্ষা দিয়েছিলেন, তা হ’লاَللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّىْ- ‘হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল! তুমি ক্ষমা করতে ভালবাসো। অতএব তুমি আমাকে ক্ষমা কর’।[26]
লায়লাতুল ক্বদরের মর্যাদা লাভের জন্য এ রাতকে যথাযথভাবে পালন করা উচিত। দীর্ঘ ক্বিরাআত ও রুকূ-সিজদার মাধ্যমে তারাবীহর ছালাত এবং একাকী যিকর-আযকার, কুরআন তেলাওয়াত, তাসবীহ-তাহলীল ও দো‘আ-ইস্তেগফারের মাধ্যমে রাত্রি অতিবাহিত করাই সুন্নাত সম্মত পদ্ধতি। কিন্তু দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, এ রাত আজকাল অনেক যায়গায় আনুষ্ঠানিকতায় বন্দী হয়ে গেছে। রাত্রির ছালাতের মূল পরিবেশকে বিনষ্ট করে ওয়ায-মাহফিল ও খানাপিনার অনুষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। আমাদের অবশ্যই এগুলি থেকে বিরত থাকতে হবে। অন্যথা প্রকৃত ছওয়াবের অধিকারী হওয়া যাবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,رُبَّ صَائِمٍ حَظُّهُ مِنْ صِيَامِهِ الْجُوعُ وَالْعَطَشُ، وَرُبَّ قَائِمٍ حَظُّهُ مِنْ قِيَامِهِ السَّهَرُ- ‘বহু ছায়েম রয়েছে যার মধ্যে ছিয়ামের কিছুই নেই ক্ষুধা ও তৃষ্ণা ব্যতীত এবং বহু রাত্রি জাগরণকারী আছে, যাদের মধ্যে কিছুই নেই রাত্রি জাগরণ ব্যতীত’।[27]
১২. ওমরাহ করা : রামাযান বছরের শ্রেষ্ঠ মাস। এ মাসে সকল নেক আমলের ছওয়াব বান্দা বহুগুণ লাভ করে। অনুরূপভাবে এই মাসে ওমরাহ সম্পাদনের মাধ্যমে হজ্জ করার সমপরিমাণ ছওয়াব অর্জন করা যায়। রাসূল (ছাঃ) বললেন, فَإِنَّ عُمْرَةً فِيْ رَمَضَانَ تَقْضِيْ حَجَّةً أَوْ حَجَّةً مَعِيْ ‘রামাযান মাসে ওমরাহ করা হজ্জ করার ন্যায় অথবা আমার সাথে হজ্জ করার ন্যায়’।[28] অন্যত্র তিনি বলেছেন, إِنَّ عُمْرَةً فِىْ رَمَضَانَ تَعْدِلُ حَجَّةً، ‘নিশ্চয়ই রামাযান মাসের ওমরাহ একটি হজ্জের সমান।[29] তবে এই ওমরাহ পালনে হজ্জের ফরযিয়াত আদায় হবে না; বরং হজ্জের সমপরিমাণ নেকী পাওয়া যাবে।
১৩. মিথ্যা কথা ও কাজ বর্জন করা : রামাযান এসেছে মানুষকে মুত্তাক্বী বানাতে। আর পাপ থেকে বেঁচে থাকতে পারলেই মুত্তাক্বী বা সংযমী হওয়া যাবে। আল্লাহ বলেছেন, لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ- ‘যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হ’তে পার’ (বাক্বারাহ ২/১৮৩)। এর অর্থ আল্লাহর ভয়ে সর্বদা পাপ থেকে দূরে থাকা এবং বল্গাহীন জীবনকে সংযত করা। এজন্যই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
বলেছেন, الصَّوْمُ جُنَّةٌ ‘ছিয়াম হ’ল ঢাল স্বরূপ’।[30]
মিথ্যা কথা ও কাজ কবীরা গোনাহ যা থেকে বিরত থাকতে না পারলে রামাযান আমাদের জীবনে কোন উপকার দেবে না। তাই রামাযানে সকল মুমিনের উচিত যাবতীয় মিথ্যা কথা ও কাজ থেকে বিরত তাকা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,مَنْ لَّمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِى أَنْ يَّدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ- ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করল না, তার পানাহার ত্যাগে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই’।[31] জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, যখন তুমি ছিয়াম রাখবে, তখন যেন তোমার কান, চোখ ও যবান সকল প্রকার মিথ্যা ও গোনাহ হ’তে মুক্ত থাকে। এসময় খাদেমের দেওয়া কষ্ট এড়িয়ে যাও। ছিয়ামের দিন তুমি ভাবগম্ভীর থাক। আর ছিয়াম থাকা ও না থাকার দিনকে তুমি সমান গণ্য করো না।[32]
১৪. ঝগড়া, মারামারি ও বেহায়াপনা থেকে বিরত থাকা : রামাযানের এই পবিত্র মাসে মুমিনকে যাবতীয় ঝগড়া-বিবাদ মারামারি, অশ্লীল কথা ও বেহায়াপনা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে অশ্লীল গান-বাজনা এবং রেডিও, টিভি ও মোবাইলের অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকতে হবে। তবেই ছিয়ামের ছওয়াব ও উচ্চ মর্যাদা লাভ করা যাবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ، فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ، ‘অতএব যখন তোমাদের কেউ ছিয়াম পালন করবে, তখন সে কোন মন্দ কথা বলবে না ও বাজে বকবে না। যদি কেউ তাকে গালি দেয় বা লড়াই করতে আসে তখন সে যেন বলে, আমি ‘ছায়েম’।[33] অশ্লীলতা থেকে বিরত না থেকে শুধু খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকার নাম ছিয়াম নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لَيْسَ الصِّيَامُ مِنَ الأَكْلِ وَالشُّرْبِ، إِنَّمَا الصِّيَامُ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ، فَإِنْ سَابَّكَ أَحَدٌ أَوْ جَهِلَ عَلَيْكَ فَلْتَقُلْ : إِنِّي صَائِمٌ، إِنِّي صَائِمٌ- ‘খানা-পিনা থেকে বিরত থাকার নাম ছিয়াম নয়; বরং ছিয়াম হ’ল বাজে কথা ও কাজ এবং ভোগ-সম্ভোগ ও বেহায়াপনা হ’তে বিরত থাকা। অতঃপর যদি কেউ তোমাকে গালি দেয় বা তোমার প্রতি মূর্খতাসূলভ আচরণ করে, তাহ’লে তুমি বল, আমি ছায়েম, আমি ছায়েম’।[34] এ বিষয়ে ছাহাবীগণ অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। প্রসিদ্ধ আছে যে, হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) ও তাঁর সাথীগণ ছিয়াম রাখার পর মসজিদে গিয়ে বসতেন ও বলতেন, আমরা আমাদের ছিয়ামকে পরিশুদ্ধ করব। অতঃপর তারা যাবতীয় অনর্থক কথা ও কর্ম যা ছিয়ামকে ত্রুটিপূর্ণ করে, সবকিছু হ’তে বিরত থাকতেন।[35]
১৫. অতিভোজন থেকে বিরত থাকা : অতিভোজন মানুষকে অলস ও ইবাদতে অমনোযোগী করে তুলে। তাই একজন আল্লাহভীরু বান্দার দায়িত্ব রামাযানের সাহারী ও ইফতারে অতিভোজন থেকে বিরত থাকা। সে অবশ্যই পরিমিত আহার করবে। যা তাকে ইবাদতে উপযোগী করে তুলবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আদম সন্তানের জন্য কয়েক লোকমা খাদ্য যথেষ্ট, যা দিয়ে সে তার কোমর সোজা রাখতে পারে (ও আল্লাহর ইবাদত করতে পারে)। এরপরেও যদি খেতে হয়, তবে পেটের তিনভাগের এক ভাগ খাদ্য ও একভাগ পানি দিয়ে ভরবে এবং একভাগ খালি রাখবে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য’।[36] তিনি বলেন, এক মুমিনের খানা দুই মুমিনে খায়। দুই মুমিনের খানা চার মুমিনে খায় এবং চার মুমিনের খানা আট মুমিনে খায় (অর্থাৎ সর্বদা সে পরিমাণে কম খায়)।[37] কেননা মুমিন এক পেটে খায় ও কাফের সাত পেটে খায় (অর্থাৎ সে সর্বদা বেশী খায়)।[38]
আবূ হুরায়রা (রাঃ) খুবই কম খেতেন। তিনি বলতেন, আমার ১৫টি খেজুর থাকত। যার মধ্যে ৫টি দিয়ে ইফতার ও ৫টি দিয়ে সাহারী করতাম। বাকী ৫টি পরের দিনের ইফতারের জন্য রেখে দিতাম’।[39]
উপসংহার : রামাযান মাস আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতে অতিবাহিত করার মধ্যেই জান্নাতে ছায়েমের জন্য ‘রাইয়ান’ নামক দরজা নির্ধারিত হয়। শুধু লোক দেখানো বা গতানুগতিক দিন পার করার মধ্যে নয়। যারা রামাযান মাসে তাক্বওয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারে তাদের জন্য রয়েছে ঈদের প্রকৃত আনন্দ। তাই আসুন! আমরা রামাযানের গুরুত্ব ও মর্যাদা যথাযথভাবে উপলব্ধি করে তাক্বওয়ার বলে বলিয়ান হয়ে ধর্মীয় ভাব গাম্ভির্যের সাথে রামাযান অতিবাহিত করি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সেই তাওফীক দান করুন-আমীন!
ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
[1]. বুখারী হা/১৯৬৯; মুসলিম হা/১১৫৬; মিশকাত হা/২০৩৬।
[2]. বুখারী হা/৩৭-৩৮; মুসলিম হা/৭৬০; মিশকাত হা/১৯৫৮।
[3]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৭০২,১০৫২; আবূদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১০৬৬।
[4]. বুখারী হা/৩৭; মুসলিম হা/৭৫৯; মিশকাত হ/১৯৫৮।
[5]. মির‘আত ‘রামাযানে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ-এর আলোচনা হা/১৩০২, ৪/৩১১ পৃ.।
[6]. তিরমিযী হা/৩৫৪৯; মিশকাত হা/১২২৭।
[7]. আবুদাঊদ হা/১৩০৭; মুসনাদে আহমাদ হা/২৬১১৪।
[8]. মুওয়াত্ত্বা হা/৩৭৯।
[9]. তিরমিযী হা/৮০৬।
[10]. ইবনু মাজাহ হা/১৭৪৬; তিরমিযী হা/৮০৭; বায়হাক্বী শু‘আব হা/৩৯৫৩; মিশকাত হা/১৯৯২।
[11]. আবুদাঊদ হা/৩৮৫৪।
[12]. তিরমিয়ী হা/৮০৭।
[13]. তিরমিযী হ/২৯১০; মিশকাত হা/২১৩৭।
[14]. বায়হাক্বী শো‘আব হা/১৯৯৪; মিশকাত হা/১৯৬৩।
[15]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ছিয়াম ও ক্বিয়াম (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ৩য় প্রকাশ, মার্চ ২০২৩ খৃ.) পৃ. ১১৩-১৪।
[16]. বুখারী হা/১৯০২।
[17]. বুখারী হা/২০৪৪; মিশকাত হা/২০৯৯। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর স্ত্রীগণও ই‘তিকাফ করেছেন’ বুখারী হা/২০২৬; মুসলিম হা/১১৭২; মিশকাত হা/২০৯৭।
[18]. বায়হাক্বী শো‘আব হা/৩৫৯৪।
[19]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৩৪২৮।
[20]. ইবনু মাজাহ হা/৪২৫০; মিশকাত হা/২৩৬৩।
[21]. নববী, রিয়াযুছ ছালেহীন ‘তওবা’ অধ্যায়।
[22]. ইবনু রজব হাম্বলী, জামে‘উল ‘উলূম ওয়াল হিকাম ২/৪০৮।
[23]. বুখারী হা/২০১৭; মুসলিম হা/১১৬৯; মিশকাত হা/২০৮৩।
[24]. বুখারী হা/২০২৪; মুসলিম হা/১১৭৪; মিশকাত হা/২০৯০।
[25]. মুসলিম হা/১১৭৫; মিশকাতহা/২০৮৯।
[26]. তিরমিযী হা/৩৫১৩; আহমাদ হা/২৫৪২৩; ইবনু মাজাহ হা/৩৮৫০; মিশকাত হা/২০৯১।
[27]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/১৯৯৭; আহমাদ হা/৮৮৪৩; হাকেম হা/১৫৭১।
[28]. বুখারী হা/১৮৬৩; ‘হজ্জ’ অধ্যায়, ‘মহিলাদের হজ্জ’ অনুচ্ছেদ।
[29]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৫০৯।
[30]. তিরমিযী হা/৭৬৪।
[31]. বুখারী হা/১৯০৩; মিশকাত হা/১৯৯৯।
[32]. বায়হাক্বী শো‘আব হা/৩৬৪৬; বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৫/৪৬।
[33]. বুখারী হা/১৯০৪; মিশকাত হা/১৯৫৯।
[34]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/১৯৯৬; হাকেম হা/১৫৭০, সনদ ছহীহ।
[35]. ছিয়াম ও কিয়াম, পৃ. ১১৪।
[36]. তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৫১৯২।
[37]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪১৭৮।
[38]. বুখারী, মিশকাত হা/৪১৭৩।
[39]. বুখারী হা/১৯৬৯; মুসলিম হা/১১৫৬; মিশকাত হা/২০৩৬। আবু নু‘আইম ইস্ফাহানী, হিলইয়াতুল আউলিয়া ১/৩৮৪।