পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । শেষ পর্ব ।
ভূমিকা :
আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে একমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং ইবাদতের যাবতীয় নিয়ম-পদ্ধতি অহী মারফত জানিয়ে দিয়েছেন, যা কুরআন ও হাদীছ গ্রন্থ সমূহে বিদ্যমান। আর সকল ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইবাদত হল ছালাত, যা পবিত্রতা অর্জন ব্যতীত বৈধ নয়। এ কারণে সকল মুহাদ্দিছ এবং ফক্বীহগণ ত্বাহারাহ বা পবিত্রতা অধ্যায় দিয়ে কিতাব লিখা শুরু করেছেন। অতএব পবিত্রতা অর্জনের গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে এ সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হ’ল।-
الطهارة (ত্বহারাহ্)-এর আভিধানিক অর্থ : النظافة، والنزاهة، والنقاوة অর্থাৎ পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ও বিশুদ্ধতা।[1]
الطهارة (ত্বহারাহ্)-এর পারিভাষিক অর্থ : পারিভাষিক অর্থে الطهارة (ত্বহারাহ্) দু’টি অর্থ প্রদান করে। যথা :
১- طهارة معنويةতথা অর্থগত দিক থেকে পবিত্রতা : তা হ’ল طهارة القلب অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের মধ্যে কোন ব্যক্তি বা বস্ত্তকে শরীক করা থেকে নিজের অন্তরকে পবিত্র রাখা এবং আল্লাহ তা‘আলার মুমিন বান্দার উপর হিংসা-বিদ্বেষ ও গোপন শত্রুতা থেকে নিজেকে বিরত রাখা।
আর এটা কোন অপবিত্র বস্ত্ত থেকে শরীর পবিত্র করার চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কেননা শিরক দ্বারা অপবিত্র শরীরকে পানি দ্বারা ধৌত করে পবিত্র করা সম্ভব নয়। যদিও বাহ্যিক দিক থেকে তার শরীর অপবিত্র নয়। অর্থাৎ তার শরীর স্পর্শ করলে কেউ অপবিত্র হবে না এবং তার উচ্ছিষ্ট অপবিত্র নয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِنَّمَا الْمُشْرِكُوْنَ نَجَسٌ ‘হে ঈমানদারগণ, নিশ্চয়ই মুশরিকরা নাপাক বা অপবিত্র’ (তওবা ২৮)।
২- الطهارة الحسية তথা অনুভবযোগ্য বাহ্যিক পবিত্রতা : তা হ’ল, رفع الحدث و زوال الخبث অর্থাৎ শরীরের অপবিত্রতা এবং শরীরে লেগে থাকা অপবিত্র বস্ত্ত দূর করা।
ব্যাখ্যা : ১- رفع الحدث তথা শরীরের নাপাকী দূর করা। অর্থাৎ যে সকল কারণ ছালাত আদায়ে বাধা প্রদান করে তা হ’তে পবিত্রতা অর্জন করা। এটা দুই প্রকার। যথা :
(ক) حدث أصغر তথা ছোট নাপাকী। যা থেকে কেবল ওযূর মাধ্যমেই পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব। যেমন পেশাব-পায়খানা এবং বায়ু নিঃসরণ হ’লে ওযূর মাধ্যমেই পবিত্রতা অর্জন করে ছালাত আদায় করা যায়।
(খ) حدث أكبر তথা বড় নাপাকী। যা থেকে গোসল ব্যতীত পবিত্রতা অর্জন সম্ভব নয়। যেমন- স্ত্রী সহবাস করলে অথবা স্বপ্নদোষের মাধ্যমে বীর্যপাত ঘটলে গোসল ওয়াজিব হয়ে যায়। এ অবস্থায় পানি না পেলে তায়াম্মুমের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করতে হয়।
২- زوال الخبث তথা শরীরে লেগে থাকা নাপাকী দূর করা। অর্থাৎ পেশাব, পায়খানা ইত্যাদি শরীরে বা কাপড়ে লেগে গেলে পানি দ্বারা ধৌত করার মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করা।[2]
পবিত্রতা অর্জনের হুকুম : নাপাকী থেকে পবিত্রতা অর্জন করা সক্ষম ব্যক্তির উপর ওয়াজিব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ ‘তোমার পোষাক-পরিচ্ছদ পবিত্র রাখ’ (মুদ্দাছছির ৪)।
তিনি অন্যত্র বলেছেন, وَعَهِدْنَا إِلَى إِبْرَاهِيْمَ وَإِسْمَاعِيْلَ أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِيْنَ وَالْعَاكِفِيْنَ وَالرُّكَّعِ السُّجُوْدِ- ‘আর ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে তাওয়াফকারী, ই‘তিকাফকারী, রুকূ ও সিজদাকারীদের জন্য আমার গৃহকে পবিত্র রাখতে আদেশ দিয়েছিলাম’ (বাক্বারাহ ১২৫)।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ ابْنِ عُمَرَ قَالَ إِنِّىْ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ- صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ لاَ تُقْبَلُ صَلاَةٌ بِغَيْرِ طُهُوْرٍ وَلاَ صَدَقَةٌ مِنْ غُلُوْلٍ-
ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘পবিত্রতা ব্যতীত ছালাত এবং হারাম মালের দান কবুল হয় না’।[3]
পবিত্রতা অর্জনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা :
(ক) বান্দার ছালাত ছহীহ্ হওয়ার পূর্বশর্ত হ’ল পবিত্রতা অর্জন করা। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : لاَ تُقْبَلُ صَلاَةُ مَنْ أَحْدَثَ حَتَّى يَتَوَضَّأَ-
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির ওযূ ভঙ্গ হয়েছে তার ছালাত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে ওযূ না করে’।[4]
(খ) আল্লাহ তা‘আলা পবিত্রতা অর্জনকারীর প্রশংসা করেছেন এবং তিনি তাদেরকে ভালবাসেন। আললাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّ اللهَ يُحِبُّ التَّوَّابِيْنَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِيْنَ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদেরকে ভালবাসেন এবং ভালবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে’ (বাক্বারাহ ২২২)।
আল্লাহ মসজিদে কুবার অধিবাসীদের প্রশংসা করে বলেন, فِيْهِ رِجَالٌ يُحِبُّوْنَ أَنْ يَتَطَهَّرُوْا وَاللهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِيْنَ- ‘সেখানে এমন লোক আছে, যারা উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করতে ভালবাসে। আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন’ (তওবা ১০৮)।
(গ) কবরের কঠিন আযাব থেকে পরিত্রাণের অন্যতম উপায় হ’ল অপবিত্র বস্ত্ত থেকে দূরে থাকা। যেমন হাদীছে এসেছে,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ مَرَّ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى قَبْرَيْنِ فَقَالَ إِنَّهُمَا يُعَذَّبَانِ وَمَا يُعَذَّبَانِ فِىْ كَبِيْرٍ أَمَّا هَذَا فَكَانَ لاَ يَسْتَنْزِهُ مِنَ الْبَوْلِ وَأَمَّا هَذَا فَكَانَ يَمْشِى بِالنَّمِيْمَةِ-
ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দু’টি কবরের পার্শ্ব দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। অতঃপর তিনি বললেন, নিশ্চয়ই এই দুই ব্যক্তি শাস্তি ভোগ করছে। কিন্তু তারা বড় কোন অপরাধের কারণে শাস্তি ভোগ করছে না। তার মধ্যে এই ব্যক্তি প্রসাব থেকে সতর্ক থাকত না। আর এই ব্যক্তি চোগলখোরী করে বেড়াত’।[5]
পানি সংক্রান্ত মাসআলা
যে পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা বৈধ:
পবিত্রতা অর্জনের জন্য ঐ পানির প্রয়োজন যে পানি নিজে পবিত্র এবং অন্যকে পবিত্র করতে সক্ষম। উল্লেখ্য যে, পানি তিন প্রকার। যথা-
(ক) طَهُوْرٌ (ত্বাহূর): অর্থাৎ যে পানি নিজে পবিত্র এবং অন্যকে পবিত্র করতে সক্ষম। অর্থাৎ যে পানির রং, স্বাদ, গন্ধ কিছুই পরিবর্তন হয়নি। যেমন- বৃষ্টির পানি, নদীর পানি, সাগরের পানি, বরফের পানি, কূপের পানি, ঝরণার পানি, নলকূপের পানি ইত্যাদি। কেবলমাত্র এই প্রকার পানি দ্বারাই পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَيُنَزِّلُ عَلَيْكُمْ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً لِيُطَهِّرَكُمْ بِهِ ‘আর আকাশ হ’তে তোমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন, আর এর মাধ্যমে তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করেন’ (আনফাল ১১)।
তিনি অন্যত্র বলেছেন, وَأَنْزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً طَهُوْرًا ‘আর আমি আকাশ থেকে পবিত্র পানি বর্ষণ করেছি’ (ফুরক্বান ৪৮)।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: سَأَلَ رَجُلٌ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّا نَرْكَبُ الْبَحْرَ وَنَحْمِلُ مَعَنَا الْقَلِيْلَ مِنَ الْمَاءِ فَإِنْ تَوَضَّأْنَا بِهِ عَطِشْنَا أَفَنَتَوَضَّأُ بِمَاءِ الْبَحْرِ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم هُوَ الطَّهُوْرُ مَاؤُهُ الْحِلُّ مَيْتَتُهُ-
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা সমুদ্রে (নৌকায়) আরোহণ করেছি এবং আমরা সঙ্গে অল্প কিছু পানি নিয়েছি। যদি আমরা সেই পানি দ্বারা ওযূ করি তাহ’লে আমরা পিপাসিত হব। অতএব আমরা কি সমুদ্রের পানি দ্বারা ওযূ করতে পারি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তার (সমুদ্রের) পানি পবিত্র এবং তার মধ্যেকার মৃত হালাল।[6]
(খ) طَاهِرٌ (ত্বাহের): অর্থাৎ যে পানি নিজে পবিত্র। কিন্তু অন্যকে পবিত্র করতে পারে না। যেমন- পেপসি, ফলের জুস, দুধ মিশানো পানি ইত্যাদি। এগুলো নিজে পবিত্র কিন্তু কোন অপবিত্রকে পবিত্র করতে পারে না। অর্থাৎ এগুলো দ্বারা ওযূ বৈধ নয় এবং শরীরে কোন নাপাকী লেগে গেলে এগুলো দ্বারা ধৌত করাও বৈধ নয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَإِنْ كُنْتُمْ مَرْضَى أَوْ عَلَى سَفَرٍ أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ أَوْ لاَمَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوْا مَاءً فَتَيَمَّمُوْا صَعِيْدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوْا بِوُجُوْهِكُمْ وَأَيْدِيْكُمْ مِنْهُ-
‘আর যদি অসুস্থ হও কিংবা সফরে থাক অথবা যদি তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে আসে অথবা তোমরা যদি স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর অতঃপর পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর। সুতরাং তোমাদের মুখ ও হাত তা দ্বারা মাসেহ কর’ (মায়েদা ৬)। অতএব যদি পানি ব্যতীত জুস, পেপসি ইত্যাদি দ্বারা ওযূ জায়েয হ’ত তাহ’লে পানি না পেলে আল্লাহ তা‘আলা সরাসরি মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করার নির্দেশ দিতেন না। বরং পানি জাতীয় জিনিস দ্বারা ওযূ করার নির্দেশ দিতেন।
(ঘ) نجس (নাজাস): অর্থাৎ যে পানি নিজে পবিত্র নয় এবং অন্যকেও পবিত্র করতে পারে না। এমন পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা জায়েয নয়।
পানির সাথে অপবিত্র বস্ত্তর মিশ্রণ হ’লে তার হুকুম :
পানি কম হোক কিংবা বেশী হোক তার সাথে অপবিত্র বস্ত্তর মিশ্রণের ফলে যদি রং, স্বাদ ও গন্ধ এই তিনটি গুণের কোন একটির পরিবর্তন হয়, তাহ’লে সেই পানি অপবিত্র হয়ে যাবে। এই পানি ব্যবহার করা জায়েয নয় এবং তা অন্যকে পবিত্র করতেও সক্ষম নয়। পক্ষান্তরে যদি রং, স্বাদ ও গন্ধ এই তিনটি গুণের সবগুলি ঠিক থাকে তাহ’লে তা পবিত্র বলে গণ্য হবে এবং তা দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা বৈধ।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ قِيْلَ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّا نَتَوَضَّأُ مِنْ بِئْرِ بُضَاعَةَ وَهِيَ يُلْقَى فِيْهَا الْحِيْضُ وَلُحُوْمُ الْكِلاَبِ وَالنَّتْنُ فَقَالَ إِنَّ الْمَاءَ طَهُوْرٌ لاَ يُنَجِّسُهُ شَيْءٌ-
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা কি ‘বুযাআ’ কূপের পানি দ্বারা ওযূ করতে পারি? অথচ তা এমন একটি কূপ, যাতে হায়েযের নেকড়া, মরা কুকুর ও পূতিগন্ধময় আবর্জনা নিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, পানি পবিত্র, কোন জিনিসই তাকে অপবিত্র করতে পারে না।[7]
পানির সাথে পবিত্র বস্ত্তর মিশ্রণ হ’লে তার হুকুম :
পানির সাথে যদি কোন পবিত্র বস্ত্তর মিশ্রণ হয়। যেমন- বৃক্ষের পাতা, সাবান, কুল বা বরই ইত্যাদি এবং রং, স্বাদ, গন্ধ এই তিনটি গুণের সবগুলোই ঠিক থাকে তাহ’লে তা পবিত্র বলে গণ্য হবে এবং তা দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা বৈধ। কিন্তু যদি উলিলখি তিনটি গুণের কোন একটি নষ্ট হয়ে যায় তাহ’লে সেই পানি طَاهِرٌ তথা পবিত্র বটে কিন্তু তা দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা বৈধ নয়।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ أُمِّ عَطِيَّةَ الأَنْصَارِيَّةِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ دَخَلَ عَلَيْنَا رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم حِيْنَ تُوُفِّيَتِ ابْنَتُهُ فَقَالَ اغْسِلْنَهَا ثَلاَثًا أَوْ خَمْسًا أَوْ أَكْثَرَ مَنْ ذَلِكَ إِنْ رَأَيْتُنَّ ذَلِكَ بِمَاءٍ وَسِدْرٍ وَاجْعَلْنَ فِي الآخِرَةِ كَافُورًا أَوْ شَيْئًا مِنْ كَافُوْرٍ-
উম্মু আতিয়্যাহ আনছারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কন্যা যায়নাব (রাঃ) মৃত্যুবরণ করলে তিনি আমাদের নিকট এসে বললেন, তোমরা তাঁকে তিনবার বা পাঁচবার বা প্রয়োজন মনে করলে তার চেয়ে অধিকবার বরই পাতাসহ পানি দিয়ে গোসল দাও। শেষবারে কর্পুর বা কিছু কর্পুর ব্যবহার করবে...।[8] অত্র হাদীছ প্রমাণ করে যে, পবিত্র বস্ত্তর মিশ্রণে পানি অপবিত্র হয় না।
গরম পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জনের হুকুম :
(ক) যদি কোন অপবিত্র বস্ত্তকে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করে পানি গরম করা হয়। অর্থাৎ যদি কেউ গাধা বা ঘোড়ার পায়খানা জমা করে এবং তাকে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করে পানি গরম করে এবং পাত্রের মুখ খোলা থাকে, তাহ’লে তা মাকরূহ বা অপসন্দনীয়। কেননা অপবিত্র বস্ত্ত নিসৃত ধোঁয়া ঐ পানিতে পতিত হওয়ার ফলে তার গন্ধ পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে পক্ষান্তরে যদি পাত্রের মুখ বন্ধ করা থাকে, তাহ’লে তাতে কোন সমস্যা নেই।[9]
(খ) যদি কোন পবিত্র বস্ত্তকে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করে পানি গরম করে অথবা সূর্যের তাপে পানি গরম করে, তাহ’লে তাতে কোন সমস্যা নেই।[10]
ব্যবহারিক পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জনের হুকুম :
ব্যবহারিক পানি অর্থাৎ ওযূ অথবা গোসল করার সময় ওযূর অঙ্গসমূহ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা বৈধ। তবে শর্ত হ’ল রং, স্বাদ ও গন্ধ ঠিক থাকতে হবে।
হাদীছে এসেছে,
قَالَ عُرْوَةُ عَنِ الْمِسْوَرِ وَغَيْرِهِ يُصَدِّقُ كُلُّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا صَاحِبَهُ وَإِذَا تَوَضَّأَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم كَادُوْا يَقْتَتِلُوْنَ عَلَى وَضُوْئِهِ.
উরওয়া (রহঃ) মিসওয়ার (রহঃ) প্রমুখের নিকট হ’তে হাদীছ বর্ণনা করেন। এ উভয় বর্ণনা একটি অন্যটির সত্যায়ন স্বরূপ। নবী (ছাঃ) যখন ওযূ করতেন তখন তাঁর ব্যবহৃত পানির উপর তাঁরা (ছাহাবায়ে কেরাম) যেন হুমড়ি খেয়ে পড়তেন’।[11]
অন্য হাদীছে এসেছে,
وَقَالَ أَبُو مُوْسَى دَعَا النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم بِقَدَحٍ فِيْهِ مَاءٌ فَغَسَلَ يَدَيْهِ وَوَجْهَهُ فِيهِ وَمَجَّ فِيْهِ ثُمَّ قَالَ لَهُمَا اشْرَبَا مِنْهُ وَأَفْرِغَا عَلَى وُجُوْهِكُمَا وَنُحُوْرِكُمَا-
আবু মূসা (রাঃ) বলেন, নবী (ছাঃ) একটি পাত্র আনালেন যাতে পানি ছিল। অতঃপর তিনি তার মধ্যে উভয় হাত ও মুখমন্ডল ধেŠত করলেন এবং তার দ্বারা কুলি করলেন। অতঃপর তাদের দু’জন [আবু মূসা ও বেলাল (রাঃ)]-কে বললেন, তোমরা এ থেকে পান কর এবং তোমাদের মুখমন্ডলে ও বুকে ঢাল।[12]
অতএব যদি ব্যবহারিক পানি পবিত্র না হ’ত তাহ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এমন নির্দেশ দিতেন না এবং ছাহাবায়ে কেরাম এমন কাজ করতেন না। এছাড়াও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এবং তাঁর ছাহাবীগণ তাঁদের স্ত্রীদের সাথে একত্রে একই পাত্র হ’তে ওযূ করতেন। যেমন হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ أَنَّهُ قَالَ كَانَ الرِّجَالُ وَالنِّسَاءُ يَتَوَضَّئُوْنَ فِيْ زَمَانِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَمِيْعًا-
আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল-এর সময় পুরুষ এবং মহিলা একত্রে (এক পাত্র হ’তে) ওযূ করতেন।[13]
মানুষ এবং গৃহপালিত পশুর উচ্ছিষ্ট পবিত্র কি?
প্রথমত ঃ মানুষের উচ্ছিষ্ট, অর্থাৎ খাওয়া ও পান করার পরে যা অবশিষ্ট থাকে তা পবিত্র। হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ كُنْتُ أَشْرَبُ وَأَنَا حَائِضٌ ثُمَّ أُنَاوِلُهُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَيَضَعُ فَاهُ عَلَى مَوْضِعِ فِىَّ فَيَشْرَبُ وَأَتَعَرَّقُ الْعَرْقَ وَأَنَا حَائِضٌ ثُمَّ أُنَاوِلُهُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَيَضَعُ فَاهُ عَلَى مَوْضِعِ فِىَّ-
আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি হায়েয অবস্থায় পান করতাম, অতঃপর তা নবী (ছাঃ)-কে দিতাম, আর তিনি আমার মুখের জায়গায় মুখ রেখেই পান করতেন। আর কখনও আমি হায়েয অবস্থায় হাড়ের গোশত খেতাম, অতঃপর তা আমি নবী (ছাঃ)-কে দিতাম, আর তিনি আমার মুখের জায়গায় মুখ রেখে খেতেন।[14] অতএব মানুষের উচ্ছিষ্ট সর্বাবস্থায়ই পবিত্র।
দ্বিতীয়ত ঃ পশুর উচ্ছিষ্ট : গৃহপালিত পশু যার গোশ্ত খাওয়া হালাল তার উচ্ছিষ্ট পবিত্র। যা ওলামায়ে কেরামের ঐক্যমত দ্বারা প্রমাণিত।
পক্ষান্তরে যে সকল পশুর গোশত খাওয়া হারাম সে সকল পশুর উচ্ছিষ্ট পবিত্র অথবা অপবিত্র হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। তবে ছহীহ মত হ’ল, কুকুর এবং শুকুর ব্যতীত অন্য সকল পশুর উচ্ছিষ্ট পবিত্র।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ كَبْشَةَ بِنْتِ كَعْبِ بْنِ مَالِكٍ وَكَانَتْ تَحْتَ ابْنِ أَبِىْ قَتَادَةَ أَنَّ أَبَا قَتَادَةَ دَخَلَ فَسَكَبَتْ لَهُ وَضُوْءًا فَجَاءَتْ هِرَّةٌ فَشَرِبَتْ مِنْهُ فَأَصْغَى لَهَا الإِنَاءَ حَتَّى شَرِبَتْ قَالَتْ كَبْشَةُ فَرَآنِى أَنْظُرُ إِلَيْهِ فَقَالَ أَتَعْجَبِيْنَ يَا ابْنَةَ أَخِىْ فَقُلْتُ نَعَمْ. فَقَالَ إِنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّهَا لَيْسَتْ بِنَجَسٍ إِنَّهَا مِنَ الطَّوَّافِيْنَ عَلَيْكُمْ وَالطَّوَّافَاتِ-
কাবশা বিনতে কা’ব ইবনে মালেক যিনি আবু কাতাদার পুত্রবধূ ছিলেন। তার থেকে বর্ণিত আছে যে, একদা (তার শ্বশুর) আবু কাতাদা তাঁর নিকট গেলেন। তিনি তাঁর জন্য ওযূর পানি ঢাললেন। তখন একটি বিড়াল আসল এবং তা হ’তে পান করতে লাগল, আর তিনি পাত্রটি বিড়ালটির জন্য কাত করে ধরলেন, যে পর্যন্ত না সে পান করল। কাবশা বলেন, তখন তিনি আমাকে দেখলেন, আমি তাঁর দিকে চেয়ে রয়েছি। এটা দেখে তিনি বললেন, হে ভাতিজী! তুমি কি আশ্চর্যবোধ করছ? তিনি বলেন, আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, বিড়াল নাপাক নয়। তা তোমাদের পাশে ঘন ঘন বিচরণকারী অথবা বিচরণকারিণী। (সুতরাং এর উচ্ছিষ্ট নাপাক নয়)।[15]
তবে পানির পরিমাণ যদি দুই কুল্লা-এর কম হয় এবং ঐ সকল পশুর খাওয়া ও পান করার ফলে রং, স্বাদ ও গন্ধ পরিবর্তিত হয়ে যায় তাহ’লে তা অপবিত্র হবে।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ قَالَ : سُئِلَ عَنِ الْمَاءِ يَكُوْنُ بِالْفَلاَةِ مِنَ الأَرْضِ وَمَا يَنُوْبُهُ مِنَ الدَّوَابِّ وَالسِّبَاعِ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ : إِذَا بَلَغَ الْمَاءُ قُلَّتَيْنِ لَمْ يُنَجِّسْهُ شَيْءٌ-
ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল সেই পানি সম্পর্কে, যা মাঠে-বিয়াবানে জমে থাকে। আর পর পর তা হ’তে নানা ধরনের বন্য জীব-জন্তু ও হিংস্র পশু পানি পান করতে থাকে। উত্তরে তিনি বললেন, ‘পানি যখন দুই কুল্লা পরিমাণ হয়, তখন তা নাপাক হয় না’।[16]
আর কুকুর এবং শূকরের উচ্ছিষ্ট অপবিত্র। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى اللهُ عليْه وسلم طُهُوْرُ إِنَاءِ أَحَدِكُمْ إِذَا وَلَغَ فِيْهِ الْكَلْبُ أَنْ يَغْسِلَهُ سَبْعَ مَرَّاتٍ أُوْلاَهُنَّ بِالتُّرَابِ-
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের কারো পাত্রে কুকুর মুখ দিলে তাকে সাতবার ধৌত কর এবং প্রথমবার মাটি দ্বারা’।[17]
অতএব কুকুরের উচ্ছিষ্ট অপবিত্র না হ’লে রাসূল (ছাঃ) সাতবার ধৌত করার নির্দেশ দিতেন না। আর শূকরের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, فَإِنَّهُ رِجْسٌ ‘নিশ্চয়ই তা অপবিত্র’ ( আন‘আম ১৪৫)।
[চলবে]
মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম
[1]. আল-মু‘জামুল ওয়াসীত, (বৈরুত : দারু এহইয়াইত তুরাছ আল-আরাবী), পৃঃ ৩৮৭।
[2]. মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি ১/২৫-৩২; ফিক্বহুল মুয়াস্সার, পৃঃ ১।
[3]. মুসলিম, হা/২২৫, মিশকাত, হা/২৮১।
[4]. বুখারী, ‘পবিত্রতা ব্যতীত ছালাত কবুল হবে না’ অনুচ্ছেদ, হা/১৩৫, বাংলা অনুবাদ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, ১/৮৫; মুসলিম, হা/২২৫। মিশকাত, হা/২৮০, বাংলা অনুবাদ, এমদাদিয়া ২/৪৮।
[5]. আবু দাউদ, হা/২০, নাসাঈ, হা/৩১, ৬৯, ইবনু মাজাহ, হা/৩৪৭, হাদীছ ছহীহ।
[6]. আবু দাউদ হা/৮৩; তিরমিযী হা/৬৯; নাসাঈ হা/৫৯; ইবনু মাজাহ হা/৩২৪৬।
[7]. মুসনাদে আহমাদ ৩/১৫; আবু দাউদ হা/৬১; নাসাঈ হা/২৭৭; মিশকাত হা/৪৪৮; বঙ্গানুবাদ, এমদাদিয়া ২/১১৫।
[8]. বুখারী ‘বরই পাতার পানি দিয়ে মৃতকে গোসল ও ওযূ করানো’ অনুচ্ছেদ, হা/১২৫৩, বাংলা অনুবাদ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স ২/৮।
[9]. শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি ১/৩৩-৩৪।
[10]. শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি ১/৩৫।
[11]. বুখারী, ‘ওযূর অবশিষ্ট পানি ব্যবহার’ অনুচ্ছেদ, হা/১৮৯, বাংলা অনুবাদ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স ১/১০৯।
[12]. বুখারী, ‘ওযূর অবশিষ্ট পানি ব্যবহার’ অধ্যায়, হা/১৮৮, বাংলা অনুবাদ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স ১/১০৯।
[13]. বুখারী, ‘ওযূর অবশিষ্ট পানি ব্যবহার’ অনুচ্ছেদ, হা/১৯৩, বাংলা অনুবাদ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স ১/১১১।
[14]. মুসলিম, হা/৩০০, মিশকাত, ‘হায়েয’ অধ্যায়, হা/৫০২, বাংলা অনুবাদ, এমদাদিয়া ২/১৪২।
[15]. আবু দাউদ, ‘বিড়ালের উচ্ছিষ্ট’ অনুচ্ছে, হা/৭৫, তিরমিযী, হা/৯২, মিশকাত, হা/৪৫১, বাংলা অনুবাদ, এমদাদিয় ২/১১৭।
[16]. মুসনাদে আহমাদ, ২/২৭, আবু দাউদ, হা/৬৩, মিশকাত, হা/৪৪৭, বাংলা অনুবাদ, এমদাদিয়া ২/১১৪।
[17]. বুখারী, হা/১৭২, মুসলিম, হা/২৭৯, মিশকাত, হা/৪৫৮, বাংলা অনুবাদ, এমদাদিয়া ২/১২১।