পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণ সমূহ (২য় কিস্তি)

গোনাহে জড়িয়ে পড়ার কারণ সমূহ :

শয়তানের কুমন্ত্রণা, প্রবৃত্তি পরায়ণতা ও নফসে আম্মারার ধোঁকা ইত্যাদি কারণে মানুষ গোনাহে জড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও নানা কারণে মানুষ পাপাচারে লিপ্ত হয়ে থাকে। নিম্নে পাপে জড়িয়ে পড়ার কিছু কারণ উল্লেখ করা হ’ল।-

১. প্রবৃত্তির অনুসরণ :

মানুষকে যেসব জিনিস পাপে লিপ্ত করে তন্মধ্যে অন্যতম হ’ল প্রবৃত্তির অনুসরণ। আর মনে যা চায় সে অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে প্রবৃত্তির অনুসরণ।[1] প্রবৃত্তির পূজারী হওয়া থেকে সাবধান করে কুরআনে বহু আয়াত নাযিল হয়েছে। আল্লাহ বলেন,قُلْ إِنِّي نُهِيتُ أَنْ أَعْبُدَ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللهِ قُلْ لآ أَتَّبِعُ أَهْوَآءَكُمْ قَدْ ضَلَلْتُ إِذًا وَّمَآ أَنَا مِنَ الْمُهْتَدِينَ- ‘তুমি (কাফেরদের) বলে দাও যে, আল্লাহকে ছেড়ে তোমরা যাদের আহবান কর, তাদের ইবাদত করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে। বলে দাও যে, আমি তোমাদের খেয়াল-খুশীর (প্রবৃত্তির) অনুসরণ করব না। তাতে আমি পথভ্রষ্ট হয়ে যাব এবং সুপথ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত থাকবো না’ (আন‘আম ৬/৫৬)

আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে ধমক দিয়ে বলেন,أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنْتَ تَكُونُ عَلَيْهِ وَكِيلاً؟ ‘তুমি কি তাকে দেখেছ, যে তার প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছে? তুমি কি তার যিম্মাদার হবে?’ (ফুরক্বান ২৫/৪৩)। তিনি স্বীয় রাসূলকে নিষেধ করে বলেন, وَلاَ تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا- ‘তুমি ঐ ব্যক্তির আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমরা আমাদের স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং সে তার খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে ও তার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে গেছে’ (কাহ্ফ ১৮/২৮)। তিনি আরো বলেন,فَاعْلَمْ أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهْوَاءَهُمْ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِنَ اللهِ إِنَّ اللهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ ‘জেনে রাখ যে, তারা কেবল তাদের খেয়াল-খুশীর (প্রবৃত্তির) অনুসরণ করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হেদায়াতকে অগ্রাহ্য করে নিজের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে, তার চাইতে বড় পথভ্রষ্ট আর কে আছে? নিশ্চয়ই আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (ক্বাছাছ ২৮/৫০)

মহান আল্লাহ দাঊদ (আঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন,يَادَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُمْ بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَى فَيُضِلَّكَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ إِنَّ الَّذِينَ يَضِلُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ بِمَا نَسُوا يَوْمَ الْحِسَابِ، ‘হে দাঊদ! আমরা তোমাকে পৃথিবীতে শাসক নিযুক্ত করেছি। অতএব তুমি লোকদের মধ্যে ন্যায়বিচার কর। আর তুমি প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তাহ’লে তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয়ই যারা বিচার দিবসকে ভুলে যাওয়ার কারণে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি’ (ছোয়াদ ৩৮/২৬)

মহান আল্লাহ আহলে কিতাবদের উদ্দেশ্য করে বলেন,قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لاَ تَغْلُواْ فِي دِينِكُمْ غَيْرَ الْحَقِّ وَلاَ تَتَّبِعُواْ أَهْوَاء قَوْمٍ قَدْ ضَلُّواْ مِن قَبْلُ وَأَضَلُّواْ كَثِيرًا وَضَلُّواْعَن سَوَاء السَّبِيلِ ‘তুমি বল, হে আহলে কিতাবগণ! তোমরা তোমাদের দ্বীনে অন্যায়ভাবে বাড়াবাড়ি করো না এবং ঐসব লোকদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না, যারা ইতিপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে ও বহু লোককে পথভ্রষ্ট করেছে এবং নিজেরা সরল পথ থেকে বিচ্যুৎ হয়েছে’ (মায়েদাহ ৫/৭৭)

প্রবৃত্তির পূজারী হওয়াকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ধ্বংসকারী বস্ত্ত বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,ثَلاَثٌ مُنْجِيَاتٌ وَثَلاَثٌ مُهْلِكَاتٌ- فَأَمَّا الْمُنْجِيَاتُ : فَتَقْوَى اللهِ فِي السِّرِّ وَالْعَلاَنِيَةِ، وَالْقَوْلُ بِالْحَقِّ فِي الرِضَا وَالسَّخَطِ، وَالْقَصْدُ فِي الْغِنَى وَالْفَقْرِ، وَأَمَّا الْمُهْلِكَاتُ : فَهَوًى مُتَّبَعٌ، وَشُحٌّ مُطَاعٌ، وَإِعْجَابُ الْمَرْءِ بِنَفْسِهِ، وَهِيَ أَشَدُّهُنَّ- ‘তিনটি বস্ত্ত মুক্তিদানকারী ও তিনটি বস্ত্ত ধ্বংসকারী। মুক্তিদানকারী তিনটি বস্ত্ত হ’ল (১) গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় করা (২) সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টিতে সত্য কথা বলা (৩) সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। আর ধ্বংসকারী তিনটি বস্ত্ত হ’ল (১) প্রবৃত্তি পূজারী হওয়া (২) লোভের দাস হওয়া এবং (৩) আত্ম অহংকারী হওয়া। আর এটিই হ’ল সবচেয়ে মারাত্মক’।[2] তিনি অন্যত্র বলেন,

تُعْرَضُ الْفِتَنُ عَلَى الْقُلُوبِ كَالْحَصِيرِ عُودًا عُودًا، فَأَيُّ قَلْبٍ أُشْرِبَهَا، نُكِتَ فِيهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ، وَأَيُّ قَلْبٍ أَنْكَرَهَا، نُكِتَ فِيهِ نُكْتَةٌ بَيْضَاءُ، حَتَّى تَصِيرَ عَلَى قَلْبَيْنِ، عَلَى أَبْيَضَ مِثْلِ الصَّفَا فَلَا تَضُرُّهُ فِتْنَةٌ مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ، وَالْآخَرُ أَسْوَدُ مُرْبَادًّا كَالْكُوزِ، مُجَخِّيًا لَا يَعْرِفُ مَعْرُوفًا، وَلَا يُنْكِرُ مُنْكَرًا، إِلَّا مَا أُشْرِبَ مِنْ هَوَاهُ،

‘মানুষের হৃদয়ে ফিতনাসমূহ এমনভাবে প্রবেশ করে, যেমন অাঁশ একটির পর আরেকটি বিছানো হয়ে থাকে এবং যেই হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা প্রবেশ করে তাতে একটি কালো দাগ পড়ে। আর যে অন্তর তাকে জায়গা দেয় না, তাতে একটি সাদা দাগ পড়ে। ফলে মানুষের অন্তরসমূহ পৃথক পৃথক দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একপ্রকার অন্তর হয় মর্মর পাথরের মতো শ্বেত, যাকে আসমান ও যমীন বহাল থাকা পর্যন্ত (ক্বিয়ামত পর্যন্ত) কোন ফিতনাই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে না। অপরদিকে দ্বিতীয় প্রকার অন্তর হয় কয়লার মতো কালো। যেমন উপুড় হওয়া পাত্রের মতো, যাতে কিছুই ধারণ করার ক্ষমতা থাকে না। তা ভালোকে ভালো জানার এবং মন্দকে মন্দ জানার ক্ষমতা রাখে না। ফলে শুধুমাত্র তাই গ্রহণ করে যা তার প্রবৃত্তির চাহিদা হয়’।[3]

তিনি আরো বলেন, وَإِنَّهُ سَيَخْرُجُ فِى أُمَّتِى أَقْوَامٌ تَجَارَى بِهِمْ تِلْكَ الأَهْوَاءُ كَمَا يَتَجَارَى الْكَلْبُ بِصَاحِبِهِ لاَ يَبْقَى مِنْهُ عِرْقٌ وَلاَ مَفْصِلٌ إِلاَّ دَخَلَهُ. ‘আর আমার উম্মতের মধ্যে কয়েকটি দলের উদ্ভব হবে যাদের শরীরে এমন কুপ্রবৃত্তি ছড়াবে যেমনভাবে জলাতংক রোগ রোগীর সমগ্র শরীরে সঞ্চারিত হয়। তার কোন শিরা-উপশিরা বাকী থাকে না, যাতে তা সঞ্চারিত হয় না’।[4]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দো‘আ করে বলতেন,اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ مُّنْكَرَاتِ الْأَخْلاَقِ وَالْأَعْمَالِ وَالْأَهْوَاءِ- ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকটে পানাহ চাচ্ছি অন্যায় চরিত্র, কর্ম ও প্রবৃত্তি পূজা হ’তে’।[5]

আলী (রাঃ) বলেন,إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَتَخَوَّفُ عَلَيْكُمُ اثْنَتَانِ : طُولُ الْأَمَلِ، وَاتِّبَاعُ الْهَوَى، فَأَمَّا طُولُ الْأَمَلِ فَيُنْسِي الْآخِرَةَ، وَأَمَّا اتِّبَاعُ الْهَوَى فَيَصُدُّ عَنِ الْحَقِّ- ‘আমি তোমাদের ব্যাপারে সবচেয়ে ভীত হই দু’টি বিষয়ে। দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষা ও প্রবৃত্তিপূজা। দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষা মানুষকে আখেরাত ভুলিয়ে দেয়। অতঃপর প্রবৃত্তি পূজা মানুষকে সত্য থেকে বিরত রাখে’।[6]

আল্লাহ প্রবৃত্তির অনুসারীদের উদাহরণ দিয়ে বলেন,

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِيَ آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ، وَلَوْ شِئْنَا لَرَفَعْنَاهُ بِهَا وَلَكِنَّهُ أَخْلَدَ إِلَى الأَرْضِ وَاتَّبَعَ هَوَاهُ فَمَثَلُهُ كَمَثَلِ الْكَلْبِ إِن تَحْمِلْ عَلَيْهِ يَلْهَثْ أَوْ تَتْرُكْهُ يَلْهَث ذَّلِكَ مَثَلُ الْقَوْمِ الَّذِينَ كَذَّبُواْ بِآيَاتِنَا فَاقْصُصِ الْقَصَصَ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ-

‘আর তুমি তাদেরকে সেই ব্যক্তির কথা শুনিয়ে দাও, যাকে আমরা আমাদের অনেক নিদর্শন (নে‘মত) প্রদান করেছিলাম। কিন্তু সে তা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ফলে শয়তান তার পিছু নেয় এবং সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। যদি আমরা চাইতাম তাহ’লে উক্ত নিদর্শনাবলী অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমে অবশ্যই তার মর্যাদা আরও উন্নত করতে পারতাম। কিন্তু সে মাটি আঁকড়ে রইল ও নিজ প্রবৃত্তির অনুসারী হ’ল। তার দৃষ্টান্ত হ’ল কুকুরের মত। যদি তুমি তাকে তাড়িয়ে দাও তবুও হাঁপাবে, আর যদি ছেড়ে দাও তবুও হাঁপাবে। এটি হ’ল সেই সব লোকদের উদাহরণ যারা আমাদের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করে। অতএব তুমি এদের কাহিনী বর্ণনা কর, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে’ (আ‘রাফ ৭/১৭৫-৭৬)

সত্যাশ্রয়ীরা প্রবৃত্তিপূজারী হ’লে গোমরাহী বিস্তৃতি লাভ করত এবং ভূমন্ডল ও নভোমন্ডলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়তো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَوِ اتَّبَعَ الْحَقُّ أَهْوَاءهُمْ لَفَسَدَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ وَمَن فِيهِنَّ، ‘বস্ত্ততঃ সত্য যদি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসারী হ’ত, তাহ’লে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল এবং এর মধ্যবর্তী সবকিছু ধ্বংস হয়ে যেত’ (মুমিনূন ২৩/৭১)

২. অজ্ঞতা বা জ্ঞানহীনতা :

আল্লাহ আমাদের স্রষ্টা, রিযিকদাতা, প্রতিপালক, নিয়ন্ত্রক। তাঁর বিধান মানা ও তাঁর ইবাদত করা বান্দার জন্য আবশ্যক। আর ইলম না থাকলে আল্লাহর বিধান জানা ও মানা যেমন সম্ভব নয়, তদ্রূপ দ্বীনি জ্ঞান না থাকলে সঠিকভাবে আমল করাও অসম্ভব। আল্লাহ বলেন, وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَعْبُدُ اللهَ عَلَى حَرْفٍ فَإِنْ أَصَابَهُ خَيْرٌ اطْمَأَنَّ بِهِ وَإِنْ أَصَابَتْهُ فِتْنَةٌ انْقَلَبَ عَلَى وَجْهِهِ خَسِرَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةَ ذَلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ، ‘লোকেদের মধ্যে কেউ কেউ (কপট বিশ্বাসী ও সুবিধাবাদীরা) আল্লাহর ইবাদত করে দ্বিধার সাথে। তাকে কল্যাণ স্পর্শ করলে শান্ত হয় এবং বিপর্যয় স্পর্শ করলে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর সেটাই হ’ল তার সুস্পষ্ট ক্ষতি’ (হজ্জ ২২/১১)। অতএব শারঈ জ্ঞানার্জন করা অতি যরূরী। এর মাধ্যমে দ্বীন পালন করা ও ইবাদত করা সহজ হয়। পক্ষান্তরে অজ্ঞতার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। অজ্ঞতার পরিণতি সম্পর্কে হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا، يَنْتَزِعُهُ مِنَ الْعِبَادِ، وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ، حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا، اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالاً فَسُئِلُوا، فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ، فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا-

‘আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অন্তর থেকে ইলম ছিনিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ইলম তুলে নিবেন না, বরং আলেমদের উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ইলমকে উঠিয়ে নিবেন। এমনকি যখন কোন আলেম অবশিষ্ট থাকবে না তখন লোকেরা মূর্খদেরকেই নেতা বানিয়ে নিবে। তারা তাদেরকে (দ্বীনের বিষয়ে) জিজ্ঞেস করবে। অতঃপর তারা অজ্ঞতা সত্ত্বেও ফৎওয়া প্রদান করবে। ফলে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে এবং অন্যকেও পথভ্রষ্ট করবে’।[7]

বস্ত্তত এই অজ্ঞতা পাপে লিপ্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। আবুল আলিয়াহ (রহঃ) বলেন,أَنَّ أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم كَانُوا يَقُولُونَ: كُلُّ ذَنْبٍ أَصَابَهُ عَبْدٌ فَهُوَ بِجَهَالَةٍ. ‘ছাহাবায়ে কেরাম বলতেন, বান্দা যে পাপেই লিপ্ত হয়, তা অজ্ঞতার কারণেই’।[8] মুজাহিদ বলেন,كُلُّ مَنْ عَصَى اللهَ خَطَأً أَوْ عَمدًا فَهُوَ جَاهِلٌ حَتَّى يَنْزِعَ عَنِ الذَّنْبِ ‘যে ব্যক্তিই ভুলবশত কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহর নাফরমানী করে সে অজ্ঞ, যতক্ষণ না সে পাপ থেকে বিরত হয়’।[9] ক্বাতাদাহ (রহঃ) বলেন,اجْتَمَعَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَرَأَوْا أَنَّ كُلَّ شَيْءٍ عُصي بِهِ فَهُوَ جَهَالَةٌ، عَمْدًا كَانَ أَوْ غَيْرَهُ، ‘রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ এ সিদ্ধান্তে একমত হয়েছেন যে, প্রত্যেক ঐ জিনিস যার দ্বারা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় (আল্লাহর) নাফরমানী করা হয়, তা অজ্ঞতা’।[10]

৩. শয়তানের প্ররোচনা :

মানুষকে পাপের পথে নেওয়ার জন্য শয়তান সব সময় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মানব শিশু জন্মের সাথে সাথেই শয়তান তাকে আঘাত করে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَا مِنْ مَوْلُوْدٍ يُوْلَدُ إِلاَّ وَالشَّيْطَانُ يَمَسُّهُ حِيْنَ يُوْلَدُ فَيَسْتَهِلُّ صَارِخًا مِنْ مَسِّ الشَّيْطَانِ إِيَّاهُ إِلاَّ مَرْيَمَ وَابْنَهَا- ‘প্রত্যেক শিশুসন্তান জন্মগ্রহণ করার সময় শয়তান তাকে স্পর্শ করে। শয়তানের স্পর্শমাত্রই সে চিৎকার করে উঠে। কিন্তু মারিয়াম (আঃ) ও তাঁর পুত্র ঈসা (আঃ)-কে পারেনি’।[11]

জন্মের সময়ে প্রত্যেকেই দ্বীনের উপর থাকে কিন্তু শয়তান তাকে সত্য দ্বীন থেকে বিচ্যুত করে দেয়। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ বলেন,وَإِنِّيْ خَلَقْتُ عِبَادِيْ حُنَفَاءَ كُلَّهُمْ وَإِنَّهُمْ أَتَتْهُمْ الشَّيَاطِيْنُ فَاجْتَالَتْهُمْ عَنْ دِيْنِهِمْ- ‘আমি আমার বান্দাদের ‘হানীফ’ (আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ) রূপে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর শয়তান তাদের কাছে আসে এবং তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে দূরে নিয়ে যায়’।[12]

এমনিভাবে শয়তান প্রত্যেক মানুষকে জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এমনকি মৃত্যুর সময়ও ধোঁকা দিয়ে থাকে। তাই আল্লাহ দুনিয়াতে মানুষকে প্রেরণ করে আল্লাহর অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ থেকে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,وَلاَ تَتَّبِعُواْ خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ- ‘তোমরা শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না, নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (বাক্বারাহ ২/১৬৮, ২০৮; আন‘আম ৬/১৪২)। মানুষকে আল্লাহর ওয়াদা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁর ইবাদত করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন,أَلَمْ أَعْهَدْ إِلَيْكُمْ يَا بَنِيْ آدَمَ أَن لاَّ تَعْبُدُوْا الشَّيْطَانَ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ، وَأَنِ اعْبُدُوْنِيْ هَذَا صِرَاطٌ مُّسْتَقِيْمٌ، وَلَقَدْ أَضَلَّ مِنْكُمْ جِبِلاًّ كَثِيْراً أَفَلَمْ تَكُوْنُوْا تَعْقِلُوْنَ- ‘হে বনু আদম! আমি কি তোমাদেরকে বলে রাখিনি যে, শয়তানের ইবাদত করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু এবং আমার ইবাদত কর। এটাই সরল পথ। শয়তান তোমাদের অনেক দলকে পথভ্রষ্ট করেছে। তবুও কি তোমরা বুঝ না?’ (ইয়াসীন ৩৬/৬০-৬২)। শয়তান মানুষকে সব সময় জাহান্নামে নিতে চায়। তাই আমাদের উচিৎ শয়তান থেকে সচেতন থাকা ও একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর অনুসরণ করা।

মানুষকে বিপথগামী করার মাধ্যমে তাদেরকে শয়তান জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوْهُ عَدُوّاً إِنَّمَا يَدْعُو حِزْبَهُ لِيَكُوْنُوْا مِنْ أَصْحَابِ السَّعِيْرِ- ‘শয়তান তোমাদের শত্রু। সুতরাং তাকে শত্রু হিসাবে গ্রহণ কর। সে তো তার দলবলকে আহবান করে শুধু এজন্য যে, তারা যেন জাহান্নামী হয়’ (ফাতির ৩৫/৬)

ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন,خَطَّ لَنَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم خَطًّا ثُمَّ قَالَ هَذَا سَبِيلُ اللهِ ثُمَّ خَطَّ خُطُوطاً عَنْ يَمِينِهِ وَعَنْ شِمَالِهِ ثُمَّ قَالَ هَذِهِ سُبُلٌ قَالَ يَزِيدُ مُتَفَرِّقَةٌ عَلَى كُلِّ سَبِيلٍ مِنْهَا شَيْطَانٌ يَدْعُو إِلَيْهِ. ثُمَّ قَرَأَ (وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِى مُسْتَقِيماً فَاتَّبِعُوهُ وَلاَ تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ). ‘আমাদের জন্য রাসূল (ছাঃ) একটা দাগ টানলেন, অতঃপর বললেন, ‘এটা আল্লাহ তা‘আলার সোজা ও সঠিক রাস্তা। অতঃপর তার ডানে ও বামে আরো কিছু দাগ টানলেন। তারপর বললেন, এগুলিও রাস্তা, যাদের প্রত্যেকটাতে শয়তান বসে মানুষদেরকে তার দিকে ডাকছে। তারপর তিনি তেলাওয়াত করলেন, ‘আর এটিই আমার সরল পথ। অতএব তোমরা এ পথেরই অনুসরণ কর। অন্যান্য পথের অনুসরণ করো না। তাহ’লে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুৎ করে দিবে’ (আন‘আম ৬/১৫৩)[13]

শয়তান পাপ কাজকে মানুষের কাছে সুশোভিত করে উপস্থাপন করে, যাতে মানুষ সে দিকে আকৃষ্ট হয়। আল্লাহ বলেন,وَلَكِنْ قَسَتْ قُلُوْبُهُمْ وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ مَا كَانُواْ يَعْمَلُوْنَ- ‘বস্ত্ততঃ তাদের অন্তর কঠোর হয়ে গেল এবং শয়তান তাদের কাছে সুশোভিত করে দেখাল, যে কাজ তারা করছিল’ (আন‘আম ৬/৪৩)। হুদহুদ পাখি সুলায়মান (আঃ)-কে রাণী বিলকীসের জাতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিল,وَجَدتُّهَا وَقَوْمَهَا يَسْجُدُوْنَ لِلشَّمْسِ مِنْ دُوْنِ اللهِ وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ فَصَدَّهُمْ عَنِ السَّبِيْلِ فَهُمْ لاَ يَهْتَدُوْنَ- ‘আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদা করছে। শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যাবলী সুশোভিত করে দিয়েছে। অতঃপর তাদেরকে সৎপথ থেকে নিবৃত্ত করেছে। অতঃপর তারা সৎ পথ পায় না’ (নামল ২৭/২৪)

অনুরূপভাবে আদ ও ছামূদ জাতি সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, وَعَادًا وَثَمُودَ وَقَدْ تَبَيَّنَ لَكُمْ مِنْ مَسَاكِنِهِمْ وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ فَصَدَّهُمْ عَنِ السَّبِيلِ وَكَانُوا مُسْتَبْصِرِينَ ‘আর আমরা ‘আদ ও ছামূদ জাতিকে ধ্বংস করেছি। তাদের পরিত্যক্ত বাড়ী সমূহ তোমাদের জন্য এর সুস্পষ্ট প্রমাণ। তাদের অপকর্মগুলিকে শয়তান তাদের নিকট শোভনীয় করেছিল। তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বাধা দিয়েছিল। অথচ তারা ছিল বিচক্ষণ ব্যক্তি’ (আনকাবূত ২৯/৩৮)। এভাবে শয়তান বিভিন্ন ধরনের কুমন্ত্রণা দিয়ে বান্দাকে আল্লাহ বিমুখ করতে সর্বদা সচেষ্ট থাকে। এমনকি ছালাতে দাঁড়ালে একাগ্রতা নষ্ট করে দেয়। যেহেতু ইবলীস মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করেছে, তাই সে সর্বদা মানুষকে ভালো কাজ থেকে বাধা দিয়ে থাকে এবং পাপে লিপ্ত করতে সচেষ্ট হয়।

৪. অসৎ সঙ্গী-সাথী :

পাপে লিপ্ত হওয়ার অন্যতম আরেকটি কারণ হ’ল অসৎ সঙ্গী-সাথী বা বন্ধু-বান্ধব। এজন্য মন্দ ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব করা যাবে না। এতে ইহকালীন জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং পরকালীন জীবনে জাহান্নামী হওয়ার উপলক্ষ তৈরী হবে। আল্লাহ বলেন,الْأَخِلَّاءُ يَوْمَئِذٍ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ إِلَّا الْمُتَّقِينَ، ‘বন্ধুরা সেদিন পরস্পরে শত্রু হবে মুত্তাক্বীরা ব্যতীত’ (যুখরুফ ৪৩/৬৭)। এজন্য রাসূল (ছাঃ) মন্দ বন্ধু থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন এভাবে,اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ جَارِ السُّوْءِ، وَمِنْ زَوْجٍ تُشَيِّبُنِيْ قَبْلَ الْمَشِيْبِ، وَمِنْ وَلَدٍ يَكُوْنُ عَلَيَّ رِبًا، وَمِنْ مَالٍ يَكُوْنُ عَلَيَّ عَذَابًا، وَمِنْ خَلِيْلٍ مَاكِرٍ عَيْنُهُ تَرَانِيْ وَقَلْبُهُ تَرْعَانِيْ إِنْ رَأَى حَسَنَةً دَفَنَهَا، وَإِذَا رَأَى سَيِّئَةً أَذَاعَهَا- ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি মন্দ প্রতিবেশী থেকে এমন স্ত্রী থেকে যে বার্ধক্য আসার পূর্বেই আমাকে বৃদ্ধ করে দেয়। এমন পুত্র সন্তান থেকে যে আমার উপর মাতববরি করে। এমন সম্পদ থেকে যা আমার আযাবের কারণ হয় এবং এমন ধোঁকাবাজ বন্ধু থেকে যার চোখ আমাকে দেখে আর তার অন্তর আমাকে পর্যবেক্ষণ করে। সে ভালো কিছু দেখলে তা গোপন করে। আর মন্দ কিছু দেখলে তা প্রচার করে’।[14]

অসৎসঙ্গী বা অসৎবন্ধুর খপ্পরে পড়ে মানুষ পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। দুনিয়াতে তার বোধোদয় হয় না। কিন্তু পরকালে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে আফসোস করা ব্যতীত কোন উপায় থাকবে না। আল্লাহ বলেন,وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلًا، يَا وَيْلَتَى لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِيلًا، لَقَدْ أَضَلَّنِي عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَاءَنِي وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنْسَانِ خَذُولًا، ‘যালেম সেদিন নিজের দু’হাত কামড়ে বলবে, হায়! যদি (দুনিয়াতে) রাসূলের পথ অবলম্বন করতাম! হায় দুর্ভোগ আমার! যদি আমি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! আমার কাছে উপদেশ (কুরআন) আসার পর সে আমাকে পথভ্রষ্ট করেছিল। বস্ত্ততঃ শয়তান মানুষের জন্য পথভ্রষ্টকারী’ (ফুরক্বান ২৫/২৭-২৯)

পাপীকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করা উচিত নয়। কেননা তার সাথে চলাফেরা করার কারণে সৎকর্মশীল ব্যক্তি ও ঐ মন্দ ব্যক্তির দ্বারা প্রভাবিত হ’তে পারে। এ ব্যাপারে সতর্ক করে আল্লাহ বলেন,فَأَعْرِضْ عَنْ مَنْ تَوَلَّى عَنْ ذِكْرِنَا وَلَمْ يُرِدْ إِلَّا الْحَيَاةَ الدُّنْيَا، ‘অতএব তুমি তাকে এড়িয়ে চল যে আমাদের স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং যে পার্থিব জীবন ছাড়া কিছুই কামনা করে না’ (নাজম ৫৩/২৯)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, الرَّجُلُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ، ‘মানুষ তার বন্ধুর রীতিনীতির (দ্বীনের) অনুসারী হয়। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকেই যেন লক্ষ্য করে, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে’।[15]

ওমর (রাঃ) বলেন,اعتزل عدوك، واحذر صديقك إلا الأمين من القوم، ولا أمين إلا من خشي الله، فلا تصحب الفاجر فتتعلم من فجوره، ولا تطلعه على سرك، واستشر في أمرك الذين يخافون الله تعالى. ‘তুমি তোমার শত্রু থেকে দূরে যাও, তোমার বন্ধুর ব্যাপারে সাবধান হও, তবে কওমের বিশ্বস্ত ব্যক্তি ব্যতীত। আর যে আল্লাহকে ভয় করে সে ব্যতীত কেউ বিশ্বস্ত হয় না। অতএব তুমি পাপীকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না, তাহ’লে তার পাপাচার তুমি শিখবে। তোমার গোপন বিষয় তাকে অবহিত করো না। তোমার কাজের ব্যাপারে তাদের কাছে পরামর্শ কর, যারা আল্লাহকে ভয় করে’।[16]

ইবনু কুদামা (রহঃ) বলেন, পাঁচটি স্বভাব বন্ধুর মাঝে প্রভাব বিস্তার করে-

১. জ্ঞান : এটা সম্পদের মূল। নির্বোধের সাহচর্যে কোন কল্যাণ নেই। কেননা সে তোমার উপকার করতে চেয়ে ক্ষতি করে ফেলবে। ২. উত্তম চরিত্র : এটা আবশ্যকীয় বিষয়। কেননা অনেক জ্ঞানী ব্যক্তির উপরে তার ক্রোধ ও প্রবৃত্তি বিজয়ী হয়, ফলে সে প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। সুতরাং তার সাহচর্যে কোন কল্যাণ নেই। ৩. নিষ্পাপ : কেননা ফাসেক বা পাপী আল্লাহকে ভয় করে না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে না, তার শত্রুতা থেকে তুমি নিরাপত্তা লাভ করবে না এবং বিশ্বস্ত হয় না। যে ব্যক্তি প্রথম নে‘আমতদাতার (আল্লাহর) সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে সে কখনও তোমার আমানত রক্ষা করবে না। ৪. বিদ‘আতী নয় : কেননা বিদ‘আতীর সাহচর্যকে ভয় করা হয়। কারণ তার সাথে তোমার সাহচর্যে রয়েছে সার্বিক অনিষ্ট। হয় সে বিদ‘আত গোপন করবে অথবা বিদ‘আত (পরিহারে) অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করবে কিংবা তার থেকে তুমি বিদ‘আত শিখবে, যা তোমাকে অধঃমুখী (ধ্বংস) করবে। ৫. দুনিয়ার প্রতি লোভহীনতা : সম্পদের প্রতি লোভ দ্বীনকে এত ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে, যেভাবে ক্ষুধার্ত নেকড়েকে মেষপালের মধ্যে ছেড়ে দিলে ক্ষতি করে। অর্থাৎ সে নেপথ্যে থেকে সুস্পষ্ট ক্ষতি করবে’।[17]

৫. উদাসীনতা :

আল্লাহ তাঁর ইবাদতের জন্য মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার জন্য আসমান-যমীনের সবকিছু অনুগত করে দিয়েছেন। তাদের জান্নাতের প্রতি অনুপ্রাণিত এবং জাহান্নাম থেকে সতর্ক করেছেন। তিনি মৃত্যু পরবর্তী জীবনে বিভিষিকা ও বিপদ-মুছীবতের বিষয়ও বিবৃত করেছেন। কিন্তু মানুষ সেসব ভুলে যায় এবং উদাসীনতায় গা ভাষিয়ে দেয়। আল্লাহ বলেন, اقْتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمْ وَهُمْ فِي غَفْلَةٍ مُعْرِضُونَ، مَا يَأْتِيهِمْ مِنْ ذِكْرٍ مِنْ رَبِّهِمْ مُحْدَثٍ إِلَّا اسْتَمَعُوهُ وَهُمْ يَلْعَبُونَ، ‘মানুষের হিসাব-নিকাশের সময় আসন্ন। অথচ তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে আছে। যখনই তাদের নিকট তাদের পালনকর্তার পক্ষ হ’তে কোন নতুন উপদেশ আসে, তখনই তারা খেলাচ্ছলে তা কান লাগিয়ে শোনে’ (আম্বিয়া ২১/১-২)। মানুষ বিভিন্ন কারণে গাফেল বা উদাসীন হয়। যেমন খারাপ বন্ধু-বান্ধব বা সঙ্গী-সাথীর প্রভাব (ফুরক্বান ২৫/২৭-২৯) ও শয়তানের প্ররোচনায় (আ‘রাফ ৭/২০০-২০২)। মানুষ আল্লাহর ইবাদত, তাঁর নিদর্শনসমূহ, পরকালের জবাবদিহিতা, মৃত্যুর ভয় প্রভৃতি থেকে উদাসীন থাকে। এই উদাসীনতাই বান্দাকে পাপে লিপ্ত করে, অন্তরকে নষ্ট করে, অন্তরে কুমন্ত্রণা ও খারাপ চিন্তার উদ্রেক করে। উদাসীনতা মানুষকে কর্মবিমুখ, দায়িত্বহীন এবং ভবিষ্যতের জন্য পাথেয় সঞ্চয় থেকে দূরে রাখে। আল্লাহর ইবাদত ও যিকর থেকে গাফেল অন্তরে শয়তান জায়গা করে নেয় এবং সে ঐ ব্যক্তির সঙ্গী হয়ে যায়। তার নিকটে শয়তান মন্দ কাজকে সুশোভিত করে তোলে। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَعْشُ عَنْ ذِكْرِ الرَّحْمَنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ، ‘যে ব্যক্তি দয়াময়ের স্মরণ থেকে অন্ধ হয়, আমরা তার জন্য এক শয়তানকে নিযুক্ত করি, যে তার সাথী হয়’ (যুখরুফ ৪৩/৩৬)

বস্ত্তত আল্লাহ, তাঁর আদেশ-নিষেধ, গোনাহের দুনিয়াবী ও পরকালীন শাস্তি, পরকালে জান্নাত-জাহান্নাম, আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ, আল্লাহর সৃষ্টির পার্থিব নিদর্শন ও কুরআনী আয়াত সমূহ সম্পর্কে গাফেলতী বা উদাসীনতা এবং দুনিয়ার প্রতি আসক্তি মানুষকে গোনাহে নিমজ্জিত করে। আর তাদের এই উদাসীনতা ও কুফরীর কারণে জাহান্নামে তাদের ঠিকানা নির্ধারিত হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ لَا يَرْجُونَ لِقَاءَنَا وَرَضُوا بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَاطْمَأَنُّوا بِهَا وَالَّذِينَ هُمْ عَنْ آيَاتِنَا غَافِلُونَ، أُولَئِكَ مَأْوَاهُمُ النَّارُ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ، ‘নিশ্চয়ই যারা আমাদের সাথে সাক্ষাতের আশা করে না এবং পার্থিব জীবন নিয়ে তৃপ্ত থাকে ও তার মধ্যেই নিশ্চিন্ত হয় এবং যারা আমাদের নিদর্শনাবলী সম্পর্কে উদাসীন থাকে; সেসব লোকদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম, তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল হিসাবে’ (ইউনুস ১০/৭-৮)

গাফেলতীর কারণে ধ্বংস-বিনাশ অবধারিত হয়, অন্তর কলুষিত হয়, অবাধ্যতা ও সীমালংঘনে লিপ্ত হয়। ফলে আল্লাহর আযাব নাযিল হয়। ফেরাঊন ও তার কওম সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,فَلَمَّا كَشَفْنَا عَنْهُمُ الرِّجْزَ إِلَى أَجَلٍ هُمْ بَالِغُوهُ إِذَا هُمْ يَنْكُثُونَ، فَانْتَقَمْنَا مِنْهُمْ فَأَغْرَقْنَاهُمْ فِي الْيَمِّ بِأَنَّهُمْ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَكَانُوا عَنْهَا غَافِلِينَ، ‘অতঃপর যখনই আমরা তাদের থেকে আযাব উঠিয়ে নিতাম একটা নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে যাওয়ার পর তখনই তারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করত। ফলে আমরা তাদের থেকে প্রতিশোধ নিলাম এবং তাদেরকে সাগরে ডুবিয়ে মারলাম। কারণ তারা আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করেছিল এবং তারা তার প্রতি উদাসীন ছিল’ (আ‘রাফ ৭/১৩৫-৩৬)

গাফেলতীর কারণে মানুষ দুনিয়াতে ক্ষতিগ্রস্ত ও পরকালে জান্নাত থেকে বঞ্চিত হয়। যাবতীয় কল্যাণ থেকে বিমুখ হয়, অন্তর গোমরাহ হয়, সে পশুর মত দুনিয়াতে জীবন যাপন করে। সে শুধু নিজের পানাহার, প্রবৃত্তির চাহিদা নিয়েই ভাবে। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ক্ষতি। আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرًا مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ لَهُمْ قُلُوبٌ لَا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَا يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لَا يَسْمَعُونَ بِهَا أُولَئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولَئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ، ‘আমরা বহু জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য। যাদের হৃদয় আছে কিন্তু বুঝে না। চোখ আছে কিন্তু দেখে না। কান আছে কিন্তু শোনে না। ওরা হ’ল চতুষ্পদ জন্তুর মতো, বরং তার চাইতেও পথভ্রষ্ট। ওরা হ’ল উদাসীন’ (আ‘রাফ ৭/১৭৯)

আল্লাহ মানুষকে গাফেলতী থেকে নিষেধ করেছেন, যাতে তারা শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ মেনে হেদায়াত লাভ করে উপকৃত হয়। তিনি বলেন,وَجَعَلْنَا لَهُمْ سَمْعًا وَأَبْصَارًا وَأَفْئِدَةً فَمَا أَغْنَى عَنْهُمْ سَمْعُهُمْ وَلَا أَبْصَارُهُمْ وَلَا أَفْئِدَتُهُمْ مِنْ شَيْءٍ إِذْ كَانُوا يَجْحَدُونَ بِآيَاتِ اللهِ وَحَاقَ بِهِمْ مَا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ، ‘আমরা তাদের দিয়েছিলাম কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয়। কিন্তু সেসব কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় তাদের কোন কাজে আসল না, যখন তারা আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার করল এবং সেই শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করল, যা নিয়ে তারা উপহাস করত’ (আহক্বাফ ৪৬/২৬)

[ক্রমশঃ]


[1]. রাগেব ইছফাহানী, আল-মুফরাদাত লিগরীবিল কুরআন, পৃঃ ৫৪৮।

[2]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৬৮৬৫; মিশকাত হা/৫১২২ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায়, ‘ক্রোধ ও অহংকার’ অনুচ্ছেদ; ছহীহাহ হা/১৮০২।

[3]. মুসলিম হা/১৪৪; ছহীহুত তারগীব হা/২৩১৯; মুসনাদে আহমাদ হা/২৩৩২৮; ছহীহুল জামে‘ হা/২৯৬০।

[4]. আহমাদ হা/১৬৪৯০; আবূ দাঊদ হা/৪৫৯৭; ছহীহুত তারগীব হা/৫১ মিশকাত হা/১৭২, সনদ হাসান।

[5]. তিরমিযী হা/৩৫৯১; মিশকাত হা/২৪৭১।

[6]. ইমাম আহমাদ, ফাযায়েলুছ ছাহাবা ক্রমিক ৮৮১।

[7]. বুখারী হা/১০০; মুসলিম হা/২৬৭৩; মিশকাত হা/২০৬।

[8]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ২/২৩৫।

[9]. তাফসীর তাবারী, ৮/৯০।

[10]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ২/২৩৫; তাফসীর তাবারী, ৮/৮৯।

[11]. বুখারী হা/ ৪১৮৯, ‘তাফসীর’ অধ্যায়; মুসলিম, মিশকাত হা/৬৯

[12]. মুসলিম হা/২৮৬৫ ‘জান্নাতের বিবরণ’ অধ্যায়; আহমাদ হা/১৬৮৩৭

[13]. আহমাদ হা/৪১৪২; দারেমী হা/২০২; নাসাঈ, হাকেম হা/৩২৪১; মিশকাত হা/১৬৬, সনদ হাসান।

[14]. ত্বাবারানী, ছহীহাহ হা/৩১৩৭।

[15]. আবুদাউদ হা/৪৮৩৩; তিরমিযী হা/২৩৭৮; মিশকাত হা/৫০১৯; ছহীহাহ হা/৯২৭।

[16]. আল-আদাবুল ইসলামিয়াহ, ১/৫০ পৃঃ; আল-মুনতাক্বা ১/৩২ পৃঃ।

[17]. আবু রহমাহ মুহাম্মাদ নাছীরুদ্দীন, ছাফওয়াতুল মাসাইল ফিত তাওহীদ ওয়াল ফিক্বহ ওয়াল ফাযাইল, ১/১৫২ পৃঃ।






বিষয়সমূহ: পাপ
ওয়াহ্হাবী আন্দোলন : উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ এবং মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব (৩য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
সফরের আদব - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
সমাজ সংস্কারে ফরায়েযী আন্দোলনের ভূমিকা - এডভোকেট জারজিস আহমাদ
রাসূল (ছাঃ)-এর দো‘আয় শামিল হওয়ার উপায় - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
হাদীছ অনুসরণে চার ইমামের গৃহীত নীতি ও কিছু সীমাবদ্ধতা পর্যালোচনা - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ক্বিয়ামতের আলামত সমূহ (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আরবী ভাষা কুরআন বুঝার চাবিকাঠি - ফাতেমা বিনতে আযাদ
ইসলামে ভ্রাতৃত্ব (২য় কিস্তি) - ড. এ এস এম আযীযুল্লাহ
আল-কুরআনের আলোকে ক্বিয়ামত (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণ সমূহ (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
১৬ মাসের মর্মান্তিক কারা স্মৃতি (৭ম কিস্তি) - মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম
আরও
আরও
.