পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । শেষ পর্ব ।
তায়াম্মুম সম্পর্কিত মাসআলা
التيمم -এর শাব্দিক অর্থ- القصد অর্থাৎ ইচ্ছা করা।
التيمم -এর পারিভাষিক অর্থ- আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট নিয়মে পবিত্র মাটি দ্বারা মুখমন্ডল ও উভয় হাত মাসাহ করার নাম তায়াম্মুম।[1]
التيمم-এর হুকুম : তায়াম্মুম ইসলামী শরী‘আতে জায়েয, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য বিশেষ ছাড়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَإِنْ كُنْتُمْ مَرْضَى أَوْ عَلَى سَفَرٍ أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ أَوْ لاَمَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوْا مَاءً فَتَيَمَّمُوْا صَعِيْدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوْا بِوُجُوْهِكُمْ وَأَيْدِيْكُمْ مِنْهُ مَا يُرِيْدُ اللهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُمْ مِنْ حَرَجٍ وَلَكِنْ يُرِيْدُ لِيُطَهِّرَكُمْ وَلِيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ-
‘আর যদি তোমরা অসুস্থ হও কিংবা সফরে থাক অথবা তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে আসে অথবা তোমরা স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর অতঃপর পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর। সুতরাং তোমাদের মুখ ও হাত তা দ্বারা মাসাহ কর। আল্লাহ তোমাদের উপর কোন সমস্যা সৃষ্টি করতে চান না, বরং তিনি চান তোমাদের পবিত্র করতে এবং তার নে‘মত তোমাদের উপর পূর্ণ করতে, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর’ (মায়েদাহ ৬)।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ ذَرٍّ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الصَّعِيْدُ الطَّيِّبُ وَضُوْءُ الْمُسْلِمِ وَإِنْ لَمْ يَجِدِ الْمَاءَ عَشْرَ سِنِيْنَ.
আবু যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘পবিত্র মাটি মুসলমানের জন্য পবিত্রকারী, যদিও সে দশ বছর পানি না পায়’।[2]
অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ حُذَيْفَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فُضِّلْنَا عَلَى النَّاسِ بِثَلاَثٍ جُعِلَتْ صُفُوْفُنَا كَصُفُوْفِ الْمَلاَئِكَةِ وَجُعِلَتْ لَنَا الأَرْضُ كُلُّهَا مَسْجِدًا وَجُعِلَتْ تُرْبَتُهَا لَنَا طَهُوْرًا إِذَا لَمْ نَجِدِ الْمَاءَ.
হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘সমগ্র মানব জাতির উপর আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে তিনটি বিষয়ে। আমাদের সারিকে করা হয়েছে ফেরেশতাদের সারির ন্যায়। সমস্ত ভূমন্ডলকে আমাদের জন্য সিজদার স্থান করা হয়েছে এবং মাটিকে করা হয়েছে আমাদের জন্য পবিত্রকারী, যখন আমরা পানি না পাই’।[3]
তায়াম্মুম ছহীহ হওয়ার পূর্বশর্ত সমূহ :
(ক) النية অর্থাৎ পানি না পেলে অযূর পরিবর্তে ছালাতের জন্য তায়াম্মুম-এর নিয়ত করা। কেননা তায়াম্মুম একটি ইবাদত, যা নিয়ত ছহীহ হওয়ার উপর নির্ভরশীল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى ‘নিশ্চয়ই প্রতিটি কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পায়’।[4] তবে ফরয ছালাতের নিয়তে তায়াম্মুম করতে হবে, তাহ’লে তাতে নফল এবং কাযা ছালাত আদায় করা বৈধ হবে। পক্ষান্তরে যদি নফল ছালাতের নিয়তে তায়াম্মুম করা হয় তাহ’লে তাতে ফরয ছালাত ছহীহ হবে না।[5] যেমন কেউ যদি তাহাজ্জুদ ছালাতের জন্য তায়াম্মুম করে, তাহ’লে ঐ তায়াম্মুম দ্বারা ফজরের ফরয ছালাত আদায় করা ছহীহ হবে না।
(খ) الإسلام অর্থাৎ ব্যক্তিকে মুসলিম হ’তে হবে। কেননা তায়াম্মুম হ’ল ইবাদত, যা কোন কাফিরের নিকট হ’তে আল্লাহ তা‘আলা গ্রহণ করবেন না।
(গ) العقل অর্থাৎ জ্ঞান সম্পন্ন হ’তে হবে। কেননা পাগল এবং অজ্ঞান ব্যক্তির উপর ইবাদত ওয়াজিব নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
رُفِعَ الْقَلَمُ عَنْ ثَلاَثَةٍ عَنِ النَّائِمِ حَتَّى يَسْتَيْقِظَ وَعَنِ الصَّبِىِّ حَتَّى يَحْتَلِمَ وَعَنِ الْمَجْنُوْنِ حَتَّى يَعْقِلَ.
‘তিন শ্রেণীর ব্যক্তির উপর থেকে আল্লাহ তা‘আলা কলম উঠিয়ে নিয়েছেন। ঘুমন্ত ব্যক্তি, যতক্ষণ পর্যন্ত সে জাগ্রত না হয়। শিশু, যতক্ষণ পর্যন্ত তার স্বপ্ন দোষ না হয় এবং পাগল, যতক্ষণ তার জ্ঞান ফিরে না আসে’।[6]
(ঘ) পানি ব্যবহারে অক্ষমতার শারঈ ওযর থাকা। অর্থাৎ শারঈ ওযরের কারণে পানি ব্যবহারে অক্ষম হ’লে তার উপর তায়াম্মুম করা ওয়াজিব। আর এই অক্ষমতা কয়েকভাবে হ’তে পারে। যেমন-
১- পানি না পাওয়া। অর্থাৎ যদি কোন ব্যক্তি ছালাতের সময় ওযূ করার জন্য পানি না পায়, তাহ’লে সে ব্যক্তি পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে ছালাত আদায় করতে পারবে। পানি বিদ্যমান থাকলে তার উপর তায়াম্মুম করা জায়েয নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَلَمْ تَجِدُوْا مَاءً فَتَيَمَّمُوْا صَعِيْدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوْا بِوُجُوْهِكُمْ وَأَيْدِيْكُمْ مِنْهُ ‘অতঃপর যদি পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর। সুতরাং তোমাদের মুখ ও হাত তা দ্বারা মাসাহ কর’ (মায়েদা ৬)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, الصَّعِيْدُ الطَّيِّبُ وَضُوْءُ الْمُسْلِمِ وَإِنْ لَمْ يَجِدِ الْمَاءَ عَشْرَ سِنِيْنَ. ‘পবিত্র মাটি মুসলমানের জন্য পবিত্রকারী, যদিও সে দশ বছর পানি না পায়’।[7]
২- অসুস্থতা বৃদ্ধি কিংবা সুস্থতা লাভ করতে বিলম্ব হওয়ার আশংকা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَإِنْ كُنْتُمْ مَرْضَى ‘আর যদি তোমরা অসুস্থ থাক, (তবে তায়াম্মুম করতে পার)। হাদীছে এসেছে,
عَنْ جَابِرٍ قَالَ خَرَجْنَا فِيْ سَفَرٍ فَأَصَابَ رَجُلاً مِنَّا حَجَرٌ فَشَجَّهُ فِيْ رَأْسِهِ ثُمَّ احْتَلَمَ فَسَأَلَ أَصْحَابَهُ فَقَالَ هَلْ تَجِدُوْنَ لِيْ رُخْصَةً فِيْ التَّيَمُّمِ فَقَالُوْا مَا نَجِدُ لَكَ رُخْصَةً وَأَنْتَ تَقْدِرُ عَلَى الْمَاءِ، فَاغْتَسَلَ فَمَاتَ فَلَمَّا قَدِمْنَا عَلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم أُخْبِرَ بِذَلِكَ، فَقَالَ قَتَلُوْهُ قَتَلَهُمُ اللهُ أَلاَّ سَأَلُوْا إِذْ لَمْ يَعْلَمُوْا فَإِنَّمَا شِفَاءُ الْعِىِّ السُّؤَالُ إِنَّمَا كَانَ يَكْفِيْهِ أَنْ يَتَيَمَّمَ وَيَعْصِرَ.
জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা আমরা এক সফরে বের হ’লাম। হঠাৎ আমাদের একজনের মাথায় একটা পাথরের চোট লাগল এবং তার মাথা জখম করে দিল। অতঃপর তার স্বপ্নদোষ হ’ল এবং সে তার সাথীদেরকে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কি এ অবস্থায় আমার জন্য তায়াম্মুমের অনুমতি আছে বলে মনে কর? তারা বলল, আমরা তোমার জন্য অনুমতি আছে বলে মনে করি না। কেননা তুমি পানি পাচ্ছ। সুতরাং সে গোসল করল আর এতে সে মারা গেল। অতঃপর আমরা যখন নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে আসলাম, তখন তাঁকে এই সংবাদ দেওয়া হ’ল। তিনি বললেন, ‘তারা তাকে হত্যা করেছে, আল্লাহ তাদেরকে হত্যা করুন। তারা যখন জানে না তখন অন্যদেরকে জিজ্ঞেস করল না কেন? কেননা অজানা রোগের চিকিৎসাই হচ্ছে জিজ্ঞেস করা। অথচ তার জন্য যথেষ্ট ছিল, তায়াম্মুম করা এবং তার জখমের উপর একটি পট্টি বাঁধা’।[8]
অতএব পানি ব্যবহারের কারণে রোগ বৃদ্ধি পাওয়ার অশংকা থাকলে তায়াম্মুম করে ছালাত আদায় করা বৈধ।
৩- প্রচন্ড শীতে পানি ব্যবহারের কারণে শারীরিক ক্ষতি অথবা মৃত্যুর ভয় করলে। হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ قَالَ احْتَلَمْتُ فِيْ لَيْلَةٍ بَارِدَةٍ فِيْ غَزْوَةِ ذَاتِ السَّلاَسِلِ فَأَشْفَقْتُ إِنِ اغْتَسَلْتُ أَنْ أَهْلِكَ فَتَيَمَّمْتُ ثُمَّ صَلَّيْتُ بِأَصْحَابِيْ الصُّبْحَ، فَذَكَرُوْا ذَلِكَ لِلنَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ يَا عَمْرُو صَلَّيْتَ بِأَصْحَابِكَ وَأَنْتَ جُنُبٌ. فَأَخْبَرْتُهُ بِالَّذِيْ مَنَعَنِيْ مِنَ الاِغْتِسَالِ وَقُلْتُ إِنِّيْ سَمِعْتُ الله يَقُوْلُ (وَلاَ تَقْتُلُوْا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيْمًا) فَضَحِكَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَلَمْ يَقُلْ شَيْئًا.
আমর ইবনুল আছ (রাঃ) বলেন, যাতু সালাসিলের যুদ্ধের সময় একদা শীতের রাতে আমার স্বপ্নদোষ হয়। আমার আশংকা হ’ল যে, যদি এই সময় আমি গোসল করি তবে ক্ষতিগ্রস্ত হব। আমি তায়াম্মুম করে আমার সাথীদের সাথে ফজরের ছালাত আদায় করি। প্রত্যাবর্তনের পর আমার সঙ্গী- সাথীরা এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে অবহিত করেন। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, হে আমর! তুমি নাপাক অবস্থায় তোমার সাথীদের সাথে ছালাত আদায় করলে? তখন আমি তাঁকে আমার গোসল করার অক্ষমতার কথা জানালাম এবং বললাম, আমি আল্লাহ তা‘আলাকে বলতে শুনেছি, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা কর না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের প্রতি অত্যন্ত মেহেরবান’ (নিসা ২৯)। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুচকি হাসি দিলেন ও কিছুই বললেন না।[9]
(ঙ) পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করা। অর্থাৎ যে মাটির সাথে পেশাব-পায়খানা মিশ্রিত হয়েছে, সেই মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করা জায়েয নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَتَيَمَّمُوْا صَعِيْدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوْا بِوُجُوْهِكُمْ وَأَيْدِيْكُمْ مِنْهُ ‘পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর। সুতরাং তোমাদের মুখ ও হাত তা দ্বারা মাসাহ কর’ (মায়েদাহ ৬)।
ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, صَعِيْدًا বলতে সেই মাটিকে বুঝানো হয়েছে যেই মাটিতে শষ্য উৎপাদন করা হয়। আর طَيِّبًا বলতে পবিত্র মাটিকে বুঝানো হয়েছে।[10]
অতএব পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করতে হবে। কিন্তু যদি মাটি পাওয়া না যায়। তাহ’লে বালি অথবা পাথর দ্বারাও তায়াম্মুম করা বৈধ। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَاتَّقُوْا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ ‘সাধ্যমত আল্লাহকে ভয় কর’ (তাগাবুন ১৬)। আওযাঈ (রহঃ) বলেন, বালি মাটির অন্তর্ভুক্ত।[11]
তায়াম্মুম ভঙ্গের কারণ সমূহ :
(ক) ওযূ ভঙ্গের কারণ সংঘটিত হওয়া। অর্থাৎ তায়াম্মুম করার পরে পেশাব, পায়খানা ও বায়ু নিঃসরণ হ’লে, স্ত্রী সহবাস করলে বা স্বপ্নদোষ হ’লে তায়াম্মুম ভঙ্গ হয়ে যাবে।
(খ) পানি উপস্থিত হওয়া। অর্থাৎ তায়াম্মুম করার পরে পানি পাওয়া গেলে তায়াম্মুম ভঙ্গ হয়ে যাবে এবং তার উপর উক্ত পানি দ্বারা ওযূ করা ওয়াজিব হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, الصَّعِيْدُ الطَّيِّبُ وَضُوْءُ الْمُسْلِمِ وَلَوْ إِلَى عَشْرِ سِنِيْنَ فَإِذَا وَجَدْتَ الْمَاءَ فَأَمِسَّهُ جِلْدَكَ فَإِنَّ ذَلِكَ خَيْرٌ. ‘পবিত্র মাটি মুসলমানের জন্য পবিত্রকারী, যদিও সে দশ বছর পানি না পায়। আর যখন পানি তুমি পাবে তখন যেন তোমার চর্মে পানি লাগাবে, কেননা এটাই উত্তম’।[12]
ছালাত আরম্ভ হওয়ার পরে পানি পাওয়া গেলে করণীয় :
পানি না পাওয়ার কারণে তায়াম্মুম করে ছালাত আরম্ভ করলে এবং ছালাত রত অবস্থায় পানি উপস্থিত হ’লে উক্ত ছালাত ছেড়ে পুনরায় ওযূ করে ছালাত আদায় করতে হবে কি-না? এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে এক্ষেত্রে ছহীহ মত হ’ল, তাকে পুনরায় ওযূ করে ছালাত আদায় করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَلَمْ تَجِدُوْا مَاءً فَتَيَمَّمُوْا صَعِيْدًا طَيِّبًا ‘অতঃপর যদি পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর (মায়েদাহ ৬)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন পানি পাবে তখন তোমার চর্মে পানি লাগাবে, এটাই উত্তম’।[13]
অতএব পানি পাওয়ার সাথে সাথে তায়াম্মুম বাতিল হয়ে যাবে। পানি দ্বারা ওযূ করে ছালাত আদায় করতে হবে।
তায়াম্মুম করে ছালাত আদায়ের পরে পানি পেলে করণীয় :
পানি না পাওয়ার কারণে তায়াম্মুম করে ছালাত আদায় করার পরে পানি পাওয়া গেলে ছালাত বাতিল হবে না। অর্থাৎ পুনরায় ওযূ করে ছালাত আদায় করতে হবে না। কেননা পানি না পাওয়ার কারণে ওযূর পরিবর্তে তায়াম্মুমের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করে ছালাত আদায় করা হয়েছে। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِىِّ قَالَ خَرَجَ رَجُلاَنِ فِيْ سَفَرٍ فَحَضَرَتِ الصَّلاَةُ وَلَيْسَ مَعَهُمَا مَاءٌ فَتَيَمَّمَا صَعِيْدًا طَيِّبًا فَصَلَّيَا ثُمَّ وَجَدَا الْمَاءَ فِى الْوَقْتِ فَأَعَادَ أَحَدُهُمَا الصَّلاَةَ وَالْوُضُوْءَ وَلَمْ يُعِدِ الآخَرُ، ثُمَّ أَتَيَا رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَذَكَرَا ذَلِكَ لَهُ، فَقَالَ لِلَّذِيْ لَمْ يُعِدْ أَصَبْتَ السُّنَّةَ وَأَجْزَأَتْكَ صَلاَتُكَ. وَقَالَ لِلَّذِيْ تَوَضَّأَ وَأَعَادَ لَكَ الأَجْرُ مَرَّتَيْنِ.
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা দুই ব্যক্তি সফরে বের হয়। পথিমধ্যে ছালাতের সময় উপনীত হ’ল তারা পানি না পাওয়ায় তায়াম্মুম করে ছালাত আদয় করল। অতঃপর উক্ত ছালাতের সময়ের মধ্যে পানি প্রাপ্ত হওয়ায় তাদের একজন ওযূ করে পুনরায় ছালাত আদায় করল এবং অপর ব্যক্তি ছালাত আদায় হ’তে বিরত থাকল। অতঃপর উভয়েই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে এই ঘটনা বর্ণনা করল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘তোমাদের যে ব্যক্তি পুনরায় ওযূ করে ছালাত আদায় করেনি সে সুন্নাত অনুযায়ী কাজ করেছে এবং এটাই তার জন্য যথেষ্ট’। আর যে ব্যক্তি ওযূ করে পুনরায় ছালাত আদায় করেছে তার সম্পর্কে বলেন, ‘তুমি দ্বিগুণ ছওয়াবের অধিকারী হয়েছ’।[14]
অতএব সুন্নাত হ’ল, পুনরায় ছালাত আদায় না করা। পক্ষান্তরে পুনরায় ওযূ করে ছালাত আদায়কারী সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দ্বিগুণ ছওয়াবের অধিকারী বলার কারণ হ’ল সে ব্যক্তি জানত না যে, কোনটি সুন্নাত। তাই সে ইজতিহাদ বা গবেষণা করে ছালাত বাতিল হওয়ার ভয়ে পুনরায় ওযূ করে ছালাত আদায় করেছিল। সুতরাং সে ইজতিহাদ ও ছালাত উভয়টির জন্য দ্বিগুণ ছওয়াবের অধিকারী হয়েছিল। কিন্তু উল্লিখিত হাদীছ হ’তে কোনটি সুন্নাত এটা জানার পরেও যদি কোন ব্যক্তি পুনরায় ওযূ করে ছালাত আদায় করে তাহ’লে তা বিদ‘আতে পরিণত হবে। কেননা তা সু্ন্নাত বহির্ভূত আমল।[15]
(গ) ওযর দূরীভূত হওয়া। অর্থাৎ যে ওযরের কারণে তায়াম্মুম করা হয়েছে সে ওযর দূরীভূত হ’লে তায়াম্মুম বাতিল হয়ে যাবে। যেমন- অসুস্থতা বৃদ্ধির আশংকায় তায়াম্মুম করে ছালাত আদায় করা বৈধ। কিন্তু তায়াম্মুম অবস্থায় সুস্থতা ফিরে পেলে তায়াম্মুম বাতিল হয়ে যাবে এবং তার উপর ওযূ করে ছালাত আদায় করা ওয়াজিব হবে।
তায়াম্মুম করার নিয়ম
তায়াম্মুমের নিয়ত করে, বিসমিল্লাহ বলে উভয় হাত মাটিতে মারবে। অতঃপর তাতে ফুঁ দিয়ে মুখমন্ডল ও উভয় হাতের কব্জি পর্যন্ত উপরিভাগ মাসাহ করবে। হাদীছে এসেছে,
عَنْ سَعِيْدِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ فَقَالَ إِنِّيْ أَجْنَبْتُ فَلَمْ أُصِبِ الْمَاءَ فَقَالَ عَمَّارُ بْنُ يَاسِرٍ لِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ أَمَا تَذْكُرُ أَنَّا كُنَّا فِيْ سَفَرٍ أَنَا وَأَنْتَ فَأَمَّا أَنْتَ فَلَمْ تُصَلِّ، وَأَمَّا أَنَا فَتَمَعَّكْتُ فَصَلَّيْتُ فَذَكَرْتُ لِلنَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إِنَّمَا كَانَ يَكْفِيْكَ هَكَذَا فَضَرَبَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم بِكَفَّيْهِ الأَرْضَ وَنَفَخَ فِيْهِمَا ثُمَّ مَسَحَ بِهِمَا وَجْهَهُ وَكَفَّيْهِ-
সাঈদ ইবনু আব্দুর রহমান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর নিকট এসে বলল, আমি নাপাক হয়েছি, কিন্তু পানি পেলাম না। এসময় আম্মার ইবনু ইয়াসার ওমর (রাঃ)-কে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, আপনার কি স্মরণ নেই যে, এক সফরে আমি ও আপনি উভয়ে ছিলাম। উভয়ে নাপাক হয়েছিলাম, কিন্তু আপনি পানির অভাবে ছালাত আদায় করলেন না, আর আমি মাটিতে গড়াগড়ি দিলাম এবং ছালাত আদায় করলাম। অতঃপর এক সময় আমি এটা নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট বিবৃত করলাম। তিনি বললেন, তোমার জন্য এরূপ করাই যথেষ্ট ছিল। এই বলে তিনি স্বীয় হাতের করদ্বয় যমীনের উপর মারলেন এবং উভয় হাতে ফুঁ দিলেন। অতঃপর উভয় হাত দ্বারা মুখমন্ডল ও দু’হাতের কব্জি পর্যন্ত মাসাহ করলেন।[16]
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
إِنَّمَا كَانَ يَكْفِيْكَ أَنْ تَقُوْلَ بِيَدَيْكَ هَكَذَا، ثُمَّ ضَرَبَ بِيَدَيْهِ الأَرْضَ ضَرْبَةً وَاحِدَةً ثُمَّ مَسَحَ الشِّمَالَ عَلَى الْيَمِيْنِ وَظَاهِرَ كَفَّيْهِ وَوَجْهَهُ.
‘তোমার পক্ষে এরূপ করাই যথেষ্ট ছিল। এই বলে তিনি তাঁর উভয় হাত একবার মাটিতে মারলেন এবং বাম হাত দ্বারা ডান হাত মাসাহ করলেন। অতঃপর মুখমন্ডল ও উভয় হাতের কব্জি পর্যন্ত তার উপরিভাগ মাসাহ করলেন’।[17]
অপবিত্র বস্ত্ত থেকে পবিত্রতা অর্জন সম্পর্কিত মাসআলা
النجاسة-এর সংজ্ঞা : النجاسة এমন অপরিচ্ছন্ন বস্ত্ত যা থেকে দূরে থাকার জন্য ইসলামী শরী‘আত নির্দেশ প্রদান করেছে।[18]
النجاسة বা অপবিত্র বস্ত্তর প্রকারভেদ : النجاسة বা অপবিত্র বস্ত্ত তিন প্রকার।[19] যথা-
(১) نجاسة مغلظة (নাজাসাতে মুগাল্লাযা) অর্থাৎ যা বেশী অপবিত্র। যেমন- কুকুর ও শূকর।
(২) نجاسة مخففة (নাজাসাতে মুখাফফাফাহ) অর্থাৎ যা অল্প অপবিত্র। যেমন- শিশুর পেশাব, যে খাদ্য খাওয়া আরম্ভ করেনি।
(৩) نجاسة مةوسطة (নাজাসাতে মুতাওয়াসসেতা) অর্থাৎ মধ্যম অবিত্র। যেমন- পেশাব ও পায়খানা।
অপবিত্র বস্ত্ত সমূহ
পৃথিবীতে এমন কিছু বস্ত্ত আছে যেগুলোকে ইসলামী শরী‘আত অপবিত্র ঘোষণা করেছে এবং তা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। যেমন-
(ক) পেশাব ও পায়খানা : হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ : إِذَا وَطِئَ أَحَدُكُمْ بِنَعْلِهِ الأَذَى، فَإِنَّ التُّرَابَ لَهُ طَهُوْرٌ.
আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ জুতা দ্বারা নাপাক জিনিস মাড়ায়, তবে (পরবর্তী) মাটি তার জন্য পবিত্রকারী’।[20]
আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে মসজিদে ছিলাম, এমন সময় এক বেদুইন আসল এবং মসজিদে দাঁড়িয়ে পেশাব করতে লাগল। রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ বলে উঠলেন, রাখ! রাখ! তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তাকে বাধা দিও না, তাকে তার অবস্থায় ছেড়ে দাও। সুতরাং তাঁরা তাকে ছেড়ে দিলেন, যে পর্যন্ত না সে পেশাব করল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ডাকলেন এবং বললেন, দেখ, এই মসজিদ সমূহে পেশাব ও অপবিত্রকরণের মত কিছু করা সঙ্গত নয়। এটা শুধু আল্লাহর যিকির, ছালাত ও কুরআন পাঠের জন্য। আনাস (রাঃ) বলেন, অতঃপর রাসূল (ছাঃ) লোকদের মধ্যে একজনকে নির্দেশ দিলেন। সে এক বালতি পানি আনল এবং তার উপর ঢেলে দিল।[21]
অতএব উপরোক্ত হাদীছদ্বয় দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, পেশাব ও পায়খানা অপবিত্র যা থেকে পবিত্রতা অর্জন করার মাধ্যম হ’ল পানি এবং মাটি।
(খ) গোশত খাওয়া হালাল এমন পশুর প্রবাহিত রক্ত : যে সকল পশুর গোশত খাওয়া হালাল সেগুলি যবেহ করলে যে রক্ত প্রবাহিত হয়, তা অপবিত্র। তবে যেসব রক্ত গোশতের মধ্যে থেকে যায়, তা পবিত্র। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, أَوْ دَمًا مَسْفُوْحًا ‘কিংবা প্রবাহিত রক্ত’ (অপবিত্র) (আন‘আম ১৪৫)।
(গ) গোশত খাওয়া হারাম এমন প্রানীর মল-মূত্র : যে সকল প্রানীর গোশত খাওয়া হারাম সেগুলির মল-মূত্র অপবিত্র। যেমন- ইঁদুর, বিড়াল, কুকুর, গাধা ইত্যাদির মল-মূত্র। হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللهِ قَالَ : أَرَادَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يَتَبَرَّزَ فَقَالَ : ائْتِنِيْ بِثَلاَثَةِ أَحْجَارٍ فَوَجَدْتُ لَهُ حَجَرَيْنِ وَرَوْثَةَ حِمَارٍ، فَأَمْسَكَ الْحَجَرَيْنِ وَطَرَحَ الرَّوْثَةَ، وَقَالَ : هِيَ رِجْسٌ.
আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পায়খানা করার ইচ্ছা করলেন। তখন তিনি বললেন, আমাকে তিনটি পাথর নিয়ে এসে দাও। আমি তাঁর জন্য দু’টি পাথর ও গাধার মল পেলাম। তিনি পথর দু’টি গ্রহণ করলেন এবং (গাধার) মল ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, এটা অপবিত্র’।[22] এ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, গোশত খাওয়া হারাম পশুর মল-মূত্র অপবিত্র।
(ঘ) মৃত প্রাণী : যে সকল পশু-পাখি শারঈ বিধান অনুযায়ী যবেহ ছাড়াই স্বাভাবিক ভাবে মৃতবরণ করে, সেসব অপবিত্র। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِلاَّ أَنْ يَكُوْنَ مَيْتَةً ‘মৃত ব্যতীত’ (আন‘আম ১৪৫)। তবে দু’টি মৃত হালাল ও পবিত্র। তা হ’ল মাছ এবং পঙ্গপাল বা ফড়িং জাতীয় প্রাণী বিশেষ। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
أُحِلَّتْ لَكُمْ مَيْتَتَانِ وَدَمَانِ، فَأَمَّا الْمَيْتَتَانِ فَالْحُوْتُ وَالْجَرَادُ، وَأَمَّا الدَّمَانِ فَالْكَبِدُ وَالطِّحَالُ.
‘দু’প্রকারের মৃত এবং দু’প্রকারের রক্ত তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। সেই মৃত দু’টি হ’ল মাছ ও টিড্ডি। আর দু’প্রকারের রক্ত হ’ল যকৃৎ ও প্লীহা’।[23]
আর যে সকল প্রাণীর রক্ত প্রবাহিত হয় না সেগুলি মৃত্যুবরণ করলেও তা পবিত্র। যেমন- মশা, মাছি, পিপিলিকা ইত্যাদি। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ، أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ : إِذَا وَقَعَ الذُّبَابُ فِيْ إِنَاءِ أَحَدِكُمْ فَلْيَغْمِسْهُ كُلَّهُ ثُمَّ لْيَطْرَحْهُ فَإِنَّ فِيْ أَحَدِ جَنَاحَيْهِ شِفَاءً وَفِي الآخَرِ دَاءً.
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কারো কোন খাবারের পাত্রে মাছি পড়ে, তখন তাকে পুরোপুরি ডুবিয়ে দিবে, তারপর ফেলে দিবে। কারণ তার এক ডানায় থাকে আরোগ্য ও আরেক ডানায় থাকে রোগ’।[24]
অত্র হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রক্ত প্রবাহিত হয় না এমন প্রাণী মৃত্যুবরণ করলেও পবিত্র।
(ঙ) المذي (মযী) : স্বামী-স্ত্রী উভয়ে সহবাসের চিন্তা অথবা ইচ্ছা করলে উত্তেজনা বসত যে সাদা তরল ও পিচ্ছিল পানি স্ত্রী ও পুরুষ লিঙ্গ থেকে নির্গত হয় যাতে শরীরিক কোন দুর্বলতা অনুভূত হয় না, তাকে মযী বলা হয়। এটা অপবিত্র হওয়ার ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম ঐক্যমত পোষণ করেছেন।[25]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِذَا رَأَيْتَ الْمَذْىَ فَاغْسِلْ ذَكَرَكَ وَتَوَضَّأْ وُضُوْءَكَ لِلصَّلاَةِ. ‘যখনই তুমি মযী দেখবে তখন তোমার পুরুষাঙ্গ ধৌত করবে এবং ছালাত আদায়ের জন্য ওযূ করবে’।[26]
অতএব মযী অপবিত্র বলেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা থেকে পবিত্রতা অর্জনের জন্য ধৌত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
(চ) الودي(ওয়াদী) : এটা সাদা গরম পানি যা সাধারণত পেশাবের পরে বের হয়ে থাকে। এটা অপবিত্র হওয়ার ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম ঐক্যমত পোষণ করেছেন। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,أَمَّا الْوَدْىُ وَالْمَذْىُ فَقَالَ : اغْسِلْ ذَكَرَكَ أَوْ مَذَاكِيْرَكَ وَتَوَضَّأْ وُضُوْءَكَ لِلصَّلاَةِ. ‘আর ওয়াদী ও মযী সম্পর্কে তিনি বলেন, তুমি তোমার লজ্জাস্থান ধৌত কর এবং ছালাতের জন্য ওযূ কর।[27] অতএব ওয়াদী অপবিত্র বলেই ধৌত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
(ছ) হয়েযের রক্ত : হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَسْمَاءَ قَالَتْ جَاءَتِ امْرَأَةٌ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَتْ أَرَأَيْتَ إِحْدَانَا تَحِيْضُ فِيْ الثَّوْبِ كَيْفَ تَصْنَعُ قَالَ تَحُتُّهُ ثُمَّ تَقْرُصُهُ بِالْمَاءِ وَتَنْضَحُهُ وَتُصَلِّيْ فِيْهِ.
আসমা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈকা মহিলা নবী (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললেন, (হে আল্লাহর রাসূল!) বলুন, আমাদের কারো কাপড়ে হায়েযের রক্ত লেগে গেলে সে কি করবে? তিনি বললেন, ‘সে তা ঘষে ফেলবে, তারপর পানি দিয়ে রগড়াবে এবং ভাল করে ধুয়ে ফেলবে। অতঃপর সেই কাপড়ে ছালাত আদায় করবে’।[28] উল্লিখিত হাদীছ হায়েযের রক্তের অপবিত্রতা প্রমাণ করে।
(জ) কুকুরের লালা : হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم طُهُوْرُ إِنَاءِ أَحَدِكُمْ إِذَا وَلَغَ فِيْهِ الْكَلْبُ أَنْ يَغْسِلَهُ سَبْعَ مَرَّاتٍ أُوْلاَهُنَّ بِالتُّرَابِ.
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের কারো পাত্রের পবিত্রতা লাভ করা হ’ল যখন তাতে কুকুর মুখ দেয় তখন তা সাতবার ধোয়া এবং প্রথমবার মাটি দ্বারা’।[29]
অপবিত্র বস্ত্ত থেকে পবিত্রতা অর্জনের পদ্ধতি :
(ক) যমীনে পতিত অপবিত্র বস্ত্ত থেকে পবিত্রতা অর্জনের পদ্ধতি : যদি যমীনের কোন স্থানে পায়খানা জাতীয় নাপাকী থাকে যা শুধুমাত্র পানি ঢেলে দূর করা সম্ভব নয়, তাহ’লে তা পানি দ্বারা ভালভাবে ধৌত করতে হবে। আর যদি পেশাব জাতীয় নাপাকী থাকে, তাহ’লে তার উপর পানি ঢেলে দিলেই তা পবিত্র হয়ে যাবে। যেমনভাবে রাসূলুল্লাহ বেদুঈনের পেশাবের উপর পানি ঢেলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
(খ) হায়েযের রক্ত থেকে কাপড় পবিত্র করার পদ্ধতি : হায়েযের রক্ত থেকে কাপড় পবিত্র করতে হ’লে তা পানি দ্বারা ধুয়ে ফেলতে হবে। হাদীছে এসেছে, ‘জনৈকা মহিলা নবী (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললেন, (হে আল্লাহর রাসূল!) বলুন, আমাদের কারো কাপড়ে হায়েযের রক্ত লেগে গেলে সে কি করবে? তিনি বললেন, ‘সে তা ঘষে ফেলবে, তারপর পানি দিয়ে রগড়াবে এবং ভাল করে ধুয়ে ফেলবে। অতঃপর সেই কাপড়ে ছালাত আদায় করবে’।[30]
(গ) পায়খানা ও পেশাব থেকে কাপড় পবিত্র করার পদ্ধতি : যদি কাপড়ে পায়খানা লাগে তাহ’লে তা পানি দ্বারা ধুয়ে ফেলতে হবে। আর পেশাব লাগলে তার উপর পানি ঢেলে দিলেই পবিত্র হয়ে যাবে। তবে দুধ পানকারী ছেলে শিশুর পেশাবের উপর পানি ছিটিয়ে দিলেই তা পবিত্র হয়ে যাবে। কিন্তু দুধ পানকারী মেয়ে শিশুর পেশাব পানি দ্বারা ধুয়ে ফেলতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يُغْسَلُ مِنْ بَوْلِ الْجَارِيَةِ وَيُرَشُّ مِنْ بَوْلِ الْغُلاَمِ ‘মেয়ের পেশাব ধেŠত করতে হয় এবং ছেলের পেশাবে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে’।[31]
(ঘ) মযী থেকে পবিত্রতা অর্জনের পদ্ধতি : মযী বের হয়ে কাপড়ে লাগলে তার উপর পানি ছিটিয়ে দিলেই তা পবিত্র হয়ে যাবে। হাদীছে এসেছে,
عَنْ سَهْلِ بْنِ حُنَيْفٍ قَالَ : كُنْتُ أَلْقَى مِنَ الْمَذْيِ شِدَّةً، فَكُنْتُ أُكْثِرُ الِاغْتِسَالَ مِنْهُ، فَسَأَلْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ ذَلِكَ، فَقَالَ : إِنَّمَا يُجْزِئُكَ مِنْهُ الْوُضُوْءُ، فَقُلْتُ : فَكَيْفَ بِمَا يُصِيْبُ ثَوْبِيْ مِنْهُ؟ قَالَ : يَكْفِيْكَ أَنْ تَأْخُذَ كَفًّا مِنْ مَاءٍ فَتَنْضَحَ بِهَا مِنْ ثَوْبِكَ حَيْثُ تَرَى أَنَّهُ أَصَابَهُ.
সাহল ইবনু হুনাইফ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমার অত্যধিক মযী নির্গত হ’ত, তাই আমি অধিক গোসল করতাম। অতঃপর আমি এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেন, মযী বের হওয়ার পরে ওযূ করাই তোমার জন্য যথেষ্ট। তখন আমি বললাম, আমার কাপড়ে মযী লাগলে কি করব? তিনি বললেন, ‘কাপড়ের যে স্থানে মযীর নিদর্শন দেখবে, এক অাঁজলা পানি নিয়ে তার উপর ছিটিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট হবে’।[32]
উল্লেখ্য যে, মযী শরীরের কোন স্থানে লাগলে সে স্থান ধুয়ে ফেলতে হবে এবং কাপড়ে লাগলে তার উপরে শুধু পানি ছিটিয়ে দিলেই চলবে।
(ঙ) কুকুরের লালা থেকে পবিত্রতা অর্জনের পদ্ধতি : কুকুরের লালা থেকে পবিত্রতা অর্জনের পদ্ধতি বর্ণনা করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের কারো পাত্রের পবিত্রতা লাভ করা হ’ল যখন তাতে কুকুর মুখ দেয় তখন তা সাতবার ধৌত করা এবং প্রথমবার মাটি দ্বারা’।[33]
[চলবে]
মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।
[1]. ফিকহুল মুয়াস্সার, পৃঃ ৩২।
[2]. নাসাঈ, তাহক্বীক: নাছিরুদ্দীন আলবানী, হা/৩২৪, তিনি হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।
[3]. মুসলিম, মিশকাত, ‘তায়াম্মুম’ অনুচ্ছেদ, হা/৪৯১, বঙ্গানুবাদ, এমদাদিয়া, ২/১৩৪।
[4]. বুখারী, হা/১।
[5]. শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি, ১/৪০১।
[6]. আবু দাউদ, তাহক্বীক: নাছিরুদ্দীন আলবানী, হা/৪৪০৩, হাদীছ ছহীহ।
[7]. নাসাঈ, তাহক্বীক: নাছিরুদ্দীন আলবানী, হা/৩২২, তিনি হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।
[8]. আবু দাউদ, মিশকাত, ‘তায়াম্মুম’ অনুচ্ছেদ, হা/৪৯৬, বঙ্গানুবাদ, এমদাদিয়া ২/১৩৭।
[9]. আবু দাউদ, তাহক্বীক : নাছিরুদ্দীন আলবানী, ‘নাপাক অবস্থায় ঠান্ডার আশংকায় তায়াম্মুম করা’ অনুচ্ছেদ, হা/৩৩৪, হাদীছ ছহীহ।
[10]. ফিকহুল মুয়াস্সার, পৃঃ৩৩।
[11]. ঐ পৃঃ ৩৪।
[12]. আবু দাঊদ, তাহক্বীক: নাছিরুদ্দীন আলবানী, হা/৩৩২, তিনি হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।
[13]. তদেব।
[14]. আবু দাউদ, তাহক্বীক: নাছিরুদ্দীন আলবানী, ‘তায়াম্মুম করে ছালাত আদায়ের পরে ওয়াক্তের মধ্যেই পানি পাওয়া’ অনুচ্ছেদ, হা/৩৩৮। হাদীছ ছহীহ।
[15]. শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি, ১/৪০৬-৪০৭।
[16]. বুখারী, ‘তায়াম্মুমের জন্য মাটিতে হাত মারার পর উভয় হাতে ফুঁ দেওয়া’ অনুচ্ছেদ, হা/৩৩৮, বঙ্গানুবাদ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স ১/১৭২।
[17]. মুসলিম, ‘তায়াম্মুম’ অধ্যায়, হা/৮৪৪।
[18]. আল-ফিকহুল মুয়াস্সার, ৩৫ পৃঃ।
[19]. আল-ফিকহুল মুয়াস্সার, ৩৫ পৃঃ, শারহুল মুমতে, ১/৪১৪ পৃঃ।
[20]. আবুদাউদ, তাহক্বীক : নাছিরুদ্দীন আলবানী, হা/৩৮৫, তিনি হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন; মিশকাত, হা/৪৬৯, বঙ্গানুবাদ, এমদাদিয়া ২/১২৫ পৃঃ।
[21]. মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত, হা/৪৬০, বঙ্গানুবাদ, এমদাদিয়া ২/১২২ পৃঃ।
[22]. বুখারী হা/১৫৬, তিরমিযী হা/১৭, নাসাঈ হা/৪২।
[23]. আহমাদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৩৯৫৩, বঙ্গানুবাদ, এমদাদিয়া ৮/১৩৩ পৃঃ।
[24]. বুখারী, কোন পাত্রে মাছি পড়া অনুচ্ছেদ, হা/৫৭৮২, বঙ্গানুবাদ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স ৫/৩৫৯ পৃঃ।
[25]. ইমাম নববী, আল-মাজমু ২/৬; ইবনু ক্বুদামা, আল-মুগনী ১/১৬৮; ছহীহ ফিকহুস সুন্নাহ ১/৭২।
[26]. আবু দাউদ, তাহক্বীক: নাছিরুদ্দীন আলবানী, হা/২০৬, তিনি হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।
[27]. সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী, ‘মযী এবং ওয়াদী গোসল ওয়াজিব করে না’ অনুচ্ছেদ, হা/৮৩২।
[28]. বুখারী, ওযূ অধ্যায়, ‘রক্ত ধৌত করা অনুচ্ছেদ’ হা/২২৭, বঙ্গানুবাদ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স ১/১২৩ পৃঃ।
[29]. মুসলিম ‘কুকুরের লালার হুকুম’ অনুচ্ছেদ হা/৬৭৭, মিশকাত ‘অপবিত্র হ’তে পবিত্রকরণ’ অনুচ্ছেদ হা/৪৫৮, বঙ্গানুবাদ, এমদাদিয়া ২/১২১ পৃঃ।
[30]. বুখারী, ওযূ অধ্যায়, ‘রক্ত ধৌত করা অনুচ্ছেদ’ হা/২২৭, বঙ্গানুবাদ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স ১/১২৩ পৃঃ।
[31]. আবু দাউদ, তাহক্বীক : নাছিরুদ্দীন আলবানী, ‘কাপড়ে শিশুর পেশাব লাগা’ অনুচ্ছেদ, হা/৩৭৬, হাদীছ ছহীহ, মিশকাত হা/৪৬৮, বঙ্গানুবাদ, এমদাদিয়া ২/১২৫ পৃঃ।
[32]. আবু দাউদ, তাহক্বীক : নাছিরুদ্দীন আলবানী, ‘কাপড়ে শিশুর পেশাব লাগা’ অনুচ্ছেদ, হা/৩৭৬, হাদীছ ছহীহ, মিশকাত হা/৪৬৮, বঙ্গানুবাদ, এমদাদিয়া ২/১২৫ পৃঃ।
[33]. মুসলিম ‘কুকুরের লালার হুকুম’ অনুচ্ছেদ হা/৬৭৭, মিশকাত ‘অপবিত্র হ’তে পবিত্রকরণ’ অনুচ্ছেদ হা/৪৫৮, বঙ্গানুবাদ, এমদাদিয়া ২/১২১ পৃঃ।