ভূমিকা :

মহান আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের মাস রামাযান। বছর ঘুরে মুমিনের জীবনে এ মাসের আগমন ঘটে তাক্বওয়া অর্জনের অনন্য সুযোগ হিসাবে। মুমিন ব্যক্তি তার রুগ্ন হৃদয়কে মাগফেরাত ও রহমতের স্বচ্ছ সলিলে পরিষ্কার করে নেয়। নেক আমলের পসরা দিয়ে ভরে নেয় আমলনামা। ছিয়াম, ক্বিয়াম, ছালাত, কুরআন তেলাওয়াত, দান-খয়রাত, তাসবীহ-তাহলীল সহ যাবতীয় ইবাদত-বন্দেগীতে অতিবাহিত হয় রামাযানের দিন-রাত। লাইলাতুল ক্বদরে হাযার মাসের ছওয়াব লাভের কোশেশও অব্যাহত থাকে। তবে ঈমান ও তাক্বওয়ার অনুপাতে বান্দার ইবাদতের তারতম্য হয়ে থাকে। যিনি যত বেশী পরহেযগার, তার ইবাদতের মাত্রা সেই অনুযায়ীই হয়ে থাকে। আর যিনি দুর্বল ঈমানের অধিকারী তার ইবাদতও তার ঈমান অনুযায়ী সম্পাদিত হয়। কিন্তু একথা সত্য যে, আল্লাহর বিশেষ রহমতের কারণে অন্যান্য মাসের তুলনায় রামাযান মাসে মুসলিমগণ কয়েক গুণ বেশী ইবাদত করে থাকেন। কিন্তু রামাযানের শেষে শাওয়ালের চাঁদ ওঠার সাথে সাথে অধিকাংশের হৃদয় থেকে রামাযানের অর্ধেক প্রভাব মুছে যায়। তারা পুনরায় রামাযান পূর্ববর্তী জীবনে ফিরে যান। ঈদের দিনেই গাফলতি ও অলসতার ঢেউ তাকে টেনে নিয়ে যায় অবাধ্যতার অতল গহবরে। রামাযানের পরে সেই গাফলতির মধ্যে নিজেদের না ডুবিয়ে রামাযানার প্রভাব মনের মুকুরে জাগিয়ে রাখতে হবে। আলোচ্য নিবন্ধে রামাযানের প্রভাব ধরে রাখার কতিপয় উপায় আলোকপাত করার চেষ্ট করা হবে ইনশাআল্লাহ।

রামাযানের প্রভাব বলতে কি বুঝায়?

রামাযান মূলতঃ তাক্বওয়া অর্জনের মাস। আল্লাহর বান্দারা এ মাসে বিবিধ ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে তাক্বওয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকেন এবং সেই প্রশিক্ষণের আলোকে বাকী এগারো মাস শরী‘আতের বিধি-বিধান প্রতিপালন করে থাকেন। যিনি রামাযানের পরেও সেই প্রশিক্ষণের প্রভাব নিজের আমল-আখলাক্বে ধরে রাখতে সক্ষম হন, তিনিই সফলতার মাক্বছাদ মনযিলে পৌঁছাতে সক্ষম হন। আর যারা রামাযানের ইবাদতের প্রভাব ধরে রাখতে পারে না, তাদের জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কারণ যেই জীবনে ছিয়াম পালন করার পরেও হালাল-হারামের মাঝে পার্থক্য করার প্রচেষ্টা থাকে না, সেখানে রামাযানের কোন গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয় না। ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহ.) বলেন, ‌لَيْسَ ‌تَقْوَى ‌اللهِ ‌بِصِيَامِ ‌النِّهَارِ، وَلَا بِقَيَامِ اللَّيْلِ، وَالتَّخْلِيطِ فِيمَا بَيْنَ ذَلِكَ، وَلَكِنَّ تَقْوَى اللهِ تَرْكُ مَا حَرَّمَ اللهُ، وَأَدَاءُ مَا افْتَرَضَ اللهُ، فَمَنْ رُزِقَ بَعْدَ ذَلِكَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ إِلَى خَيْرٍ، ‘দিনের বেলা ছিয়াম রাখা এবং রাতের বেলা ক্বিয়াম করার নাম তাক্বওয়া নয়। আবার ছিয়াম ও তাহাজ্জুদ এক সাথে আদায় করার নামও তাক্বওয়া নয়। বরং আল্লাহ যা কিছু হারাম করেছেন তা বর্জন করা এবং যা কিছু বিধিবদ্ধ করেছেন, তা পরিপূর্ণভাবে আদায় করার নামই হ’ল প্রকৃত তাক্বওয়া। আর যাকে আরো নেক আমলের তাওফীক্ব দেওয়া হয়েছে, সেটা তো সোনায় সোহাগা (ভালোর উপরে ভালো)।[1]

তাছাড়া রামাযানের ইবাদত কবুল হওয়ার অন্যতম প্রধান আলামত হ’ল রামাযানের পরেও সেই বরকতময় মাসের আমল ও অভ্যাসগুলো ধরে রাখতে পারা। হাসান বাছরী (রহ.) বলেন,إن من جزاء الحسنة الحسنة بعدها، ومن عقوبة السيئة السيئةُ بعدها، فإذا قبل الله العبد فإنه يوفقه إلى الطاعة، ويصرفه عن المعصية، ‘নেক আমলের প্রতিদান হ’ল সেই আমলের পরে আরেকটি ভালো আমল করতে পারা। আর পাপের পরিণাম হ’ল সেই পাপের পরে আরেকটি পাপ করে ফেলা। কারণ আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে কবুল করে নেন, তখন তাকে তাঁর আনুগত্য করার তাওফীক্ব দেন এবং তাকে পাপ থেকে দূরে রাখেন’।[2]

একবার বিশর আল-হাফী (রহঃ)-এর কাছে এসে এক ব্যক্তি বলল,أن قومًا يتعبدون في رمضان ويجتهدون في الأعمال فإذا انسلخ تركوا، ‘কওমের কিছু লোক রামাযানে খুবই ইবাদত করে এবং নেক আমলে অনেক পরিশ্রম করে, কিন্তু রামাযান চলে গেলে তারা সেই ইবাদত ও আমল পরিত্যাগ করে’। তখন তিনি জবাবে বললেন,بئس القوم قوم لا يعرفون الله إلا في رمضان، ‘সেই সম্প্রদায় কতই না নিকৃষ্ট, যারা শুধু রামাযান মাসেই আল্লাহকে চেনে’।[3] অর্থাৎ যারা শুধু রামাযান মাসেই জোরে-শোরে ইবাদত করার প্রয়োজন অনুভব করে, আর বাকী মাসগুলোতে ইবাদত করা যরূরী মনে করে না। আবার আরেক শ্রেণীর লোক আছে, খোদ রামাযান মাসেও যাদের হৃদয় প্রভাবিত হয় না; বরং এ মাসকে তারা দুনিয়া ইনকামের মওসুম মনে করে থাকে। এদের জীবন দুর্ভাগ্যের চূড়ান্ত সীমায় উপনীত।

সুতরাং রামাযানের প্রভাব ধরে রাখার অর্থ হ’ল আল্লাহর নির্দেশিত এবং রাসূলুল্লাহ (ছা.) প্রদর্শিত পথে রামাযানের সময়গুলো ইবাদত-বন্দেগীতে অতিবাহিত করা এবং সেই ইবাদতের গতিধারা পরবর্তী জীবনেও ধরে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে পারা।

রামাযানের প্রভাব ধরে রাখতে না পারার কারণসমূহ :

মুসলিম জীবনের সকল আমল নিয়তের উপরে নির্ভরশীল।[4] নিয়ত বিশুদ্ধ না হ’লে আমল পরিশুদ্ধ হয় না। ফলে কোন ইবাদত অভ্যাস তাড়িত হয়ে বা সামাজিকতা রক্ষার জন্য করা হ’লেও তার মাধ্যমে উপকৃত হওয়া সম্ভব হয় না। বাংলাদেশ যেহেতু মুসলিম রাষ্ট্র, সেহেতু এখানে সামাজিকভাবে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে রামাযান মাসের একটা বিরাট প্রভাব পড়ে। ইসলামের ধর্মীয় উৎসব ঈদের প্রভাব তো আরো স্পষ্ট। কিছু ব্যতিক্রম পরিস্থিতি ছাড়া আমরা আমাদের চারপাশে, পরিবারে, হাট-বাজারে, কেনা-কাটায় একটা আমেজ অনুভব করি। ফলে আমরা আমাদের নিয়তটাকে পরিশুদ্ধ করতে পারি না। বরং চারপাশে সবাই ছিয়াম রাখছে, তাই রাখছি। রামাযানে তারাবীহ পড়তে হয়, তাই পড়ি। এটা কুরআন নাযিলের মাস, কুরআন পড়তে হয়, তাই পড়ি। এখানে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য থাকলেও, রেযামন্দি হাছিলের অনুভূতিটা খুব একটা শক্তিশালী থাকে না।

ধূমপায়ী ব্যক্তি ছিয়ামরত অবস্থাতে ধূমপান করে না, কিন্তু ইফতারের পরে আবার ঠিকই সিগারেটে সুখটান মারে। রামাযান মাসে গানের কনসার্ট করা হয় না; কিন্তু ঈদের দিনে গান-বাজনা করার সিদ্ধান্তটা রামাযান মাসেই নেওয়া হয়ে থাকে। অনেকে রামাযান মাসে বিভিন্ন খারাপ অভ্যাস থেকে বিরত থাকেন; কিন্তু ঈদের দিন থেকে আবার সেই বদভ্যাসে ফিরে যান। সূদখোর-ঘুষখোর রামাযান মাসে সূদ-ঘুষ না খেলেও রামাযানের পরে এই হারাম ইনকামের বাসনা ঠিকই মনের মধ্যে পুষে রাখে। যারা রামাযানকে কেন্দ্র করে মসজিদমুখী হয়, কুরআন হাতে নেয়, তাদের কর্মতৎপরতা ও মাইন্ড সেটাপ শুধু রামাযানকে ঘিরেই আবর্তিত থাকে। তাইতো রামাযান চলে গেলে মসজিদের সাথে তাদের সম্পর্ক শিথিল হয়ে আসে এবং সারা বছর কুরআনটা আর খুলে দেখা হয় না, হ’লেও কালেভদ্রে। রামাযানে যেভাবে পাঁচ ওয়াক্ব ছালাত আদায় করা হয়, কুরআন তেলাওয়াত করা হয়- তা যে রামাযানের পরেও অব্যাহত রাখতে হবে- এই অনুভূতি ও ইচ্ছা শক্তি কয়জনের মধ্যে পাওয়া যায়? তাই তো দেখা যায় শাওয়ালের চাঁদ ওঠার পরে এশার জামা‘আতে মুছল্লী খুঁজে পাওয়া যায় না। যে ব্যক্তি সারা মাস জামা‘আতের সাথে ফজর ছালাত আদায় করেছে, ঈদের দিন তাকে আর মসজিদে পাওয়া যায় না। অথচ ঈদের জামা‘আতে ঠিকই সেজেগুজে ফুলবাবু হয়ে ঈদগাহে উপস্থিত হয়। অথচ সে জানে- এই ঈদের জামা‘আতের চেয়ে ফজরের ছালাতের গুরুত্ব হাযার গুণ বেশী।

আমাদের এই শোচনীয় অবস্থায় মূল কারণ হ’ল আমরা রামাযান মাসকে স্রেফ উৎসবের মাসে পরিণত করে ফেলেছি। রামাযানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছি। ছিয়াম সাধনার শর্ত পালনে ব্যর্থ হয়েছি, ফলে পাপ থেকে পবিত্র হ’তে পারিনি। মূলতঃ রামাযানের ছিয়াম, তারাবীহ, তাহাজ্জুদ ও লাইলাতুল ক্বদরের মাধ্যমে পূর্বের সকল গুনাহ মাফের মূল শর্ত হ’ল দু’টি- ঈমান (إِيمَانًا) এবং নেকী লাভের প্রত্যাশা (احْتِسَابًا)।[5] রামাযানের ইবাদত ঈমানের সাথে সম্পাদন করার অর্থ হ’ল বিশুদ্ধ নিয়তের সাথে ইবাদত করা, পাপ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প করা এবং হৃদয় থেকে রিয়া ও শ্রুতির শিকড় উপড়ে ফেলা।[6] আর ইহতিসাবের অর্থ হ’ল মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে প্রবল আগ্রহের সাথে আমল করা এবং তাঁর কাছে নেকী লাভের প্রত্যাশা করা।[7] শায়খ ছালেহ আল-ওছায়মীন (রহ.) বলেন, ‘সুন্দরভাবে আমল করার ব্যাপারে নেকী লাভের প্রত্যাশা করার একটি বড় প্রভাব রয়েছে। কেননা আপনি যেমন আমল করবেন, প্রতিদান সেরকমই দেওয়া হবে। যেমনভাবে কোন শ্রমিককে তার মজুরি দেওয়া হয়।[8] ইবনু বাত্ত্বাল (রহ.) বলেন, أن الأعمال الصالحة لا تزكو ولا تتقبل إلا مع الاحتساب وصدق النيات، ‘বিশুদ্ধ নিয়ত ও নেকী লাভের প্রত্যাশা ছাড়া নেক আমল পরিশুদ্ধ হয় না এবং কবুল হয় না’।[9]

এবার আমরা নিজেদের দিকে তাকাই! আমরা কি রামাযানের ইবাদত-বন্দেগীতে এই দু’টি শর্ত পরিপূর্ণভাবে পালন করি? তাক্বওয়া অর্জনের এই সময়ে আমরা কি নিজেদের সার্বিক জীবনকে পরিশুদ্ধ করার দৃঢ় সংকল্প করতে পারি? প্রত্যেক রামাযানকে জীবনের শেষ রামাযান মনে করে ইবাদত-বন্দেগী করতে পারি? রামাযানের প্রশিক্ষণ অনুযায়ী বাকী জীবন পরিচালনার জন্য আল্লাহর কাছে কায়মনো বাক্যে ফরিয়াদ করি? তওবার মাধ্যমে যাবতীয় পাপ থেকে বিরত থেকে ঈমানকে নবায়ন করি? যদি আমরা এই কাজগুলো করতে পারি, তাহ’লে আমাদের পক্ষে রামাযানের ঈমানী প্রভাব সারা বছর ধরে রাখা সম্ভব হবে। অন্যথা এই বরকতময় মাসের প্রভাব ধরে রাখা আদৌ সম্ভব হবে না।

রামাযানের প্রভাব ধরে রাখার উপায়

১. শয়তানের আক্রমণ ও ওয়াসওয়াসা থেকে আত্মরক্ষা করা :

রামাযান মাস আগমনের সাথে সাথে শয়তান ও অবাধ্য জিনদের শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। জান্নাত ও রহমাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, সারা মাস এই দরজগুলো বন্ধ করা হয় না এবং জাহান্নামের দরজাগুলো সারা মাস বন্ধ রাখা হয়।[10] রামাযানের পরে শয়তানেরা মুক্তি পেয়েই আদম সন্তানদের উপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। তাকে পুনরায় পাপের অন্ধকারে নিক্ষেপ করতে চায়। ছেড়ে দেওয়া বদভ্যাসগুলোতে পুনরায় ফিরে যেতে প্ররোচিত করতে থাকে। যে পাপ থেকে তওবা করা হয়েছে সেই পাপ ভিন্ন মোড়কে নতুন পন্থায় মোহনীয় করে উপস্থাপন করে তওবাকারী বান্দার সামনে। এভাবে যখন তাকে বিপথগামী করতে পারে না; তখন অন্যভাবে তাকে পথভ্রষ্ট করার চক্রান্ত করে। সারা মাস রহমতের দরিয়া থেকে আহরিত নেক আমলের মণি-মুক্ত নিয়ে সফলতার কিনারায় পৌঁছার আগেই বান্দার তাক্বওয়ার কিশতী ডুবিয়ে দেওয়ার পায়তারা করে।

সুতরাং যারা ঈমান ও রামাযানের প্রাপ্ত তাক্বওয়ার মাধ্যমে নিজেকে হেফাযত করে না, তারা খুব সহজেই শয়তানের আক্রমণে ধরাশায়ী হয়। বছরের অন্য সময়ের তুলনায় রামাযান পরবর্তী শয়তানী ওয়াসওয়াসার আক্রমণটা বেশী শক্তিশালী ও সর্বগ্রাসী হয়ে থাকে। তবে যারা শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে সর্বদা আল্লাহর সাহায্য কামনা করে এবং সর্বানুভূতির চিহ্ন ক্ষয় করে শয়তানী ওয়াসওয়ার সামনে মযবূত ঈমানী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, কেবল তারাই শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়। সেজন্য মুমিনের কর্তব্য হ’ল শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করা, কুরআন তেলাওয়াত করা; বিশেষকরে বাড়িতে সূরা বাক্বারাহ ও আলে ইমরান তেলাওয়াত করা, শরী‘আতের নির্দেশিত বিভিন্ন ক্ষেত্রে পঠিতব্য দো‘আগুলো পাঠ করা এবং সর্বদা নিজের জিহবাকে যিক্র-আয্কারে সিক্ত রাখা। কারণ শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে নিরাপদ হ’তে পারলে যাবতীয় নেক আমলের সুযোগ লাভ করা সহজ হয়ে যাবে।

২. রামাযানের অভ্যাসগুলো জারি রাখা :

রামাযান মাসে যে ভালো অভ্যাসগুলো অর্জিত হয়েছে, সেগুলো অল্প করে হ’লেও ধরে রাখার চেষ্টা করা ঈমানী কর্তব্য। যেমন আগেভাগে মসজিদে যাওয়া, পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত জামা‘আতের সাথে আদায় করা, ইশরাক্ব বা যুহার ছালাত আদায় করা, সকাল-সন্ধ্যার যিকিরগুলো পাঠ করা, নিজের আমলের আগ্রগতির হিসাব রাখা, দান-ছাদাক্বাহ করা, জিহবা-দৃষ্টি-কানের হেফাযত করা, মানুষকে খাওয়ানো, কুরআন তেলওয়াত করা, সবসময় মনকে ঈমানী ভাব-গাম্ভীর্যে পূর্ণ রাখা, গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা, পরিবার-পরিজনকে সময় দেওয়া, সন্তানকে দ্বীনী শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা প্রভৃতি।

আমরা যদি এই ভালো অভ্যাসগুলো নিয়মিত চর্চা না করি, তাহ’লে এগুলো আমাদের জীবন থেকে আবার হারিয়ে যাবে। রামাযানের ভালো অভ্যাস ও আমলগুলোর ব্যাপারে আমরা যদি একটু সচেতন হ’তে পারি, তাহ’লে সেই আমলগুলো ধরে রাখা খুবই সহজ। এর জন্য আহামরি কোন পদক্ষেপের দরকার নেই; প্রয়োজন শুধু মানসিকভাবে সুদৃঢ় সংকল্পের। তাছাড়া কোন আমলের অভ্যাস শুরু করার পরে সেটা পরিত্যাগ করা সমীচীন নয়। কারণ রাসূলুল্লাহ (ছা.) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল ‘আছ (রা.) -কে বলেছিলেন,يَا عَبْدَ اللهِ، لاَ تَكُنْ مِثْلَ فُلاَنٍ كَانَ يَقُومُ اللَّيْلَ، فَتَرَكَ قِيَامَ اللَّيْل،ِ ‘হে আব্দুল্লাহ! তুমি সেই লোকের মতো হয়ো না; যে ক্বিয়ামুল লাইল আদায় করতো, অতঃপর সেটা ছেড়ে দিল’।[11]

তাইতো রাসূল (ছা.) রামাযানের পরেই শাওয়ালের ছয়টি ছিয়াম, প্রতি মাসে আইয়ামে বিযের তিনটি ছিয়াম এবং প্রতি সপ্তাহে দু’টি করে ছিয়াম রাখার জন্য বলেছেন, যাতে সারা বছর ছিয়াম রাখার গতিটা ঠিক থাকে। উপরন্তু যে কোন আমল অল্প হ’লেও তা নিয়তিমিত করা আল্লাহর নিকট অধিকতর পসন্দনীয় কাজ। রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেছেন,يَا أَيُّهَا النَّاسُ!..إِنَّ أَحَبَّ الأَعْمَالِ إِلَى اللهِ مَا دَامَ وَإِنْ قَلَّ، ‘আল্লাহর নিকটে সবচেয়ে প্রিয় আমল হ’ল যা অল্প হ’লেও নিয়মিত করা হয়’।[12]

৩. বেশী আমলের ধোঁকায় না পড়া :

অধিক আমল সম্পাদন করে আত্মতৃপ্তি লাভ করা সমীচীন নয়। কেননা কোন ইবাদত ভালোভাবে সম্পাদন করার পরে শয়তান বান্দাকে ওয়াসওয়াসা দেয়। রামাযানের পরে সে বান্দাকে বলবে, মাশা-আল্লাহ! তুমি তো রামাযানে অনেক ইবাদত করেছ, সারা মাস ছিয়াম রেখেছ, কোনদিন তারাবীহ বাদ দাওনি, কয়েকবার কুরআন খতম করেছ, দান-ছাদাক্বাহ করেছ, ছায়েমকে ইফতার করিয়েছ, আরো কত আমল করেছ তার কোন ইয়াত্ত্বা নেই। শয়তান এভাবে মুমিন বান্দাকে ধোঁকা দিতে থাকে, কিন্তু বান্দা যদি এই ধোঁকায় পা দেয় তাহ’লে তার সর্বনাশ হয়ে যাবে, সে অন্যের চেয়ে নিজেকে উত্তম ভাবতে শুরু করবে, ইবাদতে অহংকারী হয়ে উঠবে এবং রামাযান পরবর্তী ইবাদতে গাফলতি করে বসবে। একবার মা আয়েশা (রা.) -কে জিজ্ঞাসা করা হ’ল, متى يكون الرجل مسيئاً؟ ‘মানুষ কখন পাপী ব্যক্তিকে পরিণত হয়?’ তিনি জবাবে বললেন, إذا ظن أنه محسن، ‘যখন সে নিজেকে নেককার মনে করে’।[13]

সুতরাং মনে রাখতে হবে যে, বান্দা শুধু তার আমল দিয়ে কখনো জান্নাতে যেতে পারবে না, যতক্ষণ না আল্লাহ তার প্রতি রহমত করবেন।[14] তাছাড়া সে যতই আমল করুক না কেন, তা কখনো বেশী হয় না। কারণ রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেছেন,لَوْ أَنَّ عَبْدًا خَرَّ عَلَى وَجْهِهِ مِنْ يَوْمِ وُلِدَ، إِلَى أَنْ يَمُوتَ هَرَمًا فِي طَاعَةِ اللهِ، لَحَقَّرَهُ ذَلِكَ الْيَوْمَ، وَلَوَدَّ أَنَّهُ رُدَّ إِلَى الدُّنْيَا كَيْمَا يَزْدَادَ مِنَ الْأَجْرِ وَالثَّوَابِ، ‘যদি কোন বান্দা ভূমিষ্ট হওয়ার দিন থেকে অতিবৃদ্ধ বয়সে মৃত্যু অবধি একান্তভাবে আল্লাহর ইবাদতে সিজদায় পড়ে থাকে, তবুও ক্বিয়ামতের দিন (সারা জীবনের এই ইবাদতের ছওয়াব দেখে) সে এটাকে খুবই নগণ্য মনে করবে। তখন সে কামনা করবে, যদি তাকে দুনিয়ায় পুনরায় ফেরত পাঠানো হ’ত, তাহ’লে আরোও বেশী প্রতিদান ও ছওয়াব লাভ করা যেত’।[15]

৪. ভয় ও আশার মাঝে অবস্থান করা :

ভয় ও আশার মাঝে ঈমান অবস্থান করে। কোন ইবাদত করার পরে তা কবুল হওয়ার ব্যাপারে যেমন প্রত্যাশা থাকতে হবে, তদ্রূপ সেটা প্রত্যাখ্যাত হওয়ারও আশংকা থাকা বাঞ্ছনীয়। মহান আল্লাহ বলেন,وَالَّذِينَ يُؤْتُونَ مَا آتَوْا وَقُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ، ‘আর তাদেরকে যা (রিযিক) দেওয়া হয়েছে তা থেকে তারা দান করে, তখন তাদের হৃদয় ভীত-কম্পিত থাকে’ (মুমিনূন ২৩/৬০)। মা আয়েশা (রা.) বলেন, আমি এই আয়াতের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললাম,يَا رَسُولَ اللهِ! أَهُوَ الَّذِي يَزْنِي، وَيَسْرِقُ، وَيَشْرَبُ الْخَمْرَ؟ ‘হে আল্লাহর রাসূল! এর দ্বারা কি এমন ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যে ব্যভিচার করে, চুরি করে এবং মদপান করে? তিনি বলেন, لَا، يَا بِنْتَ أَبِي بَكْرٍ أَوْ يَا بِنْتَ الصِّدِّيقِ وَلَكِنَّهُ الرَّجُلُ يَصُومُ، وَيَتَصَدَّقُ، وَيُصَلِّي، وَهُوَ يَخَافُ أَنْ لَا يُتَقَبَّلَ مِنْهُ، ‘না, হে আবূ বকরের কন্যা অথবা হে ছিদ্দীকের কন্যা! বরং উক্ত আয়াতে এমন ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যে ছিয়াম পালন করে, যাকাত দেয়, দান-খয়রাত করে, ছালাত আদায় করে আর আশংকা করে যে, তার এসব ইবাদত কবুল হ’ল কি-না’?[16]

প্রখ্যাত তাবে‘ঈ মালেক ইবনে দীনার (রহ.) বলেন,‌الخوف ‌على ‌العمل ‌ألا ‌يُتقبل أشد من العمل، ‘আমল করার চেয়ে কঠিন বিষয় হ’ল সেই আমল কবুল হবে কি-না তার ভয়ে ভীত হওয়া’।[17] তাবে তাবে‘ঈ আব্দুল আযীয ইবনে আবূ রাওয়াদ (রহ.) তাবে‘ঈদের ব্যাপারে বলেন,أدركتهم يجتهدون في العمل الصالح، فإذا فعلوه وقع عليهم الهم أي قبل منهم أم لا، ‘আমি তাদেরকে দেখেছি যে, তারা সৎ আমলে অনেক পরিশ্রম করতেন। যখন আমল করে ফেলতেন, তখন উৎকণ্ঠায় পড়ে যেতেন এই ভয়ে যে, তাদের এই আমল কবুল করা হবে কি-না’।[18]

মু‘আল্লা ইবনুল ফায্ল (রহ.) বলেন,كَانُوا يَدْعُونَ الله سِتَّةَ أَشْهُرِ أَنْ يُبَلِّغَهُمْ رَمَضَانُ، ثُمَّ يَدْعُونَهُ سِتَّةَ أَشْهُرٍ أَنْ يَتَقَبَّلَهُ مِنْهُمْ، ‘তারা ছয় মাস ধরে আল্লাহর কাছে দো‘আ করতেন যেন তাদের কাছে রামাযান (আরেক বার) আগমন করে। অতঃপর (রামাযানের পরে) ছয় মাস ধরে দো‘আ করতেন যেন (রামাযানের সম্পাদিত আমলগুলো) আল্লাহ কবুল করে নেন’।[19] অর্থাৎ সালাফে ছালেহীন রামাযান ব্যাপী এত বেশী আমল করার পরেও সেই আমলগুলো কবুল হওয়ার ভয়ে তটস্থ থাকতেন এবং আল্লাহর কাছে অবিরত ধারায় দো‘আ করতেন। আর এই ভয় তাদেরকে আরো বেশী বেশী নেক আমল সম্পাদনে অনুপ্রাণিত করতো।

হাসান বছরী (রহ.) বলেন,المؤمن ‌يحسن ‌ويخاف، والمنافق يسيء ويأمن، ‘মুমিন ব্যক্তি নেকীর কাজ করে তা কবুল না হওয়ার আশংকা করে, আর মুনাফিক পাপের কাজ করেও নিজেকে নিরাপদ মনে করে’।[20]

সুতরাং রামাযানের পরে আমরা যেমন ছালাত, ছিয়াম, তারাবীহ, ছাদাক্বাহ, কুরআন তেলাওয়াত প্রভৃতি ইবাদতের প্রতিদান আললাহর কাছে প্রত্যাশা করব, ঠিক তেমনি সেই আমল কবুল হওয়ার ভীতিও পোষণ করব। শুধু ইবাদত করেই যেন আমরা নিজেদের নিরাপদ মনে না করি। যদি আমরা ভয় ও আশার মাঝে অবস্থান করতে পারি, তাহ’লে রামাযানের পরে এর প্রভাব আমরা ধরে রাখতে পারব। ইনশাআল্লাহ।

৫. অনুধাবন করে কুরআন তেলাওয়াত করা :

রামাযান কুরআন নাযিলের মাস। এমাসে আমরা সবাই অন্যান্য মাসের তুলনায় অনেক বেশী কুরআন তেলাওয়াত করে থাকি। তবে লক্ষণীয় ব্যাপার হ’ল আমারা অধিকাংশই বরকত ও ছওয়াব লাভের জন্য কুরআন তেলাওয়াত করি। কুরআন অনুধাবন করে তার আলোকে জীবন গড়ার মানসিকতা রাখি না। ফলে তেলাওয়াতের মাধ্যমে নেকী অর্জিত হ’লেও কুরআন নাযিলের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।

শায়খ ওছায়মীন (রহ.) বলেন, কুরআন তেলাওয়াত দুই প্রকার- (১) শাব্দিক তেলাওয়াত। এই তেলাওয়াতের মাধ্যমে প্রতি হরফে দশটি করে নেকী লাভ করা যায়।[21] (২) হুকমী বা প্রায়োগিক তেলাওয়াত। অর্থাৎ কুরআন তেলাওয়াত করে এর যাবতীয় বিধি-বিধানকে আন্তরিকভাবে অনুধাবন করে আদিষ্ট বিষয়গুলো পালন করা এবং নিষিদ্ধ বিষয়গুলো বর্জন করা।[22] মূলত এই তেলাওয়াতের জন্যই কুরআন নাযিল হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,‌كِتَابٌ ‌أَنْزَلْنَاهُ ‌إِلَيْكَ ‌مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوْا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ- ‘এটি এক বরকতমন্ডিত কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি। যাতে লোকেরা এর আয়াত সমূহ অনুধাবন করে এবং জ্ঞানীরা উপদেশ গ্রহণ করে’ (ছোয়াদ ৩৮/২৯)। তিনি আরো বলেন,يَاأَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ- ‘হে মানবজাতি! তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে এসে গেছে উপদেশবাণী (কুরআন) এবং অন্তরের রোগসমূহের আরোগ্য এবং বিশ্বাসীদের জন্য পথ প্রদর্শক ও রহমত’ (ইউনুস ১০/৫৭)

আমরা অনেকেই প্রতিদিন শুধু শাব্দিক তেলাওয়াতটাই করে থাকি। কিন্তু আমরা কেন এই ঔষধ দিয়ে আমাদের হৃদয়ের রোগ দূর করতে পারি না? কেন আমাদের অন্তুরগুলো সেভাবে বিনম্র চিত্তে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে না যেভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে ঘোর মুশরিকরাও কুরআন শুনে সিজদায় পড়ে যেত?

এর একটি কারণ কম-বেশী আমাদের সবার মাঝে পাওয়া যায়। আর সেটা হ’ল কুরআন অনুধাবন করতে না পারা। শায়েখ আব্দুল আযীয আত-তারিফী বলেন,يفقد كثيرٌ من الناس بركة القرآن وأثره في نفوسهم لأنهم شُغلوا عن تدبّر كلام الباري بتأمل صوت القاريء، ‘অধিকাংশ মানুষের অন্তরগুলো কুরআনের বরকত এবং এর প্রভাব থেকে বঞ্চিত থাকে। কারণ তারা স্রষ্টার কালাম নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার বদলে তেলাওয়াতকারীর সুরের মূর্ছনা দিয়ে অধিক ব্যস্ত থাকে’।[23]

কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা ছিল সালাফে ছালেহীনের নিত্যদিনের আমল। তাদাববুর বা চিন্তা-ভাবনা ছাড়া তারা কুরআন তেলওয়াতের কথা কল্পনাই করতে পারতেন না। এজন্য যখনই তারা কুরআনের সামনে বসতেন, তাদের চেহারা পাল্টে যেত। শোনা যেত শুধু কান্নার আওয়াজ, কুরআনের বাণী কেড়ে নিত তাদের ঘুম।

আহমাদ ইবনে আবূল হাওয়ারী (রহ.) বলেন,إني لأقرأ القرآن، فأنظر في آية آية، فيحار فيها عقلي، وأعجب من حفاظ القرآن، كيف يهنيهم النوم، ويسعهم أن يشتغلوا بشيء من الدنيا، وهم يتلون كلام الرحمن؟ أما لو فهموا ما يتلون، وعرفوا حقه، وتلذذوا به، واستحلوا المناجاة به، لذهب عنهم النوم، فرحا بما قد رزقوا، ‘কুরআন পড়ার সময় আমি যখন একের পর এক আয়াতের দিকে তাকাই, তখন হতভম্ব হয়ে যাই! হাফেযদের কথা ভেবে যারপরনাই অবাক হই। কিভাবে তারা তেলাওয়াত না করে সারারাত ঘুমিয়ে কাটায়? কিভাবে তারা এই কুরআন ছেড়ে দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে? দয়াময় আল্লাহর যে কালাম তারা তেলাওয়াত করে, এর অর্থ যদি তারা বুঝত, তাহ’লে এর হক জানতে পারত; এর মাঝেই খুঁজে পেত প্রশান্তি। আর এর দ্বারা আল্লাহকে ডাকার যে কি শান্তি, তা যদি তারা অনুধাবন করতে পারত, তাহ’লে তারা আনন্দের আতিশয্যে নির্ঘুম কাটিয়ে দিত সারারাত; এই কারণে যে তারা কত বড় নে‘মত লাভ করেছে’।[24]

মালিক ইবনে দীনার (রহ.) বলেন, أقسم لكم، لا يؤمن عبد بهذا ‌القرآن إلا صدع قلبه، ‘আমি তোমাদেরকে কসম করে বলতে পারি, যে বান্দা কুরআনের প্রতি ঈমান রাখে, কুরআনের মাধ্যমে তার হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হবেই’।[25] কিন্তু আমাদের অন্তর চূর্ণ-বিচূর্ণ হয় না কেন? এর কারণ উল্লেখ করে শায়েখ ওছায়মীন (রহ.) বলেন,اعلم أنك كلما حجبت عن فهم كلام الله فإنما ذلك من معاصٍ تراكمت على قلبك، وإلا لو كان قلبك نقياً وصافياً لرأيت أن كلام الله تعالى أعظم الكلام، ‘মনে রাখবেন! যদি আল্লাহর কালাম অনুধাবন করতে আপনার অসুবিধা হয়, তাহ’লে সেটা আপনার হৃদয়ে পুঞ্জিভূত পাপের কারণেই হয়েছে। কারণ আপনার হৃদয়টা যদি পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন থাকে, তাহ’লে দেখতে পাবেন- আল্লাহর কালাম কতই না মহান’।[26]

যিনি নিজের হৃদয়কে পাপের ময়লা থেকে পরিষ্কার রাখতে পারেন, তিনি যথাযথভাবে কুরআন অনুধাবন করতে পারেন, এর অমিয় স্বাদ আস্বাদন করতে পরেন। ফলে কুরআনের মাধ্যমে প্রভাবিত হওয়ার জন্য তার অন্যের তেলাওয়াত শুনতে হয় না, ক্বারীর কান্না শুনে অন্তর নরম করা লাগে না; বরং হৃদয় কুটির নিজেই নম্র হয়ে যায় কুরআনের বাণীতে। সুতরাং আমরা যদি রামাযান মাসে চিন্তা-ভাবনা করে কুরআন তেলাওয়াতে অভ্যস্ত হ’তে পারি, তাহ’লে এর প্রভাব সারা বছর ধরে রাখা কখনোই কঠিন হবে না।

৬. সৎ সঙ্গে থাকা এবং অসৎ সঙ্গ পরিহার করা :

রামাযানের প্রভাব ধরে রাখার জন্য সৎ সঙ্গের অনেক বড় প্রভাব রয়েছে। কারণ মানুষ তার চারপাশের পরিবেশ ও প্রতিবেশের মাধ্যমে নিজের অজান্তেই প্রভাবিত হয়। খারাপ মানুষের সাথে মিশলে তার হৃদয়ে মন্দ প্রভাব পড়ে। সে যদি পাকা মুসলিম হয়, তাহ’লে হয়ত সে ঐ খারাপ কাজ করবে না; কিন্তু এটা নিশ্চিত যে সেই পাপের কাজটি তার কাছে আস্তে আস্তে হালকা হয়ে যাবে এবং পরবর্তীতে সেই কাজে জড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে। সুতরাং ঈমানকে তাযা রাখার জন্য সৎ সঙ্গের কোন বিকল্প নেই। কারণ কোন ব্যক্তি রামাযান মাসে ঈমানী পরিবেশে যতই পরহেযগার মানুষের সাথে থাকুক না কেন, রামাযানের পরে যদি তিনি খারাপ মানুষ ও পরিবেশে মেশেন, তাহ’লে তার জন্য রামাযানের ঈমানী প্রভাব ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে এবং ক্ষেত্র বিশেষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তাই হৃদয়জগতে তাক্বওয়ার প্রভাব জাগিয়ে রাখার জন্য মুত্তাক্বী বান্দাদের সংস্পর্শে থাকা যরূরী। আল্লাহ বলেন, الْأَخِلَّاءُ يَوْمَئِذٍ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ إِلَّا الْمُتَّقِينَ، ‘বন্ধুরা সেদিন পরস্পরে শত্রু হবে মুত্তাক্বীরা ব্যতীত’ (যুখরূফ ৪৩/৬৭)। ইবনে আত্বা (রহ.) বলেন,‌إذَا ‌أَرَدْتَ ‌أَنْ ‌تَعْرِفَ ‌مَقَامَك عِنْدَهُ فَانْظُرْ مَا أَقَامَكَ فِيهِ، ‘যদি তুমি আল্লাহর কাছে নিজের অবস্থান জানতে চাও, তাহ’লে লক্ষ্য করে দেখ! তুমি নিজেকে কোন অবস্থায় (কাদের সঙ্গে) রেখেছ’।[27]

৭. বেশী বেশী তওবা-ইস্তিগফার করা :

মানুষের পার্থিব ও পরকালীন জীবনে যাবতীয় দুর্গতির প্রধান এবং মূল কারণ হ’ল তার অর্জিত পাপ। পাপ ও গুনাহের কারণেই বান্দা নেক আমলের তাওফীক্ব লাভে ব্যর্থ হয়। রামাযান মাসে যারা ঈমান ও ইহসানের সাথে ইবাদত-বন্দেগী করতে পারে, তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু যারা নিজেদের পাপগুলো মাফ করে নিতে ব্যর্থ হয়, তাদের জীবন অভিশপ্ত হয়ে যায়। ফলে তাদের অন্তরে রামাযানের কোন প্রভাব থাকে না। রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেছেন, كُلُّ بَنِي آدَمَ خَطَّاءٌ، وَخَيْرُ الْخَطَّائِينَ التَّوَّابُونَ، ‘প্রত্যেক আদম সন্তানই ভুলকারী। তবে উত্তম ভুলকারী তারাই, যারা বারবার তওবা করে’।[28] হাসান বাছরী (রহ.) বলেন,أَكْثِرُوا مِنَ الِاسْتِغْفَارِ فِيْ بُيُوْتِكُمْ، وَعَلَى مَوَائِدِكُمْ، وَفِيْ طُرُقِكُمْ، وَفِيْ أَسْوَاقِكُمْ، وَفِيْ مَجَالِسِكُمْ أَيْنَمَا كُنْتُمْ، فَإِنَّكُمْ مَا تَدْرُوْنَ مَتَى تَنْزِلُ الْمَغْفِرَةُ، ‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন বেশী বেশী ক্ষমাপ্রার্থনা কর; তোমাদের বাড়ি-ঘরে, রাস্তা-ঘাটে, হাট-বাজারে এবং মজলিসগুলোতে। কারণ তোমরা তো জানো না কখন ক্ষমা অবতীর্ণ হবে’।[29]

বান্দা যত বেশী ক্ষমাপ্রার্থনা করে, তার হৃদয় ততই পরিষ্কার থাকে। আর পরিচ্ছন্ন হৃদয়ে যে কোন ইবাদতে সে আত্মনিয়োগ করতে পারে এবং সেই আমলে অপার্থিব তৃপ্তি অনুভব করতে পারে। তওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে হৃদয়কে পরিচ্ছন্ন না করা পর্যন্ত কোন ইবাদতের পরিপূর্ণ স্বাদ আস্বাদন করা কখনোই সম্ভব নয়। কারণ মানুষের হৃদয়টা শুভ্র-সাদা দেওয়ালের মত, যখন সে পাপ করে সেই দেওয়ালে ময়লা দাগ পড়ে। পাপ যত বেড়ে যায়, হৃদয়ের ময়লাও তত বেশী হয়। এক পর্যায়ে অন্তরটা জং ধরে যায়। জং ধরা যন্ত্রপাতি দিয়ে যেমন কোন উপকার পাওয়া যায় না, ময়লা ও নোংরা কাপড় পরিধান করে যেমন সতেজতা অনুভব করা যায় না, জ্বরাক্রান্ত মুখে যেমন পসন্দনীয় খাবারের স্বাদ পাওয়া যায় না- ঠিক তেমনি ময়লাযুক্ত হৃদয় নিয়ে ইবাদতের আগ্রহ ও তৃপ্তি অনুভব করা যায় না। সুতরাং তওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে হৃদয়কে যত বেশী পরিষ্কার রাখা যাবে, রামাযানের প্রভাব ধরে রাখা ততটাই সহজ হয়ে যাবে। আর ইবাদত কবুলে অন্যতম একটি লক্ষণ হ’ল বেশী বেশী ক্ষমাপ্রার্থনা করতে পারা। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহ.) বলেন,إِنَّ الْعَارِفَ لَيَسْتَغْفِرُ اللهَ عُقَيْبَ طَاعَتِهِ ‘জ্ঞানী বান্দা আল্লাহর ইবাদতের পর পরেই তাঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে থাকে’।[30]

৮. ক্বিয়ামুল লাইলে অভ্যস্ত হওয়া :

রামাযানের একটি উল্লেখ্যযোগ্য এবং বড় ধরনের ইবাদত হ’ল ক্বিয়ামুল লাইল বা তারাবীহ। রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেছেন, مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ، ‘যে ব্যক্তি রামাযান মাসে ঈমানের সাথে ও ছওয়াব লাভের আশায় ক্বিয়ামুল লাইল আদায় করবে, তার পূর্বের সকল পাপ ক্ষমা করা হবে’।[31] সারামাস এই ছালাতের বিধান দেওয়ার হেকমত হ’ল বান্দা যেন এই একমাস তারাবীহর ছালাতের প্রশিক্ষণ নিয়ে বছরের বাকী দিনগুলোতেও এই ছালাতে অভ্যস্ত হ’তে পারে। কারণ আল্লাহর নৈকট্য হাছিলে অন্যতম বড় মাধ্যম হ’ল ক্বিয়ামুল লাইল। উল্লেখ্য যে, তাহাজ্জুদ, তারাবীহ, ক্বিয়ামুল লাইল, ক্বিয়ামু রামাযান সবকিছুকে এক কথায় ‘ছালাতুল লাইল’ বা ‘রাত্রির (নফল) ছালাত’ বলা হয়। ক্বিয়ামুল লাইল আদায় করা পূর্ববর্তী নেককার বান্দাদের চিরায়ত অভ্যাস ছিল।

রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেছেন,عَلَيْكُمْ بِقِيَامِ اللَّيْلِ؛ فَإِنَّهُ دَأَبُ الصَّالِحِينَ قَبْلَكُمْ، وَهُوَ قُرْبَةٌ إِلَى رَبِّكُمْ، وَمَكْفَرَةٌ لِلسَّيِّئَاتِ، وَمَنْهَاةٌ لِلْإِثْمِ، ‘তোমরা অবশ্যই রাতের ইবাদত করবে। কেননা এটা তোমাদের পূর্ববর্তী সৎকর্মশীল বান্দাদের অভ্যাস, আর এটা তোমাদের রবের নৈকট্য লাভের উপায়, গুনাহসমূহের কাফফারা এবং পাপের প্রতিবন্ধক’।[32] তিনি আরো বলেছেন, أَفْضَلُ الصَّلَاةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلَاةُ اللَّيْلِ، ‘ফরয ছালাতের পর সর্বাধিক ফযীলতপূর্ণ ছালাত হ’ল রাত্রির (নফল) ছালাত’।[33]

রাসূলুল্লাহ (ছা.) এই ছালাতকে এত বেশী গুরুত্ব দিতেন যে, তিনি কখনো এই ছালাত পরিত্যাগ করতেন না। যদি অসুস্থ থাকতেন তবে বসে হ’লেও ক্বিয়ামুল লাইল আদায় করতেন। মা আয়েশা (রা.) বলেন,‌لَا ‌تَدَعْ ‌قِيَامَ ‌اللَّيْلِ فَإِنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ لَا يَدَعُهُ وَكَانَ إِذَا مَرِضَ أَوْ كَسِلَ صَلَّى قَاعِدًا، ‘তুমি ক্বিয়ামুল লাইল পরিত্যাগ করো না। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছা.) কখনো এটা ছাড়তেন না। তিনি অসুস্থ থাকলে বা অলসতা লাগলে বসে হ’লেও ক্বিয়ামুল লাইল আদায় করে নিতেন’।[34]

সুতরাং সাধ্যানুযায়ী অল্প হ’লেও রাতের ছালাতে অভ্যস্ত হওয়া উচিত। যদি শেষ রাতে তাহাজ্জুদ পড়া সম্ভব না হয়, তবে এশার পরে ঘুমের আগে দুই রাক‘আত বা চার রাক‘আত ছালাত আদায়ের মাধ্যমে আমরা ক্বিয়ামুল লাইলের নেকী হাছিল করতে পারি। আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ ও আব্দুল্লাহ ইবনে আমর থেকে মাওকূফ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, ‌مَنْ ‌صَلَّى ‌أَرْبَعًا ‌بَعْدَ ‌الْعِشَاءِ كُنَّ كَقَدْرِهِنَّ مِنْ لَيْلَةِ الْقَدْرِ، ‘যে ব্যক্তি এশার পরে চার রাক‘আত ছালাত আদায় করবে, সেটা হবে লাইলাতুল ক্বদরের ছালাতের মত মর্যাদাপূর্ণ’।[35] রাসূলুল্লাহ (ছা.) মসজিদে এশার ছালাত আদায় করে বাড়িতে এসে ঘুমের আগে এই চার রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন।[36] যারা গুরুত্বের সাথে মর্যাদা উপলব্ধি করে রামাযানে তারাবীহর ছালাত আদায় করবে, তাদের জন্য এই ছালাতে অভ্যস্ত হওয়া মোটেও কঠিন হবে না।

৯. মৃত্যুর ভাবানায় হৃদয় জগৎ উজ্জীবিত রাখা :

মৃত্যুর ভাবনা এমন একটি ইবাদত যা সর্বদা বান্দাকে নেক আমল সম্পাদনে তৎপর রাখে। আমরা জানি না কখন কোথায় এবং কিভাবে আমাদের মৃত্যু হবে। তবে সবসময় যদি অন্তরে মৃত্যুর ভাবনা জাগিয়ে রাখা যায়, তাহ’লে নেক আমল ও ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে আখেরাতের প্রস্ত্ততি নেওয়া অনেকটা সহজ হয়ে যায়। তাছাড়া মৃত্যুর আগে সৎ কাজে নিয়োজিত থাকা আল্লাহর রেযামন্দি হাছিলের লক্ষণ। রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেছেন,إِذَا ‌أَرَادَ ‌اللهُ ‌بِعَبْدٍ ‌خَيْرًا ‌اسْتَعْمَلَهُ ‌قَبْلَ ‌مَوْتِهِ، ‘আল্লাহ যখন কোন বান্দার কল্যাণ চান, মৃত্যুর আগে তাকে ভালো কাজে নিয়োজিত রাখেন। ছাহাবীগণ বললেন, يَا رَسُولَ اللهِ وَكَيْفَ يَسْتَعْمِلُهُ؟ ‘হে আল্লাহর রাসূল! কিভাবে তাকে ভালো কাজে নিয়োজিত রাখেন?’ তিনি বলেন,يُوَفِّقُهُ لِعَمَلٍ صَالِحٍ، ثُمَّ يَقْبِضُهُ عَلَيْهِ، ‘তাকে নেক আমল করার তাওফীক্ব দান করেন। অতঃপর তাকে মৃত্যু দান করেন’।[37] সুতরাং আমাদেরকে ফরয-ওয়াজিব ইবাদতের পাশাপাশি নফল, সুন্নাত ও মুস্তাহাব আমলে অভ্যস্ত হওয়া উচিত এবং নিজের কিছু গোপন আমল থাকা উচিত যে ইবাদতের কথা এক আল্লাহ ছাড়া পৃথিবীর কেউ জানে না। কারণ গোপন ইবাদতের মাধ্যমে অন্তর পরিশুদ্ধ হয় এবং নেক আমলের তাওফীক্ব অর্জিত হয়। মহান আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তাদেরকে আরশের নীচে ছায়া দান করবেন।[38] যারা মৃত্যুর ভাবনায় ব্যস্ত থাকেন, তারা কখনো অহেতুক কাজে সময় অপচয় করে না; বরং প্রকাশ্য ও গোপনে সর্বদা আখেরাতের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে। সার্রী আস-সাক্বত্বী বলেন,إنْ اغْتَمَمْتَ بِمَا يَنْقُصُ مِنْ مَالِكَ فَابْكِ عَلى مَا يَنْقُصُ مِنْ عُمُرِكَ، ‘সম্পদ হ্রাস পাওয়ার কারণে যদি তোমার দুঃশ্চিন্তা হয়, তাহ’লে আয়ু কমে যাওয়ার কারণে তোমার ক্রন্দন করা উচিত’।[39]

১০. দো‘আ করা :

যে কোন নেক কাজের তাওফীক্ব লাভের জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করা কর্তব্য। সালাফে ছালেহীন রামাযান আগমনের ছয় মাস আগে থেকে দো‘আ করতেন, যেন রামাযানের ইবাদত-বন্দেগী ভালোভাবে করতে পারেন। আবার রামাযানে সম্পাদিত নেক আমল কবুল হওয়ার জন্য পরবর্তী পাঁচ মাস আল্লাহর কাছে দো‘আ করতেন। অর্থাৎ সারাটা বছর রামাযানের প্রভাবে তাদের হৃদয়গুলো প্রভাবিত থাকতো। ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহ.) ঈদের খুৎবায় বলতেন, ‘হে লোক সকল! তোমরা ত্রিশ দিন ছিয়াম রেখেছ, ক্বিয়াম করেছ। আর আজকের এই ঈদগাহে তোমাদের আমলগুলো কবুল করার আরয নিয়ে আল্লাহর দরবারে হাযির হয়েছ’।[40]

উপসংহার :

পরিশেষে বলা যায়, রামাযানের প্রভাব ধরে রাখতে হ’লে রামাযানের আগে থেকেই এর প্রস্ত্ততি গ্রহণ করা কর্তব্য। সালাফে ছালেহীন শা‘বান মাস থেকে এর জন্য প্রস্ত্ততি শুরু করে দিতেন। যারা রামাযান মাসে তাক্বওয়ার প্রশিক্ষণ নিতে পারে ঈদের আনন্দ মূলত তাদের জন্যই। আলী (রা.) রামাযানের শেষ রাতে লোকদের ডেকে বলতেন, ‌يا ‌ليت ‌شعري ‌من ‌هذا ‌المقبولُ ‌فنهنيه، ومن هذا المحرومُ فنعزِّيه؟ أيُّها المقبولُ: هنيئًا لك، أيُّهَا المردودُ: جبر اللهُ مصيبتك، ‘হায় আফসোস! আমি তো জানি না, কার আমল কবুল হয়েছে যাকে আমি অভিনন্দন জানাবো, আর কার আমল কবুল হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে যাকে আমি সমবেদনা জানাব। হে যার আমল গ্রহণ করা হয়েছে! তোমার জন্য সুসংবাদ। আর হে যার আমল কবুল না হয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে! দো‘আ করছি আল্লাহ তোমার মুছীবত দূর করে দিন’।[41] ইবনু রজব হাম্বলী (রহ.) বলেন,ليس العيد لمن لبس الجديد، إنما العيد لمن طاعته تزيد، ليس العيد لمن تجمل باللباس والركوب، إنما العيد لمن غفرت له الذنوب، ‘যে ব্যক্তি নতুন কাপড় পরিধান করে, তার জন্য ঈদ নয়; বরং ঈদের আনন্দ সেই ব্যক্তির জন্য আল্লাহর প্রতি যার আনুগত্য বৃদ্ধি পেয়েছে। যে ব্যক্তি বাহন ও পোষাক-পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়, ঈদের আনন্দ তার জন্য নয়। ঈদের খুশি তো কেবল সেই ব্যক্তির জন্য, যার পাপরাশি ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে’।[42]

সুতরাং শুধু দামী পোষাক-পরিচ্ছদ, হরেক রকম খাদ্য খাওয়ার মধ্যে ঈদের প্রকৃত আনন্দ লাভ করা যায় না; রবং রামাযান ব্যাপী তাক্বওয়ার শিক্ষা নিয়ে সারা বছর জীবন পরিচালনার অনুপ্রেরণা ও পাপ বর্জনের সংকল্প নেওয়ার মাধ্যমেই প্রকৃত খুশি ও তৃপ্তির আমেজ পাওয়া যায়। সুফিয়ান আছ-ছাওরী (রহ.) বলেন, আমি সর্ব প্রথম দৃষ্টি সংযত রাখার মাধ্যমে আমার ঈদের দিন শুরু করি’।[43] হাসান বাছরী (রহ.) বলেন,كُلُّ يَوْمٍ لَا يُعْصَى اللهُ فِيْهِ فَهُوَ عِيْدٌ، فَالْيَوْمُ الَّذِيْ يَقْطَعُهُ الْمُؤْمِنُ فِيْ طَاعَةِ مَوْلَاهُ وَذِكْرِهِ وَشُكْرِهِ فَهُوَ لَهُ عِيْدٌ، ‘প্রত্যেক ঐ দিন মুমিনের জন্য ঈদের দিন, যেদিন সে আল্লাহর অবাধ্য হয় না (পাপ করে না)। ঐ দিনটি মুমিনের জন্য ঈদের দিন, যেদিনটি সে প্রভুর আনুগত্যে, তাঁর স্মরণে এবং তাঁর প্রতি শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে অতিবাহিত করে’।[44] মহান আল্লাহ আমাদের হৃদয়কে ছোট-বড় সকল পাপ থেকে পরিষ্কার রাখুন, রামাযানের ঈমানী প্রভাব সারা বছর যত্নের সাথে ধরে রাখার শক্তি দান করুন এবং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে তাঁর আনুগত্যে যাপন করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ

এম.এ, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

[1]. বায়হাক্বী, আয-যুহদুল কাবীর, পৃ. ৩৫১।

[2]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মিফতাহু দারিস সা‘আদাত, ১/২৯৯; আরশীফু মুলতাক্বা আহলিল হাদীছ, পৃ. ৩২১।

[3]. আব্দুল আযীয সালমান, মিফতাহুল আফ্কার ২/৩৮৩।

[4]. বুখারী হা/১; মিশকাত হা/১।

[5]. বুখারী হা/৩৮, ১৯০১; মিশকাত হা/১৯৫৮।

[6]. ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী, মির‘আতুল মাফাতীহ ৬/৪০৫; ইবনু বাত্তাল, শারহু ছহীহিল বুখারী ৪/২১।

[7]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী ৪/১১৫; মানাভী, ফায়যুল ক্বাদীর ৬/১৬০।

[8]. ওছায়মীন, লিক্বাউল বাবিল মাফতূহ ৬৮/১৫।

[9]. ইবনু বাত্ত্বাল, শারহু ছহীহিল বুখারী ৪/২১।

[10]. তিরমিযী হা/৬৮২; মিশকাত হা/১৯৬০, সনদ ছহীহ।

[11]. বুখারী হা/১১৫২।

[12]. বুখারী হা/৫৮৬১; মুসলিম হা/৭৮২; মিশকাত হা/১২৪২ ।

[13]. গাযালী, ইহয়াউ ‘উলূমিদ্দীন ৩/৩৭০।

[14]. বুখারী হা/৫৬৭৩; মুসলিম হা/২৮১৬; মিশকাত হা/২৩৭১।

[15]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৭৬৫০, সনদ ছহীহ।

[16]. ইবনু মাজাহ হা/৪১৯৮; মুস্তাদরাকে হাকেম হা/৩৪৮৬।

[17]. রেযা আহমাদ ছামদী, আল-ক্বাওয়ায়িদুল হাস্সান ফী আস্রারিত্ব ত্বা‘আতি ওয়াল ইসতি‘দাদি লি রামাযান, পৃ. ১৩৬।

[18]. মুহাম্মাদ হুসাইন ইয়াকূব, আসরারুল মুহিবিবন ফী রামাযান, পৃ.৩৪০।

[19]. ইবনু রজব হাম্বলী, লাত্বায়েফুল মা‘আরেফ, পৃ. ১৪৮; আব্দুল আযীয সালমান, মাওয়ারিদুয যামআন, ১/৩৩৮।

[20]. দুরূস শায়েখ আয়েয আল-ক্বারনী, ২২২/২৫।

[21]. তিরমিযী হ/২৯১০; মিশকাত হা/২১৩৭; সনদ ছহীহ।

[22]. ওছায়মীন, মাজালিসু শাহরি রামাযান, পৃ. ৬৩।

[23]. https://muslimreminders.wordpress.com/2019/11/17/shaykh

-abdul-aziz-at-tarefe/

[24]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া, ২/৩৯০।

[25]. ইবনু রজব হাম্বলী, আয-যিল্লু ওয়াল ইন্কিসার, পৃ.২৯৮।

[26]. ওছায়মীন, আল-লিক্বাউশ শাহ্রী, ৩১/২।

[27]. বারীক্বাহ মাহমূদিইয়াহ, ৩/৮৫।

[28]. ইবনু মাজাহ হা/৪২৫১; মিশকাত হা/২৩৪১, সনদ হাসান।

[29]. ইবনু রজব হাম্বলী, জামে‘উল ‘উলূম ওয়াল হিকাম ২/৪০৮।

[30]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন, ২/৬২।

[31]. বুখারী হা/৩৭; মুসলিম হা/৭৫৯; মিশকাত হ/১৯৫৮।

[32]. তিরমিযী হা/৩৫৪৯; মিশকাত হা/১২২৭, সনদ হাসান।

[33]. মুসলিম হা/১১৬৩; তিরমিযী হা/ ৪৩৮; নাসাঈ হা/১৬১৩; মিশকাত হা/২০৩৯

[34]. আবূদাঊদ হা/১৩০৭; মুসনাদে আহমাদ হা/২৬১১৪; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৮০০, সনদ ছহীহ।

[35]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৭৪৬৭; ছহীহুল কুতুবিত তিস‘আ হা/১৭১৬, সনদ ছহীহ; মুহাক্কিক্ব: আলবানী ও সা‘দ শাছরী।

[36]. বুখারী হা/১১৭।

[37]. আহমাদ হা/১২২১৪; মুসনাদে আবী ইয়া‘লা মাওছীলী হা/৩৮৪০, সনদ ছহীহ।

[38]. বুখারী হা/৬৬০; মুসলিম হা/৭০১; মিশকাত হা/১০৩১।

[39]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া ১/৪৯৭।

[40]. সাইয়েদ হুসাইন আল-আফানী, নিদাউর রাইয়ান ফী ফিক্বহিছ ছাওম, ২/২০৪।

[41]. ইবনু রজব, লাত্বাইফুল মা‘আরেফ, পৃ. ২১০।

[42]. লাত্বাইফুল মা‘আরেফ, পৃ. ২৭৭।

[43]. ইবনুল জাওযী, আত-তাবছিরাহ, পৃ. ১০৬।

[44]. লাতাইফুল মা‘আরেফ, পৃ.২৭৮।






বিষয়সমূহ: ছিয়াম-রামাযান
দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকার (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত (৬ষ্ঠ কিস্তি) - মুযাফফর বিন মুহসিন
মুহাম্মাদ (ছাঃ)-ই সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল - আব্দুল্লাহ বিন আবদুর রাযযাক
ইখলাছ (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
হাদীছ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পরিক্রমা - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
আলেমের গুরুত্ব ও মর্যাদা - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
প্রাক-মাদ্রাসা যুগে ইসলামী শিক্ষা (২য় কিস্তি) - আসাদুল্লাহ আল-গালিব (শিক্ষার্থী, ইংরেজী বিভাগ, ২য় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণ সমূহ (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
হিজামা : নবী (ছাঃ)-এর চিকিৎসা - মুহাম্মাদ আবু তাহের, পরিচালক, কিউসেট ইনস্টিটিউট, সিলেট।
দাওয়াত ও সংগঠন (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
চিন্তার ইবাদত - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
যাকাত সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
আরও
আরও
.