সৎ ও মুখলিছ লোকদের সাহচর্য লাভ :
মানুষ যার সাথে উঠা-বসা ও চলাফেরা করে তার দ্বারা প্রভাবিত হয়। যদি কেউ মুখলিছ লোকদের সাহচর্য লাভ করে তবে তার মধ্যে ইখলাছের ধারণা প্রবল হবে। আর যদি কোন ব্যক্তি লোক দেখানো ভাবনাধারী বা লোকশুনানো ধারণার বাহকের সাথে চলাফেরা করে তবে তার দৃষ্টিভঙ্গি তার সঙ্গীর মতই হবে। এটা সকলের কাছে বোধগম্য। যেমন হাদীছে এসেছে, اَلْمَرْءُ عَلَى دِيْنِ خَلِيْلِهِ، فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُّخَالِلْ- ‘মানুষ তার বন্ধুর আদর্শে গড়ে ওঠে। তাই তোমরা খেয়াল করে দেখবে যে, কাকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করছ’।[1]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেছেন, ‘সৎসঙ্গ অবলম্বনকারী ও অসৎসঙ্গ গ্রহণকারীদের দৃষ্টান্ত হ’ল যথাক্রমে সুগন্ধি বিক্রেতা ও কামারের মত। সুগন্ধি বিক্রেতা হয়ত তোমাকে কিছু সুগন্ধি দিবে অথবা তুমি তার থেকে সুগন্ধি কিনবে। যদি কোনটিই না হয়, তবে কমপক্ষে তার থেকে এমনিতেই সুঘ্রাণ পাবে। আর কামারের ব্যাপারটা হ’ল, হয়ত তার আগুনের ফুলকিতে তোমার কাপড় পুড়ে যাবে অথবা তার হাপরের দুর্গন্ধ তোমাকে পেয়ে বসবে’।[2]
তাই যিনি ইখলাছ অবলম্বন করতে চান তাকে অবশ্যই সৎসঙ্গ নির্বাচন করতে হবে।
মুখলিছ ও সৎ-কর্মপরায়ণদের আদর্শ রূপে গ্রহণ করা :
ইসলামের প্রথম যুগে নবী ও রাসূল, ছাহাবায়ে কেরাম, তাবে‘ঈন ও ইমামগণ, যারা নিজেদের জীবনে ইখলাছের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তাদেরকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করলে ইখলাছ অবলম্বনে সহায়ক হবে। প্রতিটি কাজে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা উচিত। যেমন আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন,
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيْراً-
‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (আহযাব ৩৩/২১)।
আল্লাহ আরো বলেন,
أُوْلَـئِكَ الَّذِيْنَ هَدَى اللّهُ فَبِهُدَاهُمُ اقْتَدِهْ قُل لاَّ أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْراً إِنْ هُوَ إِلاَّ ذِكْرَى لِلْعَالَمِيْنَ-
‘তাদেরকে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেছেন। সুতরাং তুমি তাদের পথের অনুসরণ কর। আপনি বলে দিন! আমি তোমাদের কাছে এর জন্য কোন পারিশ্রমিক চাই না। এটি সারা বিশ্বের জন্য একটি উপদেশমাত্র’ (আন‘আম ৫/৯০)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (মুমতাহিনা ৬০/৯)।
এমনিভাবে সৎকর্মপরায়ণদের অনুসরণ করার ব্যাপারে হাদীছেও নির্দেশ এসেছে, ‘তোমরা আমার সুন্নাহ ও খোলাফায়ে রাশেদার আদর্শ দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরবে’।[3]
এজন্য রাসূল ও তাঁর ছাহাবাদের সীরাত বা জীবনী অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। তাদের সীরাত অধ্যয়ন ব্যতীত তাদের আদর্শ কিভাবে জানা যাবে।
ইখলাছকে জীবনের একটি লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করা :
ইখলাছ অবলম্বন করতে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা অনেক। কিন্তু সত্যিকার মুখলিছদের সংখ্যা খুবই কম। এর কারণ ইখলাছ অবলম্বনে প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্তেবও তারা ইখলাছকে জীবনের একটি লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করতে পারেনি। একে একটি লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করলে এর অনুশীলনের প্রশ্ন আসে, মুহাসাবা বা আত্মসমালোচনার বিষয় আসে। এ ভাবনাগুলো ইখলাছ অবলম্বন করতে সহায়তা করে। যদি কেউ এটাকে অতিরিক্তি ছওয়াবের বিষয় বা নফল কাজ হিসাবে মূল্যায়ন করে, তবে সে হয়ত কখনো ইখলাছ অবলম্বনে সফল হ’তে পারবে না।
ইখলাছের পথে যা বাধা হয়ে দাঁড়ায়
এমন কিছু বিষয় আছে যা ইখলাছের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নিম্নে আমরা তার উল্লেখযোগ্য কিছু উপস্থাপন করছি।
প্রথমত : রিয়া ও সুম‘আ :
রিয়া অর্থ লোক দেখানো ভাবনা। আর সুম‘আ অর্থ মানুষকে শোনানো বা প্রচারের ভাবনা।
পারিভাষিক অর্থে রিয়া হ’ল মানুষকে দেখিয়ে তাদের প্রশংসা অর্জনের জন্য ইবাদত-বন্দেগী তথা সৎকর্মগুলো প্রকাশ করা (ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী)। ইমাম গাযালী (রহঃ) বলেন, রিয়া হ’ল ভাল কাজ-কর্ম মানুষকে দেখিয়ে তাদের অন্তরে নিজের স্থান করে নেয়া, যাতে লোকের কাছে নিজের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
আর সুম‘আ হ’ল নিজের ইবাদত-বন্দেগীর কথা মানুষকে শোনানো (আল-আশকর, আল-ইখলাছ)।
রিয়া ও সুম‘আর ব্যাপারে হাদীছে সতর্কবাণী এসেছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন বিষয় সম্পর্কে অবহিত করব না যাকে আমি দাজ্জালের চেয়ে বেশী ভয় করি? আমরা বললাম, অবশ্যই আপনি আমাদের বলে দিবেন। তিনি বললেন, তা হ’ল সূক্ষ্ম শিরক। তা এমন যে, কোন ব্যক্তি ছালাত আদায় করতে দাঁড়িয়ে খুব সুন্দর করে আদায় করল, কিন্তু তার অন্তরে ক্রিয়াশীল ছিল অন্যকে দেখানোর ভাবনা’।[4]
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, মানুষের কর্তব্য এই যে, সে আল্লাহর হুকুম সমূহ পালন করবে, তাঁর নিষেধ থেকে ফিরে থাকবে শুধু তাঁকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে। এছাড়া যদি সে এর মাধ্যমে নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব লাভের নিয়ত করে, অন্যকে অবমাননা করার সংকল্প করে, তাহ’লে এটা হবে জাহেলিয়াত। যা আল্লাহর কাছে কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। আবার সে যদি এ কাজগুলো মানুষকে দেখানো বা প্রচারের উদ্দেশ্যে করে, তবে তার কোন ছওয়াব থাকবে না (ইবনু তায়মিয়া, মিনহাজুস সুন্নাহ)।
দ্বিতীয়ত : আত্মতৃপ্তি
আত্মতৃপ্তি মানে এক ধরনের আত্মম্ভরিতা বা অহংকার। এটা কথা-বার্তা, চাল-চলন, কাজ-কর্মে অহংকার প্রকাশ করতে উদ্বুদ্ধ করে। আত্মতৃপ্তি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে অত্যন্ত সৎ মনে করে, পাক-সাফ ও অন্যের চেয়ে এগিয়ে আছি-এমন একটি ধারণা তার মাঝে সর্বদা কাজ করে। আত্মতৃপ্তি মানুষের আত্মার জন্য একটি ভয়াবহ ব্যাধি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তিনটি বিষয় মানুষকে ধ্বংস করে দেয়- নিজ প্রবৃত্তির আনুগত্য, অব্যাহত কৃপণতা, নিজের ব্যাপারে সু-ধারণা পোষণ বা আত্মতৃপ্তি। এটি এ তিনটির মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ’।[5]
আত্মতৃপ্তি মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। কারণ এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের ইবাদত-বন্দেগীকে বড় করে দেখে। তার ধারণা, সে স্বয়ং আল্লাহর উপকার করছে। আল্লাহ তা‘আলা যে নিজ অনুগ্রহে তাকে ভাল পথে চলার সামর্থ্য দিয়েছেন এ কথা সে ভুলতে বসে। ফলে সে ইখলাছের সকল বিপদ থেকে অন্ধ হয়ে যায়। তার ইখলাছ অবলম্বনে কি কি বাধা রয়েছে এ সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ বে-খবরে পরিণত হয়।
আত্মতৃপ্তি নামের এ ধ্বংসাত্মক রোগ থেকে কিভাবে বেঁচে থাকা যায়? কিভাবে এর চিকিৎসা সম্ভব? নিজের আত্মাকে সত্যিকার অর্থে অনুভব করতে হবে, লালন করতে হবে তাকে এবং নিজের প্রতিপালককে চিনতে-জানতে হবে। প্রতিপালকের সাথে নিজেকে চিনতে হবে এভাবে যে, আমার প্রতিপালক কত মহান! তিনি আমার উপর কত অনুগ্রহ করেছেন। আমার মত লক্ষ-কোটি মানুষ রয়েছে, তাদেরকে তাঁর অনুগত হওয়ার সুযোগ দেননি, আমাকে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে আমার কি কৃতিত্ব আছে? আমি কি ছিলাম? তিনি তাঁর একান্ত অনুগ্রহে আমাকে এ পর্যন্ত আসতে দিয়েছেন। আমি এখন যে সকল সৎকর্ম করছি তার সবগুলো কি তাঁর পসন্দ মত করছি? কি নিশ্চয়তা আছে এর?
একদিন মালেক ইবনু দীনারের কাছ দিয়ে মুহাল্লাব ইবনু আবি সাফারাহ বীরের মত হেলেদুলে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তার এ অবস্থা দেখে মালেক ইবনে দীনার তাকে বললেন, তুমি কি জানো না যুদ্ধের ময়দানে শত্রু সারি ব্যতীত এ রকম হাঁটা ঠিক নয়? মুহাল্লাব উত্তরে গর্ব করে বললেন, তুমি কি চেন না আমি কে? মালেক ইবনে দীনার বললেন, হ্যঁা, আমি তোমাকে ভাল করে চিনি। মুহাল্লাব বললেন, তুমি আমার সম্পর্কে কি জান? মালেক ইবনে দীনার বললেন, তোমার শুরুটা ছিল এক দুর্গন্ধময় বীর্য। তোমার শেষটা হবে একটি পঁচা লাশ। এর মধ্যবর্তী সময়ে তুমি বহন করে চলছ কতগুলো ময়লা-আবর্জনা।
আসলে মানুষ যতই গর্ব ও অহংকার করে থাক না কেন, প্রত্যেকের আসল পরিচয় তো এটাই, যা মালেক ইবনে দীনার (রহঃ) বললেন। তাই এ ধরনের অনুভূতি জাগ্রত রাখলে গর্ব, অহংকার, আত্মতৃপ্তি নামক রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
তৃতীয়ত : নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ
নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ ইখলাছ অবলম্বনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রবৃত্তির অনুসরণ বলতে বুঝায় নিজের মনে যা চায় সেটাই করা বা তার দিকে ঝুঁকে পড়া। নিজের প্রবৃত্তির অনুগত হয়ে পড়া। প্রবৃত্তিকে উপাস্য হিসাবে নেয়া বলতে এটাকেই বুঝানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন, ‘তুমি কি দেখ না তাকে, যে তার কামনা-বাসনাকে ইলাহ (উপাস্য) রূপে গ্রহণ করে? তবুও কি তুমি তার কর্মবিধায়ক হবে? তুমি কি মনে কর যে, তাদের অধিকাংশ শোনে ও বুঝে? তারা তো পশুর মতই; বরং তারা অধিক পথভ্রষ্ট’। (ফুরক্বান ২৫/৪৩-৪৪)।
আল্লাহ আরো বলেন, ‘তুমি কি লক্ষ্য করেছ তাকে, যে তার খেয়াল-খুশীকে নিজ ইলাহরূপে গ্রহণ করেছে? আল্লাহ জেনে-শুনে তাকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং তার কর্ণ ও হৃদয় সীল করে দিয়েছেন এবং তার চক্ষুর উপর দিয়েছেন আবরণ। অতএব আল্লাহর পরে কে তাকে পথনির্দেশ করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? (জাছিয়া ৪৫/২৩)।
আল্লাহ আরো বলেন, ‘এরপর তারা যদি তোমার আহবানে সাড়া না দেয়, তাহ’লে জেনে রাখবে তারা তো নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে। আল্লাহর পথনির্দেশ অগ্রাহ্য করে যে ব্যক্তি নিজ খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে তার চেয়ে অধিক বিভ্রান্ত আর কে? আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে পথনির্দেশ করেন না’ (ক্বাছাছ ২৮/৫০)।
যে প্রবৃত্তির অনুগত হয়ে পড়ে তার সম্পর্কে আল্লাহর বক্তব্য এমনি পরিস্কার। প্রবৃত্তির অনুগত হওয়া বলতে বুঝায় যখন যা মনে চায়, তাই করা। তাক্বওয়া ও পরহেযগারী, হারাম-হালাল, জায়েয-নাজায়েয, মাকরূহ-মুবাহ ইত্যাদির প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করা।
ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির অনুসরণ করে প্রবৃত্তি তাকে অন্ধ ও বধির বানিয়ে দেয়, ফলে সে স্থির করতে পারে না যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য তার করণীয় কি? আল্লাহ ও রাসূল যাতে সন্তুষ্ট হন সে তাতে সন্তুষ্ট হ’তে পারে না, আল্লাহ ও রাসূল যাতে ক্রোধান্বিত হন, তাতে তো তার রাগ জন্মায় না। বরং নিজের সন্তুষ্টি ও নিজের অসন্তুষ্টিই হ’ল তার লক্ষ্য (মিনহাজুস সুন্নাহ)।
যারা জান্নাতের অধিকারী হবে তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন, ‘সে নিজেকে প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে বিরত রেখেছে’ (নাযি‘আত ৭৯/৪০)।
অতএব প্রবৃত্তির অনুসরণ ইখলাছের পরিপন্থী ও নেক আমল বিনষ্টকারী।
ওমর ইবনু আব্দুল আযীয (রহঃ) বলেছেন, তুমি এমন হয়ো না যে, সত্য যদি তোমার মনপুত হয় তাহ’লে গ্রহণ করবে আর যদি তোমার মনের বিরুদ্ধে যায় তাহ’লে বিরোধিতা করবে। এমন চিন্তা-ভাবনা নিয়ে সত্য গ্রহণ করলে তুমি কোন প্রতিদান পাবে না এবং বাতিল বর্জন করে শাস্তি থেকে বাঁচতে পারবে না। কারণ তুমি যে সত্য গ্রহণ করেছ ও মিথ্যাকে বর্জন করেছ তা তোমার মনের মত হওয়ার কারণে। আল্লাহর জন্য নয় (শারহুল আক্বীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ)।
ইমাম শাতেবী (রহঃ) বলেছেন, প্রবৃত্তির চাহিদায় কোন ভাল কাজও প্রশংসনীয় হ’তে পারে না (শাতেবী, আল-মুআফিকাত)।
আসলেই প্রবৃত্তির বিরোধিতা করা একটা মস্তবড় কঠিন কাজ। এ কাজ করতে না পারার কারণেই অনেক ইহুদী ও খৃষ্টান এবং বহু অমুসলিম ব্যক্তি ইসলামকে সত্য বলে অনুভব করার পরেও তা কবুল করতে পারেনি। তারা নিজেদের সম্প্রদায়, দেশ, ধন-সম্পদ বিসর্জন দিতে রাযী হয়েছে কিন্তু প্রবৃত্তির বিরোধিতা করতে রাযী হয়নি।
ইমাম শাতেবী (রহঃ) চমৎকার বলেছেন, শরী‘আতের বিধি-বিধানের উদ্দেশ্য হ’ল মানুষকে তার প্রবৃত্তির গোলামী থেকে বের করে আল্লাহর গোলামীতে স্বাধীন করে দেয়া। শরী‘আতের পূর্বে সে প্রবৃত্তির বাধ্যগত দাস ছিল। ইসলামী শরী‘আত গ্রহণের ফলে সে আল্লাহর স্বাধীন দাসে পরিণত হ’ল (শাতেবী, আল-মুআফিকাত)।
অতএব যিনি ইখলাছ অবলম্বন করতে চান তার কর্তব্য হ’ল নিজের সংকল্প ও ইচ্ছাকে দৃঢ় করা, আল্লাহর নিকট উপস্থিতিকে ভয় করা, নিজের প্রবৃত্তিকে বাধা দেয়া। তাহ’লে স্থায়ী বাসস্থান হিসাবে জান্নাতের অধিকারী হওয়া যাবে (আল-আশকর, আল-ইখলাছ)।
হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, সর্বোত্তম জিহাদ হ’ল প্রবৃত্তির বিরোধিতা (আল-মাওয়ার্দী, আদাবুদ্দুনিয়া ওয়াদ-দীন)।
ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেন, মানুষের কর্তব্য হ’ল সকল সৎকর্ম করবে আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করার জন্য, আল্লাহ্কে নিজের সম্মুখে উপস্থিত জেনে ও আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য। যদি এ তিনটি শর্ত পূরণ করে সৎকর্ম বা নেক আমল করা যায়, তাহ’লে সকল সৃষ্টিজীব তার পক্ষে থাকবে, সকল কল্যাণ তার কাছেই ছুটে আসবে। আর যদি মানুষকে সন্তুষ্ট করার জন্য প্রবৃত্তির দাসত্ব করা হয় তবে ফলাফল হবে উল্টা... (তাফসীর ইবনু কাছীর)।
চতুর্থ : সৎ কাজে মানুষের প্রশংসা :
মুখলিছ ব্যক্তি সর্বদাই নিজের প্রসার ও প্রচারকে এবং নিজ কাজের সুখ্যাতিকে অপসন্দ করে। আলী (রাঃ) বলেছেন, তুমি প্রসিদ্ধি লাভ করবে এজন্য কোন কাজ শুরু করবে না। মানুষ তোমাকে স্মরণ করবে এ উদ্দেশ্যে নিজের ব্যক্তিত্বকে উন্নত করবে না। শিখবে ও গোপন রাখবে। নীরবতা অবলম্বন করবে, তাহ’লে নিরাপদ থাকবে। সৎকর্মপরায়ণ লোকদের দেখলে খুশী হবে এবং অসৎ লোকদের দেখলে ক্রোধান্বিত হবে (তাফসীর ইবনু কাছীর)।
তবে হ্যঁা, মুখলিছ ব্যক্তি যে প্রসিদ্ধি বা মানুষের প্রশংসা পায়, তা অনিচ্ছায় লাভ হয়। সে তা লাভ করার নিয়ত করেনি। নিজের অনিচ্ছায় কোন সুখ্যাতি বা মানুষের প্রশংসা অর্জন হ’লে ইখলাছের কোন ক্ষতি হয় না।
আবু যর (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে আপনার অভিমত কি যে কল্যাণকর কাজ করল এবং মানুষ এর জন্য তার প্রশংসা করল? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘এটা মুমিন ব্যক্তির জন্য অগ্রিম সুসংবাদ’।[6]
পঞ্চম : রিয়ার ভয়ে নেক আমল ত্যাগ করা
কোন ব্যক্তি একটি ভাল কাজ করতে মনস্থির করল। ইতিমধ্যে সে খেয়াল করে দেখল কাজটি করলে মানুষ দেখবে ও প্রশংসা করবে। তাই সে রিয়া বা লোক দেখানো ভাবনায় পড়ে যাবে এ আশংকায় কাজটি ত্যাগ করল। এটা শয়তানের আরকেটি কুমন্ত্রণা।
ইবনু হাযম (রহঃ) বলেন, রিয়া ত্যাগ করার ব্যাপারেও শয়তানের চক্রান্ত আছে। তাহ’ল মানুষের মনে এ ধারণা সৃষ্টি করে দেয়া যে, এ ভাল কাজটি করলে লোকেরা দেখবে, এতে তুমি রিয়ার দোষে দুষ্ট হবে। এ ধারণার পর মানুষ ভাল কাজ সম্পাদন থেকে বিরত থাকল (ইবনু হাযম, আল-আখলাক ওয়াস-সিয়ার)। শয়তান যদি এমনি একটা পথ খুলে নেয় তাহ’লে সকল ভাল কাজে এমনি করে বাধা দিতে থাকবে (আল-আশকর, আল-ইখলাছ)।
ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, যদি কারো নির্দিষ্ট কোন নফল আমল থাকে যেমন চাশতের ছালাত, তাহাজ্জুদ ইত্যাদি তাহ’লে সে এগুলো আদায় করবে, যেখানেই সে থাকুক না কেন। মানুষ দেখবে, সে রিয়ার মধ্যে পড়ে যাবে এ ভয়ে ত্যাগ করবে না। কাজেই যে সকল নেক আমল শরী‘আত অনুমোদিত তা কখনো রিয়া হবে এ ভয় করে ত্যাগ করা যাবে না (ইবনে তায়মিয়া, মাজমূউ ফাতাওয়া)।
ফুযাইল (রহঃ) বলেন, মানুষে দেখবে এ ভয়ে ভাল কাজ ত্যাগ করা একটি রিয়া। কেননা মানুষের জন্যই সে কাজটা ত্যাগ করল। আর মানুষ দেখবে এ উদ্দেশ্যে ভাল কাজ করা হ’ল শিরক। আর ইখলাছ হ’ল এ দু’টো থেকেই বেঁচে থাকা (সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা)।
ইখলাছের পথে যা বাধা নয়
সৎ লোকদের সাথে থাকার সুযোগে নেক আমল করা :
মানুষ যখন কিছু সংখ্যক মুত্তাক্বী-পরহেযগার লোকের সাথে একত্র হয়ে বিভিন্ন ইবাদত-বন্দেগী করে তখন কারো কারো মনে এ ধরনের ভাবনা জন্ম নেয় যে, এ কাজটা মনে হয় রিয়ার মধ্যে পড়ে গেল। যদি কাজটা একান্তে সম্পাদন করা হ’ত তাহ’লে কি ভাল হ’ত না? আসলে ব্যাপারটা এ রকম নয়। জামা‘আতবদ্ধ থাকলে অনেক সময় অন্যের উৎসাহে বা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক নেক আমল করা যায়, যা একা একা করার সুযোগ হয় না বা করতে গেলে অলসতায় পেয়ে বসে। তাই বলে এটা ইখলাছের বিরোধী হওয়ার কোন কারণ নেই।
এক কাজে একাধিক নিয়ত করা :
একটি নেক আমল করার সময় একাধিক ছওয়াবের নিয়ত করা যেতে পারে। এটাকে বলে তাশরীকুন্নিয়্যাত বা নিয়তের ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব। একাধিক নিয়ত দু’ধরনের হয়ে থাকে।
এক- একটি নেক আমল করার মাধ্যমে দু’টো ছওয়াব অর্জনের নিয়ত করা যেতে পারে। এতে ইখলাছের পরিপন্থী কিছু নেই। যেমন কেউ জুম‘আর ছালাতের পূর্বে গোসল করল দু’টো নিয়তে; বড় নাপাকী থেকে পবিত্রতা অর্জন ও জুম‘আর দিনের গোসলের ছওয়াব লাভ। এ দু’টো নিয়ত করা সঠিক হয়েছে। এমনিভাবে আত্মীয়-স্বজনকে দান করে আত্মীয়তার সম্পর্ক মজবুত করা ও ছাদাক্বার ছওয়াব লাভ করার নিয়ত করা যায়। ছালাতের পূর্বে মসজিদে অবস্থান করে ছালাতের অপেক্ষার ছওয়াব ও এ‘তেকাফের ছওয়াবের নিয়ত করতে অসুবিধা নেই।
দুই- একটি নেক আমল করে একটি ছওয়াব ও অন্য একটি আমলের নিয়ত করা। এতেও কোন সমস্যা নেই। যেমন কেউ ওযূ করল ছালাত আদায়ের নিয়তে। কিন্তু সাথে সাথে সে ওযূর মাধ্যমে শরীর ঠান্ডা হবে বা অলসতা কেটে যাবে এ নিয়ত করল। এতে কোন সমস্যা নেই। এমনিভাবে কেউ হজ্জ করতে গেল। তার নিয়ত সে হজ্জের ছওয়াব অর্জন করবে। সাথে নিয়ত করল হজ্জে গিয়ে সে কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য করবে। এতে নাজায়েযের কিছু নেই। মোটকথা একটি নেক আমল করে একাধিক নেক আমলের ছওয়াব অর্জন করার নিয়ত করা ইখলাছের পরিপন্থী নয়।
রিয়া বা লোক দেখানো আমল দু’ধরনের :
এক- এমন নেক আমল, যা শুধু মানুষকে দেখানোর জন্য বা শোনানোর জন্যই করা হয়। কর্তা কখনো আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করার চিন্তা মাথায় স্থান দেয়নি। শুধু পার্থিব স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে করেছে। এমন ধরনের কাজ মুমিন ব্যক্তি করতে পারে না। যে এমন নিয়ত করে সে মুনাফিক। মুনাফিকরাই ইবাদত-বন্দেগীসহ অন্যান্য নেক আমল পার্থিব স্বার্থ আদায়ের জন্য করে থাকে। এভাবে আমল নিঃসন্দেহে বাতিল বলে গণ্য।
নেক আমল করার সময় আল্লাহ রাববুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়ত করার সাথে সাথে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যও থাকে। এটাও বাতিল। এটাকেই হাদীছে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) শিরকে খফী বা ছোট শিরক বলে অভিহিত করেছেন। এ আমলের কোন ছওয়াব পাওয়া যাবে না। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন যে, আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন, ‘আমি শরীকদের শিরকের মোটেই মুখাপেক্ষী নই। যদি কোন ব্যক্তি কোন আমল করে এবং এতে আমার সাথে অন্য কাউকে শরীক করে তাহ’লে আমি তাকে ও তার শিরকী কাজকে প্রত্যাখ্যান করি’।[7]
আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের সকলকে তাঁর জন্যই সকল নেক আমল ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন ও নিবেদন করার তাওফীক দান করুন- আমীন!
ফয়ছাল বিন আলী আল-বাদানী
অনুবাদ : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
[1]. আহমাদ, তিরমিযী, আবূদাঊদ, মিশকাত হা/৫০১৯।
[2]. বুখারী, মিশকাত হা/৫০১০।
[3]. ইবনু মাজাহ; মিশকাত হা/১৬৫।
[4]. ইবনু মাজাহ; মিশকাত হা/৫৩৩৩।
[5]. বায়হাক্বী, মিশকাত হা/৫১২২, আলবানী বলেন, বিভিন্ন সূত্র ও শাওয়াহেদ-এর কারণে হাদীছটি হাসান।
[6]. মুসলিম; মিশকাত হা/৫৩১৭ ‘কিতাবুর রিক্বাক্ব’।
[7]. মুসলিম হা/২৯৮৫।