আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার অর্থ :
আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট ও ছিন্ন হওয়ার অর্থ ও তাৎপর্য হচ্ছে জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর সাথে দুর্ব্যবহার করা, তাদের প্রতি অনুগ্রহ, অনুকম্পা পরিহার করা, পূর্ববর্তী আত্মীয়দের বংশধরদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা, শারঈ ওযর ব্যতীত তাদের প্রতি ইহসান না করা, কারো প্রতি আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট করার দোষ চাপানো ইত্যাদি।[1]
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার হুকুম :
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা কবীরা গোনাহ।[2] কেননা আল্লাহ আত্মীয়দের সাথে সদাচরণ করতে এবং তাদের হক যথাযথভাবে আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন।[3] অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন[4] এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না বলে উল্লেখ করেছেন।[5] বিশেষ করে পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা হারাম।[6] আর অন্যান্য আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা গোনাহের কারণ, যা ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে।
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার অপকারিতা ও পাপ :
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা অতি বড় গোনাহের কাজ। এর ফলে পারস্পরিক বন্ধন নষ্ট হয়, বংশীয় সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ হয়, শত্রুতা ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়, বিচ্ছিন্নতা ও একে অপরকে পরিত্যাগ করা অবধারিত হয়। এটা পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, হৃদ্যতা ও ভালবাসা দূর করে, অভিশাপ ও শাস্তি ত্বরান্বিত করে, জান্নাতে প্রবেশের পথকে বাধাগ্রস্ত করে, হীনতা ও লাঞ্ছনা আবশ্যক করে। এছাড়া এর কারণে মানবমনে চিন্তা ও পেরেশানী বৃদ্ধি পায়। কেননা মানুষ যার নিকট থেকে ভাল ব্যবহার, কল্যাণ ও সুসম্পর্ক কামনা করে, তার পক্ষ থেকে কোন বিপদ আসলে সেটা অধিক পীড়াদায়ক ও অসহনীয় হয়। এতদ্ব্যতীত পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বর্ণনামতে জ্ঞাতি সম্পর্ক ছিন্ন করার কিছু পাপ ও অপকারিতা নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
১. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী অভিশপ্ত :
কুরআন মাজীদে আল্লাহ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীকে অভিশপ্ত বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَن تُفْسِدُوْا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوْا أَرْحَامَكُمْ، أُوْلَئِكَ الَّذِيْنَ لَعَنَهُمُ اللهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ- ‘তবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হ’লে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। আল্লাহ এদেরকে লা‘নত করেন এবং করেন বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২২-২৩)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুর রহমান ইবনু নাছের আস-সা‘দী বলেন, এতে দু’টি বিষয় রয়েছে। ১. আল্লাহর আনুগত্য আবশ্যকীয় করে নেয়া এবং তাঁর আদেশকে যথার্থভাবে পালন করা। এটা কল্যাণ, হেদায়াত ও কামিয়াবী। ২. আল্লাহর আনুগত্য থেকে বিমুখ হওয়া, তাঁর নির্দেশ প্রতিপালন না করা। যার দ্বারা দুনিয়াতে কেবল বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। আর এ বিপর্যয় সৃষ্টি হয় পাপাচার ও অবাধ্যতামূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে এবং জ্ঞাতি বন্ধন ছিন্ন করার কারণে। তারাই ঐসকল লোক যারা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার মাধ্যমে। আল্লাহ স্বীয় রহমত থেকে তাদেরকে দূর করে দিয়ে এবং তাঁর ক্রোধের নিকটবর্তী করে তাদের অভিসম্পাত করেন’।[7]
অন্যত্র তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَالَّذِيْنَ يَنْقُضُوْنَ عَهْدَ اللهِ مِنْ بَعْدِ مِيْثَاقِهِ وَيَقْطَعُوْنَ مَا أَمَرَ اللهُ بِهِ أَنْ يُوْصَلَ وَيُفْسِدُوْنَ فِي الأَرْضِ أُوْلَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوْءُ الدَّارِ ‘যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হবার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের জন্য আছে লা‘নত এবং তাদের জন্য আছে মন্দ আবাস’ (রা‘দ ১৩/২৫)।
২. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ক্ষতিগ্রস্ত ফাসেকদের দলভুক্ত:
জ্ঞাতি সম্পর্ক বিনষ্টকারী পাপাচারী ও ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا يُضِلُّ بِهِ إِلاَّ الْفَاسِقِيْنَ، الَّذِيْنَ يَنقُضُوْنَ عَهْدَ اللهِ مِنْ بَعْدِ مِيْثَاقِهِ وَيَقْطَعُوْنَ مَا أَمَرَ اللهُ بِهِ أَنْ يُوْصَلَ وَيُفْسِدُوْنَ فِي الأَرْضِ أُولَـئِكَ هُمُ الْخَاسِرُوْنَ- ‘বস্ত্তত তিনি ফাসেকদের ব্যতীত কাউকে বিভ্রান্ত করেন না। যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হবার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং দুনিয়ায় অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত’ (বাক্বারাহ ২/২৬-২৭)।
৩. পার্থিব শাস্তি ত্বরান্বিত হওয়া ও পরকালীন শাস্তি বাকী থাকা :
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার কারণে পরকালে কঠোর শাস্তি তো রয়েছেই। তাছাড়া দুনিয়াতেও তাদের দ্রুত শাস্তি হবে। আবু বকর (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَا مِنْ ذَنْبٍ أَجْدَرُ أَنْ يُعَجِّلَ اللهُ تَعَالَى لِصَاحِبِهِ الْعُقُوبَةَ فِى الدُّنْيَا مَعَ مَا يَدَّخِرُ لَهُ فِى الآخِرَةِ مِثْلُ الْبَغْىِ وَقَطِيْعَةِ الرَّحِمِ ‘আল্লাহ তা‘আলা বিদ্রোহী ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর ন্যায় অন্য কাউকে পৃথিবীতে দ্রুত শাস্তি দেয়ার পরও পরকালীন শাস্তিও তার জন্য জমা করে রাখেননি’।[8] অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا مِنْ ذَنْبٍ أَحْرَى أَنْ يُّعَجِّلَ اللهُ لِصَاحِبِهِ الْعُقُوْبَةَ فِي الدُّنْيَا، مَعَ مَا يَدَّخِرُ لَهُ فِي الآخِرَةِ مِنْ قَطِيْعَةِ الرَّحِمِ وَالْبَغْيِ. ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন এবং বিদ্রোহের মত দুনিয়াতেই ত্বরিৎ শাস্তির উপযুক্ত আর কোন পাপ নেই। পরকালে তার জন্য যে শাস্তি সঞ্চিত রাখা হবে, তা তো আছেই’।[9]
৪. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর সাথে আল্লাহ সম্পর্ক ছিন্ন করেন :
যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে মহান আল্লাহ তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
خَلَقَ اللهُ الْخَلْقَ، فَلَمَّا فَرَغَ مِنْهُ قَامَتِ الرَّحِمُ فَأَخَذَتْ بِحَقْوِ الرَّحْمَنِ فَقَالَ لَهَا مَهْ. قَالَتْ هَذَا مَقَامُ الْعَائِذِ بِكَ مِنَ الْقَطِيْعَةِ. قَالَ أَلاَ تَرْضَيْنَ أَنْ أَصِلَ مَنْ وَصَلَكِ وَأَقْطَعَ مَنْ قَطَعَكِ. قَالَتْ بَلَى يَا رَبِّ. قَالَ فَذَاكِ لَكِ. قَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ اقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ (فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوْا فِى الأَرْضِ وَتُقَطِّعُوْا أَرْحَامَكُمْ).
‘আল্লাহ তা‘আলা যখন সমস্ত সৃষ্টি জগতকে সৃষ্টি করলেন, তখন ‘রেহেম (আত্মীয়তা)’ উঠে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কোমর ধরল। আল্লাহ তা‘আলা জিজ্ঞেস করলেন, কি চাও? সে বলল, এটা হ’ল আত্মীয়তা ছিন্নকারী হ’তে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনার স্থান! তিনি বললেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, যে তোমার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখব। আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে, আমিও তাকে ছিনণ করব? রেহেম বলল, জ্বী হ্যাঁ, প্রভু! তিনি বললেন, এটা তো তোমারই জন্য। অতঃপর আবু হুরায়রা (রাঃ) বললেন, ইচ্ছা হ’লে পড়তে পার, ‘তবে কি (হে মুনাফিক সমাজ!) তোমরা আধিপত্য লাভ করলে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন সমূহকে ছিন্ন করবে’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২২)।[10] রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন,قَالَ اللهُ أَنَا الرَّحْمَنُ وَهِىَ الرَّحِمُ شَقَقْتُ لَهَا اِسْمًا مِنَ اسْمِىْ مَنْ وَصَلَهَا وَصَلْتُهُ وَمَنْ قَطَعَهَا بَتَتُّهُ. ‘আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, আমিই রহমান (দয়ালু), আমি আমার নাম (রহমান) থেকেই ‘রাহেম’ (আত্মীয়তার বন্ধন)-এর নাম নির্গত করেছি। সুতরাং যে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখব এবং যে তাকে ছিন্ন করবে, আমি তাকে আমা হ’তে ছিন্ন করব’।[11]
৫. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না :
জ্ঞাতি সম্পর্ক বিনষ্টকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعٌ ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[12] তিনি আরো বলেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مُدْمِنُ خَمْرٍ وَلاَ مُؤْمِنٌ بِسِحْرٍ وَلاَ قَاطِعُ رَحِمٍ ‘জান্নাতে প্রবেশ করবে না মদ পানকারী, জাদুতে বিশ্বাসী ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিনণকারী’।[13]
উপরোক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা অতি বড় গোনাহের কাজ। একাজের মাধ্যমে দুনিয়াতে বিভিন্ন লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও শাস্তি রয়েছে, পরকালে তো বটেই। তাই আমাদেরকে এ থেকে সাবধান হ’তে হবে এবং আত্মীয়তা সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। এমনকি আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীদের থেকে দূরে থাকা যরূরী। যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) বালক ও নির্বোধদের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব হ’তে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। রাবী সাঈদ ইবনু সাম‘আন (রাঃ) বলেন, ইবনু হাসানা জুহানী তাঁকে বলেছেন, তিনি আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন যে, এর নিদর্শন কি? তিনি বললেন, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা হবে, বিভ্রান্তকারীর আনুগত্য করা হবে এবং সৎপথ প্রদর্শনকারীর অবাধ্যতা করা হবে।[14]
আত্মীয়তার সম্পর্ক না থাকার নিদর্শন
কতিপয় আলামত দেখে সহজেই অনুমতি হয় যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। এগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিদর্শন নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
১. সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও দরিদ্র, অসচ্ছল ও অভাবী আত্মীয়-স্বজনকে দান-ছাদাক্বা না করা। এমন অনেক পরিবার আছে, যাদের মধ্যে সচ্ছল ও অসচ্ছল উভয় শ্রেণীর লোক আছে। কখনও কখনও সচ্ছল লোকেরা দূরবর্তী লোকদেরকে সহযোগিতা করলেও, অভাবী নিকটাত্মীয়দের সহযোগিতা করে না। এটা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন হওয়ার প্রমাণ বহন করে।
২. হাদিয়া বা উপঢৌকন বিনিময় না করা। এটা কখনও কৃপণতার কারণে হয়ে থাকে। কখনওবা এ ধারণায় হয়ে থাকে যে, যাকে হাদিয়া দেওয়া হবে তার এ ধরনের উপহার-উপঢৌকনের প্রয়োজন নেই। যদিও এ ধারণা ভুল। কেননা কোন উপহার সাধারণত মানুষের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য করে দেওয়া হয় না। বরং উপহার-উপঢৌকন পারস্পরিক মুহাববত, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি করে।[15]
৩. পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ না করা। বহু দিন, মাস ও বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায় অথচ আত্মীয়-স্বজন পরস্পরে দেখা-সাক্ষাৎ করে না। ফলে একে অপরকে ভুলে যেতে শুরু করে। এটা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পূর্ব লক্ষণ।
৪. আত্মীয়দের মাঝে একে অপরের সুখে-দুঃখে সহমর্মী ও সমব্যথী না হওয়া। বিপদাপদে পারস্পরিক সহযোগিতা না থাকা।
৫. আত্মীয় ও জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর একত্রিত হওয়ার জন্য দিনক্ষণ নির্ধারিত ও স্থান নির্দিষ্ট থাকলে, সেখানে উপস্থিত না হওয়া।
৬. আত্মীয়-স্বজন সম্পর্ক বজায় রাখলে তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা আর তারা সম্পর্ক ঠিক না রাখলে বন্ধন ছিন্ন করা। এটা প্রকৃত অর্থে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা নয়। বরং এটা হচ্ছে বিনিময়।[16] যে কোন মূল্যে সম্পর্ক ও বন্ধন বজায় রাখাই হচ্ছে আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখা।[17]
৭. বিবাহ-ওয়ালীমা, ঈদ সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদেরকে দাওয়াত না দেওয়া।
৮. খারাপ কথা ও কাজ এবং অশোভন আচরণের মাধ্যমে তাদের কষ্ট দেওয়া।
৯. তাদেরকে হকের দিকে দাওয়াত না দেওয়া, হেদায়াতের দিক-নির্দেশনা প্রদান না করা এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ না করা।
১০. ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করা কিংবা অন্য কোন কারণে আত্মীয়দের মাঝে দলাদলি ও বিচ্ছিন্নতা তৈরী করা।
উপরোক্ত কাজগুলি থেকে বিরত থেকে আত্মীয়দের সাথে সাধ্যমত সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট হওয়া সকলের জন্য অতীব যরূরী।
আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার কারণ
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন হওয়ার বহুবিধ কারণ রয়েছে, যার কোন একটি বা একাধিক কারণ বিদ্যমান থাকলে মযবূত জ্ঞাতি সম্পর্কও শিথিল হয়ে যায়, শক্ত বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। এগুলির মধ্যে কতিপয় নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
১. অজ্ঞতা : আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার ফযীলত এবং সম্পর্ক বিনষ্ট করার পাপ সম্বন্ধে অজ্ঞতা। ফলে এ ধরনের অজ্ঞ মানুষ আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষায় উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হয় না। বরং কোন কোন সময় এ বন্ধন ছিন্ন করতে তৎপর ও সচেষ্ট হয়।
২. তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতার অভাব : মানুষের তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতির অভাব থাকলে তার দ্বীনদারী দুর্বল হয়ে যায়। আল্লাহর নির্দেশ পালন করা বা না করায় তার মধ্যে তেমন কোন প্রভাব-প্রতিক্রিয়া বা ভাবান্তর সৃষ্টি হয় না। তেমনি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার নেকী অর্জনে আগ্রহী হয় না এবং এ বন্ধন ছিন্ন হওয়ার পরিণতিকে ভয় পায় না।
৩. অহংকার : কোন কোন মানুষ যখন উচ্চ পদমর্যাদা ও শীর্ষস্থান লাভ করে কিংবা বড় ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়, তখন আত্মীয়দের সাথে গর্ব-অহংকার করে। আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাৎ এবং তাদের প্রতি সৌহার্দ্য-সম্প্রীতিকে গর্বভরে প্রত্যাখ্যান করে, তাদেরকে অবজ্ঞা করে। আর এ কাজকে সে যথার্থ মনে করে। এমনকি সে এটাও মনে করে যে, মানুষ তার কাছে সাক্ষাৎ করতে আসবে এবং সে নিজে সাক্ষাৎ দাতা হওয়ার অধিক উপযুক্ত। এই অহংকার আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ।
৪. দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা : অনেক মানুষ এমন আছে যে, আত্মীয়-স্বজন থেকে দীর্ঘ সময় এমনকি বছরের পর বছর বিচ্ছিন্ন থাকে। এর ফলে তাদের মধ্যে অপরিচিতি ও অজানা-অচেনা অবস্থা সৃষ্টি হয়। দেখা-সাক্ষাতে কালক্ষেপণ ও দীর্ঘসূত্রতা তৈরী হয়। এভাবে আত্মীয়দের সাথে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার ফলে স্থায়ী বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
৫. অত্যধিক তিরস্কার : বহু মানুষ এমন আছে যে, দীর্ঘদিন পরে তার বাড়ীতে কোন আত্মীয় আসলে অব্যাহত ও অবিরতভাবে তাকে তিরস্কার ও নিন্দা করতে থাকে। এমনকি এক্ষেত্রে সীমালংঘন করে ফেলে এবং ঐ আত্মীয়ের হক ভুলে গিয়ে তাকে যথার্থ সমাদর ও যত্ন করতে ঘাটতি করে ফেলে। এতে ঐ আত্মীয় তার বাড়ীতে আসা কমিয়ে দেয়। এভাবে দূরত্ব তৈরী হয় এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট হয়।
৬. অতিরিক্ত কষ্ট করা : সমাজে এক শ্রেণীর মানুষ আছে, তাদের নিকটে কোন আত্মীয় আসলে তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত কষ্ট করে। তাদের সমাদর ও আপ্যায়নে সীমালংঘন করে; সম্পদের অপচয় করে, অর্থ-কড়ি বিনষ্ট করে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তারা নিঃসম্বল হয়ে যায়। এতে অনেক আত্মীয় তার বাড়ীতে যাওয়া কমিয়ে দেয় এ আশংকায় যে, সে সমস্যায় পড়বে।
৭. বাড়ীতে আগত আত্মীয়দের গুরুত্ব কম দেওয়া : বহু মানুষ রয়েছে যাদের বাড়ীতে আত্মীয়-স্বজন আসলে তাদেরকে যথার্থ গুরুত্ব দেয় না; তাদের সাথে প্রাণ খুলে কথাও বলে না। বরং তাদেরকে এড়িয়ে চলা বা প্রত্যাখ্যান করার ভাব মুখমন্ডলে ফুটে ওঠে এবং আত্মীয়দের সাথে যখন কথা বলে তখন তাদের মুখ শুকিয়ে যায়। তাদের আগমনে খুশি হ’তে পারে না, তাদের আগমনে শুকরিয়া আদায় করে না, তাদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা বা সাদর সম্ভাষণ জানায় না। বরং তাদের কথা-বার্তায় বিরক্তভাব পরিলক্ষিত হয়। এতে ঐ আত্মীয়ের সাথে অন্যদের সাক্ষাৎ করা বা তার বাড়ীতে আসার ব্যাপারে অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়।
৮. কৃপণতা : সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে, যাদেরকে আল্লাহ সম্পদ ও সম্মান দান করলেও তারা আত্মীয়-স্বজন থেকে দূরে থাকে। এটা অহংকারবশতঃ নয়। বরং এটা আত্মীয়দের জন্য গৃহদ্বার উন্মুক্ত হওয়ার ভয়, যাতে তারা বেশী বেশী আগমন করবে এবং তার কাছে অধিক হারে অর্থ-কড়ি চাইবে ইত্যাদি। তাছাড়া তার বাড়ীতে আসলে আত্মীয়-স্বজনকে যথার্থ আপ্যায়ন করতে হবে, সাধ্যমত তাদের খেদমত করতে হবে। এতে তার ব্যয় বেড়ে যাবে। এই ভয়ে আত্মীয়দের এড়িয়ে চলে, তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ও তাদেরকে পরিত্যাগ করে।
৯. উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ বণ্টনে বিলম্ব করা : অলসতাবশতঃ কিংবা কারো কারো যিদ ও গোঁড়ামির কারণে উত্তরাধিকারীদের মাঝে পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টনে বিলম্ব করা। যখন মীরাছ বণ্টনে দেরী হবে এবং কেউ ভোগ-দখল করতে থাকবে, তখন আত্মীয়দের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাবে। এতে প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর প্রাপ্য অংশ লাভের দাবী তীব্র হবে। অপর দিকে এই ওয়ারিছদের কেউ মারা গেলে মীরাছ বণ্টনের পরিসর বেড়ে যায়, সেটা সীমিত গন্ডির মধ্যে থাকে না। কারণ এক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব বেড়ে যায়। আর সকলে সম্পদের প্রাপ্য অংশ গ্রহণের জন্য সমবেত হয়। এতে পরস্পরের মধ্যে কুধারণার সৃষ্টি হয় এবং গোলযোগ ও ঝগড়া-বিবাদ বেঁধে যায়। ফলে পরিস্থিতি হয় সঙ্কটাপন্ন, সমস্যা হয় ব্যাপক ও বিস্তৃত। এর ফলাফল হয় আত্মীয়দের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও সম্পর্ক ছিন্নকরণ।
১০. আত্মীয়দের মাঝে যৌথ কারবার : যখন কয়েক ভাই কিংবা কিছু আত্মীয়-স্বজন মিলে যৌথভাবে কোন প্রকল্প অথবা ব্যবসা বা কোম্পানী চালু করা হয় এবং তা যদি সুদৃঢ় ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত ও স্বচ্ছভাবে পরিচালিত না হয়, তখন অংশীদারদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এজন্য তা প্রতিষ্ঠিত হ’তে হবে নিষ্কলুষ মন-মানসিকতা নিয়ে। অন্যথা যখন উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, কর্মপরিধি বেড়ে যাবে তখন পরস্পর বিরোধী মনোভাব তৈরী হবে। বিদ্রোহ ত্বরান্বিত হবে এবং খারাপ ধারণা সৃষ্টি হবে। বিশেষত তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি ও পরার্থপরতা, নিঃস্বার্থ মানসিকতা কম থাকলে অথবা একজন স্বীয় সিদ্ধান্তে অটল থাকলে কিংবা পক্ষপাতদুষ্ট হ’লে সম্পর্ক বিনষ্ট হয়, বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়। কখনও অবস্থা এমন হয় যে, এ বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ফলে প্রতিপক্ষের জন্য এটা হয় লজ্জা ও অপমানের কারণ। আল্লাহ বলেন, وَإِنَّ كَثِيْراً مِّنْ الْخُلَطَاء لَيَبْغِيْ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ إِلَّا الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوْا الصَّالِحَاتِ وَقَلِيْلٌ مَّا هُمْ ‘আর শরীকদের অনেকে একে অন্যের উপর তো অবিচার করে থাকে, করে না কেবল মুমিন ও সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিগণ এবং তারা সংখ্যায় স্বল্প’ (ছোয়াদ ৩৮/২৪)।
১১. দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকা : দুনিয়া ও দুনিয়ার ভোগ-বিলাস, বিত্ত-বৈভবে নিমজ্জিত ব্যক্তি, যার আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ও তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার মত সময় নেই এবং তাদের প্রতি সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি প্রদর্শনের মত ন্যূনতম ফুরসত নেই। এরূপ ব্যক্তির সাথে অন্যরাও সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে না। পক্ষান্তরে এ ধরনের লোকের নিকটে পার্থিব জীবন হয় মুখ্য এবং পরকালীন জীবন হয় গৌণ। ফলে তারা দ্বীনদার, পরহেযগার মানুষের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারে না। কখনওবা এদের দুনিয়াপ্রীতি ধর্মভীরু মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়। কেননা এ ধরনের লোকেরা আল্লাহভীরুদের অজ্ঞ, মূর্খ ও অসামাজিক বলে তিরস্কার ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে।
১২. দূরত্ব ও সাক্ষাৎ করতে অলসতা : এমন অনেক মানুষ আছে, যারা আত্মীয়-স্বজনের বাড়ী দূরে হয়ে গেলে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে কষ্টবোধ করে। এর ফলে ঐ আত্মীয়রা ধীরে ধীরে তার থেকে দূরে সরে যায়। দূরের আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা থাকলেও সফরের কষ্ট তাকে নিবৃত্ত করে দেয়। ফলে ঐ আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাতের জন্য তাদের বাড়ীতে গমন করতে হতোদ্যম হয়ে পড়ে।
১৩. আত্মীয়দের কষ্ট সহ্য না করা ও সহিষ্ণু না হওয়া : অনেক লোক আছে, যারা আত্মীয়দের প্রদত্ত ন্যূনতম কোন কষ্টও সহ্য করে না এবং তাদের কোন তিরস্কারও বরদাশত করে না। এমনকি এ কারণে লোকেরা ক্রমশঃ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নের দিকে ধাবিত হয়।
১৪. বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আত্মীয়দের ভুলে যাওয়া : পরিবারের কারো ওয়ালীমা বা অন্য কোন অনুষ্ঠানে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ও সম্ভ্রান্ত-ধনীদের দাওয়াত দেওয়া হয়; অথচ দরিদ্র আত্মীয়দেরকে দাওয়াত দেয়া হয় না। কখনও দায়সারাভাবে কিংবা ফোনে দাওয়াত দেওয়া হয়। কোন কোন সময় কাউকে ভুলবশত আমন্ত্রণ করা হয় না। এসব কারণে আত্মীয়দের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। কেউ এ ভুলে যাওয়াকে মনে করে তাদের সাথে ভুলে যাওয়ার অভিনয় করা হয়েছে বা তাদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান করে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এ ধরনের কুধারণা সৃষ্টির ফলে জ্ঞাতি সম্পর্ক ছিন্ন ও তাদের প্রত্যাখ্যানের দিকে ধাবিত হয়।
১৫. হিংসা-দ্বেষ : আল্লাহ অনেককে বিদ্যা-বুদ্ধি ও সম্পদ দান করেছেন এবং তাদের অন্তরে আত্মীয়দের প্রতি মুহাববত সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তারা সাধ্যমত আত্মীয়দের আদর-আপ্যায়ন করে। এটা দেখে কোন কোন আত্মীয় হিংসা করে, তার খুলূছিয়াতে সন্দেহ পোষণ করে। সে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভোগে, অস্থিরতা তাকে পেয়ে বসে। ফলে ঐ আত্মীয়ের প্রতি অকারণে বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করে। এটাই এক সময় তাদের মাঝে বিচ্ছিন্নতার প্রাচীর খাড়া করে দেয়।
১৬. অত্যধিক হাসি-ঠাট্টা : অতিরঞ্জিত কোন কিছুই ভাল নয়। তেমনি হাসি-ঠাট্টার ক্ষেত্রেও বাড়াবাড়ি মঙ্গলজনক নয়। বিশেষত সবাই এসব পসন্দ করে না। আবার হাসি-ঠাট্টার ছলে মুখ ফসকে এমন কথা বের হয়ে যায়, যা অন্যের কাছে অসহনীয় হয় এবং এটা তার মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। ফলে যে ব্যক্তি উক্ত কথা বলে তার প্রতি ক্ষোভ ও ক্রোধের সৃষ্টি হয়। যা পরস্পর সম্পর্ক ছিন্নের পর্যায়ে গড়ায়।
১৭. চোগলখোরী করা : চোগলখোরী যেমন মানুষের মধ্যে ফাসাদ সৃষ্টি করে, তেমনি আত্মীয়দের মাঝেও সম্পর্কের অবনতি এবং ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করে। কেননা পরস্পরের দোষ-ত্রুটির আদান-প্রদান ও কুৎসা রটনা মানুষের অন্তরে ক্ষোভ পয়দা করে। আর আত্মীয়দের মাঝে এ ঘটনার অবতারণা হ’লে আত্মীয়তা নষ্ট হয়।
১৮. কু-ধারণা পোষণ করা : কোন কোন সময় আত্মীয়রা অপরের কাছে স্বীয় প্রয়োজন ও চাহিদা ব্যক্ত করে তা পূরণের দাবী করে। কিন্তু দাবীকৃত ব্যক্তির পক্ষে তা পূরণ করা সম্ভব হয় না বা সে অপারগতা প্রকাশ করে। এতে যাচ্ঞাকারীর মনে ঐ আত্মীয় সম্পর্কে খারাপ ধারণা তৈরী হয়। সে মনে করে যে, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তাকে সহায়তা করা হ’ল না। এতে তার মনে ঐ আত্মীয়ের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। যা এক সময় বিচ্ছিন্নতায় রূপ নেয়। এছাড়াও বিভিন্ন কারণে কু-ধারণা সৃষ্টি হ’তে পারে। এগুলি থেকে বেঁচে থাকা যরূরী।
১৯. আত্মীয়দের থেকে নিজের প্রকৃত অবস্থা গোপন রাখার প্রচেষ্টা : এক শ্রেণীর ধনী লোক আছে, যারা সম্পদের যাকাত বের করে দূরবর্তী লোকদের দান করে এবং নিকটাত্মীয়দের পরিত্যাগ করে এ কারণে যে, আত্মীয়রা তার সম্পদের পরিমাণ জেনে যাবে। নিজেকে গোপন রাখার প্রচেষ্টায়ই সে আত্মীয়দেরকে দূরে সরিয়ে দেয়।
২০. স্বামী-স্ত্রীর অসৎ চরিত্র : কোন কোন লোক স্ত্রীর খারাপ চরিত্রের কারণে সীমাহীন কষ্ট সহ্য করে ও অশেষ দুর্ভোগ পোহায়। কেউই এটা সহ্য করতে পারে না। জীবন তার কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। স্ত্রীর অসৎ চরিত্রের কারণে সে চায় না তার কোন আত্মীয় বা অন্য কেউ তার স্ত্রীর সাথে কথা বলুক। ফলে সে আত্মীয়দের থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। এমনকি আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাৎ করা থেকেও বিরত থাকে এবং তাদের সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে চায় না। আবার কেউ তার বাড়ীতে আসলেও সে আনন্দিত হয় না, তার সাথে হাসিমুখে কথা বলে না। তাকে যথাযথ আপ্যায়ন করে না। এসব কারণ আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট করে। পক্ষান্তরে স্বামীর চরিত্র খারাপ হ’লেও স্ত্রীকে সমস্যায় পড়তে হয়। সেও স্বামীর সাথে তার কোন মহিলা আত্মীয় দেখা-সাক্ষাৎ করুক বা কথা বলুক এটা সে মেনে নিতে পারে না। ফলে স্বামীকে সে আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক রক্ষা না করতে বাধ্য করে।
এগুলি হচ্ছে আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট হওয়ার কতিপয় কারণ। সুতরাং এসব কারণের কোন একটি পরিলক্ষিত হ’লে তা দ্রুত পরিহার করতে হবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন হওয়ার মত সকল প্রকার কারণ থেকে সর্বতোভাবে দূরে থাকতে হবে।
উপসংহার :
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা অতীব যরূরী। কেননা এটা হায়াত ও রিযক বৃদ্ধির মাধ্যম এবং জান্নাত লাভের উপায়। পক্ষান্তরে আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট করা জান্নাত থেকে মাহরূম হওয়ার কারণ। এজন্য রাসূল (ছাঃ) তাঁর মৃত্যুশয্যায় থাকাকালে উম্মতকে সাবধান করে বলেন, أَرْحَامَكُمْ أَرْحَامَكُمْ ‘তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন’ (সম্পর্কে সাবধান হও)।[18] অতএব প্রত্যেক মুসলিম পুরুষ-নারীকে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন-আমীন!
[1]. মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম আল-হামদ, কাতী‘আতুর রাহিম, পৃঃ ২।
[2]. ফাতাওয়া লাজনা আদ-দায়িমাহ ২৫/২৪৭।
[3]. নিসা ৪/৩৬; বানী ইসরাঈল ১৭/২৬-২৭।
[4]. বুখারী হা/১৩৯৬।
[5]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৪, সনদ ছহীহ।
[6]. বুখারী হা/২৪০৮; মুসলিম হা/২৫৯৩; বুখারী হা/২৬৫৪; মুসলিম হা/৮৭; তিরমিযী হা/১৯০১।
[7]. আব্দুর রহমান ইবনু নাছের আস-সা‘দী, তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, ১/৭/৮৮, সূরা মুহাম্মাদ ২২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[8]. আবু দাঊদ হা/৪৯০২; তিরমিযী হা/২৫১১; ইবনু মাজাহ হা/৪২১১; মিশকাত হা/৪৯৩২।
[9]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৭, সনদ ছহীহ।
[10]. আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/৫০, সনদ ছহীহ।
[11]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৩, সনদ ছহীহ।
[12]. বুখারী হা/৫৯৮৪; মুসলিম, হা/২৫৫৬; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৪।
[13]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/৬৭৮।
[14]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬৬, সনদ ছহীহ।
[15]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৯৪, সনদ হাসান।
[16]. বুখারী হা/৫৯৯১।
[17]. মুসলিম হা/২৫৫৮।
[18]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৩৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৭৩৬, ১৫৩৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৮৯৪, সনদ ছহীহ।