পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । শেষ পর্ব 

হায়েয ও নিফাস সম্পর্কিত মাসআলা

মহিলাদের লজ্জাস্থান হ’তে নির্গত রক্ত তিন প্রকার। যথা-

(ক) دم الحيض (হায়েযের রক্ত) : এটা দুর্গন্ধযুক্ত, ঘন ও কালো রঙের হয়, যা নির্দিষ্ট সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের লজ্জাস্থান হ’তে নির্গত হয়।[1]

(খ) دم النفاس (নিফাসের রক্ত) : সন্তান প্রসবের পরে নারীদের লজ্জাস্থান হ’তে যে রক্ত নির্গত হয় তাকে নিফাস বলা হয়।[2]

(গ) دم الاسةحاضة (ইস্তিহাযার রক্ত) : হায়েয ও নিফাসের নির্ধারিত সময় ব্যতীত অন্য সময় যে রক্ত নারীর লজ্জাস্থান হ’তে নর্গত হয়, তাকে ইস্তিহাযা বলা হয়।[3]

হায়েযের সময়সীমা :

হায়েয আল্লাহ তা‘আলা আদম কন্যাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু এর সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ সময়সীমা নির্ধারণ করেননি। অতএব প্রত্যেক নারীর হায়েযের নিয়মের উপর তার সময়সীমা নির্ধারিত হবে। অর্থাৎ যে নারীর নিয়মিত তিন দিন হায়েয হয়, তার জন্য এই তিন দিনই হায়েয হিসাবে গণ্য হবে। আবার যার পাঁচ দিন হায়েয হয় তার জন্য পাঁচ দিনই হায়েয হিসাবে গণ্য হবে। কখনও এর চেয়ে এক অথবা দুই দিন বেশী হ’লে তা ইস্তিহাযা বলে গণ্য হবে।

শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, যারা হায়েযের সর্বনিম্ন সময় এক দিন, এক রাত এবং সর্বোচ্চ সময় পনের দিন বলেন, তাদের এই মত কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়। বরং এটা নারীর হায়েযের নিয়মের উপরে নির্ভরশীল।[4]

হায়েযের সময় নির্ধারণ করতে হ’লে প্রত্যেক নারীকে তার হায়েযের নিয়মের প্রতি লক্ষ্য করতে হবে। এক্ষেত্রে নারীদেরকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়।

১- المُبْتَدَأَةُ তথা আরম্ভ হওয়া : অর্থাৎ যে নারীর প্রথম হায়েয হয়েছে। এই প্রকার নারী যে কয়দিন রক্ত দেখবে, সেদিনগুলিকে হায়েয হিসাবে গণ্য করবে এবং হায়েযের যাবতীয় হুকুম মেনে চলবে।

২- المُعْةَادَةُ তথা অভ্যস্ত হওয়া : অর্থাৎ যে নারী প্রত্যেক মাসে নির্দিষ্ট সময়ে হায়েয হওয়ায় অভ্যস্ত। এই প্রকার নারী প্রত্যেক মাসে যে কয়দিন হায়েয হয়ে থাকে, সেই কয়দিনকেই হায়েয হিসাবে গণ্য করবে এবং হায়েযের যাবতীয় হুকুম পালন করবে।

যদি কোন মাসে হায়েযের নির্দিষ্ট দিন থেকে এক বা দু’দিন বেশী রক্ত দেখা দেয়, অর্থাৎ কোন নারীর প্রত্যেক মাসে নিয়মিত পাঁচ দিন হায়েয হয়। কিন্তু হঠাৎ করে কোন মাসে ছয়/সাত দিন রক্ত দেখা দিলে প্রথমত সে অতিরিক্ত দিনগুলোকে হায়েয হিসাবে গণ্য করবে না। বরং এই দিনগুলোতে ছালাত, ছিয়াম সহ ইসলামের যাবতীয় বিধান পালন করবে এবং তিন মাস পর্যন্ত এই অতিরিক্ত দিনগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখবে। যদি পরপর তিন মাস যাবৎ একই নিয়ম বলবৎ থাকে তাহ’লে সেই অতিরিক্ত দিনগুলোকেও হায়েয হিসাবে গণ্য করবে এবং হয়েযের যাবতীয় হুকুম পালন করবে।

পক্ষান্তরে যদি প্রত্যেক মাসের নির্দিষ্ট নিয়ম থেকে এক অথবা দু’দিন কম দেখা দেয়। অর্থাৎ কোন নারীর প্রত্যেক মাসে নিয়মিত সাত দিন হায়েয হয়ে থাকে। কিন্তু হঠাৎ করে কোন মাসে পাঁচ দিন পরেই রক্ত বন্ধ হয়ে গেলে সে গোসল করে পবিত্র হবে এবং ছালাত, ছিয়াম সহ ইসলামের যাবতীয় বিধান পালন করবে। তার জন্য স্বামী সহবাস বৈধ হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তারা তোমাকে ঋতুস্রাব সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বল, তা কষ্ট। সুতরাং তোমরা ঋতুস্রাবকালে স্ত্রীদের থেকে দূরে থাক এবং তারা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হয়ো না। অতঃপর যখন তারা পবিত্র হবে, তখন তাদের নিকট আস, যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদেরকে ভালবাসেন এবং ভালবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে’ (বাক্বারাহ ২/২২২)

৩- المُتَمَيَّزَةُ তথা পার্থক্য নিরূপিত হওয়া : অর্থাৎ যে নারীর হায়েয ও ইস্তিহাযার রক্তের মধ্যে পার্থক্য বুঝা যায়। হায়েয ও ইস্তিহাযার রক্তের পার্থক্য নিরূপণের জন্য চারটি আলামত লক্ষণীয়।

(ক) اللَّوْنُ(রঙ) : হায়েযের রক্ত কালো। পক্ষান্তরে ইস্তিহাযার রক্ত লাল।

(খ) الرِّقَّةُ (পাতলা) : হায়েযের রক্ত গাঢ়। পক্ষান্তরে ইস্তিহাযার রক্ত পাতলা।

(গ) الرَّائِحَةُ (গন্ধ) : হায়েযের রক্ত দুর্গন্ধযুক্ত। পক্ষান্তরে ইস্তিহাযার রক্ত সাধারণ রক্তের ন্যায় দুর্গন্ধমুক্ত।

(ঘ) التَّجَمُّدُ(জমাটবদ্ধ হওয়া) : হায়েযের রক্ত বের হওয়ার পরে জমাটবদ্ধ হয় না। কেননা তা রেহেমে জমাটবদ্ধ থাকে। অতঃপর তা গলে তরল অবস্থায় বের হয়ে পুনরায় পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায় না। পক্ষান্তরে ইস্তিহাযার রক্ত জমাটবদ্ধ হয়। কেননা তা সাধারণ রক্তের ন্যায় রগের রক্ত।

অতএব যে কয়দিন দুর্গন্ধযুক্ত, কালো ও গাঢ় রক্ত নির্গত হবে এবং তা জমাটবদ্ধ না হবে। সেই কয়দিনকেই হায়েয হিসাবে গণ্য করতে হবে। পক্ষান্তরে যে কয়দিন সাধারণ রক্তের ন্যায় দুর্গন্ধমুক্ত, লাল ও পাতলা রক্ত নির্গত হবে এবং পরে তা জমাটবদ্ধ হবে, সেই কয়দিনকে ইস্তিহাযা হিসাবে গণ্য করতে হবে।

হায়েযের নির্ধারিত সময়ের মাঝখানে রক্ত বন্ধ হয়ে পুনরায় দেখা দিলে তার হুকুম :

কোন নারীর হায়েয শুরু হওয়ার পর মাঝে বন্ধ হয়ে গিয়ে দু’একদিন পরে পুনরায় দেখা দিল, যেমন কোন নারীর মাগরিবের সময় রক্ত দেখা দিল। পরের দিন মাগরিবের সময় রক্ত বন্ধ হয়ে গেল। এর পরের দিন পুনরায় রক্ত দেখা দিল। এমতাবস্থায় এই নারী রক্ত বন্ধ হওয়া দিনগুলোকে হায়েয হিসাবে গণ্য করবে, না পবিত্রতা হিসাবে গণ্য করবে? এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে ছহীহ মত হ’ল যদি নারীর প্রত্যেক মাসে হায়েয হওয়ার নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে রক্ত বন্ধ হয়ে পুনরায় রক্ত দেখা দেয়, তাহ’লে রক্ত বন্ধ হওয়া দিনগুলোকেও হায়েয হিসাবে গণ্য করবে এবং সে দিনগুলোতে মিলন-সহবাস থেকে বিরত থাকবে।[5] আর এটা হায়েযের নির্দিষ্ট দিনের বাইরে হ’লে ইস্তিহাযা হিসাবে গণ্য হবে।

হায়েযের শেষ সময় বুঝার উপায় : হায়েয শেষ হয়েছে কি না তা বুঝার জন্য লজ্জাস্থানে তুলা অথবা ন্যাকড়া রেখে কিছুক্ষণ পরে বের করে তা শুকনো অথবা রক্ত বিহীন পরিষ্কার দেখলে গোসল করে পবিত্রতা অর্জন করবে। হাদীছে এসেছে,

وَكُنَّ نِسَاءٌ يَبْعَثْنَ إِلَى عَائِشَةَ بِالدُّرْجَةِ فِيْهَا الْكُرْسُفُ فِيْهِ الصُّفْرَةُ فَتَقُوْلُ لاَ تَعْجَلْنَ حَتَّى تَرَيْنَ الْقَصَّةَ الْبَيْضَاءَ تُرِيْدُ بِذَلِكَ الطُّهْرَ مِنَ الْحَيْضَةِ.

মহিলারা আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট কৌটায় করে তুলা প্রেরণ করত। তাতে হলুদ রং দেখলে আয়েশা (রাঃ) বলতেন, তাড়াহুড়া কর না, সাদা পরিষ্কার দেখা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। এর দ্বারা তিনি হায়েয হ’তে পবিত্র হওয়া বুঝাতেন।[6]

হায়েয হ’তে পবিত্রতা লাভের পরে পুঁজ জাতীয় কিছু বের হ’লে তার হুকুম :

হায়েয হ’তে পবিত্রতা লাভের পরে পুঁজ জাতীয় কিছু বের হ’লে তা হায়েযের অন্তর্ভুক্ত হবে কি না? এ ব্যাপারে ছহীহ মত হ’ল, তা হায়েয হিসাবে গণ্য হবে না। বরং এমতাবস্থায় সে ছালাত, ছিয়াম আদায় করবে এবং সহবাসে লিপ্ত হ’তে পারবে।

উম্মে আতিয়্যাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, كُنَّا لاَ نَعُدُّ الصُّفْرَةَ وَالْكُدْرَةَ بَعْدَ الطُّهْرِ شَيْئًا. অর্থাৎ রক্তস্রাব হ’তে পবিত্রতা অর্জনের পরে আমরা হলুদ এবং মেটে রং-এর স্রাব দেখলে তাকে হায়েয হিসাবে গণনা করতাম না।[7]

হায়েয অবস্থায় হারাম কাজ সমূহ

(ক) সহবাস করা : হায়েয অবস্থায় স্ত্রী মিলন হারাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَيَسْأَلُوْنَكَ عَنِ الْمَحِيْضِ قُلْ هُوَ أَذًى فَاعْتَزِلُوْا النِّسَاءَ فِيْ الْمَحِيْضِ وَلاَ تَقْرَبُوْهُنَّ حَتَّى يَطْهُرْنَ فَإِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوْهُنَّ مِنْ حَيْثُ أَمَرَكُمُ اللهُ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ التَّوَّابِيْنَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِيْنَ ‘আর তারা তোমাকে ঋতুস্রাব সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বল, তা কষ্ট। সুতরাং তোমরা ঋতুস্রাবকালে স্ত্রীদের থেকে দূরে থাক এবং তারা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হয়ো না। অতঃপর যখন তারা পবিত্র হবে তখন তাদের নিকট আস, যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদেরকে ভালবাসেন এবং ভালবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে’ (বাক্বারাহ ২/২২২)

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, হায়েয এবং নিফাস অবস্থায় সহবাস করা হারাম। এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম ঐক্যমত পোষণ করেছেন।[8]

হায়েয অবস্থায় সহবাস করলে কাফ্ফারা ওয়াজিব : হায়েয অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করলে কাফফারা ওয়াজিব হবে। ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, الَّذِيْ يَأْتِيْ امْرَأَتَهُ وَهِىَ حَائِضٌ قَالَ يَتَصَدَّقُ بِدِيْنَارٍ أَوْ نِصْفِ دِيْنَارٍ. অর্থাৎ নবী করীম (ছাঃ) এমন ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন, যে নিজের ঋতুবর্তী স্ত্রীর সাথে সহবাস করে, সে যেন এক অথবা অর্ধ দীনার ছাদাকা করে’।[9]

উল্লেখ্য যে, ১ ভরী সমান ১১.৬৬ গ্রাম। হাদীছে বর্ণিত ১ দীনার সমান ৪.২৫ গ্রাম স্বর্ণ। অতএব হায়েয অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করলে ৪.২৫ গ্রাম অথবা এর অর্ধেক স্বর্ণের মূল্য ছাদাক্বা করতে হবে। এ হিসাবে ১ দীনার ছাদাক্বা করতে চাইলে ১ ভরী স্বর্ণের বর্তমান বাজার মূল্যকে ২.৭৪ দিয়ে ভাগ করে যা হবে সে টাকা ছাদাক্বা করবে। আর অর্ধ দীনার ছাদাক্বা করতে চাইলে ৫.৫০ দিয়ে ভাগ করে যত টাকা আসবে তা ছাদাক্বা করবে।

হায়েযের রক্ত বন্ধ হওয়ার পরে গোসলের পূর্বে সহবাস করার হুকুম :

হায়েযের রক্ত বন্ধ হ’লে গোসলের পূর্বে সহবাস করা জায়েয কি না? এ ব্যাপারে ছহীহ মত হ’ল, গোসলের পূর্বে সহবাস করা জায়েয নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَاعْتَزِلُوْا النِّسَاءَ فِيْ الْمَحِيْضِ وَلَا تَقْرَبُوْهُنَّ حَتَّى يَطْهُرْنَ فَإِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوْهُنَّ مِنْ حَيْثُ أَمَرَكُمُ اللهُ ‘তোমরা ঋতুস্রাবকালে স্ত্রীদের থেকে দূরে থাক এবং তারা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হয়ো না। অতঃপর যখন তারা পবিত্র হবে তখন তাদের নিকট আস, যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন’ (বাক্বারাহ ২/২২২)

উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ঋতুবতী নারী পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তার সাথে সহবাসে লিপ্ত হ’তে নিষেধ করেছেন। আর রক্ত বন্ধ হ’লেও গোসলের পূর্বে সে পবিত্র নয়। তবে গোসলের পূর্বে ছিয়াম পালন করা বৈধ। কেননা ঋতুবতী নারীর রক্ত বন্ধ হ’লে সে জুনুবী অবস্থায় ফিরে আসে। আর জুনুবী অবস্থায় ছিয়াম পালন করা জায়েয।[10]

আবূ বকর ইবনু আব্দুর রহমান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, كُنْتُ أَنَا وَأَبِيْ فَذَهَبْتُ مَعَهُ حَتَّى دَخَلْنَا عَلَى عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا، قَالَتْ أَشْهَدُ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنْ كَانَ لَيُصْبِحُ جُنُبًا مِنْ جِمَاعٍ غَيْرِ احْتِلاَمٍ ثُمَّ يَصُوْمُهُ، ثُمَّ دَخَلْنَا عَلَى أُمِّ سَلَمَةَ، فَقَالَتْ مِثْلَ ذَلِكَ. অর্থাৎ আমি আমার পিতার সঙ্গে রওনা হয়ে আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট পৌঁছলাম। তিনি বললেন, আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে সাক্ষ্য দিচ্ছি, তিনি স্বপ্নদোষ ব্যতীত স্ত্রী সহবাসের কারণে জুনুবী অবস্থায় সকাল পর্যন্ত থেকেছেন এবং এরপর ছিয়াম পালন করেছেন। অতঃপর আমরা উম্মু সালামার নিকট গেলাম। তিনিও অনুরূপ কথাই বললেন।[11]

যদি বলা হয়, গোসলের পূর্বে জুনুবী অবস্থায় ছিয়াম পালন করা বৈধ হ’লে স্ত্রী সহবাস বৈধ হবে না কেন? জবাবে বলব, আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ হ’ল, وَلاَ تَقْرَبُوْهُنَّ حَتَّى يَطْهُرْنَ ‘আর তারা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হয়ো না’ (বাক্বারাহ ২/২২২)। আর গোসলের পূর্বে সে পবিত্র হয় না। বরং জুনুবী অবস্থায় থাকে। অতএব যেখানে দলীল স্পষ্ট সেখানে ক্বিয়াসের কোন স্থান নেই। সুতরাং গোসলের দ্বারা পবিত্র হ’লেই কেবল তার সাথে সহবাস করা জায়েয হবে; অন্যথা নয়।[12]

(খ) হায়েয অবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দেওয়া : হায়েয অবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দেওয়া নিষিদ্ধ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَطَلِّقُوْهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ ‘হে নবী! তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দেওয়ার ইচ্ছা করবে, তখন তাদের ইদ্দত অনুসারে তাদেরকে তালাক দাও’ (তালাক্ব ৬৫/১)

ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, আয়াতে উল্লিখিত ইদ্দত দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল হায়েয অবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দিবে না এবং তালাক দিবে না ঐ পবিত্র অবস্থায় যাতে সহবাস করা হয়েছে।[13]

নাফি‘ (রহঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে,

أَنَّ ابْنَ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا طَلَّقَ امْرَأَةً لَهُ وَهْيَ حَائِضٌ تَطْلِيْقَةً وَاحِدَةً فَأَمَرَهُ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ يُرَاجِعَهَا ثُمَّ يُمْسِكَهَا حَتَّى تَطْهُرَ ثُمَّ تَحِيْضَ عِنْدَهُ حَيْضَةً أُخْرَى ثُمَّ يُمْهِلَهَا حَتَّى تَطْهُرَ مِنْ حَيْضِهَا فَإِنْ أَرَادَ أَنْ يُطَلِّقَهَا فَلْيُطَلِّقْهَا حِينَ تَطْهُرُ مِنْ قَبْلِ أَنْ يُجَامِعَهَا فَتِلْكَ الْعِدَّةُ الَّتِي أَمَرَ اللهُ أَنْ تُطَلَّقَ لَهَا النِّسَاءُ.

ওমর (রাঃ) তাঁর স্ত্রীকে ঋতুবতী অবস্থায় এক তালাক দেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁকে আদেশ দিলেন, তিনি যেন তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনেন এবং মহিলা পবিত্র হয়ে আবার ঋতুবতী হয়ে পরবর্তী পবিত্র অবস্থা আসা পর্যন্ত তাকে নিজের কাছে রাখেন। পবিত্র অবস্থায় যদি তাকে তালাক দিতে চায়, তবে সঙ্গমের পূর্বে তালাক দিতে হবে। এটাই ইদ্দত, যে সময় স্ত্রীদেরকে তালাক দেওয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা আদেশ দিয়েছেন।[14]

(গ) হায়েয অবস্থায় ছালাত আদায় করা হারাম : আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِذَا أَقْبَلَتِ الْحَيْضَةُ فَدَعِي الصَّلاَةَ، وَإِذَا أَدْبَرَتْ فَاغْسِلِي عَنْكِ الدَّمَ وَصَلِّي. ‘হায়েয দেখা দিলে ছালাত ছেড়ে দাও। আর হায়েযের সময় শেষ হয়ে গেলে রক্ত ধুয়ে নাও এবং ছালাত আদায় কর’।[15]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, মু‘আয (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, জনৈকা মহিলা আয়েশা (রাঃ)-কে বললেন, أَتَجْزِي إِحْدَانَا صَلاَتَهَا إِذَا طَهُرَتْ فَقَالَتْ أَحَرُوْرِيَّةٌ أَنْتِ كُنَّا نَحِيْضُ مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَلاَ يَأْمُرُنَا بِهِ، أَوْ قَالَتْ فَلاَ نَفْعَلُهُ. অর্থাৎ হায়েযকালীন কাযা ছালাত পবিত্র হওয়ার পর আদায় করলে আমাদের জন্য চলবে কি না? আয়েশা (রাঃ) বললেন, তুমি কি হারুরিয়্যাহ? (খারিজীদের এক দল) আমরা নবী (ছাঃ)-এর সময়ে ঋতুবতী হ’তাম কিন্তু তিনি আমাদেরকে ছালাত কাযার নির্দেশ দিতেন না। অথবা তিনি বললেন, আমরা তা কাযা করতাম না।[16] অতএব হায়েয অবস্থায় ছালাত আদায় করা হারাম এবং এই সময়ের মধ্যকার ছালাত তার জন্য মওকূফ করা হয়েছে, যার কাযা আদায় করতে হয় না।

আছরের কিছুক্ষণ পূর্বে হায়েয হ’লে এবং যোহরের ছালাত আদায় না করে থাকলে পবিত্র হওয়ার পরে কি তাকে যোহরের ছালাত কাযা আদায় করতে হবে?

যদি কোন নারীর আছরের সময়ের কিছুক্ষণ পূর্বে অথবা মাগরিবের সময়ের কিছুক্ষণ পূর্বে হায়েয হয় এবং সে যোহর অথবা অছরের ছালাত আদায় না করে থাকে তাহ’লে তার ছুটে যাওয়া ছালাত আদায় করতে হবে। কেননা সে ছালাতের নির্ধারিত সময়ে তা আদায় করেনি, যখন সে পবিত্র ছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا ‘নিশ্চয়ই ছালাত মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরয’ (নিসা ৪/১০৩)

ঋতুবতী নারী মাগরিব অথবা ফজরের পূর্বে পবিত্র হ’লে করণীয় :

ঋতুবতী নারী মাগরিবের পূর্বে হায়েয হ’তে পবিত্র হ’লে তাকে কি যোহর এবং আছর এই দুই ওয়াক্ত ছালাতই কাযা আদায় করতে হবে; না শুধুমাত্র আছরের ছালাত কাযা আদায় করতে হবে? এ ব্যাপারে ছহীহ মত হ’ল, তাকে শুধুমাত্র আছরের ছালাত আদায় করতে হবে। কেননা যোহরের ওয়াক্ত শেষ হওয়া অবস্থায়ও সে অপবিত্র ছিল। অনুরূপভাবে ফজরের পূর্বে পবিত্র হ’লে তাকে শুধুমাত্র এশার ছালাত কাযা আদায় করতে হবে। কেননা মাগরিবের সময় সম্পূর্ণটাই শেষ হওয়া অবস্থায় সে অপবিত্র ছিল।[17]

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ أَدْرَكَ رَكْعَةً مِنَ الصَّلاَةِ فَقَدْ أَدْرَكَ الصَّلاَةَ. ‘যে ব্যক্তি কোন ছালাতের এক রাক‘আত পেল, সে ছালাত পেল’।[18]

অতএব মাগরিবের পূর্বে পবিত্র হ’লে সে আছরের ছালাতের সময়ের কিছু অংশ পাবে কিন্তু যোহরের সময়ের কোন অংশ পাবে না। ফজরের পূর্বে পবিত্র হ’লে সে এশার ছালাতের সময়ের কিছু অংশ পাবে। কিন্তু মাগরিবের সময়ের কোন অংশ পাবে না। সুতরাং উল্লিখিত হাদীছের উপর ভিত্তি করে হায়েয হ’তে পবিত্র হওয়ার পরে যে ছালাতের ওয়াক্ত পাবে শুধুমাত্র সে ছালাতের কাযা আদায় ওয়াজিব হবে।

(ঘ) হায়েয অবস্থায় ছিয়াম পালন করা : হায়েয অবস্থায় ছিয়াম পালন করা হারাম। কিন্তু রামাযানের ছিয়াম কাযা আদায় করা ওয়াজিব। মু‘আয (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, مَا بَالُ الْحَائِضِ تَقْضِى الصَّوْمَ وَلاَ تَقْضِى الصَّلاَةَ فَقَالَتْ أَحَرُورِيَّةٌ أَنْتِ قُلْتُ لَسْتُ بِحَرُورِيَّةٍ وَلَكِنِّى أَسْأَلُ. قَالَتْ كَانَ يُصِيبُنَا ذَلِكَ فَنُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّوْمِ وَلاَ نُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّلاَةِ. অর্থাৎ আমি একদিন আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, ঋতুবতী নারীকে ছিয়াম কাযা আদায় করতে হবে অথচ ছালাত কাযা আদায় করতে হবে না এটা কেমন কথা? তখন আয়েশা (রাঃ) বললেন, তুমি কি হারুরিয়্যাহ? তখন আমি বললাম, না আমি হারুরিয়্যাহ নই। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছি। আয়েশা (রাঃ) বললেন, (রাসূল (ছাঃ)-এর সময়) আমরা এ অবস্থায় পতিত হ’লে আমাদেরকে ছিয়ামের কাযা আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হ’ত কিন্তু ছালাতের কাযা আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হ’ত না।[19]

অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নারীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, أَلَيْسَ إِذَا حَاضَتْ لَمْ تُصَلِّ وَلَمْ تَصُمْ قُلْنَ بَلَى ‘হায়েয অবস্থায় তারা (নারী) কি ছালাত ও ছিয়াম হ’তে বিরত থাকে না? তাঁরা বললেন, হ্যাঁ।[20]

যে ফজরের পূর্বে হায়েয হ’তে পবিত্র হয়েছে। কিন্তু গোসল করেনি :

যে নারী ফজরের পূর্বে হয়েয হ’তে পবিত্র হয়েছে, সে গোসল করুক বা না করুক তার উপর ছিয়াম পালন করা ওয়াজিব। যেমনিভাবে জুনুবী অবস্থায় গোসল না করলেও তার উপর ছিয়াম ওয়াজিব।[21]

(ঙ) হায়েয অবস্থায় পবিত্র কা‘বা গৃহ তাওয়াফ করা : হায়েয অবস্থায় কা‘বা ঘরের তওয়াফ করা হারাম। হাদীছে এসেছে,

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

قَالَتْ خَرَجْنَا مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم : لاَ نَذْكُرُ إِلاَّ الْحَجَّ فَلَمَّا جِئْنَا سَرِفَ طَمِثْتُ فَدَخَلَ عَلَيَّ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم وَأَنَا أَبْكِي فَقَالَ مَا يُبْكِيكِ قُلْتُ لَوَدِدْتُ وَاللهِ أَنِّي لَمْ أَحُجَّ الْعَامَ قَالَ لَعَلَّكِ نُفِسْتِ قُلْتُ نَعَمْ قَالَ فَإِنَّ ذَلِكَ شَيْءٌ كَتَبَهُ اللهُ عَلَى بَنَاتِ آدَمَ فَافْعَلِيْ مَا يَفْعَلُ الْحَاجُّ غَيْرَ أَنْ لاَ تَطُوفِيْ بِالْبَيْتِ حَتَّى تَطْهُرِيْ.

অর্থাৎ আমরা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে হজ্জের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলাম। আমরা ‘সারিফ’ নামক স্থানে পৌঁছলে আমি ঋতুবতী হই। এ সময় নবী করীম (ছাঃ) এসে আমাকে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কাঁদছ কেন’? আমি বললাম, আল্লাহর শপথ! এ বছর হজ্জ না করাই আমার জন্য পসন্দনীয়। তিনি বললেন, ‘সম্ভবত তুমি ঋতুবতী হয়েছ’। আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, এটাতো আদম কন্যাদের জন্য আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন। তুমি পবিত্র হওয়া পর্যন্ত অন্যান্য হাজীদের মত সমস্ত কাজ করে যাও, কেবল কা‘বা গৃহ তাওয়াফ করবে না’।[22]

(চ) হায়েয অবস্থায় কুরআন স্পর্শ করা :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لاَ يَمَسُّهُ إِلاَّ الْمُطَهَّرُوْنَ ‘কেউ তা (কুরআন) স্পর্শ করে না পবিত্রগণ ব্যতীত’ (ওয়াক্বি‘আহ ৭৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لاَ يَمَسُّ الْقُرْآنَ إِلا طَاهِرٌ. ‘কুরআন স্পর্শ করে না পবিত্র ব্যক্তি ব্যতীত’।[23]

(ছ) হায়েয অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ ও সেখানে অবস্থান করা: অপবিত্র অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করা যাবে না। তবে প্রয়োজনে মসজিদে গমন করা বা তার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করা যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلاَ جُنُبًا إِلاَّ عَابِرِيْ سَبِيْلٍ حَتَّى تَغْتَسِلُوْا ‘আর অপবিত্র অবস্থায়ও না, যতক্ষণ না তোমরা গোসল কর, তবে যদি তোমরা পথ অতিক্রমকারী হও’ (নিসা ৪৩)

নিফাসের সময়সীমা : নিফাসের সর্বনিম্ন সময়সীমা কুরআন ও হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়। বরং এটা রক্ত প্রবাহিত হওয়া এবং না হওয়ার উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ সন্তান প্রসবের পরে যখন রক্ত বন্ধ হবে তখন থেকেই সে পবিত্র। তার উপর ইসলামের যাবতীয় বিধান অবশ্য পালনীয় এবং তখন থেকেই মিলন-সহবাস বৈধ।[24] পক্ষান্তরে নিফাসের সর্বোচ্চ সময়সীমা ৪০ দিন।

উম্মু সালামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, كَانَتِ النُّفَسَاءُ عَلَى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ تَجْلِسُ أَرْبَعِيْنَ يَوْمًا. অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে নিফাসগ্রস্ত নারীরা ৪০ দিন

পর্যন্ত অপেক্ষা করত।[25]

৪০ দিন পরে রক্ত বন্ধ না হ’লে তা ইস্তিহাযা হিসাবে গণ্য হবে। অর্থাৎ ৪০ দিন পরে গোসল করে পবিত্র হয়ে ছালাত, ছিয়াম সহ ইসলামের যাবতীয় বিধান পালন করবে এবং সহবাস বৈধ হবে।

নিফাসের হুকুম : নিফাস এবং হায়েযের হুকুম একই। হায়েয অবস্থায় যে সকল কাজ হারাম, নিফাস অবস্থাতেও সে সকল কাজ হারাম।

ইস্তিহাযা সম্পর্কিত মাসআলা

ইস্তিহাযা হচ্ছে হায়েয ও নিফাসের নির্ধারিত সময়ের পরে প্রবাহিত রক্ত। এটা হুকুম এবং বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে হায়েয ও নিফাস থেকে ভিন্ন। যেমন-

(ক) হায়েয ও নিফাসের নির্ধারিত সময়ে ছালাত, ছিয়াম ও পবিত্র কা‘বা গৃহ তাওয়াফ করা হারাম। পক্ষান্তরে ইস্তিহাযার সময়ে বৈধ।আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

جَاءَتْ فَاطِمَةُ ابْنَةُ أَبِيْ حُبَيْشٍ إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَتْ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنِّيْ امْرَأَةٌ أُسْتَحَاضُ فَلاَ أَطْهُرُ أَفَأَدَعُ الصَّلاَةَ، فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : لاَ إِنَّمَا ذَلِكِ عِرْقٌ وَلَيْسَ بِحَيْضٍ فَإِذَا أَقْبَلَتْ حَيْضَتُكِ فَدَعِي الصَّلاَةَ، وَإِذَا أَدْبَرَتْ فَاغْسِلِيْ عَنْكِ الدَّمَ ثُمَّ صَلِّيْ.

অর্থাৎ ফাতিমা বিনতু আবূ হুবাইশ রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি একজন ইস্তিহাযাগ্রস্ত নারী। আমি কখনো পবিত্র হ’তে পারি না। এমতাবস্থায় আমি কি ছালাত ছেড়ে দেব? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, না, এটাতো শিরা হ’তে নির্গত রক্ত; হায়েয নয়। তাই যখন তোমার হায়েয আসবে তখন ছালাত ছেড়ে দিবে। আর যখন তা বন্ধ হবে তখন রক্ত ধুয়ে ফেলবে, তারপর ছালাত আদায় করবে’।[26]

(খ) হায়েয ও নিফাস অবস্থায় স্ত্রী সহবাস হারাম। কিন্তু ইস্তিহাযা অবস্থায় বৈধ। ইকরিমা (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, كَانَتْ أُمُّ حَبِيْبَةَ تُسْتَحَاضُ فَكَانَ زَوْجُهَا يَغْشَاهَا. অর্থাৎ উম্মে হাবীবা (রাঃ) ইস্তিহাযাগ্রস্ত থাকা অবস্থায় তাঁর স্বামী তাঁর সাথে সঙ্গম করতেন।[27]

(গ) হায়েয ও নিফাস অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করা হারাম। কিন্তু ইস্তিহাযা অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করে ই‘তিকাফ করা জয়েয।

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, اعْتَكَفَتْ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم امْرَأَةٌ مِنْ أَزْوَاجِهِ فَكَانَتْ تَرَى الدَّمَ وَالصُّفْرَةَ وَالطَّسْتُ تَحْتَهَا وَهْيَ تُصَلِّيْ. অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে তাঁর কোন একজন স্ত্রী ই‘তিকাফ করেছিলেন। তিনি রক্ত ও হলদে পানি বের হ’তে দেখলে তাঁর নীচে একটা পাত্র বসিয়ে রাখতেন এবং সে অবস্থায় ছালাত আদায় করতেন।[28]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, أَنَّ بَعْضَ أُمَّهَاتِ الْمُؤْمِنِيْنَ اعْتَكَفَتْ وَهْيَ مُسْتَحَاضَةٌ. অর্থাৎ উম্মুল মুমিনীনের কোন একজন ইস্তিহাযা অবস্থায় ই‘তিকাফ করেছিলেন।[29]

ইস্তিহাযা চেনার উপায় :

ইস্তিহাযাগ্রস্ত নারীর জন্য তিনটি অবস্থা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

(ক) প্রত্যেক মাসে নির্দিষ্ট সময়ে হায়েয হওয়া : যে সকল নারীর প্রত্যেক মাসে নির্ধারিত সময়ে হায়েয হয়, সেই সময়ের বাইরে প্রবাহিত রক্ত ইস্তিহাযা হিসাবে গণ্য হবে। অর্থাৎ হায়েযের নির্ধারিত সময়ে ছালাত, ছিয়াম ও সহবাস থেকে বিরত থাকবে। আর এই সময়ের বাইরের দিনগুলোতে ছালাত ও ছিয়াম পালন করবে এবং সহবাস করতে পারবে।

(খ) রক্তের পার্থক্য বুঝতে পারা : যে সকল নারীর প্রত্যেক মাসে নির্ধারিত সময়ে হায়েয হয় না। কিন্তু রক্তের পার্থক্য বুঝা যায়। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কয়েক দিন গাঢ়, কালো, দুর্গন্ধযুক্ত রক্ত নির্গত হয় এবং কয়েক দিন মানুষের শরীরের স্বাভাবিক রক্তের ন্যায় রক্ত নির্গত হয়। এমতাবস্থায় গাঢ়, কালো, দুর্গন্ধময় রক্ত নির্গত হওয়ার পরে যে কয়দিন স্বাভাবিক রক্ত নির্গত হবে সে কয়দিনকেই ইস্তিহাযা হিসাবে গণ্য করবে।

(গ) কোন আলামত না থাকা : যে সকল নারীর প্রত্যেক মাসে নির্ধারিত সময়ে হায়েয হয় না এবং রক্তের কোন পার্থক্যও বুঝা যায় না। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ রক্ত প্রবাহিত হ’তে থাকে। এমতাবস্থায় সে অধিকাংশ নারীর হায়েযের নির্দিষ্ট সময়কে হায়েয হিসাবে গণ্য করবে। আর তা হ’ল ৭ দিন। অর্থাৎ প্রথম ৭ দিনকে হায়েয হিসাবে ধরে নিয়ে পরবর্তী দিনগুলোকে ইস্তিহাযা হিসাবে গণ্য করবে।[30]

উপসংহার : আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। উদ্দেশ্য হ’ল মানুষ এক আল্লাহর ইবাদত করবে। আর ইবাদত ছহীহ হওয়ার অন্যতম শর্ত হ’ল পবিত্রতা অর্জন করা। মানুষ সর্বদা চেষ্টা করবে কিভাবে আল্লাহর ভালবাসা অর্জন করা যায়। আর আল্লাহর ভালবাসা অর্জন করার অন্যতম উপায় হ’ল পবিত্রতা অর্জন করা। কেননা আল্লাহ তা‘আলা নিজে পবিত্র এবং তিনি পবিত্রতা অর্জনকারীকে ভালবাসেন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে পবিত্রতা অর্জন সম্পর্কিত যাবতীয় মাসআলা জেনে যথাযথভাবে পবিত্রতা অর্জন করে তাঁর ভালবাসার পাত্র হওয়ার তাওফীক দান করুন- আমীন!

মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম


[1]. ছহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২০৬ পৃঃ।

[2]. তদেব ১/২১৫ পৃঃ।

[3]. তদেব ১/২১৬ পৃঃ।

[4]. ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ২১/৬২৩ পৃঃ।

[5]. শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি ১/৫০০-৫০১ পৃঃ।

[6]. বুখারী, হা/৩২০ ‘হায়েয শুরু ও শেষ হওয়া’ অনুচ্ছেদ।

[7]. আবু দাঊদ, হা/৩০৭ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়।

[8]. ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়া ২১/৬২৪ পৃঃ।

[9]. আবু দাঊদ হা/২৬৪ হাদীছ ছহীহ।

[10]. শারহুল মুমতে ১/৪৮২ পৃঃ।

[11]. বুখারী, হা/১৯৩১-১৯৩২ ‘ছিয়াম’ অধ্যায়।

[12]. শারহুল মুমতে ১/৪৮৩ পৃঃ।

[13]. তাফসীর ইবনে কাছীর, তাহক্বীক : আব্দুর রয্যাক মাহদী ৬/২৩৭ পৃঃ।

[14]. বুখারী হা/৫৩৩২ ‘তালাক’ অধ্যায়।

[15]. বুখারী হা/৩৩১ ‘হায়েয’ অধ্যায়।

[16]. বুখারী হা/৩২১ ‘হায়েয’ অধ্যায়।

[17]. শারহুল মুমতে আলা যাদিল মুসতাকনি ২/১৩৩ পৃঃ।

[18]. বুখারী হা/৫৮০ ‘ছালাতের সময়সমূহ’ অধ্যায়।

[19]. মুসলিম হা/২৬৫ ‘ঋতুবতী নারীর ছিয়ামের কাযা আদায়।

[20]. বুখারী হা/৩০৪ ‘হায়েয’ অধ্যায়।

[21]. আব্দুল আযীয ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে বায, আল-মাওসু‘আতুল বাযিয়া, প্রশ্ন নম্বর ৩৩২, ১/৩৯৮ পৃঃ; ছহীহ ফিকহুস সুন্নাহ ১/২১১ পৃঃ।

[22]. বুখারী, হা/৩০৫, বঙ্গানুবাদ, তাওহীদ পাবলিকেশন্স ১/১৫৬।

[23]. মুওয়াত্ত্বা মালেক, ১/১৯৯, দারাকুতনী, ১/১২১; নাছিরুদ্দীন আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন, দ্র: ইরওয়াউল গালীল, হা/১২২।

[24]. আল-মাওসু‘আতুল বাযিয়া, প্রশ্ন নম্বর ১০৯, ১/১৮৫ পৃঃ।

[25]. ইবনু মাজাহ, হা/৬৪৮, হাদীছটি হাসান ছহীহ।

[26]. বুখারী হা/২২৮ ‘ওযূ’ অধ্যায়।

[27]. আবু দাউদ, হা/ ৩০৯, হাদীছটি ছহীহ।

[28]. বুখারী হা/৩১০ ‘হায়েয’ অধ্যায়।

[29]. বুখারী হা/৩১১ ‘হায়েয’ অধ্যায়।

[30]. ফিকহুল মুয়াস্সার, ৪২ পৃঃ।






মুসলমানদের রোম ও কন্সটান্টিনোপল বিজয় (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আহলেহাদীছ আন্দোলন ও অন্যান্য ইসলামী আন্দোলন : তুলনামূলক আলোচনা - মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম
নেতৃত্বের মোহ - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
গোপন ইবাদতে অভ্যস্ত হওয়ার উপায় - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
বিদ‘আতে হাসানার উদাহরণ : একটি পর্যালোচনা (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
তাক্বলীদের বিরুদ্ধে ৮১টি দলীল - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ইখলাছ মুক্তির পাথেয় - আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
হজ্জ পরবর্তী করণীয় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
দাওয়াত ও সংগঠন - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
এক নযরে হজ্জ
মানবাধিকার ও ইসলাম (১৫তম কিস্তি) - শামসুল আলম
শায়খ আলবানীর তাৎপর্যপূর্ণ কিছু মন্তব্য (শেষ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
আরও
আরও
.