পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । শেষ পর্ব ।

ভূমিকা :

সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি সৃষ্টিকুলের প্রতিপালক। করুণা ও শান্তি বর্ষিত হোক সেই মহামানবের উপর, যিনি বিশ্ববাসীর জন্য করুণা ও পথপ্রদর্শকরূপে প্রেরিত, যিনি আদম (আঃ)-এর বংশধরদের নেতৃপদে বরিত এবং সৌভাগ্যবানদের নেতা হিসাবে স্বীকৃত। আরও করুণা ও শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর পরিবার-পরিজন, তাঁর ছাহাবায়ে কেরাম এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত  আগমনকারী তাঁর পথের পথিকদের উপর।

আমাদের কিছু ভাই যারা কি-না কেউ শিক্ষার্থী, কেউ বিদ্বান, আবার কেউ বিদ্বান নন কিন্তু বিদ্বান হওয়ার দাবীদার, তারা বলে বেড়ান যে, জিহাদ শুধুই মুসলমানদের সার্বজনীন শাসকের অধীনে বৈধ। কোন জামা‘আত বা দলের ছায়াতলে জিহাদ করা বৈধ নয়। আর ব্যক্তি উদ্যোগে গঠিত প্রত্যেকটি জামা‘আত বা দল চাই তা জিহাদের নামে গঠিত হোক, অথবা ইসলাম প্রচারের জন্য গঠিত হোক কিংবা সমাজ কল্যাণের নামে হোক কোনটাই শরী‘আত সম্মত জামা‘আত বা দল নয়। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য জুড়ে ইসলাম প্রচারের নামে যত জামা‘আত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- যেমন সালাফী জামা‘আত, তাবলীগ জামা‘আত, আল-ইখওয়ানুল মুসলিমূন ইত্যাদি সবগুলো বিচ্ছিন্নতাবাদী জামা‘আত বা দল। এগুলো গঠন করাও যেমন জায়েয নয়, তেমনি এদের সাথে কাজ করাও বৈধ নয়। তাদের এসব কথা আমি নিজ কানে খুব মনোযোগের সাথে শুনেছি।

এদের কারো কারো টেপরেকর্ড থেকে আমি নিজ কানে এ কথাও শুনেছি যে, এসব জামা‘আত বা দল মু‘তাযিলা ও খারেজী নামক বাতিল ফিরক্বাগুলোর নতুন সংস্করণ। কেননা এরাও দল খাড়া করে মুসলিম শাসক ও মুসলিম জামা‘আতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।

তারা এটাও দাবী করছে যে, আল্লাহর পথে দাওয়াতদাতা এসব জামা‘আত বা দল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পথ ও পদ্ধতির উপর দাঁড়িয়ে নেই; তারা বরং তা থেকে বিচ্যুত।

আমি যখন দেখলাম যে, অনেক মুসলিম তরুণ ও যুবক জ্ঞান ও যুক্তি-বুদ্ধির সাথে সম্পর্কহীন এসব বাতিল ফৎওয়া ও অলীক কথায় বিভ্রান্ত ও প্রতারিত হচ্ছে তখন আমার মনে হল, সত্যকে না লুকিয়ে মানুষের সামনে তা তুলে ধরব। আল্লাহ তা‘আলা তো মানুষের কাঁধে সত্য না লুকিয়ে তা প্রকাশেরই দায়িত্ব দিয়েছেন। আর সেজন্যই আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস। এর ফলে আল্লাহ চাহে তো সত্য উন্মোচিত হবে এবং সত্যের উপর জমে থাকা মেঘ কেটে যাবে। মানুষ আল্লাহর সহায়তায় ছিরাতুল মুস্তাক্বীম বা সোজা পথের সন্ধান পাবে।

আল্লাহ তা‘আলার নিকট আমার দো‘আ ও নিবেদন তিনি যেন আমার প্রয়াসকে আন্তরিকতাপূর্ণ, নির্ভুল ও ত্রুটিমুক্ত করে গ্রহণ করেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।

জামা‘আত বা দলের অর্থ[1]

কিছু মানুষের যে কোন বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়াকে দল বলে (اَلْجَمَاعَةُ مَا اجْتَمَعَ مِنَ النَّاسِ عَلَى اَمْرٍ مَّا) ।

কমপক্ষে দু’জন সদস্য নিয়ে একটি দল গঠিত হ’তে পারে। এটাই সঠিক কথা। নবী করীম (ছাঃ) একাকী ফরয ছালাত আদায়কারী সম্পর্কে বলেছিলেন,مَنْ يَتَصَدَّقُ عَلَى هَذَا فَيُصَلِّي مَعَهُ ‘কে আছে, যে এর  সঙ্গে ছালাত আদায় করে একে ছাদাক্বা করবে’?[2]

এখানে ছাদাক্বা বা দান অর্থ লোকটির সঙ্গে ছালাতে যোগ দিয়ে তাকে জামা‘আতে ছালাতের ছওয়াব লাভের সুযোগ করে দেওয়া। যেমন নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,صَلاَةُ الجَمَاعَةِ تَفْضُلُ صَلاَةَ الفَذِّ بِسَبْعٍ وَعِشْرِينَ دَرَجَةً ‘জামা‘আতে ছালাত আদায়ে একাকী ছালাতের তুলনায় ২৭গুণ বেশী ছওয়াব হয়’।[3] সুতরাং উক্ত হাদীছ থেকে দু’জনে জামা‘আত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজেও স্রেফ একজনকে নিয়ে জামা‘আতে ছালাত আদায় করেছেন। অতএব কথা (قَوْلِيْ) কাজ (فِعْلِيْ) উভয় প্রকার হাদীছ দ্বারা দু’জন সদস্যের সমন্বয়ে দল গঠনের প্রমাণ মিলছে।

দলের সদস্য সংখ্যার ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারিত নেই। তা যেমন হাযার হাযার হ’তে পারে, তেমনি লাখ লাখও হ’তে পারে। সংখ্যা যাই হোক তারা সবাই মিলে একটি দল হবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, يَدُ اللهِ مَعَ الجَمَاعَةِ ‘জামা‘আতের সাথে আল্লাহর হাত রয়েছে’।[4]

মুসলিমদের দল বললে, তাদের ঐ সংঘকে বুঝাবে- যারা যে কোন যুগে একজন ইমাম বা নেতার ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ হয়। যেমন নবী করীম (ছাঃ) ফিৎনা সংক্রান্ত এক দীর্ঘ হাদীছে হযরত হুযায়ফা (রাঃ)-কে বলেছিলেন, تَلْزَمُ جَمَاعَةَ المُسْلِمِيْنَ وَإِمَامَهُمْ  ‘তুমি  মুসলিমদের  দল  এবং  তাদের  ইমাম  বা

নেতাকে আঁকড়ে ধরে থাকবে’।[5]

এখানে ‘অাঁকড়ে থাকা’ অর্থ তাদের আক্বীদা-বিশবাস ও দ্বীন অাঁকড়ে থাকা নয়- বরং অাঁকড়ে থাকা অর্থ তাদের জিহাদ-সংগ্রাম, ফিক্বহ বা চিন্তা-চেতনা ও কর্মতৎপরতায় শামিল থাকা। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,أَلَا مَنْ وَلِيَ عَلَيْهِ وَالٍ، فَرَآهُ يَأْتِي شَيْئًا مِنْ مَعْصِيَةِ اللهِ، فَلْيَكْرَهْ مَا يَأْتِي مِنْ مَعْصِيَةِ اللهِ، وَلَا يَنْزِعَنَّ يَدًا مِنْ طَاعَةٍ ‘সাবধান! যার উপর কাউকে শাসক নিযুক্ত করা হয়, আর সে তাকে আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কোন কাজ করতে দেখে তখন সে যেন তার ঐ অবাধ্যতামূলক কাজকে ঘৃণা করে। কিন্তু তার আনুগত্য থেকে নিজের হাত যেন গুটিয়ে না নেয়’।[6] অনুরূপভাবে তিনি বলেছেন,وَإِذَا رَأَيْتُمْ مِنْ وُلَاتِكُمْ شَيْئًا تَكْرَهُونَهُ، فَاكْرَهُواعَمَلَهُ، وَلَا تَنْزِعُوا يَدًا مِنْ طَاعَةٍ ‘যখন তোমরা তোমাদের শাসকদের এমন কোন কাজ করতে দেখ যা তোমাদের পসন্দ নয় তখন তোমরা তাদের সেই কাজকে অপসন্দ করবে, কিন্তু তাদের আনুগত্য থেকে তোমাদের হাত গুটিয়ে নেবে না’।[7] তিনি আরও বলেছেন, مَنْ كَرِهَ مِنْ أَمِيرِهِ شَيْئًا فَلْيَصْبِرْ، فَإِنَّهُ مَنْ خَرَجَ مِنَ السُّلْطَانِ شِبْرًا مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً ‘যে তার আমীর বা শাসক থেকে অপসন্দনীয় কোন আচরণ পাবে সে যেন তাতে ছবর করে। কেননা যে কেউ তার শাসক থেকে এক বিঘত পরিমাণ বেরিয়ে যাবে এবং ঐ অবস্থায় তার মৃত্যু এসে যাবে সে জাহিলিয়াতের উপর মৃত্যুবরণ করবে’।[8]

এই সব ক’টি হাদীছ থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, দল অাঁকড়ে ধরে থাকা অর্থ দলনেতা বা শাসকের অধীনে জিহাদে গমন, তার নিকট যাকাতের অর্থ জমাদান ইত্যাদি। যেসব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দলনেতার উপর ন্যস্ত রয়েছে তা আবশ্যিকভাবে মেনে চলা।

মোট কথা, দুই বা তদূর্ধ্ব সংখ্যা মিলে দল হয় এবং যে দলই কোন কাজ করতে সংঘবদ্ধ হবে তার জন্য একজন মান্যগণ্য নেতা থাকা অপরিহার্য। ছালাতের জামা‘আতে মুক্তাদীদের যেমন তাদের ইমামের অনুসরণ ফরয, ঠিক তেমনই সফরের দলে, জিহাদের দলে, সার্বিক দলে যিনি ইমাম বা নেতা থাকবেন তার অনুসরণ করা ফরয হবে। আর দ্বীনের হোক বা দুনিয়ার হোক যে কাজেই একদল মানুষ যখন সংঘবদ্ধ হয় তখন নির্বাহী আদেশদাতা একজন নেতা না থাকলে এবং সে আদেশ দ্বিধাহীনচিত্তে মানা না হ’লে তা দল বলে গণ্য হ’তে পারে না।

দল গঠনের শারঈ ভিত্তি এবং দলবদ্ধ হওয়ার বিধান :

যে সকল কাজ দলবদ্ধ না হয়ে সম্পাদন করা যায় না তার জন্য দল গঠন করা ওয়াজিব।[9] যেমন উছূলুল ফিক্বহ বা ‘ফিক্বহের সূত্রাবলী’ শাস্ত্রের একটি সুসাব্যস্ত সূত্র রয়েছে,مَا لاَ يَتِمُّ الْوَاجِبُ اِلَّا بِهِ فَهُوَ وَاجِبٌ ‘কোন ওয়াজিব যা না হ’লে সম্পাদন করা যায় না তা করা ওয়াজিব’। সুতরাং যুদ্ধের জন্য দল গঠন করা ওয়াজিব। কেননা শত্রুকে পরাভূত এবং মুসলিমদের বিজয়ী করার লক্ষ্যে যুদ্ধ করতে হ’লে একটি সুশৃঙ্খল দল, একজন আমীর ও একজন সেনাপতি ব্যতীত কস্মিনকালেও তা পরিপূর্ণ হ’তে পারবে না। আর মুসলিম উম্মাহও একজন শাসক বা নেতা ছাড়া সংঘবদ্ধ হবে না। সুতরাং একজন শাসক বা নেতা দাঁড় করানো উক্ত সূত্র মতেই ওয়াজিব হবে।

অনুরূপভাবে সমাজ থেকে যে যে অন্যায় দলবদ্ধতা ব্যতীত রোধ করা সম্ভব নয় সেই সেই অন্যায় রোধ ও দূর করার জন্য দল গঠন করা ওয়াজিব। একইভাবে দ্বীনের মধ্যে যত ফরযে কিফায়া আছে সেগুলো সম্পাদনের জন্য একজন ইমাম বা নেতার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হওয়া ওয়াজিব। যেমন জুম‘আর ছালাতের ব্যবস্থা গ্রহণ, জামা‘আতে ছালাত আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ, মসজিদ নির্মাণ, লাশের গোসল দান, কাফন পরানো, দাফন (সমাহিত) করা, শিক্ষার ব্যবস্থা করা, ঈমান ও ইসলাম প্রচার করা ইত্যাদি কাজ আল্লাহ তার বান্দাদের উপর ফরযে কিফায়া বা সামষ্টিক ভাবে ফরয করেছেন। সুতরাং এসব কাজে একজন নেতার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হওয়া ওয়াজিব হবে। সারকথা উক্ত সুসাব্যস্ত সূত্র ‘যা না হ’লে কোন ওয়াজিব পূরণ করা সম্ভব হয় না তা করা ওয়াজিব’-এর ভিত্তিতে বলব, দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা, মুসলিম জাতি ও ভূখন্ডের বিরুদ্ধে শত্রুপক্ষের চক্রান্ত রুখে দেওয়া একজন শাসক বা নেতা ছাড়া হ’তে পারে না। এজন্য দ্বীনী বিধান অনুসারেই একজন শাসক বা নেতা নিয়োগ করা ওয়াজিব। এ বিষয়ে মুসলিমদের ঐকমত্য রয়েছে। যেমন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ওফাতের পর তারা আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ)-কে ঐক্যমতের ভিত্তিতে খলীফা নির্বাচন করেছিলেন। তাঁকে নির্বাচনের উদ্দেশ্য ছিল দ্বীন প্রতিষ্ঠা, মুসলিমদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী সম্পাদন, আল্লাহর বাণীকে সমুন্নতকরণ এবং কাফিরদের ক্ষমতা খর্ব করা।

তারপর মুসলমানরা যুগ যুগ ধরে এই ধারা মেনে শাসক নিয়োগ করে আসছে। আল্লাহ তা‘আলাও কুরআন মাজীদে ইমাম নিয়োগ দানের কথা সরাসরি বলেছেন-

إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ،

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আমানত সমূহকে তার যথার্থ হকদারগণের নিকট পৌঁছে দাও। আর যখন তোমরা লোকদের মধ্যে বিচার করবে, তখন ন্যায়বিচার করবে’ (নিসা ৪/৫৮)

এখানে ‘আমানত’ হল বিচারিক ও প্রশাসনিক আমানত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,وَمَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِي عُنُقِهِ بَيْعَةٌ، مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّة ‘যে ব্যক্তি (ইমামের নিকট) বায়‘আত ছাড়া মারা যাবে সে জাহেলিয়াতের উপর মারা যাবে’।[10]

সারকথা, একজন নির্বাহী ক্ষমতাধর সর্বজনমান্য ইমাম নিয়োগ দান মুসলমানদের উপর ফরয। তাদের জন্য আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ মোতাবেক শাসন পরিচালনাকারী একজন শাসক নিয়োগ ছাড়া একটি রাতও কাটানো জায়েয নেই। নচেৎ তারা সকলেই পাপী হবে।

দেখুন, এভাবে দলবদ্ধতা ও নেতার কথা ইসলামের প্রায় ক্ষেত্রেই রয়েছে। ছালাতের জন্য জামা‘আত কারো মতে ফরযে আইন, কারো মতে ফরযে কিফায়া। উভয় মতানুসারেই জামা‘আত একটা হ’তেই হবে- যাতে ছালাত প্রতিষ্ঠা পায়। নতুবা জামা‘আত ছাড় দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত আর ছালাতের অস্তিত্ব থাকবে না। ইসলামের এ রুকনটাই বরবাদ হয়ে যাবে। তাতে কিন্তু সবাইকে পাপের ভার বহন করতে হবে। আবার যুদ্ধ করা যে ওয়াজিব তাতে কোন সন্দেহ নেই। যুদ্ধ যথাযথভাবে করতে চাইলে একজন শাসক, একজন সেনাপতি ও একটি দল লাগবে। এরা পরামর্শের ভিত্তিতে মতামত নিবে এবং একটি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করবে। সুতরাং জিহাদের জন্য একজন শাসক বা সেনাপতি নিয়োগ করা লাগবে। সেনাপতি ও শৃঙ্খলা ছাড়া যার যার মত বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ করা জায়েয হবে না। কেননা, তা পরাজয় ও ধ্বংস ডেকে আনবে। এ কথা বুঝার জন্য মানুষের বেশী একটা যুক্তি-বুদ্ধি খরচের দরকার পড়ে না।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদার যুগে হজ্জের জন্যও একজন ইমাম বা নেতা নিয়োগ দেওয়া হ’ত। লোকেরা ঐ ইমামের নির্দেশেই হজ্জের জন্য বের হ’তেন এবং তার নির্দেশেই ফিরে আসতেন।

যাকাতের মত ইবাদতও কোন ইমাম বা নেতার নিকট জমা দান এবং নিয়ম অনুযায়ী বণ্টন না করলে শুদ্ধ হয় না। আল্লাহ বলেছেন, خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً ‘তুমি তাদের মাল-সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ কর’ (তওবা ৯/১০৩)। এ আদেশ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে দেওয়া হয়েছিল। খলীফাগণও প্রতিটি শহর-জনপদে যাকাত আদায়কারী নিয়োগ দিতেন। তারা ধনীদের থেকে যাকাত সংগ্রহ করে দরিদ্রদের মধ্যে তা বণ্টন করতেন। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মু‘আয (রাঃ)-কে ইয়ামান প্রেরণকালে বলেছিলেন,

إِنَّكَ تَقْدَمُ عَلَى قَوْمٍ أَهْلِ كِتَابٍ، فَلْيَكُنْ أَوَّلَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ عِبَادَةُ اللهِ، فَإِذَا عَرَفُوا اللهَ، فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّ اللهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِيْ يَوْمِهِمْ وَلَيْلَتِهِمْ، فَإِذَا فَعَلُوْا، فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّ اللهَ فَرَضَ عَلَيْهِمْ زَكَاةً مِنْ أَمْوَالِهِمْ وَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ، فَإِذَا أَطَاعُوْا بِهَا، فَخُذْ مِنْهُمْ وَتَوَقَّ كَرَائِمَ أَمْوَالِ النَّاسِ-

‘তুমি আহলে কিতাব ইহূদী খৃষ্টানদের কাছে যাচ্ছ। তোমার সর্বপ্রথম কাজ হবে, তাদেরকে তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদের দিকে দাওয়াত দেওয়া। তারা তা মেনে নিলে তুমি তাদের জানাবে যে, আল্লাহ তা‘আলা দিনে-রাতে তাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেছেন। তারা তোমার এ কথা মেনে নিলে তুমি তাদের জানাবে যে, আল্লাহ তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন- যা তাদের ধনীদের থেকে নেওয়া হবে এবং তাদের গরীবদের মাঝে বিতরণ করা হবে। তারা যখন এতে সম্মত হবে তখন তুমি তাদের থেকে যাকাত গ্রহণ করবে। অবশ্য তুমি লোকদের বাছাবাছা দ্রব্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে’।[11]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাণী تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ ‘তাদের ধনীদের থেকে নেওয়া হবে’ এবং فَاِذَا اَطَاعُوْا فَخُذْ مِنْهُمْ  ‘তারা যখন এতে সম্মত হবে তখন তুমি তাদের থেকে যাকাত নেবে’-এর প্রতি গুরুত্ব সহকারে লক্ষ্য করুন। এ কথা প্রমাণ করে যে, ইমাম বা শাসকই যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টন করবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সাধারণ মুসলমানদের যে যেমন ইচ্ছে যাকাত বণ্টনের স্বাধীনতা দেননি। বরং এলাকা ভিত্তিক আমীর বা দায়িত্বশীলের নিকট যাকাত জমা করতে হবে তারপর শরী‘আত বর্ণিত ব্যয়ের খাত অনুযায়ী তা ব্যয় করতে হবে।

হজ্জ ও ছালাতের মতই যাকাতও দলবদ্ধতা ও ইমাম বা নেতা ছাড়া হয় না। একইভাবে ছিয়ামের জন্যও শাসক বা নেতা আবশ্যক। তিনি হিজরী মাসগুলোর শুরু ও শেষ নির্ধারণ করবেন। মুসলমানরা তার এই নির্ধারণ মেনে নিয়ে সবাই ছিয়াম শুরু ও শেষ করবে; কেউ ছিয়ামের শুরু ও ইতি টানতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে না। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,اَلصَّوْمُ يَوْمَ تَصُوْمُوْنَ، وَالفِطْرُ يَوْمَ تُفْطِرُوْنَ، وَالأَضْحَى يَوْمَ تُضَحُّوْنَ ‘ছিয়াম সেদিন থেকে যেদিন তোমরা ছিয়াম শুরু করবে, ঈদুল ফিতর সেই দিনে যেদিন তোমরা ঈদুল ফিতর করবে, আর কুরবানী বা ঈদুল আযহা সেই দিনে যেদিন তোমরা কুরবানী বা ঈদুল আযহা করবে’।[12]

উল্লিখিত সকল বর্ণনা থেকে এই নির্দেশনা পাওয়া যায় যে, ইসলামের চারটি স্তম্ভ যা মহা ইবাদত বলে গণ্য তার কোনটাই দলবদ্ধতা, শাসক বা নেতা এবং বিধি মেনে পালন ছাড়া শুদ্ধ হয় না। সুতরাং ছালাতের জামা‘আত বা দলে শরীক হওয়ার সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে তাতে শরীক না হয়ে একাকী ছালাত আদায় করবে তার ছালাত হবে না। আর যে শাসককে এড়িয়ে নিজের মত যাকাত দেবে তার যাকাত হবে না। আর যে জনগণের সাথে ছিয়াম না রেখে নিজের মত করে ছিয়াম শুরু ও শেষ করবে সে দলচ্যুত ও পাপী হবে। এমনিভাবে যে নিজের মত করে হজ্জের মানসে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে আরাফায় অবস্থানের একটা দিন ঠিক করে নিয়ে হজ্জ করবে তার হজ্জ হবে না। সুতরাং আমরা বুঝতে পারলাম, উল্লিখিত ইবাদতগুলোর জন্য জামা‘আত বা দল আবশ্যক।

জিহাদের জন্যও যে জামা‘আত বা দল গঠন আবশ্যিক তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর কোন জিহাদই একজন আমীর বা শাসক এবং একজন সেনাপতি ছাড়া হয় না। আবার এতেও কোন সন্দেহ নেই যে, জামা‘আত বা দল ইমাম বা শাসকের আনুগত্য ছাড়া চলতে পারে না। তাইতো আল্লাহ বলেছেন,إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ وَإِذَا كَانُوْا مَعَهُ عَلَى أَمْرٍ جَامِعٍ لَمْ يَذْهَبُوْا حَتَّى يَسْتَأْذِنُوْهُ، ‘মুমিন তো কেবল তারাই, যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং যখন তারা তার সঙ্গে কোন সমষ্টিগত গুরুত্বপূর্ণ কাজে সাথী হয়, তখন তারা চলে যায় না তার কাছ থেকে অনুমতি না নেওয়া পর্যন্ত’ (নূর ২৪/৬২)

আয়াতের মর্মার্থ এই যে, কোন মুসলিম যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে উদাহরণ স্বরূপ জিহাদের মত কোন দলবদ্ধ কাজে থাকবে তখন তার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট থেকে অনুমতি গ্রহণের পরেই কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে স্ব স্থান ত্যাগ করার সুযোগ মিলবে। অনুমতি ছাড়া চুপিসারে কেটে পড়লে তা আনুগত্যের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে। তাতে করে আল্লাহর অসন্তোষ ও শাস্তি ডেকে আনা হবে। যেমন আল্লাহ বলেন, قَدْ يَعْلَمُ اللهُ الَّذِيْنَ يَتَسَلَّلُوْنَ مِنْكُمْ لِوَاذًا فَلْيَحْذَرِ الَّذِيْنَ يُخَالِفُوْنَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيْبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيْبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ، ‘আল্লাহ তাদেরকে জানেন যারা তোমাদের মধ্যে চুপিসারে চলে যায়। অতএব যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সাবধান হৌক যে, ফিৎনা তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা মর্মন্তুদ শাস্তি তাদের উপর আপতিত হবে’ (নূর ২৪/৬২)

يَتَسَلَّلُوْنَ لِوَاذًا অর্থ ‘তারা লুকিয়ে পড়ে’। তারা গাছ, দেয়াল কিংবা লুকানোযোগ্য কোন কিছুর আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি- যারা  রাসূলের আদেশ লংঘন করবে আল্লাহ তাদের সাবধান করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে বিপদ অথবা জ্বালাময়ী শাস্তিতে পতিত হওয়ার ধমক দিয়েছেন। যদিও এখানে রাসূলের আদেশটা ছিল জিহাদ (আন্দোলন) মূলক কাজের বিষয়ে তবুও সার্বিকভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর সব আদেশই তাতে শামিল হবে। কেননা আয়াতের শিক্ষা শব্দের ব্যাপকতার সাথে যুক্ত; শুধু অবতরণের ঘটনার মধ্যে তা সীমিত নয় (اَلْعِبْرَةُ بِعُمُوْمِ اللَّفْظِ لَا بِخُصُوْصِ السَّبَبِ) অতএব এখানে اَوَامِر বা আদেশ বহুবচন বা আদেশ সমূহ অর্থে গণ্য করতে হবে। অর্থাৎ তাঁর সকল আদেশই মানতে হবে। তবে যে ঘটনার প্রেক্ষিতে আয়াত নাযিল হয় যেমন এখানে জিহাদ তা অবশ্যই ঐ আদেশের আওতাভুক্ত হবে। বরং তা প্রথম কাতারে থাকবে। কেননা তার প্রেক্ষিতেই তো আয়াত নাযিল হয়েছে।

সারকথা : ইসলাম একটি জামা‘আত বা দল ভিত্তিক ব্যবস্থা। প্রায় প্রতিটি বিষয়ে তা জামা‘আত বা দলের উপর নির্ভরশীল। চাই তা সার্বিক জীবনাচারে হোক কিংবা ছালাত, ছিয়াম, যাকাত ও হজ্জের মত রুকনের ক্ষেত্রে হোক। জিহাদ ও সফরের জন্যও যেমন জামা‘আত বা দল আবশ্যক, তেমনি গ্রাম, শহর ও অঞ্চলের জন্যও জামা‘আত বা দল আবশ্যক। খলীফাগণও প্রতিটি সেক্টরে আমীর বা শাসনকর্তা নিয়োগ করতেন। যেমন বাজারের আমীর, শিল্প কারখানার আমীর ইত্যাদি।

শাসক বা নেতার দায়িত্ব

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমরা জেনেছি যে, দ্বীন দুনিয়ার সকল কাজই যথার্থ ও পরিপূর্ণভাবে শুরু করতে এবং শেষ করতে চাইলে তাতে জামা‘আত বা দল গঠন আবশ্যকীয় ফরয। আমরা এ কথাও জেনেছি যে, মুসলমানদের ছালাত, ছিয়াম, যাকাত, হজ্জ, জিহাদ ইত্যাদির কোনটাই জামা‘আত বা দল, শৃঙ্খলা বিধি এবং ক্ষমতাসম্পন্ন নেতা ছাড়া হয় না। আমরা আরও জেনেছি যে, মুসলিম দেশগুলোতে কোন গ্রাম, শহর, অঞ্চল এমনকি কোন পেশা ও শিল্পও এমন থাকতে পারবে না যেখানে বিবাদ মীমাংসার জন্য একজন ক্ষমতাশালী নেতা থাকবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এবং তাঁর পরবর্তীকালে খলীফা ও ছাহাবীগণ এ পন্থাই অবলম্বন করেছিলেন। তাঁরা এ পথেরই পথিক ছিলেন।

এখন আমরা সর্বসাধারণের ইমাম বা রাষ্ট্র নায়কের সেসব দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা করব, যা আল্লাহ তার উপর ওয়াজিব করেছেন। সেসব আসলে কী?

এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, সর্ব সাধারণের ইমাম বা খলীফার উপর আল্লাহ তা‘আলা অনেক গুরুদায়িত্ব আরোপ করেছেন। এসব দায়িত্বের মূল লক্ষ্য দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ সাধন। নিম্নে এমন কিছু দায়িত্ব তুলে ধরা হ’ল- (১) আল্লাহর যমীনে আল্লাহর বিধান জারি করা ও কার্যকর রাখা (২) আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী বিচার করা (৩) ছালাত প্রতিষ্ঠা করা (৪) যাকাত আদায় ও বণ্টন করা (৫) সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা (৬) আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা, লেখনী ও অস্ত্রশস্ত্র সহ জিহাদ করা (৭) মুসলিম শিশুদের লালন-পালন, পরিচর্যা ও শিক্ষা-দীক্ষার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা (৮) অসহায় প্রতিবন্ধীদের সহায়তা প্রদান করা (৯) মানুষের মাঝে সাম্য-ইনছাফ কায়েম করা (১০) বিদ্রোহী ও অন্যায়-অত্যাচারকারীদের প্রতিহত করা (১১) অত্যাচারিত ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকার আদায় করে দেওয়া (১২) জনগণের জীবন-জীবিকা ও পার্থিব সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা (১৩) ইনছাফ ও সমতার ভিত্তিতে জনগণের মধ্যে অর্থ বণ্টন করা ইত্যাদি।

সন্দেহ নেই যে, ইসলামের দৃষ্টিতে শাসনক্ষমতা একটি মহা গুরুদায়িত্ব এবং অনেক বড় ও কষ্টসাধ্য আমানত। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইমারত বা শাসনকার্য সম্পর্কে বলেছেন,إِنَّهَا أَمَانَةٌ، وَإِنَّهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ خِزْيٌ وَنَدَامَةٌ، إِلَّا مَنْ أَخَذَهَا بِحَقِّهَا، وَأَدَّى الَّذِيْ عَلَيْهِ فِيْهَا ‘নিশ্চয়ই তা আমানত এবং নিশ্চয়ই তা ক্বিয়ামতের দিন অপমান ও আফসোসের কারণ হবে। তবে তার জন্য নয়, যে উহার হক বুঝে উহাকে গ্রহণ করবে এবং ঐ সম্পর্কিত তার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে’।[13]

কিন্তু আফসোস! বর্তমানে অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রক্ষমতাকে লুটের মাল মনে করে। এর মাধ্যমে তারা জনগণের মাথার উপর সওয়ার হয় এবং তাদের জান-মাল ও ইযযত-আবরুর উপর ইচ্ছেমত খবরদারি করে। অথচ আল্লাহর মানদন্ডে অবস্থা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। আল্লাহর মানদন্ডে রাষ্ট্রক্ষমতা হ’ল এক দায়ভার ও জনগণের খেদমত। এ এমন এক দায়ভার যে, শাসনকর্তাই মানুষের মাঝে সবচেয়ে বেশী কষ্টের বোঝা বহনকারী। তার দায়িত্বই সবচেয়ে কঠিন। এ কারণেই এ উম্মতের সবচেয়ে নেককার লোকেরা নেতৃত্বের দায়িত্বকে সবচেয়ে বেশী ভয় করতেন এবং তা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইতেন।

আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ)-কে দেখুন! তিনি বলছেন, আল্লাহর কসম! আমি একদিন কিংবা এক রাতের জন্যও খিলাফতের দায়িত্ব চাইনি (বুখারী)। ওমর (রাঃ) খিলাফতকে বড়ই  উপেক্ষার সাথে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তা একান্ত দায়িত্ব হিসাবে পালন করেছিলেন এবং মৃত্যুকালে তার প্রতি নিরুৎসাহ প্রকাশ করেছিলেন। এক ব্যক্তি তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহকে খলীফা বানানোর জন্য আকারে-ইঙ্গিতে তাঁর নিকট বিষয়টি ব্যক্ত করলে তিনি বলেছিলেন, খাত্ত্বাব বংশের একজনের জন্যই খিলাফতের দায়িত্ব পালন যথেষ্ট। যদি এ দায়িত্ব মধুর হয় তাহ’লে তারা তো তার ভাগ পেয়েছে। আর যদি তা না হয় তাহ’লে তাদের জন্য ঐ একজনের দায়িত্ব পালনই যথেষ্ট’।

মোটকথা, ইসলামে শাসকের  দায়িত্ব এক বিরাট ও মহা গুরুদায়িত্ব। আল্লাহ বলেন,الَّذِيْنَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُوْرِ- ‘তারা এমন লোক, যাদেরকে আমরা যদি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করি, তাহ’লে তারা ছালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, সৎকাজের আদেশ দেয় ও অসৎকাজে নিষেধ করে। আর সকল কাজের পরিণাম আল্লাহর ইচ্ছাধীন’ (হজ্জ ২২/৪১)

এ যুগের মানুষের দৃষ্টিতে শাসনক্ষমতা, রাজত্ব ও রাষ্ট্রীয় পদ যে অর্থে ব্যবহৃত হয় ইসলামে শাসন ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় পদের অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা। অধিকাংশ লোক এখন রাষ্ট্রক্ষমতাকে পার্থিব মহাসুযোগ, নেতাগিরি করা এবং সম্মানের ব্যাপার মনে করে। তারা ভাবে, এতে করে তাদের অবস্থান দৃঢ় হবে এবং ক্ষমতা সুসংহত হবে। তারা কখনো ভাবে না যে, এ দায়িত্বের জন্য একদিন তাকে আল্লাহর সামনে কৈফিয়ত দিতে হবে।

অবস্থাতো এতটাই নীচে নেমে গেছে যে, অনেক মুসলিম দেশে অনৈসলামিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। জাগতিক সুখ-সুবিধা লাভই এখন তাদের মুখ্য লক্ষ্য। দ্বীনী কল্যাণ-অকল্যাণ সংক্রান্ত কোন চিন্তা তাদের মাথায় নেই। জাগতিক চিন্তায় বিভোর একজন শাসক যদি সুশাসকও হয় তবুও সে একথাই ভাবে যে, সে শুধু মানুষের ইহজাগতিক দায়িত্বশীল। ইহজগতে তাদের জীবন যাপনের সুব্যবস্থা করা, জীবিকার উপকরণ বণ্টন করা, আরাম-আয়েশের সুব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্য সুবিধা বৃদ্ধি করা, শিক্ষার বন্দোবস্ত করা, বৈধ-অবৈধ সকল কাজ ইচ্ছেমত করার সুযোগ দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদিই তার কাজ। সুশাসক নিজে সুশাসনের জন্য উল্লিখিত বা অনুরূপ যা যা ভাবে জনগণও সুশাসন বলতে তেমনটাই ভাবে। তারা একজন শাসকের কাছে ঐগুলিই প্রত্যাশা করে।

কিন্তু আজ এমন সুশাসকেরও বড় অভাব। বেশীর ভাগ ক্ষমতাসীনই দ্বীন ও দুনিয়া উভয়কে ধ্বংস করতে সদা তৎপর। তাদের কাছে দ্বীনের উল্লেখযোগ্য কোন গুরুত্বই নেই। দ্বীনের দিক দিয়ে না তারা ছালাত কায়েমের ব্যবস্থা করে, না সৎ কাজের আদেশ দেয়, না অসৎ কাজের নিষেধ করে, না ইসলামী আক্বীদা বিশ্বাস সুরক্ষার ব্যবস্থা নেয়। আবার পার্থিব দিক দিয়েও তারা না জনজীবনে স্বাচ্ছন্দ আনয়নে তৎপর হয়, না জনগণের জান-মাল ও ইযযতের নিরাপত্তা বিধান করে, না দেশের পরিকল্পিত উন্নয়নে আগুয়ান হয়। তাদের কেউ কেউ তো ইসলামের শত্রুদের থেকেও মুসলমানদের সঙ্গে বেশী নির্মম ও নিষ্ঠুর আচরণ করে।

মুসলমানদের দায়িত্ব-কর্তব্য কী সে ব্যাপারে তারা বড়ই উদাসীন। সারা দেশ জুড়ে তারা অন্যায়-অবৈধ ও শরী‘আত গর্হিত কাজের সয়লাব বইয়ে দিচ্ছে। যে সব কাজে আল্লাহর পথে ইসলামের পথে চলতে বিঘ্ন সৃষ্টি হয় সেগুলো করাই আজ তাদের পেশা ও নেশা। তারা অনুশীলনকারী (Practicing) মুমিনদের পাকড়াও করার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। যখন কোন যুবক নিয়মিত মসজিদ পানে যেতে পা বাড়ায় তখন তারা তাকে ভয় দেখায়, অত্যাচার করে, জেলখানায় পুরে রাখে- অথচ তার কোনই অপরাধ নেই। অপরাধ শুধু একটাই যে, সে বলে, ‘আমার রব আল্লাহ’। আবার যখন কোন তরুণী হিজাব পরে বের হয় তখন তারা তাকে বিদ্রুপবানে জর্জরিত করে, লাঞ্ছিত করে। এমনকি অবস্থা এতদূর গড়ায় যে, শিক্ষা লাভ ও পথে ঘাটে স্বাধীনভাবে চলাচলের মত ন্যূনতম অধিকার থেকেও তাকে বঞ্চিত করা হয়।

সমাজে যত নিকৃষ্ট ও খারাপ শ্রেণীর লোক আছে এসব শাসক তাদেরকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়। তাদেরকে তারা বড় বড় পদে আসীন করে। দেশকে নরক বানানোই হয় তাদের কাজ। তারা দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে দেয়। নাগরিকদের চরিত্র ও নীতি-নৈতিকতা একেবারে তলানীতে নামিয়ে দেয়। সমাজের কল্যাণকামী সম্মানিত ব্যক্তিদের তারা তিরস্কৃত করে আর বদমাশ, যুলুমবায, ঘুষখোর ও চোর-ছ্যাচরদের করে পুরস্কৃত।

এইভাবে এসব শাসক আল্লাহ, তার রাসূল ও মুমিনদের বিরুদ্ধে সদা যুদ্ধে লিপ্ত। তারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী মুমিনদের আল্লাহর পথে চলতে বাধা দেয় এবং ইসলামের মাঝে এ দোষ সে দোষ খুঁজে বের করতে তৎপরতা চালায়।

অনেক ইসলামী দেশে ‘ধর্মীয় তৎপরতা রোধ’ (شُعْبَةُ مُكَافَحَةِ النَّشَاطِ الدِّيْنِيِّ) নামক সংস্থা খুলে জনগণের পেছনে লাগিয়ে দেওয়া হয়।

তাহ’লে দেখুন! কীভাবে মুসলমানদের অর্থ-সম্পদ ও শক্তিকে আল্লাহর যমীনে আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টিতে ব্যয় করা হচ্ছে। এভাবেই পাল্লা উল্টে গেছে, পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ফলে যে শাসক, খলীফা বা রাষ্ট্রপতির আল্লাহর বান্দা হয়ে ছালাত কায়েম, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ, দ্বীনের পাহারাদারী এবং মুসলমানদের হেফাযতে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ছিল সেই তারাই এখন আল্লাহর শত্রু হয়ে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দেওয়া সম্পদ এবং মুসলমানদের অর্থকড়ি নিয়ে যুদ্ধ করছে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ছাড়া পাপ থেকে বাঁচা ও পুণ্য কাজে আগুয়ান হওয়ার সামর্থ্য কারো নেই।

(চলবে)


[1]. আল-মু‘জামুল ওয়াসীত অভিধানে জামা‘আত বা দলের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, اَلْجَمَاعَةُ مَا اجْتَمَعَ مِنَ النَّاسِ عَلَى هَدَفٍ تَحْتَ إِمَارَةٍ ‘একজন নেতার নেতৃত্বে কোন লক্ষ্য অর্জনের সংকল্প নিয়ে জনগণের একতাবদ্ধ হওয়াকে জামা‘আত বা দল বলে। মূলতঃ দল বলতে এমন কিছু মানুষের সমষ্টিকে বুঝায় যাদের একজন নেতা এবং কিছু লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকে। ঐ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য নির্দিষ্ট কর্মসূচী থাকে। তারা সংঘবদ্ধ চেষ্টার মাধ্যমে কর্মসূচীগুলো বাস্তবায়ন করে এবং লক্ষ্যে পৌঁছার চেষ্টা চালিয়ে যায়।-অনুবাদক।

[2]আহমাদ হা/১১৬৩১; দারেমী হা/১৪০৮; আবূদাঊদ হা/৫৭৪; বায়হাক্বী, মা‘রিফাতুস সুনান হা/৪৩৩৩; হাকিম হা/৭৫৮, আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত।  

[3]বুখারী হা/৬৪৫; মুসলিম হা/৬৪৯।  

[4]তিরমিযী হা/২১৬৬। ইবনু আববাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত। আলবানী ছহীহ বলেছেন।  

[5]বুখারী হা/৩৬০৬; মুসলিম হা/১৮৪৭।   

[6]মুসলিম হা/১৮৫৫।    

[7]মুসলিম হা/১৮৫৫।    

[8]মুসলিম হা/১৮৪৯।   

[9]. এই পুস্তিকায় যেখানেই ওয়াজিব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে সেখানেই তা ফরয বা অবশ্য পালনীয় অর্থ বহন করে। ফিক্বহ শাস্ত্রে ফরয-এর স্থলে ওয়াজিব শব্দের ব্যবহার অহরহ লক্ষ করা যায়। যেমন হিদায়া গ্রন্থে আছে الَصَّوْمُ ضَرْباَنِ وَاجِبٌ وَنَفْلٌ ‘ছিয়াম দুই প্রকার : ওয়াজিব ও নফল। এখানে ওয়াজিব ছিয়াম হ’ল রামাযানের ছিয়াম। আর রামাযানের ছিয়াম সবার মতেই ফরয। অতএব ফরয অর্থে ওয়াজিব শব্দের ব্যবহার একটি সুপ্রচলিত বিষয়।

[10]মুসলিম হা/১৮৫১।    

[11]বুখারী হা/৪৩৪৩৭; মুসলিম হা/১৯।     

[12]তিরমিযী হা/৬৯৭, আলবানীর মতে হাদীছটি ছহীহ।    

[13]মুসলিম হা/১৮২৫।     





জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে ‘আত-তাহরীক’-এর ভূমিকা - বযলুর রশীদ
পারিবারিক অপরাধ : কারণ ও প্রতিকার - মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন
নেতৃত্বের মোহ - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য শিখন ফলাফলের গুরুত্ব (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া
সীমালংঘন ও দুনিয়াপূজা : জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার দুই প্রধান কারণ (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
অনারবী ভাষায় জুম‘আ ও ঈদায়েনের খুৎবা : একটি বিশ্লেষণ - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
শারঈ মানদন্ডে ঈদে মীলাদুন্নবী - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
কুরবানীর মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
বিদায়ের আগে রেখে যাও কিছু পদচিহ্ন (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
তাছফিয়াহ ও তারবিয়াহ : মুসলিম জীবনে এর প্রয়োজনীয়তা (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর উপর নির্যাতন - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
বৃদ্ধাশ্রম : মানবতার কলঙ্কিত কারাগার - মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম
আরও
আরও
.