পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । শেষ পর্ব  

মসজিদের ফযীলত :

ইসলামী শরী‘আতে মসজিদের অনেক ফযীলত রয়েছে। এসব ফযীলতেও রয়েছে ভিন্নতা। কোন কোন মসজিদকে ফযীলতের দিক দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা অন্য সকল মসজিদ থেকে আলাদা করেছেন। এক্ষেত্রে প্রথম হচ্ছে মসজিদে হারাম, দ্বিতীয় মসজিদে নববী, তৃতীয় মসজিদে আক্বছা, চতুর্থ মসজিদে ক্বোবা। মর্যাদাপূর্ণ এ চারটি মসজিদ ব্যতীত পৃথিবীর অন্যান্য সকল মসজিদের মর্যাদা সমান। উল্লিখিত প্রত্যেক মসজিদের পৃথক পৃথক ফযীলত নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-

ক. মসজিদে হারামের ফযীলত : 

পৃথিবীর সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ মসজিদ হ’ল মক্কায় অবস্থিত মসজিদে হারাম। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে এ মসজিদের অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন-

(১) মুসলমানদের ক্বিবলা : মুসলমানদের ক্বিবলা হচ্ছে মসজিদে হারাম তথা বায়তুল্লাহ। প্রত্যেক মুসলমানকে ছালাতের সময় মসজিদে হারামের দিকে মুখ করে ছালাত আদায় করতে হয়। ক্বিবলামুখী হওয়া ছালাতের অন্যতম ফরয। ইচ্ছাকৃতভাবে মসজিদে হারাম ব্যতীত অন্য কোন দিকে ফিরে ছালাত আদায় করলে তা কবুল হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَحَيْثُ مَا كُنْتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ، ‘অতএব তুমি মাসজিদুল হারামের (কা‘বা গৃহের) দিকে তোমার চেহারা ফিরিয়ে দাও। আর তোমরা যেখানেই থাক তোমাদের চেহারাকে সেদিকেই (কা‘বার দিকে) ফিরিয়ে দাও’ (বাক্বারাহ ২/১৪৪)

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, যখন নবী করীম (ছাঃ) কা‘বায় প্রবেশ করেন, তখন তাঁর সকল দিকে দো‘আ করেন, ছালাত আদায় না করেই বেরিয়ে আসেন এবং বের হবার পর কা‘বার সামনে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেন এবং বলেন, এটাই ক্বিবলা’।[1] 

(২) কা‘বাকে ক্বিবলা হিসাবে গ্রহণ করা মুসলিম হওয়ার পরিচায়ক : কা‘বাকে ক্বিবলা হিসাবে গ্রহণ করা মুসলিম হওয়ার পরিচায়ক। আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) বলেন,مَن صَلّى صَلاتَنا واسْتَقْبَلَ قِبْلَتَنا، وأَكَلَ ذَبِيحَتَنا فَذلكَ المُسْلِمُ الذي له ذِمَّةُ اللهِ وذِمَّةُ رَسولِهِ، ‘যে ব্যক্তি আমাদের ন্যায় ছালাত আদায় করে, আমাদের ক্বিবলামুখী  হয়  আর  আমাদের  যবেহকৃত  প্রাণী খায়, সেই

মুসলিম, যার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যিম্মাদার’।[2]

(৩) এক লক্ষ গুণ বেশী ছওয়াব : বায়তুল্লায় ছালাত আদায় করলে অন্যান্য মসজিদের চেয়ে এক লক্ষ গুণ বেশী ছওয়াব হয়। আবুদ্দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

فَضْلُ الصلاةِ في المسجدِ الحرامِ على غيرِه مائةُ ألفِ صلاةٍ، وفي مَسْجِدِي أَلْفُ صلاةٍ،

‘মসজিদে হারামে ছালাত আদায় করার ফযীলত অন্য মসজিদে ছালাত আদায়ের চেয়ে এক লক্ষ গুণ বেশী। আর আমার মসজিদে (মসজিদে নববীতে) ছালাত আদায়ে এক হাযার গুণ বেশী’।[3] 

(৪) এই মসজিদের উদ্দেশ্যে ছওয়াবের আশায় সফর করা বৈধ : আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لا تُشَدُّ الرِّحالُ إلّا إلى ثَلاثَةِ مَساجِدَ: المَسْجِدِ الحَرامِ، ومَسْجِدِ الرَّسُولِ صلى اللهُ عليهِ وسلم، ومَسْجِدِ الأقْصى. ‘মসজিদে হারাম তথা বায়তুল্লাহ, রাসূল (ছাঃ)-এর মসজিদ তথা মসজিদে নববী এবং মাসজিদুল আক্বছা এই তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন মসজিদের উদ্দেশ্যে (ছওয়াবের আশায়) হাওদা বাঁধা যাবে না (অর্থাৎ সফর করা যাবে না)’।[4] 

(৫) ইসলাম ফিরে যাবে মসজিদে হারামের দিকে : ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إنَّ الإسْلامَ بَدَأَ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ غَرِيبًا كما بَدَأَ، وَهو يَأْرِزُ بيْنَ المَسْجِدَيْنِ، كما تَأْرِزُ الحَيَّةُ في جُحْرِها. ‘ইসলাম মুষ্টিমেয় লোকের মাধ্যমে তার যাত্রা করেছে। সত্বর তা মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যেই ফিরে আসবে, যেমনটি সূচনাতে ছিল। সাপ যেমন সংকুচিত হয়ে তার গর্তে প্রবেশ করে তদ্রূপ ইসলামও দুই মসজিদের (বায়তুল্লাহ ও মসজিদে নববী) মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে’।[5]

(৬) এই মসজিদের দিকে ফিরে বা পিছনে রেখে পেশাব-পায়খানা করা যাবে না : আবূ আইয়ূব আনছারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,

اذَا أَتَيْتُمُ الْغَائِطَ فَلاَ تَسْتَقْبِلُوا الْقِبْلَةَ وَلاَ تَسْتَدْبِرُوهَا، وَلَكِنْ شَرِّقُوا أَوْ غَرِّبُوا قَالَ أَبُو أَيُّوبَ فَقَدِمْنَا الشَّأْمَ فَوَجَدْنَا مَرَاحِيضَ بُنِيَتْ قِبَلَ الْقِبْلَةِ، فَنَنْحَرِفُ وَنَسْتَغْفِرُ الل‏‏‏‏‏‏‏‏‏‏‏‏

‘যখন তোমরা পায়খানায় যাও, তখন ক্বিবলার দিকে মুখ কিংবা পিঠ করবে না, বরং পূর্ব অথবা পশ্চিম দিকে ফিরে বসবে (এটা কা‘বার উত্তর বা দক্ষিণের লোকদের জন্য। কেননা কা‘বা হচ্ছে মদীনার সরাসরি দক্ষিণে)। আবূ আইয়ূব আনছারী (রাঃ) বলেন, আমরা যখন সিরিয়ায় গেলাম, সেখানে পায়খানাগুলো ক্বিবলামুখী বানানো পেলাম। তখন আমরা কিছুটা ঘুরে বসতাম এবং আল্লাহর নিকট তওবা ও ইস্তিগফার করতাম’।[6]

‘আব্দুর রহমান ইবনু ইয়াযীদ (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সালমান (রাঃ)-কে বলা হ’ল, আপনাদের নবী প্রতিটি বিষয় আপনাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। এমনকি পেশাব-পায়খানার শিষ্টাচারও? সালমান (রাঃ) বলেন, হ্যাঁ, তিনি আমাদেরকে ক্বিবলামুখী হয়ে পেশাব-পায়খানা করতে, ডান হাত দিয়ে ইস্তিনজা করতে, আমাদের কাউকে তিনটি ঢিলার কম দিয়ে ইস্তিনজা করতে এবং শুকনা গোবর অথবা হাড় দিয়ে ইস্তিনজা করতে নিষেধ করেছেন’।[7]

(৭) ইসরা ও মি‘রাজ শুরু হয়েছে এ মসজিদ থেকে : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবনের অন্যতম মু‘জিযা মি‘রাজ ও ইসরা। যা শুরু হয়েছিল মক্কার বায়তুল্লাহ থেকে। মহান আল্লাহ বলেন,

سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ

‘মহাপবিত্র তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রিবেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আক্বছায়, যার চতুষ্পার্শ্বকে আমরা বরকতময় করেছি, তাকে আমাদের নিদর্শনসমূহ দেখাবার জন্য। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (আল-ইসরা ১৭/১)

(৮) মুশরিকদের প্রবেশ নিষেধ : বায়তুল্লাহর আরেকটি মর্যাদা এ কারণে যে, এখানে কোন বিধর্মী তথা কাফের-মুশরেক প্রবেশ করতে পারবে না। মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ فَلَا يَقْرَبُوا الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ بَعْدَ عَامِهِمْ هَذَا- ‘হে মুমিনগণ! মুশরিকরা নাপাক বৈ কিছুই নয়। অতএব তারা যেন এ বছরের পর মাসজিদুল হারামের নিকটে না আসে’ (তাওবা ৯/২৮)

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবুবকর (রাঃ) নবম হিজরীতে হজ্জে আমাকে এ আদেশ দিয়ে পাঠিয়ে দেন যে, আমি যেন কুরবানীর দিন ঘোষণাকারীদের সঙ্গে মিনায় (সমবেত লোকদের) এ ঘোষণা করে দেই যে, এ বছরের পর কোন মুশরিক হজ্জ করতে পারবে না। আল্লাহর ঘর নগ্নদেহে তাওয়াফ করবে না। হুমায়েদ ইবনু আব্দুর রহমান (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আলী (রাঃ)-কে পুনরায় এ আদেশ দিয়ে প্রেরণ করলেন যে, তুমি সূরা বারাআতের বিধানসমূহ ঘোষণা করে দাও। আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, মিনায় অবস্থানকারীদের মাঝে (কুরবানীর পর) আলী (রাঃ) সূরা বারাআতের বিধানসমূহ ঘোষণা করলেন যে, এ বছরের পর কোন মুশরিক হজ্জ করতে পারবে না। কেউ নগ্ন অবস্থায় আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করতে পারবে না’।[8]

(৯) দাজ্জাল প্রবেশ করতে পারবে না : দাজ্জাল পুরো পৃথিবী অল্প সময়ের মধ্যে ভ্রমণ করতে পারলেও মক্কা ও মদীয়ায় প্রবেশ করতে পারবে না। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

لَيسَ مِن بَلَدٍ إلّا سَيَطَؤُهُ الدَّجّالُ، إلّا مَكَّةَ، والمَدِينَةَ، ليسَ له مِن نِقابِها نَقْبٌ، إلّا عليه المَلائِكَةُ صافِّينَ يَحْرُسُونَها، ثُمَّ تَرْجُفُ المَدِينَةُ بأَهْلِها ثَلاثَ رَجَفاتٍ، فيُخْرِجُ اللهُ كُلَّ كافِرٍ ومُنافِقٍ

‘মক্কা ও মদীনা ব্যতীত এমন কোন শহর নেই যেখানে দাজ্জাল পদচারণ হবে না। মক্কা ও মদীনার প্রত্যেকটি প্রবেশ পথেই ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে পাহারায় নিয়োজিত থাকবে। এরপর মদীনা তার অধিবাসীসহ তিনবার কেঁপে উঠবে এবং আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত কাফের এবং মুনাফিকদেরকে বের করে দিবেন’।[9]

(১০) এখানে পাপাচার নিষিদ্ধ : পৃথিবীর সর্বত্রই পাপকর্ম নিষিদ্ধ। তবে মক্কায় এটি আরো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا وَيَصُدُّوْنَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ وَالْمَسْجِدِ الْحَرَامِ الَّذِي جَعَلْنَاهُ لِلنَّاسِ سَوَاءً الْعَاكِفُ فِيهِ وَالْبَادِ وَمَنْ يُرِدْ فِيهِ بِإِلْحَادٍ بِظُلْمٍ نُذِقْهُ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ

‘যারা অবিশ্বাস করে এবং আল্লাহর পথ ও মাসজিদুল হারাম হ’তে বাধা সৃষ্টি করে, যাকে আমরা প্রস্ত্তত করেছি স্থানীয় ও বহিরাগত সকল মানুষের জন্য সমান হিসাবে। বস্ত্ততঃ যে ব্যক্তি সেখানে অন্যায়ভাবে কোন ধর্মদ্রোহী কাজ করতে চাইবে, আমরা তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আস্বাদন করাব’ (হজ্জ ২২/২৫)

খ. মসজিদে নববীর ফযীলত :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কর্তৃক নির্মিত, মদীনায় অবস্থিত মসজিদে নববীরও। বিশেষ ফযীলত রয়েছে। এই মসজিদ ও হারামের অন্তর্ভুক্ত। বায়তুল্লাহ ও মসজিদে নববী এই দুই মসজিদকে একত্রে ‘হারামাইন’ বলা হয়। যেমন-

(১) মসজিদে নববীতে ছালাত আদায় অন্য মসজিদের চেয়ে এক হাযার গুণ উত্তম : আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,صَلاَةٌ فِي مَسْجِدِي هَذَا خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ صَلاَةٍ فِيمَا سِوَاهُ إِلاَّ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ ‘মসজিদুল হারাম (কা‘বা) ব্যতীত আমার এ মসজিদে ছালাত আদায় করা অন্যান্য মসজিদের তুলনায় এক হাযার গুণ বেশী ছওয়াব’।[10]

(২) এই মসজিদের একটি স্থান হ’ল জান্নাতের বাগান : আব্দুল্লাহ ইবনু যায়েদ মাযিনী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا بَيْنَ بَيْتِي وَمِنْبَرِي رَوْضَةٌ مِنْ رِيَاضِ الْجَنَّةِ ‘আমার ঘর ও মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানটুকু জান্নাতের বাগানগুলোর একটি বাগান’।[11] অন্য বর্ণায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমার মিম্বার অবস্থিত আমার হাউজ (কাউছার) এর উপরে।[12]

(৩) বায়তুল্লাহর ন্যায় এই মসজিদের উদ্দেশ্যেও ছওয়াবের আশায় ভ্রমণ করা বৈধ।[13]

(৪) এই মসজিদ তথা মদীনায় দাজ্জাল প্রবেশ করতে পারবে না।[14]

(৫) ইসলাম ফিরে যাবে মসজিদে নববীর দিকে।[15]

গ. মসজিদে আক্বছার ফযীলত : 

পৃথিবীর তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ হ’ল মসজিদে আক্বছা। ‘বায়তুল মুক্বাদ্দাস’ বা ‘বায়তুল মাক্বদিস’ ফিলিস্তীনের কুদস অথবা জেরুযালেম বা (পুরাতন নাম) ঈলীয়া শহরে অবস্থিত। মক্কা থেকে কুদস (উট বা ঘোড়ায় চড়ে) চল্লিশ দিনের সফরের দূরত্ব। এই মসজিদেরও কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন-

(১) মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা : ছালাত ফরয হওয়ার পর থেকে প্রথম ১৬/১৭ মাস ‘বায়তুল মুক্বাদ্দাস’ ছিল মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা। বারা ইবনু ‘আযিব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর বাণীوَحَيْثُ مَا كُنْتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ ‘আর তোমরা যেখানে থাক তোমাদের চেহারাকে সেদিকেই (কা‘বার দিকে) ফিরিয়ে দাও’ (বাক্বারাহ ২/১৪৪) নাযিল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমরা ষোল মাস যাবৎ বায়তুল মুক্বাদ্দিসের দিকে মুখ করে নবী করীম (ছাঃ)-এর পিছনে ছালাত আদায় করেছি।[16]

(২) ইসরার শেষ স্থান : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মহান আল্লাহ তা‘আলা মক্কার মাসজিদুল হারাম থেকে ফিলিস্তীনের মসজিদে আক্বছা পর্যন্ত ইসরা বা রাত্রির ভ্রমণ করিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘মহাপবিত্র তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রিবেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আক্বছায়, যার চতুষ্পার্শ্বকে আমরা বরকতময় করেছি, তাকে আমাদের নিদর্শনসমূহ দেখাবার জন্য। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (ইসরা ১৭/১)। এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, এই মসজিদের আশপাশ আল্লাহ বরকতময় করে রেখেছেন। এই অঞ্চল প্রাকৃতিক নদ-নদী, ফল-ফসলের প্রাচুর্য এবং নবীদের বাসস্থান ও কবরস্থান হওয়ার কারণে পৃথক বৈশিষ্ট্যের দাবী রাখে। আর এই কারণে একে বরকতময় বলা হয়েছে।

(৩) মি‘রাজ শুরু হয়েছিল এই মসজিদ থেকে : মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে এই মসজিদ থেকেই মি‘রাজে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং আকাশ থেকে পুনরায় এখানেই নামিয়ে ছিলেন।

(৪) ছওয়াবের আশায় বায়তুল্লাহ ও মসজিদে নববীর ন্যায় এই মসজিদের উদ্দেশ্যেও সফর করা বৈধ।[17]

(৫) পৃথিবীতে স্থাপিত দ্বিতীয় মসজিদ : মক্কায় অবস্থিত বায়তুল্লাহর পর পৃথিবীর দ্বিতীয় মসজিদ হ’ল মসজিদে আক্বছা।[18]

(৬) সকল নবীদের একত্রিত হওয়ার স্থান : নবী-রাসূলগণের মধ্যে ইবরাহীম, ইসহাক, ইয়াকূব, মূসা, দাঊদ, সুলায়মান, ইলিয়াস, যাকারিয়া, ইয়াহ্ইয়া ও ঈসা (আঃ) সহ বনু ইস্রা্ঈলের হাযার হাযার নবী ও রাসূলের আবাসস্থল ছিল বায়তুল মুক্বাদ্দাস-এর আশেপাশের এলাকা। এছাড়াও মি‘রাজের সময় নবীগণকে আল্লাহ তা‘আলা এই মসজিদে একত্রিত করেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ইমামতিতে সকলে ছালাত আদায় করেছিলেন।[19] এ কারণেও এই মসজিদটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

(৭) এই মসজিদে ছালাত আদায় জীবনের সমস্ত গোনাহ মাফের মাধ্যম : আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, সুলায়মান (আঃ) বায়তুল মুক্বাদ্দাস-এর নির্মাণ কাজ শেষ করে আল্লাহর কাছে তিনটি বিষয়ে প্রার্থনা করেছিলেন। তা হ’ল- আল্লাহর হুকুম মত ন্যায়বিচার, এমন রাজত্ব যা তাঁর পরে আর কাউকে দেয়া হবে না এবং যে ব্যক্তি বায়তুল মুক্বাদ্দাসে কেবলমাত্র ছালাত আদায়ের জন্য আসবে, সে তার গুনাহ থেকে এমনভাবে বের হয়ে যাবে, যেন তার মা তাকে সেদিনই প্রসব করেছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, প্রথম দু’টি তাঁকে দান করা হয়েছে এবং আমি আশা করি তৃতীয়টিও তাকে দান করা হয়েছে’।[20]

ঘ. মসজিদে ক্বোবার ফযীলত :

মদীনায় হিজরতের সময় ১৪ নববী বর্ষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় প্রবেশের আগে ক্বোবা নামক স্থানে সোমবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত অবস্থান করেন ও একটি মসজিদ তৈরী করেন। তারপর সেখানে ছালাত আদায় করেন। এটাই ক্বোবা মসজিদ নামে পরিচিত। এটি মসজিদে নববী থেকে ১ ফারসাখ তথা ৩ মাইল বা ৫ কি.মি দূরে অবস্থিত। এটিই ছিল মদীনায় নির্মিত প্রথম মসজিদ। যার প্রথম উদ্যোক্তা ছিলেন ‘আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ)। তিনিই রাসূল (ছাঃ)-কে এদিকে ইঙ্গিত দেন। অতঃপর পাথরসমূহ জমা করেন। তারপর প্রথমে রাসূল (ছাঃ) ক্বিবলার দিকে একটি পাথর রাখেন। অতঃপর আবূবকর (রাঃ) একটি রাখেন। এরপর বাকী কাজ ‘আম্মারের নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়।[21] মসজিদে ক্বোবার অনেক ফযীলত রয়েছে।

(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কর্তৃক নির্মিত প্রথম মসজিদ :  রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হিজরতের পর মদীনায় পৌঁছার পূর্বে ক্বোবা নামক স্থানে সাওয়ারী থেকে অবতরণ করেন ও কিছুদিন অবস্থান করেন এবং সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদটির নাম হচ্ছে ‘মসজিদে ক্বোবা’, যে মসজিদ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,لَمَسْجِدٌ أُسِّسَ عَلَى التَّقْوَى مِنْ أَوَّلِ يَوْمٍ أَحَقُّ أَنْ تَقُومَ فِيهِ، فِيهِ رِجَالٌ يُحِبُّونَ أَنْ يَتَطَهَّرُوا وَاللهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِينَ. ‘অবশ্যই যে মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাক্বওয়ার উপর প্রথম দিন থেকে তা বেশী হক্বদার যে, তুমি সেখানে ছালাত আদায় করতে দাঁড়াবে। সেখানে এমন লোক আছে, যারা উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করতে ভালবাসে। আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন’ (তওবা ৯/১০৮)

(২) ওমরাহর সমান নেকী লাভ : বাড়ী থেকে ওযূ করে মসজিদে ক্বোবায় গিয়ে ছালাত আদায় করলে ওমরার সমান নেকী পাওয়া যায়। সাহল ইবনু হুনাইফ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,من تطهَّر في بيتِه، ثم أتى مسجدَ قُباءٍ، فصلّى فيه صلاةً؛ كان له كأجْرِ عُمرةٍ.  ‘যে ব্যক্তি নিজের বাড়ীতে পবিত্রতা অর্জন করল অর্থাৎ ওযূ করল, অতঃপর  ক্বোবা  মসজিদে এসে ছালাত  আদায়  করল, তার

জন্য একটি ওমরাহর সমান ছওয়াব রয়েছে’।[22]

ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) প্রতি শনিবার ক্বোবা মসজিদে আসতেন, কখনো পদব্রজে, কখনো সাওয়ারীতে। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ)ও ঐরূপ করতেন।[23] অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এসে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন।[24]

ঘ. অন্যান্য মসজিদের গুরুত্ব ও ফযীলত :

উপরোক্ত চারটি মসজিদ ছাড়া পৃথিবীর সকল মসজিদের মর্যাদা সমান। পৃথিবীর অন্যান্য মসজিদগুলোরও বিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্ব রয়েছে। যেমন-

(১) মসজিদ আল্লাহর ঘর : পৃথবীর সকল মসজিদকে আল্লাহ নিজের ঘর বলে উল্লেখ করেছেন। এজন্য মসজিদগুলিকে ‘বায়তুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর ঘর’ বলা হয়। ইবরাহীম (আঃ) তাঁর স্ত্রী হাজেরা ও তাঁর সন্তান ইসমাঈল (আঃ)-কে কা‘বা ঘরের পাশে রেখে এই বলে আল্লাহর কাছে দো‘আ করেছিলেন যে, رَبَّنَا إِنِّي أَسْكَنْتُ مِنْ ذُرِّيَّتِي بِوَادٍ غَيْرِ ذِي زَرْعٍ عِنْدَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِيُقِيمُوا الصَّلَاةَ فَاجْعَلْ أَفْئِدَةً مِنَ النَّاسِ تَهْوِي إِلَيْهِمْ وَارْزُقْهُمْ مِنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَشْكُرُونَ ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার সন্তানদের একাংশকে তোমার এ পবিত্র (কা‘বা) গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় রেখে যাচ্ছি। হে আমাদের পালনকর্তা! যেন তারা ছালাত কায়েম করে। অতএব কিছু মানুষের অন্তরকে তুমি তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে দাও এবং তাদেরকে ফল-ফলাদি দ্বারা রূযী দান কর। যাতে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে’ (ইবরাহীম ১৪/৩৭)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, 

وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِىْ بَيْتٍ مِنْ بُيُوْتِ اللهِ يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إِلاَّ نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلاَئِكَةُ وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ

‘যখনই কোন একদল মানুষ আল্লাহর ঘরসমূহের কোন এক ঘরে (মসজিদে) সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব পাঠ করে এবং নিজেদের মধ্যে আপোসে তা অধ্যয়ন করে, তখন তাদের উপর প্রশান্তি অবতীর্ণ হয়, রহমত তাদেরকে আচ্ছাদিত করে নেয় এবং ফেরেশতাগণ তাদের পরিবেষ্টন করে রাখেন। এমনকি তাদের কথা আল্লাহ তাঁর নিকটবর্তী ফেরেশতাগণের মধ্যে আলোচনা করেন’।[25]

সাঈদ বিন যুবায়ের (রাঃ) বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন,المساجدُ بيوتُ اللهِ في الأرضِ تضيءُ لأهلِ السَّماءِ كما تضيءُ نجومُ السَّماءِ لأهلِ الأرضِ ‘পৃথিবীতে মসজিদসমূহ আল্লাহর ঘর। এগুলো আসমানবাসীর জন্য তেমনি আলোকিত করে যেমনভাবে দুনিয়াবাসীদের জন্য আকাশের তারকাগুলো আলোকিত করে’।[26]

(২) মসজিদের মালিক আল্লাহ : পৃথিবীর সব কিছুর একচ্ছত্র মালিক হচ্ছেন আল্লাহ। এরপরেও বিশেষভাবে মসজিদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,فَلْيَعْبُدُوا رَبَّ هَذَا الْبَيْتِ ‘অতএব তারা যেন ইবাদত করে এই গৃহের মালিকের’ (কুরায়শ ১০৬/৩)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَأَنَّ الْمَسَاجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدْعُوا مَعَ اللهِ أَحَدًا ‘নিশ্চয়ই মসজিদ সমূহ কেবল আল্লাহর জন্য। অতএব তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে আহবান করো না’ (জিন ৭২/১৮)। অন্য আয়াতে তিনি বলেন, وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ مَنَعَ مَسَاجِدَ اللهِ أَنْ يُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ وَسَعَى فِي خَرَابِهَا، ‘তার চাইতে বড় যালেম আর কে আছে যে আল্লাহর মসজিদ সমূহে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে বাধা দেয় এবং সেগুলিকে বিরান করার চেষ্টা চালায়?’ (বাক্বারাহ ২/১১৪)

(৩) মসজিদ পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম জায়গা : পৃথিবীর মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে পসন্দের জায়গা হ’ল মসজিদ। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أحَبُّ البلادِ إلى اللهِ مساجدُها وأبغَضُ البلادِ إلى اللهِ أسواقُها ‘আল্লাহ তা‘আলার কাছে সবচাইতে প্রিয় জায়গা হ’ল মসজিদ সমূহ আর সবচাইতে খারাপ জায়গা হ’ল বাযার সমূহ’।[27]

(৪) মসজিদ এমন জায়গা যেখানে আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয় : মহান আল্লাহ বলেন,

فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللهُ أَنْ تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ يُسَبِّحُ لَهُ فِيهَا بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ، رِجَالٌ لَا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ يَخَافُونَ يَوْمًا تَتَقَلَّبُ فِيهِ الْقُلُوبُ وَالْأَبْصَارُ،

‘(উক্ত জ্যোতি থাকে) মসজিদ সমূহে, যেগুলিকে আল্লাহ মর্যাদামন্ডিত করার এবং সেখানে আল্লাহর নাম স্মরণ করার ও সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর তাসবীহ তেলাওয়াতের আদেশ করেছেন। (মসজিদ আবাদকারী) ঐ লোকগুলি হ’ল তারাই, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য বা ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে এবং ছালাত কায়েম ও যাকাত প্রদান থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে, যেদিন তাদের হৃদয় ও চক্ষু বিপর্যস্ত হবে’ (নূর ২৪/৩৬-৩৭)

(৫) ছালাত আদায়ের স্থান : ঈমানের পর বান্দার উপর ফরয হ’ল ছালাত আদায় করা। ক্বিয়ামতের দিনও সর্বপ্রথম ছালাতের হিসাব নেওয়া হবে। আর এই ছালাত আদায়ের অন্যতম স্থান হ’ল মসজিদ। মসজিদে নিমেণাক্ত ছালাত আদায় করা হয়।

(ক) জুম‘আর ছালাত : সপ্তাহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন হ’ল জুম‘আর দিন। জুম‘আর দিনের প্রধান আমল হ’ল জুম‘আর ছালাত আদায় করা। জুম‘আর ছালাতের অন্যতম স্থান হ’ল মসজিদ। মহান আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ،

‘হে মুমিনগণ! যখন জুম‘আর দিন ছালাতের জন্য আযান দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও এবং ব্যবসা ছেড়ে দাও। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বুঝ’ (জুম‘আ ৬২/৯)

আবু হুরায়রা ও আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لينتَهينَّ أقوامٌ عن ودعِهمُ الجمعاتِ، أو ليختِمَنَّ اللهُ على قلوبِهِم، وليَكونُنَّ مِنَ الغافلينَ ‘লোকেরা যেন জুম‘আ ত্যাগ করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকে; নচেৎ আল্লাহ অবশ্যই তাদের অন্তরে মোহর লাগিয়ে দিবেন। অতঃপর তারা অবশ্যই উদাসীনদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে’।[28]

(খ) ফরয ছালাত আদায়ের স্থান : ফরয ছালাতের উত্তম স্থান হ’ল মসজিদ। আর নফল ছালাতের উত্তম স্থান হ’ল বাড়ী। আবুদ্দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘যে গ্রামে বা অঞ্চলে তিনজন মানুষ বসবাস করবে, সে স্থানে জামা‘আতে ছালাত আদায় করা না হ’লে তাদের ওপর শয়তান জয়ী হয়। অতএব তুমি জামা‘আতকে নিজের জন্যে অপরিহার্য করে নাও। কারণ দলচ্যুত ছাগলকে নেকড়ে বাঘ ধরে খেয়ে ফেলে’।[29]

(গ) আগমনী ছালাতের স্থান : কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, كان النبي صلي الله عليه وسلم إذا قدم من سفر بدأ بالمسجد فصلى فيه. ‘নবী করীম (ছাঃ) সফর হ’তে ফিরে এসে প্রথমে মসজিদে প্রবেশ করে ছালাত আদায় করতেন’।[30]

মসজিদ শুধু ছালাতের স্থান নয়; বরং ছালাতের সাথে সাথে আল্লাহর যিকর ও কুরআন তিলওয়াতেরও স্থান। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে মসজিদে ছিলাম। এমন সময় জনৈক বেদুঈন এসে মসজিদে দাঁড়িয়ে পেশাব করতে লাগল। ছাহাবীগণ তখন বলে উঠলেন, থাম, থাম। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তাকে পেশাব করতে বাধা দিও না। তাকে পেশাব করতে বাধা দিও না, তাকে তার অবস্থায় ছেড়ে দাও। তাই ছাহাবীগণ তাকে ছেড়ে দিলেন। পেশাব শেষ করলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ডেকে বললেন, এই মসজিদ সমূহে পেশাব ও অপবিত্রকরণের কোন কাজ করা জায়েয নয়। বরং এটা শুধু আল্লাহর যিকর, ছালাত ও কুরআন তেলাওয়াতের জন্য। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদে উপস্থিত একজনকে নির্দেশ দিলেন সে এক বালতি পানি এনে (পেশাবের উপর) ঢেলে দিল।[31]

(৬) মসজিদে ছালাত আদায়ে অধিক ছওয়াব : আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, 

صَلاةُ الرَّجُلِ في الجَماعَةِ تُضَعَّفُ على صَلاتِهِ في بَيْتِهِ، وفي سُوقِهِ، خَمْسًا وعِشْرِينَ ضِعْفًا، وذلكَ أنَّهُ: إذا تَوَضَّأَ، فأحْسَنَ الوُضُوءَ، ثُمَّ خَرَجَ إلى المَسْجِدِ، لا يُخْرِجُهُ إلّا الصَّلاةُ، لَمْ يَخْطُ خَطْوَةً، إلّا رُفِعَتْ له بها دَرَجَةٌ، وحُطَّ عنْه بها خَطِيئَةٌ، فَإِذا صَلّى، لَمْ تَزَلِ المَلائِكَةُ تُصَلِّي عليه، ما دامَ في مُصَلّاهُ: اللَّهُمَّ صَلِّ عليه، اللَّهُمَّ ارْحَمْهُ، ولا يَزالُ أحَدُكُمْ في صَلاةٍ ما انْتَظَرَ الصَّلاةَ

‘ঘরে অথবা বাযারে ছালাত আদায় করার চেয়ে মসজিদে জামা‘আতে ছালাত আদায় করার ছওয়াব পuঁচশ গুণ বেশী। কারণ কোন ব্যক্তি যখন ভাল করে ওযূ করে কেবলমাত্র ছালাত আদায় করার জন্যই মসজিদে গমন করে, তার প্রতি ক্বদমের বিনিময়ে একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয় এবং একটি করে গুনাহ মাফ করা হয়। অতঃপর যখন ছালাত আদায় শেষ করে মুছাল্লায় বসে থাকে, ফেরেশতাগণ তখন ঐ ব্যক্তির জন্য অনবরত  এই  দো‘আ  করতে  থাকেন যে, হে আল্লাহ!

তুমি তাকে মাফ করে দাও। হে আল্লাহ! তুমি তার উপর রহমত বর্ষণ কর। আর তোমাদের কেউ ছালাতের জন্য অপেক্ষা করলে, সে সময়টা ছালাতের মধ্যেই গণ্য হবে’।[32]

আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, صَلَاةُ الْجَمَاعَةِ تَفْضُلُ صَلَاةَ الْفَذِّ بِسْبَعٍ وَعِشْرِيْنَ دَرَجَةً ‘একা একা ছালাত আদায় করার চেয়ে জামা‘আতে ছালাত আদায় করা সাতাশ গুণ বেশী ছওয়াব’।[33]

(৭) ই‘তেকাফের স্থান : মসজিদ ব্যতীত অন্যত্র ই‘তেকাফ করা বৈধ নয়। মহান আল্লাহ বলেন,وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ ‘আর তোমরা স্ত্রীগমন কর না যখন তোমরা মসজিদে ই‘তেকাফ অবস্থায় থাক’ (বাক্বারাহ ২/১৮৭)

(৮) মসজিদ আল্লাহভীরুদের ঘর : আবুদ্দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,المسجدُ بيتُ كلِّ تَقِيٍّ  ‘মসজিদ হ’ল প্রত্যেক আল্লাহভীরুদের ঘর’।[34]

[চলবে]

 লেখক  : মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ

সহকারী শিক্ষক, ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল, খিলগাঁও, ঢাকা।


[1]. বুখারী হা/৩৯৮; মুসলিম হা/১৩৩০; নাসাঈ হা/২৯১৭।

[2]. বুখারী হা/৩৯১; নাসাঈ হা/১৫৯৮; মিশকাত হা/১৩।

[3]. ‘আল জামি‘উছ ছাগীর হা/৫৮৫, ছহীহুল জামি‘ হা/৪২১১।

[4]. বুখারী হা/১১৮৯; আবূ দাঊদ হা/২০৩৩।

[5]. মুসলিম হা/১৪৬, (ই.ফা) হা/২৭১।

[6]. বুখারী হা/৩৯৪; মুসলিম হা/২৬৪।

[7]. মুসলিম হা/২৬২; তিরমিযী হা/১৬; মিশকাত হা/৩৭০।

[8]. বুখারী হা/৪৬৫৫; মুসলিম হা/১৩৪৭; আবূ দাঊদ হা/১৯৪৬।

[9]. বুখারী হা/১৮৮১; মুসলিম হা/২৯৪৩।

[10]. বুখারী হা/১১৯০; মুসলিম হা/১৩৯৪; আহমাদ হা/১৬০৫।

[11]. বুখারী হা/১১৯৫; মুসলিম হা/১৩৯০; আহমাদ হা/৮৮৭২।

[12]. বুখারী হা/১১৯৬; মুসলিম হা/১৩৯১; আহমাদ হা/৭২২২।

[13]. বুখারী হা/১১৮৯; আবূ দাঊদ হা/২০৩৩।

[14]. বুখারী হা/১৮৮১; মুসলিম হা/২৯৪৩।

[15]. মুসলিম (হা.একা.) হা/২৪৮ (ই.ফা) হা/২৭১।

[16]. মুসলিম হা/৫২৭, ‘মসজিদ ও ছালাতের স্থান’ অধ্যায় ।

[17]. বুখারী হা/১১৮৯; আবূদাউদ হা/২০৩৩।

[18]. বুখারী হা/৩৩৬৬; মুসলিম হা/৫২০; নাসাঈ হা/৬৯০; মিশকাত হা/৭৫৩।

[19]. মুসলিম হা/১৭২; মিশকাত হা/৫৮৬৬।

[20]. ইবনু মাজাহ হা/১৪০৮; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৭৭৮।

[21]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), (তৃতীয় সংস্করণ ২০১৬), ২৩৮-২৩৯ পৃঃ।

[22]. ইবনু মাজাহ হা/১৪১২; নাসাঈ হা/৬৯৯; আলবানী : ছহীহ আত-তারগীব হা/১১৮১।

[23]. বুখারী হা/১১৯৩।

[24]. বুখারী হা/১১৯৪।

[25]. মুসলিম হা/৭০২৮; ইবনু মাজাহ হা/১৮৫; তিরমিযী হা/২৯৪৫; ছহীহুল জামি‘ হা/৬৫৭৭।

[26]. হায়ছামী, মাজমাউয যাওয়ায়েদ ২/১০।

[27]. মুসলিম হা/৬৭১, ই.ফা. হা/১৪০০; মিশকাত হা/৬৯৬; ছহীহুল জামি‘ হা/১৬৭।

[28]. মুসলিম হা/৮৬৫; নাসাঈ হা/১৩৭০; ইবনে মাজাহ হা/১১২৭।

[29]. আবূ দাঊদ হা/৫৪৭; আহমাদ হা/২৭৫১৪; মিশকাত হা/১০৬৭।

[30]. বুখারী হা/৪৪১৮, ‘ছালাত’ অধ্যায় ‘সফর হ’তে ফিরে আসার পর ছালাত আদায়’ অনুচ্ছেদ; মুসলিম হা/২৭৬৯।

[31]. বুখারী হা/১২২১; মুসলিম হা/২৮৫; মিশকাত হা/৪৯২।

[32]. মুসলিম হা/৬৪৭; মিশকাত হা/৭০২।

[33]. বুখারী হা/৬৪৫; মুসলিম হা/৬৫০; মিশকাত হা/১০৫২।

[34]. তাবারাণী, আল-কাবীর; ছহীহাহ হা/৭১৬; ছহীহ আত-তারগীব হা/৩৩০।






বিষয়সমূহ: মসজিদ
মুনাফিকী - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার কতিপয় ক্ষেত্র - ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
ঈদায়নের কতিপয় মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
ইবাদতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ক্বিয়ামতের আলামত সমূহ (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
কাদেসিয়া যুদ্ধ - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
সকল সৃষ্টির ইবাদত ও আনুগত্য - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
চিন্তার ইবাদত (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
দাওয়াতের ক্ষেত্র ও আধুনিক মাধ্যম সমূহ - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
আশূরায়ে মুহাররম - আত-তাহরীক ডেস্ক
ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের বিধান - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
হেদায়াত - যহূর বিন ওছমান, দিনাজপুর
আরও
আরও
.