ছওম বা ছিয়াম : অর্থ বিরত থাকা। শরী‘আতের পরিভাষায় আল­লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ছুবহে ছাদিক হ’তে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌন সম্ভোগ হ’তে বিরত থাকাকে ‘ছওম’ বা ‘ছিয়াম’ বলা হয়। ২য় হিজরী সনে ছিয়াম ফরয হয়।

ছিয়ামের ফাযায়েল : রাসূলুল­লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় রামাযানের ছিয়াম পালন করে, তার বিগত সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়’।[1]

রাসূল (ছাঃ) আরও বলেন, ‘আদম সন্তানের প্রত্যেক নেক আমলের ছওয়াব দশগুণ হ’তে সাতশত গুণ পর্যন্ত প্রদান করা হয়। আল্লাহ বলেন, কিন্তু ছওম ব্যতীত। কেননা ছওম কেবল আমার জন্যই (রাখা হয়) এবং আমিই তার পুরস্কার প্রদান করব। সে তার যৌনাকাঙ্খা ও পানাহার কেবল আমার জন্যই পরিত্যাগ করে। ... ছিয়াম (অন্যায় অপকর্মের বিরুদ্ধে) ঢাল স্বরূপ। অতএব যখন তোমরা ছিয়াম পালন করবে, তখন মন্দ কথা বলবে না ও বাজে বকবে না। যদি কেউ গালি দেয় বা লড়াই করতে আসে তখন বলবে, আমি ছায়েম’।[2]

মাসায়েল : ১. ছিয়ামের নিয়ত : নিয়ত অর্থ- মনন করা বা সংকল্প করা। অতএব মনে মনে ছিয়ামের সংকল্প করাই যথেষ্ট। হজ্জের তালবিয়া ব্যতীত ছালাত, ছিয়াম বা অন্য কোন ইবাদতের শুরুতে আরবী বা অন্য ভাষায় নিয়ত পড়া বিদ‘আত।

২. ইফতার ও সাহারী : রাসূলুল­লাহ (ছাঃ) বলেন, দ্বীন চিরদিন বিজয়ী থাকবে, যতদিন লোকেরা ইফতার দ্রুত করবে। কেননা ইহূদী-নাছারাগণ ইফতার দেরীতে করে’।[3] তিনি বলেন, তোমরা ইফতার দ্রুত কর এবং সাহারী দেরীতে কর।[4]

৩. ইফতারের দো‘আ : ‘বিসমিল­লাহ’ বলে শুরু ও ‘আলহামদুলিল­লাহ’ বলে শেষ করবে।[5] ইফতারের দো‘আ হিসাবে প্রসিদ্ধ আল­লহুম্মা লাকা ছুমতু... হাদীছটি ‘যঈফ’। ইফতার শেষে নিম্নোক্ত দো‘আ পড়া যাবে- ‘যাহাবায যামাউ ওয়াবতাল­লাতিল উরূকু ওয়া ছাবাতাল আজরু ইনশাআল­লাহ’ (পিপাসা দূরীভূত হ’ল ও শিরাগুলি সঞ্জীবিত হ’ল এবং আল­লাহ চাহেন তো পুরস্কার ওয়াজিব হ’ল)।[6]

৪. সাহারীর আযান : রাসূল (ছাঃ)-এর যামানায় তাহাজ্জুদ ও সাহারীর আযান বেলাল (রাঃ) দিতেন এবং ফজরের আযান অন্ধ ছাহাবী ইবনু উম্মে মাকতূম (রাঃ) দিতেন।[7] বুখারীর ভাষ্যকার ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘বর্তমান কালে সাহারীর সময় লোক জাগানোর নামে আযান ব্যতীত যা কিছু করা হয় সবই বিদ‘আত’।[8]

৫. তারাবীহ্র ছালাতের ফযীলত : রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রামাযানের রাত্রিতে ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রাত্রির ছালাত আদায় করে, তার বিগত সকল গোনাহ মাফ করা হয়’।[9]

৬. তারাবীহ্র রাক‘আত সংখ্যা : (ক) হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন,

‘রাসূলুল­লাহ (ছাঃ) রামাযান বা রামাযানের বাইরে (তিন রাক‘আত বিতরসহ) এগার রাক‘আতের বেশী রাতের নফল ছালাত আদায় করতেন না’।[10]

(খ) হযরত সায়েব বিন ইয়াযীদ (রাঃ) বলেন, ‘ওমর ফারূক (রাঃ) উবাই ইবনু কা‘ব ও তামীম আদ-দারী (রাঃ)-কে রামাযানের রাত্রিতে লোকদেরকে সাথে নিয়ে জামা‘আত সহকারে এগারো রাক‘আত ছালাত আদায়ের নির্দেশ দান করেন’।[11] এ সময় তাঁরা প্রথম রাত্রিতে ইবাদত করতেন।[12] আলবানী (রহঃ) বলেন, মুওয়াত্ত্বায় (হা/৩৮০) ইয়াযীদ বিন রূমান কর্তৃক যে বর্ণনাটি এসেছে যে, ‘লোকেরা ওমর ফারূক (রাঃ)-এর যামানায় ২৩ রাক‘আত তারাবীহ পড়ত’ একথাটি ‘যঈফ’। কেননা ইয়াযীদ বিন রূমান ওমর (রাঃ)-এর যামানা পাননি।[13] অতএব ইজমায়ে ছাহাবা কর্তৃক ওমর, ওছমান ও আলী (রাঃ)-এর যামানা থেকে ২০ রাক‘আত তারাবীহ সাব্যস্ত বলে যে কথা চালু রয়েছে, তার কোন শারঈ ভিত্তি নেই। একথাটি ‘মুদরাজ’ বা পরবর্তীকালে অনুপ্রবিষ্ট। এতদ্ব্যতীত চার খলীফার কারো থেকেই ছহীহ সনদে ২০ রাক‘আত তারাবীহ প্রমাণিত নয়।[14] বিশ রাক‘আত তারাবীহ-এর প্রমাণে বর্ণিত হাদীছটি জাল।[15]

(গ) জামা‘আতের সাথে রাতের ছালাত (তারাবীহ) আদায় করা রাসূলুল­লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত এবং দৈনিক নিয়মিত জামা‘আতে আদায় করা ‘ইজমায়ে ছাহাবা’ হিসাবে প্রমাণিত (মিশকাত হা/১৩০২)। অতএব তা বিদ‘আত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

৭. ছিয়াম ভঙ্গের কারণ সমূহ : (ক) ছিয়াম অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে খানাপিনা করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় এবং তার কাযা ওয়াজিব হয়। (খ) যৌনসম্ভোগ করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় এবং তার কাফফারা স্বরূপ একটানা দু’মাস ছিয়াম পালন অথবা ৬০ (ষাট) জন মিসকীন খাওয়াতে হয় (নিসা ৯২; মুজাদালাহ ৪)। (গ) ছিয়াম অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে ক্বাযা আদায় করতে হবে। তবে অনিচ্ছাকৃত বমি হ’লে, ভুলক্রমে কিছু খেলে বা পান করলে, স্বপ্নদোষ বা সহবাসজনিত নাপাকী অবস্থায় সকাল হয়ে গেলে, চোখে সুর্মা লাগালে বা মিসওয়াক করলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় না।[16]

৮. ছিয়ামের অন্যান্য বিধান : (ক) অতি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা অসুস্থ তথা যারা ছিয়াম পালনে অক্ষম, তারা ছিয়ামের ফিদইয়া হিসাবে দৈনিক একজন করে মিসকীন খাওয়াবেন (বাক্বারাহ ২/১৮৪)। ছাহাবী আনাস (রাঃ) গোশত-রুটি বানিয়ে একদিনে ৩০ (ত্রিশ) জন মিসকীন খাইয়েছিলেন।[17] ইবনু আববাস (রাঃ) গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিণী মহিলাদেরকে ছিয়ামের ফিদইয়া আদায় করতে বলতেন।[18] (খ) মৃত ব্যক্তির ছিয়ামের ক্বাযা তার উত্তরাধিকারীগণ আদায় করবেন অথবা তার বিনিময়ে ফিদইয়া দিবেন।[19] ফিদইয়ার পরিমাণ দৈনিক এক মুদ বা সিকি ছা‘ চাউল অথবা গম।[20] তবে বেশী দিলে বেশী নেকী পাবেন (বাক্বারাহ ২/১৮৪)


[1]. বুখারী হা/৩৮; মুসলিম হা/৭৬০; মিশকাত হা/১৯৫৮

[2]. বুখারী হা/১৯০৪; মুসলিম হা/১১৫১; মিশকাত হা/১৯৫৯

[3]. আবুদাউদ হা/২৩৫৩; মিশকাত হা/১৯৯৫

[4]. ত্বাবারাণী, ছহীহুল জামে‘ হা/৩৯৮৯

[5]. বুখারী, মিশকাত হা/৪১৯৯; মুসলিম, ঐ, হা/৪২০০

[6]. আবুদাঊদ হা/২৩৫৭-২৩৫৮; মিশকাত হা/১৯৯৩-৯৪

[7]. বুখারী হা/১৯১৯; মুসলিম হা/১০৯২; নায়লুল আওত্বার ২/১২০ পৃঃ

[8]. ফাৎহুল বারী হা/৬২২-২৩-এর ব্যাখ্যা, ২/১২৩-২৪; নায়লুল আওত্বার ২/১১৯

[9]. মুসলিম হা/৭৫৯; মিশকাত হা/১২৯৬

[10]. বুখারী হা/১১৪৭; মুসলিম হা/৭৩৮; মিশকাত হা/১১৮৮

[11]. মুওয়াত্ত্বা মালেক হা/৩৭৯, সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/১৩০২, ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘রামাযানে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ

[12]. বুখারী, মিশকাত হা/১৩০১

[13]. দ্রঃ আলবানী, মিশকাত হা/১৩০২ টীকা-২

[14]. হাশিয়া মুওয়াত্ত্বা পৃঃ ৭১-এর হাশিয়া-৭, ‘রামাযানে ছালাত’ অধ্যায়; দ্রঃ তুহফাতুল আহওয়াযী শরহ তিরমিয়ী হা/৮০৩-এর ব্যাখ্যা ৩/৫২৬-৩২

[15]. আলবানী, ইরওয়াউল গালীল হা/৪৪৫, ২/১৯১ পৃঃ

[16]. শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ৫/২৭১-৭৫, ২৮৩; ১/১৬২ পৃঃ

[17]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ১৮৪ আয়াত

[18]. বুখারী হা/৪৫০৫; ইরওয়া হা/৯১২; নায়ল ৫/৩১১ পৃঃ

[19]. নায়লুল আওতার ৫/৩১৫-১৭ পৃঃ

[20]. বায়হাক্বী হা/৮০০৫-০৬, ৪/২৫৪ পৃঃ






তাক্বলীদের বিরুদ্ধে ৮১টি দলীল - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
মুহাররম ও আশূরা : করণীয় ও বর্জনীয় - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
১৬ মাসের মর্মান্তিক কারা স্মৃতি (৭ম কিস্তি) - মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম
দ্বীনে হক্ব প্রচারে ‘আত-তাহরীক’-এর ভূমিকা - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ভালবাসা (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ইহসান ইলাহী যহীর
কুরআন মাজীদের অনুবাদ ও তাফসীরে ভারতীয় উপমহাদেশের আহলেহাদীছ আলেমগণের অগ্রণী ভূমিকা - ড. নূরুল ইসলাম
বক্তার আধিক্য ও আলেমের স্বল্পতা - আছিফ রেযা, ছাত্র, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।
খতমে নবুঅত আন্দোলন ও আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরাম - ড. নূরুল ইসলাম
কাদেসিয়া যুদ্ধ - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আহলেহাদীছ জামা‘আতের বিরুদ্ধে কতিপয় মিথ্যা অপবাদ পর্যালোচনা (৭ম কিস্তি) - তানযীলুর রহমান - শিক্ষক, বাউটিয়া দাখিল মাদ্রাসা, রাজশাহী
ঈদে মীলাদুন্নবী - আত-তাহরীক ডেস্ক
শরী‘আতের আলোকে জামা‘আতবদ্ধ প্রচেষ্টা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আরও
আরও
.