
ভূমিকা :
কুরআন আল্লাহর নাযিলকৃত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব। শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর অবতীর্ণ এই কিতাবে মওজূদ আছে মানবতার হেদায়াত ও পথনির্দেশ। কুরআন পাঠ করা শ্রেষ্ঠ নফল ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। তবে শুধু পাঠের জন্য কুরআন অবতীর্ণ হয়নি; বরং পাঠের মাধ্যমে অনুধাবন করে এর বিধান সার্বিক জীবনে বাস্তবায়ন করার জন্য কুরআন নাযিল হয়েছে। আর সালাফে ছালেহীন ছিলেন কুরআনের বিধান বাস্তবায়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পবিত্র কুরআনের সাথে তাদের দৈনন্দিন সম্পর্ক কেমন ছিল, কিভাবে তারা কুরআন তেলাওয়াত করতেন, চর্চা করতেন, বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা সেটা তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। উল্লেখ্য যে, ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে এযাম এবং তাবে তাবেঈনের তিন যুগের বরণীয় ও অনুসরণীয় সোনালী ব্যক্তিগণ সালাফে ছালেহীন নামে পরিচিত এবং তাদের পরবর্তী যুগে যারা ছাহাবায়ে কেরামের আদর্শের পুর্ণাঙ্গ অনুসারী ছিল তারা সালাফ নামে অভিহিত।
সালাফদের কুরআন চর্চা :
সালাফে ছালেহীনের কুরআন চর্চার বিভিন্ন ধরণ রয়েছে। তাদের জীবনী থেকে কতিপয় নমুনা পেশ করে সেগুলোকে পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হ’ল-
১. শৈশবে কুরআন চর্চা :
সালাফে ছালেহীনের শিক্ষাজীবন শুরু হ’ত কুরআন শেখার মাধ্যমে। তারা শৈশবে সর্বপ্রথম কুরআনের শিক্ষা গ্রহণ করতেন। তাদের স্বর্ণালী যুগে শৈশবের কুরআন শিক্ষা এতটাই প্রসিদ্ধ ছিল যে, তারা হাদীছ ও ফিক্বহের জ্ঞান অর্জনের আগে কুরআন হিফয করতেন। আর যারা কুরআন হিফয করত না, তাদের তারা হাদীছ ও ফিক্বহ শিখাতেন না। ইমাম শাফেঈ, সাহল তুসতারী সহ প্রমুখ সালাফ ছয়-সাত বছর বয়সে কুরআন হিফয করেছেন। ইমাম মহিউদ্দীন (৬৩১-৬৭৬ হি.) বলেন,وكان السلف لا يعلمون الحديث والفقه إلا لمن حفظ القرآن ‘সালাফগণ কেবলমাত্র তাকেই হাদীছ ও ফিক্বহ শিক্ষা দিতেন, যার কুরআন মুখস্থ আছে’।[1] সেজন্য ইমাম নববী (রহঃ) শৈশবকাল থেকে কুরআনের ভালবাসা বুকে ধারণ করেছিলেন। তার বয়স যখন দশ বছর, তখন তিনি এতো বেশী তেলাওয়াত করতেন যে, অন্য বালকেরা তার সাথে খেলতে চাইত না। তিনিও তাদের থেকে পালিয়ে বেড়াতেন এবং নিভৃতে কুরআন পাঠে নিমগ্ন থাকতেন। মহল্লায় তার বাবার দোকান ছিল। তিনি নববীকে দোকানে বসিয়ে রাখতেন; কিন্তু বেচা-কেনায় মনোযোগ দিতে নিষেধ করতেন। ফলে তিনি দোকানে বসেও কুরআন তেলাওয়াত করতেন। এ অবস্থা দেখে জনৈক আলেম নববীর পিতাকে বলেন, আশা করা যায় আপনার ছেলে যুগের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী-তপস্বী হবে। তিনি বলনে, আপনি কী জ্যোতির্বিদ? আলেম বললেন, না, আমি জ্যোতির্বিদ নই; তবে আল্লাহ আমাকে দিয়ে কথাটি বলিয়ে নিয়েছেন।[2] সেই আলেমের দূরদর্শিতা পরবর্তীতে সত্যে পরিণত হয়েছিল। ক্ষণজন্মা এই মহান ইমাম যুগের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। ইলমী ময়দানে তার অবদান অবিস্মরণীয়। যুগ যুগ ধরে সারা বিশে^র জ্ঞানপিয়াসী মানুষ তার লিখিত কিতাব-পত্রের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও হবেন ইনশাআল্লাহ।
ইমাম সুলাইম ইবন আইয়ূব আর-রাযী (৪৪৭ হি.) বলেন, আমার বাল্যকাল কেটেছিল ‘রাই’ নগরীতে। দশ বছর বয়সে আমি কুরআন শেখার জন্য এক শায়েখের কাছে গেলাম। তিনি আমাকে দেখে বললেন, ‘এসো, পড়ো’। আমি অনেক চেষ্টা করেও সূরা ফাতেহা পড়তে পারলাম না। জিহবায় জড়তা থাকায় আটকে গেল। তিনি বললেন, ‘তোমার মা আছে?’ বললাম, ‘হ্যাঁ’ তিনি বললেন, ‘তাকে বলবে তোমার জন্য দো‘আ করতে, যাতে তুমি কুরআন পড়তে পার, আর ইলম অর্জন করতে পার’। আমি বাসায় ফিরে মায়ের কাছে দো‘আ চাইলাম। মা দো‘আ করে দিলেন। বড় হওয়ার পর আমি বাগদাদে গেলাম। সেখানে আরবী ও ফিক্বহ শিখলাম। তারপর ‘রাই’ নগরীতে আবার ফিরে এলাম। কোন একদিন আমি জামে মসজিদে ‘মুখতাসারুল মুযানী’ পড়াচ্ছিলাম। এমন সময় সেই শায়খ এসে হাযির। আমাদেরকে সালাম দিলেন তিনি। তবে আমাকে চিনতে পারলেন না। আমার পড়া শুনলেন তিনি ঠিকই, কিন্তু বুঝলেন না কি বলছি। তিনি বলে ফেললেন, ‘এই রকম শেখা যায় কিভাবে?’ তখন আমার বলতে ইচ্ছা হ’ল, ‘আপনার যদি মা থাকে, তাহ’লে তাকে দো‘আ করতে বলবেন। তবে লজ্জায় আমি আর কিছু বলিনি’।[3]
প্রাচ্যের হাফেয খত্বীব বাগদাদী (রহঃ) বলেন, ‘কুরআন মুখস্থ করার মাধ্যমে তালিবুল ইলমের শিক্ষাজীবন শুরু করা উচিৎ। কেননা এটা মহিমান্বিত জ্ঞান এবং অগ্রগণ্যতা ও অগ্রবর্তিতার ক্ষেত্রে অধিকতর উপযোগী। তারপর আল্লাহ যদি তাকে কুরআন হিফয করার তাওফীক্ব দান করেন, তাহ’লে তার উচিত হবে না সাথে সাথেই হাদীছ অথবা এমন কোন জ্ঞান আহরণে মশগূল হয়ে পড়া, যা তাকে কুরআন ভুলে যাওয়ার দিকে ঠেলে দিবে। সুতরাং প্রাথমিক পর্যায়ে তার কর্তব্য হ’ল অন্যান্য পাঠের চেয়ে বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছ অধ্যয়ন করা। কেননা শরী‘আতের মূল উৎস কুরআন ও হাদীছ।[4] পশ্চিমের হাফেয ইমাম ইবনু আব্দিল বার্র (৩৬৮-৪৬৩হি.) বলেন, فَأَوَّلُ الْعِلْمِ حِفْظُ كِتَابِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ وَتَفَهُّمُهُ وَكُلُّ مَا يُعِينُ عَلَى فَهْمِهِ فَوَاجِبٌ طَلَبُهُ مَعَهُ ‘শিক্ষার প্রথম পাঠ হ’ল কুরআন মুখস্থ করা এবং তা অনুধাবন করা। পাশাপাশি কুরআন অনুধাবনের জন্য সহায়ক জ্ঞান অর্জন করাও আবশ্যক’।[5]
২. মুছহাফ দেখে কুরআন তেলাওয়াত করা :
মুছহাফ দেখে নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত ছিল সালাফদের চিরায়ত অভ্যাস। কারণ মুখস্থ তেলাওয়াতের মাধ্যমে কুরআন যতটা অনুধাবন করা যায়, মুছহাফ দেখে তেলাওয়াত করলে তার চেয়ে বেশী হৃদয়ঙ্গম করা যায়। এজন্য সালাফদের মতে মুছহাফ দেখে কুরআন তেলাওয়াত করার মাধ্যমে চার রকমের উপকার হাছিল হয় : (১) চোখের মাধ্যমে দেখার ছওয়াব, (২) কানের মাধ্যমে শোনার ছওয়াব, (৩) জিহবার মাধ্যমে উচ্চারণের ছওয়াব এবং অন্তরের মাধ্যমে তাদাববুরের ছওয়াব।
জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ছাহাবী ইসলামের তৃতীয় খলীফা ওছমান (রাঃ) বলেন,لَوْ أَنَّ قُلُوبَنَا طَهُرَتْ مَا شَبِعَتْ مِنْ كَلَامِ رَبِّنَا، وَإِنِّي لَأَكْرَهُ أَنْ يَأْتِيَ عَلَيَّ يَوْمٌ لَا أَنْظُرُ فِي الْمُصْحَفِ، ‘আমাদের হৃদয় যদি (পাপাচার) থেকে পবিত্র থাকত, তবে আমাদের রবের কালামে এরা কখনো পরিতৃপ্ত হ’ত না। আমি এটা খুবই অপসন্দ করি যে, আমার একটা দিন অতিবাহিত হয়ে যাবে অথচ আমি মুছহাফে একবার নযর বুলিয়ে দেখব না’।[6] আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন,إِنِّي لَأَسْتَحْيِي أَلَّا أَنْظُرَ كُلَّ يَوْمٍ فِي عَهْدِ رَبِّي مَرَّةً ‘প্রতিদিন একবার হ’লেও আমার রবের প্রতিশ্রুতি (কুরআনের) দিকে একবার নযর না বুলানোকে আমি খুই লজ্জাবোধ করি’।[7]
আব্দুল্লাহ ইবনে শাওযাব (৮৬-১৫৬হি.) বলেন, ‘উরওয়া ইবনে যুবায়ের (রহঃ) প্রতি দিন মুছহাফ দেখে দেখে কুরআনের এক চতুর্থাংশ তেলাওয়াত করতেন। অতঃপর রাতের ছালাতেও তেলাওয়াত করতেন। তবে যে রাতে তার পা কাটা হয়েছিল সে রাতে এ আমলটা করতে পারেননি। তাই পরের রাতে ছুটে যাওয়া অংশ তেলাওয়াত করে নেন। উল্লেখ্য যে, পায়ে ক্যান্সার হয়েছিল বিধায় তাঁর পা কেটে ফেলা হয়েছিল’।[8] সুফইয়ান ছাওরী (৯৭-১৬১ হি.) বলেন, আমর ইবনে ক্বায়েস (মৃ. ১৪৬হি.) এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যার কাছে আমি শিখেছি কুরআন তেলাওয়াত, ফারায়েয এবং শিষ্টাচার। আমি তাকে বাযারে খোঁজ করতাম। যদি সেখানে না পেতাম, তবে তার বাড়িতে পেয়ে যেতাম, তখন তিনি হয় ছালাত রত অবস্থায় থাকতেন অথবা মুছহাফ হাতে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। তিনি এমনভাবে তেলাওয়াতে মশগূল থাকতেন যেন কোনকিছু হারানোর আশংকা করছেন। আর তাকে বাড়িতে না পাওয়া গেলে ঠিকই মসজিদে অথবা গোরস্থানে পাওয়া যেত এমন অবস্থায় যে, তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।[9]
আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহঃ)-এর ছাত্র কর্ডোভার ইমাম বাক্বী ইবনে মাখলাদ (২০১-২৭৬হি.) প্রতিদিনের নেক আমলের জন্য আলাদা সময় বরাদ্দ রাখতেন। তিনি প্রতিদিন ফজর ছালাতের পর মুছহাফ দেখে কুরআনের এক ষষ্ঠাংশ বা পাঁচ পারা করে তেলাওয়াত করতেন।[10]
৩. নিয়মিত কুরআন খতম করা :
কুরআন খতম করার অর্থ হ’ল পুরো কুরআন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তেলাওয়াত করে শেষ করা। সালাফদের কুরআন খতমের ধরণ বিভিন্ন রকমের ছিল। কেউ প্রতি তিন দিনে, কেউ পাঁচ/ছয়/সাত দিনে, আবার কেউ কেউ প্রতি মাসে একবার করে কুরআন খতম করতেন। আবার কেউ অনুধাবন করে অল্প অল্প করে তেলাওয়াত করতেন। এর কারণ ছিল এই যে, তারা কুরআন পড়ে শেষ করার চেয়ে আয়াতের মর্ম উপলব্ধি ও তদানুযায়ী আমল করাকে অগ্রাধিকার দিতেন। কুরআনের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল খুবই গভীর। তেলাওয়াত ছাড়া তাদের কোন দিন অতিবাহিত হ’ত না।
একবার আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আছ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি কত দিনে কুরআন খতম করব? তিনি বললেন, এক মাসে। ছাহাবী বললেন, إِنِّي أَقْوَى مِنْ ذَلِكَ ‘আমি এর চেয়ে অধিক শক্তি রাখি। তখন তিনি (ছাঃ) বললেন, সাত দিনে খতম করবে। তিনি বললেন, আমি এর চেয়েও বেশী শক্তি রাখি। তিনি বললেন, لَا يَفْقَهُ مَنْ قَرَأَهُ فِي أَقَلَّ مِنْ ثَلَاثٍ ‘যে ব্যক্তি তিন দিনের কমে কুরআন খতম করে, সে কুরআনকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না’।[11]
তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম করা যাবে কি-না এ ব্যাপারে ইমামদের মাঝে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য মত হ’ল- যেমন ইবনু রজব হাম্বলী (রহঃ) বলেন, ‘সাধারণভাবে তিন দিনের কম সময়ে নিয়মিত কুরআন খতম করা উচিত নয়। তবে রামাযান মাসের মতো ফযীলতপূর্ণ সময়ে তিন দিনের কম সময়ে কুরআন পড়ে শেষ করাতে কোন দোষ নেই। যেমন- এ মাসে বেশী বেশী তেলাওয়াত করা, বিশেষভাবে লায়লাতুল ক্বদর অন্বেষণে রাতের বেলা তেলাওয়াত ইত্যাদি। অনুরূপভাবে মক্কার মত বরকতপূর্ণ স্থানে তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম করা মাকরূহ নয়; বরং বরকতপূর্ণ সময়ে ও স্থানে বেশী বেশী তেলাওয়াত করা মুস্তাহাব। আর এটাই জমহূর ওলামায়ে কেরামের মত। আর এ ব্যাপারে সালাফদের আমল রয়েছে।[12]
হুসাইন আল-‘আনক্বাযী (রহঃ) বলেন, ইবনে ইদরীস যখন জীবন-সায়াহ্নে, তখন তার মেয়ে কান্না করতে লাগল। তিনি বললেন, لَا تَبْكِي يَا بُنَيَّة، فَقَدْ خَتَمْتُ القُرْآنَ فِي هَذَا البَيْتِ أَرْبَعَةَ آلَافِ ختمة ‘বেটি আমার! কান্না করো না। আমি এই ঘরে চার হাযার বার কুরআন খতম করেছি’।[13] এটা অসম্ভব নয়। কেননা কেউ যদি প্রতি তিন দিনে একবার করে কুরআন খতম করে, তবে তিনি মাসে দশ বার এবং বছর ১২০ বার কুরআন খতম করতে পারবেন। তাছাড়া তারা রামাযান মাসে তো আরো বেশী তেলাওয়াত করতেন। সুতরাং ৩০-৩৫ বছর যাবত এভাবে তেলাওয়াত করতে থাকলে চার হাযার বার কুরআন খতম করা সম্ভব।
আহমাদ ইবনে আব্দুল্লাহ বলেন, মা‘রূফ ইবনে ওয়াছেল আত-তামীমী সফরে কিংবা বাড়িতে যেখানেই থাকতেন প্রতি তিন দিনে একবার কুরআন খতম করতেন।[14]
অনেক সালাফ মসজিদে বেশী বেশী তেলাওয়াত করতেন। কেননা মসজিদে পারিবারিক ঝামেলা থাকে না। বিশিষ্ট তাবেঈ ছাবিত বিন আসলাম আল-বুনানী (মৃ.১২৭হি.) তার মহল্লার মসজিদের ব্যাপারে বলেন,ما تركت في المسجد الجامع سارية إلا وقد ختمت القرآن عندها وبكيت عندها ‘এই জামে মসজিদের এমন কোন খুঁটি আমি ছাড়িনি, যার কাছে আমি কুরআন খতম করিনি এবং কাঁন্নাকাটি করিনি’।[15]
মুজাহিদ (রহ.) বলেন, الرَّحْمَةُ تَنْزِلُ عِنْدَ خَتْمِ الْقُرْآنِ ‘কুরআন খতম করার সময় রহমত নাযিল হয়’।[16] এজন্য সালাফদের অনেকেই কুরআন খতম করার পর আল্লাহর কাছে দো‘আ করতেন। যেমন ইবনুল জাওযী বলেন, আমি বিবাহের পরে কুরআন খতম করে আল্লাহর কাছে দশ জন সন্তান চেয়েছিলাম, আল্লাহ আমাকে সেটাই দান করেছেন।
৪. অনুধাবন করে অর্থ বুঝে তেলাওয়াত :
অর্থ না বুঝে তেলাওয়াতের মাধ্যমে নেকী লাভ করা যায়, কিন্তু কুরআন শুধু এজন্য নাযিল হয়নি; বরং নাযিল হয়েছে তা অনুধাবন করার জন্য এবং তদনুযায়ী আমল করার জন্য। আমর ইবনে মুররাহ (রাঃ) বলেন, একদা নবী করীম (ছাঃ) আমাকে বললেন, আমার কাছে কুরআন পাঠ কর। আমি বললাম, আমি আপনার কাছে পাঠ করব? অথচ আপনার উপরেই তো এই কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি বললেন, আমি অন্যের মুখ থেকে কুরআন তেলাওয়াত শুনতে পসন্দ করি। এরপর আমি তাঁর নিকট সূরা ‘নিসা’ পাঠ করলাম, যখন আমি এই পর্যন্ত পাঠ করলাম,فَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا مِنْ كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهِيدٍ وَجِئْنَا بِكَ عَلَى هَؤُلَاءِ شَهِيدًا، ‘অতএব সেদিন কেমন হবে, যেদিন আমরা প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী (নবী) আনব এবং তোমাকে তাদের সকলের উপর সাক্ষী করব?’ (নিসা ৪/৪১)। তিনি বললেন, থাম! থাম! তখন তাঁর দু’চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু ঝরছিল।[17] আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকেও অনুরূপ বর্ণনা এসেছে।[18]
একবার আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি তো বৃদ্ধ হয়ে গেলেন। রাসূল (ছাঃ) জবাবে বলেন, সূরা হূদ, ওয়াকি‘আহ, সূরা মুরসালাত, সূরা নাবা ও সূরা তাকবীর আমাকে বৃদ্ধ করে দিয়েছে’।[19] আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, اقْرَأْ مَا تَسْمَعُهُ أُذُنَاكَ وَيَفْقَهُهُ قَلْبُكَ ‘তুমি এমনভাবে কুরআন তেলাওয়াত কর, যেন তোমার দু’কান সেটা শুনতে পায় এবং তোমার হৃদয় তা উপলব্ধি করতে পারে’।[20]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ কুরআনের মাধ্যমে প্রভাবিত হ’তেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উরওয়া ইবনে যুবায়ের (রহঃ) বলেন, আমি আমার দাদী আসমা বিনতে আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম যে, কুরআন শ্রবণ করার সময় আল্লাহর রাসূলের ছাহাবীদের কি অবস্থা হ’ত? জবাবে তিনি বলেন, تدمع أعينهم، وتقشعر جلودهم كما نعتهم الله ‘তাদের চোখ থেকে অশ্রু ঝরতো এবং শরীর কেঁপে উঠত, যেমনটা আল্লাহ তাদের প্রশংসা করেছেন’।[21] মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পূর্ব মুহূর্তে আবুবকর (রাঃ) নিজ বাড়ির পাশে মসজিদ নির্মাণ করে সেখানে ছালাত আদায় করতেন এবং কুরআন তেলাওয়াত করতেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন,كَانَ أَبُو بَكْرٍ رَجُلاً بَكَّاءً، لاَ يَمْلِكُ عَيْنَيْهِ إِذَا قَرَأَ الْقُرْآنَ، ‘আবুবকর ছিলেন একজন ক্রন্দনকারী ব্যক্তি, তিনি যখন কুরআন পড়তেন, তখন তাঁর অশ্রু সংবরণ করতে পারতেন না’।[22]
বিশিষ্ট তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনে কা‘ব আল-কুরাযী (৪০-১০৮হি.) বলেন,لَأَنْ أَقْرَأَ فِي لَيْلَتِي حَتَّى أُصْبِحَ بِإِذَا زُلْزِلَتِ، وَالْقَارِعَةُ لَا أَزِيدُ عَلَيْهِمَا، وَأَتَرَدَّدُ فِيهِمَا وَأَتَفَكَّرُ، أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ أَهُذَّ الْقُرْآنَ لَيْلَتِي هَذًّا، يعني: أَنْثُرَهُ نَثْرًا، ‘কুরআন গদ্যের মতো তাড়াতাড়ি পড়ে রাত শেষ করার চেয়ে আমি যদি রাতের শুরু থেকে সকাল পর্যন্ত কেবল সূরা যিলযাল ও সূরা ক্বারি‘আহ তেলাওয়াত করি, এর চেয়ে আর বেশী কিছু না তেলাওয়াত করে শুধু এ দু’টিরই পুনরাবৃত্তি করতে থাকি এবং এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকি, তাহ’লে এটাই আমার নিকটে অধিকতর পসন্দনীয়’।[23]
মূলত কুরআনের প্রকৃত মিষ্টতা অনুভব করা যায় তখনই, যখন পঠিত বা শ্রবণকৃত আয়াতগুলো অনুধাবন করা যায়। হাসান বসরী (রাঃ) বলেন,تَفَقَّدُوا الْحَلَاوَةَ فِي الصَّلَاةِ وَفِي الْقُرْآنِ وَفِي الذِّكْرِ فَإِنْ وَجَدْتُمُوهَا فَامْضُوا وَأَبْشِرُوا وَإِنْ لَمْ تَجِدُوهَا فَاعْلَمُوا أَنَّ الْبَابَ مُغْلَقٌ، ‘ছালাত, কুরআন ও যিকরে মিষ্টতার খোঁজ কর। মিষ্টতা খুঁজে পেলে আগে বাড়াও এবং সুসংবাদ নাও। আর যদি না পেয়ে থাকো, তাহ’লে জেনে রেখো, দরজা বন্ধ হয়ে গেছে’।[24] এজন্য শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,الْقِرَاءَةُ الْقَلِيلَةُ بِتَفَكُّرٍ أَفْضَلُ مِنْ الْكَثِيرَةِ بِلَا تَفَكُّرٍ، ‘না বুঝে অনেক বেশী কুরআন তেলাওয়াত করার চেয়ে চিন্তা-ভাবনা করে অল্প তেলাওয়াত করা অতি উত্তম’।[25]
৫. আমল করার উদ্দেশ্যে কুরআন তেলাওয়াত :
ছাহাবায়ে কেরাম যখন কুরআন শিখতেন বা তেলাওয়াত করতেন, তখন এর বিধান অনুযায়ী আমল করার জন্যই সেটা করতেন। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন,كانَ الرجل مِنَّا إذا تعلَّم عَشْر آياتٍ لم يجاوزهُنّ حتى يعرف معانيهُنَّ، والعملَ بهنَّ، ‘আমাদের মধ্যকার কোন ব্যক্তি যখন দশটি আয়াত শিখতেন, তখন সেই আয়াতগুলো অতিক্রম করতেন না যতক্ষণ না এগুলোর অর্থ জানতে পারতেন এবং তার প্রতি আমল করতে পারতেন’।[26] ফুযাইল ইবনে ইয়ায (রহঃ) বলেন, ‘কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে আমল করার জন্য। সেজন্য আমল করার নিয়তেই কুরআন তেলাওয়াত করা কর্তব্য। তাকে বলা হ’ল, কুরআনের ওপর আমল করা হয় কিভাবে? জবাবে তিনি বলেন, কুরআন যা হালাল করেছে, সেটাকে হালাল হিসাবে গ্রহণ করা। যা হারাম করেছে, তা হারাম হিসাবে মেনে নেওয়া। কুরআনে যা কিছু নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা এবং যা থেকে নিষেধ করা হয়েছে, তা থেকে পরিপূর্ণরূপে বিরত থাকা। আর তেলাওয়াতের প্রাক্কালে আশ্চর্যজনক বিষয় সমূহ আসলে থেমে যাওয়া এবং চিন্তা-ভাবনা করা’।[27] হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন, نزل القرآن ليُتدبَّر ويُعمَل به، فاتَّخِذوا تلاوتَهُ عَمَلًا، ‘কুরআন নাযিল হয়েছে চিন্তা-ভাবনা করা ও তার প্রতি আমল করার জন্য। সুতরাং তোমরা কুরআন তেলাওয়াত করাকে আমল হিসাবে গ্রহণ কর’।[28]
৬. রাতের বেলায় অধিক তেলওয়াত করতেন :
যে কোন সময় কুরআন তেলাওয়াতের ফযীলত রয়েছে। কিন্তু রাতের তেলাওয়াতের ফযীলত সবচেয়ে বেশী। ক্বিয়ামতের দিন কুরআন যখন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে, তখন রাতের তেলাওয়াতের কথা উল্লেখ করে বলবে,أَيْ رَبِّ ...مَنَعْتُهُ النُّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ، ‘হে আমার রব! আমি তাকে রাতের বেলা ঘুমাতে বাধা দিয়েছিলাম (অর্থাৎ সে রাত জেগে কুরআন তেলাওয়াত করেছে)। সুতরাং তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর’। অতঃপর আল্লাহ কুরআনের সুফারিশ কবুল করবেন।[29] এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রতি রাতে সূরা সাজদাহ ও সূরা মূলক না পড়ে ঘুমাতেন না।[30]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এবং ছাহাবায়ে কেরাম তাহাজ্জুদের ছালাতে বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করতেন। তামীমুদ্দারী (রাঃ) তাহাজ্জুদের ছালাতে সূরা জাছিয়া পড়তেন। যখন তিনি সেই আয়াতে পৌঁছান যেখানে আল্লাহ বলেছেন,أَمْ حَسِبَ الَّذِينَ اجْتَرَحُوا السَّيِّئَاتِ أَنْ نَجْعَلَهُمْ كَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَوَاءً مَحْيَاهُمْ وَمَاتُهُمْ سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ- ‘যারা দুষ্কৃতিসমূহ অর্জন করে, তারা কি ভেবেছে যে, আমরা তাদের বাঁচা ও মরাকে তাদের সমান গণ্য করব, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে? কতই না মন্দ সিদ্ধান্ত তারা নিয়ে থাকে!’ (জাসিয়া ৪৫/২১)। তিনি আয়াতটি বারবার তেলাওয়াত করতে থাকেন এবং কাঁদতে থাকেন। আর এভাবেই ভোর হয়ে যায়।[31]
আববাস ইবনে মায়সারাহ (মৃ. ১৬০হি.) প্রতি রাতে এক হাযার আয়াত তেলাওয়াতের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন এবং তা নিয়মিত তেলাওয়াত করতেন। যদি কোন রাতে ঐ পরিমাণ তেলাওয়াত করতে সক্ষম না হ’তেন, তবে নেকীর ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য পরের দিন ছিয়াম রাখতেন।[32] আবূ ইসহাক্ব আস-সাবেঈ (৩৩-৯৪হি.) প্রতি রাতে ক্বিয়ামুল লাইলে এক হাযার আয়াত তেলাওয়াত করতেন। আর হাযার আয়াত পূর্ণ করার জন্য তিনি সূরা ছাফ্ফাত, ওয়াক্বিয়াহ-এর মত ছোট আয়াত বিশিষ্ট সূরাগুলো তেলাওয়াত করতেন।[33] মূলত তিনি নিমেণাক্ত হাদীছের উপর আমল করতেন, যেখানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ قَامَ بِعَشْرِ آيَاتٍ لَمْ يُكْتَبْ مِنَ الغَافِلِينَ، وَمَنْ قَامَ بِمِائَةِ آيَةٍ كُتِبَ مِنَ القَانِتِينَ، وَمَنْ قَامَ بِأَلْفِ آيَةٍ كُتِبَ مِنَ المُقَنْطِرِينَ، ‘যে ব্যক্তি রাতের ছালাতে দশটি আয়াত তেলাওয়াত করবে, তার নাম গাফেলদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হবে না। আর যে ব্যক্তি (রাতের) ছালাতে এক শত আয়াত পাঠ করবে, তার নাম অনুগত বান্দাদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হবে। আর যে ব্যক্তি ক্বিয়ামে এক হাযার আয়াত তেলাওয়াত করবে, তাকে অফুরন্ত পুরস্কার প্রাপ্তদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হবে’।[34]
আব্দুর রায্যাক ছান‘আনী (রহঃ) বলেন, সুফইয়ান ছাওরী (রহঃ) প্রত্যেক রাতের সময়কে দুই ভাগে ভাগ করতেন। একভাগে কুরআন তেলাওয়াত করতেন, আর একভাগে হাদীছ অধ্যয়ন করতেন।[35] মুহাম্মাদ আবূ নছর আত-তূসী (মৃ. ৩৪৪হি.) ছিলেন মুহাদ্দিছ, ফক্বীহ এবং সাহিত্যিক। তিনি হাদীছে নববীর জন্য দেশ থেকে দেশান্তরে সফর করতেন। দিনের বেলা ছিয়াম রাখতেন এবং রাতে তাহাজ্জুদ পড়তেন। নিয়মিত দান-ছাদাক্বা করতেন। সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করতেন। এই মহান মনীষী রাতের সময়কে তিন ভাগে ভাগ করতেন, একভাগ গ্রন্থ রচনার জন্য, একভাগ কুরআন তেলাওয়াতের জন্য এবং একভাগ ঘুমের জন্য।[36]
মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ (রহঃ) বলেন, হুসাইন ইবনে আলী আত-তামীমী (মৃ. ৩৭৫)-এর ছোহবতে আমি প্রায় ত্রিশ বছর কাটিয়েছি। বাড়ীতে-সফরে, গ্রীষ্ম-শীতে সর্বদা তার সাথে থেকে দেখেছি যে, তিনি কখনো ক্বিয়ামুল লাইল ছাড়তেন না। তিনি প্রতি রাতের ক্বিয়ামে কুরআনের এক সপ্তমাংশ তেলাওয়াত করতেন।[37] আবূ মানুছূর ইবনে কারখী বাগদাদী (রহঃ) রাতের ছালাতে প্রতি রাক্ব‘আতে এক পারা করে তেলাওয়াত করতেন এবং পুরো রাতে কুরআনের এক সপ্তমাংশ পাঠ করতেন।[38]
৭. রামাযান মাসে কুরআন চর্চা :
রামাযান মাস হ’ল আল্লাহর কিতাব অধ্যয়নের মাস। এ মাসে শুধু কুরআনই নাযিল হয়নি; বরং অন্যান্য আসমানী কিতাবগুলোও রামাযান মাসে নাযিল হয়েছে।[39] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রামাযান মাসে জিবরীল আমীনকে কুরআন তেলাওয়াত করে শুনাতেন এবং তার তেলাওয়াত শুনতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আববাস (রাঃ) বলেন, قَالَ كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَجْوَدَ النَّاسِ، وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِى رَمَضَانَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ، وَكَانَ يَلْقَاهُ فِى كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ الْقُرْآنَ، فَلَرَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَجْوَدُ بِالْخَيْرِ مِنَ الرِّيحِ الْمُرْسَلَةِ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। রামাযানে তিনি আরো অধিক দানশীল হ’তেন, যখন জিবরীল (আঃ) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। আর রামাযানের প্রতি রাতেই জিবরীল (আঃ) তাঁর সাথে দেখা করতেন এবং তাঁরা একে অপরকে কুরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন। নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রবাহিত বায়ু অপেক্ষাও অধিক দানশীল ছিলেন’।[40]
সালাফে ছালেহীন রামাযানের তেলাওয়াতের প্রস্ত্ততি স্বরূপ শা‘বান মাস থেকে ঘরে দরজা বন্ধ করে দিয়ে কুরআন তেলাওয়াতে নিবিষ্ট হ’তেন। আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন,كان المسلمون إذا دخل شعبان انكبوا على المصاحف فقرؤها وأخرجوا زكاة أموالهم تقوية للضعيف والمسكين على صيام رمضان ‘যখন শা‘বান মাস আগমন করত, তখন মুসলিমরা মুছহাফের প্রতি নিবিষ্ট হ’তেন এবং তেলাওয়াত করতেন। আর তারা (শা‘বান মাসেই) তাদের সম্পদের যাকাত দিয়ে দিতেন, যেন গরীব-মিসকীনরা রামাযানের ছিয়াম সাধনার সাবলম্বী হ’তে পারে’।[41] ইমাম ইবনু রজব হাম্বলী (রহঃ) বর্ণনা করেছেন, সালাফে ছালেহীনের কেউ কেউ রামাযান মাসে প্রত্যেক দিন, আবার কেউ প্রতি তিন দিনে, কেউ প্রতি সাত দিনে, আবার কেউ প্রতি দশ দিনে কুরআন খতম করতেন। তারা যেমন ক্বিয়ামুল লাইলে কুরআন তেলাওয়াত করতেন, তদ্রূপ ছালাতের বাহিরেও তেলাওয়াত করতেন। ক্বাতাদা (রাঃ) রামাযানের বাহিরে প্রতি সাত দিনে কুরআন খতম করতেন, আর রামাযানে প্রতি তিন দিনে কুরআন খতম করতেন। সুফয়ান ছাওরী (রাঃ) রামাযান মাসে অন্যান্য সকল নফল ইবাদত পরিহার করে শুধু কুরআন তেলাওয়াতে রত থাকতেন। আয়েশা ছিদ্দীক্বা (রাঃ) রামাযান মাসে কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে দিন শুরু করতেন। তিনি সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত মুছহাফ দেখে তেলাওয়াত করতেন। অতঃপর ঘুমিয়ে যেতেন। ইমাম মালেক ইবেন আনাস (রাঃ) রামাযান মাসে দারস-তাদীরস থেকে মুক্ত থাকতেন। কেবল কুরআনের মুছহাফ নিয়ে পড়ে থাকতেন এবং তেলাওয়াত করতেন।[42]
৮. নির্জন-নিভৃতে তেলাওয়াত :
প্রকাশ্যে কুরআন তেলাওয়াতের চেয়ে গোপনে তেলাওয়াত করার মর্যাদা বেশী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,الْجَاهِرُ بِالْقُرْآنِ، كَالْجَاهِرِ بِالصَّدَقَةِ، وَالْمُسِرُّ بِالْقُرْآنِ، كَالْمُسِرِّ بِالصَّدَقَةِ، ‘প্রকাশ্যে কুরআন তেলাওয়াতকারী প্রকাশ্যে দানকারীর মত। আর গোপনে কুরআন পাঠকারী গোপনে দানকারীর মত’।[43] এজন্য সালাফগণের কেউ কেউ গোপনে তেলাওয়াত করতেন। ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেন, كان عمل الربيع بْن خثيم كله سرا فربما دخل عَلَيْهِ الداخل وَقَدْ نشر المصحف فيغطيه بثوبه، ‘রবি‘ বিন খুছাইম সকল (নফল) আমল গোপন করতেন। এমনকি তার কুরআন পড়া অবস্থায় কেউ তার ঘরে প্রবেশ করলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে কাপড় দিয়ে কুরআন ঢেকে ফেলতেন (যেন তার কুরআন তেলাওয়াতের বিষয়টি আগন্তুক বুঝতে না পারে)’।[44]
মুহাম্মাদ ইবনে আসলাম আবুল হাসান আল-কিন্দী (১৮০-২৪২) নিভৃতে-গোপনে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। তার ছেলে বর্ণনা করেন যে, তিনি ঘরে দরজা বন্ধ করে দিয়ে কুরআন তেলাওয়াত করতেন এবং কাঁন্নাকাটি করতেন। আর যখন বাহিরে বের হ’তেন, তখন মুখ ধুয়ে চোখে সুরমা লাগাতেন যেন চোখে-মুখে কাঁন্নার প্রভাব না ফুটে ওঠে। তিনি লোক পাঠিয়ে গরীবদের মাঝে খাবার ও পোশাক বিতরণ করতে এবং কঠোরভাবে নিষেধ করে দিতেন যেন তার পরিচয় প্রকাশ না পায়।[45]
ফুযায়েল ইবনে ইয়াযের ছেলে আলী ইবনে ফুযায়েল (রহঃ) নিভৃতচারী হয়ে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। তিনি একজন আল্লাহভীরু ইবাদতগুযার বান্দা ছিলেন। ঘরের এক নির্জন জায়গায় তিনি নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করতেন। একদিন রাতে তিনি সেই জায়গায় তেলাওয়াত করতে থাকেন এবং সেখানেই ইন্তিকাল করেন। তিনি তার পিতার আগেই পরকালে পাড়ি জমান।[46]
৯. তেলাওয়াতের মাঝে দো‘আ-প্রার্থনা :
কুরআন তেলাওয়াতের সময় প্রার্থনা করা মুস্তাহাব। নাফে (রহঃ) বলেন, كَانَ ابْنُ عُمَرَ يَقْرَأُ فِي صَلَاتِهِ فَيَمُرُّ بِالْآيَةِ فِيهَا ذِكْرُ الْجَنَّةِ فَيَقِفُ وَيَسْأَلُ اللهَ الْجَنَّةَ، وَيَدْعُو وَيَبْكِي. وَيَمُرُّ بِالْآيَةِ فِيهَا ذِكْرُ النَّارِ فَيَقِفُ فَيَدْعُو وَيَسْتَجِيرُ بِاللهِ عَزَّ وَجَلَّ ‘ইবনে ওমর (রাতের) ছালাতে জান্নাতের আলোচনা সংক্রান্ত আয়াত তেলাওয়াত করার সময় থেমে যেতেন এবং আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করতেন। তিনি দো‘আ করতেন এবং কাঁন্নাকাটি করতেন। আর জাহান্নামের বর্ণনা সংবলিত আয়াত তেলাওয়াত করার সময় থেমে যেতেন এবং আল্লাহর কাছে দো‘আ করতেন এবং জাহান্নাম থেকে পানাহ চাইতেন’।[47] ইমাম ইবনে বায (রহঃ) বলেন, ‘কুরআন তেলাওয়াতের সময় দো‘আ করা মুস্তাহাব। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাহাজ্জুদের ছালাতে যখন কোন আযাব সংক্রান্ত আয়াত তেলাওয়াত করতেন, তখন সেই আযাব থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতেন। আর যখন আল্লাহর দয়া সংক্রান্ত আয়াত তেলাওয়াত করতেন, তখন সেই রহমত প্রার্থনা করতেন। এটা রাতের ছালাতে করা যায় এবং দিনের ছালাতেও। অথবা ছালাতের বাহিরে কুরআন তেলাওয়াতের সময়ও এভাবে দো‘আ করা যায়। এর জন্য পুনরায় আঊযুবিল্লাহ-বিসমিল্লাহ পড়ার প্রয়োজন নেই। স্মর্তব্য যে, নফল ছালাতের ক্ষেত্রে এবং একাকী ছালাত আদায়ের সময় এই বিধান প্রযোজ্য হবে। ফরয ছালাতের ক্ষেত্রে নয়’।[48]
১০. কুরআনের মাধ্যমে প্রবলভাবে প্রভাবিত হওয়া :
সালাফে ছালেহীন কুরআন তেলাওয়াতের সময় এর মাধ্যমে প্রবলভাবে প্রভাবিত হ’তেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বলেন, যখন সূরা যিলযাল নাযিল হয়, তখন আবুবকর (রাঃ) কাঁদতে শুরু করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, ‘হে আবুবকর! তুমি কাঁদছ কেন?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এই সূরা আমাকে কাঁদাচ্ছে’।[49] মালিক বিন দীনার (মৃ. ১৪০ হি.) একদা কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। যখন তিনি এই আয়াতে পৌঁছলেন, لَوْ أَنْزَلْنَا هَذَا الْقُرْآنَ عَلَى جَبَلٍ لَرَأَيْتَهُ خَاشِعًا مُتَصَدِّعًا مِنْ خَشْيَةِ اللهِ وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ- ‘যদি এই কুরআন আমরা কোন পাহাড়ের উপর নাযিল করতাম, তাহ’লে অবশ্যই তুমি তাকে আল্লাহর ভয়ে বিনীত ও বিদীর্ণ হ’তে দেখতে। আর আমরা এইসব দৃষ্টান্ত মানুষের জন্য বর্ণনা করি যাতে তারা চিন্তা করে’ (হাশর ৫৯/২১) তখন তিনি প্রবলভাবে কেঁদে উঠলেন এবং বললেন,أُقْسِمُ لَكُمْ لَا يُؤْمِنُ عَبْدٌ بِهَذَا الْقُرْآنِ إِلَّا صَدَعَ قَلْبُه ‘আমি তোমাদেরকে কসম করে বলছি, যে ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে এই কুরআনের প্রতি ঈমান আনবে, তার হৃদয় (কুরআনের মর্মবাণী অনুধাবন করে) বিগলিত হয়ে যাবে’।[50]
হাফস ইবনে ওমর আল-জুফী (রহঃ) বলেন, একদা দাঊদ আত-ত্বাঈ (১০০-১৬৫হি.) বেশ কিছুদিন যাবৎ অসুস্থ ছিলেন। তার অসুস্থতার কারণ ছিল এই যে, তিনি কুরআন তেলাওয়াতের সময় জাহান্নামের আলোচনা সংক্রান্ত আয়াত বারবার তেলাওয়াত করতে থাকেন এবং এভাবে পুরো রাত কাটিয়ে দেন। ফলে সকালবেলা অসুস্থ হয়ে পড়েন।[51]
আলী ইবনে ফুযাইল (মৃ. ১৮০হি.) একটি আয়াত তেলাওয়াত করতে গিয়ে তো ভয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তিনি সূরা আন‘আম তেলাওয়াত করছিলেন। যখন তিনি এই আয়াতে পৌঁছলেন,وَلَوْ تَرَى إِذْ وُقِفُوا عَلَى النَّارِ فَقَالُوا يَالَيْتَنَا نُرَدُّ وَلَا نُكَذِّبَ بِآيَاتِ رَبِّنَا وَنَكُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ- ‘যদি তুমি তাদের সেই সময়ের অবস্থা দেখতে, যখন তাদেরকে জাহান্নামের কিনারে দাঁড় করানো হবে। অতঃপর তারা বলবে, হায় যদি আমাদের পুনরায় (দুনিয়ায়) ফিরিয়ে দেওয়া হ’ত, তাহ’লে আমরা আমাদের প্রতিপালকের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করতাম না এবং আমরা বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম’ (আন‘আম ৬/২৭)। তখন তিনি থমকে দাঁড়ান এবং মৃত্যুবরণ করেন। ইবরাহীম ইবনে বাশার (রহঃ) বলেন, আমি তার জানাযা ছালাতে অংশগ্রহণ করেছিলাম’।[52] ফুযাইল ইবনে ইয়াযের খাদেম ইবরাহীম ইবনে আশ‘আছ (রহ.) বলেন, আমি ফুযাইল ইবনে ইয়াযের চেয়ে অধিক নরম দিলের অধিকারী আর কাউকে দেখিনি। যখন তিনি আল্লাহকে স্মরণ করতেন বা তার কাছে আল্লাহর কথা স্মরণ করা হ’ত অথবা কুরআন তেলাওয়াত করা হ’ত- তখন তার চেহারায় ভয় ও উৎকণ্ঠা ফুটে উঠত। তার দু’চোখ ছাপিয়ে অশ্রুধারা এমনভাবে প্রবাহিত হ’ত যে, তার ব্যাপারে উপস্থিত লোকজনের করুণা হ’ত’।[53] আবূ হুমামা (রহঃ) বলেন, আমি ঈসা ইবনে দাঊদ (রহঃ)-কে বললাম, দুনিয়ার প্রতি আপনার আগ্রহ কতটুকু? তিনি কেঁদে দিয়ে বললেন, ‘আমার ইচ্ছা হয় বুকটা চিরে অন্তরের দিকে তাকিয়ে দেখি যে, সেখানে কুরআন কি কাজ করেছে? তিনি যখন কুরআন তেলাওয়াত করতেন, তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেন। ফলে তার দীর্ঘশ^াস উঠে যেত। আর আমার মনে হ’ত, এই বুঝি প্রাণটা বেরিয়ে গেল।[54]
১১. গুরুত্বপূর্ণ আয়াত বারবার তেলাওয়াত করা :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কুরআন তেলাওয়াত করার সময় গুরুত্বপূর্ণ আয়াত একাধিকবার তেলাওয়াত করতেন। আবূ যার (রাঃ) বলেন, এক রাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাহাজ্জুদের ছালাতে ভোর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে একটি মাত্র আয়াত পড়তে থাকলেন, আয়াতটি হ’ল-إِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ، وَإِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ- ‘যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তাহ’লে তারা আপনার বান্দা। আর যদি তাদের ক্ষমা করেন, তাহ’লে আপনি মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (মায়েদাহ ৫/১১৮)। তাবেঈ ইবনে আবী মুলাইকা (মৃ. ১১৭হি.) বলেন, আমি মক্কা থেকে মদীনা পর্যন্ত আবুবকর (রাঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি রাতের বেলা ক্বিয়ামুল লাইল করতেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হ’ল- ছালাতে তার তেলাওয়াত কেমন ছিল? জবাবে তিনি বললেন, তিনি ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করতেন। আর যখন এই আয়াত তেলাওয়াত করলেনوَجَاءَتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ ذَلِكَ مَا كُنْتَ مِنْهُ تَحِيدُ ‘আর মৃত্যুযন্ত্রণা আসবে নিশ্চিতভাবে। যা থেকে তুমি পালিয়ে বেড়াতে’ (ক্বাফ ৫০/১৯)। তখন আয়াতটি বারবার তেলাওয়াত করতে থাকতেন এবং ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেন এবং অনেক বেশী কাঁদতেন।[55]
ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) ছালাতে সূরা তূর তেলাওয়াত করতেন। যখন তিনি এই আয়াতে পৌঁছতেন,إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ لَوَاقِعٌ، مَا لَهُ مِنْ دَافِعٍ، ‘নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালকের শাস্তি অবশ্যই আসবে। একে প্রতিহত করার কেউ নেই’ (তূর ৫২/৭-৮)। তিনি আয়াত দু’টো বারবার তেলাওয়াত করতেন এবং আল্লাহর আযাবের ভয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তেন।[56] এমনকি ছালাতে যখন কুরআন তেলাওয়াত করা হ’ত এবং আল্লাহর আযাব ও জাহান্নাম সংক্রান্ত আয়াত আসত, তখন তিনি ভয়ে কাঁদতে থাকতেন। একেবারে পিছনের কাতারে অবস্থানকারী লোকেরাও তাঁর কাঁন্নার আওয়ায শুনতে পেত।[57]
ইসহাক ইবনে ইবরাহীম (রহঃ) বলেন,كَانَتْ قِرَاءتُهُ [الفُضَيْلِ] حَزِيْنَةً، شَهِيَّةً، بَطِيئَةً، مُتَرسِّلَةً، كَأَنَّهُ يُخَاطِبُ إِنْسَاناً، وَكَانَ إِذَا مَرَّ بِآيَةٍ فِيْهَا ذِكْرُ الجَنَّةِ، يُرَدِّدُ فِيْهَا، ‘ফুযাইল ইবনে ইয়ায (রহঃ) দুঃখভরা কণ্ঠে, প্রবল অনুরাগ নিয়ে এবং ধীরে ধীরে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। মনে হ’ত যেন তিনি কোন মানুষকে সম্বোধন করে কিছু বলছেন। যখন জান্নাতের আলোচেনা সম্বলিত কোন আয়াত তিনি অতিক্রম করতেন, তখন সেই আয়াত বারবার তেলাওয়াত করতেন’।[58]
১২. বিপদাপদে এবং রোগে-শোকে কুরআন তেলাওয়াত :
ছালেহ আল-মুয়ায্যিন (রহঃ) বলেন, একবার আমি ও ওমর ইবেন আব্দুল আযীয (রহঃ) খুবই বিষণ্ণ সময় পার করছিলাম। এশার ছালাতের আযান দেওয়া হ’ল। তিনি ছালাত আদায় করে ঘরে প্রবেশ করলেন। ভিতরে বেশিক্ষণ অবস্থান করেননি। তারপর বেরিয়ে এসে সংক্ষিপ্তভাবে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করলেন এবং কুরআন খুলে সূরা আনফাল পড়া শুরু করলেন। বারবার এটা তেলাওয়াত করতে থাকলেন। যখন শাস্তির আয়াত তেলাওয়াত করতেন, তখন রোনাজারি করে কাঁদতেন। আর রহমতের আয়াত তেলাওয়াতের সময় দো‘আ করতেন। এইভাবেই ফজরের আযান দিয়ে দিল।[59] ছালেহ আল-মুর্রী (রহঃ) বলেন, একবার আমার স্ত্রী পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছিল। আমি তার পাশে কুরআন তেলাওয়াত করায় সে সুস্থ হয়ে গেল। বিষয়টি আমি গালিব আল-ক্বাত্তান (রহঃ)-কে বললাম। কিন্তু তিনি একটুও বিস্মিত হলেন না; বরং বললেন,وَاللهِ لَوْ أَنَّكَ حَدَّثْتَنِي: أَنَّ مَيِّتًا قُرِئَ عَلَيْهِ الْقُرْآنُ فَحَيِيَ، مَا كَانَ ذَلِكَ عِنْدِي عَجَبًا، ‘আল্লাহর কসম! তুমি যদি আমাকে বলতে যে, কোন মৃত ব্যক্তির পাশে কুরআন তেলাওয়াত করার পর সে জীবিত হয়ে গেছে, তবুও আমি বিস্মিত হ’তাম না’।[60]
১৪. কখনো কুরআন থেকে গাফেল থাকতেন না :
সালাফে ছালেহীন কুরআন তেলাওয়াত থেকে কখনো গাফেল থাকতেন না। মুক্বীম অবস্থায় হোক আর সফর অবস্থায় হোক সর্বাবস্থায় তারা কুরআন তেলাওয়াতের ইবাদত করতেন। একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আবূ মূসা আশ‘আরী এবং মু‘আয ইবনে জাবাল (রাঃ)-কে ইয়ামেনে পাঠালেন। তারা সফরেও কুরআন তেলাওয়াত ও ক্বিয়ামুল লায়েল থেকে গাফেল থাকতেন না। আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস হ’ল, كَيْفَ تَقْرَأُ القُرْآنَ؟ ‘আপনি কিভাবে কুরআন তেলাওয়াত করেন?’ জবাবে তিনি বলেন,قَائِمًا وَقَاعِدًا وَعَلَى رَاحِلَتِي، وَأَتَفَوَّقُهُ تَفَوُّقًا، ‘আমি দাঁড়িয়ে, বসে, সাওয়ারীর পিঠে আরোহী অবস্থায় এবং কিছুক্ষণ পরপরই তেলাওয়াত করি’।[61] ‘আছেম ইবনে আববাস বলেন, আমি সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব (রহঃ)-কে রাতের সফরে আরোহী অবস্থায় প্রচুর তেলাওয়াত করতে শুনেছি।[62] সালাফে ছালেহীন মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কুরআন তেলাওয়াত নিমগ্ন থাকতেন। জুনাইদ ইবনে মুহাম্মাদ (রহঃ) যখন মৃত্যু শয্যায়, তখন তিনি কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। দিনটি ছিল জুম‘আর দিন। এমন মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে কুরআন পাঠ করতে দেখে আবূ মুহাম্মাদ আল-জুরাইরী তাকে বললেন, ‘হে আবুল কাসেম! নিজের প্রতি একটু দয়া করুন’। তখন তিনি বললেন, খুব শিঘ্রই আমার আমলনামার খাতা গুটিয়ে নেওয়া হবে, আর এই মুহূর্তে আমার জন্য কুরআন তেলাওয়াতের চেয়ে অধিক প্রয়োজনীয় আর কিছু নেই।[63]
উপসংহার :
সালাফে ছালেহীন এই উম্মতের শ্রেষ্ঠ মানুষ। তাদের জীবন ছিল কুরআনের আলোয় আলোকিত। তাঁরা আমাদের চেতনার বাতিঘর। জীবন চলার পথে-প্রান্তরে তাঁরাই আমাদের আলোকবর্তিকা স্বরূপ। তাদের অনুসরণীয় পথেই রয়েছে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির নিশ্চয়তা। সার্বিক জীবনে আমরা যেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এবং সালাফে ছালেহীনের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারি, মহান আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী; এম.ফিল গবেষক, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. আবু যাকারিয়া মুহিউদ্দীন নববী, আল-মাজমূ‘ শারহুল মুহায্যাব (কায়রো : ইদারাতুত তাবা‘আতিল মুনীরিইয়াহ, ১৩৪৪-১৩৪৭হি.) ১/৩৮ পৃ.।
[2]. শামসু্দ্দীন যাহাবী, তারীখুল ইসলাম (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-আরবী, ২য় মুদ্রণ, ১৪১৩হি./১৯৯৩খৃ.) ৫০/২৪৭।
[3]. শামসুদ্দীন যাহাবী, সিয়ারু আ-লামিন নুবালা, মুহাক্কিক্ব : শু‘আইব আরনাউত্ব ও অন্যান্য (বৈরূত : মুআস্সাসাতুর রিসালাহ, ২য় সংস্করণ, ১৪০৫হি./১৯৮৫খৃ.) ১৭/৬৪৬।
[4]. খত্বীব বাগদাদী, আল-জামি‘ লি আখলাকির রাবী ওয়া আদাবিস সামি‘, মুহাক্কিক্ব : ড. মাহমূদ আত-তাহহান (রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, তাবি) ১/১০৬-১১১
[5]. ইবনু আব্দিল বার্র, জামে‘উ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহী, তাহক্বীক্ব : আবূল আশবাল আয-যুহাইরী (সঊদী আরব : দারু ইবনিল জাওযী, প্রথম প্রকাশ, ১৪১৪হি./১৯৯৪খৃ.), ২/১১২৯।
[6]. বায়হাক্বী, আল-আসমাউ ওয়াছ ছিফাত ১/৫৯৩।
[7]. তাফসীরে কুরতুবী ১/২৮।
[8]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান ৩/৫৩১; ইবনু খাল্লিকান, ওয়াফয়াতুল আ‘য়ান, মুহাক্কিক্ব : ইহসান আববাস (বৈরূত : দারু ছাদের, ১ম মুদ্রণ, ১৯৯৪খৃ.) ৩/২৫৭।
[9]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৬/২৫০।
[10]. যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ২০/৩২০।
[11]. আবূদাঊদ হা/১৩৯০; মিশকাত হা/২২০১; সনদ ছহীহ।
[12]. ইবনু রজব হাম্বলী, লাত্বায়েফুল মা‘আরেফ (সৌদি আরব : দারু ইবনে হাযম, ১ম মুদ্রণ, ১৪২৪হি./২০০৪খৃ.) পৃ. ১৭১; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ৩/৭৯।
[13]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৯/৪৪; তারীখুল ইসলাম ১৩/২৫০।
[14]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া (কায়রো : দারুল হাদীছ, ১৪২১হি./২০০০খৃ.) ২/৬৯।
[15]. ইবনুল জাওযী, আল-মুন্তাযাম ফী তারীখিল মুলূকি ওয়াল উমাম (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-ইলমিইয়াহ, ১ম মুদ্রণ, ১৪১২হি./১৯৯২খৃ.) ৭/১৮৮; ছিফাতুছ ছাফওয়া, ২/১৫৫।
[16]. আবুবকর ফারিয়াবী (মৃ. ৩০১হি.), ফাযায়েলুল কুরআন (রিয়াদ : মাকতাবাতুর রুশ্দ, ১ম মুদ্রণ, ১৪০৯হি./১৯৮৯খৃ.) পৃ. ১৮৯; মুহিউদ্দীন নববী, আল-আযকার (সৌদি আরব : দারু ইবনে হাযম, ১ম মুদ্রণ, ১৪২৫হি./২০০৪খৃ.) পৃ. ২০০।
[17]. বুখারী হা/৪৫৮২।
[18]. বুখারী হা/৫০৫০।
[19]. তিরমিযী হা/৩২৯৭; মিশকাত হা/৫৩৫৪; ছহীহ হাদীছ।
[20]. ইবনু আব্দিল বার্র, আল-ইস্তিযকার (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-ইলমিইয়াহ, ১ম মুদ্রণ, ১৪২১হি./২০০০খৃ.) ২/৪৭৮।
[21]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান ৩/৪১৭।
[22]. বুখারী হা/৩৯০৫।
[23]. ইবনুল মুবারাক, আয্-যুহদ ওয়ার রাক্বায়েক্ব ১/৯৭।
[24]. হিলয়াতুল আওলিয়া ১০/৪৬; ইবনু রজব হাম্বলী, নুযহাতুল আসমা ২/৪৭০।
[25]. ইবনু তায়মিয়াহ, আল-ফাতাওয়াল কুবরা, ৫/৩৩৪।
[26]. তাফসীরে ত্বাবারী, ১/৮০।
[27]. খত্বীব বাগদাদী, ইক্বতিযাউল ইলমি আল-আমাল, মুহাক্কিক্ব: নাছিরুদ্দীন আলবানী (বৈরূত : আল-মাকতাব আল-ইসলামী, ৫ম মুদ্রণ, ১৪০৪হি./১৯৭৪খৃ.), পৃ. ৭৬।
[28]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন (বৈরূত: দারুল কিতাব আল-আরবী, ২য় মুদ্রণ, ১৪১৬হি./১৯৯৬হি.) ১/৪৫০।
[29]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/১৮৩৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৮৮২; মিশকাতা হা/১৯৬৩; সনদ ছহীহ।
[30]. তিরমিযী হা/২৮৯২; মিশকাতা হা/২১৫৫; ছহীহ।
[31]. মারওয়াযী, মুখতাছার কিয়ামিল লায়ল (পাকিস্তান, ফয়ছালাবাদ : হাদীছ একাডেমী, ১ম মুদ্রণ, ১৪০৮হি./১৯৮৮খৃ.) পৃ. ১৪৯।
[32]. জামালুদ্দীন মিয্যী, তাহযীবুল কামাল ফী আসমাইর রিজাল (বৈরূত: মুআস্সাসাতুর রিসালাহ ১ম মুদ্রণ, ১৪০০-১৪১৩হি./১৯৮০-১৯৯২খৃ.) ১৪/১৬৮।
[33]. ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশ্ক্ব তাহক্বীক : আমর আল-আমরী (বৈরূত : দারুল ফিক্র, ১৪১৫হি./১৯৯৫খৃ.) ৪৬/২২৬।
[34]. আবূদাঊদ হা/১৩৯৮; মিশকাত হা/১২০১; সনদ ছহীহ।
[35]. ইবনু আবী হাতেম, আল-জার্হ ওয়াত তা‘দীল (হায়দারাবাদ : মাজলিসু দাইরাতিল মা‘আরেফ আল-ওছমানিয়া, ১ম মুদ্রণ, ১২৭১হি./১৯৫২খৃ.) ১/১১৬।
[36]. ইবনুল ইমাদ হাম্বলী, শাযারাতুয যাহাব (দামেশক্ব : দারু ইবনে কাছীর, ১ম মুদ্রণ, ১৪০৬হি./১৯৮৬খৃ.) ৪/২৩৭; ইবনুল জাওযী, আল-মুন্তাযাম ১৪/১০০।
[37]. ইবনুল জাওযী, আল-মুন্তাযাম, ৭/১৮৮; ছিফাতুছ ছাফওয়া, ১৪/৩১২।
[38]. খত্বীব বাগদাদী, তারীখু বাগদাদ, তাহক্বীক: মুছতাফা আব্দুল ক্বাদের আত্বা (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-ইলমিইয়াহ, ১ম প্রকাশ, ১৪১৭হি.), ৬/৫৭; যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ২৭/২১৯।
[39]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৫৭৫; সনদ হাসান।
[40]. বুখারী হা/৬; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/২৯২।
[41]. ইবনু রজব হাম্বলী, লাত্বায়েফুল মা‘আরেফ, পৃ. ১৩৫।
[42]. লাত্বায়েফুল মা‘আরেফ, পৃ. ৩৯৯-৪০০।
[43]. তিরমিযী হা/১৩৩৩; নাসাঈ হা/২৫৬১, সনদ ছহীহ।
[44]. ইবনুল জাওযী, তালবীসু ইবলীস (বৈরূত: দারুল ফিকর, ১ম মদ্রণ, ১৪২১হি./২০০১খ্রি.), পৃ. ১২৮।
[45]. ইবনুল জাওযী, আল-মুন্তাযাম ১১/৩০৩; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১২/২০১।
[46]. ইবনু হিববান, আছ-ছিক্বাত (হায়দারাবাদ : দাইরাতুল মা‘আরেফ আল-ওছমানিয়া, ১ম মুদ্রণ, ১৩৯৩হি./১৯৭৩খৃ.) ৮/৪৬৪।
[47]. আহমাদ ইবনে হাম্বল, কিতাবুয যুহ্দ, হাশিয়া: মুহাম্মাদ আব্দুস সালাম শাহীন (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-ইলমিইয়াহ, প্রথম মুদ্রণ, ১৪২০হি./১৯৯৯খৃ.), পৃ. ১৫৮।
[48]. ফাতাওয়া নূরুন আলাদ্দারব ১/৩৩৪।
[49]. ইবনু আবিদ্দুনয়া, আর-রিক্কাহ ওয়াল বুকা, মুহাক্কিক্ব : মুহাম্মাদ খায়ের রামাযান ইউসুফ (বৈরূত : দারু ইবনে হাযম, ৩য় মুদ্রণ, ১৪১৯হি./১৯৯৮খৃ.) ক্রমিক : ৭৫, পৃ. ৮১; সনদ ছহীহ।
[50]. আহমাদ ইবনে হাম্বল, কিতাবুয যুহ্দ. পৃ. ২৫৮।
[51]. আবূ নু‘আইম আস্ফাহানী, হিলয়াতুল আওলিয়া ৭/৩৪০।
[52]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৮/৪৪৬।
[53]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৮/৪২৬; ইবনু আসাকির, তারীখু দিশাশ্ক্ব ৪৮/৩৯১; আবূ নু‘আইম, হিলয়াতুল আওলিয়া ৮/৮৪।
[54]. ইবনু আবিদ্দুনয়া, আল-মুতামান্নীন (বৈরূত : দারু ইবনে হাযম, ১ম মুদ্রণ, ১৪১৮হি./১৯৯৭খৃ.), পৃ. ৪৮।
[55].মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/৩৮৪৬৩; ২০/১১২; সনদ হাসান। যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৩/৩৫২।
[56]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-জাওয়াবুল কাফী, মুহাক্কিক্ব: মুহাম্মাদ আজমাল ইছলাহী (রিয়াদ: দারু ‘আত্বাআতুল ইলম, ৪র্থ সংস্করণ, ১৪৪০হি./২০১৯খ্রি.), ১/৯২।
[57]. ইবনুল মুলাক্কিন, আত-তাওযীহ লি শরহিল জামি‘ আছ-ছাগীর (দামেশ্ক : দারুন নাওয়াদির) ২৪/১৭০; ইবনুল জাওযী, মানাক্বিবে ওমর ইবনিল খাত্তাব, পৃ. ১৬৭।
[58]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৮/৪২৮।
[59]. ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশ্ক্ব ২৩/৩৩২; আবূ নু‘আইম আস্ফাহানী, হিলয়াতুল আওলিয়া ৫/৩২৪।
[60].আবূ নু‘আইম, হিলয়াতুল আওলিয়া ৬/১৭০।
[61]. বুখারী হা/৪৩৪৪; অধ্যায়-৬৪ ‘কিতাবুল মাগাযী’, অনুচ্ছেদ-৬১।
[62]. ইবনু সা‘দ, আত-তাবাক্বাতুল কুবরা, ৫/১০১।
[63]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়া ১/৫২১; বায়হাক্বী, আয-যুহদুল কাবীর, পৃ. ১৯৯।