তাওফীক্ব লাভের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

ভূমিকা :

তাওফীক্ব যাবতীয় কল্যাণের উৎস। দুনিয়া ও আখেরাতে সফল হওয়ার মূল চালিকা শক্তি। তাওফীক্ব ছাড়া বান্দা নেক আমলে আত্মনিয়োগ করতে পারে না। আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক কাজের জন্য সক্ষমতা অর্জন করতে পারে না। ঈমানের পথে অবিচল থাকতে পারে না। অপরদিকে তাওফীক্ব থেকে বঞ্চিত বান্দা দুনিয়াতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পরকালে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হয়। সেজন্য প্রতি মুহূর্তে তাওফীক্ব অতিব প্রয়োজন এবং তাওফীক্ব লাভের জন্য সচেষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়।

তাওফীক্বের পরিচয় :

তাওফীক্ব (‌التَّوْفِيقُ) আরবী শব্দ, যার অর্থ- الإلهامَ للخَيْر ‘কল্যাণের জন্য এলাহী প্রেরণা’।[1] এর আরো কিছু অর্থ আছে, যেমন : (الهِدَايَةُ) পথনির্দেশ, (الرُّشْدُ) সৎপথ, (التَّأْيِـيْدُ) সাহায্য করা, (التَّسْدِيدُ) পথ দেখানো, (التَّيْسِيْرُ) সহজ করা, (التَّقْوِيَةُ) শক্তিশালী করা, (الإعْطَاءُ) প্রদান করা, (الإفَازَةُ) সাফল্য দেওয়া, (الإصْلاحُ) সংশোধন করা ইত্যাদি। মোট কথা আল্লাহ যখন তাঁর বান্দাকে শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে কোন সামর্থ্য ও সক্ষমতা দান করেন, তখন সেটাকে তাওফীক্ব বলা হয়।

পারিভাষিক অর্থে,التَّوْفِيق من الله للْعَبد ‌سد ‌طَرِيق ‌الشَّرّ وتسهيل طَرِيق الْخَيْر، ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওফীক্ব লাভের অর্থ হ’ল বান্দার জন্য মন্দ পথ বন্ধ করা এবং কল্যাণের পথ সুগম করে দেওয়া’।[2] জুরজানী বলেন,التوفيق: جعل الله فعل عباده موافقًا بما يحبه ويرضاه، ‘আল্লাহ যা পসন্দ করেন ও যাতে সন্তুষ্ট হন স্বীয় বান্দার কর্মকান্ড সে অনুযায়ী নির্ধারণ করার নাম তাওফীক্ব’।[3] আহমাদ মুখতার ওমর বলেন, আল্লাহ কাউকে তাওফীক্ব দিয়েছেন, এর অর্থ হ’ল,جعل الله تعالى قول العبد وفعله موافقين لأمره ونهيه، ‘আল্লাহ বান্দার কথা ও কাজকে তাঁর আদেশ-নিষেধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করেছেন’।[4]

মোটকথা তাওফীক্ব হচ্ছে এক ধরনের গায়েবী সাহায্য, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয় বান্দার অবস্থাভেদে। কখনো তার চিন্তা-চেতনায়, কখনো তার মন-মানসিকতা ও অনুভূতিতে, কখনো তার কর্মকান্ড ও শারীরিক সক্ষমতায়, আবার কখনো তার পরিবার-পরিজন ও সামাজিকতায়। আর আল্লাহ যাদেরকে তাওফীক্ব দান করেন, তাদেরকে বলা হয় ‘মুওয়াফ্ফাক্ব’ বা তাওফীক্বপ্রাপ্ত বান্দা। এক আছারে বর্ণিত হয়েছে, ‌لا ‌يَتَوَفَّقُ ‌عَبْدٌ ‌حَتَّى ‌يُوَفِّقَه ‌اللهُ ‘আল্লাহ কোন বান্দাকে তাওফীক্ব না দেওয়া পর্যন্ত সে তাওফীক্বপ্রাপ্ত হ’তে পারে না’।[5]

আর তাওফীক্বের বিপরীত হ’ল (الْخِذْلَانُ) ‘পরিত্যাগ করা, ব্যর্থ করা, নিরাশ করা, ফেলে রাখা’।[6] আল্লাহ বলেন,‌إِنْ ‌يَنْصُرْكُمُ ‌اللهُ ‌فَلَا غَالِبَ لَكُمْ وَإِنْ يَخْذُلْكُمْ فَمَنْ ذَا الَّذِي يَنْصُرُكُمْ مِنْ بَعْدِهِ وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ، ‘যদি আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেন, তবে কেউই তোমাদের উপর জয়লাভ করবে না। আর যদি তিনি তোমাদের পরিত্যাগ করেন, তবে তাঁর পরে কে আছে যে তোমাদের সাহায্য করবে? অতএব মুমিনদের উচিত আল্লাহর উপরেই ভরসা করা’ (আলে ইমরান ৩/১৬০)। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম জাওযিয়্যাহ (রহঃ) বলেন,كل خير فأصله بِتَوْفِيق الله للْعَبد وكل شَرّ فأصله خذلانه لعَبْدِهِ، ‘বান্দার জন্য আল্লাহর তাওফীক্বই হচ্ছে সকল কল্যাণের মূল উৎস। আর বান্দাকে পরিত্যাগ করাই তার যাবতীয় অকল্যাণের মূল কারণ’।[7] তিনি আরো বলেন,‌أَنَّ ‌التَّوْفِيقَ ‌هُوَ ‌أَنْ ‌لَا ‌يَكِلَكَ اللهُ إِلَى نَفْسِكَ، وَأَنَّ الْخِذْلَانَ هُوَ أَنْ يُخَلِّيَ بَيْنَكَ وَبَيْنَ نَفْسِكَ، ‘তাওফীক্ব হচ্ছে আল্লাহ আপনাকে আপনার নিজের উপরে সোপর্দ করবেন না (বরং আপনাকে সাহায্য করবেন)। আর ব্যর্থতা হচ্ছে আল্লাহ আপনাকে আপনার উপরেই ছেড়ে দিবেন (কোন সাহায্য করবেন না)’।[8] যেমন কঠিন মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আল্লাহর কাছে তাওফীক্ব কামনা করে দো‘আ করতেন,اللَّهُمَّ رَحْمَتَكَ أَرْجُو، فَلَا تَكِلْنِي إِلَى نَفْسِي طَرْفَةَ عَيْنٍ، وَأَصْلِحْ لِي شَأْنِي كُلَّهُ، لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ، ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার রহমতের আশা করি। অতএব তুমি মুহূর্তের জন্যও আমাকে আমার নিজের উপর সোপর্দ করো না এবং আমার সার্বিক অবস্থা সংশোধন করে দাও। তুমি ব্যতীত প্রকৃত কোন মা‘বূদ নেই’।[9]

তাওফীক্বের উৎস :

তাওফীক্বের উৎস কেবল আল্লাহ রাববুল আলামীন। অর্থাৎ তাওফীক্ব আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। এতে বান্দার কোন হাত নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চাচা আবূ তালেব যখন মৃত্যু শয্যায়, তখন তিনি বারবার স্বীয় চাচাকে ইসলাম গ্রহণ করতে বলেন। কিন্তু আল্লাহ তাওফীক্ব না দেওয়ায় আবূ তালেব ইসলাম কবুল করতে পারেননি। আল্লাহ বলেন,إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللهَ يَهْدِي مَن يَشَاء وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِين، ‘নিশ্চয়ই তুমি হেদায়াত করতে পারো না যাকে তুমি ভালবাস। বরং আল্ল­াহই যাকে চান তাকে হেদায়াত দান করে থাকেন। আর তিনিই হেদায়াত প্রাপ্তদের সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৬)। আল্লাহ বলেন,‌وَمَنْ ‌يَهْدِ ‌اللهُ ‌فَمَا ‌لَهُ ‌مِنْ ‌مُضِلٍّ، ‘আর আল্লাহ যাকে পথ দেখান, তাকে পথভ্রষ্টকারী কেউ নেই’ (যুমার ৩৯/৩৭)। ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) বলেন, ومن يوفِّقه الله للإيْمان به، والعمل بكتابه، فما له من مضلّ، ‘আল্লাহ যাকে তাঁর প্রতি ঈমান এনে তাঁর কিতাব অনুযায়ী আমল করার তাওফীক্ব দান করেন, তাকে পথভ্রষ্ট করার কেউ নেই’।[10] সাঈদ ইবনে ওয়াহাফ আল-কাহত্বানী (রহঃ) বলেন,أن هداية التوفيق والتسديد والتثبيت بيد الله تعالى، فلا يهتدي مهتدٍ، ولا يهديه هادٍ إلا بتوفيق الله عز وجل، ‘তাওফীক্ব, সৎপথ ও অবিচলতার হেদায়াত একমাত্র আল্লাহর হাতে। মহান আল্লাহর তাওফীক্ব ছাড়া কোন হেদায়াত প্রত্যাশী হেদায়াত লাভ করতে পারে না এবং কোন পথপ্রদর্শকও তাকে পথ দেখাতে পারে না’।[11] হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, أن النعم كلها من الله وحده؛ نِعم الطاعات ونِعم اللَّذَّات، فترغب إليه أن يُلهمك ذكرَها ويُوزِعَك شكرَها... تلك النعم منه ومن مجردِ فضله؛ فذِكرُها وشكرُها لا يُنال إلَّا بتوفيقه، ‘আল্লাহর আনুগত্যের নে‘মত ও (ইবাদত ও খাবারের) স্বাদ আস্বাদনের নে‘মত সহ প্রত্যেক নে‘মত একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। সুতরাং আপনি তাঁর কাছেই প্রত্যাশা করবেন যেন তিনি আপনার অন্তরে সেই অনুগ্রহরাজিকে স্মরণ করার এবং এর শুকরিয়া আদায়ের তাওফীক্ব দান করেন। এসকল নে‘মতরাজি তাঁর একক কর্তৃত্ব থেকেই আসে। ফলে তাঁর তাওফীক্ব ছাড়া এসব নে‘মতের স্মরণ ও শুকরিয়া আদায় করাও সম্ভব হয় না’।[12] অর্থাৎ তাওফীক্বের মাধ্যমে আল্লাহ বাহ্যিক কোন নে‘মত প্রদান করেন যেমন আমাদের অনুগ্রহ করেন, তেমনি তাঁর প্রিয় বান্দাকে সেই নে‘মতের শুকরিয়া আদায়েরও তাওফীক্ব দান করেন। সুতরাং আমাদের অন্তরে আল্লাহর আনুগত্য, যিক্র ও শুকরিয়া আদায়ের যে অনুভূতি জাগ্রত হয়, সেটা তাওফীক্বেরও অন্তর্ভুক্ত। আর এই তাওফীক্ব আসে একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে।

তাওফীক্বের প্রকারভেদ :

তাওফীক্ব মূলত দুই ধরনের যথা- সাধারণ তাওফীক্ব ও বিশেষ ধরনের তাওফীক্ব।

(১) সাধারণ তাওফীক্ব :

সাধারণ তাওফীক্ব হচ্ছে যেটা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টিকূলের সবাইকে দিয়ে থাকেন। যেমন নিঃশ^াস নেওয়ার তাওফীক্ব, সুস্থ থাকার তাওফীক্ব, বেঁচে থাকার তাওফীক্ব। মুসলিম ও কাফেরসহ আল্লাহর সকল সৃষ্টি এই তাওফীক্ব লাভের মাধ্যমে দুনিয়াতে বেঁচে থাকতে পারে। আল্লাহর তাওফীক্ব না হ’লে কেউ দুনিয়াতে সুস্থ ও নিরাপদে বসবাস করতে পারত না, নির্বিঘ্নে নিঃশ^াস নিতে পারত না, হাঁটা-চলা করতে পারত না, নিজেদের আহার্য জোগাড় করতে পারত না। মূলতঃ এই তাওফীক্ব আল্লাহর সৃষ্টি হিসাবে সবাই পেয়ে থাকে।

(২) বিশেষ ধরনের তাওফীক্ব :

এই তাওফীক্ব শুধু আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ নে‘মত হিসাবে পেয়ে থাকেন। যেমন- হেদায়াত লাভ করার তাওফীক্ব, ঈমান আনা, আল্লাহভীরুতা ও নেক আমল করার তাওফীক্ব, হালাল রূযী ও বরকত লাভ করার তাওফীক্ব ইত্যাদি। আল্লাহ বলেন, مَنْ يَهْدِ اللهُ فَهُوَ الْمُهْتَدِي، ‘আল্লাহ যাকে সুপথ প্রদর্শন করেন, সেই-ই সুপথপ্রাপ্ত হয়’ (কাহফ ১৮/১৭)। অত্র আয়াতের তাফসীরে মুফাসসিরগণ বলেন,مَنْ ‌يُوَفِّقُهُ ‌اللهُ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى لِسُلُوكِ سَبِيلِ الْهُدَى بِاسْتِعْمَالِ عَقْلِهِ وَحَوَاسِّهِ، بِمُقْتَضَى سُنَّةِ الْفِطْرَةِ وَإِرْشَادِ الدِّينِ، فَهُوَ الْمُهْتَدِي، ‘মহান আল্লাহ যাকে দ্বীনের সঠিক দিকনির্দেশনা ও ফিৎরাতের স্বভাব অনুযায়ী ইন্দ্রীয়লব্ধ ও অর্জিত জ্ঞানের আলোকে সঠিক পথে চলার তাওফীক্ব দান করেন, সেই হেদায়াতপ্রাপ্ত’।[13] যুহায়লী (রহঃ) বলেন, من يهد الله بالتوفيق، فهو المهتدي ‘আল্লাহ যাকে তাওফীক্বের মাধ্যমে হেদায়াত দান করেন, সে-ই সুপথপ্রাপ্ত’।[14] ফলে যারা হেদায়াতের পথে পরিচালিত হয় না, তারা তাওফীক্ব থেকে বঞ্চিত। তাওফীক্ব লাভ না করার কারণেই মূলতঃ তারা বিপথগামী হয়।[15] মোটকথা মুমিন বান্দা আল্লাহর পক্ষ থেকে ঈমান, আমল ও তাক্বওয়াসহ কোন নেক আমল বা ইবাদত করার যে সামর্থ্য ও সক্ষমতা লাভ করেন, সেটাই বিশেষ ধরনের তাওফীক্ব। এমনকি কোন বান্দা যখন সৎ আমলের নিয়ত করতে পারে, সেটাও তাওফীক্ব লাভ করার করণেই হয়। যেমন পুণ্যবান সালাফদের যখন কোন নেক আমলের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হ’ত। তখন তারা বলতেন, ‘আল্লাহ আমাকে এই আমলে নিয়ত করার তাওফীক্ব দিলে আমি তা করব’।[16]

এই ধরনের তাওফীক্বপ্রাপ্ত বান্দার বৈশিষ্ট্য হ’ল তাকে যদি দুনিয়াবী পদ-মর্যাদা প্রদান করা হয়, তবে তিনি সেই পদ-মর্যাদাকে আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক কাজে, দ্বীনের সহযোগিতায় এবং মুসলিম ভাইয়ের কল্যাণে ব্যবহার করেন। তাকে যদি অর্থ-সম্পদ প্রদান করা হয়, তিনি সেই সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহর অনুগত্যে ব্যয় করেন। মূলত মহান আল্লাহ বিভিন্নভাবে বান্দাকে পরীক্ষা করে থাকেন। তাওফীক্বপ্রাপ্ত বান্দা সেই পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হ’তে পারে। কেননা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত সবকিছুর জন্য সে শুকরিয়া আদায় করে। অপরদিকে তাওফীক্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ার লক্ষণ হ’ল, আল্লাহর নে‘মতপ্রাপ্ত হওয়ার পরেও তার অবাধ্যতা করা এবং তার সাথে কুফরী করা।[17]

তাওফীক্বের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

(১) প্রত্যেক বান্দা আল্লাহর তাওফীক্বের মুখাপেক্ষী :

পৃথিবীর সকল মানুষ তাওফীক্বের মুখাপেক্ষী। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে পারা তাওফীক্বপ্রাপ্ত হওয়ার নমুনা। কেননা আল্লাহর তাওফীক্ব অর্জন ছাড়া কেউ ঈমান আনতে পারে না এবং ছিরাতে মুস্তাক্বীমে চলতে পারে না। জনৈক সালাফকে জিজ্ঞাসা করা হ’ল,‌ما ‌الشيء ‌الذي ‌لا ‌يستغني ‌عنه ‌المرء ‌في ‌كل ‌حال؟ ‘মানুষ সর্বদা কোন জিনিসের মুখাপেক্ষী থাকে? জবাবে তিনি বলেন, মানুষ সর্বদা তাওফীক্বের মুখাপেক্ষী থাকে’।[18] আমীন আব্দুল্লাহ শাক্বাভী বলেন,إِنّ توفيق الله عز وجل لا غنى للعبد عنه، لا في الدنيا ولا في الاخرة، فمن وفقه الله فقد أفلح وفاز، وأعلى مراتب توفيق الله لعبده: أن يحبِّب إليه الإِيمان والطاعة، ويُكرِّه إليه الكفر والمعصية، وهي المرتبة التي نالها أَصحاب النبي صلى الله عليه وسلم، ‘দুনিয়াতে ও আখেরাতে বান্দা সর্বদা আল্লাহর তাওফীক্বের মুখাপেক্ষী। আল্লাহ যাকে তাওফীক্ব দান করেন, সে সফল ও কৃতকার্য হয়। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওফীক্ব লাভের সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে ঈমান ও আল্লাহর আনুগত্য বান্দার কাছে প্রিয়তর হওয়া এবং কুফরী ও পাপাচার ঘৃণার্হ হওয়া। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ এই স্তরের তাওফীক্ব লাভে ধন্য হয়েছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন, وَاعْلَمُوا أَنَّ فِيكُمْ رَسُولَ اللهِ لَوْ يُطِيعُكُمْ فِي كَثِيرٍ مِّنَ الْأَمْرِ لَعَنِتُّمْ وَلَكِنَّ اللهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ الْإِيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ وَكَرَّهَ إِلَيْكُمُ الْكُفْرَ وَالْفُسُوقَ وَالْعِصْيَانَ أُولَئِكَ هُمُ الرَّاشِدُونَ، ‘আর তোমরা জেনে রেখ যে, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছেন। যদি তিনি বহু বিষয়ে তোমাদের কথা মেনে নেন, তাহ’লে তোমরাই কষ্টে পতিত হবে। বরং আল্লাহ তোমাদের নিকট ঈমানকে প্রিয় করেছেন এবং তোমাদের অন্তরে একে সুশোভিত করেছেন। আর কুফরী, ফাসেকী ও অবাধ্যতাকে তোমাদের নিকট অপ্রিয় করেছেন। বস্ত্ততঃ এরাই হ’ল সুপথ প্রাপ্ত’ (হুজুরাত ৪৯/৭)[19]

হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, অত্র আয়াতে আল্লাহ মুমিন বান্দাদের সম্বোধন করে বলেছেন, لَوْلَا تَوْفِيقُهُ لَكُمْ ‌لَمَا ‌أَذْعَنَتْ ‌نُفُوسُكُمْ ‌لِلْإِيمَانِ، ‘আল্লাহর তাওফীক্ব যদি না হ’ত, তবে তোমাদের অন্তরগুলো ঈমানের জন্য বিগলিত হ’ত না’।[20] মূলতঃ তাওফীক্ব ছাড়া মুমিন বান্দা আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন নে‘মত লাভ করতে পারে না। আল্লাহকে স্মরণ করা ও তাঁর নেম‘তের শুকরিয়া আদায়ের অনুভূতি জাগ্রত হওয়া, সবকিছু তাওফীক্ব লাভের কারণেই হয়ে থাকে। সুতরাং তাওফীক্ব অর্জন করার জন্য প্রত্যেক বান্দাকে আল্লাহর প্রতি বিনীত হওয়া উচিত।[21]

(২) তাওফীক্ব প্রাপ্ত বান্দা আমৃত্যু নেক আমল করার সুযোগ পায় :

মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে নেক আমলে ব্যস্ত থাকতে পারা সৌভাগ্যের আলামত। কেননা বান্দার জীবনের শেষ আমলের মাধ্যমে তাকে সৌভাগ্যবান অথবা দুর্ভাগা বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ তার মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তের আমল যদি ভালো হয়, তবে সে আল্লাহর পুণ্যবান বান্দা হিসাবে বিবেচিত হন, আর যদি সারা জীবন ভালো আমল করেও শেষ আমল খারাপ হয়ে যায়, তবে তিনি আল্লাহর কাছে খারাপ বান্দা হিসাবে বিবেচিত হন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ العَبْدَ لَيَعْمَلُ عَمَلَ أَهْلِ النَّارِ وَإِنَّهُ مِنْ أَهْلِ الجَنَّةِ، وَيَعْمَلُ عَمَلَ أَهْلِ الجَنَّةِ وَإِنَّهُ مِنْ أَهْلِ النَّارِ، وَإِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالخَوَاتِيْمِ، ‘কোন বান্দা জাহান্নামীদের মত আমল করতে থাকে, অথচ সে জান্নাতী। আবার কেউ জান্নাতীদের মত আমল করে, অথচ সে জাহান্নামী। কেননা সর্বশেষ আমলের ভিত্তিতেই মানুষের ভালো-মন্দ নির্ধারিত হয়’।[22] ব্যাপারটা খুবই স্পর্শকাতর ও ঝুকিপূর্ণ। কারণ এখন হয়ত আমরা ভালো আমলের মাধ্যমে সময় পার করছি। কিন্তু এমনও হ’তে পারে- মৃত্যুর আগে আগে আমরা এই নেক আমলের ধারা অব্যাহত রাখতে অক্ষম হয়ে যেতে পারি। সুতরাং নিজের ইবাদত-বন্দেগী ও নেক আমল নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোন সুযোগ নেই। সেজন্য নেক আমল করার পাশাপাশি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাওফীক্ব লাভের জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে।

আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,إِذَا أَرَادَ اللهُ بِعَبْدٍ خَيْرًا اسْتَعْمَلَهُ، ‘আল্লাহ যখন কোন বান্দার কল্যাণ চান, তখন তাকে দিয়ে ভালো কাজ করিয়ে নেন’। তাকে প্রশ্ন করা হ’লা كَيْفَ يَسْتَعْمِلُهُ يَا رَسُولَ اللهِ؟ ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কিভাবে তার দ্বারা ভালো কাজ করিয়ে নেন? তিনি বললেন, يُوَفِّقُهُ لِعَمَلٍ صَالِحٍ قَبْلَ الـمَوْتِ، ‘মৃত্যুর আগে তাকে ভালো কাজ করার তাওফীক্ব দান করেন’।[23]

অপর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إذا أحبَّ اللهُ عَبدًا عسَّلَه، ‘আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে ভালোবাসেন, তখন তাকে (মানুষের মাঝে) প্রশংসিত করেন’। ছাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করেন, يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا عسَّلَه؟ ‘হে আল্লাহর রাসূল! কিভাবে তাকে প্রশংসিত করেন?’ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, يُوَفِّقُ لَهُ عَمَلًا صَالِحًا بَيْنَ يَدَيْ أَجَلِهِ حَتَّى يَرْضَى عَنْهُ جِيرَانُهُ أَوْ مَنْ حَوْلَهُ، ‘মৃত্যুর আগে তাকে নেক আমল করার তাওফীক্ব দান করেন, ফলে (তার মৃত্যুর সময়) তার প্রতিবেশী ও আশ-পাশের লোকজন সবাই তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকে’।[24] ইমাম মুনযিরী (রহঃ) বলেন, وَفقه الله لعمل صَالح يتحفه بِهِ كَمَا يتحف الرجل أَخَاهُ إِذا أطْعمهُ الْعَسَل، ‘মানুষ যেমন তার ভাইকে আপ্যায়ন করার পর মধু খাওয়ায়, তেমনি আল্লাহ তাঁর বান্দাকে (মৃত্যুর আগে) নেক আমলের তাওফীক্ব দান করেন’।[25]

আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষের উদাহরণ রয়েছে, যারা জীবনভর খারাপ আমল করে; কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে পরিবর্তন হয়ে যায়। তার আমল-আখলাকে আমূল পরিবর্তন দেখা যায়। আল্লাহর ইবাদত ও মানুষের সাথে মু‘আমালাতের ব্যাপারে সে তার ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো সংশোধন করে নেয়। আগে যারা তাকে ঘৃণা করত, মৃত্যুর আগে তাদের মন থেকে ঘৃণা উবে যায়, সেই ব্যক্তির ব্যাপারে তাদের অন্তরে সুধারণা ও ভালোবাসা পয়দা হয়। আর সেও দেহ-মনকে পুরোদমে আল্লাহর অভিমুখী করে দেয় এবং সেই মহাক্ষণের মধ্যেই সে পরপারে পাড়ি জমায়। যার ব্যাপারে এমন অবস্থা ঘটে তিনি মূলতঃ তাওফীক্বপ্রাপ্ত বান্দা। আর তিনি কতই না সৌভাগ্যবান!

আবার এমন অনেক মানুষের নযীর পাওয়া যায়, যাদের প্রথমিক জীবন খুবই গোছালো, পরিপাটি এবং নেক আমলে পরিপূর্ণ ছিল। কিন্তু তার জীবনের শেষ সময়গুলোতে ইবাদতে ভাটা পড়ে। আগে যে উদ্যমে নেক আমল করত, সেই উদ্যমে আর ইবাদত করতে পারে না। মানুষের সাথে তার দূরত্ব তৈরী হয়। মুমিন বান্দাদের থেকে আস্তে আস্তে দূরে চলে যায়। যারা আগে মন থেকে ভালোবাসত, তাদের ভালোবাসাতেও বাধা সৃষ্টি হয়। ফলে তিনি আগের মত প্রতিবেশী ও আশপাশের মানুষের আন্তরিক ভালোবাসা লাভে ব্যর্থ হন। আর এই অবস্থা চলতে চলতে তার জীবনের অবসান ঘটে। জীবনের শেষ বেলায় এমন অবস্থা তৈরী হয় সেই সব লোকের ক্ষেত্রে, যারা আল্লাহর তাওফীক্ব লাভে ব্যর্থ হয়েছে এবং যাদেরকে তাওফীক্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

(৩) নবী-রাসূলগণ তাওফীক্ব লাভের দো‘আ করেছেন :

তাওফীক্ব এত অপরিহার্য ব্যাপার যে, নবী-রাসূলগণ এটার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন। দুনিয়াবী যিন্দেগী ও পরকালীন জীবনের জন্য প্রত্যেক বান্দা এলাহী তাওফীক্বের মুখাপেক্ষী। যখন শু‘আইব (আঃ)-এর কওম তার দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং তার উপর বিভিন্ন ধরনের অপবাদ আরোপ করেছিল। তখন তিনি বলেছিলেন,‌إِنْ ‌أُرِيدُ إِلَّا الْإِصْلَاحَ مَا اسْتَطَعْتُ وَمَا تَوْفِيقِي إِلَّا بِاللهِ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ أُنِيبُ، ‘আমি আমার সাধ্যমত তোমাদের সংশোধন চাই মাত্র। আর আমার কোনই ক্ষমতা নেই আল্ল­াহর সাহায্য ব্যতীত। আমি তাঁর উপরেই নির্ভর করি এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাই’ (হূদ ১১/৮৮)। ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন,وَمَا تَوْفِيقِي إِلَّا بِاللهِ -এর অর্থ হচ্ছে,ما صرت موفقا هاديا نبيا مرشدا إلا بتأييد الله سبحانه، ‘আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আমি তাওফীক্বপ্রাপ্ত হেদায়াতপ্রাপ্ত পথপ্রদর্শক নবী হ’তে পারি না’।[26] জামালুদ্দীন ক্বাসেমী বলেন, এর অর্থ হচ্ছে- وما كوني موفقا للإصلاح إلا بمعونة الله وتأييده، ‘আর আমি আল্লাহর সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া (সমাজ) সংস্কারের তাওফীক্ব লাভ করতে পারি না’।[27] অর্থাৎ নবী-রাসূলগণ নিজ প্রচেষ্টায় হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারেন না এবং সংস্কারের কাজ করতে পারে না; যতক্ষণ না আল্লাহ তাদের তাওফীক্ব দান করেন।[28]

মহান আল্লাহ সুলায়মান (আঃ)-কে যে রাজত্ব দান করেছিলেন, পৃথিবীর আর কেউ সেটা লাভ করতে পারেনি এবং পারবেও না। মানুষ তো বটেই, জিনদের উপরেও তিনি ক্ষমতাবান ছিলেন। বাতাস তার হুকুম মেনে চলত। তিনি পশু-পাখি ও পিঁপড়ার ভাষা বুঝতেন। এই ক্ষমতাধর পয়গাম্বরও আল্লাহর নে‘মতের শুকরিয়া ও নেক আমল করার তাওফীক্ব চেয়ে আল্লাহর কাছে কাতর কণ্ঠে প্রার্থনা করতেন। মহান আল্লাহ সেই দো‘আটি পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন,‌رَبِّ ‌أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَدْخِلْنِي بِرَحْمَتِكَ فِي عِبَادِكَ الصَّالِحِينَ، ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমাকে সামর্থ্য দাও, যাতে আমি তোমার নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে দান করেছ। আর যাতে আমি এমন সৎকর্ম করতে পারি, যা তুমি পসন্দ কর এবং আমাকে তোমার অনুগ্রহে তোমার সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত কর’ (নামল ২৭/১৯)। আব্দুর রহমান বিন নাছের আস-সা‘দী (রহঃ) বলেন, আলোচ্য আয়াতে ‘আমাকে সামর্থ্য দাও’ (‌أَوْزِعْنِي)-এর অর্থ হচ্ছে, ألهمني ووفقني ‘আমার অন্তরে এলহাম কর এবং আমাকে তাওফীক্ব দান কর’। এই দো‘আর মাধ্যমে সুলায়মান (আঃ) আল্লাহর কাছে তাওফীক্ব কামনা করেছেন, যেন তিনি দ্বীন-দুনিয়ার ব্যাপারে তার উপর এবং তার পিতা-মাতার উপর আল্লাহ প্রদত্ত সকল নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে পারেন এবং আল্লাহর তাওফীক্বপ্রাপ্ত বান্দা হয়ে তাঁর সন্তুষ্টিমূলক নেক আমলসমূহ ইখলাছের সাথে সম্পাদন করতে পারেন’।[29]

আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) নিয়মিত আল্লাহর কাছে তাওফীক্ব কামনা করতেন।[30] তিনি আমাদেরকে প্রত্যেক ফরয ছালাতের পরে নে‘মতের শুকরিয়া এবং সুন্দরভাবে নেক আমল করার তাওফীক্ব চেয়ে আল্লাহর কাছে দো‘আ করার অছিয়ত করেছেন। তিনি মু‘আয ইবনে জাবাল (রাঃ)-কে বলেন, ‘হে মু‘আয! আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে ভালবাসি। কথাটি তিনি দুই বার বললেন। তারপর বললেন, ‘হে মু‘আয! আমি তোমাকে অছিয়ত করছি, অবশ্যই তুমি প্রত্যেক ছালাতের পরে এই দো‘আটি পাঠ করা ছাড়বে না, اللَّهُمَّ أَعِنِّي عَلَى ذِكْرِكَ، وَشُكْرِكَ، وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ، ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তোমার যিক্র করার, শুকরিয়া আদায়ের এবং সুন্দর ইবাদত করতে সাহায্য কর’।[31] এই দো‘আতে আল্লাহর আনুগত্যের তাওফীক্ব কামনা করা হয়েছে এবং মু‘আয (রাঃ)-এর মাধ্যমে উম্মতের সবাইকে ফরয ছালাতের পরে এই দো‘আটি পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মূলত পবিত্র কুরআন এবং ছহীহ হাদীছে যতগুলো দো‘আ বর্ণিত হয়েছে, সবগুলোতেই আল্লাহর কাছে তাওফীক্ব কামনা করা হয়। কেননা তাওফীক্ব হচ্ছে আল্লাহর গায়েবী সাহায্য, যেটা ছাড়া পৃথিবীর কোন মানুষ এক মুহূর্ত বেঁচে থাকতে পারবে না। মুমিন বান্দা হেদায়াতের উপরে অবিচল থাকতে পারবে না, ইবাদত-বন্দেগী করার সামর্থ্য অর্জন করতে পারবে না, পাপ থেকে বেঁচে থাকতে পারবে না, শয়তানের উপর বিজয়ী হ’তে পারবে না। সেজন্য আমরা নিজের বা অপরের জন্য দো‘আ করার সময় বলে থাকি, ‘আল্লাহ আমাকে এটা করার তাওফীক্ব দিন’, ‘আল্লাহ আপনাকে সেটা করার তাওফীক্ব দান করুন’ ইত্যাদি।

(৪) তাওফীক্ব বান্দার প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত : আল্লাহ যাকে ভালবাসেন, সে পাপ কাজে জড়িয়ে পড়লে তাকে তওবা করার এবং ক্ষমা প্রার্থনার তাওফীক্ব দান করেন। আর আল্লাহ যাকে পসন্দ করেন না, তার অন্তরে অনুশোচনার অনুভূতি সৃষ্টি করেন না। তখন সে পাপকে তুচ্ছজ্ঞান করে এবং পাপাচারে অটল থাকে। ফলে তওবা-ইস্তিগফারের তাওফীক্ব থেকে সে বঞ্চিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন,يُدْخِلُ مَنْ يَشاءُ فِي رَحْمَتِهِ وَالظَّالِمِينَ أَعَدَّ لَهُمْ عَذاباً أَلِيماً، ‘তিনি যাকে ইচ্ছা স্বীয় অনুগ্রহের মধ্যে দাখিল করেন। আর যালেমদের জন্য তিনি প্রস্ত্তত রেখেছেন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (দাহর ৭৬/৩১)। মুফাসসিরগণ বলেন,يُدْخِلُ مَنْ يَشاءُ فِي رَحْمَتِهِ أي بأن ‌يوفّقه ‌للتوبة فيتوب فيدخل الجنة، ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা স্বীয় অনুগ্রহে প্রবেশ করান’ এর অর্থ হচ্ছে, তাকে তওবা করার তাওফীক্ব দান করেন। অতঃপর তার তওবা কবুল করে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান’।[32]

অনুরূপভাবে আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে কিছু দান করতে চান, তখন সেটার জন্য তাকে দো‘আ করার অনুভূতি দান করেন। ফলে সে আল্লাহর কাছে দো‘আ করে, আর আল্লাহ তার দো‘আ কবুল করে তাকে সেটা দান করেন। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, ‌إِنِّي ‌لَا ‌أَحْمِلُ ‌هَمَّ ‌الْإِجَابَةِ، وَلَكِنْ أَحْمِلُ هَمَّ الدُّعَاءِ، فَإِذَا أُلْهِمْتُ الدُّعَاءَ عَلِمْتُ أَنَّ الْإِجَابَةَ مَعَهُ، ‘আমি দো‘আ কবুল হওয়ার চিন্তা করি না; বরং আমি দো‘আ করতে পারব কি-না সেই চিন্তা করি। কেননা যখন আমাকে দো‘আ করার অনুভূতি দান করা হয়, তখন আমি বুঝে নেই- আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করার জন্যই আমাকে দো‘আ করার অনুভূতি দেওয়া হয়েছে’।[33] ওমর (রাঃ) আরো বলেন, ‌توفيق ‌قليل ‌خير ‌من ‌مال ‌كثير، ‘সামান্য তাওফীক্ব অঢেল সম্পদের চেয়ে কল্যাণকর’।[34]

হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,فإذا كان كل خيرٍ فأصله التوفيق، وهو بيد الله لا بيد العبد؛ فمفتاحه الدعاء والافتقارُ وصدقُ اللَّجأ والرغبة والرهبة إليه؛ فمتى أعطى العبدَ هذا المفتاحَ فقد أراد أن يفتح له، ومتى أضله عن المفتاح بقي باب الخير مُرْتَجًا دونه، ‘প্রত্যেক কল্যাণের মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে তাওফীক্ব, যা কেবল আল্লাহর হাতেই রয়েছে, কোন বান্দার হাতে নয়। আর এই কল্যাণের চাবিকাঠি হচ্ছে, দো‘আ, আল্লাহর মুখাপেক্ষী হওয়া, একনিষ্ঠতার সাথে তাঁর অভিমুখী হওয়া এবং তাঁর আশ্রয় গ্রহণ করা। আল্লাহ যখন বান্দার জন্য কল্যাণের দুয়ার খুলতে চান, তখন তাকে এই চাবি দিয়ে দেন। আর যখন তাকে কল্যাণের চাবি থেকে বঞ্চিত করেন, তখন তার জন্য কল্যাণের দরজা দিয়ে বের হওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে যায়’।[35] তিনি আরো বলেন, أَنَّ الْأَعْمَالَ الصَّالِحَةَ مِنْ تَوْفِيقِ اللهِ وَفَضْلِهِ وَمَنِّهِ، وَصَدَقَتِهِ عَلَى عَبْدِهِ، إِنْ أَعَانَهُ عَلَيْهَا وَوَفَّقَهُ لَهَا، وَخَلَقَ فِيهِ إِرَادَتَهَا وَالْقُدْرَةَ عَلَيْهَا، وَحَبَّبَهَا إِلَيْهِ، وَزَيَّنَهَا فِي قَلْبِهِ وَكَرَّهَ إِلَيْهِ أَضْدَادُهَا، ‘নেক আমল সমূহ বান্দার প্রতি আল্লাহর তাওফীক্ব, অনুগ্রহ, দয়া ও অনুকম্পার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ যখন বান্দাকে সৎকাজের ব্যাপারে সাহায্য করতে চান, তখন তাকে সেই আমল করার তাওফীক্ব দান করেন। সেই কাজের ব্যাপারে তার ইচ্ছা জাগিয়ে দেন এবং শারীরিক সামর্থ্য দান করেন। ঐ আমলকে তার কাছে প্রিয় ও তার অন্তরে সুশোভিত করে তোলেন। আর সেই আমলের বৈপরীত্বকে তার কাছে অপসন্দনীয় করে দেন’।[36]

(৫) তাওফীক্ব থেকে বঞ্চিত করে বান্দাকে শাস্তি দেওয়া হয় :

তাওফীক্ব দানের মাধ্যমে আল্লাহ যেমন তাঁর বান্দার প্রতি অনুগ্রহ করেন, ঠিক তেমনি তাওফীক্ব থেকে বঞ্চিত করে শাস্তি প্রদান করেন। বান্দাকে যখন তাওফীক্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়, তখন সে খুব সহজেই পাপ কাজে জড়িয়ে পড়ে, শয়তানের ওয়াসওয়াসায় প্রভাবিত হয়ে যায়। ফলে সেই পাপের প্রভাবে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। পার্থিব জীবনে ও আখেরাতে সে শাস্তির উপযুক্ত হয়ে যায়। মূলতঃ বান্দা যখন আল্লাহর রেযামন্দির সীমানা থেকে ছিঁটকে পড়ে, তখন সে নেক আমলের তাওফীক্ব থেকে ঝরে পড়ে, অথচ নেক আমল করার জন্যই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ، ‘যিনি মৃত্যু ও জীবনকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য, কে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সুন্দর আমল করে? আর তিনি মহাপরাক্রান্ত ও ক্ষমাশীল’ (মুলক ৬৭/২)। ফক্বীহগণ বলেন,السعيد فيها هو الموفق للطاعة والاستجابة، والشقي فيها الذي ‌حرم ‌التوفيق، ‘সৌভাগ্যবান সেই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহর আনুগত্য ও দো‘আ কবুলের তাওফীক্ব দেওয়া হয়েছে। আর দুর্ভাগা সেই ব্যক্তি, যাকে তাওফীক্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে’।[37] আল্লামা রাগেব ইস্ফাহানী (রহঃ) বলেন,من ‌حرم ‌التوفيق فأهمل نفسه ودسَّاها فقد خاب وخسر، ‘যাকে তাওফীক্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অতঃপর সে তার আত্মাকে লাগামহীন ও কলুষিত করে রেখেছ। ফলে সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে’। যেমন আল্লাহ বলেন, قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا، وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا ‘সফল হয় সেই ব্যক্তি, যে তার নফসকে পরিশুদ্ধ করে এবং ব্যর্থ হয় সেই ব্যক্তি, যে তার নফসকে কলুষিত করে’ (লায়ল ৯১/৯-১০)[38]

হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,والله تعالى يعاقب الكذابَ بأن يُقعِده ويُثبِّطه عن مصالحه ومنافعه، ويُثيِب الصادقَ بأن يوفقه ‌للقيام ‌بمصالح دنياه وآخرته؛ ‘মহান আল্লাহ মিথ্যাবদীদেরকে কল্যাণকর ও উপকারী কাজ থেকে বিরত রেখে তাদের শাস্তি দেন। আর সত্যাশ্রয়ী বান্দাকে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণকর কাজ করার তাওফীক্ব দিয়ে তাকে পুরস্কৃত করেন’।[39]

সম্মানিত পাঠক! আমাদের জীবন চলার পথে প্রতি পদে তাওফীক্বের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। পার্থিব কল্যাণ হাছিলে এবং পরকালীন জীবনে সফল হ’তে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওফীক্ব নামক গায়েবী সাহায্যের প্রয়োজন। তাওফীক্ব থেকে বঞ্চিত হ’লে আমাদের জীবন ভুল-ত্রুটিতে সয়লাব হয়ে যাবে। ফলে আমরা কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হব এবং বিভিন্ন ধরনের শাস্তির সম্মুখীন হব। মুহাম্মাদ হুসাইন ইয়া‘কূব বলেন, اعلم أخي التائب! أنّ العبد إذا ‌حرم ‌التوفيق يجد في كل خطوة عثرة، ‘হে তওবাকারী ভাই! জেনে রেখ! বান্দাকে যখন তাওফীক্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়, তখন তার পায়ে পায়ে ভুল-ত্রুটি দেখা দেয়’।[40] অতএব মহান আল্লাহ আমাদেরকে সার্বিক কল্যাণ ও মঙ্গলের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ

এমফিল গবেষক, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


[1]. মুরতাযা আয-যুবাইদী, তাজুল ‘আরূস মিন জাওয়াহিরিল ক্বামূস ২৬/৪৭৯।

[2]. আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব ২/১০৪৭।

[3]. জুরজানী, আত-তা‘রীফাত, পৃ. ৬৯।

[4]. মু‘জামুল লুগাতিল আরাব্যিাহ আল-মু‘আছিরাহ ৩/২৪৭৪।

[5]. খলীল আহমাদ আল-ফারাহিদী, কিতাবুল আইন ৫/২২৬।

[6]. ড. ফজলুর রহমান, আল-মু‘জামুল ওয়াফী (ঢাকা : রিয়াদ প্রকাশনী, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, ২০০৯) পৃ. ৪৩৭।

[7]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ ১/১৪১।

[8]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালিকীন, ১/৪১৫।

[9]. আবূদাঊদ হা/৫০৯০; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৭০১; মিশকাত হা/২৪৪৭, সনদ হাসান।

[10]. তাফসীরে ত্বাবারী (জামে‘উল বায়ান) ২১/২৯৫।

[11]. কাহত্বানী, আল-হুদা আন-নববী, পৃ. ৩২।

[12]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ ১/২৯৬।

[13]. মুহাম্মাদ রাশীদ যিয়া, তাফসীরুল মানার ৯/৩৪৯।

[14]. আত-তাফসীরুল মুনীর ১৫/২১২।

[15]. ইবনে আশূর, আত-তাহরীর ওয়াত তানবীর, ৯/১৮০।

[16]. আবূ হামিদ গাযালী, ইহয়াউ উলূমিদ্দীন ৪/৩৭৪।

[17]. আমীন ইবনে আব্দুল্লাহ আশ-শাক্বাভী, মাওসূআতুত দুরার আল-মুনতাক্বাত ১/৩১।

[18]. রাগেব ইস্ফাহানী, মুহাযারাতুল উদাবা ১/৫৩১।

[19]. শাক্বাভী, মাওসূআতুত দুরার আল-মুনতাক্বাত ১/২৯।

[20]. মাদারিজুস সালিকীন ১/৪১৬।

[21]. মুহাম্মাদ ইবরাহীম আত-তুওয়াইজিরী, মাওসূ‘আতু ফিক্বহিল কুলূব ২/১২১৩।

[22]. বুখারী ৬৬০৭; মুসলিম ১১২; মিশকাত হা/৮৩।

[23]. তিরমিযী হা/২১৪২; ছহীহুত তারগীব হা/৩৩৫৭; মিশকাত হা/৫২৮৮, সনদ ছহীহ।

[24]. মুস্তাদরাকে হাকেম হা/১২৫৮; ছহীহুত তারগীব হা/৩৩৫৮, সনদ ছহীহ।

[25]. আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ৪/১২৬।

[26]. শাওকানী, তাফসীরে ফাৎহুল ক্বাদীর ২/৫৮৯।

[27]. তাফসীরে ক্বাসেমী (মাহাসিনুত তা’বীল) ৬/১২৬।

[28]. তাফসীরে ত্বাবারী (জামে‘উল বায়ান) ১৫/৪৫৪।

[29]. আব্দুর রহমান বিন নাছের আস-সা‘দী, তাফসীরে সা‘দী (তাফসীরুল কারীমির রহমান), পৃ. ৬০৩।

[30]. আবূদাঊদ হা/৫০৯০; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৭০১; মিশকাত হা/২৪৪৭, সনদ হাসান।

[31]. আবূদাঊদ হা/১৫২২; নাসাঈ হা/১৩০৩; মিশকাত হা/৯৪৯, সনদ ছহীহ।

[32]. আবূ জা‘ফর আন-নাহ্হাস, ই‘রাবুল কুরআন ৫/৭০।

[33]. ইবনু তায়মিয়া, মাজমূ‘উল ফাতাওফা ৮/১৯৩; ইক্বতিযাউছ ছিরাতিল মুস্তাক্বীম ২/২২৯।

[34]. রাগেব ইস্ফাহানী, মুহাযারাতুল উদাবা, ১/৫৩১।

[35]. আল-ফাওয়ায়েদ ১/১৪১।

[36]. মাদারিজুস সালিকীন ১/১১৫।

[37]. ফাতাওয়া আশ-শাবাকাতুল ইসলামিইয়াহ ১/৪৪১।

[38]. রাগেব ইস্ফাহানী, আয-যারী‘আহ ইলা মাকারিমিশ শারী‘আহ, পৃ. ৮২।

[39]. আল-ফাওয়ায়েদ ১/১৯৮।

[40]. মুহাম্মাদ হুসাইন ইয়াকূব, কাইফা আতূবু, পৃ. ৬৯।






বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
সীমালংঘন ও দুনিয়াপূজা : জাহান্নামীদের দুই প্রধান বৈশিষ্ট্য (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
দাঈর সফলতা লাভের উপায় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল
যাকাত ও ছাদাক্বা - আত-তাহরীক ডেস্ক
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত পরিচিতি - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মিথ্যার ধ্বংসাত্মক প্রভাব - ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
পিতা-মাতার উপর সন্তানের অধিকার (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ শফীকুল আলম
বাংলা বানান রীতি ও আমাদের প্রস্তাবনা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ভুল সংশোধনে নববী পদ্ধতি (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
তাহরীকে জিহাদ : আহলেহাদীছ ও আহনাফ (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
মুহাসাবা (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
মানবাধিকার ও ইসলাম (১৫তম কিস্তি) - শামসুল আলম
আরও
আরও
.