মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা

ভূমিকা :

যুগে যুগে পৃথিবীতে বহু মহা মনীষীর আগমন ঘটেছে, যারা দুনিয়াতে অমরকীর্তি রেখে গেছেন। তাদের জীবনগঠন ও শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে তাদের মায়েদের ভূমিকা ছিল অনন্য। আমরা জানি যে, পিতা-মাতার আদর-যত্ন, লালন-পালন ছাড়া কোন সন্তান বড় হ’তে পারে না। প্রতিপালনের এ স্বাভাবিক অবদানের বাইরেও অনেক মা নিজের আদরের সন্তানকে যথাযোগ্য মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য যারপর নেই চেষ্টা করেছেন। তাদের এ অনন্য প্রচেষ্টার মাধ্যমেই অনেক মনীষী ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। মুসলিম উম্মাহর জন্য রেখে গেছেন অসামান্য অবদান। সুতরাং বিগত মহাপুরুষ বিদগ্ধ মনীষীগণের জীবন গঠনে তাদের মায়েদের ভূমিকা কিরূপ ছিল, এ প্রবন্ধে সে বিষয়ে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

আনাস বিন মালিক (রাঃ)-এর মা

আনাস বিন মালিক (রাঃ)-এর মায়ের নাম মুলাইকা বিনতে মিলহান। তার উপাধি ছিল গুমাইছা বা রুমাইছা। তবে তিনি উম্মু সুলাইম নামে প্রসিদ্ধ।

কোন মা যদি উপহার হিসাবে নিজ সন্তানকে নিয়ে গৌরব করতে চান, মুসলিম উম্মাহর উপর নিজ সন্তানকে নিয়ে গর্ব করতে চান, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর গৃহের অংশীজন হিসাবে মুসলিম উম্মাহর উপর ফখর করতে চান তবে সবদিক দিয়েই আনাস বিন মালিক (রাঃ)-এর মায়ের সে অধিকার রয়েছে। আনাস (রাঃ)-এর মা তাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খাদেম হিসাবে তাঁর হাতে সমর্পণ করেছিলেন। এ খেদমতের সুযোগ লাভ যেমন আনাস (রাঃ)-এর জন্য ছিল শ্রেষ্ঠ উপহার তেমনি গোটা মুসলিম জাতির জন্যও তা শ্রেষ্ঠ উপঢৌকন। এ খেদমতের সুযোগ নবী করীম (ছাঃ)-এর হাদীছের হেফাযতের অন্যতম মাধ্যম হয়েছিল। আর এভাবে দ্বীনও সুরক্ষা লাভ করেছিল। বস্ত্তত নবী করীম (ছাঃ)-এর খেদমতের মধ্য দিয়ে আনাস (রাঃ) আমাদের জন্য দু’হাযারের অধিক হাদীছ বর্ণনা করে গেছেন। এমনকি বলতে হয় যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একান্ত নিকটে থাকার দরুন তিনি তাঁর নানাবিধ অবস্থা, কথাবার্তা ও কার্যাবলী সম্পর্কে এমন সব বর্ণনা নকল করেছেন যা অন্য কোন ছাহাবীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। কারণ প্রায় সময় সাথে থাকার ফলে তিনি তাঁর এমন অনেক বিষয় অবহিত হ’তে পেরেছিলেন যা জানার সুযোগ অন্যদের ছিল না।

আনাস (রাঃ)-এর মায়ের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খেদমতের চিন্তা আগে থেকেই বাসা বেঁধেছিল। তাইতো মদীনায় তাঁর শুভাগমনের সাথে সাথে তিনি তা কার্যকর করার আগ্রহে তাঁর নিকট ছুটে যান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও তাঁর আবেদনে তড়িৎ সাড়া দেন এবং তার আগ্রহকে বাস্তবে রূপ দেন।

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মদীনায় পদার্পণ করেন তখন আমার বয়স ছিল আট বছর। আমার মা আমার হাত ধরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট নিয়ে গেলেন। তিনি তাঁকে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আনছারদের এমন কোন নারী-পুরুষ নেই যে আপনাকে কোন না কোন উপঢৌকন দেয়নি। আমার পক্ষে আপনাকে উপঢৌকন দেওয়ার সামর্থ্য নেই, কেবল আমার এই পুত্র ছাড়া। আপনি তাকে গ্রহণ করুন, সে আপনার চাহিদা মতো আপনার খেদমত করবে। তিনি বলেন, তারপর আমি দশ বছর যাবৎ তাঁর খেদমত করেছি। না তিনি আমাকে মেরেছেন, না বকেছেন, না মুখ কালো করেছেন’।[1]

আনাস (রাঃ)-এর মায়ের তোহফা কতই না উত্তম তোহফা! তার হিম্মত কতই না বড় হিম্মত! ঐ মহিমান্বিত মায়ের হিম্মত অনেক উচ্চে, তার আগ্রহ অনেক ঊর্ধ্বে। তিনি চাচ্ছিলেন যে, তার ছেলে এ সম্মানে ভূষিত হবেন এবং কালের প্রবাহে তার এ গৌরব ও ইয্যত অক্ষুণ্ণ থাকবে। মাশাআল্লাহ তার এ চাওয়া পূরণ হয়েছে। বাস্তবিকই যুগ যুগ ধরে আনাস (রাঃ)-এর নাম রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নামের সাথে যুক্ত রয়েছে। তার উপাধি ছিল ‘খাদেমুর রাসূল’। আনাস (রাঃ) নিজের নামের সাথে এ উপাধি উল্লেখ করতেন। এ উপাধি নিয়ে তিনি গৌরব করতেন। অনেক সময় তিনি বলতেন, ‘আমি আশা করি যে, ক্বিয়ামতের দিন আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করব, তারপর তাঁকে বলব, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ আপনার ছোট্ট খাদেম আনাস।[2]

আনাস (রাঃ)-এর মা তার ছেলের প্রতিপালন ও সেবা-যত্নে যথাসাধ্য শ্রম ব্যয় করেছিলেন। ছেলেরূপী তার এ আমানত তিনি দৃঢ়তার সাথে ধারণ করেছিলেন এবং যেদিন তিনি প্রথম দ্বীন ইসলামে দাখিল হন সেদিন থেকে নিয়ে এ আমানত অত্যন্ত নিপুণভাবে রূপায়ণের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। জাহেলী যুগে তিনি ছিলেন মালিক বিন নযরের স্ত্রী। তার ঔরসে আনাস বিন মালিক (রাঃ)-এর জন্ম হয়। তারপর যখন আল্লাহ তা‘আলা নবী করীম (ছাঃ)-কে ইসলামসহ প্রেরণ করলেন তখন যারা ইসলামের ডাকে দ্রুত সাড়া দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে উম্মু সুলাইম ছিলেন অন্যতম। তিনি নিজ কওমের সাথে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং তার স্বামীকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিয়েছিলেন। কিন্তু মালিক ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন এবং স্ত্রীর প্রতি রাগ করে বাড়ি ছেড়ে শাম চলে যান। সেখানেই তার মৃত্যু হয়।[3] উম্মু সুলাইম তাতে মোটেও বিচলিত হননি। সেকালে পুরুষকে পরিবারের খুঁটি ও ভিত্তি ভাবা হ’ত। তারপরও স্বামীকে ছেড়ে ইসলামে অটল থাকা তার ঈমানী দৃঢ়তা, মানসিক স্থিরতা, উঁচু হিম্মত ও সঙ্কল্পে অবিচলতার পরিচয় বহন করে।

উম্মু সুলাইম পুত্র আনাসের প্রতিপালন ও শিক্ষাদীক্ষার দায়িত্ব একাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। এ দায়িত্ব তিনি পুরোপুরি এবং যথাযথই পালন করেছিলেন। তার মতো দায়িত্বশীল মা আর কে আছে, যিনি ছিলেন যথার্থ বুদ্ধিমত্তা ও বিশুদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী?

তার স্বামী আবু ত্বালহার ঔরসে তার গর্ভজাত সন্তান যেদিন মারা যায়, সেদিনে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তাতে তার ঐ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় ফুটে উঠেছে। আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবু ত্বালহার এক ছেলে অসুস্থ ছিল। তাকে রেখে আবু ত্বালহা বাইরে যান। ইত্যবসরে শিশুটি মারা যায়। তিনি বাড়ি ফিরে এসে বললেন, আমার ছেলে কি করছে? উম্মু সুলাইম ছিলেন ঐ শিশুর মা, তিনি বললেন, সে আগের থেকেও শান্তিতে আছে। তারপর তিনি তার সামনে রাতের খাবার হাযির করলেন। তিনি তা খেয়ে নিলেন। পরে স্বামী স্ত্রী দু’জনে মিলিত হন। মিলন শেষে স্ত্রী তাকে বললেন, ছেলেকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করো। সকাল হ’লে আবু ত্বালহা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে গিয়ে সকল বৃত্তান্ত বললেন। তিনি বললেন, তোমরা কি আজ রাতে মিলিত হয়েছিলে? তিনি বললেন, হ্যঁা। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দো‘আ করলেন, হে আল্লাহ! তুমি তাদের দু’জনের মধ্যে বরকত দাও। পরে তিনি একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেন। আবু ত্বালহা তখন আমাকে বললেন, একে নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে নিয়ে যাও। তিনি তার সাথে কয়েকটা খেজুর দিয়ে দেন। নবী করীম (ছাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তার সাথে কি কিছু আছে? তিনি বললেন, হ্যঁা, কয়েকটা খেজুর। তিনি তা নিয়ে দাঁতে চিবালেন এবং নিজের মুখ থেকে বের করে বাচ্চার মুখে দিলেন। এভাবে তার তাহনীক করলেন এবং নাম রাখলেন আব্দুল্লাহ। বুখারীর অন্য বর্ণনায় আছে, বর্ণনাকারী ইবনু উয়াইনা বলেন, আনছারদের এক ব্যক্তি বলেছেন, আমি আব্দুল্লাহর ঔরসজাত নয় জন সন্তানকে দেখেছি, তারা প্রত্যেকেই কুরআনের ক্বারী হয়েছেন।[4]

উম্মু সুলাইম ছিলেন একজন ধৈর্যশীলা মহিলা। সে ধৈর্য ছিল বড়ই বরকতময়। তার প্রজ্ঞাও ছিল উঁচু পর্যায়ের। কিছু ছহীহ বর্ণনায় এসেছে, আনাস (রাঃ)-এর বয়স দশ বছর না হ’তেই তার মা তাকে লেখাপড়া শিক্ষা দেন এবং ভালোভাবে লেখাপড়া রপ্ত না করা অবধি তিনি তাকে নবী করীম (ছাঃ)-এর হাতে সোপর্দ করেননি।

ইমাম আহমাদ স্বীয় মুসনাদে আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-এর মদীনায় পদার্পণকালে উম্মু সুলাইম আমার হাত ধরে আমাকে তাঁর সামনে নিয়ে গেলেন, তারপর বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ আমার ছেলে। এ লেখায় পারদর্শী এক কিশোর। তিনি বলেন, অতঃপর আমি নয় বছর রাসূল (ছাঃ)-এর সেবা-যত্ন করেছি, আমি যা কিছুই করেছি না কেন, তিনি কখনও বলেননি, তুমি খারাপ কাজ করেছ অথবা তুমি যা করেছ কত না নিকৃষ্ট![5]

সেই পবিত্র যামানায় লেখাপড়ার দিক দিয়ে আরবের অবস্থা যে কেমন ছিল তা যারা জানেন তারাই অনুধাবন করতে পারবেন। এই মহীয়সী মা তার সন্তানকে মহিমান্বিত মানুষদের কাতারভুক্ত করতে কতই না ত্যাগ স্বীকার করেছেন! কি আশ্চর্যই না তার এ কাজ!

স্বীয় পুত্র আনাস (রাঃ)-এর উপর উম্মু সুলাইম (রাঃ)-এর এটাও এক মহা অনুগ্রহ যে, তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তিনি পুনরায় বিয়ে করতে অস্বীকার করেন। তার কথা ছিল, আমার আনাস বড় মানুষ হোক, বিভিন্ন মজলিসে অংশগ্রহণ করুক এবং ব্যক্তিত্ববানদের মাঝে কথা বলুক, তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে। তিনি বলতেন, ‘আনাস বড় মানুষ না হওয়া এবং মজলিসে না বসা পর্যন্ত আমি বিয়ে করব না’। আনাস (রাঃ) এ সম্পর্কে বলতেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা আমার মাকে উত্তম প্রতিদান দিন। তিনি আমাকে সুন্দরভাবে প্রতিপালন করেছিলেন’।[6]

সন্তানকে নিয়ে আনাসের মায়ের চাওয়া-পাওয়া তার সন্তানের মধ্যে নিশ্চিত হয়েছিল। তিনি বড় মানুষ হয়েছিলেন, ব্যক্তিত্ববানদের মজলিসে বসেছিলেন এবং সে মজলিসের মধ্যমণি হয়েছিলেন।

চারিদিক থেকে উম্মু সুলাইমকে বিয়ের প্রস্তাব অনেকেই দিয়েছিলেন। ছাহাবী আবু ত্বালহা, যায়দ বিন সাহল আনছারী (রাঃ) ছিলেন তাদের অন্যতম।[7] উম্মু সুলাইম (রাঃ) আবু ত্বালহাকেই বিয়ে করেন। পূর্বের স্বামীর বদলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে উম্মু সুলাইমের স্বামী হিসাবে মনোনীত করেন। তাদের এ বিবাহ ছিল আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন। কেননা আবু ত্বালহা (রাঃ) বিয়ের প্রস্তাবদানকালে কাফের ছিলেন। বুদ্ধিমতী উম্মু সুলাইম তাকে কায়দা করে বলেন, ‘হে আবু ত্বালহা! আপনার মতো মানুষকে তো ফিরিয়ে দেওয়া চলে না। কিন্তু আপনি হ’লেন কাফের, আর আমি মুসলিম। কাফের তো মুসলিমের জন্য হালাল নয়। আপনি যদি ইসলাম গ্রহণ করেন তবে আপনার ইসলাম গ্রহণই আমার বিয়ের মহর হবে। ফলে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইসলাম গ্রহণ তার বিয়ের মহর ধার্য হয়। ছাবেত আল-বুনানী বলেন, আমরা উম্মু সুলাইমের মহর ‘ইসলাম’ থেকে দামী কোন মহরের কথা কোন দিন শুনিনি।[8] এ কারণেই সমগ্র উম্মাতের মাঝে তার মহর সবচেয়ে দামী ও মহতী বলে স্বীকৃত।

তাদের বিয়ে নিয়ে বেশকিছু চিত্তাকর্ষক বর্ণনা আছে। যেমন আবু ত্বালহা (রাঃ) বিয়ের প্রস্তাব দিলে উম্মু সুলাইম (রাঃ) তাকে বলেছিলেন, ওহে আবু ত্বালহা! আপনি কি জানেন না, যে মা‘বূদের আপনি অর্চনা করেন সে মাটি থেকে উদগত গাছ বিশেষ? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, জানি না আবার! তিনি বলেছিলেন, একটা গাছের ইবাদত-অর্চনা করতে আপনার লজ্জা লাগে না? যদি আপনি ইসলাম গ্রহণ করেন তবে আমি ইসলাম গ্রহণ ছাড়া আর কিছু মহর হিসাবে আপনার নিকট দাবী করব না। আবু ত্বালহা এ কথায় তাকে বলেন, আমি আমার দিকটা ভেবে দেখি। তিনি চলে যান এবং একসময় ফিরে এসে বলেন, ‘আশহাদু আল্লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসূলুহ’। তখন উম্মু সুলাইম পুত্র আনাসকে ডেকে বলেন, আনাস আবু ত্বালহার সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দাও। অতঃপর আনাস (রাঃ) তার মাকে আবু ত্বালহা (রাঃ)-এর সাথে বিয়ে দিয়ে দেন।[9]

আল্লাহ তা‘আলা আবু ত্বালহা (রাঃ)-এর উপর বড়ই মেহেরবানী করেছিলেন। ইসলাম গ্রহণ ও উম্মু সুলাইম (রাঃ)-কে বিয়ের ফলে তিনি মদীনার আনছারদের মধ্যে প্রথম সারির (মুক্বাদ্দিমীন) মুসলিম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। হিজরতের পূর্বে মিনার সন্নিকটে আকাবায় যে বায়া‘আত সংঘটিত হয়েছিল তাতে নির্বাচিত ১২জন নকীবের তিনি ছিলেন অন্যতম। বদরসহ অন্যান্য যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। জাহেলী ও ইসলামী যুগে যে ক’জন নামকরা বীরপুরুষ ও তীরন্দায ছিলেন তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে বিখ্যাত।

আবু ত্বালহা (রাঃ) উম্মু সুলাইমের মতো একজন মহিয়সী রমণী ও পুণ্যশীলার বরকতের ভাগীদার হয়েছিলেন। তিনি হ’লেন আনাস (রাঃ)-এর মা, আর এই হ’ল তার বুদ্ধিমত্তা। এমন মহিলা আর কে আছেন যিনি এক্ষেত্রে তার সমকক্ষ হ’তে পারেন?

এমনি দু’জন মহৎ মানুষের মাঝে আনাস (রাঃ) বেড়ে উঠেছিলেন এবং তাদের গৃহে তিনি যেভাবে সাদরে পালিত হয়েছিলেন তাতে তার উঁচু মর্যাদা ও ইসলামের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান লাভের জন্য সেটাই হ’ত যথেষ্ট। কিন্তু এ মর্যাদা ও অবস্থান তো আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খেদমত ও তাঁর হাতে শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে অর্জিত মর্যাদার সাথে তুল্য হ’তে পারে না। স্বয়ং মানবজাতির শিক্ষাগুরুর কাছে রেখে তিনি তার তারবিয়াত করেছিলেন। এমন মর্যাদা খুব কম মানুষের নছীবে জুটেছে।

আনাস (রাঃ) বলেন, দশ বছর অবধি আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খেদমত করেছি। এ সময়ের মধ্যে কখনও তিনি আমার প্রতি বেদনাসূচক কোন শব্দ (যেমন ‘উহ’) উচ্চারণ করেননি। আমি কোন কিছু করে ফেললে বলেননি, এটা কেন করেছ? আবার কোনটা না করলে বলেননি, এটা কেন করনি? তিনি ছিলেন মানবকূলের মধ্যে মহত্তম চরিত্রের অধিকারী। আমার হাত দিয়ে মোটা-মিহি এমন কোন ধরনের রেশম বা অন্য কোন নরম জিনিস ছুঁয়ে দেখিনি, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাতের তালু থেকে বেশী নরম ছিল। এমন কোন মেশক ও আতরও শুঁকতে পাইনি যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ঘাম থেকে অধিক সুগন্ধিযুক্ত ছিল।[10] এমন এক উচ্চতম মানে আনাস (রাঃ) তারবিয়াত লাভ করেছিলেন। এমন গুণ নিয়েই তিনি নবুয়তের মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা সম্পন্ন করেছিলেন।

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীছের ময়দান এবং তার জীবনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শিক্ষার প্রভাব এক প্রশস্ত উর্বর ময়দান, যেখান থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শুধু মণিমুক্তা উদ্গত হবে। একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর খাদেম আনাস (রাঃ)-এর নিকট একটি গুপ্ত কথা বলেন। তারপর তাকে অছিয়ত স্বরূপ বলেন, আল্লাহর রাসূলের গুপ্ত কথা তুমি কাউকে বলে দিও না। পরে আনাস (রাঃ) পথে বের হন। এ সময়ে তিনি ছিলেন ছোট্ট বালক। বালকরা যেমন খেলাধুলা করে তিনিও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। ছোটদের উপর যেমন খেলাধুলার প্রভাব পড়ে তার উপরও তেমনি প্রভাব পড়ত। সেদিন পথে কিছু বালককে তিনি খেলতে দেখতে পান। ফলে তিনিও তাদের সাথে খেলতে লেগে যান। কিছু সময় পর নবী করীম (ছাঃ) তাঁর কোন এক প্রয়োজনে বের হন। তিনি তখন আনাস (রাঃ)-কে খেলতে দেখতে পেয়ে ছেলেদের কাছে এগিয়ে এলেন এবং তাদের সালাম দিলেন। তারপর আনাস (রাঃ)-এর কান ধরে ঠাট্টাচ্ছলে বললেন, এই দুষ্টু, আমি কি তোমাকে একটা কাজে পাঠাইনি? আনাস (রাঃ) ওযরখাহি করে বললেন, আমি ভুলে গিয়েছিলাম। তিনি তখন বললেন, তবে এখন যাও।

পরে তিনি ঘরে গেলে তার মা উম্মু সুলাইম তাকে জিজ্ঞেস করেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলে? তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একটা প্রয়োজনে ব্যস্ত ছিলাম। তার মা বললেন, কি সে প্রয়োজন? তিনি বললেন, এটি একটি গুপ্ত কথা। মা বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর গুপ্ত কথা হেফাযত কর, কাউকে বলে দিও না।

আনাস (রাঃ) নববই বছর বয়সে তার প্রিয় ছাত্র ছাবিত বুনানীকে ঘটনার প্রায় আশি বছর পর এ হাদীছ শুনাতে গিয়ে বলেছিলেন, আল্লাহর কসম! হে ছাবিত, আমি যদি সে গুপ্ত কথা কাউকে ব্যক্ত করতাম তবে তোমাকে তা বলতাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পরে আমি কাউকে তা বলিনি। আমার মা উম্মু সুলাইম আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি তাকেও বলিনি।[11]

নবী করীম (ছাঃ) ও তাঁর খাদেম আনাস (রাঃ)-এর মধ্যে এমন রস-রহস্যের ঘটনা অনেক ঘটেছে। যার সবগুলো থেকে আতরের সুঘ্রাণ ও মেশকের সুগন্ধি ঝরে পড়ে। নবী করীম (ছাঃ) প্রদত্ত শিক্ষা ও তার প্রভাব যে কতটা গভীর ছিল এবং সে শিক্ষাকে পাকাপোক্ত ও স্থায়ী করতে আনাস (রাঃ)-এর মায়ের যে সহযোগিতা তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

তার ছেলের বাড়ী ফিরতে দেরী হয়েছে। সেজন্য মা তাকে জিজ্ঞেস করছেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলে? ছেলে বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একটা প্রয়োজনে ব্যস্ত ছিলাম। মা বললেন, কি সে প্রয়োজন? তিনি বললেন, এটি গোপনীয় কথা। মা তাকে উপদেশ দিলেন, তাহ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর গোপন কথা হেফাযত কর, কাউকে বলে দিও না।

মাতা-পুত্রের কথোপকথনের মধ্যে কত সুন্দর শিষ্টাচারই না ফুটে উঠেছে! সন্তানদের প্রতিপালনে এ এক সুন্দর ও শক্তিশালী পন্থা। এমন প্রতিপালনকারীর মায়ের দেহ আল্লাহ মণিমুক্তায় জড়িয়ে রাখুন। আনাস (রাঃ) দ্বীন ইসলামের যত কিছু উৎসর্গ করেছেন তা সবই তার মায়ের ওযনের পাল্লায় যোগ হবে ইনশাআল্লাহ। কতই না সুন্দর উপহার তাকে দিয়েছিলেন তার মা! কতই না সুন্দর আমল মাতা-পুত্র মিলে দ্বীন ইসলামের কল্যাণে করে গিয়েছেন!

আনাস (রাঃ)-এর মা একাধিকবার তার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দো‘আর উপলক্ষ হয়েছেন। ইমাম মুসলিম আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, একদিন নবী করীম (ছাঃ) আমাদের বাড়িতে এলেন। বাড়িতে তখন আমি, আমার মা ও আমার খালা উম্মু হারাম ছাড়া আর কেউ ছিল না। আমার মা তাঁকে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার এই ছোট্ট খাদেমটার জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করুন। তিনি তখন আমার জন্য সকল প্রকার কল্যাণ চেয়ে দো‘আ করলেন। দো‘আর শেষাংশে তিনি বলেছিলেন, ইয়া আল্লাহ! তুমি তাকে বেশী বেশী করে সম্পদ ও সন্তান দান কর এবং তাতে তাকে বরকত দাও’।[12]

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর হাবীবের দো‘আ কবুল করেছিলেন। আনছারদের মধ্যে আনাস (রাঃ)-ই ছিলেন ধনে-জনে সবার উপরে। তিনি তার জীবদ্দশায় এক শতের উপরে সন্তান ও নাতি-পুতি দেখে গিয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা তাকে দীর্ঘ জীবন দান করেছিলেন। একশ’ তিন বছর তিনি আয়ু পেয়েছিলেন।[13]

নবী করীম (ছাঃ)-এর দো‘আর প্রতি ইঙ্গিত করে আনাস (রাঃ) বলেন, আমি তো দু’টি দো‘আ ফলতে দেখেছি, এখন আমি তৃতীয় দো‘আ ফলবতী হওয়ার অপেক্ষায় আছি। আল্লাহর কসম! আমার সম্পদ অঢেল, আর আমার সন্তান-সন্ততি ও নাতি-পুতির সংখ্যা শ’ ছাড়িয়ে যাবে। এক বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেছেন, আমার আঙুর বাগানে বছরে দু’বার ফল ধরে, আর আমার ঔরসজাত সন্তানের সংখ্যা এক শত ছয় জন।[14]

নবী করীম (ছাঃ) তার কুনিয়াত বা উপনাম রেখেছিলেন ‘আবু হামযাহ’। আনাস (রাঃ)-এর মা ছিলেন ফক্বীহ। ওছমান (রাঃ)-এর নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে তিনি বলেছিলেন, ‘জেনে রাখ, এখন থেকে তারা রক্তপাত ছাড়া আর কিছু দোহন করবে না’।[15] উত্তরকালে ঘটনা এমনই দাঁড়িয়েছিল। এ কথা তার বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে তিনি বেশ কিছু হাদীছ বর্ণনা করেছেন এবং বিভিন্ন হুকুম-আহকাম জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তার উত্তর বলে দিতেন। কেউ ফৎওয়া জিজ্ঞেস করলে নবী করীম (ছাঃ) থেকে যা শুনেছেন তদনুসারে ফৎওয়া দিতেন। তিনি তার ইলম অনুযায়ী আমল করতেন, ইলমের দাবী পূরণে তৎপর থাকতেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মহিলাদের থেকে যেসকল প্রতিশ্রুতি পালনের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন সেগুলো তিনি যথাযথ পালন করে গিয়েছিলেন।

উম্মু আতিয়া (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) আমাদের থেকে বায়‘আত গ্রহণকালে এই প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে, আমরা যেন কারও মৃত্যুতে বিলাপ না করি। কিন্তু আমাদের মধ্যে পাঁচজন ব্যতীত আর কেউ এ প্রতিশ্রুতির উপর অটল থাকতে পারেনি। তারা হ’লেন উম্মু সুলাইম, উম্মুল ‘আলা, আবু সাবিরার কন্যা, মু‘আযের স্ত্রী এবং অন্য আরেকজন মহিলা।[16] প্রথমেই তিনি আনাস (রাঃ)-এর মায়ের নাম উল্লেখ করেছেন। এর থেকে বড় মাহাত্ম্য আর কি হ’তে পারে!

উম্মু সুলাইম (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ)-কে বড়ই ক্বদর ও সম্মান করতেন। তাঁর মাহাত্ম্য ও মর্যাদা সম্পর্কেও তিনি সম্যক সচেতন ছিলেন। তাঁর থেকে বরকত লাভ এবং তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণে তিনি বড়ই উদগ্রীব থাকতেন। এ বিষয়ে আনাস (রাঃ) বর্ণিত একটি হাদীছ উল্লেখের দাবী রাখে। তিনি বলেন, উম্মু সুলাইম (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ)-এর জন্য চামড়ার নির্মিত একটা বিছানা বিছিয়ে রাখতেন। তার বাড়িতে এলে তিনি সেই বিছানায় দিবানিদ্রা যেতেন। নবী করীম (ছাঃ) যখন ঘুমিয়ে পড়তেন তখন তিনি একটা কাঁচের শিশিতে তাঁর গায়ের ঘাম ও চুল সংগ্রহ করতেন। তারপর মেশক ও রামেকের মিশ্রণে তৈরি সুক নামক এক প্রকার সুগন্ধিতে তা মিশাতেন।

আনাস (রাঃ)-এর নাতি/পৌত্র ছুমামা বিন আব্দুল্লাহ বলেন, আনাস (রাঃ)-এর মৃত্যুকাল নিকটবর্তী হ’লে তিনি আমাকে উক্ত সুক হ’তে কিছুটা তার লাশের জন্য ব্যবহৃত সুগন্ধির সাথে মিশিয়ে দিতে অছিয়ত করে যান। তার এ ইচ্ছা পূরণ করা হয়েছিল।[17]

আনাস (রাঃ) থেকে আরও বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) আমাদের বাড়িতে এলেন এবং আমাদের এখানে দিবানিদ্রা গেলেন। তাঁর গা থেকে ঘাম ঝরছিল। আমার মা একটা শিশি নিয়ে এলেন এবং তাঁর ঘাম নিজ হাতে মুছে তাতে জমা করতে লাগলেন। ইত্যবসরে নবী করীম (ছাঃ) জেগে উঠে বললেন, উম্মু সুলাইম, তুমি এসব কি করছ? তিনি বললেন, এটা আপনার ঘাম। আমরা আমাদের সুগন্ধির সাথে এটা মিশাব। এ হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম সুগন্ধি।[18]

উম্মু সুলাইম যেমন তার ছেলের জন্য নবী করীম (ছাঃ)-এর বরকত লাভের প্রত্যাশা করেছিলেন তেমনি নিজের ঘরের জন্যও তাঁর বরকত কামনা করতেন। তার সে কামনাও পূরণ হয়েছিল। নবী করীম (ছাঃ) আবু ত্বালহা ও উম্মু সুলাইমের বাড়িতে যতটা যাতায়াত করতেন, তাঁর স্ত্রীদের ঘর ছাড়া আর কারও বাড়িতে তত যাতায়াত করতেন না।[19]

এই মহিয়সী রমণীর বাড়িতে নবী করীম (ছাঃ) যখনই পদার্পণ করতেন তখনই তিনি তাঁর জন্য আগে থেকে প্রস্ত্ততকৃত কোন না কোন উপহার দিতেন।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে হাদীছ মুখস্থ রাখার দিক দিয়ে আনাস (রাঃ) এক উঁচু আসনের অধিকারী ছিলেন। আল্লাহর রাসূল থেকে অধিক সংখ্যায় হাদীছ বর্ণনা ও মুখস্থ রাখার ক্ষেত্রে আবূ হুরায়রা ও ইবনু ওমরের পরেই তার স্থান। তার বর্ণিত হাদীছ সংখ্যা ২২৮৬। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম সমন্বিতভাবে বর্ণনা করেছেন ১৮০টি হাদীছ। বুখারী এককভাবে ৮০ ও মুসলিম এককভাবে ৯০টি হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[20]

ইমাম সুয়ূতী তার ‘আলফিয়াতুল হাদীছ’ গ্রন্থে বলেছেন, হাদীছ বর্ণনায় ‘মুকছিরূন’ যারা, তারা হ’লেন আবু হুরায়রা, তারপরে রয়েছেন ইবনু ওমর, আনাস ও আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস। তদ্রূপ আবু সাঈদ খুদরী, জাবের এবং নবীসহধর্মিণী আয়েশা (রাঃ)।[21]

নবী করীম (ছাঃ) যখন মদীনায় শুভাগমন করেন তখন আনাস (রাঃ) ছিলেন আট-দশ বছরের কিশোর। তাঁর মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ২০ বছর। বেশ কিছু বছর তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে কাটিয়েছিলেন। সকাল-সন্ধ্যা তাঁর সঙ্গে কাটাতেন, তাঁর সাথে জেগে থাকতেন, তাঁর খেদমত করতেন। তাঁর অধিকাংশ কাজ সম্পর্কে তিনি ওয়াকিফহাল ছিলেন।

উম্মতের জন্য আনাস (রাঃ)-এর অবদানের এ যৎসামান্য আলোচনা। আবার তার এ অবদান মূলত আমরা তার মায়ের হাত ধরে লাভ করেছি। তিনি আবার ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য যে অবদান রেখেছেন তা তার সন্তানের মধ্য দিয়ে রেখেছেন। অতএব হে পাঠকবর্গ! ভাল করে ভাবুন, সন্তানকে লালন-পালন, শিক্ষা-দীক্ষা প্রদান ও বড় মানুষ করে গড়ে তুলতে একজন মা কি অসামান্য অবদান রাখতে পারেন!

সন্তান লালন-পালনের পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে বিভিন্ন যুদ্ধে এই মহতী মায়ের অংশগ্রহণ ও বীরত্বের কাহিনী কম কৃতিত্বপূর্ণ নয়। যেসব মহিলা যুদ্ধে যেতেন তিনি তাদের মধ্যে শরীক থাকতেন। অনেক ঘটনা তার সাক্ষী রয়েছে। ইমাম মুসলিম আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তার মা উম্মু সুলাইম হুনাইন যুদ্ধের দিন একট খঞ্জর হাতে করে বেরিয়ে আসেন। খঞ্জরটা তার সাথেই ছিল। তা দেখে আবু ত্বালহা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! দেখুন, উম্মু সুলাইমের হাতে খঞ্জর! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, এ খঞ্জর কেন? তিনি বললেন, আমি এজন্য এটা এনেছি যে, মুশরিকদের কেউ আমার কাছে এলে আমি এটা দিয়ে তার পেট ফেড়ে দেব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার কথা শুনে হাসতে লাগলেন। তিনি বললেন, পরবর্তীতে আপনার হাতে পরাস্ত যারা মুক্তি পাবে আমি তাদের হত্যা করব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হে উম্মু সুলাইম! (তার আর দরকার হবে না।) আল্লাহই এজন্য যথেষ্ট, তিনি ভাল ব্যবস্থা নিবেন।[22]

আনাস (রাঃ)-এর মা উম্মু সুলাইম রুমাইছা নবী করীম (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় জীবিত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে তিনি যে অঙ্গীকার করেছিলেন তা পূরণ করেছিলেন। নবী করীম (ছাঃ) যখন আনাস (রাঃ)-এর মাকে ছেড়ে এ নশ্বর জগৎ ত্যাগ করেন তখন তিনি তার উপর রাযী-খুশী ছিলেন। বরং মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাকে জান্নাতের সুসংবাদ শুনিয়ে যান। জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমি জান্নাতে প্রবেশ করেছি। হঠাৎ করেই আমার সামনে আবু ত্বালহার স্ত্রী রুমাইছাকে দেখতে পেলাম। অতঃপর আমি পায়ের আওয়ায শুনে বললাম, ইনি কে? জিবরীল বললেন, ইনি বিলাল। আমি একটা প্রাসাদ দেখতে পেলেম যার আঙিনায় এক কিশোরী দাঁড়িয়েছিল। আমি বললাম, এটা কার? বললেন, ওমরের। তিনি ওমরকে বললেন, আমি তাতে প্রবেশ করে দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনার আত্মসম্মানবোধের কথা চিন্তা করে আর তা করলাম না। ওমর (রাঃ) বললেন, আমার আববা আম্মা আপনার জন্য কুরবান হউন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার বেলাতেও কি আমি আত্মসম্মান দেখাব?[23]

নবী করীম (ছাঃ) থেকে আরও বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি জান্নাতে প্রবেশ করে পায়ের আওয়ায শুনতে পেলাম। বললাম, ইনি কে? তারা বলল, ইনি আনাস বিন মালিকের মা রুমাইছা বিনতে মিলহান’।[24]

উম্মু সুলাইম (রাঃ) আবুবকর, ওমর, ওছমান, আলী (রাঃ)-এর আমলে বেঁচে ছিলেন। মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর শাসনামলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আনাস বিন মালিক (রাঃ)-এর মায়ের জীবনীতে মুসলিম মায়েদের জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছু রয়েছে। যেমন-

১. নানা বাধা-বিঘ্ন ও কষ্ট-ক্লেশ মাড়িয়ে কল্যাণের পথে তার অগ্রযাত্রা। তিনি মদীনায় ইসলাম কবুলকারীদের একেবারে প্রথম সারিতে ছিলেন। তার স্বামী তার এ পদক্ষেপ মেনে না নিলেও তিনি তাতে কোন ভ্রূক্ষেপ করেননি, ভয় পাননি বা দমে যাননি। ইসলামের খাতিরে বরং তিনি স্বামীকে ত্যাগ করেছেন এবং হকের উপর অবিচল থেকেছেন।

২. তিনি ছিলেন দৃঢ় সংকল্প ও উচ্চাশার অধিকারী। ছেলেকে কল্যাণ থেকে কল্যাণের পথে উন্নীত করতে তার আগ্রহের অন্ত ছিল না।

৩. স্বীয় ভূমিকা পালনের মধ্যে নিজেকে গচ্ছিত রেখে যান। তিনি এমন সব চিন্তা করেছেন যার মধ্য দিয়ে ইসলামের খেদমত, রাসূলের খেদমত ও মুসলিম জাতির খেদমত নিশ্চিত হয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি এক অনন্য ভূমিকা পালন করে গেছেন।

৪. সন্তানের শিক্ষা মযবূত করতে তিনি ছিলেন যথেষ্ট আগ্রহী। তিনি তাকে শুধু আল্লাহর নিকট সোপর্দ করেই দায়িত্ব শেষ করেননি, বরং ছেলে যাতে লেখাপড়ায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে সেজন্য তিনি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, উদ্দীপনা সৃষ্টি, সাহস যোগান ও সহযোগিতার মাধ্যমে তাকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। আনাস (রাঃ) বলতেন, ‘আমার মা আমাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খেদমত করতে উদ্বুদ্ধ করতেন’।[25] ইসলামের সুমহান খেদমত আঞ্জাম দেওয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা উম্মু সুলাইমকে ভরপুর প্রতিদানে সিক্ত করুন এবং তার মতো ভূমিকা পালনকারী মা আমাদেরকে দান করুন।-আমীন! [ক্রমশঃ]

মূল (আরবী) : ইউসুফ বিন যাবনুল্লাহ আল-‘আতীর

অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক


[1]. আবু ইয়ালা, ৩৬২৪।

[2]. আহমাদ, মুসনাদ হা/৩/২২২। মুসনাদের তাহক্বীক্বকারীগণ বলেছেন, হাদীছটি ছহীহ মুসলিমের শর্তে পর্যায়ের ছহীহ।

[3]. আল-ইছাবাহ ৮/২২৭।

[4]. বুখারী হা/১৩০১; মুসলিম হা/২১৪৪।

[5]. আহমাদ হা/১২২৭৩, শায়খ শুয়াইব আরনাউত বলেন, এ হাদীছের সনদ শায়খাইনের শর্ত অনুসারে ছহীহ।

[6]. ইবনু সা‘দ, তাবাকাত ১০/৩৯৬।

[7]. সিয়ারু আ‘লামিননুবালা, ২/২৭।

[8]. আব্দুর রাযযাক হা/১০৪১৭; তায়ালিসি, মুসনাদ হা/২৫৯০।

[9]. হিলইয়াতুল আওলিয়া ২/৬০।

[10]. মুসলিম হা/২৩৩০।

[11]. বুখারী হা/৫৯৩১।

[12]. মুসলিম, হা/২৪৮১/১৩৮৭।

[13]. ছুয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবা, পৃ ১৬।

[14]. আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ৮/৩০১।

[15]. আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ৭/১৯৫।

[16]. বুখারী হা/১২৪৪।

[17]. বুখারী হা/৫৯২৫।

[18]. মুসলিম হা/২৩৩১।

[19]. বুখারী হা/২৬৮৯

[20]. দালীলুল ফালেহীন লি-তুরুকি রিয়াযিছলিহীন ১/৯৮। সিয়ারু আলামিন্নুবালা ৩/৩৯৫।

[21]. মুহিউদ্দীন বিন আব্দুল হামীদ-এর শরাহসহ আলফিয়াতুল হাদীছ ২/২২।

[22]. মুসলিম হা/১৮০৯।

[23]. বুখারী হা/৩৪৭৬; মুসলিম হা/২৩৯৪।

[24]. মুসলিম হা/২৪৫৬।

[25]. মুসলিম হা/২০২৯।






বিদায়ের আগে রেখে যাও কিছু পদচিহ্ন (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
কুরবানীর মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
আশূরায়ে মুহাররম - আত-তাহরীক ডেস্ক
খেয়াল-খুশির অনুসরণ (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
তওবা (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ঈমান - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
আল্লামা আলবানী সম্পর্কে শায়খ শু‘আইব আরনাঊত্বের সমালোচনার জবাব (২য় কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
বিদ‘আত ও তার পরিণতি (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
অছিয়ত নামা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত (৬ষ্ঠ কিস্তি) - মুযাফফর বিন মুহসিন
কথাবার্তা বলার আদব বা শিষ্টাচার - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ইসলাম ও পর্দা - মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান
আরও
আরও
.