ভূমিকা :

মানবজাতির হেদায়েতের জন্য আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে আসমানী কিতাব সমূহ পাঠিয়েছেন। কালের আবর্তনে পূর্বের বিষয় রহিত করে পরবর্তী বিধান চালু করা হয়েছিল। এমনকি পূর্বের কিতাবের অনেক বিধান রহিত করে পরে নতুন কিতাব নাযিল করা হয়েছে। আর সার্বজনীন আসমানী কিতাব আল-কুরআন নাযিল করার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা পূর্বের সকল বিধান রহিত করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ২৩ বছরের নবুঅতী জীবনে অবস্থা ও সময় বিবর্তনে বিধানেরও পরিবর্তন ঘটেছে। আর এটা করা হয়েছে উম্মতে মুহাম্মাদীর সার্বিক কল্যাণে। এই পরিবর্তনগুলোকে মূলনীতির ভাষায় নাসখ, নাসেখ ও মানসূখ বলা হয়। সঠিক পন্থায় জীবন পরিচালনার জন্য নাসেখ ও মানসূখের বিধান জানা একান্ত প্রয়োজন। অন্যথা সঠিকভাবে কুরআন বুঝা সম্ভব নয়।

নাসখের পরিচয় :

النسخ অর্থ দূর করা, বিদূরিত করা, স্থানান্তর করা, বর্ণনা করা, লিখন ইত্যাদি। একটি লেখা থেকে আরেকটি লেখা নকল করা। যেমন বলা হয়, نسخت الكتاب ‘আমি বইটি কপি করে নিয়েছি’। আল্লাহ বলেন,هَذَا كِتَابُنَا يَنْطِقُ عَلَيْكُمْ بِالْحَقِّ إِنَّا كُنَّا نَسْتَنْسِخُ مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ، ‘এই যে আমাদের আমলনামা, যা তোমাদের বিরুদ্ধে সত্য সাক্ষ্য দিবে! আমরা তোমাদের কৃতকর্মসমূহ লিপিবদ্ধ করিয়েছিলাম’ (জাছিয়াহ ৪৫/২৯)। অর্থাৎ আমল সমূহকে কিতাবে স্থানান্তর করা।

আরেকটি অর্থ বিদূরিত করা। نَسَخَتِ الشَّمْسُ الظِّلَّ ‘রৌদ্র ছায়াকে দূর করে দিল’। আল্লাহ বলেন,فَيَنْسَخُ اللهُ مَا يُلْقِي الشَّيْطَانُ، ‘তখন আল্লাহ দূর করে দেন শয়তান যা মিশিয়ে দেয়’ (হজ্জ ২২/৫২)। আরেকটি অর্থ একটি দূর করে সেখানে উত্তম আরেকটি বসানো। যেমন আল্লাহ বলেন, مَا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا ‘আমরা কোন আয়াত রহিত করলে কিংবা তা ভুলিয়ে দিলে তদপেক্ষা উত্তম অথবা তদনুরূপ আয়াত আনয়ন করি’ (বাক্বারাহ ২/১০৬)। আল্লাহ আরও বলেন, وَإِذَا بَدَّلْنَا آيَةً مَكَانَ آيَةٍ وَاللهُ أَعْلَمُ بِمَا يُنَزِّلُ قَالُوا إِنَّمَا أَنْتَ مُفْتَرٍ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لاَ يَعْلَمُوْنَ ‘আমরা যখন এক আয়াত পরিবর্তন করে তার স্থলে অন্য আয়াত আনয়ন করি, আর আল্লাহ যা নাযিল করেন তিনিই তা ভাল জানেন, তখন তারা বলে, তুমি তো মনগড়া কথা বল। বরং তাদের অধিকাংশই (প্রকৃত বিষয়) জানে না’ (নাহল ১৬/১০১)। আলোচ্য আয়াতে তৃতীয় অর্থটি বুঝানো হয়েছে।

নাসখের পারিভাষিক অর্থ :

বিদ্বানগণ নাসখের পারিভাষিক সংজ্ঞায় বলেন,نسخ حكم شرعى بخطاب شرعى ‘কোন একটি শারঈ বিধানকে পরবর্তী শারঈ নির্দেশ দ্বারা রহিত করা’। ইমাম জীযানী (রহঃ) বলেন, رفع الحكم الثابت بخطاب متقدم بخطاب متراخٍ عنه ‘পূর্ব নির্দেশনা দ্বারা সাব্যস্ত একটি বিধান পরবর্তী নির্দেশনা দ্বারা প্রত্যাহার করে নেওয়া’।[1] শায়খ উছায়মীন (রহঃ) বলেন,رفع حكم دليل شرعي أو لفظه بدليل من الكتاب والسنة، ‘কুরআন ও হাদীছের দলীলের মাধ্যমে শারঈ কোন দলীলের হুকুম বা শব্দ উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে নাসখ’।[2] মোট কথা কুরআন এবং সুন্নাহ দ্বারা সাব্যস্ত বিধান পরবর্তীতে নাযিলকৃত কুরআনের আয়াত বা ছহীহ হাদীছ দ্বারা নাসখ বা রহিত করাকে নাসখ বলে। যে আয়াত বা হাদীছ দ্বারা নাস্খ করা হয় তাকে নাসেখ এবং যে বিধানকে রহিত করা হয় তাকে মানসূখ বলা হয়।

নাসখের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ওলামায়ে কিরামের পরিভাষাগত পার্থক্য :

‘নাসখ’ শব্দটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ওলামায়ে কেরামের মাঝে পরিভাষাগত কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন পূর্ববর্তী ওলামায়ে কেরামের পরিভাষায় ‘নাসখ’ ছিল সুপ্রশস্ত অর্থবহনকারী একটি শব্দ। এতে এমন কতগুলো বিষয়ও ছিল, পরবর্তী ওলামায়ে কেরাম যেগুলোকে ‘নাসখ’ বলে অভিহিত করেন না। যেমন পূর্ববর্তীদের নিকট ব্যাপকের বিশেষত্বকরণ (تخصيص العام) এবং বিশেষত্বের সাধারণীকরণ (تعميم الخاص) নাসখের অর্থের মাঝে শামিল ছিল।

পক্ষান্তরে পরবর্তী ওলামায়ে কেরামের নিকট নাসখের অর্থ এতটা ব্যাপক নয়। এতে শুধু ঐ ক্ষেত্রে নাসখ সাব্যস্ত করা হয়, যার মাঝে প্রথম হুকুমকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। শুধু আমকে খাছ বা খাছকে আম করা বা সাধারণের নির্দিষ্ট হওয়াকেই নাসখ বলা হয় না।

পরিভাষায় এ পার্থক্যের কারণে পূর্ববর্তী ওলামায়ে কেরামের নিকট কুরআন মাজীদের মানসূখ আয়াতের সংখ্যা অনেক বেশী ছিল। সাধারণ একটি পার্থক্যের কারণে তারা এক আয়াতকে মানসূখ আর অন্য আয়াতকে নাসেখ আখ্যায়িত করতেন। কিন্তু পরবর্তী ওলামায়ে কেরামের পরিভাষা অনুযায়ী মানসূখ আয়াতের সংখ্যা খুবই কম। ইমাম সুয়ূত্বী এরূপ ২০টি আয়াতের কথা বলেছেন।[3] শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী মাত্র পাঁচটির কথা বলেছেন। পক্ষান্তরে ইমাম ইবনু খুযায়মা বলেছেন যে, দু’টি হাদীছকেও আমি পরস্পর বিরোধী জানি না। কেউ জানলে তা আমার সামনে পেশ করুক। আমি উভয় হাদীছের মধ্যে সমন্বয় করে দেব’।[4] কেননা তার মতে নাসেখ ও মানসূখ বলে পরিচিত প্রত্যেকটি হুকুম স্ব স্ব স্থানে ও স্ব স্ব প্রেক্ষিতে জারী আছে, রহিত নয়। এ বিষয়ে তিনি বিশদ ব্যাখ্যা পেশ করেছেন।

নাসখের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা :

শরী‘আতে নাসখ একটি সুপরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা প্রত্যেক বিদ্বানের জানা আবশ্যক। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لَمْ تَكُنْ نُبُوَّةٌ قَطُّ إِلاَّ تَنَاسَخَتْ ‘এমন নবুঅত কখনো ছিল না, যাতে নাসখ বা পরিবর্তন করা হয়নি’।[5] অর্থাৎ বিগত সকল শরী‘আতে নাসখের বিধান ছিল। একবার আলী ইবনে আবী তালেব (রাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে মসজিদে নছীহত করতে দেখে তাকে বলেন, أَتَعْرِفُ النَّاسِخَ مِنَ الْمَنْسُوخِ؟ ‘তুমি কি নাসেখ ও মানসূখ সম্পর্কে জ্ঞান রাখো’? লোকটি বলল, না। তখন আলী (রাঃ) তাকে বললেন, فَاخْرُجْ مِنْ مَسْجِدِنَا وَلَا تُذَكِّرْ فِيْهِ ‘তুমি আমাদের মসজিদ থেকে বের হয়ে যাও। এখানে কিছছা-কাহিনী বর্ণনা করবে না’। অন্য বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন, هَلَكْتَ وَأَهْلَكْتَ، ‘তুমি নিজে ধ্বংস হয়েছ এবং অন্যকে ধ্বংস করেছ’।[6]

ইমাম কুরতুবী (রহঃ) সূরা বাক্বারার ১০৬ নং আয়াতের তাফসীরে বলেন, هذه آية عظمى فى الأحكام ‘শরী‘আতের বিধানগত বিষয়ে এটি একটি মহান আয়াত’। এরপর তিনি বলেন,مَعْرِفَةُ هَذَا الْبَابِ أَكِيدَةٌ وَفَائِدَتُهُ عَظِيمَةٌ، لَا يَسْتَغْنِي عَنْ مَعْرِفَتِهِ الْعُلَمَاءُ، وَلَا يُنْكِرُهُ إِلَّا الْجَهَلَةُ الْأَغْبِيَاءُ، ‘নাসখ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা খুবই যরূরী এবং এর উপকারিতা অনেক। আলেমগণ একে উপেক্ষা করতে পারেন না। কেবল মূর্খ ও নির্বোধ ছাড়া কেউ এর গুরুত্ব অস্বীকার করতে পারে না’।[7]

অভিজ্ঞ চিকিৎসক যেমন একজন রোগীর অবস্থা সম্পর্কে জানেন যে, অবস্থার পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে তার জন্য ঔষধ পরিবর্তন করতে হবে। তাই তিনি প্রথমে এক ঔষধ দিয়ে পরে অবস্থা বুঝে আরেকটি ঔষধ দেন এবং এটাই হ’তে পারে তার জন্য সর্বশেষ ঔষধ। ইসলামী শরী‘আত তেমনি মানবজাতির জন্য আল্লাহর নাযিলকৃত সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। সেকারণ কোন কোন বিষয়ে পূর্বাপর হুকুম ও হুকুম রহিতের বিধান এসেছে মানবজাতির স্থায়ী কল্যাণ সাধনের জন্য। যদিও নাসেখ ও মানসূখের সংখ্যা খুবই কম।

জমহূর বিদ্বানগণ যুক্তি ও শরী‘আত উভয় দিক দিয়ে নাসখ-কে জায়েয মনে করেন। তারা উপরোক্ত আয়াতকে ‘আম তথা ব্যাপক অর্থবোধক হিসাবে গ্রহণ করেন এবং মানসূখ আয়াতগুলিকে খাছ বা নির্দিষ্ট বিধান হিসাবে ব্যাখ্যা করেন। বস্ত্ততঃ কোন হুকুমই বাতিল নয়, সবই সত্য এবং সবই পালনযোগ্য। তবে আল্লাহ দয়া করে বান্দার উপর থেকে কোন তেলাওয়াত বা কোন হুকুম উঠিয়ে নিয়েছেন বান্দার কল্যাণের স্বার্থে।

উপরন্তু বান্দার প্রতি আল্লাহর দয়া ও হিকমতের দাবী হ’ল, তিনি তাদের জন্য এমন শারঈ বিধান প্রণয়ন করবেন, যে ব্যাপারে তিনি জানেন যে, এতে তাদের জন্য দ্বীন-দুনিয়ার কল্যাণ রয়েছে। আর কল্যাণ অবস্থা ও সময় ভেদে বিভিন্ন হয়। কাজেই কোন হুকুম একটি সময়ে বা অবস্থায় বান্দার জন্য অধিকতর কল্যাণ বিবেচিত হয়, আবার অন্য সময় বা অবস্থার প্রেক্ষিতে আরেকটি হুকুম তাদের জন্য অধিকতর কল্যাণকর বিবেচিত হ’তে পারে।

নিম্নের আয়াত ও হাদীছগুলো তারই প্রমাণ বহন করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, مَا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا، ‘আমরা কোন আয়াত রহিত করলে কিংবা তা ভুলিয়ে দিলে তদপেক্ষা উত্তম অথবা তদনুরূপ আয়াত আনয়ন করি’ (বাক্বারাহ ২/১০৬)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,الْآنَ خَفَّفَ اللهُ عَنْكُمْ وَعَلِمَ أَنَّ فِيكُمْ ضَعْفًا، ‘আল্লাহ এখন তোমাদের উপর বোঝা লাঘব করে দিলেন এবং তিনি জেনেছেন যে, তোমাদের মধ্যে কিছু দুর্বলতা এসে গেছে’ (আনফাল ৮/৬৬)

তিনি আরো বলেন, فَالْآنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُوا مَا كَتَبَ اللهُ لَكُمْ ‘অতএব এখন তোমরা স্ত্রীগমন কর এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা নির্ধারণ করেছেন, তা সন্ধান কর’ (বাক্বারাহ ২/১৮৭)

উপরের আয়াতদ্বয়ে الْآنَ শব্দ প্রমাণ করে যে, এগুলি পূর্বের হুকুম পরিবর্তিত হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলীল।

(৩) রাসূল (ছাঃ) বলেন, نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ، فَزُورُوهَا، ‘আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা যিয়ারত করবে’।[8] অত্র হাদীছটি কবর যিয়ারতের নিষেধাজ্ঞা রহিত হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলীল।

নাসখের শর্তসমূহ :

যেসব ক্ষেত্রে নাসখ সম্ভব, সেসব ক্ষেত্রে নাসখ বা রহিতকরণ সাব্যস্ত হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হ’ল-

(১) উভয় দলীলের মাঝে সমন্বয় করা সম্ভব না হওয়া। তাই উভয় দলীলের মাঝে সমন্বয় করা সম্ভব হ’লে, উভয়টি অনুযায়ী আমল করা সম্ভব হওয়ার কারণে নাসখ সাব্যস্ত হবে না।

(২) নাসেখ বা রহিতকারী দলীল পরে আসার ব্যাপারে জ্ঞান থাকা :

এটি জানা যেতে পারে মূল দলীলের মাধ্যমে অথবা ছাহাবীর সংবাদের মাধ্যমে অথবা ইতিহাসের মাধ্যমে।

(ক) দলীল পরে আসার বিষয়টি (নছ বা হাদীছ থেকে) দলীলের মাধ্যমে জানা যায়। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنِّي قَدْ كُنْتُ أَذِنْتُ لَكُمْ فِي الِاسْتِمْتَاعِ مِنَ النِّسَاءِ، وَإِنَّ اللهَ قَدْ حَرَّمَ ذَلِكَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ، فَمَنْ كَانَ عِنْدَهُ مِنْهُنَّ شَيْءٌ فَلْيُخَلِّ سَبِيلَهُ، وَلَا تَأْخُذُوا مِمَّا آتَيْتُمُوهُنَّ شَيْئًا، ‘হে লোক সকল! আমি তোমাদেরকে স্ত্রীলোকদের সাথে মুত‘আহ বিবাহের অনুমতি দিয়েছিলাম। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তা হারাম করেছেন ক্বিয়ামত পর্যন্ত। অতএব যার নিকট এ ধরনের বিবাহ সূত্রে কোন স্ত্রীলোক আছে, সে যেন তার পথ ছেড়ে দেয়। আর তোমরা তাদের যা কিছু দিয়েছে তা কেড়ে নিও না’।[9]

(খ) ছাহাবীর সংবাদের মাধ্যমেও রহিতকারী দলীল পরে আসার বিষয়টি জানা যায়। যেমন আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘কুরআনে এ আয়াতটি নাযিল হয়েছিল ‘দশবার দুধপানে হারাম সাব্যস্ত হয়’। অতঃপর তা রহিত হয়ে যায় ‘পাঁচবার পান দ্বারা হারাম সাব্যস্ত হয়’ এর দ্বারা। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মৃত্যুবরণ করেন অথচ ঐ আয়াতটি কুরআনের আয়াত হিসাবে তিলাওয়াত করা হ’ত’।[10]

(গ) নাসখ ও মানসূখের বিষয়টি ইতিহাস দ্বারা জানা যায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী,الْآنَ خَفَّفَ اللهُ عَنْكُمْ وَعَلِمَ أَنَّ فِيكُمْ ضَعْفًا، ‘আল্লাহ এখন তোমাদের উপর বোঝা লাঘব করে দিলেন এবং তিনি জেনেছেন যে, তোমাদের মধ্যে কিছু দুর্বলতা এসে গেছে’ (আনফাল ৮/৬৬)

আয়াতের الْآنَ (এখন) শব্দটি এ হুকুম পরে আসার ব্যাপারে প্রমাণ বহন করে। অনুরূপভাবে যদি উল্লেখ করা হয় যে, নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) হিজরতের পূর্বে কোন বিষয়ে হুকুম দিয়েছেন। তারপর হিজরতের পরে তার বিপরীত ফায়ছালা দিয়েছেন। তখন দ্বিতীয়টি রহিতকারী সাব্যস্ত হবে।

(৩) নাসেখ বা রহিতকারী দলীল বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হওয়া :

এক্ষেত্রে অধিকাংশ বিদ্বান শর্ত করেছেন যে, রহিতকারী দলীল মানসূখ বা রহিত দলীলের চেয়ে শক্তিশালী অথবা সমমানের হ’তে হবে। কাজেই তাদের মতে, মুতাওয়াতির পর্যায়ের হাদীছ, খবরে ওয়াহেদ পর্যায়ের হাদীছ দ্বারা রহিত হবে না। যদিও রহিতকারী দলীলটি ছহীহ হয়। কিন্তু অধিকতর অগ্রগণ্য অভিমত হ’ল নাসখ সাব্যস্ত হওয়ার জন্য নাসেখকে অধিকতর শক্তিশালী কিংবা সমমানের হওয়া শর্ত নয়। কেননা নাসখ-এর ক্ষেত্র হ’ল হুকুম আর হুকুম সাব্যস্ত হওয়ার জন্য মুতাওয়াতির হওয়া শর্ত নয়।

(৪) নাসখ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় হওয়া : নাসখ রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় হ’তে হবে। ছাহাবায়ে কেরামের যামানায় কেউ কুরআনের আয়াত বা হাদীছ নাসখের দাবী করলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে।[11]

(৫) রাবীর ইসলাম গ্রহণের অগ্রগামিতা : বর্ণনাকারী পরে ইসলাম গ্রহণ করলে তার বর্ণিত হাদীছটি নাসেখ হিসাবে গণ্য হবে। আর পূর্বে ইসলাম গ্রহণকারী ছাহাবীর বর্ণিত হাদীছ মানসূখ হিসাবে গণ্য হবে যদি দু’টি বর্ণনার মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়।[12]

(৬) নাসেখ অবশ্যই কিতাব বা সুন্নাহর অহী হ’তে হবে :  যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَإِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُنَا بَيِّنَاتٍ قَالَ الَّذِينَ لا يَرْجُونَ لِقَاءَنَا ائْتِ بِقُرْآنٍ غَيْرِ هَذَا أَوْ بَدِّلْهُ قُلْ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أُبَدِّلَهُ مِنْ تِلْقَاءِ نَفْسِي إِنْ أَتَّبِعُ إِلا مَا يُوحَى إِلَيَّ ‘আর যখন তাদের উপর আমাদের স্পষ্ট আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন যারা আমাদের সাক্ষাতের আশা করে না তারা বলে, এটা বাদ দিয়ে অন্য কুরআন নিয়ে এস অথবা এটাকে পরিবর্তন করে আনো। তুমি বল, একে নিজের পক্ষ থেকে পরিবর্তন করা আমার কাজ নয়। আমি তো কেবল তারই অনুসরণ করি যা আমার নিকট অহি করা হয়। আমি যদি আমার প্রতিপালকের অবাধ্যতা করি’ তাহ’লে আমি এক ভয়ংকর দিবসের শাস্তির ভয় করি (ইউনুস ১০/১৫)। অর্থাৎ ইজমা‘ দ্বারা নাসখ হবে না। অনুরূপভাবে ক্বিয়াসের মাধ্যমেও নাসখ হবে না।[13]

(৭) নাসেখ ও মানসূখ একসাথে না আসা : কারণ পরস্পর- বিরোধী দু’টি বিধান এক স্থানে একত্রিত হওয়া বিধিসম্মত নয়। এমনটি হ’লে মানসূখ স্বস্থানে ছাবেত থাকার দাবী রাখে এবং নাসেখ তা অপসারণ করার দাবী রাখে। এর বিপরীতও হ’তে পারে।

(৮) মানসূখ হবে শরী‘আতের বিধানের ক্ষেত্রে ইতিহাস বা খবরের ক্ষেত্রে নয় : কারণ খবর বা ইতিহাসে নাসখের স্থান নেই। যেমন পূর্বের এবং পরের ইতিহাস, জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনা, আর আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে ইত্যাদি।

নাসখের প্রকারসমূহ :

নাসখ প্রধানত তিন প্রকার : যেমন

১। হুকুম মানসূখ বা রহিত; কিন্তু তার তেলাওয়াত বহাল(نسخ الحكم دون التلاوة) : কুরআনের এ ধরনের নাসখ বেশী। যেমন, (১) আল্লাহ বলেন,إِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ عِشْرُونَ صَابِرُونَ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ وَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِائَةٌ يَغْلِبُوا أَلْفًا، ‘যদি তোমাদের মধ্যে বিশ জন দৃঢ়চিত্ত মুজাহিদ থাকে, তাহ’লে তারা দু’শো জন কাফেরের উপর বিজয়ী হবে। আর যদি তোমাদের মধ্যে এরূপ একশ’ জন থাকে, তবে তারা এক হাযার কাফেরের উপর বিজয়ী হবে’ (আনফাল ৮/৬৫)

অত্র আয়াতের বিধান নিচের আয়াত দ্বারা রহিত হয়েছে الْآنَ خَفَّفَ اللهُ عَنْكُمْ وَعَلِمَ أَنَّ فِيكُمْ ضَعْفًا فَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِائَةٌ صَابِرَةٌ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ... ‘আল্লাহ এখন তোমাদের উপর বোঝা লাঘব করে দিলেন এবং তিনি জেনেছেন যে, তোমাদের মধ্যে কিছু দুর্বলতা রয়েছে। অতএব যদি এখন তোমাদের মধ্যে একশ’ জন দৃঢ়চিত্ত মুজাহিদ থাকে, তবে তারা দু’শো জন কাফেরের উপর জয়লাভ করবে। আর এক হাযার জন থাকলে তারা দু’হাযারের উপর জয়লাভ করবে আল্লাহর হুকুমে’ (আনফাল ৮/৬৫)

(২) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنْكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا وَصِيَّةً لِأَزْوَاجِهِمْ مَتَاعًا إِلَى الْحَوْلِ غَيْرَ إِخْرَاجٍ فَإِنْ خَرَجْنَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِي مَا فَعَلْنَ فِي أَنْفُسِهِنَّ مِنْ مَعْرُوفٍ ، ‘আর তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করে ও স্ত্রীদের ছেড়ে যায়, তারা যেন স্বীয় স্ত্রীগণকে বের করে না দিয়ে এক বছরের জন্য ভরণ-পোষণের অছিয়ত করে যায়। অবশ্য যদি তারা বের হয়ে যায়, তবে তাদের নিজেদের ব্যাপারে ন্যায়ানুগভাবে তারা যা করে, তাতে তোমাদের কোন দোষ নেই’(বাক্বারা ২/২৪০)

জমহূর বিদ্বানগণের মতে, আয়াতটি সূরা বাক্বারার ২৩৪ আয়াত দ্বারা ‘মানসূখ’ হয়ে গেছে। যেখানে বিধবাদের ইদ্দতকাল ৪ মাস ১০ দিন বলা হয়েছে। তবে তাবেঈ মুজাহিদ ও আত্বা বলেন, বরং এটি বিধবা স্ত্রীদের জন্য স্বামীদের পক্ষ হ’তে অছিয়ত হিসাবে বলা হয়েছে (وَصِيَّةً لِأَزْواجِهِمْ)।

যদি তারা স্বামীর বাড়ীতে থাকতে চায়।[14]

(৩) আল্লাহর বাণী :يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نَاجَيْتُمُ الرَّسُولَ فَقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيْ نَجْوَاكُمْ صَدَقَةً ذَلِكَ خَيْرٌ لَكُمْ وَأَطْهَرُ، ‘হে মুমিনগণ! যখন তোমরা রাসূলের সঙ্গে একান্তে কথা বলবে, তখন কথা বলার পূর্বে ছাদাক্বা পেশ কর। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম ও পবিত্রতর’ (মুজাদালা ৫৮/১২)। পরে আল্লাহর বাণী- أَأَشْفَقْتُمْ أَنْ تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيْ نَجْوَاكُمْ صَدَقَاتٍ فَإِذْ لَمْ تَفْعَلُوا وَتَابَ اللهُ عَلَيْكُمْ فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيعُوا اللهَ وَرَسُولَهُ، ‘তোমরা কি (রাসূলের সঙ্গে) একান্তে আলাপকালে ছাদাক্বা পেশ করতে ভয় পাচ্ছ? এক্ষণে যখন সেটা তোমরা করলে না এবং আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দিলেন, তখন তোমরা ছালাত কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর (মুজাদালা ৫৮/১২) আয়াত দ্বারা রহিত করা হয়।

(৪) আল্লাহর বাণী : وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ ‘আর যাদের জন্য এটি খুব কষ্টকর হবে, তারা যেন এর পরিবর্তে একজন করে মিসকীনকে খাদ্য দান করে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৩) আয়াতটি পরবর্তী আয়াতেরفَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ، ‘অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে, সে যেন এ মাসের ছিয়াম রাখে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৪) অংশ দ্বারা রহিত হয়ে গেছে।

উল্লেখ্য যে, তেলাওয়াত রহিত না করে হুকুম রহিত করার হিকমত হ’ল, তেলাওয়াতের ছওয়াব অবশিষ্ট রাখা এবং উম্মতকে নাসখ-এর হিকমত বা তাৎপর্য স্মরণ করিয়ে দেয়া। [ক্রমশঃ]

মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম

সিনিয়র শিক্ষক, রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ।


[1]. মা‘আলেম ফী উছূলিল ফিক্বহ, পৃ. ২৪৬

[2]. আল-উছূল মিন ইলমিল উছূল, পৃ. ৫১

[3]. আল-ইতক্বান, ৪৭তম অধ্যায় ‘নাসেখ ও মানসূখ’।

[4]. সুয়ূত্বী, তাদরীবুর রাবী ২/১৯৬।

[5]. মুসলিম হা/২৯৬৭; ছহীহুত তারগীব হা/৩৩১২।

[6]. মুছন্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৫৪০৭; তাফসীরে কুরতুবী

[7]. তাফসীরে কুরতুবী ২/৬২; বাক্বারাহ ১০৬ আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য

[8]. মুসলিম হা/১৯৭৭; মিশকাত হা/১৭৬২

[9]. মুসলিম হা/১৪০৬

[10]. মুসলিম হা/১৪৫২; মিশকাত হা/৩১৬৭

[11]. মা‘আলিমুস সুনান ৩/২১২

[12]. মা‘আলিমুস সুনান ১/২৩৫

[13]. জীযানী, মা‘আলিম উছূলিল ফিক্বহ পৃ. ২৪৮-৪৯

[14]. তাফসীর ইবনু কাছীর, বাক্বারাহ ২৪০ আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য, ১/৪৯৯।






পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণ সমূহ (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
সমাজ সংস্কারে তাবলীগী ইজতেমা - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
মুমিন কিভাবে রাত অতিবাহিত করবে - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ইবাদতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা (৫ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
চুল ও দাড়িতে কালো খেযাব ব্যবহারের বিধান - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
কুরআন নিয়ে চিন্তা করব কিভাবে? - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
মৃত ব্যক্তির নিকট কুরআন তেলাওয়াতের বিধান - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
মাসায়েলে কুরবানী - আত-তাহরীক ডেস্ক
শোকর (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ইবাদতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
রোহিঙ্গারা বাঁচতে চায় - লিলবর আল-বারাদী - যশপুর, তানোর, রাজশাহী
আরও
আরও
.