মসজিদে বৈধ কাজসমূহ :
মসজিদ আল্লাহর ঘর, যেখানে মুসলমানগণ প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করেন, রামাযান মাসের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করে থাকেন। এছাড়াও কিছু কাজ রয়েছে, যা মসজিদের মত পবিত্র স্থানে করা বৈধ। যেমন-
(১) শিক্ষা গ্রহণ ও প্রদান করা : মসজিদ হ’ল শিক্ষা গ্রহণের অন্যতম স্থান। মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় বিষয়াবলী প্রতিদিন ইমামের কাছ থেকে শিক্ষা নিবেন এবং সে অনুযায়ী আমল করবেন। আবার ইমামগণও বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জনসাধারণকে শিক্ষা দিবেন। আবু ওয়াক্বিদ আল-লায়ছী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) একদা মসজিদে বসেছিলেন, তাঁর সাথে আরও লোকজন ছিল। এমতাবস্থায় তিনজন লোক আসল। তন্মধ্যে দু’জন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর দিকে এগিয়ে আসল এবং একজন চলে গেল। আবু ওয়াক্বিদ (রাঃ) বলেন, তাঁরা দু’জন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। অতঃপর তাদের একজন মজলিসের মধ্যে কিছুটা খালি জায়গা দেখে সেখানে বসে পড়ল এবং অপরজন তাদের পেছনে বসল। আর তৃতীয় ব্যক্তি ফিরে গেল। যখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) অবসর হ’লেন তখন (ছাহাবীদের লক্ষ্য করে) বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এই তিন ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু বলব না? তাদের একজন আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করল, আল্লাহ তাকে আশ্রয় দিলেন। অন্যজন লজ্জাবোধ করল, তাই আল্লাহ তার ব্যাপারে লজ্জাবোধ করলেন। আর অপরজন (মজলিসে হাযির হওয়া থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিল, তাই আল্লাহ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন’।[1]
(২) বিচার-ফায়ছালা ও শারঈ সিদ্ধান্ত বা নছীহত করা : কোন বিষয়ে মীমাংসার প্রয়োজন হ’লে অথবা কোন বিষয়ে সমাধান দিতে চাইলে মসজিদে বসেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি তা করতে পারবেন। আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা মসজিদে বসা ছিলাম। ইতিমধ্যে উটে আরোহণ করে এক ব্যক্তি আসল এবং সে উটকে মসজিদের (আঙ্গিনায়) বসাল ও বাঁধলো। আর উপস্থিত লোকদের জিজ্ঞেস করল, তোমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ (ছাঃ) কে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন উপস্থিতদের মধ্যে ঠেস দিয়ে বসা ছিলেন। আমরা তাকে বললাম, এই ঠেস দিয়ে বসা ফর্সা ব্যক্তি। তখন সে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলল, হে আব্দুল মুত্তালিবের বংশজাত! তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, আমি তোমার ডাকে সাড়া দিয়েছি। তখন সে বলল, হে মুহাম্মাদ! আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব এবং প্রশ্নের ব্যাপারে কঠোরতা আরোপ করব। আপনি কিছু মনে করবেন না। তখন তিনি বললেন, তোমার যা মনে চায় প্রশ্ন কর।
তখন সে বলল, আমি আপনাকে আপনার প্রভু এবং আপনার পূর্ববর্তীদের নতুন প্রভুর নামে শপথ দিয়ে বলছি, আল্লাহ তা‘আলা কি আপনাকে সমস্ত মানুষের হেদায়াতের জন্য পাঠিয়েছেন? রাসূল (ছাঃ) বললেন, নিশ্চয়ই, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন। সে বলল, এখন আমি আপনাকে আল্লাহর নামে শপথ দিয়ে বলছি, আল্লাহ তা‘আলা কি আপনাকে রাতে-দিনে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, নিশ্চয়ই, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন। অতঃপর সে বলল, আমি আপনাকে আল্লাহর নামে শপথ দিয়ে বলছি, আল্লাহ তা‘আলা কি আপনাকে বছরের এ (রামাযান) মাসে ছাওম পালন করতে নির্দেশ দিয়েছেন? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, নিশ্চয়ই, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন। অতঃপর সে বলল, আমি আপনাকে আল্লাহর নামে শপথ দিয়ে বলছি, আল্লাহ তা‘আলা কি আপনাকে আমাদের বিত্তশালীদের থেকে এ যাকাত নিয়ে তা আমাদের অভাবীদের মধ্যে বণ্টন করার নির্দেশ দিয়েছেন? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, নিশ্চয়ই, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন। তারপর ঐ ব্যক্তি বলল, আপনি যা নিয়ে এসেছেন, তার উপর আমি ঈমান আনলাম। আর আমি নিজ গোত্রের অবশিষ্ট লোকদের জন্য দূতরূপে এসেছি এবং আমার নাম হ’ল যিমাম ইবনু ছা‘লাবা। আমি সা‘দ ইবনু বকর গোত্রের লোক।[2]
আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, সূদ সম্পর্কিত সূরা বাক্বারার আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হ’লে নবী করীম (ছাঃ) মসজিদে গিয়ে সেসব আয়াত ছাহাবীগণকে পাঠ করে শুনালেন। অতঃপর তিনি মদের ব্যবসা হারাম করে দিলেন।[3]
(৩) মসজিদে অবস্থান ও খাওয়া-দাওয়া করা : অন্যান্য বৈধ কাজের ন্যায় মসজিদে অবস্থান করা ও খাওয়া-দাওয়া করা জায়েয। আয়েশা (রাঃ) বলেন,
لَمَّا أُصِيبَ سَعْدُ بْنُ مُعَاذٍ يَوْمَ الْخَنْدَقِ رَمَاهُ رَجُلٌ فِى الأَكْحَلِ فَضَرَبَ عَلَيْهِ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم خَيْمَةً فِى الْمَسْجِدِ فَيَعُوْدُهُ مِنْ قَرِيْبٍ.
‘খন্দকের যুদ্ধের দিন এক ব্যক্তির নিক্ষিপ্ত তীরে সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ) আঘাতপ্রাপ্ত হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার জন্য মসজিদের ভেতর একটি তাঁবু টানালেন। যেন তিনি কাছ থেকে তাকে দেখতে পারেন’।[4] আর যারা ই‘তিকাফ করবে তারা মসজিদে অবস্থান করবে এবং মসজিদেই খাওয়া-দাওয়া করবে। এছাড়াও রামাযান মাসে মসজিদে ইফতারেরও ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।
(৪) প্রয়োজনীয় বৈধ কথা-বার্তা বলা : যিকির-আযকার, তাসবীহ-তাহলীলসহ যে কোন বৈধ কথা-বার্তা মসজিদে বলা জায়েয। সিমাক (রহঃ) বলেন,
قلتُ لجابرِ بنِ سَمُرةَ أكُنتَ تجالسُ رسولَ اللهِ صلّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ قالَ نعَم كثيرًا فَكانَ لا يقومُ من مصلّاهُ الَّذي صلّى فيهِ الغداةَ حتّى تطلُعَ الشَّمسُ فإذا طلَعت قامَ صلّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ
‘আমি জাবের বিন সামুরাহ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাহচর্যে থাকতেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, অধিক সময় তাঁর সাহচর্যে ছিলাম। তিনি সূর্যোদয় পর্যন্ত ঐ স্থানেই বসে থাকতেন যেখানে তিনি ফজরের ছালাত আদায় করেছেন। অতঃপর সূর্যোদয় হ’লে তিনি উঠে যেতেন’।[5] জাবের বিন সামুরাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যে স্থানে ছালাত আদায় করতেন সূর্য পূর্ণভাবে উদয় না হওয়া পর্যন্ত ঐ স্থান হ’তে উঠতেন না। সূর্য উদয় হ’লে উঠৈ দাঁড়াতেন। আর ইত্যবসরে কথাবার্তা বলতেন এবং জাহেলী যুগের কাজ-কারবারের আলোচনা করে ছাহাবাগণ হাসতেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও মুচকি হাসতেন’।[6]
(৫) ঘুমানো : বিশেষ প্রয়োজনে মসজিদে ঘুমানো যায়। আববাদ ইবনু তামীম (রঃ) তাঁর চাচা হ’তে বর্ণনা করেন,أَنَّهُ رَأَى رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم مُسْتَلْقِيًا فِي الْمَسْجِدِ، وَاضِعًا إِحْدَى رِجْلَيْهِ عَلَى الأُخْرَى، ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মসজিদের মধ্যে চিৎ হয়ে এক পা অপর পায়ের উপর রেখে শায়িত অবস্থায় দেখেছি’।[7] ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় মসজিদে ঘুমাতাম। অথচ আমি তখন যুবক ছিলাম’।[8]
সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ফাতেমা (রাঃ)-এর ঘরে আসলেন, কিন্তু আলী (রাঃ)-কে ঘরে পেলেন না। তিনি ফাতেমা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার চাচাত ভাই কোথায়? তিনি বললেন, আমার ও তার মধ্যে বাদানুবাদ হওয়ায় তিনি আমার সাথে রাগ করে বাইরে চলে গেছেন। আমার নিকটে দুপুরের বিশ্রামও করেননি। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) এক ব্যক্তিকে বললেন, দেখ তো সে কোথায়? সে খুঁজে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি মসজিদে শুয়ে আছেন। তখন রাসূল (ছাঃ) আসলেন এবং বললেন, উঠ, হে আবূ তুরাব! উঠ, হে আবূ তুরাব![9]
অতএব বিশেষ প্রয়োজনে মসজিদে থাকা ও ঘুমানো যায়। তবে এক্ষেত্রে মসজিদের পবিত্রতার আদবগুলো যাতে লংঘিত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
(৬) অমুসলিমদের প্রবেশ করা ও তাদেরকে বন্দি করে রাখা : বিশেষ প্রয়োজনে অমুসলিম ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করতে পারে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নাজদ এলাকায় অশ্বারোহী কাফেলা পাঠালেন। তারা বনী হানীফাহ গোত্রের ছুমামাহ বিন উছাল নামক এক ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে এলো। সে ইয়ামানবাসীদের নেতা ছিল। লোকটিকে মসজিদে নববীর একটি খুঁটিতে বেঁধে রাখা হ’ল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার কাছে এসে বললেন, হে ছুমামা! তোমার নিকট কি আছে? সে বলল, হে মুহাম্মাদ! আমার কাছে কল্যাণ আছে? আপনি আমাকে হত্যা করলে এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করলেন, যার রক্তের প্রতিশোধ নেয়া হবে। আর আপনি যদি অনুগ্রহ করেন, তাহ’লে একজন সম্মানী লোককে অনুগ্রহ করলেন। আপনি সম্পদের আশা করলে যত ইচ্ছা চাইতে পারেন দেয়া হবে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) চলে গেলেন। পরবর্তী সকাল বেলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে ছুমামা! তুমি তোমার সাথে কেমন আচরণের প্রত্যাশা কর? সে আগের মতই জবাব দিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছুমামাকে ছেড়ে দিলেন। পরে তিনি ইসলাম কবুল করেন।[10]
এমনকি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) শয়তানকেও বন্দি করে রাখতে চেয়েছিলেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, গত রাতে এক দুষ্ট জিন আমার ছালাত নষ্ট করার জন্য আমার উপর আক্রমণ করতে শুরু করল। তবে আল্লাহ তা‘আলা আমাকে শক্তি দান করলেন তাকে কাবু করার। আমি তাকে গলা টিপে ধরেছিলাম। আমার ইচ্ছে হ’ল তাকে মসজিদের একটি খুঁটির সাথে বেঁধে রাখি, যাতে সকাল বেলা তোমরা সবাই তাকে দেখতে পাও। কিন্তু তখনই আমার স্মরণ হ’ল আমার ভাই নবী সুলায়মানের দো‘আর কথা। তিনি দো‘আ করেছিলেন,رَبِّ اغْفِرْ لِي وَهَبْ لِي مُلْكًا لَا يَنْبَغِيْ لِأَحَدٍ مِنْ بَعْدِيْ، ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে ক্ষমা কর এবং আমাকে এমন রাজত্ব দান কর, যা আমার পরে আর কেউ যেন না পায়’ (ছোয়াদ ৩৮/৩৫)। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা জিনটিকে (আমার হাতে) লাঞ্ছিত করে তাড়িয়ে দিলেন’।[11]
(৭) অভাবী লোকদের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করা : মুহাম্মাদ ইবনুল মুছান্না আল-আনাযী (রহঃ) মুনযির ইবনু জারীর থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমরা ভোরের দিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। এ সময় তাঁর কাছে পাদুকাবিহীন, প্রায় বস্ত্রহীন, গলায় চামড়ার ‘আবা’ (কালো ডোরাকাটা চাদর দিয়ে কোন রকম শরীর ঢাকা পোষাক) পরিহিত এবং নিজেদের তরবারি ঝুলন্ত অবস্থায় একদল লোক আসল। এদের অধিকাংশ কিংবা সকলেই মুযার গোত্রের লোক ছিল। অভাব-অনটনে তাদের এ করুণ অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মুখমন্ডল পরিবর্তিত ও বিষণ্ণ হয়ে গেল। তিনি ভিতরে প্রবেশ করলেন, অতঃপর বেরিয়ে এলেন। তিনি বেলাল (রাঃ)-কে আযান দিতে নির্দেশ দিলেন। বেলাল (রাঃ) আযান ও ইক্বামত দিলেন। ছালাত শেষ করে তিনি উপস্থিত মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন এবং সূরা নিসার ১নং আয়াত ও সূরা হাশরের ১৮নং আয়াত তেলাওয়াত করলেন।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমাদের প্রত্যেকেরই তাদের দীনার, দিরহাম, কাপড়-চোপড়, গম ও খেজুরের ভান্ডার হ’তে দান করা উচিত। অবশেষে তিনি বললেন, যদি খেজুরের এক টুকরাও হয়। বর্ণনাকারী বলেন, এটা শুনে আনছারদের এক ব্যক্তি একটি থলে নিয়ে এলো, যা সে বহন করতে পারছিল না। অতঃপর লোকেরা একের পর এক জিনিসপত্র আনতে লাগলো। এমনকি আমি দেখলাম, শস্যে ও কাপড়-চোপড়ে দু’টি স্তূপ হয়ে গেছে এবং দেখলাম, (আনন্দে) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চেহারা ঝলমল করছে, যেন তা স্বর্ণে মোড়ানো।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ইসলামে যে ব্যক্তি কোন নেক কাজ চালু করল সে এর ছওয়াব তো পাবেই, তার পরের লোকেরা যারা এ নেক কাজের উপর আমল করবে তাদেরও সমপরিমাণ ছওয়াব সে পাবে। অথচ এদের ছওয়াব কিছু কমবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোন মন্দ রীতির প্রচলন করল, তার জন্য তো এ কাজের গুনাহ আছেই। এরপর যারা এ মন্দ রীতির উপর আমল করবে তাদের সমপরিমাণ গুনাহও তার ভাগে আসবে, অথচ এতে আমলকারীদের গুনাহ কম করা হবে না’।[12]
(৮) কবিতা আবৃত্তি করা : মসজিদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ইসলামী হামদ-না‘ত, কবিতা আবৃত্তি করা ও প্রয়োজনীয় কথা বলা জায়েয। জাবের বিন সামুরাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
شهِدتُ النَّبيَّ صلى الله عليه وسلم أكثَرَ مِنْ مِئةِ مَرَّةٍ فيْ المَسجِدِ، وَأصحابُهُ يَتَذاكَروْنَ الشِّعرَ، وأشياءَ مِن أمْرِ الجاهليَّةِ، فرُبَّما تَبَسَّمَ معهم،
‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে শতাধিক বৈঠকে ছিলাম। সেসব বৈঠকে তাঁর ছাহাবীগণ কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং জাহিলী যুগের বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করতেন। তিনি সেগুলো চুপ করে শুনতেন এবং কখনো কখনো মুচকি হাসতেন’।[13] রাসূল (ছাঃ) তাঁর পক্ষ থেকে হাসসান বিন ছাবেতকে (কবিতার মাধ্যমে কাফেরদের) জবাব দিতে বলেন এবং তার জন্য রাসূল (ছাঃ) দো‘আ করেন।[14] উল্লেখ্য, রাসূল (ছাঃ) মসজিদে জাহেলী যুগেরও বাতিলপন্থীদের কবিতা আবৃত্তি করতে এবং কবিতা নিয়ে গর্ব-অহংকার প্রকাশ করতে নিষেধ করতেন।
(৯) ছাদাক্বার মাল জমা রাখা : মসজিদে ছাদাক্বার মাল রাখা জায়েয। যেমন ফিৎরার চাল, যাকাতের সম্পদ অথবা আল্লাহর নামে মান্নতের জিনিস। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট বাহরাইন হ’তে কিছু সম্পদ আসলো। তিনি বললেন, এগুলো মসজিদে রেখে দাও। রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এ যাবত যত সম্পদ আনা হয়েছে তার মধ্যে এ সম্পদই ছিল সবচেয়ে বেশী। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) ছালাতের জন্য চলে গেলেন। এর দিকে দৃষ্টি দিলেন না। ছালাত শেষ করে তিনি সম্পদের নিকটে গিয়ে বসলেন। তিনি যাকেই দেখলেন, কিছু সম্পদ দিয়ে দিলেন। ইতিমধ্যে আববাস (রাঃ) এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাকেও কিছু দিন। কারণ আমি নিজের ও আকীলের (এ দু’জন বদর যুদ্ধে মুসলমানদের কয়েদী ছিলাম) পক্ষ থেকে মুক্তিপণ দিয়েছি। রাসূল (ছাঃ) বললেন, নিয়ে যাও। তিনি কাপড় ভর্তি করে নিলেন। অতঃপর তা উঠাতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! কাউকে বলুন, যেন আমাকে এটি উঠিয়ে দেয়। তিনি বললেন, না। আববাস (রাঃ) বলেন, তাহ’লে আপনি নিজেই তা তুলে দিন। তিনি বললেন, না। তখন আববাস (রাঃ) তা থেকে কিছু সম্পদ রেখে দিলেন। অতঃপর পুনরায় তা তুলতে চেষ্টা করলেন। (এবারও তুলতে না পেরে) তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! কাউকে আদেশ করুন যেন আমাকে তুলে দেয়। তিনি বললেন, না। আববাস (রাঃ) বললেন, তাহ’লে আপনি তুলে দিন। তিনি বললেন, না। অতঃপর আববাস (রাঃ) আরো কিছু সম্পদ নামিয়ে রাখলেন। এবার তিনি উঠাতে পারলেন এবং তা নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। রাসূল (ছাঃ) তার এই লোভ দেখে এতই বিস্মিত হয়েছিলেন যে, তিনি আববাসের দিকে তাকিয়ে থাকলেন যতক্ষণ না তিনি চোখের আড়াল হ’লেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) সেখানে একটি দিরহাম অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত উঠলেন না।[15] এই হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মসজিদে দান-ছাদাক্বার মাল জমা করা ও বণ্টন করা যাবে।
মসজিদ সংশ্লিষ্ট অবৈধ কাজসমূহ :
মসজিদ কেন্দ্রিক অনেক অবৈধ কাজ রয়েছে। যা থেকে বেঁচে থাকা যরূরী। নিম্নে কতিপয় উল্লেখ করা হ’ল।-
(১) কবরকে মসজিদ বানানো : বর্তমানে আমাদের দেশে অনেক মসজিদের পার্শ্বেই কবর রয়েছে। কোন কোন মসজিদের নীচেও কবর রয়েছে। আবার কোন কোন কবরকে পাকা করে লাল কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে, যা ইসলামে হারাম। এমনকি মসজিদে কবর থাকলে সেখানে ছালাত নিষিদ্ধ।[16] আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর মুত্যু শয্যায় বলেছেন,لَعَنَ اللهُ اليَهُودَ والنَّصارى، اتَّخَذُوْا قُبُورَ أنْبِيائِهِمْ مَساجِدَ، ‘আল্লাহর অভিশাপ ইহুদী ও খৃষ্টানদের প্রতি। তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে’।[17]
আয়েশা (রাঃ) আরো বলেন,
أنَّ أُمَّ حَبِيبَةَ، وأُمَّ سَلَمَةَ ذَكَرَتا كَنِيسَةً رَأَيْنَها بالحَبَشَةِ فيها تَصاوِيرُ، فَذَكَرَتا للنَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فقالَ: إنَّ أُولَئِكَ إذا كانَ فِيهِمُ الرَّجُلُ الصّالِحُ فَماتَ، بَنَوْا على قَبْرِهِ مَسْجِدًا، وصَوَّرُوا فيه تِيكَ الصُّوَرَ، أُولَئِكَ شِرارُ الخَلْقِ عِنْدَ اللهِ يَومَ القِيامَةِ.
‘একদিন উম্মু হাবীবাহ ও উম্মু সালামা (রাঃ) তাঁর সাথে আলোচনা করলেন যে তাঁরা হাবশায় খৃষ্টানদের একটি গির্জা দেখে এসেছেন। সে গির্জায় নানা ধরনের চিত্র অংকিত রয়েছে। তারা দু’জন এসব কথা নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে উল্লেখ করলেন। তখন তিনি বললেন, তাদের কোন নেককার লোক মারা গেলে তার কবরের উপর মসজিদ তৈরি করত এবং এসব ছবি অংকিত করে রাখত। এরাই ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টি হিসাবে গণ্য হবে’।[18] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই বলে আল্লাহর কাছে দো‘আ করতেন, اللّهُمَّ لَا تَجْعَلْ قَبْرِىْ وَثَنًا يُعْبَدُ اشْتَدَّ غَضَبُ اللهِ عَلى قَوْمٍ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ، ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার কবরকে ইবাদতের স্থান বানিও না। আল্লাহর কঠিন রোষানলে পতিত হবে সেই জাতি, যারা তাদের নবীর কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে’।[19]
এমনকি অনেক কবরকে মাযার নাম দিয়ে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য সেখানে মানুষ মান্নত করে, সিজদা করে, সম্মান করে, গিলাফ পরায়, টাকা-পয়সা দেয় ইত্যাদি। এসবই ইসলামে হারাম ও সবচেয়ে বড় পাপ।
আবার অনেকে মসজিদের পাশে কবর দেওয়াকে কবরের আযাব থেকে রক্ষা ও ফযীলতের কাজ মনে করেন। আরো ধারণা করেন যে, মুওয়ায্যিনের আযান ও মুছল্লীদের যাতায়াত নাজাতের কারণ হবে। যেমনটি বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬ খ্রিঃ) তার এক কবিতায় লিখেছেন,
‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই।
যেন গোরে থেকেও মুওয়ায্যিনের আযান শুনতে পাই।
আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই মুছল্লীরা যাবে,
পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে,
গোর আযাব থেকে এ গুনাহগার পাইবে রেহাই।
কত পরহেযগার খোদার ভক্ত নবীজির উম্মত,
সেই কুরআন শুনে যেন আমি পরাণ জুড়াই।
কত দরবেশ-ফকীর রে ভাই মসজিদের আঙিনাতে
আল্লাহর নাম যিকির করে লুকিয়ে গভীর রাতে।
আমি তাদের সাথে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর নাম জপিতে চাই।
এসবই ভ্রান্ত আক্বীদা। কারণ মানুষ মারা গেলে দুনিয়ার সাথে তার সম্পর্ক বন্ধ হয়ে যায়। দুনিয়ার কেউ মৃত ব্যক্তিকে কিছু শুনাতে পারবে না। আবার কবরবাসীও দুনিয়ার লোকদের কোন উপকার করতে পারবে না (নামল ২৭/৮০; রূম ৩০/৫২; ফাতির ১৪)।
প্রকাশ থাকে যে, মসজিদের সাথে কবরের কোন সম্পর্ক নেই। এক্ষেত্রে কবরকে মসজিদ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে হবে অথবা মসজিদকে কবর থেকে সরিয়ে নিতে হবে। ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, আলহামদুল্লিাহ। বিদ্বানগণ এ বিষয়ে একমত যে, কবরের উপর মসজিদ করা যাবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ ব্যাপারে নিষেধ করেছেন। আর মসজিদে কোন মাইয়েতকে দাফন করা যাবে না।[20]
(২) হারানো জিনিসের ঘোষণা দেওয়া : কারো কোন জিনিস হারিয়ে গেলে মসজিদে বা মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেওয়া জায়েয নয়। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি শুনে অথবা দেখে যে, মসজিদে এসে কেউ তার হারানো জিনিস খুঁজছে, সে যেন বলে, তোমার হারানো জিনিস তুমি যেন না পাও আল্লাহ সেটিই করুন। কারণ হারানো জিনিস খোঁজার জন্য এ ঘর তৈরি করা হয়নি’।[21]
বুরায়দাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি মসজিদে হারানো জিনিস অনুসন্ধান করল। সে বলল, লাল বর্ণের উটের প্রতি কে ঘোষণা জানালো? অতঃপর নবী করীম (ছাঃ) বললেন, لاَ وَجَدْتَ إِنَّمَا بُنِيَتِ الْمَسَاجِدُ لِمَا بُنِيَتْ لَهُ، ‘তুমি যেন (তোমার হারানো জিনিস) না পাও। কেননা মসজিদ তো মসজিদের কাজের জন্য বানানো হয়েছে’।[22]
(৩) মসজিদ নিয়ে গর্ব করা : মসজিদ আল্লাহর ঘর। তাই মসজিদ নিয়ে বড়াই করা বা গর্ব করা উচিত নয়। আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لا تقوم الساعة حتى يتبًاهى الناس في المساجد ‘ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না, মানুষেরা মসজিদ নিয়ে পরস্পর গর্ব করবে’।[23]
(৪) ক্রয় বিক্রয় করা : মসজিদ নির্মাণ করা হয়, আল্লাহর ইবাদত করার জন্য, তাঁর যিকির করার জন্য ও আল্লাহর ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী পালনের জন্য। মসজিদ দুনিয়াবী কোন কাজের জন্য বানানো হয়নি। যেমন ক্রয়-বিক্রয় করা, বাযার বসানো ইত্যাদি। আমর ইবনু শু‘আয়ব (রহঃ) তার পিতা হ’তে, তার পিতা তার দাদা হ’তে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদে কবিতা আবৃত্তি করতে, ক্রয়-বিক্রয় করতে এবং জুম‘আর ছালাতের পূর্বে বৃত্তাকারে বসতে নিষেধ করেছেন।[24] এমনকি কেউ বেচা-কেনা করলে লাভবান না হওয়ার জন্য দো‘আ করতে বলেছেন।[25]
(৫) লাল বাতি জ্বালানো : অনেক মসজিদে লাল বাতি লাগানো থাকে এবং নীচে লেখা থাকে ‘লাল বাতি জ্বলানো অবস্থায় সুন্নাত আদায় করা নিষেধ’। আর জামা‘আতের দুই/এক মিনিট পূর্বে লাল বাতি জ্বালিয়ে দেয়া হয় আর মুছল্লীগণ এ অবস্থায় সুন্নাত ছালাতের নিয়ত না করে বসে বসে ফরযের জন্য অপেক্ষা করেন। এটা শরী‘আত সম্মত নয়। বরং মুছল্লী যখনই মসজিদে প্রবেশ করবে তখনই দুই রাক‘আত সুন্নাত আদায় করবে। সুন্নাত শেষ করার আগেই যদি মুওয়ায্যিন ইক্বামত দেয় তখন মুছল্লী সুন্নাত ছেড়ে দিয়ে জামা‘আতে শরীক হবে। আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, إِذا أُقِيمَتِ الصَّلاةُ فلا صَلاةَ إلّا المَكْتُوبَةُ، ‘যখন ইক্বামত দেওয়া হবে তখন ফরয ছালাত ছাড়া অন্য কোন ছালাত নেই’।[26]
(৬) অযথা গল্প-গুজব করা : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,يأتي على النّاسِ زمانٌ يكونُ حديثُهم في مساجدِهم في أمرِ دنياهم، فلا تُجالِسوهم، فليس للهِ فيهم حاجةٌ ‘অচিরেই এমন এক সময় আসবে যখন মানুষ মসজিদে বসে নিজেদের দুনিয়াবী কথাবার্তা বলবে। অতএব তোমরা এসব লোকদের গল্প-গুজবে বসবে না। আল্লাহ তা‘আলার এমন লোকের প্রয়োজন নেই’।[27]
(৭) উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা : মসজিদে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা নিষেধ। সায়িব ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كُنْتُ قائِمًا في المَسْجِدِ فَحَصَبَنِي رَجُلٌ، فَنَظَرْتُ فَإِذا عُمَرُ بنُ الخَطّابِ، فَقالَ: اذْهَبْ فَأْتِنِي بهَذَيْنِ، فَجِئْتُهُ بهِما، قالَ: مَن أنْتُما أوْ مِن أيْنَ أنْتُما؟ قالا: مِن أهْلِ الطّائِفِ، قالَ: لو كُنْتُما مِن أهْلِ البَلَدِ لَأَوْجَعْتُكُما، تَرْفَعانِ أصْواتَكُما في مَسْجِدِ رَسولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم
‘একদা আমি মসজিদে দন্ডায়মান ছিলাম, এমন সময় আমাকে একজন লোক কংকর মারলো। আমি দেখি তিনি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)। তিনি আমাকে বললেন, যাও- ঐ দু’ব্যক্তিকে আমার নিকট নিয়ে আসো। আমি তাদেরকে নিয়ে আসলাম। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কোন গোত্রের বা কোথাকার লোক? তারা বলল, আমরা তায়েফের লোক। ওমর (রাঃ) বললেন, যদি তোমরা মদীনার লোক হ’তে তাহ’লে আমি তোমাদেরকে নিশ্চয়ই কঠিন শাস্তি দিতাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মসজিদে তোমরা উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছ?[28]
মসজিদে পাশ্ববর্তী মুছল্লীর অসুবিধা করে উচ্চৈঃস্বরে যিকির করা এমনকি কুরআন তেলাওয়াত করাও নিষেধ। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) মসজিদে ই‘তিকাফ করছিলেন। তিনি ছাহাবীদের শুনতে পেলেন তারা উচ্চ আওয়াযে কুরআন তেলাওয়াত করছে। তাদের তেলাওয়াত শুনে তিনি পর্দা খুলে বলেন, إنَّ المصلِّيَ يُناجي ربَّهُ فلينظُرْ أحدُكُم بما يُناجي بِهِ ربَّهُ ولا يجهَرْ بعضُكُم على بعضٍ بالقراءةِ، ‘মুছল্লী তার প্রতিপালকের সাথে কানে কানে কথা বলে। সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকে যেন লক্ষ্য করে সে তার রবের সাথে কি বলছে। আর তোমাদের কেউ যেন একে অপরের উপরে উচ্চৈঃস্বরে কুরআন তেলাওয়াত না করে’।[29]
(৮) কারুকার্য ও নকশা করা : জমহুর ওলামায়ে কেরাম মসজিদ কারুকার্যমন্ডিত করাকে অপসন্দ করতেন।[30] আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদিন নবী করীম (ছাঃ) একখানা নকশা অংকিত কাপড়ে ছালাত আদায় করলেন এবং (ছালাত শেষে) বললেন,شَغَلَتْنِي أَعْلاَمُ هَذِهِ فَاذْهَبُوا بِهَا إِلَى أَبِي جَهْمٍ وَائْتُونِي بِأَنْبِجَانِيِّهِ ‘এ কাপড়ের নকশা ও কারুকার্য আমার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। এটা নিয়ে আবু জাহম-এর কাছে যাও এবং সাদামাটা মোটা চাদরখানা আমাকে এনে দাও’।[31] ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,ما أمرت بتشييد المساجد قال ابن عبًاس لتزخرفنها كما زخرفت اليهود والنصارى ‘মসজিদ সমূহকে উচ্চ ও চাকচিক্যময় করে নির্মাণ করার জন্য আমি আদিষ্ট হইনি। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, অবশ্যই তোমরা মসজিদগুলোকে চাকচিক্যময় করবে যেভাবে ইহুদী-খ্রিস্টানরা (গীর্জাকে) চাকচিক্যময় করেছে’।[32]
(৯) মসজিদে লাল ও হলুদ রং ব্যবহার করা : মুছল্লীদের ছালাতে বাধা সৃষ্টি করে এমন কোন কিছু মসজিদে স্থাপন করা যাবে না। এমনকি রঙের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা যরূরী। আবু সাঈদ (রাঃ) বলেন, মসজিদে নববীর ছাদ ছিল খেজুর গাছের ডালের তৈরী। ওমর (রাঃ) মসজিদ নির্মাণের হুকুম দিয়ে বলেন, আমি লোকদেরকে বৃষ্টি হ’তে রক্ষা করতে চাই। মসজিদে লাল ও হলুদ রং লাগানো হ’তে সাবধান থাক, এতে মানুষকে তুমি ফিতনায় ফেলবে’।[33]
অনেকে মক্কা-মদীনার ভালেবাসার নিদর্শন হিসাবে মেহরাবের দুই পাশে কা‘বা ও মাসজিদুল হারাম অথবা মসজিদে নববীর মিনারের ছবি ব্যবহার করে থাকেন। এমনকি অনেকে মেহরাবের উপরে কালিমা তাইয়েবা বা কালিমা শাহাদত লিখে রাখেন। এটা পরিহার করা যরূরী। কেননা এর ফলে ছালাতের সময় অনেকের মনোযোগ সেদিকে চলে যায়। যা ছালাতের খুশূ-খুযূতে বিঘ্ন ঘটায়।
(১০) জুম‘আর ছালাতের পূর্বে মসজিদে বৃত্তাকারে বসা : জুম‘আর দিন ইমামের খুৎবার আগে কোন রকমের মজলিস কায়েম করা বা হালাকার ব্যবস্থা করা নিষেধ। আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,نَهَى عَنِ الشِّرَاءِ وَالْبَيْعِ فِي الْمَسْجِدِ وَأَنْ تُنْشَدَ فِيهِ ضَالَّةٌ وَأَنْ يُنْشَدَ فِيهِ شِعْرٌ وَنَهَى عَنِ التَّحَلُّقِ قَبْلَ الصَّلاَةِ يَوْمَ الْجُمُعَةِ، ‘রাসূল (ছাঃ) মসজিদে বেচা-কেনা করতে, হারনো বস্ত্ত তালাশ করতে এবং কবিতা আবৃত্তি করতে নিষেধ করেছেন। আর নিষেধ করেছেন জুম‘আর দিন ছালাতের পূর্বে মসজিদে গোল হয়ে বসতে’।[34] অর্থাৎ বিভিন্ন স্থানে গোল হয়ে বসে কথা বলা যাতে, মুছল্লীদের ছালাতে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়।
(১১) সহবাস করা : মসজিদে স্বামী-স্ত্রী সহবাস করা হারাম। মহান আল্লাহ বলেন,وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ تِلْكَ حُدُودُ اللهِ ‘আর তোমরা স্ত্রীগমন করো না যখন তোমরা মসজিদে ই‘তেকাফ অবস্থায় থাক’ (বাক্বারাহ ২/১৮৭)। তবে মসজিদে ই‘তিকাফ অবস্থায় স্ত্রীর সাথে দেখা সাক্ষাৎ, কথা-বার্তা ও খোঁজ-খবর নেওয়াতে কোন অসুবিধা নেই। ছাফিয়া বিনতে হুই (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ই‘তেকাফ অবস্থায় তাঁর খিদমতে উপস্থিত হ’তেন এবং কোন প্রয়োজনীয় কথা জিজ্ঞেস করার থাকলে তা জিজ্ঞেস করে চলে যেতেন। একদা রাত্রে যখন তিনি চলে যাচ্ছিলেন তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁকে বাড়ীতে পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য তাঁর সাথে যান। কেননা তাঁর বাড়ী মসজিদে নববী হ’তে একটু দূরে ছিল। পথে দু’জন আনছার ছাহাবীর (রাঃ) সাথে সাক্ষাৎ হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে তাঁর স্ত্রী দেখে তাঁরা লজ্জিত হন এবং দ্রুত পদক্ষেপে চলতে থাকেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা থামো এবং জেনে রাখো যে, এটা আমার স্ত্রী ছাফিয়া বিনতে হুই (রাঃ)। তখন তারা বলেন, সুবহানাল্লাহ (অর্থাৎ আমরা অন্য কোন ধারণা করতে পারি)! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন বলেন,إنَّ الشَّيطانَ يجري مِنْ ابنِ آدمَ مجرى الدَّمِ وإنِّي خشيتُ أن يقذفَ في قلوبِكما شيئًا، ‘শয়তান মানুষের শিরায় শিরায় রক্তের ন্যায় চলাচল করে থাকে। আমার আশংকা হ’ল যে, সে তোমাদের অন্তরে কোন কু-ধারণা সৃষ্টি করে করে দেয় কি-না’।[35] এমনকি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ই‘তিকাফ অবস্থায় মসজিদ থেকে মাথা বের করে দিতেন আর আয়েশা (রাঃ) হায়েয অবস্থায় তাঁর মাথা আঁচড়ে দিতেন।[36]
(১২) আল্লাহ ও মুহাম্মাদ লিখা : অনেকে মসজিদের মেহরাবের ডানে ও বামে একপাশে আল্লাহ ও অপর পাশে মুহাম্মাদ লিখে রাখেন। এভাবে মসজিদের এক পাশে আল্লাহ অন্য পাশে মুহাম্মাদ লিখে রাখা শিরকী আক্বীদার নামান্তর। যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কেননা স্রষ্টা ও সৃষ্টি কখনো সমপর্যায়ভুক্ত নয়। আল্লাহ ও মুহাম্মাদ কখনো একই মর্যাদার অধিকারী নন। আল্লাহ হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা। আর মুহাম্মাদ (ছাঃ) হচ্ছেন আল্লাহর সৃষ্ট বান্দা ও রাসূল। এছাড়াও অনেকে মসজিদের চারপাশে আল্লাহর গুণবাচক নাম, সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত, আয়াতুল কুরসী লিখে রাখেন, এগুলিও ঠিক নয়। আনাস (রাঃ) বলেন, আয়েশা (রাঃ)-এর একটি পর্দা ছিল। তিনি সেটা দ্বারা তার ঘরের এক পাশ^র্ ঢেকে রেখেছিলেন। নবী করীম (ছাঃ) তাকে বলেন, أمِيطِي عَنَّا قِرامَكِ هذا، فإنَّه لا تَزالُ تَصاوِيرُهُ تَعْرِضُ في صَلاتِي، ‘আমার সামনে থেকে তোমার এই পর্দাটা সরিয়ে নাও। কারণ ছালাতের মধ্যে এই ছবিগুলো আমার সামনে বারবার আসছে’।[37]
(১৩) নিজের জন্য নির্দিষ্ট কোন জায়গা নির্ধারণ করা : আব্দুর রহমান ইবনু শিবল (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন,
نَهَى رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَنْ نَقْرَةِ الْغُرَابِ وَافْتِرَاشِ السَّبُعِ وَأَنْ يُوَطِّنَ الرَّجُلُ الْمَكَانَ فِي الْمَسْجِدِ كَمَا يُوَطِّنُ الْبَعِيْرُ،
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিষেধ করেছেন কাকের ঠোকরের মত (তাড়াতাড়ি) সিজদাহ করতে, চতুস্পদ জন্তুর ন্যায় বাহু বিছাতে এবং উটের ন্যায় মসজিদের মধ্যে নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করে নিতে’।[38]
(১৪) কাতারের মাঝখানে পিলার বা দেওয়াল রাখা : বর্তমানে অনেক মসজিদের কাতারের মাঝখানে পিলার দেওয়া হয়, যা দু’জন মুছল্লীর মাঝখানে আড়াল সৃষ্টি করে, এ ধরনের কাজ নিষিদ্ধ। মু‘আবিয়াহ ইবনু কুর্রা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, كنا نُنهى أن نصُفَّ بين السَّواري على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم ‘রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে আমাদেরকে নিষেধ করা হ’ত আমরা যেন খুঁটির মাঝে ছালাতের কাতার না করি’।[39]
[চলবে]
মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
সহকারী শিক্ষক, ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল, খিলগাঁও, ঢাকা।
[1]. বুখারী হা/৬৬; মুসলিম হা/৬১৭৬; আহমাদ হা/২১৯৬৬।
[2]. বুখারী হা/৬৩; নাসাঈ হা/২০৯২-৯৩; ইবনু মাজাহ হা/১৪০২।
[3]. বুখারী হা/৪৫৯; মুসলিম হা/১৫৮০; আহমাদ হা/২৬৪৩৪।
[4]. আবূদাঊদ হা/৩১০১, হাদীছ ছহীহ।
[5]. মুসলিম হা/৬৭০; আবূদাঊদ হা/১২৯৪; তিরমিযী হা/৫৮৫।
[6]. মুসলিম, আবূদাঊদ হা/১২৯৪; মিশকাত হা/৪৭৪৭।
[7]. বুখারী হা/৪৭৫; আবূদাঊদ হা/৪৮৬৬; মিশকাত হা/৪৭০৮।
[8]. বুখারী হা/৪৪০; নাসাঈ হা/৭২২; তিরমিযী হা/৩২১।
[9]. বুখারী হা/৪৪১।
[10]. আবূদাঊদ হা/২৬৭৯; নাসাঈ হা/৭১২।
[11]. মুসলিম হা/১০৯৬।
[12]. মুসলিম হা/২২৪১; মিশকাত হা/২১০।
[13]. তিরমিযী হা/২৮৫০; আহমাদ হা/২০৮৮৫; ছহীহ ইবনে হিববান হা/৫৭৮১।
[14]. বুখারী হা/৩২১২; মুসলিম হা/২৪৮৫।
[15]. বুখারী হা/৪২১; আবূদাঊদ হা/৩১০১; নাসাঈ হা/৭১০।
[16]. আবূদাঊদ হা/৪৯২; তিরমিযী হা/৩১৭; মিশকাত হা/৭৩৭।
[17]. বুখারী হা/১৩৯০; মুসলিম হা/৫২৯; মিশকাত হা/৭১২।
[18]. বুখারী হা/৩৮৭৩।
[19]. মুয়াত্ত্বা মালিক হা/৪১৪; মিশকাত হা/৭৫০।
[20]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২২/১৯৪-৯৫ পৃঃ; আলবানী, তাহযীরুল সাজিদ ৪৫ পৃঃ; মাসিক আত-তাহরীক আগষ্ট ২০১৬ প্রশ্নোত্তর ৩১/৪৩১।
[21]. মুসলিম হা/৫৬৮; আবূদাঊদ হা/৪৭৩; ইবনু মাজাহ হা/৭৬৭; মিশকাত হা/৭০৬।
[22]. মুসলিম হা/১১৪৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৫৬৮।
[23]. আবূদাঊদ হা/৪৪৯; নাসাঈ হা/৬৮৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৮৯৫; মিশকাত হা/৭১৯।
[24]. আবূদাঊদ হা/১০৭৯; তিরমিযী হা/৩২২; মিশকাত হা/৭৩২।
[25]. তিরমিযী হা/১৩২১; ইরওয়া হা/১২৯৫; মিশকাত হা/৭৩৩।
[26]. মুসলিম হা/৭১০; আবূদাঊদ হা/১২৬৬।
[27]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/২৯৬২; হাকিম হা/৭৯১৬; ছহীহাহ হা/১১৬৩; মিশকাত হা/৭৪৩।
[28]. বুখারী হা/৪৭০; মিশকাত হা/৭৪৪।
[29]. আবূদাঊদ হা/১৩৩২; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৭১৪।
[30]. ইবনে তায়মিয়া মাজমূ‘ ফৎওয়া ২/১৮৩।
[31]. বুখারী হা/৭৫২; মুসলিম হা/১১২৫।
[32]. আবূদাঊদ হা/৪৪৮; মিশকাত হা/৭১৮।
[33]. বুখারী হা/৪৬৬ এর আলোচনা দ্রঃ।
[34]. আবূদাঊদ হা/১০৭৯; তিরমিযী হা/৩২২; নাসাঈ হা/৭১৩।
[35]. বুখারী হা/৩২৮১; মুসলিম হা/২১৭৫।
[36]. বুখারী হা/৫৯২৫।
[37]. বুখারী হা/৩৭৪; মিশকাত হা/৭৫৮।
[38]. আবূদাঊদ হা/৮৬২; নাসাঈ হা/১১১১; ইবনু মাজাহ হা/১৪২৯।
[39]. ইবনু মাজাহ হা/১০০২; ছহীহাহ হা/৩৩৫।