মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ইবাদতগুলোর মধ্যে ছালাত হচ্ছে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত। যা ঈমানের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ। এটা মুমিন ও কাফিরের মাঝে পার্থক্যকারী। আর এ ইবাদত পালনের অন্যতম স্থান হ’ল মসজিদ। যা পৃথিবীর মধ্যে আল্লাহর নিকটে সবচেয়ে পসন্দের জায়গা। প্রত্যেক মুমিন প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচবার তার প্রভূর আদেশ পালনার্থে সেখানে সমবেত হয়। এই মসজিদে আসা-যাওয়া ও অবস্থানের অনেক ফযীলত ও নিয়ম-কানূন রয়েছে। সাথে সাথে আল্লাহর ঘর মসজিদ নির্মাণ করা ও আবাদ করাও অনেক ফযীলতপূর্ণ কাজ। আলোচ্য প্রবন্ধে এই বিষয়ে আলোচনা করা হ’ল।-
মসজিদের পরিচিতি :
মাসজিদ শব্দটি আরবী। কুরআনে শব্দটি মোট ১৭ বার এসেছে। আর ‘মাসজিদ’ (مسجد) শব্দটি স্থানবাচক শব্দ। যার অর্থ হ’ল- সিজদার স্থান, ছালাতের স্থান। আভিধানিক অর্থে যেখানে বান্দা আল্লাহর ইবাদতের নিমিত্তে সিজদা করে সেটাই মাসজিদ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,وَجُعِلَتْ لِىَ الأَرْضُ مَسْجِدًا وَطَهُورًا ‘আমার জন্য ভূপৃষ্ঠকে মসজিদ ও পবিত্র করা হয়েছে’।[1] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,حَيْثُما أَدْرَكَتْكَ الصَّلاةُ فَصَلِّ، والأرْضُ لكَ مَسْجِدٌ، ‘যেখানেই তোমার ছালাতের সময় হবে, সেখানেই তুমি ছালাত আদায় করে নিবে। কারণ গোটা পৃথিবী তোমার জন্য মসজিদ বা সিজদার স্থান’।[2] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, وَجُعِلَتْ لِىَ الأَرْضُ طَيِّبَةً طَهُورًا وَمَسْجِدًا، ‘আমার জন্য গোটা পৃথিবী পাক-পবিত্র ও মসজিদ করা হয়েছে’।[3] পৃথিবীর সকল স্থানের মালিক হ’লেন আল্লাহ। সুতরাং আল্লাহর জন্য তাঁর বান্দা বা যমীনের যে কোন পবিত্রতম স্থানে সিজদায় লুটিয়ে পড়বে। আর ওযূর জন্য কোন পানি না পেলে অথবা পানি ব্যবহারে অক্ষম হ’লে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে পবিত্র হ’তে পারবে (নিসা ৪/৪৮)।
মাসজিদ শব্দটি নিমেণাক্ত অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন-
(১) الجامع (আল-জামে‘) : ঐ মসজিদকে জামে‘ মসজিদ বলা হয় যেখানে মানুষ সপ্তাহের জুম‘আর দিনে যোহরের ওয়াক্তে জুম‘আর ছালাত আদায় করার জন্য একত্রিত হয়।
(২) المصلى (আল-মুছাল্লা) : ছালাত অথবা দো‘আর স্থান। ইসলামী শরী‘আতের পরিভাষায় মাসজিদ হ’ল,
البيوت المبنية للصلاة فيها لله فهي خالصة له سبحانه ولعبادته،
‘এমন গৃহ, যা একমাত্র ছালাতের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। আর এটা একমাত্র আল্লাহর ও তাঁর ইবাদতের জন্যই নির্দিষ্ট।[4]
যে সকল স্থানে ছালাত আদায় করা নিষিদ্ধ :
পৃথিবীর সকল পবিত্র স্থানে ছালাত আদায় করা গেলেও নিমেণর স্থানগুলিতে ছালাত আদায় নিষিদ্ধ :
কবরস্থান ও গোসলখানা : আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,الاَرْضُ كُلُّهَا مَسْجِدٌ اِلَّا الْمَقْبَرَةَ وَالْحَمَّامَ، ‘সমগ্র যমীনই মসজিদ (তথা ছালাতের স্থান) কেবলমাত্র কবরস্থান ও গোসলখানা ব্যতীত’।[5]
উট বাঁধার স্থান : উট বাঁধার স্থানে ছালাত আদায় করা যাবে না। বারা ইবনু আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে উট বাঁধার স্থানে ছালাত আদায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, ‘তোমরা উট বাঁধার স্থানে ছালাত আদায় করবে না। কারণ সেটি শয়তানের আড্ডাখানা। অতঃপর তাঁকে ছাগল বাঁধার স্থানে ছালাত আদায় করার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘তোমরা তাতে ছালাত আদায় কর, কারণ তা বরকতময়’।[6] আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
إِنْ لَمْ تَجِدُوا إِلاَّ مَرَابِضَ الْغَنَمِ وَأَعْطَانَ الإِبِلِ فَصَلُّوا فِي مَرَابِضِ الْغَنَمِ وَلاَ تُصَلُّوْا فِيْ أَعْطَانِ الإِبِلِ،
‘তোমরা
বকরী ও উটের খোঁয়াড় ব্যতীত ছালাত আদায় করার কোন জায়গা না পেলে, বকরীর
খোঁয়াড়ে ছালাত আদায় করতে পার, কিন্তু উটের খোঁয়াড়ে আদায় করবে না’।[7]
আযাবের স্থান :
পূর্ববর্তী জাতিসমূহের উপর আযাবের স্থানে ছালাত আদায় করা যাবে না।
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা
এসব আযাবপ্রাপ্ত সম্প্রদায়ের লোকালয়ে ক্রন্দনরত অবস্থা ব্যতীত প্রবেশ করবে
না। কান্না না আসলে সেখানে প্রবেশ করো না, যেন তাদের উপর যা আপতিত হয়েছিল
তা তোমাদের প্রতিও আসতে না পারে’।[8]
ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন নবী (ছাঃ) হিজর (ছামূদ গোত্রের বস্তি) অতিক্রম করেন, তখন তিনি বললেন, যারা নিজ আত্মার উপর অত্যাচার করেছিল তাদের আবাসস্থলে কান্নাকাটি ব্যতীত প্রবেশ কর না যাতে তোমাদের প্রতি শাস্তি আপতিত না হয়, যা তাদের প্রতি হয়েছিল। তারপর তিনি তাঁর মস্তক আবৃত করলেন এবং অতি দ্রুতবেগে চলে উক্ত উপত্যকা অতিক্রম করলেন।[9]
বিদ্বানগণের ঐক্যমতে আযাবের স্থানে ছালাত আদায় নিষিদ্ধ। ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, গযবের স্থানে ছালাত আদায় করা সকলের ঐক্যমতে হারাম।[10]
ব্যস্ত রাস্তায় ছালাত আদায় করা : ব্যস্ত রাস্তা যেখানে যানবাহন চলাচল করে সেখানে মানুষকে কষ্ট দিয়ে ছালাত আদায় না করাই উত্তম। তবে যদি রাস্তার এক পাশে হয় এবং মানুষের চলাচলে অসুবিধা না হয় তাহ’লে সেখানে ছালাত আদায় করা যাবে। এছাড়া পরিত্যাক্ত রাস্তায় ছালাত আদায় করা যাবে। তাছাড়া যরূরী প্রয়োজন, যেমন জুম‘আ ও ঈদের ছালাতে জায়গা সংকুলান না হ’লে রাস্তায় আদায় করা যাবে।[11] জনগণের চালাচলে বিঘ্ন না ঘটলে রাস্তায় ছালাত আদায় করা যাবে। যেমন নিম্নের হাদীছে এসেছে,
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা রাস্তার মাঝে বসা সম্পর্কে সতর্ক হও। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাতে না বসে তো আমাদের উপায় নেই। আমরা তথায় (বসে) আলোচনা করে থাকি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যদি তোমাদের একান্তই বসতে হয়, তাহ’লে তোমরা রাস্তার হক আদায় করবে। ছাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! রাস্তার হক কি? তিনি বললেন, দৃষ্টি সংযত রাখা, কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা, সালামের জবাব দেয়া, সৎকাজের আদেশ দেয়া এবং অসৎ কাজ হ’তে নিষেধ করা’।[12]
সর্বপ্রথম নির্মিত মসজিদ :
পৃথিবীর প্রথম মসজিদ হ’ল মক্কায় অবস্থিত মসজিদে হারাম বা বায়তুল্লাহ। মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِلْعَالَمِيْنَ، ‘নিশ্চয়ই প্রথম ইবাদতগৃহ, যা মানবজাতির জন্য মক্কায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যা বরকতমন্ডিত এবং বিশ্ববাসীর জন্য পথ প্রদর্শক’ (আলে ইমরান ৩/৯৬)।
আবূ যার গিফারী (রাঃ)
বলেন,قُلتُ: يا رَسولَ اللهِ، أَيُّ مَسْجِدٍ وُضِعَ أَوَّلَ؟ قالَ:
المَسْجِدُ الحَرامُ. قُلتُ: ثُمَّ أَيٌّ؟ قالَ: ثُمَّ المَسْجِدُ الأقْصى
قُلتُ: كَمْ كانَ بيْنَهُما؟ قالَ: أَرْبَعُونَ، ثُمَّ قالَ: حَيْثُما
أَدْرَكَتْكَ الصَّلاةُ فَصَلِّ، والأرْضُ لكَ مَسْجِدٌ، ‘আমি বললাম, হে
আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! সর্বপ্রথম কোন মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি
বললেন, মসজিদে হারাম। আমি বললাম, অতঃপর কোন্টি? তিনি বললেন, মসজিদে আক্বছা।
আমি বললাম, এ দুইয়ের নির্মাণের মাঝখানে ব্যবধান কত? তিনি বললেন, চল্লিশ
(বছরের)। (অতঃপর তিনি বললেন), যেখানেই তোমার ছালাতের সময় হবে, সেখানেই তুমি
ছালাত আদায় করবে। কারণ সম্পূর্ণ পৃথিবীই তোমার জন্য মসজিদ বা সিজদার
স্থান’।[13]
পৃথিবীর প্রথম মসজিদ আদম (আঃ) সর্বপ্রথম কা‘বা ঘর নির্মাণ করেন।[14] পরে ইব্রাহীম (আঃ) স্বীয় পুত্র সন্তান ও তাঁর স্ত্রীকে এই মসজিদের নিকটে রেখে আল্লাহর কাছে এই বলে দো‘আ করেন, ‘আর যখন ইবরাহীম বলেছিল, হে আমার পালনকর্তা, এ শহর (মক্কা)-কে তুমি শান্তিময় কর এবং আমাকে ও আমার সন্তানদের তুমি মূর্তিপূজা থেকে দূরে রাখ। হে আমার প্রতিপালক! এই মূর্তিগুলো বহু মানুষকে বিপথগামী করেছে। অতএব যে আমার অনুসারী হবে, সে আমার দলভুক্ত। আর যে আমার অবাধ্য হবে, নিশ্চয় তুমি ক্ষমাশীল ও দয়াবান। হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার এক সন্তানকে তোমার এ পবিত্র (কা‘বা) গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় আবাদ করেছি। হে আমাদের পালনকর্তা যেন তারা ছালাত কায়েম করে। অতএব কিছু মানুষের অন্তরকে তুমি তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে দাও এবং তাদেরকে ফল-ফলাদি দ্বারা রূযী দান কর। যাতে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে’ (ইবরাহীম ১৪/৩৫-৩৭)।
পরে আল্লাহর আদেশে ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ) কা‘বা ঘর পুনর্নির্মাণ করেন এবং আল্লাহর কাছে এই বলে দো‘আ করেন, رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ، ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি আমাদের পক্ষ হ’তে এটি কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (বাক্বারাহ ২/১২৭)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সময় কা‘বা ঘরের দেয়ালগুলো নষ্ট হয়ে যায় এবং কা‘বা ঘর থেকে মূল্যবান মালামাল চুরি হয়ে যায়। তখন কুরায়েশরা কা‘বা ঘর সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ছিল তখন ৩৫ বছর। কা‘বা নির্মাণের পর হাজারে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে কুরাইশদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব দেখা দিলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মধ্যস্ততায় এর সমাধান হয় এবং গোত্রীয় দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। ফলে সকলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থেকে রক্ষা পায়।
হালাল টাকার
অভাবে কুরাইশরা কা‘বাকে ইব্রাহীম (আঃ)-এর মূল ভিত্তির উপর নির্মাণ করতে
পারেনি। ফলে হাত্বীমকে কা‘বার দেয়ালের বাইরে রাখা হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর
ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সার্বিক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে এটা থেকে বিরত
থাকেন।[15]
আয়েশা (রাঃ)-এর বোনের ছেলে বিশিষ্ট ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (রাঃ) স্বীয় খেলাফতকালে (৬৪-৭৩ হিঃ) ৬৪ হিজরী সনে কা‘বাগৃহ ভেঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ইচ্ছানুযায়ী তা পুনর্নির্মাণ করেন। কিন্তু ৭৩ হিজরী সনে তিনি যুদ্ধে নিহত হ’লে উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক ইবনু মারওয়ানের নির্দেশে গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তা পুনরায় ভেঙ্গে আগের মত হাত্বীমকে বাইরে রেখে নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে আববাসীয় খলীফা মাহদী ও হারূণ এটি পুনর্নির্মাণ করে রাসূল (ছাঃ)-এর ইচ্ছা পূরণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯ হিঃ) তাদেরকে বলেন, ‘আপনারা কা‘বা গৃহকে রাজা-বাদশাহদের খেল-তামাশার বস্ত্ততে পরিণত করবেন না।[16] বর্তমানে এভাবেই কা‘বা ঘর রয়েছে এবং হাজীগণ হাত্বীমের বাহির দিয়েই তাওয়াফ করেন।
মসজিদে যিরার বা ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে নির্মিত মসজিদ :
মসজিদে যিরার সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
وَالَّذِيْنَ اتَّخَذُوْا مَسْجِدًا ضِرَارًا وَكُفْرًا وَتَفْرِيقًا بَيْنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَإِرْصَادًا لِمَنْ حَارَبَ اللهَ وَرَسُولَهُ مِنْ قَبْلُ وَلَيَحْلِفُنَّ إِنْ أَرَدْنَا إِلَّا الْحُسْنَى وَاللهُ يَشْهَدُ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ، لَا تَقُمْ فِيْهِ أَبَدًا لَمَسْجِدٌ أُسِّسَ عَلَى التَّقْوَى مِنْ أَوَّلِ يَوْمٍ أَحَقُّ أَنْ تَقُومَ فِيْهِ فِيهِ رِجَالٌ يُحِبُّونَ أَنْ يَتَطَهَّرُوا وَاللهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِيْنَ-
‘আরেক দল লোক রয়েছে যারা মসজিদ নির্মাণ করে (ইসলামের) ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে, যিদ ও কুফরীর তাড়নায়, মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে পূর্ব থেকেই যুদ্ধকারীদের ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহারের জন্য। অথচ তারা কসম করে বলে যে, কল্যাণ ব্যতীত আমরা অন্য কিছুই কামনা করি না। পক্ষান্তরে আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, ওরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী। তুমি সেখানে কখনো দাঁড়াবে না। অবশ্যই যে মসজিদ প্রথম দিন থেকে তাক্বওয়ার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, সেটাই তোমার (ছালাতের জন্য) দাঁড়াবার যথাযোগ্য স্থান। সেখানে এমন সব লোক রয়েছে, যারা উত্তমরূপে পরিশুদ্ধ হওয়াকে ভালবাসে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন’ (তাওবা ৯/১০৭-১০৮)।
মসজিদে যিরার নির্মাণের ইতিহাস :
মসজিদে যিরার মুনাফিকদের চক্রান্তের একটি অংশ। মদীনায় আবু ‘আমের নামক এক ব্যক্তি জাহেলী যুগে নাছারা ধর্ম গ্রহণ করে আবু ‘আমের পাদ্রী নামে খ্যাত ছিল। তার পুত্র ছিলেন বিখ্যাত ছাহাবী হানযালা (রাঃ), যার লাশকে ফেরেশতাগণ গোসল দিয়েছিলেন। কিন্তু পিতা নিজের গোমরাহী ও নাছারাদের দ্বীনের উপরই ছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হিজরত করে মদীনায় আসলে আবু ‘আমের তার কাছে উপস্থিত হয় এবং ইসলামের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার অভিযোগের জবাব দেন। কিন্তু তাতে সেই হতভাগার অন্তর তৃপ্ত হ’ল না। তদুপরি সে বলল, আমরা দু’জনের মধ্যে যে মিথ্যুক সে যেন অভিশপ্ত ও আত্মীয়-স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মুত্যুবরণ করে। সে এ কথাও বলল যে, আপনার যে কোন প্রতিপক্ষের সাহায্য আমি করে যাব। সে মতে হুনাইন যুদ্ধ পর্যন্ত সকল রণাঙ্গনে সে মুসলমানদের বিপরীতে অংশ নেয়। হাওয়াযেনের মত সুবৃহৎ শক্তিশালী গোত্রও যখন মুসলমানদের কাছে পরাজিত হ’ল, তখন সে নিরাশ হয়ে সিরিয়া চলে গেল। কারণ তখন সিরিয়া ছিল নাছারাদের কেন্দ্রস্থল।
এ ষড়যন্ত্রের শুরুতে সে মদীনার পরিচিত মুনাফিকদের কাছে চিঠি লিখে যে, রোম সম্রাট কর্তৃক মদীনা অভিযানের চেষ্টায় আমি আছি। কিন্তু যথাসময়ে সম্রাটের সাহায্য হয় এমন কোন সম্মিলিত শক্তি তোমাদের থাকা চাই। এর পন্থা হ’ল এই যে, তোমরা মদীনায় মসজিদের নাম দিয়ে একটি গৃহ নির্মাণ কর, যেন মুসলিমদের অন্তরে কোন সন্দেহ না আসে। তারপর সে গৃহে নিজেদের সংগঠিত কর এবং যতটুকু সম্ভব যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম সংগ্রহ করে সেখানে রাখ। আর পারস্পরিক আলোচনা ও পরামর্শের পর মুসলিমদের বিরুদ্ধে কর্মপন্থা গ্রহণ কর। তারপর আমি রোম সম্রাটকে নিয়ে এসে মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথীদের উৎখ্যাত করব।
তার এ পত্রের ভিত্তিতে বার জন মুনাফিক মদীনার কূবা মহল্লায় একটি মসজিদ নির্মাণ করে। তারপর তারা মুসলমানদের প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে সিদ্ধান্ত নেয় যে, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দ্বারা এক ওয়াক্ত ছালাত সেখানে পড়াবে। এতে মুসলিমগণ নিশ্চিত হবে যে, পূর্বনির্মিত মসজিদের মত এটিও একটি মসজিদ। এ সিদ্ধান্ত মতে তাদের এক প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে হাযির হয়ে আরয করে যে, কূবার বর্তমান মসজিদটি অনেক ব্যবধানে রয়েছে। দুর্বল ও অসুস্থ লোকদের সে পর্যন্ত যাওয়া দুস্কর। এছাড়া মসজিদটি এমন প্রশস্ত নয় যে, এলাকার সকল লোকের সংকুলান হ’তে পারে। তাই আমরা দুর্বল লোকদের সুবিধার্থে অপর একটি মসজিদ নির্মাণ করেছি। আপনি যদি তাতে এক ওয়াক্ত ছালাত আদায় করেন, তবে আমরা ধন্য হব।
নবম হিজরীর রজব মাসে
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন তাবূক যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি
প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, সফর শেষে ফিরে এসে ছালাত আদায় করবেন। কিন্তু তাবূক
যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে যখন তিনি মদীনার নিকটবর্তী এক স্থানে বিশ্রাম
নিচ্ছিলেন, তখন সূরা তওবার উপরোক্ত ১০৭ ও ১০৮ নং আয়াত নাযিল করে মহান
আল্লাহ মুনাফিকদের যড়যন্ত্র ফাঁস করে দেন।[17]
আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কতিপয় ছাহাবীকে এ হুকুম দিয়ে পাঠালেন যে, এক্ষুণি গিয়ে কথিত মসজিদটি ধ্বংস কর এবং আগুন লাগিয়ে এসো। আদেশ মতে তারা গিয়ে মসজিদটি সমূলে ধ্বংস করে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে আসলেন।
তাই
কোন মসজিদকে যিরার হওয়ার জন্য চারটি শর্ত রয়েছে। ১. মুসলিমদের ক্ষতি সাধন
২. কুফরী করা, ৩. মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি ও ৪. সেখানে আল্লাহ ও তাঁর
রাসূলের শক্রদের আশ্রয় দান।[18]
পূর্ববতী উম্মতের আমলে মসজিদ :
পূর্ববর্তী উম্মতদের ইবাদতের স্থানও মসজিদ বলে আল্লাহ কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করেছেন। আছহাবে কাহাফের আলোচনা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
وَكَذَلِكَ أَعْثَرْنَا عَلَيْهِمْ لِيَعْلَمُوا أَنَّ وَعْدَ اللهِ حَقٌّ وَأَنَّ السَّاعَةَ لَا رَيْبَ فِيْهَا إِذْ يَتَنَازَعُونَ بَيْنَهُمْ أَمْرَهُمْ فَقَالُوا ابْنُوا عَلَيْهِمْ بُنْيَانًا رَبُّهُمْ أَعْلَمُ بِهِمْ قَالَ الَّذِيْنَ غَلَبُوْا عَلَى أَمْرِهِمْ لَنَتَّخِذَنَّ عَلَيْهِمْ مَسْجِدًا-
‘এভাবে আমরা তাদের বিষয়টি প্রকাশ করে দিলাম। যাতে লোকেরা জানতে পারে যে, আল্লাহর ওয়াদা সত্য এবং কিয়ামতে কোন সন্দেহ নেই। অতঃপর যখন লোকেরা তাদের করণীয় বিষয়ে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করল, তখন তারা বলল, তাদের গুহামুখে তোমরা একটা প্রাচীর নির্মাণ কর (যাতে ওটা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়)। কেননা তাদের বিষয়ে তাদের প্রতিপালকই ভাল জানেন। তবে তাদের কর্তব্য বিষয়ে যাদের মত প্রবল ছিল তারা বলল যে, আমরা অবশ্যই তাদের উপর একটা মসজিদ নির্মাণ করব’ (কাহাফ ১৮/২১)।
বনী ইসরাঈলের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
إِنْ أَحْسَنْتُمْ أَحْسَنْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ وَإِنْ أَسَأْتُمْ فَلَهَا فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ الْآخِرَةِ لِيَسُوءُوا وُجُوهَكُمْ وَلِيَدْخُلُوا الْمَسْجِدَ كَمَا دَخَلُوهُ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَلِيُتَبِّرُوا مَا عَلَوْا تَتْبِيرًا-
‘তোমরা সৎকর্ম করলে নিজেদের জন্যই সেটা করবে। আর মন্দকর্ম করলে সেটাও নিজেদের জন্য। অতঃপর যখন প্রতিশ্রুত দ্বিতীয় সময়টি এসে গেল, (তখন আমরা অন্য বান্দাদের প্রেরণ করলাম) যাতে তারা তোমাদের মুখমন্ডল কালিমালিপ্ত করে দেয় এবং যাতে তারা মসজিদে (বায়তুল মুক্বাদ্দাসে) ঢুকে পড়ে, যেমন প্রথমবার ঢুকেছিল এবং যেখানেই জয়ী হয় সেখানেই পুরোপুরি ধ্বংসযজ্ঞ চালায়’ (ইসরা ১৭/৭)।
এছাড়াও ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ)-এর বায়তুল্লাহ নির্মাণের কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে এবং যাকারিয়া (আঃ) মসজিদের ইমাম ছিলেন এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে ঈসা (আঃ)-এর মা মারিয়াম (আঃ) মসজিদেরই খাদেম ছিলেন এবং মসজিদের এক পার্শ্বে অবস্থান করেই মসজিদের খিদমত করতেন (আলে ইমরান ৩/৩৬-৩৯)।
[চলবে]
লেখক পরিচিতি : সহকারী শিক্ষক, ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল, খিলগাঁও, ঢাকা।
[1]. বুখারী হা/২৯৭৭; মুসলিম হা/৫২৩; ইবনে মাজাহ হা/৫৬৭।
[2]. বুখারী হা/৩৪২৫; মুসলিম হা/৫২০।
[3]. মুসলিম হা/১০৫০, (ই.ফা) হা/১০৪৪; ছহীহুল জামি‘ হা/৩১০০।
[4]. আল-মাউসূয়াতুল ফিকহিয়া (কুয়েত: ওয়াযারাতুল আওকাফ ওয়াশ শুউনিল ইসলামিয়া ২য় প্রকাশ ১৯৮৩), ৩৭/১৯৪।
[5]. আবূদাঊদ হা/৪৯২; তিরমিযী হা/৩১৭; মিশকাত হা/৭৩৭।
[6]. আবূদাঊদ হা/৪৯৩।
[7]. তিরমিযী হা/৩৪৮; ইবনু মাজাহ হা/৭৬৮।
[8]. বুখারী হা/৪৩৩, ৩৩৮০।
[9]. বুখারী হা/৪৪১৯।
[10]. আল-মাজমূ‘ ৩/১৬৯; শারহুল মুমতে‘ ২/২৩৭-৬০।
[11]. শায়খ মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ, প্রশ্নোত্তর নং ১৪০২০৮।
[12]. বুখারী হা/৬২২৯; আবূদাঊদ হা/৪৮১৫।
[13]. বুখারী হা/৩৩৬৬; মুসলিম হা/৫২০; নাসাঈ হা/৬৯০; মিশকাত হা/৭৫৩।
[14]. বুখারী হা/৩৪২৫; মুসলিম হা/৫২০।
[15]. বুখারী হা/১৫৮৬।
[16]. তাফসীর ইবনু কাছীর, সূরা বাক্বারাহ ১২৭-১২৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ৮১ পৃঃ।
[17]. সিরাত ইবনে হিশাম, তাফসীরে ইবনে কাছীর, তাফসীরে বাগভী সূরা তওবা ১০৭-১০৮নং আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
[18]. কুরআনুল কারীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর), (সঊদী আরব : বাদশাহ ফাহদ কুরআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স ১৪৪০ হিঃ), ১/১০১৮ পৃঃ।