
৩. ব্যভিচার ও তার হদ : নারী ও পুরুষের বিবাহবহির্ভূত অবৈধ দৈহিক মিলনকে ব্যভিচার বলে। আরবীতে ব্যভিচারের নাম যেনা। যেনা শব্দটিও বাংলায় বহুল প্রচলিত। এক সময় ব্যভিচারকে ফে‘ল শানী‘ও বলা হ’ত। (فعل شنيع) শব্দটি মূলত আরবী এবং তার অর্থ- কদর্য কাজ। ব্যভিচারের পরিবর্তে শব্দটি বর্তমানে ধর্ষণ নামে সমধিক পরিচিত। তবে কোন নারীর সাথে তার অসম্মতিতে জোরপূর্বক দৈহিক মিলন করলে তাকে ধর্ষণ বলা অধিক যুক্তিযুক্ত। আইনে সম্মতিক্রমে দৈহিক মিলন ও জোরপূর্বক দৈহিক মিলনের শাস্তি এক নয়। সেজন্য নামেও পার্থক্য থাকা উচিত।
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ব্যভিচারকে হারাম করেছেন। আল্লাহ বলেন, وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا ‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট পথ’ (বনু ইস্রাঈল১৭/৩২)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِذَا زَنَى الْعَبْدُ خَرَجَ مِنْهُ الإِيْمَانُ فَكَانَ فَوْقَ رَأْسِهِ كَالظُّلَّةِ فَإِذَا خَرَجَ مِنْ ذَلِكَ الْعَمَلِ عَادَ إِلَيْهِ الإِيْمَانُ، ‘বান্দা যখন ব্যভিচারে লিপ্ত থাকে তখন তার থেকে ঈমান বের হয়ে তার মাথার উপর ছায়ার ন্যায় বিরাজ করতে থাকে। তারপর যখন সেই দুষ্কর্ম থেকে সে ফিরে আসে তখন তার মাঝে ঈমান পুনরায় ফিরে আসে’।[1] কাজেই মুমিন নর-নারী মাত্রেই এহেন হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও শয়তান ও কুপ্রবৃত্তির কারণে অনেকে এ দুষ্কর্মে জড়িয়ে পড়তে পারে। এজন্য ইসলাম বিচারের মাধ্যমে বিষয়টি যথাসম্ভব রোধ করার ব্যবস্থা রেখেছে। বিচার ছাড়াও ব্যভিচার রোধ বা হ্রাসে ইসলামের বেশ কিছু পদক্ষেপ রয়েছে।
এক. নারী-পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ ও জৈবিক চাহিদা একটি প্রাকৃতিক ব্যাপার। এটি পূরণের জন্য ইসলাম বিবাহের দিকে আহবান জানায়। বিবাহের ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে ভালোবাসা, দয়া-মায়া ও পারস্পরিক নির্ভরতা গড়ে ওঠে তা অতুলনীয়। পারিবারিক ছায়ায় তারা বৈধ পথে জৈবিক চাহিদা পূরণের এক অবারিত ও স্থায়ী সুযোগ লাভ করে। তাদের ব্যভিচারের জন্য সুযোগ খুঁজতে হয় না। তাদের দাম্পত্য জীবনের ফসল হিসাবে যে ভবিষ্যৎ বংশধরদের আগমন ঘটে তারাও পরিবারের আশ্রয়ে নিরাপদে ও শান্তিতে বাস করতে পারে।
দুই. বৈধ পথে জৈবিক চাহিদা পূরণের সাথে অবৈধ পথে তা পূরণের সকল পথ ইসলাম বন্ধ করেছে। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, নাচ, উত্তেজক চিত্র, অশ্লীল গান-বাজনা, কুদৃষ্টি এবং এমন যেসব কাজ ব্যভিচারের দ্বার খুলে দেয় ইসলাম তা নিষিদ্ধ করেছে।
তিন. ব্যভিচারকে ইসলামে দন্ডণীয় অপরাধ গণ্য করা হয়েছে। শাস্তির ভয়ে বহু মানুষ ব্যভিচার করার সময় সাত বার চিন্তা করবে। ধরা পড়লে বদনাম ও অপমানের ভাগীদার হ’তে হয়।
চার. ব্যভিচারের আধিক্য নানা ধরনের মারাত্মক ব্যাধি বয়ে আনে। যা অনেক সময় পুরুষানুক্রমে চলতে থাকে। যেমন এইডস।
পাঁচ. ব্যভিচারের ফলে পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। তার মাধ্যমে আগত সন্তানদের নিরাপদ আশ্রয় জোটার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে পড়ে। মোটকথা, ব্যভিচারের ক্ষতি অনেক বেশী। সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টির অন্যতম উপলক্ষ এই ব্যভিচার। এসব কারণে ব্যভিচার রোধে ইসলাম কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেছে।
ব্যভিচার প্রমাণের শর্ত : দু’টি বিষয়ের যে কোন একটি পাওয়া গেলে ব্যভিচার প্রমাণিত হবে। এক. স্বীকারোক্তি, দুই. সাক্ষীদের সাক্ষ্য। ব্যভিচারী নারী হোক কিংবা পুরুষ হোক সে যদি স্বীকার করে যে, সে ব্যভিচার করেছে তবে তার স্বীকারোক্তিতে অপরাধ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলে হদ জারী করা হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মায়েয আসলামী ও গামেদী বংশের এক মহিলাকে তাদের স্বীকারোক্তিতে রজমের আদেশ দিয়েছিলেন।[2] কেউ যদি কোন মহিলার সাথে ব্যভিচারের দাবী করে আর সেই মহিলা তা অস্বীকার করে তাহ’লে শুধু পুরুষের উপর হদ জারী হবে, মহিলার উপর হবে না।[3]
সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে ইসলাম খুব কড়াকড়ি আরোপ করেছে। যেহেতু ব্যভিচার প্রমাণিত হ’লে ব্যভিচারী নারী-পুরুষের মান-মর্যাদা ধুলোয় মিশে যায়। পরিবারের অন্যদেরও তাতে লজ্জিত হ’তে হয়, তাই তাদের মানহানির বিষয়ে কারও মুখ খুলতে শরী‘আত কঠোর শর্তাদি আরোপ করেছে। যথা :
এক. চার জন সাক্ষীর সাক্ষ্য প্রদান করা। আল্লাহ চারজন সাক্ষী হাযির করতে বলেছেন’ (নূর ২৪/৪)। একজন কম হ’লেও হদ কায়েম হবে না। ঐ তিন জন বরং সতীত্বে দোষারোপের অভিযোগে অভিযুক্ত হবে। দুই. সাক্ষীদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া। তিন. সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন হওয়া, পাগল না হওয়া। চার. সাক্ষীদের আদলের অধিকারী বা ন্যায়পরায়ণ হওয়া’ (বাক্বারাহ ২/২৮২; হুজুরাত ৪৯/৬)। পাঁচ. মুসলিম হওয়া। ছয়. চাক্ষুষভাবে দেখা। সুরমাদানির মধ্যে যেমন সুরমা শলাকা ঢুকে যায়, তেমনভাবে নারীর যোনিপথে পুরুষের পুরুষাঙ্গ ঢুকানো অবস্থায় দেখতে হবে। সাত. সাক্ষীরা আদালতে সুস্পষ্ট ভাষায় দেখার কথা বলবে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে যাবে না। আট. একই সময়ে একই স্থানে চারজন সাক্ষীকে উপস্থিত থেকে দেখতে হবে। সময় ও স্থানের হেরফের হ’লে সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না। নয়. সাক্ষীদের সকলের পুরুষ হওয়া। যেনার হদের ক্ষেত্রে নারীদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। দশ. সাক্ষ্যদানের নির্দিষ্ট সময় থেকে সাক্ষ্য বিলম্বিত না হওয়া।[4]
দেখুন, ব্যভিচারের শাস্তি একশত বেত্রাঘাত হোক কিংবা রজম হোক তা প্রমাণ করতে সাক্ষীদের মধ্যে যে দশটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে তা একত্রিত হওয়া কত কঠিন! ব্যভিচারের শাস্তি নিঃসন্দেহে কঠিন, কিন্তু তা প্রমাণ করা আরও কঠিন। আর প্রমাণিত হ’লে সে শাস্তি সমাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। কেউ আর সহজে এ পথে পা বাড়াবে না।
ব্যভিচারের হদ : ব্যভিচারী পুরুষ ও নারী অবিবাহিত হ’লে তাদের হদ একশত বেত্রাঘাত বলে কুরআনে উল্লেখ আছে। (নূর ২৪/২)। এতদসঙ্গে হাদীছে এক বছর দেশান্তরের কথা বলা হয়েছে।[5] আর বিবাহিত হ’লে তাদের হদ রজম বা পাথরের আঘাতে হত্যা। এ বিধান হাদীছে উল্লেখিত হয়েছে।[6] উক্ত হদ তখনই জারী হবে যখন বিবাহ ব্যতীত কোন পুরুষ তার জননেন্দ্রীয় কোন মহিলার লজ্জাস্থান তথা যোনিপথে প্রবেশ করাবে। শুধু শিশু পর্যন্ত প্রবেশই হদ জারীর জন্য যথেষ্ট, রেতঃপাত শর্ত নয়। এর সঙ্গে নিম্নের শর্তও বিদ্যমান থাকা যরূরী। এক. ব্যভিচারকারী নারী-পুরুষ প্রত্যেকের প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন হওয়া। অপ্রাপ্তবয়স্ক ও বিকৃত মস্তিষ্ক হ’লে তাদের উপর হদ জারী হবে না। তবে তাদের উপর তা‘যীর জারী হবে। দুই. তাদের স্বাধীন হওয়া। দাস-দাসী বিবাহিত হ’লেও তাদের উপর রজমের হদ জারী হবে না। দাসীর হদ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন,فَإِذَا أُحْصِنَّ فَإِنْ أَتَيْنَ بِفَاحِشَةٍ فَعَلَيْهِنَّ نِصْفُ مَا عَلَى الْمُحْصَنَاتِ مِنَ الْعَذَابِ، ‘অতঃপর যখন তারা বিবাহ বন্ধনে এসে যাবে, তখন যদি তারা কোন অশ্লীল কাজ করে, তবে তাদের উপর স্বাধীনা নারীদের অর্ধেক শাস্তি বর্তাবে’ (নিসা ৪/২৫)। রজম যেহেতু ভাগ করে দেওয়া যায় না তাই দাস-দাসীদের উপর রজম প্রযোজ্য হবে না। তিন. বৈধ বিবাহের পর ব্যভিচার সংঘটিত হওয়া, চাই বিবাহ বহাল থাকুক কিংবা না থাকুক। চার. উভয়ের সম্মতি থাকা। কোন পক্ষের উপর বলপ্রয়োগ করা হ’লে তার উপর হদ জারী হবে না। পাঁচ. ব্যভিচার হারাম হওয়া সম্পর্কে অবগত থাকা।[7] মূলত সমাজে হদ যাতে কম কার্যকর হয় সেজন্য শরী‘আতে অনেক বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে।
৪. সতীত্বে দোষারোপ ও তার হদ : সতীত্বে দোষারোপকে আরবীতে ‘কাযফ’ বলে। কাযফ শব্দের অর্থ নিক্ষেপ করা। কুরআনে এ অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে (ত্ব-হা ২০/৩৯)। শরী‘আতের পরিভাষায় কারও প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ আরোপকে কাযফ বলে। যেমন কেউ বলল, হে ব্যভিচারী, হে ব্যভিচারিণী, কিংবা অমুক লোক অমুক নারীর সাথে ব্যভিচার করেছে, অমুক হারামযাদা ইত্যাদি।
এ ধরনের কথায় মূলত কোন নারী কিংবা পুরুষের বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ আনয়ন করা হয়ে থাকে। এখন যদি সতীত্বে দোষারোপকারী ব্যক্তি তার অভিযোগের পক্ষে তারসহ প্রকৃতই চারজন সাক্ষী হাযির করতে পারে এবং আদালতে সে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয় তবে অভিযুক্ত ব্যক্তির উপর যেনার হদ কার্যকর হবে এবং সে সতীত্বে দোষারোপের হদ থেকে মুক্তি পাবে। আসলে ইসলাম চায় মানুষের ইয্যত-আব্রুর হেফাযত, খ্যাতির সুরক্ষা এবং তাদের শরাফতকে সম্মান করা। এজন্যই ইসলাম চায় খারাপ জিহবাকে বন্ধ করতে এবং যারা নিরপরাধ মানুষ তাদের চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের দরজা বন্ধ করতে। দুর্বল চরিত্রের লোকেরা যাতে মানুষের অনুভূতিকে আহত না করে এবং তাদের সম্ভ্রম নিয়ে ছিনিমিনি না খেলে সেদিকে ইসলামের কড়া দৃষ্টি রয়েছে। মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য কুরআন কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছে। এজন্য ইসলাম সতীত্বে দোষারোপকে হারাম ও কবীরা গোনাহ গণ্য করেছে। কেউ বিনা প্রমাণে এহেন অপরাধ করলে তাকে বা তাদেরকে আশিটি কষাঘাতের মুখোমুখি হ’তে হবে, চাই তারা পুরুষ হোক কিংবা নারী। ভবিষ্যতে তাদের সাক্ষ্য গৃহীত হবে না। তারা দুষ্কৃতিকারী ও অভিশাপের পাত্র বলে গণ্য হবে (নূর ২৪/৪-৫, ২৩-২৫)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক জিনিস থেকে বেঁচে থেকো। তন্মধ্যে একটি قَذْفُ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ الْغَافِلَاتِ، ‘সতী-সাধ্বী মুমিন সরলা নারীদের সতীত্বে দোষারোপ করা’।[8]
সতীত্বে দোষারোপ কিভাবে প্রমাণিত হবে : সতীত্বে দোষারোপ দু’ভাবে প্রমাণিত হ’তে পারে। এক. দোষারোপকারীর নিজের স্বীকারোক্তিতে ও দুই. দু’জন ন্যায়পরায়ণ পুরুষের সাক্ষীর সাক্ষ্য সাপেক্ষে।
সতীত্বে দোষারোপে হদ জারীর শর্ত : সতীত্বে দোষারোপের জন্য কিছু শর্ত রয়েছে সেগুলো পাওয়া গেলে তখন তা সতীত্বে দোষারোপের হদের আওতায় আসবে। এসব শর্তের কিছু দোষারোপকারীর সাথে, কিছু দোষারোপকৃতের সাথে এবং কিছু দোষারোপের ভাষার সাথে জড়িত।
দোষারোপকারীর সাথে যুক্ত শর্ত : এক. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া, দুই. সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়া, তিন. স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে দোষারোপ করা। সুতরাং অপ্রাপ্তবয়স্ক, পাগল ও জোরপূর্বক দোষারোপ আদায় করা হ’লে তাদের উপর হদ আরোপ হবে না। হাদীছে এসেছে,رُفِعَ الْقَلَمُ عَنْ ثَلَاثَةٍ : عَنِ النَّائِمِ حَتَّى يَسْتَيْقِظَ، وَعَنِ الصَّبِيِّ حَتَّى يَحْتَلِمَ، وَعَنِ الْمَجْنُونِ حَتَّى يَعْقِلَ، ‘তিন ধরনের লোকের উপর থেকে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে: (১) ঘুমন্ত ব্যক্তি, যতক্ষণ না জাগ্রত হয়, (২) নাবালেগ, যতক্ষণ না সে বালেগ হয় এবং (৩) পাগল, যতক্ষণ না জ্ঞানসম্পন্ন হয়।[9] অন্য এক হাদীছে এসেছে,إِنَّ اللهَ قَدْ تَجَاوَزَ عَنْ أُمَّتِي الْخَطَأَ، وَالنِّسْيَانَ، وَمَا اسْتُكْرِهُوا عَلَيْهِ، ‘আল্লাহ আমার উম্মত থেকে ভুল, বিস্মৃতি ও বল প্রয়োগকে তুলে নিয়েছেন’।[10]
দোষারোপকৃত নারী ও পুরুষের সাথে যুক্ত শর্ত : এক. সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়া, দুই. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া, তিন. মুসলিম হওয়া, চার. স্বাধীন হওয়া। পাগল, শিশু, অমুসলিম ও দাস-দাসীর প্রতি দোষারোপে হদ আরোপ হবে না, তা‘যীর আরোপ হবে।
দোষারোপের ভাষার সাথে জড়িত শর্ত : দোষারোপের ভাষার সাথে জড়িত শর্তের মধ্যে রয়েছে, সরাসরি যেনার শব্দ উল্লেখ করা, চাই তা মুখে বলা হোক কিংবা লিখিত হোক। অথবা তা আকারে-ইঙ্গিতে বলা হোক।[11]
৫. মদ ও নেশার পরিচয় : আঙুর, মধু, খেজুর, গম, যব ইত্যাদি থেকে তৈরি তরল পদার্থ যখন বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেশার উদ্রেক করে তখন তাকে মদ বলে। মদ হারামকালে এগুলো থেকে সাধারণত মদ তৈরি হ’ত। হাদীছে এসেছে, كُلُّ مُسْكِرٍ خَمْرٌ وَكُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ، ‘প্রত্যেক নেশা উদ্রেককারী দ্রব্য মদ এবং প্রত্যেক নেশা উদ্রেককারী দ্রব্য হারাম’।[12] কাজেই নেশার দ্রব্য মাত্রেই মদ ও হারাম- চাই তা তরল হোক কিংবা কঠিন হোক, পাউডার হোক কিংবা ইঞ্জেকশন হোক। আর যা বেশী পরিমাণ সেবনে নেশা হয় তার কম পরিমাণ সেবনও হারাম। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَا أَسْكَرَ كَثِيرُهُ، فَقَلِيلُهُ حَرَامٌ ‘যে জিনিস অধিক পরিমাণ সেবনে নেশা সৃষ্টি হয়, তার অল্প পরিমাণ সেবনও হারাম’।[13]
মাদক সেবন হেতু মানবদেহে সৃষ্ট বৈকল্যের ফলে মানুষের বোধশক্তি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এই অবস্থাকে নেশা বলে। নেশার ঘোর যতক্ষণ দেহে বিরাজ করে ততক্ষণ মাদকসেবীর হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। তখন সে যেকোন অঘটন ঘটাতে পারে। নেশার ঘোর কেটে যাওয়ার পর সে স্বাভাবিক জ্ঞানে ফিরে এলেও একটি সময় পরে তার মধ্যে মাদক গ্রহণের তীব্র নেশা জাগে। তখন মাদক না পেলে তার দেহে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, وَالْخَمْرُ مَا خَامَرَ الْعَقْلَ، ‘মদ তাই যা মানুষের বিবেক-বুদ্ধি আচ্ছন্ন করে দেয়’।[14] নেশার উদ্রেককারী যাবতীয় দ্রব্য হারাম, চাই তা মদ নামে আখ্যায়িত হোক কিংবা ভিন্ন নামে। কারও জন্য তা পান করা বৈধ নয়। আল্লাহ বলেছেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ، ‘হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, পূজার বেদী ও ভাগ্যতীর সমূহ শয়তানের নাপাক কর্ম বৈ কিছুই নয়। অতএব এগুলি হ’তে বিরত থাক। যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’ (মায়েদাহ ৫/৯০)। এক হাদীছে এসেছে,لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِي الْخَمْرِ عَشَرَةً عَاصِرَهَا وَمُعْتَصِرَهَا وَشَارِبَهَا وَحَامِلَهَا وَالْمَحْمُولَةَ إِلَيْهِ وَسَاقِيَهَا وَبَائِعَهَا وَآكِلَ ثَمَنِهَا وَالْمُشْتَرِيَ لَهَا وَالْمُشْتَرَاةَ لَهُ- ‘মদের সাথে সম্পৃক্ত দশ শ্রেণীর লোককে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অভিসম্পাত করেছেন। এরা হ’ল: মদ প্রস্ততকারী, মদের ফরমায়েশকারী, মদ পানকারী, মদ বহনকারী, যার জন্য মদ বহন করা হয়, মদ পরিবেশনকারী, মদ বিক্রয়কারী, এর মূল্য ভোগকারী, মদের ক্রেতা এবং যার জন্য মদ কেনা হয়’।[15]
অন্য এক হাদীছে এসেছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, الْخَمْرُ أُمُّ الْخَبَائِثِ فَمَنْ شَرِبَهَا لَمْ تُقْبَلْ مِنْهُ صَلَاتُهُ أَرْبَعِينَ يَوْمًا، فَإِنْ مَاتَ وَهِيَ فِي بَطْنِهِ مَاتَ مَيْتَةً جَاهِلِيَّةً، ‘মদ সকল অপরাধের উৎস। যে তা পান করবে তার চল্লিশ দিনের ছালাত কবুল হবে না। মদ তার পেটে থাকা অবস্থায় যদি সে মারা যায় তবে সে মৃত্যু হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু’।[16]
আরেক হাদীছে এসেছে, আবূদ্দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমার বন্ধু (নবী করীম (ছাঃ) আমাকে উপদেশ দিয়েছেন, لاَ تَشْرَبِ الْخَمْرَ فَإِنَّهَا مِفْتَاحُ كُلِّ شَرٍّ ‘শরাব পান করো না, কারণ তা সমস্ত পাপাচারের চাবি’।[17]
আধুনিক যুগে তো নানা নামের নানা পদের মাদক দুনিয়া জুড়ে সহজলভ্য। এ্যালকোহল, ভাঙ, হাশিশ, মারিজুয়ানা, আফিম, কোকেন, হিরোইন, আইচ, ভায়াগ্রা, বিয়ার, শ্যাম্পেন, হুইস্কি, ভদকা, ব্রান্ডি ইত্যাদি যে নামের মাদকই হোক না কেন তা পান করা হারাম এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ইসলাম চায় এমন এক প্রজন্ম গড়ে তুলতে যারা হবে দেহে, মনে ও বুদ্ধিতে শক্তিশালী। কিন্তু মদ মানুষের ব্যক্তিত্বকে দুর্বল করে দেয়। বিশেষ করে তা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা রহিত করে দেয়, নেশার ঘোরে তার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়। আর জ্ঞান লোপ পেলে সে হয়ে পড়ে নিকৃষ্ট পশুতুল্য। তখন তার থেকে মার-পিট, খুনখারাবী, হত্যা, রাহাজানি, ছিনতাই, ভাঙচুর, ধর্ষণ, বলাৎকার, সড়ক দুর্ঘটনা ইত্যাদি যে কোন কিছু হ’তে পারে। এমনকি সে নিজেও আহত নিহত হ’তে পারে। মাদকাসক্ত ব্যক্তি শুধু নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না বরং পরিবার ও সমাজকেও সে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় স্ত্রী ও সন্তানদের উপর নির্যাতন চালায়। নেশার টাকা যোগাড় করতে তারা ঘর থেকে টাকা চুরি করে, আসবাব পত্র বিক্রয় করে দেয়। টাকা না পেলে মাতা-পিতা ও অন্যদের মারপিট করে, ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। তার দেহেও এইডসসহ নানা ব্যাধি বাসা বাঁধতে পারে। মোটকথা, মাদকাসক্ত ব্যক্তি পরিবারের শান্তি ও নিরাপত্তার মাথা তো খায়ই সেই সঙ্গে সমাজও তার ভয়ে তটস্থ থাকে। সে কখন কার কি ক্ষতি করে বসে তা বলা যায় না।
মদ শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই ক্ষতিকারক নয় বরং চিকিৎসা বিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র, সমাজ বিজ্ঞান, অর্থনীতি প্রভৃতির সাথে জড়িত সকলেই মদকে ক্ষতিকারক এবং কঠিনভাবে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন।[18] দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, আজকের বিশ্বে প্রায় প্রতিটি দেশে লাইসেন্স যোগে মদের কেনা-বেচা চলে। আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়া-আফ্রিকার অমুসলিম দেশগুলোতে মদের সয়লাব বললে অত্যুক্তি হবে না। সেখানে লোকেরা পানির মতো মদ পান করে। তারাও মদের অপকারিতা স্বীকার করে। কিন্তু ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে তাকে আইনী বৈধতা দিয়ে রেখেছে। মুসলিম দেশগুলোতেও ইসলামের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মদ কেনা-বেচা হয়ে থাকে এবং অমুসলিমদের সাথে অনেক মুসলিমও তা পানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে উঠতি বয়সী তরুণরা দিন দিন নেশায় বুঁদ হয়ে উঠছে। মাদকের অসহ্য ক্ষতির কথা চিন্তা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২০ খৃষ্টাব্দে মদ নিষিদ্ধ করা হয়। চৌদ্দ বছর এ নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। সে সময়ে মাদকের বিরুদ্ধে সরকার ৬০ মিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু জনগণ এ নিষেধাজ্ঞার উল্টো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। সারা দেশে নিষেধের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৩ খৃষ্টাব্দে সরকার মাদকের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়।[19]
অথচ ইসলামে মাদকের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রাক্কালে আরবে মদের ব্যাপক প্রচলন ছিল। ইসলামের বিধিবিধান পালনে অভ্যস্ত ছাহাবীদের মাঝে যখন মাদক হারামের আদেশ জারী হয় তখন তাঁরা বিনা বাক্য ব্যয়ে মদ পান ত্যাগ করেন।[20] আজও মুসলিম সমাজে অমুসলিম সমাজের তুলনায় মাদকাসক্তির পরিমাণ অনেক কম। ইসলামের সৌন্দর্যের এটি অন্যতম দিক।
মদ পানের হদ : মুসলিম ফক্বীহগণ এ কথায় একমত যে, মাদকসেবীর উপর হদ প্রয়োগ আবশ্যিক এবং তার হদ কষাঘাত। কিন্তু কষাঘাতের পরিমাণ নিয়ে মতভেদ আছে। ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম মালিক (রহঃ)-এর মতে আশি কষাঘাত। ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর মতে চল্লিশ কষাঘাত। ইমাম আহমাদ (রহঃ) এক বর্ণনায় আশি এবং এক বর্ণনায় চল্লিশ কষাঘাতের কথা বলেছেন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ)-এর আমলে চল্লিশ কষাঘাত আরোপ করা হ’ত। ওমর (রাঃ)-এর আমলে ছাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে আশি কষাঘাত করা হয়।[21]
মাদক সেবন কিভাবে প্রমাণিত হবে : মাদক সেবন দু’ভাবে প্রমাণিত হ’তে পারে। ১. সেবনকারীর স্বীকারোক্তিতে ও ২. দু’জন ন্যায়পরায়ণ পুরুষ সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে।
হদ জারীর শর্ত : মাদক সেবনকারীর উপর হদ জারী করতে হ’লে তার মধ্যে চারটি শর্ত বিদ্যমান থাকতে হবে। ১. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া, ২. সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়া, ৩. স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে মাদক সেবন করা। ৪. সে যে নেশার দ্রব্য পান করছে তা তার জানা থাকতে হবে। সুতরাং অপ্রাপ্তবয়স্ক, পাগল, জোরপূর্বক সেবনকৃত এবং অজ্ঞাতসারে সেবনকারীর উপর হদ আরোপিত হবে না। মাদকসেবী অমুসলিম হ’লেও তার উপর হদ জারী হবে। এখানে মুসলিম হওয়া শর্ত নয়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে ইসলাম মাদককে কেন হারাম ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য করেছে তা বুঝা যায় এবং সে ক্ষেত্রেও তা প্রমাণ সাপেক্ষে কেবল উপযুক্ত ক্ষেত্রে কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছে। ইসলামী আদব-আখলাক মেনে চললে এবং হদ জারীর ব্যবস্থা থাকলে দেশে দেশে মাদকের ছোবল নিশ্চয়ই কমে যেত। [ক্রমশঃ]
[1]. তিরমিযী হা/২৬২৫। আবুদাউদ হা/৪৬৯০।
[2]. মুসলিম হা/১৬৯৫; মিশকাত হা/৩৫৬৫।
[3]. আবুদাউদ হা/৪৪৬৬, সনদ ছহীহ।
[4]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩৭১-৩৭৫।
[5]. বুখারী হা/৬৬৩৩; মিশকাত হা/৩৫৫৫।
[6]. বুখারী হা/৫২৭১।
[7]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩৬৬, ৩৬৭, ৩৭০।
[8]. বুখারী হা/২৭৬৬; মুসলিম হা/১৬৩।
[9]. আবুদাউদ হা/৪৪০৩, সনদ ছহীহ।
[10]. ইবনু মাজাহ হা/২০৪৩; সনদ ছহীহ, বায়হাক্বী।
[11]. ফিকহুস সুন্নাহ ২/৩৯৩-৪০৩।
[12]. মুসলিম হা/৫১১৪; নাসাঈ হা/৫৫৮২; আবুদাউদ হা/৩৬৭৯; তিরমিযী হা/১৮৬১; ইবনু মাজাহ হা/৩৩৯০।
[13]. নাসাঈ হা/৫৬০৭; আবুদাউদ হা/৩৬৮১; তিরমিযী হা/১৮৬৫; ইবনু মাজাহ হা/৩৩৯২।
[14]. বুখারী হা/৪৬১৯; মুসলিম হা/৭৪৪৯; আবুদাউদ হা/৩৬৬৯।
[15]. তিরমিযী হা/১২৯৫; ইবনু মাজাহ হা/৩৩৮১।
[16]. দারাকুৎনী হা/৪৬১০; তাবারানী আওসাত হা/৩৬৬৭; হাকেম হা/৭২৩৬; ছহীহাহ হা/১৮৫৪।
[17]. ইবনু মাজাহ হা/৩৩৭১, ৪০৩৪।
[18]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩৩৩।
[19]. ঐ, ২/৩৩৫।
[20]. বুখারী হা/৪৬১৭; মুসলিম হা/৫০২৬।
[21]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩৫৪।