৫. কুরআন মাজীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং মনোযোগ দিয়ে কুরআন শ্রবণ :

কুরআন মাজীদকে আঁকড়ে ধরার অন্যতম উপায় হ’ল, কুরআন মাজীদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করা এবং কোনভাবেই এর অবমাননা না করা। ভক্তি-শ্রদ্ধাভরে কুরআন তেলাওয়াত করা, তেলাওয়াতের সময় চুপ থাকা ও মনোযোগ দিয়ে কুরআন শ্রবণ করা। মহান আল্লাহ বলেন,وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ‘আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাকো, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হ’তে পার’ (আ‘রাফ ৭/২০৪)

হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, لَمَّا ذَكَرَ اللَّهُ تَعَالَى أَنَّ الْقُرْآنَ بَصَائِرُ لِلنَّاسِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ، أَمَرَ تَعَالَى بِالْإِنْصَاتِ عِندَ تِلَاوَتِهِ إِعْظَامًا لَهُ وَاحْتِرَامًا ‘কুরআন মানুষের জন্য জ্ঞানভান্ডার, হেদায়াত ও রহমত- একথা উল্লেখ করার পর আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের প্রতি সম্মান-মর্যাদা প্রদর্শনার্থে তেলাওয়াতের সময় চুপ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন’।[1]

আধুনিক মুফাস্সির শায়খ আব্দুর রহমান সা‘দী (রহঃ) বলেন, ‘প্রত্যেক কুরআন তেলাওয়াত শ্রবণকারীর জন্য এই নির্দেশ প্রযোজ্য। কেননা কুরআন তেলাওয়াতের সময় মনোযোগ দিয়ে তা শ্রবণ ও চুপ থাকার জন্য সে আদিষ্ট। আর মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ ও চুপ থাকার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তেলাওয়াতের সময় কথা বলা পরিহার করা অথবা মনোযোগ দিয়ে কুরআন শ্রবণ করা থেকে যা কিছু ব্যস্ত রাখবে তা পরিত্যাগ করার মাধ্যমে বাহ্যিকভাবে চুপ থাকা যায়। পক্ষান্তরে মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা মানে হ’ল, কুরআন শ্রবণের সময় কান ও হৃদয়-মন সজাগ রাখা এবং যা শুনে তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা। কুরআন তেলাওয়াতের সময় যে ব্যক্তি এই দু’টি বিষয়কে আবশ্যক করে নিবে সে প্রভূত কল্যাণ, গভীর জ্ঞান, নিত্য ঈমান নবায়ন, হেদায়াত বৃদ্ধি এবং তার দ্বীনের ব্যাপারে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করবে। এজন্য আল্লাহ মনোযোগ দিয়ে কুরআন শ্রবণ ও চুপ থাকার শর্তে রহমত প্রাপ্তির কথা বলেছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, কারো নিকট কুরআন পাঠ করা হলে সে যদি চুপ থেকে মনোযোগ দিয়ে তা শ্রবণ না করে, তাহলে সে আল্লাহর রহমত এবং বহুবিধ কল্যাণ লাভ থেকে বঞ্চিত হবে’।[2]

এজন্য কুরআন তেলাওয়াত শ্রবণের সময় যেসকল মুমিন বিনম্রচিত্ত হয় না আল্লাহ তাদেরকে নিন্দা করেছেন এবং এ ব্যাপারে কাফেরদের মতো হওয়া থেকে সতর্ক করে বলেছেন, أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ وَلَا يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ وَكَثِيرٌ مِنْهُمْ فَاسِقُونَ ‘মুমিনদের কি সে সময় আসেনি যে, তাদের হৃদয় সমূহ বিগলিত হবে আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য নাযিল হয়েছে, তার কারণে? এবং তারা তাদের মত হবে না যাদেরকে ইতিপূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর তাদের উপর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে। ফলে তাদের হৃদয়সমূহ শক্ত হয়ে গেছে এবং তাদের বহু লোক পাপাচারী হয়েছে?’ (হাদীদ ৫৭/১৬)

হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) তাইতো বলেছেন,

إِذَا أَرَدْتَ الانْتِفَاعَ بِالْقُرْآنِ فَاجْمَعْ قَلْبَكَ عِندَ تِلَاوَتِهِ وَسَمَاعِهِ، وَأَلْقِ سَمْعَكَ، وَاحْضُرْ حُضُورَ مَنْ يُخَاطَبُ بِهِ، مَنْ تَكَلَّمَ بِهِ سُبْحَانَهُ مِنْهُ إِلَيْهِ، فَإِنَّهُ خِطَابٌ مِنْهُ لَكَ عَلَى لِسَانِ رَسُولِهِ، قَالَ تَعَالَى : إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَذِكْرَىٰ لِمَنْ كَانَ لَهُ قَلْبٌ أَوْ أَلْقَى السَّمْعَ وَهُوَ شَهِيدٌ-

‘তুমি যদি কুরআন দ্বারা উপকৃত হ’তে চাও তাহ’লে কুরআন তেলাওয়াত ও শ্রবণের সময় তোমার হৃদয়-মনকে সজাগ রাখবে এবং এমন মনোযোগ দিয়ে কুরআন শ্রবণ করবে যেন তোমার মনে এই ভাবের উদয় হয় যে, আল্লাহ এর দ্বারা তোমাকে সম্বোধন করেছেন। কেননা রাসূলের যবানে আল্লাহর পক্ষ থেকে এর মাধ্যমে তোমাকে সম্বোধন করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই এর মধ্যে উপদেশ রয়েছে ঐ ব্যক্তির জন্য যার মধ্যে অনুধাবন করার মত হৃদয় রয়েছে এবং যে মনোযোগ দিয়ে কথা শোনে’ (ক্বাফ ৫০/৩৭)[3]

আজুররী বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কালাম (কুরআন) নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে, সে তাঁর প্রতিপালক এবং তাঁর বিশাল ক্ষমতা ও শক্তি, মুমিনদের প্রতি তাঁর অপার অনুগ্রহ এবং তার উপর আল্লাহ যেসব ইবাদত ফরয করেছেন তা জানতে পারবে। তখন তার কর্তব্য হবে ওয়াজিব ইবাদতকে নিজের জন্য অবধারিত করে নেওয়া এবং তার মহান প্রতিপালক তাকে যেসব বিষয় থেকে সতর্ক করেছেন তা থেকে বিরত থাকা এবং যেসব বিষয়ে উৎসাহিত করেছেন সেসব বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠা। কুরআন তেলাওয়াত ও শ্রবণের সময় যার বৈশিষ্ট্য এমনটি হবে, কুরআন তার জন্য আরোগ্যস্বরূপ হয়ে যাবে। তখন সে সম্পদ ছাড়াই ধনী হয়ে যাবে এবং আত্মীয়স্বজন ব্যতীতই সম্মানিত হবে। অন্যরা যা অপছন্দ করে সে তা পছন্দ করবে। কোন সূরা তেলাওয়াত শুরু করার সময় তার লক্ষ্য হবে, আমার তেলাওয়াতকৃত অংশ দ্বারা আমি কখন উপদেশ গ্রহণ করব? কুরআন খতম করা তার উদ্দেশ্য হবে না। বরং তার উদ্দেশ্য হবে, আল্লাহর সম্বোধন আমি কখন বুঝতে সক্ষম হব? কখন আল্লাহর নিষেধকৃত বিষয় সমূহ থেকে বিরত হব? কখন শিক্ষা লাভ করব? কেননা কুরআন তেলাওয়াত ইবাদত। আর উদাসীন মনে ইবাদত হয় না। আল্লাহই এর তৌফিকদাতা’(لِأَنَّ تِلَاوَةَ الْقُرْآنِ عِبَادَةٌ، لَا تَكُونُ بِغَفْلَةٍ، وَاللَّهُ الْمُوَفَّقُ لِذَٰلِكَ) ।[4]

ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, مَنْ أَصْغَى إِلَى كَلَامِ اللَّهِ وَكَلَامِ رَسُولِهِ بِعَقْلِهِ، وَتَدَبَّرَهُ بِقَلْبِهِ، وَجَدَ فِيهِ مِنَ الْفَهْمِ وَالْحَلَاوَةِ وَالْبَرَكَةِ وَالْمَنْفَعَةِ مَا لَا يَجِدُهُ فِي شَيْءٍ مِنَ الْكَلَامِ، لَا مَنْظُومِهِ وَلَا مَنْثُورِهِ ‘যে ব্যক্তি মনোযোগ দিয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথা শ্রবণ করবে এবং হৃদয় দিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে, সে কুরআন ও হাদীছের মধ্যে এমন বুঝ, সুমিষ্টতা, বরকত ও উপকার লাভ করবে, যা অন্য কোন গদ্য ও পদে পাবে না’।[5]

৬. কুরআনের দিকে দাওয়াত দেওয়া :

কুরআন মাজীদকে আঁকড়ে ধরার অন্যতম উপায় হ’ল, হেদায়াতের প্রদীপ্ত আলোকস্তম্ভ কুরআনের দিকে মানুষকে আহবান জানানো। এটি কুরআনের হকও বটে। মহান আল্লাহ বলেন,ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কর প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক কর সুন্দর পন্থায়। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক ভালভাবেই জানেন কে তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং তিনি ভালভাবেই জানেন কে সুপথপ্রাপ্ত হয়েছে’ (নাহল ১৬/১২৫)। এখানে হিকমত দ্বারা অনেক মুফাস্সিরের মতে কুরআন উদ্দেশ্য।[6]

আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কুরআন ও এতে যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে তার দিকে মানুষকে আমৃত্যু দাওয়াত দিয়েছেন। এমনকি হজ্জের মওসুমেও তিনি এ দাওয়াত থেকে নিবৃত্ত হননি। যেমন হজ্জের সময় রাসূল (ছাঃ) বলতেন,أَلاَ رَجُلٌ يَحْمِلُنِى إِلَى قَوْمِهِ فَإِنَّ قُرَيْشًا قَدْ مَنَعُونِى أَنْ أُبَلِّغَ كَلاَمَ رَبِّى، ‘এমন কোন ব্যক্তি আছে কি যে আমাকে তার গোত্রের কাছে নিয়ে যাবে [যাতে আমি তাদেরকে আমার প্রতিপালকের কালাম (কুরআন)-এর দাওয়াত দিতে পারি]। কেননা কুরাইশরা আমাকে আমার প্রতিপালকের কালামের দিকে দাওয়াত প্রদান করতে বাধা দিয়েছে’।[7]

৭. কুরআনী মানহাজকে আঁকড়ে ধরা :

মানহাজ শব্দের অর্থ হ’ল, পথ, পন্থা, পদ্ধতি, সুস্পষ্ট রাস্তা প্রভৃতি। কুরআন মাজীদে ‘মিনহাজ’ শব্দটি ‘মানহাজ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।[8] মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানহাজ অবলম্বন অত্যন্ত যরূরী। মহান আল্লাহ বলেন, لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য আমরা পৃথক পৃথক বিধান ও পন্থা নির্ধারণ করেছি’ (মায়েদাহ ৪/৪৮)। কাজেই একজন মুসলিম তাঁর আক্বীদা, ইবাদত, লেনদেন, আদব-আখলাক সহ সকল বিষয়ে কুরআনী মানহাজকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে। সাগ্রহে ও আনন্দচিত্তে আল্লাহ প্রদত্ত শরী‘আতের পূর্ণ অনুসরণ করবে। মহান আল্লাহ বলেন,ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَى شَرِيعَةٍ مِنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ، إِنَّهُمْ لَنْ يُغْنُوا عَنْكَ مِنَ اللهِ شَيْئًا وَإِنَّ الظَّالِمِينَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَاللهُ وَلِيُّ الْمُتَّقِينَ، هَذَا بَصَائِرُ لِلنَّاسِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ- ‘অতঃপর আমরা তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি দ্বীনের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির উপর। অতএব তুমি তার অনুসরণ কর এবং অজ্ঞদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করোনা। নিশ্চয়ই তারা তোমাকে আল্লাহর শাস্তি থেকে আদৌ বাঁচাতে পারবে না। আর নিশ্চয়ই যালেমরা পরস্পরের বন্ধু। অথচ আল্লাহ হ’লেন মুত্তাক্বীদের বন্ধু। এটি মানবজাতির জন্য জ্ঞানভান্ডার এবং দৃঢ়বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য হেদায়াত ও রহমত’ (জাছিয়া ৪৫/১৮-২০)

৮. কুরআনী চরিত্রে চরিত্রবান হওয়া :

কুরআনে বর্ণিত উন্নত চরিত্র-মাধুর্য ও মহৎ গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে কুরআনকে আঁকড়ে ধরতে হবে। মহান আল্লাহ রাসূল (ছাঃ)-এর প্রশংসা করে বলেন, وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ ‘আর নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত’ (কলম ৬৮/৪)। রাসূল (ছাঃ)-এর সমগ্র জীবন ছিল কুরআনের বাস্তব চিত্র। একদা আয়েশা (রাঃ)-কে রাসূল (ছাঃ)-এর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হ’লে তিনি বলেছিলেন, فَإِنَّ خُلُقَ نَبِىِّ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ الْقُرْآنَ. ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নবীর চরিত্র ছিল কুরআন’।[9]

সা‘দ বিন হিশাম বিন আমের থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, أَتَيْتُ عَائِشَةَ فَقُلْتُ يَا أُمَّ الْمُؤْمِنِينَ أَخْبِرِينِى بِخُلُقِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم. قَالَتْ كَانَ خُلُقُهُ الْقُرْآنَ أَمَا تَقْرَأُ الْقُرْآنَ قَوْلَ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ (وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ) ‘আমি আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে এসে বললাম, হে উম্মুল মুমিনীন! আমাকে রাসূল (ছাঃ)-এর চরিত্র সম্পর্কে বলুন! তিনি বললেন, তার চরিত্র ছিল কুরআন। তুমি কি কুরআনে আল্লাহর এই বাণী পড়নি: ‘আর নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত’ (কলম ৬৮/৪)[10] আল্লামা সিন্ধী বলেন,وَكَوْنُ خَلْقِهِ الْقُرْآنَ هُوَ أَنَّهُ كَانَ مُتَمَسِّكًا بِآدَابِهِ وَأَوَامِره وَنَوَاهِيه وَمَحَاسِنه، ‘কুরআন তার চরিত্র থাকার মানে হ’ল, তিনি কুরআনে বর্ণিত আদব ও আদেশ-নিষেধ সমূহকে এবং সুন্দর গুণাবলীকে আঁকড়ে ধারণকারী ছিলেন’।[11]

হাসান বাছরী (২১-১১০ হি.) বলেন, وَاللَّهِ مَا تَدَبُّرُهُ بِحِفْظِ حُرُوفِهِ وَإِضَاعَةِ حُدُودِهِ، حَتَّى إِنَّ أَحَدَهُمْ لَيَقُولُ: قَرَأْتُ الْقُرْآنَ كُلَّهُ، مَا يُرَى لَهُ الْقُرْآنُ فِي خُلُقٍ وَلَا عَمَلٍ ‘আল্লাহর কসম! কুরআন অনুধাবনের অর্থ কেবল এর হরফগুলি হিফয করা এবং এর হুদূদ বা সীমারেখাগুলি বিনষ্ট করা নয়। যাতে একজন বলবে যে, সমস্ত কুরআন শেষ করেছি। অথচ তার চরিত্রে ও কর্মে কুরআন নেই’।[12]

কুরআন মাজীদকে আঁকড়ে ধরার উপকারিতা :

কুরআন মাজীদকে আঁকড়ে ধরার বহুবিধ উপকার ও কল্যাণ রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হ’ল-

১. চিরস্থায়ী সৌভাগ্য অর্জন :

যে ব্যক্তি কুরআন মাজীদের প্রতি ঈমান আনবে, এর বিশুদ্ধতার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করবে এবং কুরআনের প্রতি আমল করবে সে এর মাধ্যমে চিরস্থায়ী সৌভাগ্য লাভ করে নিজেকে ধন্য করতে সক্ষম হবে। মহান আল্লাহ বলেন, يَوْمَ يَأْتِ لَا تَكَلَّمُ نَفْسٌ إِلَّا بِإِذْنِهِ فَمِنْهُمْ شَقِيٌّ وَسَعِيدٌ، فَأَمَّا الَّذِينَ شَقُوا فَفِي النَّارِ لَهُمْ فِيهَا زَفِيرٌ وَشَهِيقٌ، خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ إِنَّ رَبَّكَ فَعَّالٌ لِمَا يُرِيدُ، وَأَمَّا الَّذِينَ سُعِدُوا فَفِي الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ عَطَاءً غَيْرَ مَجْذُوذٍ، ‘যখন সেদিনটি আসবে, তখন কোন ব্যক্তি আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কথা বলতে পারবে না। আর তাদের মধ্যে থাকবে হতভাগা ও ভাগ্যবান। অতঃপর যারা হতভাগা হবে তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। সেখানে তাদের জন্য থাকবে কেবল চীৎকার ও আর্তনাদ। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে, যতদিন আসমান ও যমীন বর্তমান থাকবে। তবে তোমার প্রতিপালক যদি অন্য কিছু চান। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক যা চান তা-ই করে থাকেন। পক্ষান্তরে যারা ভাগ্যবান, তারা চিরকাল জান্নাতে থাকবে, যতদিন আসমান ও যমীন বর্তমান থাকবে। তবে তোমার প্রতিপালক যদি অন্য কিছু চান। আর এ দান হবে অফুরন্ত’ (হুদ ১১/১০৫-১০৮)। তিনি আরো বলেন, فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشْقَى، وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى، قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيرًا، قَالَ كَذَلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا وَكَذَلِكَ الْيَوْمَ تُنْسَى، وَكَذَلِكَ نَجْزِي مَنْ أَسْرَفَ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِآيَاتِ رَبِّهِ وَلَعَذَابُ الْآخِرَةِ أَشَدُّ وَأَبْقَى، ‘অতঃপর যখন তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে হেদায়াত আসবে, তখন যে আমার হেদায়াতের অনুসরণ করবে, সে (দুনিয়াতে) বিপথগামী হবে না এবং (আখেরাতে) কষ্টে পতিত হবে না। আর যে ব্যক্তি আমার কুরআন হ’তে মুখ ফিরিয়ে নিবে, তার জীবিকা হবে সংকুচিত এবং ক্বিয়ামতের দিন আমরা তাকে উঠাব অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন তুমি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালে? অথচ আমি তো (দুনিয়াতে) ছিলাম চক্ষুষ্মান। আল্লাহ বলবেন, এটাই তো বিধান। তোমার কাছে আমাদের আয়াতসমূহ এসেছিল। অতঃপর তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। আর সেভাবেই তুমি আজ উপেক্ষিত হ’লে। আর এভাবেই আমরা তাকে প্রতিফল দেব, যে বাড়াবাড়ি করে এবং তার প্রতিপালকের আয়াত সমূহে বিশ্বাস স্থাপন করে না। নিশ্চয়ই পরকালের শাস্তি অতীব কঠোর ও সর্বাধিক স্থায়ী’ (ত্বোয়াহা ২০/১২৩-১২৭)

২. আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ :

যে কুরআনকে আঁকড়ে ধরবে, মহান আল্লাহকে ভয় করবে এবং সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের পথে চলবে সে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যমে সফলকাম হবে। মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ هُمْ خَيْرُ الْبَرِيَّةِ، جَزَاؤُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ذَلِكَ لِمَنْ خَشِيَ رَبَّهُ ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে, তারাই হ’ল সৃষ্টির সেরা। তাদের জন্য প্রতিদান রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকটে চিরস্থায়ী বসবাসের বাগিচাসমূহ; যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয় নদী সমূহ। যেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর উপরে সন্তুষ্ট। এটা তার জন্য, যে তার প্রতিপালককে ভয় করে’ (বাইয়েনাহ ৭৮/৭-৮)

৩. হেদায়াত লাভ :

কুরআন মাজীদকে আঁকড়ে ধরলে জীবন চলার পথে সার্বিক হেদায়াত লাভ করা যায়। ব্যক্তি ও সমাজের বৃহত্তর কল্যাণ ও সার্বিক মঙ্গলের বিষয় তার সামনে প্রতিভাত হয়। ফলে সে পথভ্রষ্ট হওয়া থেকে বেঁচে যায়।[13] যেমন মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ وَيُبَشِّرُ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا كَبِيرًا ‘নিশ্চয় এই কুরআন এমন পথের নির্দেশনা দেয় যা সবচাইতে সরল। আর তা সৎকর্মশীল মুমিনদের সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার’ (বনু ইস্রাইল ১৭/৯)

৪. দৈহিক ও আত্মিক রোগ সমূহ থেকে আরোগ্য লাভ :

কুরআন মাজীদকে আঁকড়ে ধরলে দৈহিক ও আত্মিক নানাবিধ রোগ-ব্যাধি, সন্দেহ-সংশয়, শিরক-নিফাক প্রভৃতি থেকে আরোগ্য লাভ করা যায়। ইবনুল জাওযী বলেন, تِلَاوَةُ الْقُرْآنِ تَعْمَلُ فِي أَمْرَاضِ الْفُؤَادِ مَا يَعْمَلُهُ الْعَسَلُ فِي عِلَلِ الْأَجْسَادِ ‘কুরআন পাঠ অন্তরের ব্যাধি সমূহ নিরাময়ে ঐরূপ কাজ করে, শরীরের রোগ নিরাময়ে যেরূপ মধু কাজ করে’।[14] মহান আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ ‘হে মানবজাতি! তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে এসে গেছে উপদেশবাণী (কুরআন) এবং অন্তরের ব্যাধিসমূহের উপশম। আর বিশ্বাসীদের জন্য পথ প্রদর্শক ও রহমত’ (ইউনুস ১০/৫৭)

তিনি আরো বলেন,وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ وَلَا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارًا ‘আর আমরা কুরআন নাযিল করেছি, যা বিশ্বাসীদের জন্য আরোগ্য ও অনুগ্রহ স্বরূপ। কিন্তু যালেমদের জন্য তা কেবল ক্ষতিই বৃদ্ধি করে’ (বনু ইস্রাইল ১৭/৮২)। হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আল্লাহ তার কিতাব সম্পর্কে বলছেন, ... এটি মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও অনুগ্রহ। অর্থাৎ কুরআন অন্তরের ব্যাধি সমূহ যেমন সন্দেহ, নিফাক, শিরক, বক্রতা ও বিচ্যুতি দূর করে দেয়। কুরআন এ সকল কিছু থেকে আরোগ্য দান করে। অনুরূপভাবে এটি রহমতও। এর মাধ্যমে অন্তরে ঈমান, প্রজ্ঞা ও কল্যাণ লাভের উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। যে ব্যক্তি কুরআনের প্রতি ঈমান এনেছে, একে সত্যায়ন করেছে এবং এর অনুসরণ করেছে, তার জন্যই কেবল কুরআন আরোগ্য ও রহমত স্বরূপ। আর নিজের নফসের প্রতি যুলুমকারী কাফেরের জন্য কুরআন শ্রবণ কেবল এ থেকে তার দূরত্ব, মিথ্যা প্রতিপন্নকরণের প্রবণতা ও কুফুরীই বৃদ্ধি করে। কাজেই সমস্যা কাফেরের, কুরআনের নয়’ (والآفة من الكافر لا من القرآن)[15] যেমন মহান আল্লাহ বলেন,قُلْ هُوَ لِلَّذِينَ آمَنُوا هُدًى وَشِفَاءٌ وَالَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ فِي آذَانِهِمْ وَقْرٌ وَهُوَ عَلَيْهِمْ عَمًى أُولَئِكَ يُنَادَوْنَ مِنْ مَكَانٍ بَعِيدٍ ‘বলে দাও, এটি বিশ্বাসীদের জন্য পথনির্দেশ ও আরোগ্য। আর যারা অবিশ্বাসী, তাদের কর্ণে রয়েছে বধিরতা এবং কুরআন তাদের উপর অন্ধত্ব (অর্থাৎ অন্ধকার)। তাদেরকে যেন বহুদূর থেকে আহবান করা হচ্ছে’ (হামীম সাজদাহ ৪১/৪৪)

তাছাড়া শারঈ ঝাড়-ফুঁক মুমিনের দৈহিক আরোগ্য দান করে আল্লাহর হুকুমে। এটা কেবল তার জন্যই হয়ে থাকে, যিনি কুরআন অনুধাবন করেন ও সে অনুযায়ী আমল করেন। ঐ ব্যক্তির জন্য নয়, যে কেবল ভান করে তেলাওয়াত করে। যার মধ্যে কোন খুশূ-খুযূ ও আনুগত্য নেই। এ কারণেই ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘কুরআন হ’ল আরোগ্য গ্রন্থ। যা আত্মা ও দেহ এবং দুনিয়া ও আখেরাত সবকিছুকে শামিল করে। ঐ ব্যক্তির জন্য যে একে পূর্ণ বিশ্বাস ও ভালোবাসার সাথে গ্রহণ করে এবং এর প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্যের শর্ত সমূহ পূরণ করে। এটি আসমান ও যমীনের মালিকের কালাম। যদি এটি পাহাড়ের উপর নাযিল হ’ত, তা হ’লে তা বিদীর্ণ হয়ে যেত। অতএব আত্মার ও দেহের এমন কোন রোগ নেই, কুরআনে যার আরোগ্যের নির্দেশনা নেই’।[16]

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,كَانَ إِذَا اشْتَكَى يَقْرَأُ عَلَى نَفْسِهِ بِالْمُعَوِّذَاتِ وَيَنْفُثُ، فَلَمَّا اشْتَدَّ وَجَعُهُ كُنْتُ أَقْرَأُ عَلَيْهِ وَأَمْسَحُ بِيَدِهِ رَجَاءَ بَرَكَتِهَا. ‘যখনই নবী করীম (ছাঃ) অসুস্থ হতেন তখনই তিনি সূরা ফালাক ও নাস পড়ে নিজের উপর ফুঁক দিতেন। যখন তার রোগ কঠিন হয়ে গেল, তখন বরকত অর্জনের জন্য আমি এই সূরা পাঠ করে তাঁর হাত দিয়ে শরীর মাসেহ করে দিতাম’।[17]

আয়েশা (রাঃ) থেকে অন্য একটি হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘প্রতি রাতে নবী করীম (ছাঃ) বিছানায় যাওয়ার প্রাক্কালে সূরা ইখলাছ, সূরা ফালাক ও নাস পাঠ করে দু’হাত একত্র করে হাতে ফুঁক দিয়ে যতদূর সম্ভব সমস্ত শরীরে হাত বুলাতেন। মাথা ও মুখ থেকে আরম্ভ করে তাঁর দেহের সম্মুখভাগের উপর হাত বুলাতেন এবং তিনবার এরূপ করতেন’।[18]

৫. কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অফুরন্ত নেকী অর্জন :

প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর কর্তব্য হ’ল নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করা। মহান আল্লাহ বলেন, فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ ‘অতএব তোমাদের পক্ষে যতটুকু সহজ হয়, ততটুকু তেলাওয়াত কর’ (মুয্যাম্মিল ৭৩/২০)

কুরআন তেলাওয়াতকারী মুমিন নর-নারী কুরআন পাঠের মাধ্যমে অফুরন্ত নেকী এবং প্রভূত কল্যাণ ও শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে সক্ষম হবে। এর মাধ্যমে সে অন্যদের উপর মর্যাদা লাভ করবে। আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَثَلُ الَّذِى يَقْرَأُ الْقُرْآنَ كَالأُتْرُجَّةِ طَعْمُهَا طَيِّبٌ وَرِيحُهَا طَيِّبٌ وَالَّذِى لاَ يَقْرَأُ الْقُرْآنَ كَالتَّمْرَةِ طَعْمُهَا طَيِّبٌ وَلاَ رِيحَ لَهَا، وَمَثَلُ الْفَاجِرِ الَّذِى يَقْرَأُ الْقُرْآنَ كَمَثَلِ الرَّيْحَانَةِ رِيحُهَا طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا مُرٌّ، وَمَثَلُ الْفَاجِرِ الَّذِى لاَ يَقْرَأُ الْقُرْآنَ كَمَثَلِ الْحَنْظَلَةِ طَعْمُهَا مُرٌّ وَلاَ رِيحَ لَهَا ‘যে ব্যক্তি কুরআন তেলাওয়াত করে তার দৃষ্টান্ত হ’ল সুস্বাদু ও সুগন্ধিযুক্ত লেবুর মতো। আর যে মুমিন ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে না তার দৃষ্টান্ত হ’ল এমন খেজুরের মতো, যা সুগন্ধিহীন, কিন্তু খেতে সুস্বাদু। আর ফাসেক-ফাজের ব্যক্তির মধ্যে যে কুরআন পাঠ করে তার দৃষ্টান্ত হ’ল রায়হান জাতীয় লতার মতো, যার সুগন্ধি আছে, কিন্তু খেতে বিস্বাদ। আর যে ফাসেক একেবারেই কুরআন পড়ে না তার উপমা হ’ল মাকাল ফলের মতো, যা খেতেও বিস্বাদ এবং যার কোন সুগন্ধও নেই’।[19] হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) এই হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেন, وَفِي الْحَدِيثِ فَضِيلَةُ حَامِلِي الْقُرْآنِ وَضَرْبُ الْمَثَلِ لِلتَّقْرِيبِ لِلْفَهْمِ وَأَنَّ الْمَقْصُودَ مِنْ تِلَاوَةِ الْقُرْآنِ الْعَمَلَ ‘হাদীছটিতে কুরআনের ধারক-বাহকদের মর্যাদা ঘোষিত হয়েছে। বোধগম্যতার জন্য উপরোক্ত দৃষ্টান্ত প্রদান করা হয়েছে। এখানে কুরআন তেলাওয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হল কুরআনে নির্দেশিত বিষয়ের প্রতি আমল করা’।[20]

আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, يُقَالُ لِصَاحِبِ الْقُرْآنِ اقْرَأْ وَارْتَقِ وَرَتِّلْ كَمَا كُنْتَ تُرَتِّلُ فِى الدُّنْيَا فَإِنَّ مَنْزِلَتَكَ عِنْدَ آخِرِ آيَةٍ تَقْرَأُ بِهَا، ‘ক্বিয়ামতের দিন কুরআনের হাফেযকে বলা হবে, পাঠ করতে থাক ও উপরে আরোহণ করতে থাক এবং দুনিয়াতে যেভাবে ধীরে-সুস্থে পাঠ করতে ঠিক সেরূপে ধীরে-সুস্থে পড়তে থাক। যে আয়াতে তোমার পাঠ শেষ হবে সেখানেই তোমার স্থান’।[21]

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,الْمَاهِرُ بِالْقُرْآنِ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ وَالَّذِى يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَيَتَتَعْتَعُ فِيهِ وَهُوَ عَلَيْهِ شَاقٌّ لَهُ أَجْرَانِ ‘কুরআন পাঠে দক্ষ ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন সম্মানিত লেখক ফেরেশতাদের সাথে থাকবে। আর যে ব্যক্তি কষ্ট করে কুরআন তেলাওয়াত করে তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ ছওয়াব’।[22] কষ্ট করে কুরআন পাঠকারী ব্যক্তি তেলাওয়াতের ছওয়াব ও কষ্টের ছওয়াব পাবে (أَجْرٌ بِالْقِرَاءَةِ وَأَجْرٌ بِتَتَعْتُعِهِ فِي تِلَاوَتِهِ وَمَشَقَّتِهِ)।[23]

৬. কুরআনের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের শ্রেষ্ঠত্ব :

কুরআনের পঠন-পাঠন ও শিক্ষাদানে রয়েছে প্রভূত কল্যাণ ও শ্রেষ্ঠত্ব। ওছমান বিন আফফান (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে কুরআন শেখে এবং অন্যকে শিখায়’।[24] মহান আল্লাহ বলেন,وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ ‘ঐ ব্যক্তির চাইতে কথায় উত্তম আর কে আছে, যে (মানুষকে) আল্লাহর দিকে ডাকে ও নিজে সৎকর্ম করে এবং বলে, নিশ্চয়ই আমি আজ্ঞাবহদের অন্তর্ভুক্ত’ (হামীম সাজদাহ ৪১/৩৩)। হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, وَالدُّعَاءُ إِلَى اللَّهِ يَقَعُ بِأُمُورٍ شَتَّى مِنْ جُمْلَتِهَا تَعْلِيمُ الْقُرْآنِ وَهُوَ أَشْرَفُ الْجَمِيعِ ‘বিভিন্নভাবে আল্লাহর দিকে ডাকা যায়। তন্মধ্যে কুরআন শিক্ষাদান অন্যতম। এটি সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাপূর্ণ’।[25]

উপসংহার :

পরিশেষে বলা যায়, কুরআন মাজীদকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে আঁকড়ে ধরা একজন মুসলিমের অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্য। কুরআনের প্রতি মুসলমানদের ভালোবাসা থাকলেও সত্যিকার অর্থে কুরআন মাজীদকে আঁকড়ে ধরা থেকে মুসলমানরা বহুদূরে অবস্থান করছে। সেজন্য কুরআন বিমুখতাই মুসলিম উম্মাহর অধঃপতনের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ اللهَ يَرْفَعُ بِهَذَا الْكِتَابِ أَقْوَامًا وَيَضَعُ بِهِ آخَرِينَ ‘আল্লাহ তা‘আলা এ কিতাবের (কুরআন) মাধ্যমে কোন কোন জাতিকে উন্নতি দান করেন। আবার অন্যদেরকে করেন অবনত’।[26] ইমাম তীবী বলেন, فَمَنْ قَرَأَهُ وَعَمِلَ بِمُقْتَضَاهُ مُخْلِصًا رَفَعَهُ اللَّهُ، وَمَنْ قَرَأَهُ مُرَائِيًا غَيْرَ عَامِلٍ بِهِ وَضَعَهُ اللَّهُ أَسْفَلَ السَّافِلِينَ ‘যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে এবং তদনুযায়ী একনিষ্ঠভাবে আমল করে আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। আর যে আমল করার জন্য নয়; বরং লোক দেখানোর জন্য কুরআন পড়ে আল্লাহ তাকে ধ্বংসের অতল গহবরে নিক্ষেপ করেন’।[27] মহাকবি আল্লামা ইকবাল তাইতো বলেছেন,

وہ زمانے میں معزّز تھے مسلماں ہو کر

اور تم خوار ہوئے تارکِ قرآں ہو کر

‘যুগে যুগে তারা সম্মানিত ছিল মুসলমান হয়ে

আর লাঞ্ছিত হয়েছ তোমরা কুরআন ত্যাগী হয়ে’।

সুতরাং এ পতনদশা থেকে উত্তরণের জন্য কুরআনের কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া মুসলমানদের কোন গত্যন্তর নেই। কুরআনী বিধান বাস্তবায়নের মধ্যেই নিহিত আছে দেশ-জাতি ও বিশ্বের কল্যাণ। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন! আমীন!!


[1]. তাফসীর ইবনে কাছীর ৩/৫৮৭।

[2]. তাফসীরে সা‘দী, পৃ. ৩১৪।

[3]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়াইদ (কায়রো : দারুল হাদীছ, ১৪২৬ হি./২০০৫ খৃ.), পৃ. ৭

[4]. আজুররী, আখলাকু আহলিল কুরআন, পৃ. ৩৬-৩৭

[5]. ইকতিযাউছ ছিরাতিল মুস্তাক্বীম ২/২৭০।

[6]. ইবনুল জাওযী, যাদুল মাসীর ২/৫৯৩

[7]. আবুদাঊদ হা/৪৭৩৪; তিরমিযী হা/২৯২৫; ইবনু মাজাহ হা/২০১

[8]. রাগেব ইস্পাহানী, আল-মুফরাদাতু ফী গারীবিল কুরআন, পৃ. ৫০৮

[9]. মুসলিম হা/৭৪৬

[10]. আহমাদ হা/২৪৬৪৫; শু‘আইব আরনাউত হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন

[11]. হাশিয়াতুস সিন্ধী আলান নাসাঈ ৩/২০০

[12]. তাফসীর ইবনে কাছীর ৭/৬০, সূরা ছোয়াদ ২৯ আয়াতের তাফসীর দ্র.

[13]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, কুরআন অনুধাবন (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় প্রকাশ, সেপ্টেম্বর ২০২৩), পৃ. ১৪

[14]. আত-তাবছিরাহ ১/৭৯

[15]. তাফসীর ইবনে কাছীর ৫/১১৮

[16]. কুরআন অনুধাবন, পৃ. ১৭

[17]. বুখারী হা/৫০১৬

[18]. বুখারী হা/৫০১৭

[19]. বুখারী হা/৫০২০

[20]. ফাতহুল বারী ৯/৮৫

[21]. তিরমিযী হা/২৯১৪; আবূদাউদ হা/১৪৬৪

[22]. বুখারী হা/৪৯৩৭; মুসলিম হা/৭৯৮

[23]. শরহে নববী ‘আলা মুসলিম ৬/৮৪

[24]. বুখারী হা/৫০২৭

[25]. ফাতহুল বারী ৯/৯৬, হা/৫০২৭-এর ব্যাখ্যা দ্র.

[26]. মুসলিম হা/৮১৭; ইবনু মাজাহ হা/২১৮; মিশকাত হা/২১১৫

[27]. মির‘আতুল মাফাতীহ ৯/২২






কুরবানীর মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
রিয়া : পরিচয় ও প্রকারভেদ - ড. নূরুল ইসলাম
নববী চিকিৎসা পদ্ধতি - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
নববী চিকিৎসা পদ্ধতি (৩য় কিস্তি) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের আবশ্যকতা (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আমানত (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান
বিদায়ের আগে রেখে যাও কিছু পদচিহ্ন (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ঈদায়নের কতিপয় মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
ইসলাম ও গণতন্ত্র - ডাঃ মুহাম্মাদ আব্দুল হাফীয, চাঁপাই নবাবগঞ্জ
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য শিখন ফলাফলের গুরুত্ব - প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া
উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য ইসলামের কর্মসূচী - ড. নূরুল ইসলাম
খেয়াল-খুশির অনুসরণ - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আরও
আরও
.