পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭ । পর্ব ৮ । শেষ পর্ব ।
আহলেহাদীছ নামটি কি সঠিক?
প্রশ্ন : আমরা কেন আহলেহাদীছ? আমরা কেন মুসলিম নই? কোন ছাহাবী কি আহলেহাদীছ ছিলেন বা তারা কি নিজেদের নাম আহলেহাদীছ রেখেছিলেন? দলীল দ্বারা সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করুন যে, আমরা কেন আহলেহাদীছ? জাযাকুমুল্লাহ খায়রান (আল্লাহ আপনাদেরকে উত্তম প্রতিদান দিন)।
এ প্রশ্নগুলি ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ তথা ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার পক্ষ হ’তে করা হয়েছে এবং ছহীহ বুখারীর হাদীছও উপস্থাপন করা হয়েছে যে, জামা‘আতুল মুসলিমীন এবং তাদের ইমামকে অাঁকড়ে ধর।
-উম্মে খালেদ, ক্যান্টনমেন্ট।
জবাব :
‘মুসলিমীন’ শব্দটি মুসলিম শব্দের বহুবচন এবং সর্বসম্মতিক্রমে
আত্মসমর্পণকারী, আনুগত্যকারী ও বাধ্য ও অনুগত ব্যক্তিদেরকে মুসলিম বলা হয়।
মুসলমানদের অনেক নাম ও উপাধি রয়েছে। যেমন মুহাজিরীন, আনছার, ছাহাবা, তাবেঈন
ইত্যাদি। একটি ছহীহ হাদীছে এসেছে, فَادْعُوا بِدَعْوَى اللهِ الَّذِى
سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ الْمُؤْمِنِيْنَ عِبَادَ اللهِ ‘তোমরা আল্লাহ
প্রদত্ত নামে ডাকো। যিনি তোমাদেরকে মুসলিমীন, মুমিনীন এবং ইবাদুল্লাহ
(আল্লাহর বান্দা) নামে অভিহিত করেছেন’।[1]
এই হাদীছের সনদ ছহীহ। ইয়াহ্ইয়া বিন আবী কাছীর ‘আমি শুনেছি’ বাক্যটি পরিষ্কারভাবে বলেছেন।
মূসা
বিন খালাফ আবু খালাফ কর্তৃক ইয়াহইয়া বিন আবী কাছীর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে
যে, فَادْعُوا الْمُسْلِمِيْنَ بِأَسْمَائِهِمْ بِمَا سَمَّاهُمُ اللهُ
عَزَّ وَجَلَّ الْمُسْلِمِيْنَ الْمُؤْمِنِيْنَ عِبَادَ اللهِ عَزَّ
وَجَلَّ ‘তোমরা মুসলমানদেরকে তাদের নামসমূহ মুসলিমীন, মুমিনীন ও
ইবাদুল্লাহ দ্বারা ডাকো। যে নামগুলি আল্লাহ তা‘আলা রেখেছেন’।[2]
এই হাদীছের সনদ হাসান লি-যাতিহি। এতে আবু খালফ মূসা বিন খালাফ নামক একজন রাবী রয়েছেন। যিনি জমহূর মুহাদ্দিছগণের নিকটে বিশ্বস্ত। এজন্য তিনি সত্যবাদী, হাসানুল হাদীছ।
মুসনাদে আহমাদে (৫/২৪৪, হা/২৩২৯৮) উক্ত হাদীছের একটি ছহীহ শাহেদ অর্থাৎ সমর্থনমূলক হাদীছও বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং উপরোক্ত বর্ণনাটি একেবারেই ছহীহ। আল-হামদুলিল্লাহ।
উক্ত হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, মুসলমানদের ‘মুসলিম’ ছাড়া আরো নাম রয়েছে। এজন্য ‘আমাদের নাম স্রেফ মুসলিম’ কতিপয় লোকের এমনটা বলা ভুল এবং অগ্রহণযোগ্য।
ছহীহ
মুসলিমের ভূমিকাতে বিখ্যাত তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (রহঃ)-এর বক্তব্য
লিপিবদ্ধ রয়েছে যে, فَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ السُّنَّةِ فَيُؤْخَذُ
حَدِيْثُهُمْ ‘সুতরাং আহলে সুন্নাতের প্রতি লক্ষ্য করা হ’ত। অতঃপর তাদের
হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত’।[3]
এ উক্তির বর্ণনাকারীগণ এবং ইমাম মুসলিমের সম্মতিতে তা (ইবনে সিরীনের বক্তব্য) ছহীহ মুসলিমে মওজুদ রয়েছে। ছহীহ মুসলিম হাযার হাযার লক্ষ লক্ষ আলেম পড়েছেন। কিন্তু কেউই উক্ত বক্তব্যের সমালোচনা করেননি যে, মুসলমানদের ‘আহলে সুন্নাত’ নাম ভুল। প্রতীয়মান হ’ল যে, ‘আহলে সুন্নাত’ নামটি বিশুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে মুসলমানদের ইজমা রয়েছে।
একটি ছহীহ হাদীছে এসেছে যে, ‘ত্বায়েফাহ
মানছূরাহ’ বা ‘সাহায্যপ্রাপ্ত দল’ সর্বদা বিজয়ী থাকবে। এর ব্যাখ্যায় ইমাম
বুখারী (রহঃ) বলছেন, يعني أهل الحديث অর্থাৎ আহলেহাদীছগণ। তার অর্থ
‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ দ্বারা আহলেহাদীছ উদ্দেশ্য।[4]
ইমাম বুখারীর শিক্ষক আলী ইবনুল মাদীনী এই হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেছেন, هم أهل الحديث ‘তারা হ’লেন আহলুল হাদীছ’।[5]
ইমাম
কুতায়বা বিন সাঈদ বলেছেন, إذا رأيت الرجل يحب أهل الحديث، ... فإنه على
السنة ‘যদি তুমি কোন ব্যক্তিকে আহলেহাদীছদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করতে দেখ,
... (তখন বুঝবে যে,) সেই ব্যক্তি সুন্নাতের উপরে (আছে)’।[6]
ইমাম
আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিত্বী বলেছেন, لَيْسَ فِى الدُّنْيَا مُبْتَدِعٌ
إِلاَّ وَ هُوَ يَبْغَضُ أَهْلَ الْحَدِيْثِ- ‘দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী
নেই, যে আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না’।[7]
ইমাম
আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেছেন, إن لم تكن هذه الطائفة المنصورة أصحاب
الحديث، فلا أدري من هم. ‘সাহায্যপ্রাপ্ত এই দলটি দ্বারা যদি আছহাবুল হাদীছ
(আহলেহাদীছ) উদ্দেশ্য না হয়, তবে আমি জানি না তারা কারা’?[8]
হাফছ বিন গিয়াছ আহলেহাদীছদের সম্পর্কে বলেছেন, هم خير أهل الدنيا ‘তারা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মানুষ’।[9]
ইমাম
শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন, إِذَا رَأَيْتُ رَجُلاً مِّنْ أَصْحَابِ الْحَدِيْثِ
فَكَأَنِّيْ رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ
حَيًّا- ‘আমি যখন কোন আহলেহাদীছ ব্যক্তিকে দেখি, তখন যেন আমি নবী কারীম
(ছাঃ)-কেই জীবিত দেখি’।[10]
সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত মুহাদ্দিছ ইমাম ইবনু কুতায়বা আদ-দীনাওয়ারী (মৃঃ ২৭৬ হিঃ) ‘তাবীলু মুখতালাফিল হাদীছ ফির রাদ্দি আলা আ‘দায়ি আহলিল হাদীছ’ (تأويل مختلف الحديث فى الرد على أعداء أهل الحديث) শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেখানে তিনি আহলেহাদীছদের দুশমনদের কঠিনভাবে জবাব প্রদান করেছেন।
এই
বক্তব্যগুলি মুহাদ্দিছগণের মাঝে কোনরূপ অস্বীকৃতি ও আপত্তি ব্যতিরেকেই
প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ রয়েছে। সুতরাং প্রতীয়মান হ’ল যে, আহলেহাদীছ নামটি জায়েয
ও বিশুদ্ধ হওয়ার পক্ষে ইমামগণের ইজমা রয়েছে। আর একথা সূর্যকিরণের চেয়েও
সুস্পষ্ট যে, মুসলিম উম্মাহ ভ্রষ্টতার উপর একমত হ’তে পারেন না। রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেছেন,لا يجمع الله أمتي أو قال هذه الأمة على الضلالة أبدا ويد
الله على الجماعة- ‘আল্লাহ আমার উম্মতকে কিংবা বলেছেন এই উম্মতকে কখনো
গুমরাহীর উপরে একত্রিত করবেন না এবং জামা‘আতের উপরে আল্লাহর হাত রয়েছে’।[11]
উপরোল্লেখিত দলীলসমূহ দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, আহলেহাদীছ এবং আহলুস সুন্নাহ মুসলমানদের বৈশিষ্ট্যগত নাম এবং উপাধি। আর এই দলটিই ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ বা সাহায্যপ্রাপ্ত দল।
আহলেহাদীছ-এর দু’টি অর্থই হ’তে পারে। ১. ছহীহ
আক্বীদাসম্পন্ন মুহাদ্দিছীনে কেরাম। ২. ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন সাধারণ জনগণ।
যারা দলীলের ভিত্তিতে মুহাদ্দিছগণের পথে চলেন এবং তাদের অনুসরণ করেন।[12]
একথা প্রমাণিত যে, ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ জান্নাতে যাবে। কেননা এটি হক্বপন্থী জামা‘আত। তবে কি শুধু মুহাদ্দিছগণই জান্নাতে যাবেন আর তাদের অনুসারী সাধারণ জনগণ জান্নাতের বাইরে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবেন?
সুতরাং প্রতীয়মান হ’ল
যে, ত্বায়েফাহ মানছূরাহ-এর মধ্যে মুহাদ্দিছগণ এবং তাদের অনুসারী উভয়ই শামিল
রয়েছেন। স্বীয় বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা কুরআন-হাদীছ অনুধাবনকারী এবং ইজমা
অস্বীকারকারী মাসঊদ আহমাদ (বিএসসি) তাকফীরী লিখেছেন, ‘আমরাও মুহাদ্দিছগণকে
আহলুল হাদীছ বলে থাকি’। যুবায়ের ছাহেবের (লেখকের) উল্লেখিত বক্তব্যগুলি
আমাদের সমর্থনে, প্রত্যুত্তরে নয়।[13]
হাদীছ বর্ণনাকারীদেরকে মুহাদ্দিছীন বলা হয়। সাধারণ মুসলমানগণও জানেন যে, ছাহাবী ও তাবেঈগণ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। সুতরাং প্রমাণিত হ’ল যে, ছাহাবী ও তাবেঈগণ মুহাদ্দিছ তথা আহলেহাদীছ ছিলেন।
মাসঊদ আহমাদের উপরে একটি নতুন অহী
অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি উদ্ধত গলায় প্রচার চালাচ্ছেন যে, ‘মুহাদ্দিছগণ তো চলে
গেছেন। এখন তো ঐ সমস্ত ব্যক্তি জীবিত রয়েছেন, যারা তাদের গ্রন্থ সমূহ থেকে
নকল করেন মাত্র’।[14]
মাসঊদ আহমাদ ছাহেবের
উক্ত বক্তব্যের পর্যালোচনা করতে গিয়ে মুহতারাম ভাই ড. আবু জাবের আদ-দামানভী
বলছেন, ‘মাসঊদ আহমাদের বক্তব্যের সারমর্ম এই যে, যেভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর
উপরে নবুঅতের সিলসিলা বন্ধ হয়ে গেছে, ঠিক তেমনিভাবে মুহাদ্দিছগণের আগমনের
সিলসিলাও কোন বিশেষ মুহাদ্দিছ ব্যক্তি পর্যন্ত সমাপ্ত হয়ে গেছে। এখন
ক্বিয়ামত পর্যন্ত আর কোন মুহাদ্দিছ জন্ম নিবেন না এবং বর্তমানে যারাই আসবেন
তারা শুধুমাত্র পূর্ববর্তী মুহাদ্দিছগণের গ্রন্থ হ’তে নকলকারীই হবেন।
যেভাবে লোকেরা ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ কেউ বারজন ইমামের পরে
তাদের সিলসিলা খতম করে দিয়েছেন। মাসঊদ আহমাদ ছাহেবের মনে হ’তে পারে যে,
এভাবে মুহাদ্দিছগণের আগমনের ধারাবাহিকতাও বর্তমানে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু
তিনি (মাসঊদ আহমাদ) এ ব্যাপারে কোন দলীল উল্লেখ করেননি। তার দৃষ্টিতে
ইমামদের বক্তব্যতো ভ্রূক্ষেপযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে তিনি নিজের বক্তব্যকেই
দলীল হিসাবে গ্রহণ করেছেন। অথচ যে ব্যক্তিই ইলমে হাদীছের প্রতি আকর্ষণ বোধ
করেন, তাকে মুহাদ্দিছগণের দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে।[15]
ছহীহ বুখারীর হাদীছ, تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِيْنَ وَإِمَامَهُمْ ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন এবং তাদের ইমামকে অাঁকড়ে ধরবে’।[16]
এই হাদীছের অনুকূলে ইমাম বুখারী (রহঃ) লিখিত অনুচ্ছেদ كَيْفَ الأَمْرُ
إِذَا لَمْ تَكُنْ جَمَاعَةٌ ‘যখন জামা‘আত থাকবে না তখন কি করতে হবে’-এর
ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেছেন, وَالْمَعْنَى مَا الَّذِي
يَفْعَلُ الْمُسلمُ فِي حَال الِاخْتِلاَفِ مِنْ قبل ان يَقع الْإِجْمَاعُ
عَلَى خَليْفَةٍ ‘উক্ত হাদীছের মর্মার্থ এই যে, একজন খলীফার ব্যাপারে
ঐক্যমতের পূর্বে মতভেদপূর্ণ পরিস্থিতিতে মুসলমানগণ কি করবেন’?[17]
বদরুদ্দীন
আইনী হানাফী লিখছেন, وَحَاصِل معنى التَّرْجَمَة أَنه إِذا وَقع اخْتِلَاف
وَلم يكن خَليفَة فَكيف يفعل الْمُسلم من قبل أَن يَقع الِاجْتِمَاع على
خَليفَة ‘এ অনুচ্ছেদের সারমর্ম হ’ল, যখন মুসলমানদের মাঝে মতপার্থক্য হবে
এবং কোন খলীফা থাকবে না, এমতাবস্থায় একজন খলীফার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণের
পূর্বে মুসলমানগণ কি করবেন’?[18]
‘জামা‘আত’
শব্দের ব্যাখ্যায় বুখারীর ভাষ্যকার ইমাম ক্বাসত্বালানী (রহঃ) লিখছেন,
مجتمعون على خَليفَة ‘একজন খলীফার অধীনে ঐক্যবদ্ধ ব্যক্তিগণ’।[19]
ইমাম কুরতুবী (মৃঃ ৬৫৬ হিঃ) লিখছেন,
يعني : أنه متى اجتمع المسلمون على إمام فلا يُخرج عليه وإنْ جَارَ كما تقدّم، وكما قال في الرواية الأخرى: فاسمع، وأطع. وعلى هذا فتُشهد مع أئمة الْجَوْر الصلوات، والجماعات، والجهاد، والحج، وتُجْتَنَبُ معاصيهم، ولا يطاعون فيها.
অর্থাৎ যখন মুসলমানগণ কোন খলীফার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ
করবেন, তখন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না। যদিও তিনি অত্যাচারী হন।
যেমনটি পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। যেমনভাবে অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, তুমি
তার আদেশ শোন এবং তার আনুগত্য কর (যদিও সে তোমার পিঠে প্রহার করে)। এ
হাদীছের আলোকে অত্যাচারী ইমাম তথা শাসকদের সাথে ছালাত, ঈদের জামা‘আত,
জিহাদ, হজ্জ (প্রভৃতি) আদায় করা যাবে। তবে তাদের পাপকার্য সমূহ থেকে বিরত
থাকতে হবে এবং এ ব্যাপারে তাদের আনুগত্য করা যাবে না।[20]
ইমাম
কুরতুবী (রহঃ) আরো বলেন, فلو بايع أهل الحل والعقد لواحدٍ موصوف بشروط
الإمامة لانعقدت له الخلافة، وحرمت على كل أحدٍ المخالفة ‘যদি জ্ঞানী-গুণী
ব্যক্তিগণ খেলাফতের শর্তাবলী পূরণকারী কোন ব্যক্তির নিকট বায়‘আত গ্রহণ
করেন, তাহ’লে তার খেলাফত কায়েম হয়ে যাবে এবং প্রত্যেক মুসলমানের উপরে তার
বিরোধিতা করা হারাম সাব্যস্ত হয়ে যাবে’।[21]
হাদীছের
ব্যাখ্যাকারদের উক্ত ভাষ্য সমূহ দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, ‘জামা‘আতুল
মুসলিমীন’ এবং তাদের ইমাম দ্বারা খিলাফত এবং খলীফা উদ্দেশ্য। এই ব্যাখ্যার
সমর্থন এর দ্বারাও হয় যে, হুযায়ফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত অন্য আরেকটি বর্ণনায়
এসছে যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, فَإِنْ لَمْ تَجِدْ يَوْمَئِذٍ خَلِيْفَةً
فَاهْرَبْ حَتَّى تَمُوْتَ ‘তুমি যদি তখন কোন খলীফা না পাও, তাহ’লে মৃত্যু
অবধি পালিয়ে থাকবে’।[22]
একটি গুরুত্বপূর্ণ ফায়েদা :
ইবনু বাত্তাল কুরতুবী (মৃঃ ৪৪৯হিঃ) বলেছেন,فإذا لم يكن لهم إمام فافترق
أهل الإسلام أحزابًا فواجب اعتزال تلك الفرق كلها ‘সুতরাং যখন তাদের কোন
ইমাম (খলীফা) থাকবে না এবং মুসলমানেরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে যাবে, তখন ঐ
দলসমূহ হ’তে দূরে থাকা আবশ্যক’।[23]
হুযায়ফা (রাঃ) বর্ণিত উক্ত হাদীছ দ্বারা দুই শ্রেণীর মানুষ ফায়েদা লোটার চেষ্টা করেছে।
১. ঐ সকল লোক, যারা ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ নামে একটি কাগুজে দল গঠন করেছে এবং একজন সাধারণ ব্যক্তি সেই পার্টির নেতা বনে গেছে। অথচ এ দলটি মুসলমানদের খেলাফতভিত্তিক জামা‘আত নয় এবং সেই দলের নেতাও ইমাম বা খলীফা নয়।
২. ঐ সকল লোক, যারা একজন কাগুজে খলীফা বানিয়েছে। যার নিকটে না আছে সৈন্য, আর না আছে কোন ক্ষমতা। এই কাগুজে খলীফার এক ইঞ্চি মাটির উপরেও কোন কর্তৃত্ব নেই। ঐ খলীফা না কোন কাফেরদের সাথে জিহাদ করেছে, আর না কোন শারঈ দন্ডবিধি বাস্তবায়ন করেছে। তাকে খলীফা বলা খেলাফতের সাথে ঠাট্টা করার শামিল। সূরা বাক্বারার ৩০ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) লিখেছেন,
وَقَدِ اسْتَدَلَّ الْقُرْطُبِيُّ وَغَيْرُهُ بِهَذِهِ الْآيَةِ عَلَى وُجُوبِ نَصْبِ الْخَلِيفَةِ لِيَفْصِلَ بَيْنَ النَّاسِ فِيمَا يَخْتَلِفُونَ فِيهِ، وَيَقْطَعَ تَنَازُعَهُمْ، وَيَنْتَصِرَ لِمَظْلُومِهِمْ مِنْ ظَالِمِهِمْ، وَيُقِيمَ الْحُدُودَ، وَيَزْجُرَ عَنْ تَعَاطِي الْفَوَاحِشِ-
‘কুরতুবী প্রমুখ এ আয়াত দ্বারা খলীফা কায়েম করা ওয়াজিব
হওয়া সাব্যস্ত করেছেন। যাতে তিনি লোকদের মধ্যে বিবদমান বিষয়ের ফায়ছালা
করেন এবং তাদের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটান। যালেমের বিরুদ্ধে মাযলূমকে সাহায্য
করতে পারেন, দন্ডবিধি বাস্তবায়ন করেন এবং যাবতীয় অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা থেকে
বিরত রাখেন’।[24]
ক্বাযী আবু ইয়া‘লা
মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন আল-ফার্রা এবং ক্বাযী আলী বিন মুহাম্মাদ বিন হাবীব
আল-মাওয়ার্দী ও খলীফা হওয়ার জন্য জিহাদ, রাজনৈতিক শক্তি এবং হুদূদ বা
দন্ডবিধি প্রয়োগ করার শর্তাবলী আরোপ করেছেন।[25]
মোল্লা
আলী ক্বারী হানাফী (রহঃ) লিখছেন, ولأن المسلمين لا بد لهم من إمام، يقوم
بتنفيذ أحكامهم، وإقامة حدودهم، وسدّ ثغورهم، وتجهيز جيوشهم، وأخذ صدقاتهم.
‘মুসলমানদের জন্য এমন একজন ইমাম (খলীফা) হওয়া যরূরী, যিনি হুকুম-আহকাম
বাস্তবায়ন করবেন, তাদের মাঝে দন্ডবিধি কায়েম করবেন, সীমান্ত এলাকার হেফাযত
করবেন, সৈন্য-বাহিনী প্রস্ত্তত করবেন এবং মানুষদের নিকট থেকে
যাকাত-ছাদাক্বা আদায় করবেন’।[26]
ওলামায়ে কেরামের উল্লিখিত বক্তব্যের সরাসরি বিপরীত একজন কাগুজে খলীফা বানানো, যিনি নিজের ঘরেই শারঈ হুদূদ কায়েমে ব্যর্থ হন এবং নিজের ঘর-বাড়ীকে হেফাযত করতে সক্ষম হন না, এগুলি ঐ সমস্ত লোকের কাজ যারা মুসলিম উম্মাহর মাঝে দলাদলি সৃষ্টি করতে এবং বাতিল মতবাদ সমূহকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করতে চায়।
একটি
হাদীছে এসেছে, وَمَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِى عُنُقِهِ بَيْعَةٌ مَاتَ مِيتَةً
جَاهِلِيَّةً ‘যে ব্যক্তি মারা যায় এমতাবস্থায় যে তার গর্দানে কোন ইমামের
বায়‘আত নেই, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল’।[27]
এ
হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেছেন,تدري ما الإمام؟
الذي يجتمع المسلمون عليه كلهم يقول: هذا إمام، فهذا معناه ‘তুমি কি জান
(উক্ত হাদীছে বর্ণিত) ইমাম কাকে বলে? ইমাম তিনিই, যার ইমাম হওয়ার ব্যাপারে
মুসলিম উম্মাহ ঐক্যমত পোষণ করেছে। প্রতিটি লোকই বলবে যে, ইনিই ইমাম
(খলীফা)। এটাই উক্ত হাদীছের মর্মার্থ।[28]
সারসংক্ষেপ এই যে, ইমাম এবং জামা‘আতুল মুসলিমীন সংক্রান্ত হাদীছ সমূহ দ্বারা দলীল সাব্যস্ত করে কিছু লোকের কাগুজে জামা‘আত এবং কাগুজে আমীর বানানো একেবারেই ভ্রান্ত এবং সালাফে ছালেহীনের বুঝের সরাসরি বরখেলাফ।
কিছু মানুষ ‘আহলেহাদীছ’ নাম শুনে জ্বলে-পুড়ে মরেন এবং সাধারণ মানুষের মাঝে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে অপচেষ্টা চালান যে, আহলেহাদীছ নামটি দলবাজি। আমরা যেহেতু মুসলিম তাই আমাদেরকে মুসলিম বলাই উচিত। সেজন্যই আমরা সালাফে ছালেহীন, মুহাদ্দিছ এবং ইমামগণের অসংখ্য দলীল পেশ করেছি এ মর্মে যে, আহলেহাদীছ বলা কেবল জায়েযই নয়; বরং পসন্দনীয়ও বটে। আর এটাই ত্বায়েফাহ মানছূরাহ তথা সাহায্যপ্রাপ্ত দল।
[চলবে]
মূল : শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ*
অনুবাদ : আহমাদুল্লাহ
সৈয়দপুর, নীলফামারী।
[1]. তিরমিযী, হা/২৮৬৩; ইমাম তিরমিযী হাদীছটিকে হাসান ছহীহ গরীব বলেছেন। ইবনু হিববান, মাওয়ারিদ, হা/১২২২, ১৫৫০) এবং হাকেম একে ছহীহ বলেছেন (১/১১৭, ১১৮, ২৩৬, ৪২১, ৪২২) এবং যাহাবী তাকে সমর্থন করেছেন।
[2]. আহমাদ, ৪/১৩০, হা/১৭৩০২; ৪/২০২, হা/১৭৯৫৩, সনদ হাসান।
[3]. মুসলিম, হা/২৭ অনুচেছদ-৫; দারুস সালাম পাবলিকেশন্সের ক্রমিক নং অনুসারে।
[4]. খত্বীব বাগদাদী, মাসআলাতুল ইহতিজাজ বিশ-শাফেঈ, পৃঃ ৪৭; সনদ ছহীহ।
[5]. তিরমিযী হা/২২২৯; ‘ফিতান’ অধ্যায়, ‘পথভ্রষ্ট শাসকদের আলোচনা’ অনুচ্ছেদ; আরেযাতুল আহওয়াযী, ৯/৭৪; সনদ ছহীহ।
[6]. খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ, হা/১৪৩, পৃঃ ১৩৪; সনদ ছহীহ।
[7]. হাকেম, মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৪, সনদ ছহীহ।
[8]. ঐ, পৃঃ ২; ইবনু হাজার আসক্বালানী ফাতহুল বারীতে (১৩/২৫০) একে ছহীহ বলেছেন।
[9]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৩, সনদ ছহীহ।
[10]. শারফু আছহাবিল হাদীছ, হা/৮৫, পৃঃ ৯৪, সনদ ছহীহ।
[11]. মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/৩৯৮, ৩৯৯, ১/১১৬, সনদ ছহীহ।
[12]. মুক্বাদ্দামাতুল ফিরক্বাতুল জাদীদাহ, পৃঃ ১৯; ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূঊ ফাতাওয়া, ৪/৯৫।
[13]. আল-জামা‘আতুল ক্বাদীমাহ বা-জাওয়াবে আল-ফিরক্বাতুল জাদীদাহ, পৃঃ ৫।
[14]. ঐ, পৃঃ ২৯।
[15]. খুলাছাতুল ফিরক্বাতিল জাদীদাহ, পৃঃ ৫৫।
[16]. বুখারী, হা/৭০৮৪।
[17]. ফাতহুল বারী, হা/৭০৮৪, ১৩/৩৫।
[18]. উমদাতুল ক্বারী, ২৪/১৯৩, ‘ফিতান’ অধ্যায়।
[19]. ইরশাদুস সারী, ১০/১৮৩।
[20]. আল-মুফহাম লিমা আশকালা মিন তালখীছে কিতাবে মুসলিম, ৪/৫৭।
[21]. ঐ, ৪/৫৭-৫৮।
[22]. আবুদাঊদ হা/৪২৪৭; ছহীহ আবু ‘আওয়ানাহ, ৪/৪৭৬; সনদ হাসান। রাবী ছাখর বিন বদরকে ইবনে হিববান ও আবু ‘আওয়ানাহ ছিক্বাহ বলেছেন। অপর রাবী সুবাই‘ ইবনে খালেদকে ইজলী এবং ইবনে হিববান ছিক্বাহ বলেছেন। এ হাদীছটির অনেক শাহেদ তথা সমর্থক হাদীছ রয়েছে।
[23]. ইবনু বাত্তাল, শারহুল বুখারী, ১০/৩২। [এই ব্যাখ্যা ভ্রমাত্মক। কেননা পৃথিবীতে সর্বত্র সর্বদা হকপন্থী খলীফা থাকবেন না। সে অবস্থায় মুসলিম উম্মাহ বাধ্যগতভাবে বাতিলপন্থী শাসকদের আনুগত্য করবে। কিন্তু ইসলামী অনুশাসন পালনের জন্য তারা নিজেদের মধ্যকার ইসলামী আমীরের আনুগত্য করবে। যদিও তিনি শারঈ দন্ডবিধি কায়েম করবেন না। যেভাবে মাক্কী জীবনে রাসূল (ছাঃ) মুসলমানদের আনুগত্য লাভ করেছেন। কিন্তু তাদের উপর শারঈ দন্ডবিধি জারী করেননি। কারণ এজন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা তখন তিনি লাভ করেননি। এ নীতি সকল যুগেই প্রযোজ্য। ইমারত ও বায়‘আত বিহীন জীবন বিশৃংখল জীবনের নামান্তর। যাকে হাদীছে জাহেলিয়াতের জীবন বলা হয়েছে এবং যা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। অতএব সর্বাবস্থায় মুসলমানকে একজন শারঈ আমীরের প্রতি আনুগত্যশীল হয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।- স.স.]
[24]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ১/২০৪।
[25]. আল-আহকামুস সুলতানিয়াহ, পৃঃ ২২; মাওয়ার্দী, আল-আহকামুস সুলতানিয়াহ, পৃঃ ৬; মাসিক ‘আল-হাদীছ’, সংখ্যা ২২, পৃঃ ৩৯।
[26]. শারহুল ফিক্বহিল আকবার, পৃঃ ১৪৬।
[27]. ইবনু আবী আছেম, আস-সুন্নাহ, হা/১০৫৭, সনদ হাসান; মুসলিম, হা/১৮৫১।
[28]. সুওয়ালাতু ইবনে হানী, পৃঃ ১৮৫; অনুচ্ছেদ ২০১১; খাল্লাল, আস-সুন্নাহ, পৃঃ ৮১, অনুচ্ছেদ ১০; আল-মুসনাদ মিন মাসাইলিল ইমাম আহমাদ, অনুচ্ছেদ-১। গৃহীত : আল-ইমামাতুল উযমা ইনদা আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ, পৃঃ ২১৭।