পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭ । পর্ব ৮ । শেষ পর্ব 

জামা‘আতুল মুসলিমীন দ্বারা কি উদ্দেশ্য?

প্রশ্ন : নিবেদন হ’ল যে, ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ (রেজিস্টার্ড) বুখারী ও মুসলিমের এই (সামনে আসছে) হাদীছকে নিজেদের পক্ষে পেশ করে থাকে। যখন তাদের এই বুঝ ও ইসতিফাদাহ (উপকৃত হওয়া) এবং এভাবে দলীল গ্রহণের ব্যাপারে আমাদের ভিন্নমত রয়েছে। দয়া করে খায়রুল কুরূনের (স্বর্ণ যুগ) বুঝ ও ইসতিফাদাহ দ্বারা উপকৃত করবেন।

كَيْفَ الأَمْرُ إِذَا لَمْ تَكُنْ جَمَاعَةٌ ‘যখন জামা‘আত থাকবে না তখন কি করতে হবে’ অনুচ্ছেদের অধীনে ১৯৬৮ নং হাদীছে এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِينَ وَإِمَامَهُمْ. قُلْتُ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُمْ جَمَاعَةٌ وَلاَ إِمَامٌ؟ قَالَ فَاعْتَزِلْ تِلْكَ الْفِرَقَ كُلَّهَا، وَلَوْ أَنْ تَعَضَّ بِأَصْلِ شَجَرَةٍ حَتَّى يُدْرِكَكَ الْمَوْتُ وَأَنْتَ عَلَى ذَلِكَ-

‘জামা‘আতুল মুসলিমীন এবং তাদের ইমামকে অাঁকড়ে ধরবে। আমি বললাম, যদি তাদের কোন জামা‘আত ও ইমাম না থাকে? তিনি বললেন, তুমি ঐ দলগুলোকে পরিত্যাগ করবে। যদিও তোমাকে গাছের শিকড় কামড়ে ধরে থাকতে হয় এবং এমতাবস্থায় তোমার মৃত্যু এসে যায়’।[1]

মুহতারাম! এ সম্পর্কে তিনটি যুগের উদ্ধৃতিসমূহ দ্বারা পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিন যে, ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ (রেজিস্টার্ড) এ হাদীছের ভিত্তিতে-

১. সবাইকে গোমরাহ এবং নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে সঠিক মনে করে।

২. তাদের কতিপয় গ্রন্থ যেমন (১) দাওয়াতে ইসলাম (পৃঃ ৪৭-৪৮)-এ ৩৪টি মাযহাবী জামা‘আত (২) দাওয়াতে ফিকর ও নযর (পৃঃ ৪৯) গ্রন্থে ৩৩টি মাযহাবী জামা‘আত এবং  লামহায়ে ফিকরিয়াহ (পৃঃ ৪২) ও অন্যান্য গ্রন্থে ৩৩টি মাযহাবী জামা‘আতের নাম গণনা করেছে। সেখানে এই বুঝ দেয়ার চেষ্টা করেছে যে, এই (জামা‘আতগুলি) যেহেতু ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ (রেজিস্টার্ড)-এর সাথে সম্পৃক্ত নয়; সেহেতু (সেগুলি) গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট।

৩. সাধারণভাবে তাতে রাজনৈতিক দলসমূহের উল্লেখ থাকা কোন আশঙ্কা থেকে মুক্ত নয়।

দয়া করে আপনার মূল্যবান সময় থেকে কিছু সময় বিশেষ দিকনির্দেশনার জন্য অবশ্যই উৎসর্গ করবেন।

-সংস্কার ও কল্যাণকামী : তারেক মাহমূদ, সাঈদ অটোজ, দীনা জেহলাম।

জবাব : এতে কোন সন্দেহ নেই যে, কুরআন ও ছহীহ হাদীছ হুজ্জাত বা দলীল এবং কুরআন ও হাদীছ থেকে ইজমায়ে উম্মতের দলীল হওয়া সাব্যস্ত রয়েছে। এজন্য শরী‘আতের দলীল হ’ল তিনটি- ১. কুরআন মাজীদ ২. ছহীহ ও হাসান লি-যাতিহি এবং মারফূ‘ হাদীছ সমূহ ৩. ইজমায়ে উম্মত।

সাবীলুল মুমিনীন সংক্রান্ত আয়াত এবং অন্যান্য দলীল দ্বারা নিম্নোক্ত দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিও প্রমাণিত রয়েছে :

১. কুরআন ও সুন্নাহর স্রেফ ঐ মর্মই গ্রহণযোগ্য, যেটি সালাফে ছালেহীন (যেমন ছাহাবা, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, মুহাদ্দিছগণ, ওলামায়ে দ্বীন ও ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন হাদীছ ব্যাখ্যাকারগণ) থেকে সর্বসম্মতিক্রমে অথবা কোন মতভেদ ছাড়াই সাব্যস্ত রয়েছে।

২. ইজতিহাদ যেমন সালাফে ছালেহীনের আছার দ্বারা দলীল গ্রহণ করা।

এই ভূমিকার পরে সাইয়েদুনা হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِينَ وَإِمَامَهُمْ ‘মুসলমানদের জামা‘আত এবং তাদের ইমামকে অাঁকড়ে ধরবে’-এর ব্যাখ্যায় আরয হ’ল যে, এখানে জামা‘আতুল মুসলিমীন দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল মুসলমানদের খেলাফত এবং ‘তাদের ইমাম’ (إمامهم) দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল ‘তাদের খলীফা’ (خليفتهم) (অর্থাৎ মুসলমানদের খলীফা)। এই ব্যাখ্যার দু’টি দলীল নিম্নরূপ :

১. (সুবাই‘ বিন খালেদ) আল-ইয়াশকুরী (নির্ভরযোগ্য তাবেঈ)-এর সনদে বর্ণিত আছে যে, হুযায়ফা (রাঃ) বলেন, ‘যদি তুমি তখন কোন খলীফা না পাও, তবে মৃত্যু অবধি পালিয়ে থাকবে’।[2]

এই হাদীছের রাবীদের সংক্ষিপ্ত তাওছীক্ব নিম্নরূপ  :

১. সুবাই‘ বিন খালেদ আল-ইয়াশকুরী (রহঃ) : তাঁকে  ইবনু হিববান, ইমাম ইজলী, হাকেম, আবূ ‘আওয়ানাহ এবং  যাহাবী ছিক্বাহ (নির্ভরযোগ্য) ও ছহীহুল হাদীছ বলেছেন। সুতরাং এই শক্তিশালী সত্যায়নের পর তাঁকে ‘মাজহূল’ (অজ্ঞাত) কিংবা ‘মাসতূর’ (অপরিচিত) বলা ভুল।

২. ছাখর বিন বদর আল-ইজলী (রহঃ) : ইবনু হিববান এবং আবূ ‘আওয়ানাহ তাঁকে ছিক্বাহ ও ছহীহুল হাদীছ বলেছেন। এই তাওছীক্বের পরে শায়খ আলবানীর তাঁকে মাজহূল বলা ভুল।

৩. আবুত তাইয়াহ ইয়াযীদ বিন হুমায়েদ (রহঃ) : তিনি ছহীহায়েন এবং সুনানে আরবা‘আর রাবী এবং ছিক্বাহ-ছাবত (নির্ভরযোগ্য) ছিলেন।

৪. আব্দুল ওয়ারিছ বিন সাঈদ (রহঃ) : তিনি ছহীহায়েন ও সুনানে আরবা‘আর রাবী এবং ছিক্বাহ-ছাবত (নির্ভরযোগ্য) ছিলেন।

৫. মুসাদ্দাদ বিন মুসারহাদ (রহঃ) : ছহীহ বুখারী ও অন্য হাদীছ গ্রন্থের রাবী এবং ছিক্বাহ-হাফেয ছিলেন।

প্রমাণিত হ’ল যে, এ সনদটি হাসান লি-যাতিহি। আর  ক্বাতাদা (ছিক্বাহ-মুদাল্লিস)-এর নাছর বিন আছেম হ’তে সুবাই‘ বিন খালেদ সূত্রের বর্ণনাটি ছাখর বিন বদরের হাদীছের শাহেদ বা সমর্থক। যেটি মাসঊদ আহমাদ বিএসসির ‘উছূলে হাদীছ’-এর আলোকে সুবাই‘ বিন খালেদ (রহঃ) পর্যন্ত ছহীহ।[3]

এই হাসান (এবং মাসঊদিয়ার মূলনীতি অনুযায়ী ছহীহ) বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, হুযায়ফা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে ইমাম দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল খলীফা। আর স্মর্তব্য যে, হাদীছ হাদীছকে ব্যাখ্যা করে।

২. হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন ও তাদের ইমামকে অাঁকড়ে ধরবে’-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন,

قَالَ الْبَيْضَاوِيُّ : الْمَعْنَى إِذَا لَمْ يَكُنْ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةٌ فَعَلَيْكَ بِالْعُزْلَةِ وَالصَّبْرِ عَلَى تَحَمُّلِ شِدَّةِ الزَّمَانِ وَعَضُّ أَصْلِ الشَّجَرَةِ كِنَايَةٌ عَنْ مُكَابَدَةِ الْمَشَقَّةِ-  

‘বায়যাবী (মৃঃ ৬৮৫ হিঃ) বলেছেন, এর অর্থ হ’ল, যখন যমীনে কোন খলীফা থাকবে না, তখন তোমার কর্তব্য হ’ল বিচ্ছিন্ন থাকা এবং যুগের কষ্ট সহ্য করার ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করা। আর গাছের শিকড় কামড়ে থাকা দ্বারা কষ্ট সহ্য করার প্রতি ইশারা করা হয়েছে’।[4]

হাফেয ইবনু হাজার মুহাম্মাদ বিন জারীর বিন ইয়াযীদ আত-ত্বাবারী (মৃঃ ৩১০ হিঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে,

وَالصَّوَابُ أَنَّ الْمُرَادَ مِنَ الْخَبَرِ لُزُومُ الْجَمَاعَةِ الَّذِينَ فِي طَاعَةِ مَنِ اجْتَمَعُوا عَلَى تَأْمِيرِهِ فَمَنْ نَكَثَ بَيْعَتَهُ خَرَجَ عَنِ الْجَمَاعَةِ، قَالَ : وَفِي الْحَدِيثِ أَنَّهُ مَتَى لَمْ يَكُنْ لِلنَّاسِ إِمَامٌ فَافْتَرَقَ النَّاسُ أَحْزَابًا فَلَا يَتَّبِعُ أَحَدًا فِي الْفُرْقَةِ وَيَعْتَزِلُ الْجَمِيعَ إِنِ اسْتَطَاعَ ذَلِكَ-

‘সঠিক হ’ল, হাদীছ দ্বারা উদ্দেশ্য ঐ জামা‘আতকে অাঁকড়ে ধরা, যে (দলটি) তার (ইমাম)-এর ইমারতের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আর যে ব্যক্তি তার বায়‘আতকে ভঙ্গ করল, সে জামা‘আত থেকে বের হয়ে গেল। তিনি (ইবনু জারীর) বলেন, আর হাদীছটিতে (এটাও) আছে যে, যখন মানুষের কোন ইমাম থাকবে না এবং লোকেরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়বে, তখন সে কোন দলেরই অনুসরণ করবে না এবং সক্ষম হলে সব দল থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে’।[5]

ছহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাতা আল্লামা আলী বিন খালাফ বিন আব্দুল মালিক বিন বাত্ত্বাল কুরতুবী (মৃঃ ৪৪৯ হিঃ) বলেছেন, وفيه حجة لجماعة الفقهاء فى وجوب لزوم جماعة المسلمين وترك القيام على أئمة الجور، ‘এ হাদীছে ফক্বীহদের জন্য মুসলমানদের জামা‘আতকে অাঁকড়ে ধরার এবং যালিম শাসকদের বিরোধিতা না করার দলীল রয়েছে’।[6]

হাফেয ইবনু হাজার উক্ত হাদীছের একটি অংশের ব্যাখ্যায় বলেছেন,وَهُوَ كِنَايَةٌ عَنْ لُزُومِ جَمَاعَةِ الْمُسْلِمِينَ وَطَاعَةِ سَلَاطِينِهِمْ وَلَوْ عَصَوْا ‘এটি মুসলমানদের জামা‘আতকে অাঁকড়ে ধরা এবং তাদের শাসকদের আনুগত্য করার ইঙ্গিতবাহী। যদিও তারা (শাসকবর্গ) নাফরমানী করে’।[7]

হাদীছ ব্যাখ্যাকারকদের (ইবনু জারীর ত্বাবারী, ক্বাযী বায়যাবী, ইবনু বাত্ত্বাল ও হাফেয ইবনু হাজার) উক্ত ব্যাখ্যাসমূহ (সালাফে ছালেহীনের বুঝ) দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, উল্লিখিত হাদীছ (জামা‘আতুল মুসলিমীন ও তাদের ইমামকে অাঁকড়ে ধরবে) দ্বারা প্রচলিত জামা‘আত ও দলসমূহ (যেমন মাসঊদ আহমাদ বিএসসির জামা‘আতুল মুসলিমীন রেজিস্টার্ড) উদ্দেশ্য নয়। বরং মুসলমানদের সর্বসম্মত খেলাফত ও খলীফা উদ্দেশ্য।

একটি হাদীছে এসেছে যে, مَنْ مَاتَ وَلَيْسَ لَهَّ إِمَامٌ مَاتَ مِيْتَةً جَاهِلِيَّةً ‘যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে এমতাবস্থায় যে তার কোন ইমাম (খলীফা) নেই, সে জাহেলিয়াতের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল’।[8]

এই হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) তাঁর এক ছাত্রকে বলেছেন যে, تدري ما الإمام؟ الذي يجتمع المسلمون عليه كلهم يقول: هذا إمام، فهذا معناه ‘তুমি কি জান (উক্ত হাদীছে বর্ণিত) ইমাম কাকে বলে? ইমাম তিনিই, যার ইমাম হওয়ার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহ ঐক্যমত পোষণ করেছে। প্রতিটি লোকই বলবে যে, ইনিই ইমাম (খলীফা)। এটাই উক্ত হাদীছের মর্মার্থ’।[9]

এই ব্যাখ্যা দ্বারাও এটাই প্রমাণিত হ’ল যে, ‘তাদের ইমাম’(إمامهم) দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল ঐ ইমাম (খলীফা), যার খেলাফতের ব্যাপারে সকল মুসলমানের ইজমা হয়ে গেছে। যদি কারো ব্যাপারে প্রথম থেকেই মতানৈক্য হয়, তবে তিনি্ঐ হাদীছে উদ্দেশ্য নন। এজন্য ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার (জামা‘আতুল মুসলিমীন রেজিস্টার্ড) উক্ত হাদীছ দ্বারা নিজের তৈরী ও নতুন গজিয়ে ওঠা ফিরক্বাকে উদ্দেশ্য নেয়া ভুল, বাতিল এবং অনেক বড় ধোঁকাবাজি।

আপনারা তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন যে, কোন নির্ভরযোগ্য ও সত্যবাদী ইমাম, মুহাদ্দিছ, হাদীছের ভাষ্যকার অথবা আলেম  খায়রুল কুরূনের (স্বর্ণ) যুগ, হাদীছ সংকলনের যুগ এবং হাদীছ ব্যাখ্যাতাদের যুগে (১ম হিজরী শতক থেকে ৯ম হিজরী শতক পর্যন্ত) কি এ হাদীছ দ্বারা এই দলীল সাব্যস্ত করেছেন যে, জামা‘আতুল মুসলিমীন দ্বারা খেলাফত উদ্দেশ্য নয় এবং ‘তাদের ইমাম’ দ্বারা খলীফা উদ্দেশ্য নয়। বরং কাগুজে রেজিস্টার্ড জামা‘আত এবং তার কাগুজে অমনোনীত আমীর উদ্দেশ্য? যদি এর কোন প্রমাণ থাকে তবে যেন পেশ করে। অন্যথায় সাধারণ মুসলমানদেরকে যেন বিভ্রান্ত না করে। বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন : মুহতারাম আবূ জাবের আব্দুল্লাহ দামানভী হাফিযাহুল্লাহর গ্রন্থ ‘আল-ফিরক্বাতুল জাদীদাহ’।

আছহাবুল হাদীছ কারা?

আবূ ত্বাহের বারাকাত আল-হাউযী আল-ওয়াসিত্বী বলেছেন, আমি মালেক ও শাফেঈর শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে আবুল হাসান (আলী বিন মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ বিন আত-ত্বাইয়িব) আল-মাগাযিলী (মৃঃ ৪৮৩ হিঃ)-এর সাথে বিতর্ক করি। আমি শাফেঈ মাযহাবের অনুসারী হওয়ায় শাফেঈকে শ্রেষ্ঠ সাব্যস্ত করি। আর তিনি মালেকী মাযহাবের অনুসারী হওয়ায় মালেক (বিন আনাস)-কে শ্রেষ্ঠ আখ্যা দেন। অতঃপর আমরা দু’জন আবূ মুসলিম (ওমর বিন আলী বিন আহমাদ বিন লায়ছ) আল-লায়ছী আল-বুখারী (মৃঃ ৪৬৬ হিঃ বা ৪৬৮ হিঃ)-কে ফায়ছালাকারী তৃতীয় ব্যক্তি (বিচারক) নির্ধারণ করলে তিনি ইমাম শাফেঈকে শ্রেষ্ঠ আখ্যা দেন। এতে আবুল হাসান রেগে যান এবং বলেন, ‘সম্ভবতঃ আপনি তাঁর (ইমাম শাফেঈ) মাযহাবের উপরে আছেন’? জবাবে তিনি (ইমাম আবূ মুসলিম আল-লায়ছী আল-বুখারী) বললেন, نحن أصحاب الحديث، الناس على مذاهبنا فلسنا على مذهب أحد، ولوكنا ننتسب إلى مذهب أحد لقيل انتم تضعون له الأحاديث- ‘আমরা আছহাবুল হাদীছ। লোকেরা আমাদের মাযহাবের উপরে আছে। আমরা কারো মাযহাবের উপরে নেই। যদি আমরা কারো মাযহাবের দিকে সম্পর্কিত হ’তাম তাহলে বলা হ’ত, ‘তোমরা তার (মাযহাবের) জন্য হাদীছ জাল করো’।[10]

প্রতীয়মান হ’ল যে, আছহাবুল হাদীছ (আহলুল হাদীছ) কোন তাক্বলীদী মাযহাব যেমন- শাফেঈ ও মালেকী-এর মুক্বাল্লিদ ছিল না। বরং কুরআন ও হাদীছের উপরে আমলকারী ছিল। এই তাৎপর্যপূর্ণ উক্তির পরেও যদি কোন ব্যক্তি এ দাবী করে যে, আছহাবুল হাদীছ  (আহলেহাদীছগণ) শাফেঈ, মালেকী ও অন্যদের তাক্বলীদকারী ছিলেন, তবে এ ব্যক্তি যেন তার মস্তিষ্কের চিকিৎসা করিয়ে নেয়।

সতর্কীকরণ : ইমাম আবূ মুসলিম আল-লায়ছী ছিক্বাহ ছিলেন।[11]

সালাফে ছালেহীন ও তাক্বলীদ

আল্লাহ তা‘আলার ঘোষণা, ‘বলুন, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হ’তে পারে’? (যুমার ৩৯/৯)। এই আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, মানুষদের দু’টি (বড়) শ্রেণী রয়েছে।

১. আলেমগণ (মর্যাদাগত দিক থেকে আলেমদের কয়েক প্রকার রয়েছে। আর তাদের মধ্যে ইলম অন্বেষণকারীও শামিল রয়েছে)।

২. সাধারণ মানুষ (সাধারণ মানুষের কতিপয় শ্রেণী রয়েছে। আর তাদের মধ্যে নিরক্ষর মূর্খও শামিল রয়েছে)।

সাধারণ মানুষের জন্য এই বিধান যে, তারা আহলে যিকরদের (আলেম-ওলামাদের) জিজ্ঞাসা করবে (নাহল ১৬/৪৩)। এই জিজ্ঞাসাবাদ তাক্বলীদ নয়।[12] যদি জিজ্ঞাসা করা তাক্বলীদ হ’ত তাহলে ব্রেলভী ও দেওবন্দীদের সাধারণ জনতা বর্তমান ব্রেলভী ও দেওবন্দী আলেমদের মুক্বাল্লিদ হ’ত এবং নিজেদেরকে কখনো হানাফী, মাতুরীদী বা নকশবন্দী ইত্যাদি বলত না। কেউ সরফরাযী হ’ত, কেউ আমীনী, কেউ তাকাবী এবং কেউ হত ঘুম্মানী (?)। অথচ কেউই এর প্রবক্তা নন। সুতরাং সাধারণভাবে জিজ্ঞাসা করাকে তাক্বলীদ আখ্যা দেয়া ভুল ও বাতিল।

আলেমদের জন্য তাক্বলীদ জায়েয নয়। বরং সাধ্যানুযায়ী কিতাব ও সুন্নাত এবং কথা ও কর্মে ইজমার উপরে আমল করা যরূরী। যদি তিনটি দলীলের মধ্যে কোন মাসআলা না পাওয়া যায় তাহ’লে ইজতিহাদ (যেমন- ঐক্যমত পোষণকৃত ও অবিতর্কিত সালাফে ছালেহীনের আছার দ্বারা দলীল গ্রহণ করা এবং ক্বিয়াসে ছহীহ ইত্যাদি) জায়েয আছে। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (মৃঃ ৭৫১ হিঃ) বলেছেন, وَإِذَا كَانَ الْمُقَلِّدُ لَيْسَ مِنْ الْعُلَمَاءِ بِاتِّفَاقِ الْعُلَمَاءِ لَمْ يَدْخُلْ فِي شَيْءٍ مِنْ هَذِهِ النُّصُوصِ- ‘আর যখন আলেমদের ঐক্যমত অনুযায়ী (ইজমা) মুক্বাল্লিদ আলেম নয়, তখন সে এ দলীল সমূহের (আয়াত ও হাদীছ সমূহে বর্ণিত ফযীলত সমূহের) অন্তর্ভুক্ত নয়’।[13] এ উক্তির মর্ম দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, আলেম মুক্বাল্লিদ হন না।

হাফেয ইবনু আব্দিল বার্র আন্দালুসী (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ) বলেছেন,قَالُوْا : وَالْمُقَلِّدُ لَا عِلْمَ لَهُ وَلَمْ يَخْتَلِفُوا فِي ذَلِكَ  ‘তারা (আলেমগণ) বলেছেন, মুক্বাল্লিদের কোন ইলম নেই। আর এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই’।[14]

এই ইজমা দ্বারাও এটাই প্রমাণিত হ’ল যে, আলেম মুক্বাল্লিদ হন না। বরং হানাফীদের ‘আল-হিদায়া’ গ্রন্থের টীকায় লেখা আছে যে, يُحْتَمَلُ أَنْ يَكُونَ مُرَادُهُ بِالْجَاهِلِ الْمُقَلِّدَ؛ لِأَنَّهُ ذَكَرَهُ فِي مُقَابَلَةِ الْمُجْتَهِدِ ‘সম্ভবতঃ জাহিল দ্বারা তাঁর উদ্দেশ্য মুক্বাল্লিদ। কেননা তিনি তাকে মুজতাহিদের বিপরীতে উল্লেখ করেছেন’।[15]

এই ভূমিকার পর এই গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে ১০০ জন আলেমের উদ্ধৃতি পেশ করা হ’ল। যাদের ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত আছে যে, তারা তাক্বলীদ করতেন না।-

১. সাইয়েদুনা আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেছেন, لاتقلدوا دينكم الرجال ‘তোমরা তোমাদের দ্বীনের ক্ষেত্রে লোকদের তাক্বলীদ করবে না’।[16]

আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেছেন, اُغْدُ عَالِمًا أَوْ مُتَعَلِّمًا وَلَا تَغْدُ إِمَّعَةً بَيْنَ ذَلِكَ- ‘আলেম অথবা ছাত্র হও। এতদুভয়ের মাঝে (অর্থাৎ এছাড়া) মুক্বাল্লিদ হয়ো না’।[17] ‘ইম্মা‘আহ’র একটি অনুবাদ মুক্বাল্লিদও আছে।[18] বুঝা গেল যে, ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ)-এর নিকটে লোকদের তিনটি প্রকার রয়েছে। ক. আলেম খ. ছাত্র (طالب علم)  গ. মুক্বাল্লিদ।

তিনি মানুষদেরকে মুক্বাল্লিদ হ’তে নিষেধ করে দিয়েছেন এবং আলেম অথবা ছাত্র হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

২. মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) বলেছেন,وأما العالم فإن اهتدى فلا تقلدوه دينكم ‘আলেম হেদায়াতের উপরে থাকলেও তোমরা তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে তার তাক্বলীদ করবে না’।[19]

সতর্কীকরণ : ছাহাবায়ে কেরামের মধ্য থেকে কোন একজন ছাহাবী থেকেও তাক্বলীদের সুস্পষ্ট বৈধতা কথা বা কর্মে সাব্যস্ত নেই। বরং হাফেয ইবনু হাযম আন্দালুসী (মৃঃ ৪৫৬ হিঃ) বলেছেন, ‘প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল ছাহাবী এবং প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল তাবেঈর প্রমাণিত ইজমা রয়েছে যে, তাদের মধ্য থেকে বা তাদের পূর্বের কোন ব্যক্তির সকল কথা গ্রহণ করা নিষেধ এবং না জায়েয’।[20]

৩. ইমামু দারিল হিজরাহ (মদীনার ইমাম) মালিক বিন আনাস মাদানী (মৃঃ ১৭৯ হিঃ) অনেক বড় মুজতাহিদ ছিলেন। ত্বাহত্বাবী হানাফী ইমাম চতুষ্টয়ের ব্যাপারে (ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আহমাদ) বলেছেন, وهم غير مقلدين ‘তারা গায়ের মুক্বাল্লিদ’।[21]

মুহাম্মাদ হুসাইন ‘হানাফী’ নামক এক ব্যক্তি লিখেছেন, ‘প্রত্যেক মুজতাহিদ স্বীয় ধ্যান-ধারণার উপরে আমল করেন। এজন্য চার ইমামের সবাই গায়ের মুক্বাল্লিদ’।[22]

মাস্টার আমীন উকাড়বী বলেছেন, ‘মুজতাহিদের উপরে ইজতিহাদ ওয়াজিব। আর নিজের মতো (অন্য) মুজতাহিদের তাক্বলীদ করা হারাম’।[23]

সরফরায খান ছফদর গাখড়ুবী দেওবন্দী বলেছেন, ‘আর তাক্বলীদ জাহিলের জন্যেই। যে আহকাম ও দলীলসমূহ সম্পর্কে অনবগত অথবা পরস্পর বিরোধী দলীলসমূহের মাঝে সমন্বয় সাধন করার ও অগ্রাধিকার দেয়ার যোগ্যতা রাখে না...’।[24]

৪. ইমাম ইসমাঈল বিন ইয়াহ্ইয়া আল-মুযানী (মৃঃ ২৬৪ হিঃ) বলেছেন, ‘আমার এই ঘোষণা যে, ইমাম শাফেঈ নিজের এবং অন্যদের তাক্বলীদ করতে নিষেধ করেছেন। যাতে (প্রত্যেক ব্যক্তি) স্বীয় দ্বীনকে সামনে রাখে এবং নিজের জন্য সতর্কতা অবলম্বন করে’।[25] ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন, ولا تقلد وني ‘তোমরা আমার তাক্বলীদ করো না’।[26]

৫. আহলে সুন্নাতের প্রসিদ্ধ ইমাম ও মুজতাহিদ আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাম্বল (মৃঃ ২৪১ হিঃ) ইমাম আওযাঈ ও ইমাম মালেক সম্পর্কে স্বীয় ছাত্র ইমাম আবূদাঊদ সিজিস্তানী (রহঃ)-কে বলেছেন, لَا تُقَلِّدْ دِينَكَ أَحَدًا مِنْ هَؤُلَاءِ ‘তুমি তোমার দ্বীনের ব্যাপারে এদের কারো তাক্বলীদ করবে না’।[27]

ফায়েদা : ইমাম নববী বলেছেন, فَإِنَّ الْمُجْتَهِدَ لَا يُقَلِّدُ الْمُجْتَهِدَ  ‘কেননা নিশ্চয়ই একজন মুজতাহিদ অন্য মুজতাহিদের তাক্বলীদ করেন না’।[28]

ইবনুত তুরকুমানী (হানাফী) বলেছেন, فَإِنَّ الْمُجْتَهِدَ لَا يُقَلِّدُ الْمُجْتَهِدَ ‘কেননা নিঃসন্দেহে একজন মুজতাহিদ অন্য মুজতাহিদের তাক্বলীদ করেন না’।[29]

সতর্কীকরণ : কতিপয় ব্যক্তি (নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য) কতিপয় আলেমকে ত্বাবাক্বাতে মালেকিয়া, ত্বাবাক্বাতে শাফেঈয়া, ত্বাবাক্বাতে হানাবিলাহ ও ত্বাবাক্বাতে হানাফিয়াহতে উল্লেখ করেছেন। যা উল্লিখিত আলেমদের মুক্বাল্লিদ হওয়ার দলীল নয়। যেমন-

ক. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলকে সুবকীর ত্বাবাক্বাতে শাফেঈয়াতে (১/১৯৯; অন্য সংস্করণ, ১/২৬৭) উল্লেখ করা হয়েছে।

খ. ইমাম শাফেঈকে ত্বাবাক্বাতে মালেকিয়াহতে (আদ-দীবাজুল মুযাহহাব, পৃঃ ৩২৬, ক্রমিক নং ৪৩৭) ও ত্বাবাক্বাতে হানাবিলাহতে (১/২৮০) উল্লেখ করা হয়েছে।

ইমাম আহমাদ কি ইমাম শাফেঈর এবং ইমাম শাফেঈ কি ইমাম মালেক ও ইমাম আহমাদের মুক্বাল্লিদ ছিলেন?

প্রতীয়মান হ’ল যে, উল্লিখিত ত্বাবাক্বাতে কোন আলেমের উল্লেখ থাকা তার মুক্বাল্লিদ হওয়ার দলীল নয়।[30]

৬. ইমাম আবূ হানীফা নু‘মান বিন ছাবিত কূফী কাবুলী (রহঃ) সম্পর্কে ত্বাহত্বাবী হানাফীর বক্তব্য গত হয়েছে যে, তিনি গায়ের মুক্বাল্লিদ ছিলেন (৩নং উক্তি দ্রঃ)। আশরাফ আলী থানবী দেওবন্দী বলেছেন, ‘কেননা ইমামে আ‘যম আবূ হানীফার গায়ের মুক্বাল্লিদ হওয়া সুনিশ্চিত’।[31]

ইমাম আবূ হানীফা স্বীয় শিষ্য ক্বাযী আবূ ইউসুফকে বলেন, ‘আমার সকল কথা লিখবে না। আমার আজ এক রায় হয় এবং কাল বদলে যায়। কাল অন্য রায় হয় তো পরশু সেটাও পরিবর্তন হয়ে যায়’।[32]

ফায়েদা : শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ ও হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (উভয়ের উপর আল্লাহ রহম করুন) দু’জনেই বলেছেন যে, ইমাম আবূ হানীফা তাক্বলীদ থেকে নিষেধ করেছেন।[33]

নিজেদেরকে হানাফী ধারণাকারীদের নিম্নোক্ত গ্রন্থসমূহেও লিখিত আছে যে, ইমাম আবূ হানীফা তাক্বলীদ থেকে নিষেধ করেছেন।

(১) মুক্বাদ্দামা উমদাতুর রি‘আয়াহ ফী হাল্লি শারহিল বেক্বায়া, পৃঃ ৯ (২) কাওছারী, লামাহাতুন নাযর ফী সীরাতিল ইমাম যুফার, পৃঃ ২১ (৩) হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৫৭।

৭. শায়খুল ইসলাম আবূ আব্দুর রহমান বাক্বী বিন মাখলাদ বিন ইয়াযীদ কুরতুবী (মৃঃ ২৭৬ হিঃ) সম্পর্কে ইমাম আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনুল ফুতূহ বিন আব্দুল্লাহ আল- হুমায়দী আল-আযদী আল-আন্দালুসী আল-আছারী আয-যাহেরী (মৃঃ ৪৮৮ হিঃ) স্বীয় শিক্ষক আবূ মুহাম্মাদ আলী বিন আহমাদ ওরফে ইবনু হাযম থেকে বর্ণনা করেছেন, وكان متخيرا لا يقلد أحدا ‘তিনি (কুরআন, সুন্নাহ ও প্রাধান্যযোগ্য মতকে) বেছে নিতেন। কারো তাক্বলীদ করতেন না’।[34] হাফেয ইবনু হাযমের বক্তব্য ইবনে বাশকুওয়ালের কিতাবুছ ছিলাহ-তেও (১/১০৮, জীবনী ক্রমিক নং ২৮৪) উল্লেখ আছে।

হাফেয যাহাবী বাক্বী বিন মাখলাদ সম্পর্কে বলেছেন, وكان مجتهدا لايقلد أحدا بل يفتي بالأثر ‘তিনি মুজতাহিদ ছিলেন। তিনি কারো তাক্বলীদ করতেন না। বরং আছার (হাদীছ ও আছার) দ্বারা ফৎওয়া দিতেন’।[35]

ফায়েদা : হাফেয আবূ সা‘দ আব্দুল করীম বিন মুহাম্মাদ বিন মানছূর আত-তামীমী আস-সাম‘আনী (মৃঃ ৫৬২ হিঃ) বলেছেন, الأثري... هذه النسبة الى الأثر يعنى الحديث وطلبه واتباعه-  ‘আল-আছারী... এই সম্বন্ধটি আছারের প্রতি অর্থাৎ হাদীছ, হাদীছ অনুসন্ধান এবং তার অনুসরণের দিকে সম্বন্ধ’।[36]

হাফেয সাম‘আনী বলেছেন,الظاهري... هذه النسبة إلى أصحاب الظاهر، وهم جماعة  ينتحلون مذهب داود بن على الأصبهاني صاحب الظاهر، فإنهم يجرون النصوص على ظاهرها، وفيهم كثرة- ‘আয-যাহেরী... এ সম্বন্ধটি যাহেরীদের প্রতি। আর তারা ঐ জামা‘আত, যারা দাঊদ বিন আলী ইস্পাহানী যাহেরীর মাযহাবকে গ্রহণ করে। এরা নছকে (কুরআন ও হাদীছের দলীল সমূহকে) তার বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করে। আর এরা (সংখ্যায়) অনেক’।[37]

হাফেয সাম‘আনী (রহঃ) বলেছেন, اَلسَّلَفى... هذه النسبة إلى السلف وانتحال مذهبهم على ما سمعت-   ‘আস-সালাফী.... এই সম্বন্ধটি সালাফ এবং তাদের মাযহাব গ্রহণ করার প্রতি। যেমনটি আমি শ্রবণ করেছি’।[38]

এর দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুসলমানদের অসংখ্য গুণবাচক নাম ও উপাধি রয়েছে। এজন্য সালাফী, যাহেরী, আছারী, আহলেহাদীছ এবং আহলে সুন্নাত দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল ঐ সকল ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুসলমান, যারা কুরআন, হাদীছ ও ইজমার অনুসরণ করে এবং কোন মানুষের তাক্বলীদ করে না। আল-হামদুল্লিাহ।

৮. ইমাম আবূ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহাব বিন মুসলিম আল-ফিহরী আল-মিসরী (মৃঃ ১৯৭ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন, وكان ثقة حجة حافظا مجتهدا لا يقلد أحدا، ذا تعبد وزهد- ‘তিনি (হাদীছ বর্ণনায়) ছিক্বাহ বা নির্ভরযোগ্য, হুজ্জাত[39], হাফেয ও মুজতাহিদ ছিলেন। তিনি কারো তাক্বলীদ করতেন না। তিনি ইবাদতগুযার ও দুনিয়া বিমুখ ছিলেন’।[40]

৯. মছূলের বিচারক আবূ আলী আল-হাসান বিন মূসা আল-আশয়াব আল-বাগদাদী (মৃঃ ২০৯ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন,  وَكَانَ مِنْ أَوْعِيَةِ العِلْمِ لاَ يُقَلِّدُ أَحَداً‘তিনি ইলমের অন্যতম ভান্ডার ছিলেন। তিনি কারো তাক্বলীদ করতেন না’।[41]

১০. আবূ মুহাম্মাদ আল-ক্বাসেম বিন মুহাম্মাদ বিন ক্বাসেম বিন মুহাম্মাদ বিন ইয়াসার আল-বায়ানী আল-কুরতুবী আল-আন্দালুসী (মৃঃ ২৭৬ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন,

ولازم ابن عبد الحكم حتى برع في الفقه وصار إماما مجتهدا لا يقلد أحدا وهو مصنف كتاب الإيضاح في الرد على

المقلدين، ‘তিনি (মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ) ইবনে আব্দুল হাকাম (বিন আ‘য়ান বিন লায়ছ আল-মিসরী)-এর সাহচর্য লাভ করেছিলেন। এমনকি তিনি ফিক্বহে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন এবং ইমাম ও মুজতাহিদ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কারো তাক্বলীদ করতেন না। তিনি আল-ঈযাহ ফির রাদ্দি আলাল মুক্বাল্লিদীন গ্রন্থের রচয়িতা’।[42]

মুক্বাল্লিদদের প্রত্যুত্তরে তাঁর উক্ত গ্রন্থের নাম নিম্নোক্ত আলেমগণও উল্লেখ করেছেন-

ক. আল-হুমায়দী আল-আন্দালুসী আয-যাহেরী।[43]

খ. আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন আলী বিন আব্দুল কাফী আস-সুবকী।[44]

গ. ছালাহুদ্দীন খলীল বিন আয়বাক আছ-ছাফাদী।[45]

ঘ. জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী।[46]

সতর্কীকরণ : আমাদের জানা মতে হাদীছ সংকলনের যুগ (৫ম শতাব্দী হিঃ) বরং ৮ম শতাব্দী হিজরী পর্যন্ত কোন নির্ভরযোগ্য, সত্যবাদী ও ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন আলেম কিতাবুদ দিফা‘ আনিল মুক্বাল্লিদীন, কিতাবু জাওয়াযিত তাক্বলীদ, কিতাবু উজূবিত তাক্বলীদ বা এ মর্মের কোন গ্রন্থ রচনা করেননি। যদি কারো এই গবেষণা সম্পর্কে ভিন্নমত থাকে, তবে শুধুমাত্র একটি সুস্পষ্ট উদ্ধৃতি পেশ করুন। কোন জবাবদাতা আছে কি?


[1]ছহীহ বুখারী, হা/৭০৮৪, ৩/৭৭৯; ছহীহ মুসলিম, ৫/১৩৭, হা/১৮৪৭ ‘নেতৃত্ব’ অধ্যায়, ‘ফিতনা আবির্ভাবের সময় এবং সর্বাবস্থায় জামা‘আতুল মুসলিমীনকে অাঁকড়ে ধরা ওয়াজিব’ অনুচ্ছেদ।

[2]আবূদাউদ, হা/৪২৪৭, সনদ হাসান; মুসনাদে আবী ‘আওয়ানাহ, ৪/৪২০, হা/৭১৬৮।

[3]. দেখুন : সুনানে আবূদাঊদ, হা/৪২৪৪; হাকেম (৪/৪৩২-৪৩৩) একে ছহীহ বলেছেন এবং যাহাবী তাঁর সাথে ঐক্যমত পোষণ করেছেন।

[4]ফাৎহুল বারী, ১৩/৩৬।

[5]ফাৎহুল বারী, ১৩/৩৬।

[6]ইবনু বাত্ত্বাল, শরহে ছহীহ বুখারী, ১০/৩৩।

[7]ফাৎহুল বারী, ১৩/৩৬।

[8]ছহীহ ইবনে হিববান, ১০/৪৩৪, হা/৪৫৭৩, হাদীছ হাসান।

[9]. সুওয়ালাতু ইবনে হানী, পৃঃ ১৮৫, অনুচ্ছেদ ২০১১; তাহকীকী মাকালাত ১/৪০৩।  

[10]সুওয়ালাতুল হাফেয আস-সালাফী লিখুমাইয়েস আল-হাউযী, পৃঃ ১১৮, ক্রমিক  নং ১১৩।

[11]দেখুন : আমার গ্রন্থ ‘আল-ফাতহুল মুবীন ফী তাহক্বীক্বি ত্বাবাক্বাতিল মুদাল্লিসীন’, পৃঃ ৫৮; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১৮/৪০৮।

[12]. দেখুন : ইবনুল হাজিব নাহবী, মুনতাহাল উছূল, পৃঃ ২১৮-২১৯ এবং আমার গ্রন্থ : ‘দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা’, পৃঃ ১৬

[13]. ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ২/২০০

[14]. জামেউ‘ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ২/২৩১, ‘তাক্বলীদের ফিতনা’ অনুচ্ছেদ

[15]. হেদায়া আখীরায়েন, পৃঃ ১৩২, টীকা-৬, ‘বিচারকের বৈশিষ্ট্য’ অধ্যায়

[16]. বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা, ২/১০, সনদ ছহীছ; আরো দেখুন : দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৫

[17]. জামেউ‘ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ১/৭১-৭২, হা/১০৮, সনদ হাসান

[18]. দেখুন : তাজুল আরূস, ১১/৪; আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব, পৃঃ ২৬; আল-ক্বামূসুল ওয়াহীদ, পৃঃ ১৩৪

[19]. জামেউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ২/২২২, হা/৯৫৫, সনদ হাসান; উপরন্তু দেখুন : দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৫-৩৭।

[20]. ইবনু হাযম, আন-নুবযাতুল কাফিয়াহ, পৃঃ ৭১; সুয়ূত্বী, আর-রাদ্দু আলা মান উখলিদা ইলাল আরয, পৃঃ ১৩১-১৩২; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৪-৩৫

[21]. হাশিয়াতুত ত্বাহত্বাবী আলাদ দুর্রিল মুখতার, ১/৫১

[22]. মুঈনুল ফিক্বহ, পৃঃ ৮৮

[23]. তাজাল্লিয়াতে ছফদর, ৩/৪৩০

[24]. আল-কালামুল মুফীদ ফী ইছবাতিত তাক্বলীদ, পৃঃ ২৩৪

[25]. মুখতাছারুল মুযানী, পৃঃ ১; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৮

[26]. ইবনু আবী হাতেম, আদাবুশ শাফেঈ ওয়া মানাক্বিবুহু, পৃঃ ৫১, সনদ হাসান; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৮

[27]. মাসাইলু আবুদাঊদ, পৃঃ ২৭৭

[28]. শরহ ছহীহ মুসলিম, ১/২১০, হা/২১-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ

[29]. বায়হাক্বী, আল-জাওহারুন নাক্বী আলাস-সুনানিল কুবরা ৬/২১০

[30]. দেখুন : আবূ মুহাম্মাদ বদীউদ্দীন রাশেদী সিন্ধী, তানক্বীদে সাদীদ বর রিসালায়ে ইজতিহাদ ওয়া তাক্বলীদ, পৃঃ ৩৩-৩৭

[31]. মাজালিসে হাকীমুল উম্মাত, পৃঃ ৩৪৫; মালফূযাতে হাকীমুল উম্মাত, ২৪/৩৩২

[32]. তারীখু ইয়াহ্ইয়া বিন মাঈন, দূরীর বর্ণনা, ২/৬০৭, ক্রমিক নং ২৪৬১; সনদ ছহীহ; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৮-৩৯

[33]. দেখুন : ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ২০/১০, ২১১; ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ২/২০০, ২০৭, ২১১, ২২৮; সুয়ূত্বী, আর-রাদ্দু আলা মান উখলিদা ইলাল আরয, পৃঃ ১৩২

[34]. জুযওয়াতুল মুক্বতাবাস ফী যিকরি উলাতিল আন্দালুস, পৃঃ ১৬৮; ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশক্ব, ১০/২৭৯।

[35]. তারীখুল ইসলাম, ২০/৩১৩, ২৭৬ হিজরীতে মৃত্যুবরণকারীরা

[36]. আল-আনসাব, ১/৮৪।

[37]. ঐ, ৪/৯৯

[38]. ঐ, ৩/২৭৩

[39]. যিনি তিন লাখ হাদীছের ইলম সনদ ও মতনসহ মুখস্থ রাখেন তাকে হুজ্জাত বলা হয়। দ্রঃ ড. সুহায়েল হাসান, মু‘জামু ইছতিলাহাতে হাদীছ, পৃঃ ১৬৩।-অনুবাদক।

[40]. তাযকিরাতুল হুফফায, ১/৩০৫, জীবনী ক্রমিক নং ২৮৩

[41]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৬/৫৬০

[42]. তাযকিরাতুল হুফফায, ২/৬৪৮, জীবনী ক্রমিক নং ৬৭১

[43]. জুযওয়াতুল মুক্বতাবাস, ১/১১৮

[44]. ত্বাবাক্বাতুশ শাফেঈয়া আল-কুবরা, ১/৫৩০

[45]. আল-ওয়াফী বিল ওফায়াত, ২৪/১১৬

[46]. ত্বাবাক্বাতুল হুফফায, পৃঃ ২৮৮, জীবনী ক্রমিক নং ৬৪৭





কবিগুরুর অর্থকষ্টে জর্জরিত দিনগুলো - ড. গুলশান আরা
ব্রেলভীদের কতিপয় আক্বীদা-বিশ্বাস - মুহাম্মাদ নূর আব্দুল্লাহ হাবীব
পারিবারিক অপরাধ : কারণ ও প্রতিকার (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন
ইখলাছ (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
যাকাত ও ছাদাক্বা - আত-তাহরীক ডেস্ক
বিদ‘আত ও তার পরিণতি - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
বিদ‘আত ও তার পরিণতি (৬ষ্ঠ কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
আমাদের পরিচয় কি শুধুই মুসলিম? - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
মুহাররম ও আশূরা : করণীয় ও বর্জনীয় - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
ইখলাছ মুক্তির পাথেয় (৩য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
পাপাচার থেকে পরিত্রাণের উপায় সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার কতিপয় ক্ষেত্র - ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
আরও
আরও
.