মুখলিছদের আলামত

যারা ইখলাছ অবলম্বন করেন, তাদের বলা হয় মুখলিছ। তাদের কিছু গুণাবলী রয়েছে, যা দেখে বুঝা যাবে যে তারা ইখলাছের গুণে সমৃদ্ধ। এ সকল গুণাবলীর মধ্যে প্রধান প্রধান কয়েকটি নিম্নে আলোচনা করা হ’ল :

আল্লাহর সন্তুষ্টিই তাদের একান্ত কাম্য :

ইখলাছের উঁচু স্থানে অবস্থান করেন যারা, তাদের অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে যাবতীয় কাজ-কর্মে তারা একমাত্র আল্লাহ্কেই উদ্দেশ্য করেন; খ্যাতি, প্রশংসা, কিংবা নশবর পার্থিব সম্পদের কিছুই তাদের উদ্দেশ্য নয়। তাদের এ অবস্থার কথা বহু আয়াত ও হাদীছে এসেছে।

আল্লাহ তাঁর প্রতি সমর্পিত বান্দাদের কথা উল্লেখ করে বলেন, وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيْدُوْنَ وَجْهَهُ- ‘তুমি নিজেকে ধৈর্য সহকারে রাখবে তাদের সংসর্গে, যারা সকাল ও সন্ধ্যায় ডাকে তাদের প্রতিপালকে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে’ (কাহফ ১৮/২৮)। অর্থাৎ তারা তাদের দো‘আ ও ইবাদতের মাধ্যমে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি চায়, পার্থিব কোন স্বার্থ চায় না।

আবু মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে এসে বলল, জনৈক ব্যক্তি জিহাদ করছে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ পাওয়ার জন্য, আরেক ব্যক্তি জিহাদ করছে লোকেরা তাকে স্মরণ করবে এজন্য, অন্য এক ব্যক্তি জিহাদ করছে তার মর্যাদা বেড়ে যাবে সেজন্য। এর মধ্যে কে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর বাণীকে সর্বশীর্ষে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে লড়াই করছে সে-ই আল্লাহর পথ জিহাদ করছে’।[1]

মুখলিছ ব্যক্তি তার সকল কাজের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে আল্লাহর দ্বীনকে সর্বশীর্ষে প্রতিষ্ঠিত করা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।

তারা গোপনে কাজ করা পসন্দ করে :

মুখলিছ বান্দারা নিজেদের সৎকর্মগুলো গোপনে সম্পাদন করতে ভালবাসেন। অনুরূপভাবে তারা অন্যের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখতে পসনদ করেন। আল্লাহ তা‘আলাও এ ধরনের লোকদের পসন্দ করেন। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ রাববুল আলামীন ভালবাসেন এমন বান্দাকে যে মুত্তাকী ও ধনী এবং দানশীলতায় গোপনীয়তা রক্ষাকারী’।[2]

আমাদের পূর্ববর্তী ছাহাবা ও ইমামগণ শুধু কথা বলে যাননি। তারা নিজেদের ভাল কাজগুলো গোপন রাখার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যেমন ওমর (রাঃ) মদীনার পল্লীর এক অন্ধ অসহায় বৃদ্ধা মহিলার সেবা করতেন প্রতি রাতে এসে। তার জন্য পানি বহন করতেন, খাদ্য তৈরী করে দিতেন, কাপড়-চোপড় পরিস্কার করতেন। একদিন তিনি দেখলেন তার আসার পূর্বে কেউ এসে তার কাজগুলো করে দিয়ে গেছে। পরের দিন তিনি আরো আগে আসলেন যাতে অন্য কেউ তার কাজ করার সুযোগ না নেয়। তিনি এসে দেখলেন, আবু বকর (রাঃ) বৃদ্ধার কাজগুলো গুছিয়ে দিচ্ছেন। আবু বকর (রাঃ) তখন ছিলেন খলীফার দায়িত্বে। ওমর (রাঃ) তাকে দেখে বললেন, হে তুমি! আমার জীবন তোমার জন্য কুরবান হোক (আস-সুয়ূতী, তারীখুল-খুলাফা)

অবশ্য গোপনে আমল করার বিষয়টি নফল আমলের বেলায় প্রযোজ্য; ফরয বা ওয়াজিবের বেলায় নয়। ফরয ও ওয়াজিব প্রকাশ্যে আদায় করতে হয়।

তাদের ভিতরের দিকটা বাহ্যিক দিকের চেয়ে ভাল থাকে :

মুখলিছ এমন নন যে, মানুষ যা দেখে, এমন কাজগুলো খুব ভাল করে আদায় করেন আর যা মানুষ দেখে না শুধু আল্লাহ দেখেন, সে সকল বিষয় যেনতেন ভাবে আদায় করেন। তিনি যে কোন কাজ একাগ্রতার সাথে সম্পন্ন করবেন। অর্থাৎ সকল কাজে সর্বদা এ ভাবনা থাকা যে, আমি যা করছি আল্লাহ তা অবশ্যই দেখছেন।

যেমন আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন,

وَالَّذِيْنَ يَبِيْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّداً وَقِيَاماً-

‘এবং তারা রাত অতিবাহিত করে তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে থেকে’ (ফুরক্বান ২৫/৬৪)

যারা প্রকাশ্যে ভাল কাজ করে আর গোপনে পাপে জড়িয়ে পড়ে তারা কখনো মুখলিছ হ’তে পারে না। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে অনেকের কথা আমি জানি, যারা ক্বিয়ামতের দিন তিহামা অঞ্চলের সাদা পর্বতমালা পরিমাণ সৎকর্ম নিয়ে উপস্থিত হবে, কিন্তু আল্লাহ তাদের সৎকর্মগুলো বিক্ষিপ্ত ধুলিকণায় পরিণত করে দিবেন। একথা শুনে ছাওবান (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তাদের পরিচয় দিন, আমরা যেন নিজেদের অজান্তে তাদের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে যাই। তিনি বললেন, তারা তোমাদেরই ভাই, তোমাদের সাথেই থাকে। তোমরা যেমন রাত জেগে ইবাদত কর, তারাও করে। কিন্তু যখন একাকী হয় তখন আল্লাহর সীমালংঘন করে (পাপে লিপ্ত হয়)[3]

তারা তাদের সৎকর্ম প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় করে :

মুখলিছ ব্যক্তি যত বেশী ইবাদত-বন্দেগী ও নেক আমল করুক না কেন তারা সর্বদা এ ভয় রাখে যে, কর্মগুলো আল্লাহ কবুল করবেন, না কি প্রত্যাখ্যান করবেন, তা একমাত্র আল্লাহই অবগত। তাদের এ গুণের কথা আল-কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে-

وَالَّذِيْنَ يُؤْتُوْنَ مَا آتَوا وَّقُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلَى رَبِّهِمْ رَاجِعُوْنَ-

‘যারা তাদের যা দান করার তা দান করে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে যে, তারা তাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরে যাবে’ (মুমিনূন ২৩/৬০)

আয়েশা (রাঃ) এ আয়াতের অর্থ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন যে, ‘আল্লাহ এ কথা কাদের জন্য বলেছেন, যারা মদ্যপান করে, চুরি করে তাদের জন্য? উত্তরে তিনি বললেন, না, হে সত্যবাদীর কন্যা (আয়েশা)! তারা হ’ল, যারা ছিয়াম পালন করে, ছালাত আদায় করে, দান-ছাদাক্বা করে; সাথে সাথে এ ভয় রাখে যে, হয়ত আমার এ আমলগুলো আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তারাই দ্রুত সম্পাদন করে কল্যাণকর কাজ এবং তারা তাতে অগ্রগামী’।[4]

তারা মানুষের প্রশংসার অপেক্ষা করে না :

যখন তারা কোন সৃষ্টজীবের কল্যাণের জন্য কাজ করে বা কোন মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য নিয়োজিত হয়, তাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করতে নেমে পড়ে, তখন তারা কারো কাছ থেকে নিজের পারিশ্রমিক আশা করে না। কারো প্রশংসা কামনা করে না। শুধু কামনা করে আল্লাহ রাববুল আলামীনের সন্তুষ্টি। রাসূলগণ এ বক্তব্যের সমর্থন করেছেন। আল্লাহর বাণী,

وَمَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلاَّ عَلَى رَبِّ الْعَالَمِيْنَ-

‘আমি তোমাদের নিকট এর জন্য কোন প্রতিদান চাই না; আমার পুরস্কার তো জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট আছে’ (শু‘আরা ২৬/১০৯)

এজন্য যারা তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে, তাঁরা তাদেরকে কিছু বলতেন না। যারা তাদের বাধা দিত, তাঁরা তাদের সাথে বৈরিতা পোষণ করতেন না। এমনকি মানুষ তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুক-তাও তাঁরা কামনা করতেন না।

যেমন আল্লাহ বলেন,

إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لاَ نُرِيْدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلاَ شُكُوْرًا-

‘এবং তারা বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদের আহার্য দান করি, তোমাদের নিকট এর বিনিময়ে কোন প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও কামনা করি না’ (দাহর ৭৬/৯)। অর্থাৎ আমরা যে দান করলাম তার বিনিময়ে তোমাদের থেকে কোন প্রতিদান বা প্রশংসা অথবা কৃতজ্ঞতা পাওয়ার আশা করি না। আমাদের উদ্দেশ্য হ’ল কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ।

আসলে যাদের সম্পর্কে এ কথা বলা হয়েছে, তারা কিন্তু মুখে এ কথা বলেনি। এটা ছিল তাদের অন্তরের লুক্কায়িত কথা। কিন্তু আল্লাহ রাববুল আলামীন জানেন ও জানিয়েছেন। এটা তাদের ইখলাছের বরকত। আল্লাহ তা‘আলা জানিয়েছেন অন্যদেরকে এ আদর্শে অনুপ্রাণিত করার জন্য (তাফসীর ইবনে কাছীর)

মুখলিছ ব্যক্তি নিজের জন্য পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা কামনা করে না :

অনেক মানুষ আছেন, যারা ভাল কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। ইখলাছ অবলম্বন ও দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে আদায় করেই কাজ করেন। কিন্তু যদি তার পদমর্যাদা কমিয়ে দেয়া হয় বা সুযোগ-সুবিধায় ঘাটতি হয়, তবে তিনি অস্থির হয়ে যান। আসলে যিনি সত্যিকার মুখলিছ তার এমন হওয়ার কথা নয়। ছাহাবায়ে কেরামের ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই যে, আবু বকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ)-এর মত শীর্ষস্থানীয় ছাহাবাদের যখন ওসামা ইবনে যায়েদের অধীনস্থ করা হ’ল তখন তাদের মধ্যে সামান্য প্রতিক্রিয়াও দেখা যায়নি। এমনিভাবে যখন খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ)-কে সেনাপতির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হ’ল তখন তিনি পূর্বের ন্যায় সাধারণ সৈনিক হয়ে থাকলেন। মুখলিছ ব্যক্তি যখন আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিদান আশা করেন তখন এ সকল বিষয় নিয়ে মন খারাপ করেন না।

যদি এমন হয় যে, সুযোগ-সুবিধা ভাল পেলে সব কিছু ঠিকঠাক থাকে আর একটু অন্যরকম হ’লে সব গড়বড় হয়ে যায়, তাহ’লে সে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে এটা কিভাবে দাবী করা যায়? বরং সে নিজের প্রবৃত্তিকে সন্তুষ্ট করার জন্য কাজ করে।

এ বিষয়টি একটি হাদীছে দু’ব্যক্তির চরিত্রের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে এভাবে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, টাকা-পয়সার দাস ধ্বংস হোক, রেশম কাপড়ের দাস ধ্বংস হোক, ধ্বংস হোক পোশাকের দাস। এদের অবস্থা এমন যে, প্রদান করা হ’লে খুশী হয় আর না দিলে অসন্তুষ্ট হয়। ধ্বংস হোক! অবনত হোক! কাঁটা বিঁধলে তা যেন উঠাতে না পারে। তবে সৌভাগ্যবান আল্লাহর ঐ বান্দা, যে আল্লাহর পথে ঘোড়ার লাগাম ধরেছে, মাথার চুল এলোমেলো করেছে ও পদদ্বয় ধুলায় ধূসরিত করেছে। যদি তাকে পাহারার দায়িত্ব দেয়া হয় তবে সে পাহারার দায়িত্ব পালন করে। যদি তাকে বাহিনীর পিছনে দায়িত্ব দেয়া হয় তবে তা পালন করে। যদি সে নেতার সাথে সাক্ষাৎ করার অনুমতি চায় তবে তাকে অনুমতি দেয়া হয় না। যদি সে কারো জন্য সুপারিশ করে তবে তার সপারিশ গ্রহণ করা হয় না।[5]

ইখলাছ অর্জনের পদ্ধতি?

ইখলাছ অর্জনের কিছু পদ্ধতি আছে, যার প্রধান কয়েকটি নিম্নে আলোচনা করা হ’ল :

যথাযথভাবে আল্লাহর পরিচয় :

আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, তিনি মহান, তিনি ধনী, কারো মুখাপেক্ষী নন, সর্ববিষয় তার ক্ষমতাধীন, তিনি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান। মানুষ যা কিছু খিয়ানত করে, যা কল্পনা করে, সবই তাঁর জানা। তাঁর হাতেই সকল ধরনের লাভ ও ক্ষতি; কল্যাণ ও অকল্যাণ। তাঁর কোন কাজেই কোন অংশীদার নেই। তিনি যা ইচ্ছা করেন তা-ই হয়, যা ইচ্ছা করেন না, তা কোনভাবেই হবার নয়-এ ভাবনাগুলো সর্বদা তাজা ও সজীব রাখা।

সাথে সাথে নিজের প্রতি আল্লাহর নে‘মত, অনুগ্রহ ও ইহসানের প্রতি খেয়াল রাখা। তার এ সকল নে‘মতের পরিবর্তে আমি তার জন্য কিছু করতে পেরেছি কি? যদি কিছু করি তা কি বিশুদ্ধভাবে করছি যা আল্লাহর কাছে কবুলের শতভাগ সম্ভাবনা আছে? আল্লাহর অধিকার অনেক বড় ও ব্যাপক। তাঁর হক বা অধিকার আমরা কতটুকু আদায় করতে পারি? এ ধরনের ভাবনা মানুষকে আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ বা মুখলিছ হ’তে সাহায্য করে।

ইখলাছের ছওয়াব ও পুরস্কার স্মরণ করা :

ইখলাছের তাৎপর্য ও তার প্রতিদানের কথা স্মরণ করা। মনে রাখা, ইখলাছ হ’ল আমল কবুলের শর্ত। জান্নাতে প্রবেশের একমাত্র রাস্তা। আর শয়তানের কুমন্ত্রণা ও ধোঁকা থেকে বাঁচার একটা মজবুত কেল্লা। যেমন আল্লাহ বলেছেন,

قَالَ رَبِّ بِمَا أَغْوَيْتَنِيْ لأُزَيِّنَنَّ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَلَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِيْنَ- إِلاَّ عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِيْنَ-

‘শয়তান বলল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি যে আমাকে বিপথগামী করলেন সেজন্য আমি পৃথিবীতে মানুষের নিকট পাপকর্মকে অবশ্যই শোভন করে দেব এবং আমি তাদের সকলকে বিপথগামী করব। তবে তাদের নয়, যারা আপনার ইখলাছ অবলম্বনকারী (একনিষ্ঠ) বান্দা’ (হিজর ১৫/৩৯-৪০)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

إِنَّكُمْ لَذَائِقُو الْعَذَابِ الْأَلِيْمِ- وَمَا تُجْزَوْنَ إِلاَّ مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ- إِلاَّ عِبَادَ اللَّهِ الْمُخْلَصِيْنَ- فَوَاكِهُ وَهُمْ مُّكْرَمُوْنَ- فِيْ جَنَّاتِ النَّعِيْمِ- عَلَى سُرُرٍ مُّتَقَابِلِيْنَ-

‘তোমরা অবশ্যই মর্মন্তুদ শাস্তি আস্বাদন করবে এবং তোমরা যা করতে তারই প্রতিফল পাবে। তবে তারা নয় যারা আল্লাহর একনিষ্ঠ (মুখলিছ) বান্দা। তাদের জন্য আছে নির্ধারিত রিযক-ফলমূল; আর তারা হবে সম্মানিত, সুখদ-কাননে তারা মুখোমুখি হয়ে আসীন হবে’ (ছফফাত ৩৭/৩৮-৪৪)

যে ব্যক্তি কোন নেক আমলের দ্বারা শুধু পার্থিব স্বার্থ অর্জন করার নিয়ত করবে তাকে পার্থিব সে স্বার্থ দেয়া হবে পূর্ণভাবে। কিন্তু আখেরাতে থাকবে তার জন্য শাস্তি। কারণ তার নিয়ত ও পুরো চিন্তা-ভাবনা ছিল দুনিয়াকে ঘিরে। আল্লাহ তো তাঁর বান্দাদের অন্তরের নিয়ত অনুযায়ী প্রতিদান দিবেন। যেমন আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন,

مَنْ كَانَ يُرِيْدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِيْنَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيْهَا وَهُمْ فِيْهَا لاَ يُبْخَسُوْنَ- أُوْلَـئِكَ الَّذِيْنَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ إِلاَّ النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُواْ فِيْهَا وَبَاطِلٌ مَّا كَانُواْ يَعْمَلُوْنَ-

‘যে পার্থিব জীবন ও তার শোভা কামনা করে, দুনিয়াতে আমি তাদের কর্মের পূর্ণ ফল দান করি এবং সেথায় তাদেরকে কম দেয়া হবে না। তাদের জন্য আখেরাতে আগুন ব্যতীত অন্য কিছুই নেই। আর তারা যা করে আখেরাতে তা নিষ্ফল হবে এবং তারা যা করে থাকে তা নিরর্থক’ (হূদ ১১/১৫-১৬)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে মানুষকে শোনানোর জন্য কাজ করল আল্লাহ তা মানুষকে শুনিয়ে দেবেন। আর যে মানুষকে দেখানোর জন্য কাজ করল আল্লাহ তা মানুষকে দেখিয়ে দেবেন’।[6]

আত্মজিজ্ঞাসা ও অধ্যবসায় :

যে কোন কাজ শুরু করার পূর্বে নিজেকে জিজ্ঞেস করবে যে, এ কাজ দ্বারা তোমার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী? উত্তর যদি আপনার কাছে সঠিক ও শুদ্ধ মনে হয়, তবে কাজ শুরু করে দিন। আর যদি লক্ষ্য করেন, উত্তর সঠিক হচ্ছে না তাহ’লে নিয়ত ঠিক করে নিন আপনার কাজটি শুরু করার পূর্বে।

সালমান (রাঃ) বলেন, প্রত্যেক কাজের শুরুতে তোমার প্রতিপালককে স্মরণ করবে, যখন তুমি সংকল্প কর এবং প্রত্যেক বিচারে তাকে স্মরণ করবে, যখন তুমি রায় দেবে। এর অর্থ এই নয় যে, নিয়ত খারাপ দেখলে কাজটি পরিত্যাগ করবে; বরং নিয়তকে বিশুদ্ধ করে কাজটি শুরু করবে। এটা হ’ল সঠিক নিয়তের অনুশীলন।

আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা :

মানুষ আল্লাহর কাছে বেশী করে ধর্ণা দিয়ে তাঁর কাছে বেশী করে দো‘আ-প্রার্থনা করে ইখলাছ অবলম্বনের তাওফীক কামনা করবে। এজন্য তো আল্লাহ রাববুল আলামীন দৈনিক পাঁচ বার ছালাতের মাধ্যমে আমাদের বলতে শিখিয়েছেন, ‘আমরা তোমারই ইবাদত করি আর তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি’ (ফাতিহা ১/৪)। অর্থাৎ একমাত্র তোমারই উপাসনা করি অন্য কারো নয়; আর তোমার উপাসনার জন্য তোমারই কাছে সামর্থ্য চাই, অন্য কারো কাছে নয়। তোমার সাহায্য ছাড়া কেউ ভাল কাজ করতে পারে না এবং তোমার সাহায্য ছাড়া কেউ খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে পারে না।

ইবরাহীম (আঃ) শিরক থেকে বিরত থাকা ও আল্লাহর তাওহীদে অটল থাকার জন্য প্রার্থনা করেছেন এভাবে,

وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيْمُ رَبِّ اجْعَلْ هَـذَا الْبَلَدَ آمِناً وَاجْنُبْنِيْ وَبَنِيَّ أَن نَّعْبُدَ الْأَصْنَامَ-

‘স্মরণ করুন! যখন ইবরাহীম বলল, হে আমার প্রতিপালক, আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে প্রতিমা পূজা থেকে দূরে রেখ’ (ইবরাহীম ১৪/৩৫)

অর্থাৎ হে আমার প্রভু! আমার সন্তানদের ও শিরকের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে দিন এবং আমাদের তাওহীদ ও ইখলাছ অবলম্বনকারী বানান (নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী, ফাতহুল বায়ান)

রাসূলে কারীম (ছাঃ) শিরক থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করার শিক্ষা দিয়েছেন বহু হাদীছে। যেমন- ছাহাবী আবু মূসা আল-আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, হে মানব সকল! তোমরা শিরক থেকে নিজেদের রক্ষা কর। কেননা তা অনুভবে পিঁপড়ার চলার শব্দের চেয়েও সূক্ষ্ম। একজন ব্যক্তি প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! যা পিঁপড়ার চলার শব্দের চেয়েও হাল্কা-আমরা অনুভব করতে পারি না তা থেকে কিভাবে বেঁচে থাকব? তিনি বললেন, তোমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে, হে আল্লাহ! আমরা এমন শিরক থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি যা আমরা জানি এবং এমন শিরক থেকেও তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি, যা আমরা জানি না।[7]

তাই শিরক থেকে বেঁচে থাকতে এবং ইখলাছের উপর কায়েম থাকতে সর্বদা আল্লাহর কাছে সাহায্য ও সামর্থ্য প্রার্থনা করা উচিত।

ইবাদত-বন্দেগী বেশী করা :

মানুষের কাছে শয়তানের প্রত্যাশা এই যে, সর্বতোভাবে সে আল্লাহর আনুগত্য পরিত্যাগ করুক, কিংবা নিয়ত ও ধরনের দিক দিয়ে ইবাদত পালন করুক অযথার্থ প্রক্রিয়ায়। কিন্তু শয়তান যখন জানতে পারে যে, বান্দা তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে, বর্জন করছে তার আনুগত্য এবং যখনি সে বান্দাকে কুমন্ত্রণা দিচ্ছে, বেড়ে যাচ্ছে ইবাদত-বন্দেগী ও ইখলাছ, তখন সে ক্ষ্যান্ত হয়। কারণ বান্দার এ অটলতাই তার জন্য প্রভূত কল্যাণের কারণ হবে সন্দেহ নেই। হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, শয়তান তোমার দিকে দৃষ্টি দিয়ে যখন দেখে যে তুমি সর্বদা আল্লাহর আনুগত্যে অটল, তখন সে তোমাকে প্রত্যাখ্যান করে চলে যায়। আর যখন দেখে তুমি কখনো আনুগত্য করছ, আবার কখনো ছেড়ে দিচ্ছ তখন সে তোমার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠে (ইবনুল মুবারক, আয-যুহুদ)

আত্মতৃপ্তি পরিহার করা :

আমি খুব ভাল মানুষ বা আমি অনেক লোকের চেয়ে সৎকর্ম বেশী করি, এ ধরনের অনুভূতি লালন করার নাম হ’ল আত্মতৃপ্তি। এটা এক খারাপ আচরণ। শয়তান এ পথ দিয়ে মানুষকে প্রতারিত করে থাকে, ঢুকে পড়ে তার অন্তকরণে সন্তর্পণে।

যে আত্মতৃপ্তিতে ভোগে, সে যেন আল্লাহর প্রতি অনুগ্রহ করেছে বলে ধারণা পোষণ করে। যেমন আল্লাহ রাববুল আলামীন আত্মতৃপ্তিতে পতিত হওয়া কতিপয় মানুষের কথা বলেছেন এভাবে,

يَمُنُّوْنَ عَلَيْكَ أَنْ أَسْلَمُوْا قُل لَّا تَمُنُّوْا عَلَيَّ إِسْلاَمَكُم بَلِ اللَّهُ يَمُنُّ عَلَيْكُمْ أَنْ هَدَاكُمْ لِلْإِيْمَانِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِيْنَ-

‘তারা ইসলাম গ্রহণ করে তোমাকে ধন্য করেছে বলে মনে করে। বল, তোমাদের ইসলাম গ্রহণ আমাকে ধন্য করেছে বলে মনে করো না, বরং আল্লাহ ঈমানের দিকে পরিচালিত করে তোমাদেরকে ধন্য করেছেন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’ (হুজুরাত ৪৯/১৭)

ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, ইখলাছ অবলম্বনে যতগুলো বাধা আছে তার মধ্যে আত্মতৃপ্তি হ’ল অন্যতম। আত্মতৃপ্তি যাকে পেয়ে বসবে তার আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে। এমনিভাবে যে অহংকার করবে তার আমল নিষ্ফলতায় পর্যবসিত হবে (আল-আরবাঈন আন-নাবাবিয়্যাহ)

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, মানুষ যখন কোন কাজ শুরু করবে তখন আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করার নিয়ত করবে, আল্লাহ তাকে অনুগ্রহ করে এ কাজ করার সামর্থ্য দিয়েছেন এটা মনে রাখবে, তাঁরই দেয়া শক্তি ও সামর্থ্য দ্বারা এ কাজ করা হচ্ছে, তিনিই মুখ, অন্তর, চোখ, কানকে এ কাজে ব্যবহারের উপযোগী করেছেন এ অনুভূতি পোষণ করবে। এ রকম নিয়ত ও অনুভূতি যদি কাজ করার শুরুতে না থাকে তাহ’লে আত্মতৃপ্তিতে পতিত হওয়ার দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাবে। ফলে তার আমলটা বৃথা যাবে (ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ)

সৃষ্টজীব আমার কাজ সম্পর্কে জানুক, তারা আমার প্রশংসা করুক ও আমাকে তিরস্কার না করুক-এমন নিয়তে কাজ করলে তা এক ধরনের শিরক বলে আল্লাহর কাছে গণ্য হবে (ইবনে তাইমিয়া, মাজমূউ ফাতাওয়া)

মানুষের সমালোচনা ও প্রশংসার প্রতি লক্ষ্য রেখে মুখলিছ বান্দা ইবাদত-বন্দেগী করতে পারে না। কেন সে মানুষের ভাল-মন্দ কথার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করবে। সে তো জানে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘জেনে রাখ! পুরো জাতি যদি তোমাকে উপকার করতে একত্র হয় তবুও তোমার কোন উপকার করতে পারবে না, তবে আল্লাহ তোমার জন্য যা লিখে রেখেছেন (তা অবশ্যই ঘটবে)। এমনিভাবে, পুরো জাতি যদি তোমার ক্ষতি করার জন্য একত্র হয় তবুও তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তবে আল্লাহ যা তোমার বিপক্ষে লিখে রেখেছেন (তা নিশ্চয়ই ঘটবে)। কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে আর খাতা শুকিয়ে গেছে।[8]

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, আগুন ও পানি যেমন একত্র হ’তে পারে না। সাপ এবং গুই সাপ যেমন এক গর্তে থাকতে পারে না, তেমনি একই হৃদয়ে ইখলাছ ও মানুষকে সন্তুষ্ট করার ভাবনা একত্র হ’তে পারে না (ইবনুল কাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ)

মানুষের নযর কাড়ার প্রতি গুরুত্ব দিলে, তাদের সন্তুষ্টি অর্জনের ভাবনা অন্তরে স্থান দিলে তা কাউকে উপকার করবে না ও ক্ষতি থেকেও ফিরাবে না। বরং এ ধরনের ভাবনা শুধু মানুষের কাধে সমালোচনার যোগান দেয়।

[চলবে

ফয়ছাল বিন আলী আল-বাদানী

অনুবাদ : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান


[1]. বুখারী হা/১৮১০; মিশকাত হা/৩৮১৪

[2]. মুসলিম হা/২৯৬৫; মিশকাত হা/৫২৮৪

[3]. ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/৪২৪৫, সনদ ছহীহ

[4]. ছহীহ তিরমিযী হা/৩১৭৫, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/৫৩৫০

[5]. বুখারী হা/২৮৮৭, ‘জিহাদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ ৬৯; মিশকাত হা/৫১৬১

[6]. বুখারী হা/৬৪৯৯; মিশকাত হা/৫৩১৬

[7]. মুসনাদ আহমাদ হা/১৯৬২২; সনদ হাসান, ছহীহ তারগীব হা/৩৬

[8]. ছহীহ তিরমিযী হা/২৫১৬, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/৫৩০২






মানব জাতির প্রকাশ্য শত্রু শয়তান (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত পরিচিতি (৩য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
নিয়মের রাজত্ব - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
পুনরুত্থান - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
অল্পে তুষ্টি (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
বিবাহের গুরুত্ব ও পদ্ধতি - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
ঈমানের গুরুত্ব ও ফযীলত - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
আলেমে দ্বীনের মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
পবিত্রতা অর্জন সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা (৩য় কিস্তি) - মীযানুর রহমান মাদানী
তাক্বলীদের বিরুদ্ধে ৮১টি দলীল (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ফৎওয়া : গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও বিকাশ (২য় কিস্তি) - ড. শিহাবুদ্দীন আহমাদ, শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, রাজশাহী
আরও
আরও
.