ইলমের যেমন গুরুত্ব ও ফযীলত রয়েছে তেমনি ইলম অন্বেষণ ও ইলম শিক্ষা দানেরও বিশেষ গুরুত্ব ও ফযীলত রয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি নিমেণ উল্লেখ করা হ’ল-
(১) নবী-রাসূলগণকে প্রেরণের অন্যতম উদ্দেশ্য শিক্ষাদান : আদম (আঃ) থেকে শুরু করে মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত ৩১৫ জন রাসূল সহ এক লক্ষ চবিবশ হাযার পয়গাম্বর পৃথিবীতে এসেছিলেন।[1] সকল পয়গাম্বরের প্রধান দায়িত্ব ছিল মানুষকে দ্বীন শিক্ষাদান করা। আমাদের নবীকে প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِنْكُمْ يَتْلُو عَلَيْكُمْ آيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ،
‘যেমন আমরা তোমাদের মধ্য থেকেই একজনকে রাসূল হিসাবে প্রেরণ করেছি, যিনি তোমাদের নিকট আমাদের আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনান। যিনি তোমাদের পবিত্র করেন এবং তোমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ শিক্ষা দেন। আর তোমাদের এমনসব বিষয় শিক্ষা দেন, যা তোমরা জানতে না’ (বাক্বারাহ ২/১৫১)।[2]
(২) ইলম অন্বেষণ করা ফরয : দ্বীনি ইলম অর্জন করা ফরয। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِم، ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয’।[3]
(৩) ইলম শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেওয়া অভিশাপমুক্ত : আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,الدُّنْيَا مَلْعُونَةٌ مَلْعُونٌ مَا فِيهَا إِلاَّ ذِكْرَ اللهِ تَعَالَى وَمَا وَالاَهُ وَعَالِماً أَوْ مُتَعَلِّماً، ‘পৃথিবী অভিশপ্ত এবং অভিশপ্ত তার মধ্যেকার সকল বস্ত্ত। তবে আল্লাহর যিকর ও তার আনুষঙ্গিক বিষয় এবং আলেম (দ্বীনী শিক্ষক) ও তালেবে ইলম (দ্বীনী শিক্ষার্থী) ব্যতীত’।[4] আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, اغْدُ عَالِمًا أَوْ مُتَعَلِّمًا وَلَا تَغْدُ فِيْمَا بَيْنَ ذَلِكَ ‘তোমরা আলেম (শিক্ষক) হও অথবা ছাত্র হও, এর মধ্যখানে কিছু হয়ো না।[5]
(৪) ইলম অর্জনের জন্য বের হওয়া হজ্জের সমান নেকী : আবূ উমামা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ غَدَا إِلَى الْمَسْجِدِ لا يُرِيدُ إِلا أَنْ يَتَعَلَّمَ خَيْرًا أَوْ يَعْلَمَهُ، كَانَ لَهُ كَأَجْرِ حَاجٍّ تَامًّا حِجَّتُهُ ‘যে ব্যক্তি কেবলমাত্র কল্যাণমূলক কিছু শিক্ষা করা অথবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে মসজিদের দিকে যাত্রা করে, তার জন্য (তার আমলনামায়) একটি পূর্ণ হজ্জের সমপরিমাণ নেকী লিপিবদ্ধ করা হয়’।[6]
(৫) ইলম অর্জনের জন্য বের হওয়া জিহাদের সমান নেকী : আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ جَاءَ مَسْجِدِي هَذَا لَمْ يَأْتِ إِلاَّ لِخَيْرٍ يَتَعَلَّمُهُ أَوْ يُعَلِّمُهُ فَهُوَ بِمَنْزِلَةِ الْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللهِ وَمَنْ جَاءَ لِغَيْرِ ذَلِكَ فَهُوَ بِمَنْزِلَةِ رَجُلٍ يَنْظُرُ إِلَى مَتَاعِ غَيْرِهِ، ‘যে ব্যক্তি কল্যাণমূলক (দ্বীনী ইলম) শিক্ষা গ্রহণ করা অথবা দেওয়ার উদ্দেশ্য আমার এই মসজিদে আসে, সে ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের মর্যাদায় সমুন্নত হয়। আর যে ব্যক্তি এছাড়া ভিন্ন কোন উদ্দেশ্যে আসে, সে ঐ ব্যক্তির সমতুল্য, যে পরের আসবাবপত্রের প্রতি তাকিয়ে থাকে’।[7]
(৬) ইলমের মজলিসকে ফেরেশতারা ঘিরে রাখেন : ছাফওয়ান বিন আসসাল মুরাদী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট আসলাম। তিনি মসজিদে তাঁর এক লাল রঙের চাদরে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। আমি তাঁকে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি ইলম অন্বেষণ করতে এসেছি। আমার এ কথা শুনে তিনি বললেন,مَرْحَبًا بطالبِ الْعِلْمِ، طَالِبُ الْعِلْمِ لَتَحُفُّهُ الْمَلائِكَةُ وَتُظِلُّهُ بِأَجْنِحَتِهَا، ثُمَّ يَرْكَبُ بَعْضُهُ بَعْضًا حَتَّى يَبْلُغُوا السَّمَاءَ الدُّنْيَا مِنْ حُبِّهِمْ لِمَا يَطْلُبُ، ‘ইলমে দ্বীন শিক্ষার্থীকে আমি স্বাগত জানাই। অবশ্যই ইলম অন্বেষণকারীকে ফেরেশতাগণ তাঁদের পাখা দ্বারা পরিবেষ্টন করে নেন। অতঃপর একে অন্যের উপর আরোহণ করেন। অনুরূপভাবে তাঁরা নিম্ন আসমান পর্যন্ত পৌঁছে যান। এতদ্বারা তাঁরা তার ঐ ইলম অন্বেষণের প্রতি নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করে থাকেন।[8] আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
مَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللهِ يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إِلاَّ حَفَّتْهُمُ الْمَلاَئِكَةُ وَنَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ وَمَنْ أَبْطَأَ بِهِ عَمَلُهُ لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ
‘যখন কোন জনসমষ্টি আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্যকার কোন ঘরে সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করে এবং পরস্পর তা শিক্ষা করে, তখন ফেরেশতারা তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রাখেন, তাদের উপর প্রশান্তি নাযিল হয়, দয়া ও অনুগ্রহ তাদের আবৃত করে নেয় এবং আল্লাহ তাঁর নিকটে অবস্থানকারীদের (ফেরেশতাদের) সাথে তাদের বিষয়ে আলোচনা করেন। (পৃথিবীতে) যার সৎকর্ম কম হবে (আখেরাতে) তার বংশমর্যাদা কোন উপকারে আসবে না’।[9]
(৭) ইলমের মজলিস নিয়ে আল্লাহ ফেরেশতাদের সাথে আলোচনা করেন : আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার ছাহাবীদের একটি হালকার নিকটে গিয়ে বললেন, কিসে তোমাদের বসিয়েছে? তারা বলল, আমরা বসেছি আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য। যেহেতু তিনি আমাদেরকে ইসলামের দিকে পথ দেখিয়েছেন এবং আমাদের উপর তিনি ইহসান করেছেন। তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! তোমাদেরকে কি শুধু এ বিষয়েই বসিয়েছে? তারা বলল, আল্লাহর শপথ! আমাদেরকে একমাত্র এ বিষয় বসিয়েছে। তিনি বললেন,أَما إنِّي لَمْ أَسْتَحْلِفْكُمْ تُهْمَةً لَكُمْ، وَلَكِنَّهُ أَتانِي جِبْرِيلُ فأخْبَرَنِي أنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يُباهِي بكُمُ المَلائِكَةَ، ‘আমি তোমাদেরকে অপবাদ দেয়ার জন্যে শপথ করতে বলিনি, বরং আমার নিকট জিবরীল (আঃ) এসে আমাকে অবহিত করেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাগণের নিকট তোমাদের মর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা করছেন’।[10]
(৮) ইলমী মজলিসে অবস্থানকারীকে ক্ষমা করা হয় : সুহায়ল ইবনু হানযালাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَا جَلَسَ قَوْمٌ مَجْلِسًا يَذْكُرُوْنَ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ فِيْهِ فَيَقُوْمُوْنَ حَتّٰى يُقَالُ لَهُمْ قُوْمُوْا قَدْ غَفَرَ اللهُ لَهُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَبُدِلَّتْ سَيِّئَاتِكُمْ حَسَنَاتٍ، ‘কিছু লোক একটি মজলিসে বসে যখন আল্লাহ তা‘আলার স্মরণ করে তারপর উঠে চলে যায় তখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের গুনাহগুলোকে মাফ করে দিয়েছেন এবং তোমাদের গুনাহগুলোকে নেকী দ্বারা পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে’।[11]
(৯) ইলম অর্জন করতে হবে কবর পর্যন্ত : প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্যেই শিক্ষাকে সীমাবদ্ধ করা ঠিক নয় বরং সব বয়সের লোককেই শিক্ষার মধ্যে থাকতে হবে। আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, أنا أطلب العلم إلى أن أدخل القبر ‘আমি কবরে প্রবেশ করা পর্যন্ত ইলম অর্জন করতে থাকব’।[12]
(১০) ইলম অর্জন ও শিক্ষাদান গাছ লাগানোর মত : আবূ ইনাবাহ (উতবাহ) আল-খাওলানী হ’তে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে দু’ক্বিবলার দিকেই ছালাত আদায় করেছেন। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,لاَ يَزَالُ اللهُ يَغْرِسُ فِي هَذَا الدِّينِ غَرْسًا يَسْتَعْمِلُهُمْ فِي طَاعَتِهِ، ‘আল্লাহ সর্বদা এই দ্বীনের মধ্যে একটি গাছ রোপণ করতে থাকবেন (এমন লোক সৃষ্টি করতে থাকবেন) যাদের তিনি তাঁর আনুগত্যে নিয়োজিত রাখবেন’।[13] ইবনে কুদামা (রহঃ) বলেন, وغرس الله هم أهل العلم والعمل ‘আল্লাহর গাছ রোপণ হ’ল- আলেম ও আবেদগণ’।[14]
(১১) কুরআন শিক্ষা উট লাভের চেয়েও উত্তম : উক্বাহ ইবনু আমের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আসলেন। তখন আমরা ছুফ্ফাহ বা মসজিদের চত্বরে অবস্থান করছিলাম। তিনি বললেন, তোমাদের কেউ কি চায় যে, প্রতিদিন ‘বুত্বহান’ বা আকীকের বাজারে যাবে এবং সেখানে থেকে কোন পাপ বা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা ছাড়াই বড় কুঁজ বিশিষ্ট দু’টি উটনী নিয়ে আসবে? আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা এরূপ চাই। তিনি বললেন, ‘তাহ’লে কি তোমরা কেউ মসজিদে গিয়ে আল্লাহর কিতাবের দু’টি আয়াত শিক্ষা দিবে না কিংবা পাঠ করবে না? এটা তার জন্য ঐরূপ দু’টি উটনীর চেয়েও উত্তম। এরূপ তিনটি আয়াত তিনটি উটনীর চেয়ে উত্তম এবং চারটি আয়াত চারটি উটনীর চেয়ে উত্তম। আর অনুরূপ সমসংখ্যক উটনীর চেয়ে তত সংখ্যক আয়াত উত্তম’।[15]
(১২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পক্ষ থেকে সুসংবাদ : শিক্ষা গ্রহণকারী ও শিক্ষদানকারীদের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পক্ষ থেকে সুসংবাদ রয়েছে। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,سَيَأْتِيكُمْ أَقْوَامٌ يَطْلُبُونَ الْعِلْمَ فَإِذَا رَأَيْتُمُوهُمْ فَقُولُوا لَهُمْ مَرْحَبًا مَرْحَبًا بِوَصِيَّةِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَاقْنُوهُمْ قُلْتُ لِلْحَكَمِ مَا اقْنُوهُمْ قَالَ عَلِّمُوهُمْ، ‘অচিরেই তোমাদের নিকট ইলম শিক্ষার জন্য দলে দলে লোক আসবে। তোমরা তাদের দেখলেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অছিয়ত অনুযায়ী স্বাগত জানাবে এবং তাদের তালক্বীন দিবে (জ্ঞানদান করবে)। আমি হাকাম (রহঃ)-কে বললাম, আমরা তাদের কি তালক্বীন দিব? তিনি বলেন, তাদের ইলম শিক্ষা দিবে’।[16]
(১৩) ইলম অন্বেষণকারীদের জন্য ফেরেশতারা পাখা বিছিয়ে দেয় : আবূদ দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, مَنْ سَلَكَ طَرِيقاً يَبْتَغِي فِيهِ عِلْماً سَهَّلَ اللهُ لَهُ طَرِيقاً إِلَى الجَنَّةِ، وَإِنَّ المَلاَئِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا لِطَالِبِ العِلْمِ رِضاً بِمَا يَصْنَعُ، ‘যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের জন্য পথ চলে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেন। আর ফেরেশতাগণ তালেবে ইলমের জন্য তার কাজে প্রসন্ন হয়ে নিজেদের ডানাগুলি বিছিয়ে দেন’।[17]
(১৪) শিক্ষাদানকারী আমলকারীর সমান ছওয়াব পাবেন : শিক্ষাদানের মত মহৎ কাজ যারা করবেন তাদের শিক্ষা পেয়ে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত লোক আমল করবে শিক্ষদানকারী তাদের সমান ছওয়াব পাবেন। মু‘আয বিন আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ عَلَّمَ عِلْماً فَلَهُ أَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهِ لاَ يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الْعَامِلِ، ‘যে ব্যক্তি কোন ইলম শিক্ষা দেয়, তার জন্য রয়েছে সেই ব্যক্তির সমপরিমাণ ছওয়াব, যে সেই ইলম অনুযায়ী আমল করে। এতে আমলকারীর ছওয়াব কিঞ্চিৎপরিমাণ হ্রাস করা হবে না’।[18]
(১৫) নিজে শিক্ষা করা ও অপরকে শিক্ষা দেওয়ার ফযীলত : আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ আমাকে যে হেদায়াত ও ইলম দিয়ে পাঠিয়েছেন তার উদাহরণ হ’ল ঐ বৃষ্টির ন্যায় যা কোন যমীনে বর্ষিত হ’ল। উক্ত যমীনের কিছু অংশ ছিল খুবই ভাল ও উর্বর। সে যমীন পানি ধারণ করে প্রচুর ঘাস, তৃণলতা ও শাক-সব্জি উৎপন্ন করল। যমীনের অন্য অংশ ছিল খুবই শক্ত। তা পানি ধারণ করে রাখল। উহা দ্বারা আল্লাহ মানুষের উপকার করলেন। মানুষেরা তা পান করল, চতুষ্পদ জন্তুকে পান করাল এবং চাষাবাদও করল। সেই বৃষ্টির কিছু পানি যমীনের এমন এক অংশে পতিত হ’ল, যা ছিল মসৃণ পাথর যুক্ত সমতল ময়দান। সে পানি ধরে রাখতে পারে না এবং কোন তৃণলতাও উৎপন্ন করতে পারে না।
সুতরাং এটিই হ’ল ঐ ব্যক্তির উদাহরণ যে আল্লাহর দ্বীন বুঝতে সক্ষম হয়েছে এবং আমাকে আল্লাহ যে হেদায়াত দিয়ে পাঠিয়েছেন তা দ্বারা উপকৃত হয়েছে। তাই সে নিজে উহা শিক্ষা করেছে এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছে। আবার ঐ ব্যক্তির উদাহরণ, যে দ্বীনী জ্ঞান শিক্ষা অর্জনের জন্য চেষ্টা করেনি এবং আমাকে আল্লাহ যে হেদায়াত দিয়ে পাঠিয়েছেন তা কবুলও করেনি।[19]
(১৬) শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষাদান উত্তম কাজ : ওছমান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে কুরআন শিখে ও অন্যকে শিখায়’।[20] অন্য বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ أَفْضَلَكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম সে, যে নিজে কুরআন শিখে
এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়’।[21]
(১৭) ইলম শিক্ষা দেওয়া অনেক ফযীলত : পথহারা মানুষকে যদি পথ দেখিয়ে সঠিক পথে আনা যায় তাহ’লে তা ইলম শিক্ষাদানকারীদের জন্য বিশাল ছওয়াব রয়েছে। সাহল ইবনে সা‘দ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) (খায়বার যুদ্ধের সময়) আলী (রাঃ)-কে সম্বোধন করে বললেন, فَوَاللهِ لأَنْ يَهْدِيَ اللهُ بِكَ رَجُلاً وَاحِداً خَيْرٌ لَكَ مِنْ أَنْ يَكُونَ لَكَ حُمْرُ النَّعَمِ، ‘আল্লাহর শপথ! তোমার দ্বারা একটি মানুষকেও যদি আল্লাহ সৎ পথ দেখান, তবে তা (আরবের মহামূল্যবান) লাল উট অপেক্ষা উত্তম হবে’।[22]
(১৮) ইলম অর্জন ও প্রচারকারীর জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর দো‘আ : রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষ থেকে মহান আল্লাহর কাছে ইলম অন্বেষণ ও প্রচারকারীর জন্য বিশেষ দো‘আ রয়েছে। যায়েদ ইবনু ছাবিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,نَضَّرَ اللهُ امْرَأً سَمِعَ مِنَّا حَدِيثًا، فَحَفِظَهُ حَتَّى يُبَلِّغَهُ، فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ إِلَى مَنْ هُوَ أَفْقَهُ مِنْهُ، وَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ لَيْسَ بِفَقِيهٍ، ‘যে ব্যক্তি আমার নিকট থেকে হাদীছ শুনে তা মুখস্থ রাখল এবং অন্যের নিকটও তা পৌঁছে দিল, আল্লাহ তাকে চিরউজ্জ্বল করে রাখবেন। জ্ঞানের অনেক বাহক তার চেয়ে অধিক সমঝদার লোকের নিকট তা বহন করে নিয়ে যায়; যদিও জ্ঞানের বহু বাহক নিজেরা জ্ঞানী নয়’।[23]
(১৯) ইলমের জন্য বের হ’লে আল্লাহ জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দিবেন : ইলম অর্জনের জন্য পথ চলা আলেমদের বৈশিষ্ট্য। পূর্ববর্তী ইমামগণ হাদীছ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন স্থানে গমন করতেন। আর ইলমের জন্য পথ চলার কারণে আল্লাহ জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দিবেন। আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللهُ لَهُ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ ‘যে লোক জ্ঞানের খোঁজে কোন পথ চলবে, তার জন্য আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতের পথ সহজ করে দিবেন’।[24]
পরিশেষে বলব, দ্বীনী ইলম অর্জন করা ও শিক্ষা দেওয়া অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ আমল। কারণ এর মাধ্যমে পার্থিব জীবনে হারাম-হালাল ও আল্লাহর বিধান অবগত হওয়া যায়। ফলে পরকালীন মুক্তি ও জান্নাত লাভের জন্য আমল করা সহজ হয়। এটা ছাদাক্বায়ে জারিয়া হওয়ায় কবরে বা বারযাখী জীবনেও এর ছওয়াব অব্যাহত থাকবে। উপরন্তু এর মাধ্যমে জান্নাতের পথ সুগম হয়। অতএব আমাদের সকলের জন্য দ্বীনী ইলম অর্জন করা অবশ্য কর্তব্য। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন-আমীন!
মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
তুলাগাঁও নোয়াপাড়া, দেবিদ্বার, কুমিল্লা।
[1]. আহমাদ, মিশকাত হা/৫৭৩৭; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৬৬৮।
[2]. এছাড়াও সূরা বাক্বারাহ ২/১২৯; আলে ইমরান ৩/১৬৪; জুম‘আ ৬২/২ নং আয়াতে এ ব্যাপারে আলোচনা এসেছে।
[3]. ইবনে মাজাহ হা/২২৪; ছহীহুল জামে হা/৩৯১৩।
[4]. তিরমিযী হা/২৩২২; ইবনু মাজাহ হা/৪১১২; ছহীহুত তারগীব হা/৭০।
[5]. নাজরাতুন নাঈম (জেদ্দা: দারুল অসীলাহ, ১ম প্রকাশ ১৯৮৮খ্রি.) ৭/২৯৭৬।
[6]. ত্বাবারানী হা/৭৩৪৬; ছহীহুত তারগীব হা/৮৬, সনদ হাসান।
[7]. ইবনে মাজাহ হা/২২৭; ছহীহুত তারগীব হা/৮৭।
[8]. আহমাদ হা/১৮০৯৩; ত্বাবারানী হা/৭১৯৬; ছহীহুত তারগীব ৭১।
[9]. মুসলিম হা/২৬৯৯; তিরমিযী হা/১৪২৫; ইবনে মাজাহ হা/২৪১।
[10]. মুসলিম হা/২৭০১; তিরমিযী হা/৩৩৭৯।
[11]. আল-মু‘জামুল কাবীরহা/৬০৩৯; ছহীহুল জা‘মে‘ হা/৫৬১০।
[12].https://twitter.com/ahmadbinhanbl/status/1226892125956198402?lang=en
[13]. ইবনে মাজাহ হা/৮; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৪৪২।
[14]. মাফাতেহ দারুস সা‘আদাহ ১/১৪৪।
[15]. মুসলিম হা/৮০৩।
[16]. ইবনে মাজাহ হা/২৪৭; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৮০।
[17]. আবু দাঊদ হা/৩৬৪৩; তিরমিযী হা/২৬৮২; ছহীহুত তারগীব হা/৬৭।
[18]. ইবনে মাজাহ হা/২৪০, ছহীহুত তারগীব হা/৭৬।
[19]. বুখারী হা/৭৯; মুসলিম হা/৬০৯৩।
[20]. বুখারী হা/৫০২৭।
[21]. বুখারী হা/৫০২৮।
[22]. বুখারী হা/৩০০৯, ৩৭০১; মুসলিম হা/৬৩৭৬।
[23]. আবূ দাঊদ হা/৩৬৬২; তিরমিযী হা/২৬৫৬; ছহীহুত তারগীব ৮৩
[24]. তিরমিযী হা/২৬৪৬; ইবনে মাজাহ হা/২২৫।