পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । পর্ব ৭ । পর্ব ৮ । শেষ পর্ব ।
[ফিরক্বায়ে
মাসঊদিয়াসহ কিছু লোক ও খারেজীরা এই দাবী করতে থাকে যে, আমাদের নাম স্রে্রফ
মুসলিম বা মুসলিমীন এবং অন্যান্য সকল নাম (চাই গুণবাচক নাম হোক বা উপাধি)
রাখা নাজায়েয অথবা উত্তম নয়। আমাদের এই গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে সালাফে
ছালেহীনের বুঝের আলোকে এ সকল লোকের দলীলসমূহের যথার্থ জবাব রয়েছে।
আল-হামদুলিল্লাহ।]
করাচীর নতুন গজিয়ে উঠা একটি ফিরক্বা অনেক দিন যাবৎ আহলুল হাদীছ ওয়াল আছার-এর বিরুদ্ধে ‘তাকফীর’ (কাফের আখ্যায়িত করা), ‘তাবদী‘ (বিদ‘আতী আখ্যা দান), ভৎর্সনা ও তিরস্কারের বাজার গরম করে রেখেছে। কতিপয় অবুঝ লোকের উক্ত ফিরক্বার প্রতারণার জালে আটকা পড়ার আশঙ্কা থাকার কারণে এই প্রবন্ধটিকে বিস্তারিতভাবে দলীল সহ লেখা হয়েছে। যাতে ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার বাতিল দাবীসমূহ এবং অপবাদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া যায়। আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে দ্বীন ইসলামের উপরে অটল রাখেন এবং গোমরাহীর পথসমূহের শয়তানী বৈশিষ্ট্যমন্ডিত দাঈদের প্রতারণা থেকে রক্ষা করেন। -আমীন!
আহলুল হাদীছ : মুহাদ্দিছদের জামা‘আতকে আহলুল হাদীছ বলা হয়। যেভাবে মুফাসসিরদের জামা‘আতকে আহলুত তাফসীর এবং ঐতিহাসিকদের জামা‘আতকে আহলুত তারীখ বলা হয়।
দলীল-১ :
ছহীহ বুখারীর রচয়িতা ইমাম বুখারী (রহঃ) ‘জুযউল ক্বিরাআত খালফাল ইমাম’
গ্রন্থের ১৩ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ولا يحتج أهل الحديث بمثله ‘এরূপ বর্ণনাকারী
দ্বারা আহলুল হাদীছগণ দলীল গ্রহণ করেন না’।[1] বরং ইমাম বুখারী (রহঃ) আহলেহাদীছদেরকে ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ (জান্নাতী এবং হক্বপন্থী জামা‘আত) আখ্যা দিয়েছেন।[2]
দলীল-২ : জামে‘
তিরমিযীর লেখক ইমাম তিরমিযী (রহঃ) স্বীয় ‘আল-জামে’ গ্রন্থে (১/১৬ পৃঃ)
বলেছেন, وَابْنُ لَهِيعَةَ ضَعِيفٌ عِنْدَ أَهْلِ الْحَدِيثِ ‘ইবনু লাহী‘আহ
আহলুল হাদীছদের নিকটে যঈফ’।[3]
সতর্কীকরণ : যেহেতু আব্দুল্লাহ ইবনু লাহী‘আহ ইখতিলাতের কারণে যঈফ ছিলেন এবং মুদাল্লিসও ছিলেন, সেহেতু তার বর্ণিত হাদীছ দু’টি শর্তের ভিত্তিতে হাসান লি-যাতিহি হয় :
১. বর্ণনাটি ইখতিলাতের[4] পূর্বের হওয়া।[5]
২. বর্ণনায় ‘সামা‘[6] অর্থাৎ ‘আমি শুনেছি’ কথাটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা।[7]
দলীল-৩ : আজ পর্যন্ত কোন মুসলিম আলেম একথা অস্বীকার করেননি যে, ‘আহলুল হাদীছ’ দ্বারা মুহাদ্দিছদের জামা‘আত উদ্দেশ্য। এজন্য এই গুণবাচক নাম ও নসব জায়েয হওয়ার ব্যাপারে ইজমা রয়েছে।
আহলেহাদীছ উপাধি ও গুণবাচক নামটি বিশুদ্ধ হওয়ার
ব্যাপারে ৫০টি উদ্ধৃতির জন্য দেখুন আমার গ্রন্থ : ‘তাহক্বীক্বী, ইছলাহী
আওর ইলমী মাক্বালাত’ (১/১৬১-১৭৪)।[8]
দলীল-৪ : ইমাম মুসলিমও মুহাদ্দিছগণকে আহলুল হাদীছ বলেছেন।[9]
ইমাম মুসলিম (রহঃ) নিজেও আহলেহাদীছ ছিলেন। যেমনটি হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন,
ونحن لا نعني بأهل الحديث المقتصرين على سماعه أو كتابته أو روايته بل نعني بهم : كل من كان أحق بحفظه ومعرفته وفهمه ظاهراً وباطناً واتباعه باطناً وظاهراً وكذلك أهل القرآن-
‘আমরা আহলেহাদীছ বলতে কেবল তাদেরকেই বুঝি
না যারা হাদীছ শুনেছেন, লিপিবদ্ধ করেছেন বা বর্ণনা করেছেন। বরং আমরা
আহলেহাদীছ দ্বারা ঐ সকল ব্যক্তিকে বুঝিয়ে থাকি, যারা হাদীছ মুখস্থকরণ এবং
গোপন ও প্রকাশ্যভাবে তার জ্ঞান লাভ ও অনুধাবন এবং অনুসরণ করার অধিক হকদার।
অনুরূপভাবে আহলে কুরআন দ্বারাও এরাই উদ্দেশ্য’।[10]
হাফেয
ইবনু তায়মিয়ার নিকটে ইমাম মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, ইবনু
খুযায়মাহ এবং আবূ ই‘য়ালা প্রমুখ সকলেই আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরে ছিলেন এবং
তারা কোন আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না।[11]
আহলুল হাদীছ-এর ফযীলত :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِى ظَاهِرِينَ
حَتَّى يَأْتِيَهُمْ أَمْرُ اللَّهِ وَهُمْ ظَاهِرُونَ ‘আমার উম্মতের
একটি দল সর্বদা বিজয়ী থাকবে। অবশেষে তাদের নিকটে আল্লাহর ফায়ছালা (কিয়ামত)
এসে যাবে এমতাবস্থায় যে, তারা বিজয়ী থাকবে’।[12]
ছাওবান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত একটি হাদীছে আছে যে, ‘আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা হকের উপরে বিজয়ী থাকবে’।[13]
স্মর্তব্য যে, এই উচ্চমর্যাদাও দলীলের মাধ্যমে বর্ণিত হবে। যেমন-
১.
আহমাদ বিন সিনান (মৃঃ ২৫৯ হিঃ) উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেছেন, هم أهل
العلم وأصحاب الآثار ‘তাঁরা হ’লেন আহলুল ইলম (আলেমগণ) এবং আছহাবুল আছার
(আহলেহাদীছগণ)’।[14]
২. আলী ইবনুল মাদীনী (মৃঃ ২৩৪ হিঃ) বলেন, هُمْ أَصْحَابُ الْحَدِيثِ ‘তারা হ’লেন আছহাবুল হাদীছ’।[15] অন্য বর্ণনায় এসেছে, هُمْ أَهْلُ الْحَدِيثِ ‘তারা হ’লেন আহলুল হাদীছ’।[16] প্রমাণিত হ’ল যে, আছহাবুল হাদীছ এবং আহলেহাদীছ একই জামা‘আতের দু’টি নাম।
৩.
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (মৃঃ ২৪১ হিঃ) উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেন,إن لم
تكن هذه الطائفة المنصورة أصحاب الحديث فلا أدري من هم؟ ‘সাহায্যপ্রাপ্ত এই
দলটি যদি আছহাবুল হাদীছ (আহলেহাদীছ) না হয়, তবে আমি জানি না তারা কারা’?[17]
তিনি বলেন, صاحب الحديث عندنا من يستعمل الحديث ‘আমাদের নিকটে আহলেহাদীছ ঐ ব্যক্তি, যিনি হাদীছের উপরে আমল করেন’।[18]
সতর্কীকরণ : উপরের উদ্ধৃতিতে ‘ছাহেবুল হাদীছ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল আহলুল হাদীছ।
৪.
হাফছ বিন গিয়াছ (মৃঃ ১৯৪ হিঃ) আছহাবুল হাদীছ সম্পর্কে বলেছেন, هم خير أهل
الدنيا ‘তারা হ’লেন (আহলেহাদীছগণ) দুনিয়ায় সবার চাইতে শ্রেষ্ঠ’।[19]
৫.
হাকেমও (মৃঃ ৪০৫ হিঃ) হাফছ বিন গিয়াছ (রহঃ)-এর বক্তব্যকে সত্যায়ন করেছেন
এবং বলেছেন, إن أصحاب الحديث خير الناس ‘নিশ্চয়ই আছহাবুল হাদীছগণ
(মুহাদ্দিছগণ) মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম’।[20]
উক্ত
আইম্মায়ে মুসলিমীন-এর সুস্পষ্ট বক্তব্য দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে,
ত্বায়েফাহ মানছূরাহ সম্পর্কিত হাদীছের ব্যাখ্যা হ’ল আছহাবুল হাদীছ, আহলুল
ইলম (আলেমগণ), আহলেহাদীছ (মুহাদ্দিছগণ)। আর এর উপরেই ইজমা রয়েছে।[21]
আহলুল হাদীছদের দুশমন : আহলুল হাদীছ-এর শত্রুরা তাঁদের উপরে নানাবিধ মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে থাকে।
এ
জাতীয় লোকদের সম্পর্কেই ইমাম আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিত্বী বলেছেন, ليس في
الدنيا مبتدع إلا وهو يبغض أهل الحديث وإذا ابتدع الرجل نزع حلاوة الحديث
من قلبه- ‘দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী নেই, যে আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ
পোষণ করে না। যখন কোন ব্যক্তি বিদ‘আত করে, তখন তার অন্তর থেকে হাদীছের
স্বাদ ছিনিয়ে নেওয়া হয়’।[22]
আহলুল হাদীছদের সাথে শত্রুতার পরিণতি : মুসলমানদের মধ্যে আহলেহাদীছগণ অত্যন্ত উচ্চমর্যাদার অধিকারী এবং প্রকৃতপক্ষে তাঁরাই আল্লাহর ওলী।
আল্লাহর
ওলীদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, مَنْ عَادَى لِى وَلِيًّا فَقَدْ
آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ ‘যে ব্যক্তি আমার কোন ওলীর সাথে শত্রুতা পোষণ করবে,
আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিচ্ছি’।[23]
চিন্তা করুন! কত কঠিন ধমকি। এক্ষণে যে ব্যক্তি ঐসকল আল্লাহর ওলীকে কাফের বলে, তার পরিণাম কি হবে?
হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ)-কে কাফের আখ্যা দান : তাক্বরীবুত তাহযীব, তাহযীবুত তাহযীব, আল-ইছাবাহ, লিসানুল মীযান, তা‘জীলুল মানফা‘আহ, আদ-দেরায়াহ এবং আত-তালখীছুল হাবীর প্রভৃতি উপকারী গ্রন্থসমূহের লেখক, নির্ভরযোগ্য ইমাম, সর্বশেষ হাফেয, ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ)-এর ন্যায়পরায়ণতা ও উচ্চমর্যাদার ব্যাপারে মুহাদ্দিছগণের ইজমা রয়েছে এবং তাঁর গ্রন্থাবলী দ্বারা ধারাবাহিকভাবে উপকার গ্রহণ করা জারী রয়েছে।
ফিরক্বা মাসঊদিয়ার জন্ম :
কয়েক বছর আগে করাচীতে ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়াহ নামে একটি ফিরক্বার জন্ম হয়েছে। যার প্রতিষ্ঠাতা হ’লেন মাসঊদ আহমাদ বিএসসি ছাহেব। এই ফিরক্বাটি নিজের নাম ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ রেখে অনৈসলামী এবং তাগূত্বী সরকারের নিকট থেকে রেজিস্ট্রেশন করে নিয়েছে। মাসঊদ ছাহেব একটি পুস্তিকা রচনা করেছেন। যার নাম রেখেছেন ‘মাযাহিবে খামসাহ’ বা পঞ্চ মাযহাব (অর্থাৎ আহলেহাদীছ, হানাফী, শাফেঈ, মালেকী, হাম্বলী) আওর দ্বীন ইসলাম’। উক্ত পুস্তিকায় ছয়টি ভাগ রয়েছে। ১. আহলুল হাদীছ ২. হানাফী ৩. শাফেঈ ৪. মালেকী ৫. হাম্বলী এবং ৬. দ্বীন ইসলাম।
এর উদ্দেশ্য হ’ল এই যে, মাসঊদ ছাহেবের নিকটে আহলেহাদীছ ও অন্যরা দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ। মাসঊদ ছাহেব আহলেহাদীছদের ভাগে হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ)-কে তাঁর ফাতহুল বারী সহ এনেছেন (পৃঃ ২৯ দ্রঃ)।
প্রতীয়মান হ’ল যে, মাসঊদ ছাহেবের নিকটে হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ। (আস্তাগফিরুল্লাহ)
রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেছেন, أَيُّمَا رَجُلٍ مُسْلِمٍ أَكْفَرَ رَجُلاً مُسْلِمًا
فَإِنْ كَانَ كَافِرًا وَإِلاَّ كَانَ هُوَ الْكَافِرَ ‘যে মুসলিম অন্য
মুসলিমকে কাফের বলল, যদি সে কাফের হয় (তবে ঠিক আছে)। অন্যথায় এরূপ ব্যক্তি
নিজেই কাফের’।[24]
ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার মুসলিম দাবী : মাসঊদ ছাহেব এর উপরে জোর দিয়েছেন যে, আমাদের স্রেফ একটি নাম রয়েছে অর্থাৎ মুসলিম। এ নামটি আল্লাহর রাখা। (এটা) ফিরক্বাবাজি নাম নয়’।[25]
সতর্কীকরণ : আমাদের জানা মতে, মাসঊদ ছাহেবের পূর্বে মুসলিম উম্মাহর (খায়রুল কুরূনের যুগ হোক, হাদীছ সংকলনের যুগ হোক কিংবা হাদীছ ব্যাখার যুগ হোক) কোন আলেম এ দাবী করেননি যে, ‘আমাদের নাম স্রেফ মুসলিম’। যদি কারো কাছে মাসঊদ ছাহেবের উল্লিখিত দাবীর ঘোষণা কোন আলেমের পক্ষ থেকে সাব্যস্ত হয়, তবে তিনি যেন দলীল পেশ করেন।
মাসঊদ ছাহেব স্বীয় মনগড়া দাবীর ‘দলীল’ পেশ করেন, هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِين ‘তিনি তোমাদের নাম রেখেছেন ‘মুসলিম’।[26]
জনাব মুহতারাম আবূ জাবের আব্দুল্লাহ দামানভী ছাহেব বলেছেন, ‘এই আয়াত দ্বারা এটা প্রতীয়মান হল যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নাম মুসলিম রেখেছেন’। কিন্তু এই আয়াতের কোথাও এ কথার উল্লেখ নেই যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নাম স্রেফ মুসলিম রেখেছেন। অন্য কথায় মুসলিম ছাড়া অন্য নাম রাখা নিষিদ্ধ। এ কথা কেউই অস্বীকার করতে পারে না যে, মুসলিমই আমাদের সত্তাগত নাম এবং দুনিয়াতে বর্তমানে আমরা এই নামেই পরিচিত। চৌদ্দশ বছর যাবৎ পৃথিবী আমাদের এ নাম সম্পর্কে অবগত আছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত আমরা সেই নামেই পরিচিত হ’তে থাকব। কিন্তু এই নামটি ব্যতীত আল্লাহ তা‘আলা আমাদের আরো অনেক নাম রেখেছেন। যেগুলিকে অস্বীকার করা যায় না’।
মুহতারাম দামানভী ছাহেবের সত্যায়ন : মুহতারাম দামানভী ছাহেব হাফিযাহুল্লাহর দাবীর সত্যায়নে আমরা কুরআন ও হাদীছ থেকে আরো কিছু নাম ও উপাধি পেশ করছি :
১. আল-মুমিন বা আল-মুমিনূন : আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ أَلْقَى إِلَيْكُمُ السَّلَامَ لَسْتَ مُؤْمِنًا تَبْتَغُونَ عَرَضَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ‘যে তোমাদের সালাম করে তাকে বলো না যে তুমি মুমিন নও (অর্থাৎ কারো অন্তর ফেড়ে দেখার চেষ্টা করো না)। তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদ অনুসন্ধান কর’ (নিসা ৪/৯৪)। তিনি আরো বলেছেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই’ (হুজুরাত ৪৯/১০) এবং বলেছেন, قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ ‘নিশ্চয়ই ঐসব মুমিন সফলকাম’ (মুমিনূন ২৩/১)।
২. হিযবুল্লাহ : আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, أَلَا إِنَّ حِزْبَ اللهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ‘জেনে রাখ যে, অবশ্যই হিযবুল্লাহ সফলকাম হবে’ (মুজাদালাহ ৫৮/২২)।
সতর্কীকরণ : হিযবুল্লাহর (আল্লাহর দল) বিপরীতে হিযবুশ শয়তান (শয়তানের দল) রয়েছে এবং হিযবুশ শয়তান বা শয়তানের অনুসারীরাই প্রকৃতপক্ষে ক্ষতির মধ্যে রয়েছে (মুজাদালাহ ৫৮/১৯)।
৩. আউলিয়াউল্লাহ : আল্লাহ বলেন, أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ‘মনে রেখ আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (ইউনুস ১০/৬২)। আউলিয়াউল্লাহর (আল্লাহর বন্ধুরা) বিপরীতে আউলিয়াউশ শয়তান (শয়তানের বন্ধুরা) রয়েছে।
এগুলি ছাড়া নিম্নোক্ত নামগুলিও কুরআন মাজীদ দ্বারা সাব্যস্ত রয়েছে :
১. আল-মুহাজিরীন (তাওবাহ ৯/১০০) ২. আল-আনছার (ঐ) ৩. আস-সাবিকূনাল আউয়ালূন (ঐ) ৪. রববানিইয়ীন (আলে ইমরান ৩/৭৯) ৫. আল-ফুক্বারা (বাক্বারাহ ২/২৭৩) ৬. আছ-ছালেহীন (নিসা ৪/৬৯) ৭. আশ-শুহাদা (ঐ) ৮. আছ-ছিদ্দীক্বীন প্রভৃতি (ঐ)।
ছহীহ হাদীছসমূহেও মুসলমানদের কতিপয় নামের উল্লেখ রয়েছে। যেমন : ১. উম্মাতু মুহাম্মাদ (ছাঃ)।[27] ২. আল-গুরাবা।[28] ৩. ত্বায়েফাহ।[29] ৪. হাওয়ারীইঊন।[30] ৫. আছহাব।[31] ৬. আল-খলীফাহ।[32] ৭. আহলুল কুরআন।[33] ৮. আহলুল্লাহ।[34]
উক্ত দলীলসমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, মুসলমানদের আরও অনেক (গুণবাচক) নাম রয়েছে। যেগুলি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ছাঃ) রেখেছেন। এজন্য ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার প্রতিষ্ঠাতার এ দাবী ভিত্তিহীন এবং মিথ্যা যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের স্রেফ একটি নাম ‘মুসলিম’ রেখেছেন। যদি তিনি বলেন যে, এগুলি গুণবাচক নাম। তবে আরয এই যে, গুণবাচক নামও নাম-ই হয়ে থাকে।
দলীল-১ : আল্লাহ তা‘আলার যাতী বা সত্তাগত নাম ‘আল্লাহ’ এবং তাঁর অসংখ্য গুণবাচক নাম রয়েছে। যেমন :
(১) রব (ফাতিহা ১/১)। (২) আর-রহমান (ঐ)। (৩) আর-রহীম (ঐ)। (৪) ইলাহ (নাস ১৪/৩)। (৫) আল-আলীম (বাক্বারাহ ২/১৩৭)। (৬) আল-ক্বাদীর (রূম ৩০/৫৪)। (৭) আল-মালিক (হাশর ৫৯/২৩)। (৮) আল-কুদ্দূস (ঐ) ইত্যাদি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا ‘আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সুন্দর নাম সমূহ। সে নামেই তোমরা তাঁকে ডাক’ (আ‘রাফ ৭/১৮০)।
তিনি আরো বলেছেন, قُلِ ادْعُوا اللهَ أَوِ ادْعُوا الرَّحْمَنَ أَيًّا مَا تَدْعُوا فَلَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى ‘তুমি বল, তোমরা ‘আল্লাহ’ নামে ডাক বা ‘রহমান’ নামে ডাক, তোমরা যে নামেই ডাকো না কেন, সকল সুন্দর নাম তো কেবল তাঁরই জন্য’ (বনু ইসরাঈল ১৭/১১০)। আল্লাহ তা‘আলার উক্ত গুণবাচক নাম সমূহকেও ‘নাম’-ই বলা হয়েছে।
দলীল-২ : মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সত্তাগত নাম মুহাম্মাদ এবং আহমাদও তাঁর সত্তাগত নাম। কুরআনে বলা হয়েছে, اسْمُهُ أَحْمَدُ ‘তাঁর নাম আহমাদ’ (ছফ্ফ ৬১/৬)।
রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেছেন, أَنَا مُحَمَّدٌ وَأَحْمَدُ وَالْمُقَفِّى وَالْحَاشِرُ
وَنَبِىُّ التَّوْبَةِ وَنَبِىُّ الرَّحْمَةِ ‘আমি মুহাম্মাদ (প্রশংসিত),
আহমাদ (অত্যধিক প্রশংসিত), মুক্বাফফী (শেষ নবী), হাশের (একত্রিতকারী),
নবীয়ে তওবাহ ও নবীয়ে রহমত’।[35]
বাগাবীর
শারহুস সুন্নাহ-তে আছে যে, নবী (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ لِى أَسْمَاءً أَنَا
أَحْمَدُ وَأَنَا مُحَمَّدٌ، وَأَنَا الْمَاحِى الَّذِى يَمْحُو اللهُ بِهِ
الْكُفْرَ، وَأَنَا الْحَاشِرُ الَّذِى يُحْشَرُ النَّاسُ عَلَى قَدَمِى،
وَأَنَا الْعَاقِبُ ‘আমার কিছু নাম রয়েছে। আমি আহমাদ, আমি মুহাম্মাদ, আমি
আল-মাহী, যার দ্বারা আল্লাহ কুফরকে নিশ্চিহ্ন করে দিবেন। আমি আল-হাশের।
আমার পদতলে লোকদেরকে একত্রিত করা হবে এবং আমি আক্বিব (সর্বশেষ নবী)। ইমাম
বাগাবী বলেন, ‘এ হাদীছের বিশুদ্ধতায় সবাই একমত। হাদীছটি ইমাম মুসলিম বর্ণনা
করেছেন’।[36]
এই হাদীছগুলি দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, সাইয়েদুনা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আরোও অনেক নাম রয়েছে। যেমন : আহমাদ, আল-মাহী, আল-হাশের, আল-আক্বিব, আল-মুক্বাফফী, নবীয়ে তওবাহ এবং নবীয়ে রহমত ইত্যাদি।
কুরআন ও হাদীছের উক্ত দলীলসমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, গুণবাচক নামও নাম-ই হয়ে থাকে।
ছাহাবীগণ এবং মুসলিমীন :
১.
হুযায়ফা (রাঃ)-এর সামনে একজন ব্যক্তি মুসলমানদেরকে ‘আল-মুছাল্লূন’
(اَلْمُصَلُّونَ) বা মুছল্লীগণ বলেছিলেন। হুযায়ফা (রাঃ) এর প্রতিবাদ
করেননি; বরং তাকে অনেক ভালো পরামর্শও দিয়েছিলেন।[37]
২. ওমর (রাঃ) বলেন, يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ ‘হে কুরাইশদের দল’।[38]
৩. ওমর (রাঃ) বলেন, يَا مَعْشَرَ الأَنْصَارِ ‘হে আনছারের দল’।[39]
৪. আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) ও অন্য খলীফাগণকে ছাহাবীগণ ‘আমীরুল মুমিনীন’ (أمير المؤمنين) বা মুমিনদের নেতা বলতেন। এ বিষয়টি মুতাওয়াতির বা ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত।
এগুলি ছাড়া আরো অনেক নামও ছাহাবীগণ থেকে প্রমাণিত রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের সবার উপরে সন্তুষ্ট হোন।
আহলুস সুন্নাহ : মুসলিমীন, মুহাদ্দিছীন এবং মুমিনীনকে ‘আহলুস সুন্নাহ’ (অর্থাৎ সুন্নাতের অনুসারী)ও বলা হয়েছে।
দলীল-১ : তাবেঈ
মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (মৃঃ ১১০ হিঃ) বলেছেন,فَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ
السُّنَّةِ فَيُؤْخَذُ حَدِيْثُهُمْ ‘সুতরাং আহলে সুন্নাতের প্রতি লক্ষ্য
করা হ’ত। অতঃপর তাদের হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত’।[40]
সারমর্ম এই যে, ইবনু সীরীন (রহঃ) মুসলমানদের জন্য ‘আহলুস সুন্নাহ’ নামটি ব্যবহার করেছেন।
সতর্কীকরণ : এই নামটি ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার নিকটে অপ্রমাণিত, বিদ‘আত এবং নতুন শরী‘আত তৈরীর শামিল। এজন্য তাদের নিকটে ইবনু সীরীন (রহঃ)-যার ন্যায়পরায়ণতার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ইজমা রয়েছে, তিনি ইসলাম থেকে খারিজ এবং আহলুস সুন্নাহ ফিরক্বার একজন ব্যক্তি বলে গণ্য হবেন (নাঊযুবিল্লাহ)।
এবার লক্ষ্য করুন! তাবেঈ ইবনু সীরীন (রহঃ) (যিনি অসংখ্য ছাহাবীর শিষ্য এবং ছহীহায়েনের অন্যতম প্রধান রাবী) সম্পর্কে কখন ফৎওয়া দেয়া হচ্ছে?!
আহলুস সুন্নাহ বা এ জাতীয় শব্দ নিম্নোক্ত আইম্মায়ে মুসলিমীনও ব্যবহার করেছেন :
১. আইয়ূব আস-সাখতিয়ানী (মৃঃ ১৩১ হিঃ)।[41]
২. যায়েদাহ বিন কুদামাহ।[42] ৩. আহমাদ বিন হাম্বল।[43]
৪. বুখারী।[44] ৫. ইয়াহইয়া ইবনু মা‘ঈন।[45]
৬. আবূ ওবায়েদ ক্বাসেম বিন সাল্লাম।[46]
৭. মুহাম্মাদ বিন নাছর আল-মারওয়াযী।[47]
৮. হাকেম নিশাপুরী।[48]
৯. আহমাদ ইবনুল হুসায়েন আল-বায়হাক্বী (মৃঃ ৪৫৭ হিঃ)।[49]
১০. আবূ হাতিম আর-রাযী (মৃঃ ২৭৭ হিঃ)।
ইমাম আবূ হাতিম (রহঃ) জাহমিয়াদের[50] এই নিদর্শন বর্ণনা করেছেন যে, তারা আহলুস সুন্নাহকে ‘মুশাবিবহা’[51] বলে।[52]
১১. ইমাম আবূ জা‘ফর মুহাম্মাদ ইবনু জারীর আত-ত্বাবারী (মৃঃ ৩১০ হিঃ)।[53]
১২. ফুযায়েল বিন ‘ইয়ায (মৃঃ ১৮৭ হিঃ)।[54]
১৩. শায়খুল ইসলাম আবূ ওছমান ইসমাঈল আছ-ছাবূনী (মৃঃ ৪৪৯ হিঃ)।[55]
১৪. ইবনু আব্দিল বার্র আল-আন্দালুসী (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ)।[56]
১৫. খত্বীব বাগদাদী (শারফু আছহাবিল হাদীছ)।
১৬. আবূ ইসহাক্ব ইবরাহীম বিন মূসা আল-কুরতুবী (মৃঃ ৭৯১ হিঃ)।[57]
১৭. হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ)।[58]
১৮. হাফেয আহমাদ ইবনু হাজার আসক্বালানী (মৃঃ ৮৫২ হিঃ)।[59]
সুন্নী নাম :
১.
হাফেয যাহাবী (রহঃ) একজন বিদ্বান সম্পর্কে বলেছেন, الرازي السني الفقيه
أحد أئمة السنة ‘আর-রাযী একজন সুন্নী, ফক্বীহ এবং আহলুস সুন্নাহর অন্যতম
ইমাম’।[60]
যায়েদাহ বিন কুদামাহ (রহঃ)-কে বহু
ইমাম ‘ছাহেবু সুন্নাহ’ (صاحب سنة) বা হাদীছপন্থী এবং ‘আহলুস সুন্নাহ-এর
অন্তর্ভুক্ত’ (من أهل السنة) বলেছেন।[61]
২. হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) তাক্বরীবুত তাহযীবে (রাবী ক্রমিক ৪২০৮) আব্দুল মালেক বিন ক্বারীব আল-আছমাঈ আল-বাছরী সম্পর্কে বলেছেন, صدوق سني ‘তিনি সত্যবাদী সুন্নী’।
মুহাম্মাদী মাযহাব :
মুহাম্মাদ বিন ওমর আদ-দাঊদী (রহঃ) ইমাম, হাফেয, আল-মুফীদ (উপকারকারী),
মুহাদ্দিছুল ইরাক (ইরাকের মুহাদ্দিছ) ইবনু শাহীন (রহঃ) সম্পর্কে বর্ণনা
করেন যে, وكان إذا ذكر له مذهب أحد، يقول : أنا محمدي المذهب ‘যখন তার
নিকটে কারো মাযহাবের কথা উল্লেখ করা হ’ত তখন তিনি বলতেন, ‘আমি মুহাম্মাদী
মাযহাবের’।[62]
সারসংক্ষেপ : কুরআন, হাদীছ এবং মুসলিম ইমামগণের সর্বসম্মত উক্তিসমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হল যে, মুসলমানদের আরো গুণবাচক নাম রয়েছে। যেগুলি দ্বারা তাদেরকে ডাকা হয়েছে। যেমন : আহলুস সুন্নাহ, আহলুল হাদীছ, সুন্নী, মুহাম্মাদী, হিযবুল্লাহ প্রভৃতি। সুতরাং মাসঊদ ছাহেবের এ দাবী একেবারেই ভিত্তিহীন এবং দলীলবিহীন যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নাম স্রেফ মুসলিম রেখেছেন।
মাসঊদ ছাহেবের নিকটে ‘মুসলিম’ ব্যতীত অন্য সকল নাম (যেমন : আহলুস সুন্নাহ, আহলুল হাদীছ, হিযবুল্লাহ প্রভৃতি) বেঠিক এবং ফিরক্বা। আর তার নিকটে ফিরক্বাবন্দী শিরক, আযাব ও লা‘নত (‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ তথা ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার স্টীকার দ্রষ্টব্য)।
এজন্য আইম্মায়ে মুসলিমীন যেমন তাবেঈ বিদ্বান মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (রহঃ) ও অন্যেরা তার নিকটে ইসলাম থেকে খারিজ এবং মুশরিক সাব্যস্ত হয়েছে। (আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই)।
তাকফীরের ফিৎনা : ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়া নির্লজ্জভাবে মুহাদ্দিছগণকে কাফের আখ্যাদান করছে। কার্যতঃ এরা না কোন মুসলমানকে সালাম করে, আর না তার পিছে ছালাত আদায় করে। তাদের নিকটে স্রেফ ঐ ব্যক্তিই ‘মুসলিম’, যে ব্যক্তি তাদের ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ায় (জামা‘আতুল মুসলিমীন রেজিস্ট্রার্ড) শামিল হয়েছে এবং মাসঊদ ছাহেবের বায়‘আত গ্রহণ করেছে। অন্য কোন ব্যক্তি নিজেকে লক্ষ বার মুসলিম বললেও তারা তাদের অবস্থানেই অবিচল থাকেন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ صَلَّى
صَلاَتَنَا، وَاسْتَقْبَلَ قِبْلَتَنَا، وَأَكَلَ ذَبِيحَتَنَا، فَذَلِكَ
الْمُسْلِمُ الَّذِى لَهُ ذِمَّةُ اللهِ وَذِمَّةُ رَسُولِهِ ‘যে ব্যক্তি
আমাদের মতো ছালাত আদায় করে, আমাদের কেবলার দিকে মুখ ফিরায় এবং আমাদের
যবহকৃত প্রাণী ভক্ষণ করে, সে ব্যক্তি মুসলিম। যার জন্য আল্লাহ এবং তাঁর
রাসূলের যিম্মাদারী রয়েছে’।[63]
আলোচনার অকাট্য ফায়ছালা :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, فَادْعُوا بِدَعْوَى اللهِ الَّذِى سَمَّاكُمُ
الْمُسْلِمِينَ الْمُؤْمِنِيْنَ عِبَادَ اللهِ ‘তোমরা আল্লাহ প্রদত্ত নামে
ডাকো। যিনি তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিমীন, মুমিনীন, ইবাদুল্লাহ (আল্লাহর
বান্দা)’।[64]
এই সনদকে ইবনু খুযায়মাহ, হাকেম ও যাহাবী (রহঃ)ও ছহীহ বলেছেন।[65] ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেছেন, هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ غَرِيبٌ ‘এটি হাসান ছহীহ গরীব হাদীছ’।[66]
ইয়াহইয়া ইবনু আবী কাছীর আবূ ইয়া‘লা ও অন্যদের সনদ সমূহে ‘সামা’ (আমি শুনেছি)-এর কথাও উল্লেখ করেছেন।
ফিরক্বার আলোচনা : ফিরক্বার প্রয়োগ হকপন্থীদের ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে এবং বাতিলপন্থীদের ক্ষেত্রেও। কিন্তু মাসঊদ ছাহেব ঢালাওভাবে বলেন, ‘ফিরক্বাবন্দী শিরক’!
রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেছেন, تَكُونُ فِى أُمَّتِى فِرْقَتَانِ فَتَخْرُجُ مِنْ
بَيْنِهِمَا مَارِقَةٌ يَلِى قَتْلَهُمْ أَوْلاَهُمْ بِالْحَقِّ ‘আমার
উম্মতের মধ্যে দু’টি ফিরক্বা হবে। তারপর তাদের মধ্য থেকে একটি ‘মারিক্বাহ’
(পথভ্রষ্ট ফিরক্বাহ, খারেজীদের দল) বের হবে। তাদের সাথে লড়াই করবে ঐ দলটি,
যেটি হক্বের অধিক নিকটবর্তী হবে’।[67] অন্য বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেছেন,تَفْتَرِقُ أُمَّتِى فِرْقَتَيْنِ فَتَمْرُقُ بَيْنَهُمَا
مَارِقَةٌ فَيَقْتُلُهَا أَوْلَى الطَّائِفَتَيْنِ بِالْحَقِّ ‘আমার উম্মত
দু’টি ফিরক্বায় বিভক্ত হবে এবং তাদের মধ্য থেকে একটি দল বের হবে (অর্থাৎ
গোমরাহ (খারেজী) ফিরক্বা)। উভয় ফিরক্বার মধ্যে যে দলটি হক্বের অধিক
নিকটবর্তী সেটি ঐ গোমরাহ দলকে হত্যা করবে’।[68]
এই ফিরক্বা দু’টি আলী (রাঃ) ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর ফিরক্বা ছিল এবং তাঁদের মধ্য থেকে খারেজীদের জামা‘আত বের হয়েছিল। সেই ‘জামা‘আত’কে আলী (রাঃ) হত্যা করেছিলেন।
প্রতীয়মান হ’ল যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামের দু’টি জামা‘আতকে দু’টি ফিরক্বা আখ্যা দিয়েছেন। অতএব প্রমাণিত হ’ল যে, মুসলমানদের জামা‘আতকে ‘ফিরক্বা’ও বলা হয়েছে। অর্থাৎ নাজী (মুক্তিপ্রাপ্ত) ফিরক্বা। আর এই দু’টি ফিরক্বা (আলী ও মু‘আবিয়ার দল) হক্বের উপরে ছিল।
মূল
: শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ
অনুবাদ
: আহমাদুল্লাহ
সৈয়দপুর, নীলফামারী।
[1]. নাছরুল বারী ফী তাহকীকি জুযইল ক্বিরাআহ লিল-বুখারী, পৃঃ ৮৮ হা/৩৮,।
[2]. মাসআলাতুল ইহতিজাজ বিশ-শাফেঈ, পৃঃ ৪৭, সনদ ছহীহ; যুবায়ের আলী যাঈ, তাহক্বীক্বী মাক্বালাত ১/১৬১।
[3]. তিরমিযী, হা/১০।
[4]. রাবীর হিফয শক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়া, বিবেক-বুদ্ধি দুর্বল হয়ে যাওয়া, হাদীছকে সঠিকভাবে মনে রাখতে না পারায় হাদীছের বাক্যে তালগোল পাকিয়ে যাওয়াকে ইখতিলাত বলা হয়। বিভিন্ন কারণে ইখতিলাত হ’তে পারে। যেমন : বয়স বেড়ে যাওয়া, বই-পুস্তক জ্বলে যাওয়া, ধন-সম্পদের ক্ষতি হওয়া কিংবা সন্তান-সন্ততির মৃত্যু ঘটার কারণে মানসিক আঘাত পাওয়া ইত্যাদি (তায়সীরু মুছত্বলাহিল হাদীছ, পৃঃ ১২৫ প্রভৃতি)।-অনুবাদক।
[5]. দেখুন : আমার গ্রন্থ ‘আল-ফাতহুল মুবীন’, পৃঃ ৭৭-৭৮।
[6]. ‘আমি শ্রবণ করেছি’, ‘আমাকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন’ ‘আমাদেরকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন’, ‘আমাকে সংবাদ প্রদান করেছেন’ কিংবা ‘আমাদেরকে সংবাদ প্রদান করেছেন’ ইত্যাদি শব্দাবলী দ্বারা হাদীছের সনদ বর্ণনা করাকে ‘সামা’ বলা হয় (তায়সীরু মুছত্বলাহিল হাদীছ, পৃঃ ১৫৯ প্রভৃতি)।-অনুবাদক।
[7]. আল-ফাতহুল মুবীন, পৃঃ ৭৭।
[8]. বিস্তারিত আলোচনা দেখুন : আত-তাহরীক, জুন ২০১৫ সংখ্যা, পৃঃ ২৫-৩০।-অনুবাদক।
[9]. ছহীহ মুসলিম, শরহে নববী সহ, ১/৫৫; অন্য আরেকটি সংস্করণ, ১/৫, ২৬।
[10]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ৪/৯৫।
[11]. দেখুন : মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২০/৪০; তাহক্বীক্বী মাক্বালাত, ১/১৬৮।
[12]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৩১১, মুগীরাহ বিন শু‘বাহ (রাঃ) হ’তে।
[13]. মুসলিম হা/১৯২০।
[14]. খতীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ, পৃঃ ২৭, নং ৪৯, সনদ ছহীহ।
[15]. তিরমিযী, ২/৪৩, হা/২১৯২, সনদ ছহীহ।
[16]. তিরমিযী ৪/৫০৫, সুনানে তিরমিযী (আরেযাতুল আহওয়াযী সহ), ৯/৭৪।
[17]. হাকেম, মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ২, সনদ হাসান; ইবনু হাজার আসক্বালানী এটিকে ছহীহ বলেছেন। দ্রঃ ফাৎহুল বারী, ১৩/২৫০, হা/৭৩১১-এর ব্যাখ্যা।
[18]. খত্বীব বাগদাদী, আল-জামে‘, হা/১৮৩, ১/১৪৪, অন্য আরেকটি সংস্করণ ১/১৪৪, হা/১৮৩ সনদ ছহীহ; ইবনুল জাওযী, মানাকিবুল ইমাম আহমাদ, পৃঃ ২০৭-২০৮।
[19]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৩, সনদ ছহীহ।
[20]. উলূমুল হাদীছ, পৃঃ ৩।
[21]. বিস্তারিত দেখুন আমার গ্রন্থ : তাহক্বীক্বী মাক্বালাত ১/১৬১-১৭৪।
[22]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৪, নং ৬, সনদ ছহীহ।
[23]. বুখারী হা/৬৫০২, ৮/১৩১।
[24]. আবুদাঊদ হা/৪৬৮৭, শব্দগুলি তাঁর এবং এর সনদ ছহীহ; মূল হাদীছ রয়েছে ছহীহ মুসলিমে, হা/৬০।
[25]. মাযহাবে আহলুল হাদীছ কী হাকীকাত, পৃঃ ১।
[26]. হজ্জ ২২/৭৮। গৃহীত : ‘আল-মুসলিম’ পত্রিকা ৪র্থ সংখ্যা ৪৬ পৃঃ।
[27]. ছহীহ বুখারী, হা/ ৫২২১, ৬৬৩১; ছহীহ মুসলিম, হা/৯০১।
[28]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৫।
[29]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৩১১; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৬ ইত্যাদি।
[30]. মুসলিম, হা/৫০।
[31]. মুসলিম, হা/৫০।
[32]. আহমাদ, ৫/১৩১, সনদ হাসান।
[33]. আল-মুস্তাদরাক, ১/৫৫৬, হা/২০৪৬, সনদ হাসান; মুসনাদে আবী দাঊদ আত-ত্বায়ালিসী, হা/২১২৪, ‘মাকতাবা শামেলা’ হ’তে।
[34]. ঐ ৭।
[35]. মুসলিম, হা/২৩৫৫।
[36]. শারহুস সুন্নাহ, হা/৩৬৩০, ১৩/২১২।
[37]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, হা/৩৮২৮৯, ১৫/১৭; আল-মুস্তাদরাক, ৪/৪৪৪-৪৪৫; ইমাম হাকেম বলেন, ‘শায়খায়নের শর্তানুযায়ী হাদীছটি ছহীহ। তবে তারা হাদীছটি বর্ণনা করেননি। মানছূর থেকে সুফিয়ান ছাওরীর বর্ণনাটি শক্তিশালী। আর সনদের বাকী অংশটুকু ছহীহ।
[38]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, ১৪/৪৮২, সনদ ছহীহ। আল-হাকাম বিন মীনা ছিক্বাহ বা নির্ভরযোগ্য রাবী।
[39]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, ১৪/৫৬৭, হা/৩৮১৯৯, সনদ হাসান।
[40]. মুসলিম, হা/২৭ অনুচ্ছেদ-৫; দারুস সালাম পাবলিকেশন্সের ক্রমিক নং অনুসারে।
[41]. ইবনু ‘আদী, আল-কামিল, ১/৭৫, সনদ ছহীহ; হিলয়াতুল আওলিয়া ৩/৯; আল-জুযউছ ছানী মিন হাদীছি ইয়াইইয়া ইবনে মা‘ঈন হা/১০২।
[42]. খত্বীব, আল-জামে‘, হা/৭৫৫।
[43]. আল-মুনতাখাব মিন ইলালিল খাল্লাল, হা/১৮৫।
[44]. বুখারী, জুযউ রফয়ে ইয়াদাইন, হা/১৫।
[45]. তারীখু ইবনে মা‘ঈন, দূরীর বর্ণনা, রাবী নং ২৯৫৫, আবুল মু‘তামির ইয়াযীদ বিন তিহমান-এর জীবনী দ্রষ্টব্য।
[46]. আল-আমওয়াল হা/১২১৮, ‘লা তাজ‘আল যাকাতাকা’, কিতাবুল ঈমানের শুরুতে।
[47]. কিতাবুছ ছালাত, হা/৫৮৮।
[48]. আল-মুসতাদরাক, ১/২০১, হা/৩৯৭।
[49]. দেখুন : কিতাবুল ই‘তিক্বাদ ওয়াল হিদায়া ইলা সাবীলির রাশাদ আলা মাযহাবিস সালাফ ওয়া আছহাবিল হাদীছ সহ বায়হাক্বীর অন্যান্য গ্রন্থসমূহ।
[50]. জাহমিয়া একটি ভ্রান্ত ফিরক্বা। জাহম বিন ছাফওয়ান এই ফিরক্বার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আল্লাহর গুণাবলীকে অস্বীকার করতেন। তিনি কুরআনকে সৃষ্ট মনে করতেন। তিনি আরো বলতেন যে, আল্লাহ তা‘আলা সর্বত্র বিরাজমান।
[51]. মুশাবিবহা : যারা রবের সাথে অন্য কিছুকে সাদৃশ্য প্রদান করে। এটি অন্যতম একটি গোমরাহ ফিরক্বা। এই ফিরক্বা দু’টি ভাগে বিভক্ত। ১. যারা স্রষ্টার সত্তার সাথে অন্যের সত্তার সাদৃশ্য প্রদান করে। যেমন: আল্লাহর হাত, মুখমন্ডল আমাদের হাত, মুখমন্ডলের মতই। চরমপন্থী শী‘আগণ যেমন সাবী’আহ, মুগীরীয়াহ ইত্যাদি এই আক্বীদা পোষণ করে। ২. যারা আল্লাহর গুণাবলীকে সৃষ্টির গুণাবলীর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে করে। যেমন : আল্লাহর দর্শন আমাদের দর্শনের ন্যায়। তার শ্রবণ আমাদের শ্রবণের মতই। কার্রামিয়া, হিশামী শী‘আগণ এই শ্রেণীভুক্ত।- অনুবাদক।
[52]. উছূলুদ দ্বীন, পৃঃ ৩৮; তাহক্বীক্বী মাক্বালাত, ২/২৩।
[53]. ত্বাবারী, ছরীহুস সুন্নাহ, পৃঃ ২০।
[54]. হিলয়াতুল আওলিয়া, ৮/১০৩, ১০৪, সনদ ছহীহ; ত্বাবারী, তাহযীবুল আছার, ৭/৪৪, হা/১৯৭৫, সনদ ছহীহ।
[55]. তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘আক্বীদাতুস সালাফ আছহাবিল হাদীছ এবং আর-রিসালাহ ফী ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাহ ওয়া আছহাবিল হাদীছ ওয়াল আইম্মাহ’ দ্রষ্টব্য।
[56]. আত-তামহীদ, ১/৮, ২/২০৯ ইত্যাদি।
[57]. শাত্বিবী, আল-ই‘তিছাম, ১/৬১।
[58]. দেখুন : সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৫/৩৭৪।
[59]. ফাতহুল বারী ১/২৮১-এর বরাতে মাসঊদ আহমাদ, মাযাহিবে খামসাহ, পৃঃ ৩৯।
[60]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১০/৪৪৬।
[61]. দেখুন : তাহযীবুত তাহযীব, ৩/২৬৪।
[62]. খত্বীব, তারীখু বাগদাদ, ১১/২৬৭, সনদ ছহীহ, ওমর বিন আহমাদ বিন ওছমান ওরফে ইবনু শাহীন-এর জীবনী।
[63]. বুখারী, হা/৩৯১।
[64]. মুসনাদে আবী ই‘য়ালা আল-মূছেলী ৩/১৪২; ছহীহ ইবনু হিববান ৮/৪৩।
[65]. ছহীহ ইবনে খুযায়মাহ, হা/১৯৩০; আল-মুসতাদরাক, ১/৪২১, ১১৭, ২৩৬।
[66]. তিরমিযী, হা/২৮৬৩।
[67]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৬৫।
[68]. মুসনাদে আবী ইয়া‘লা আল-মূছিলী, ২/৪৯৯, হা/১৩৪৫, সনদ ছহীহ; ইবনু হিববান তার ছহীহ গ্রন্থে (৮/২৫৯) এবং আহমাদ (হা/১১৩২৬, ৩/৭৯) হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।