সর্বাগ্রে
মুছাফাহার অর্থ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা যথোপযুক্ত মনে হচ্ছে। যাতে
মাসআলাটি বুঝতে সহজ হয়। মুছাফাহা-এর অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে হাফেয ইবনু
হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, هِيَ مُفَاعَلَةٌ مِنَ الصَّفْحَةِ
وَالْمُرَادُ بِهَا الْإِفْضَاءُ بِصَفْحَةِ الْيَدِ إِلَى صَفْحَةِ
الْيَدِ ‘এটা صفحة থেকে বাবে مفاعلة-এর মাছদার বা ক্রিয়ামূল। যার অর্থ
হাতের তালুর সাথে হাতের তালু মিলানো’।[1]
ইবনুল
আছীর (রহঃ) ‘আন-নিহায়া’ গ্রন্থে লিখেছেন,وَمِنْهُ حَدِيثُ المُصَافَحَة
عِنْدَ اللِّقاء وَهِيَ مُفُاعلَة مِنْ إلْصاقِ صَفْح الكَفِّ بالكَفِّ،
وَإِقْبَالِ الوجْه عَلَى الوجْه ‘এক হাতের তালুর ভিতরের অংশের সাথে অন্য
হাতের তালুর ভিতরের অংশ মিলানো এবং পরস্পরের চেহারা মুখোমুখি করা।[2]
মোল্লা
আলী ক্বারী হানাফীও মুছাফাহার অনুরূপ সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তিনি
বলেছেন,اَلْمُصَافَحَةُ: هِيَ الْإِفْضَاءُ بِصَفْحَةِ الْيَدِ إِلَى
صَفْحَةِ الْيَدِ ‘মাছাফাহ হ’ল হাতের তালুর সাথে হাতের তালু মিলানো’।[3]
আল্লামা মুরতাযা যুবায়দী হানাফী কামূসের শরাহ ‘তাজুল আরূস’ গ্রন্থে مصافحة-এর এই অর্থই লিখেছেন যে,
الرَّجُلُ
يُصَافِحُ الرَّجُلَ إِذَا وَضَعَ صَفْحَ كَفِّهِ فِيْ صَفْحِ كَفِّهِ
وَصَفْحَا كَفَّيْهِمَا وَجْهَاهُمَا وَمِنْهُ حَدِيثُ الْمُصَافَحَةِ
عِنْدَ اللِّقَاءِ وَهِيَ مُفَاعَلَةٌ مِنْ إِلْصَاقِ صَفْحِ الْكَفِّ
بِالْكَفِّ وَإِقْبَالِ الْوَجْهِ عَلَى الْوَجْهِ-[4]
প্রকাশ
থাকে যে, মুছাফাহা করা নবী করীম (ছাঃ)-এর সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত। আর এটি
গুনাহ মাফ হওয়ার মাধ্যমও বটে। হযরত বারা বিন আযেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَا مِنْ مُسْلِمَيْنِ يَلْتَقِيَانِ فَيَتَصَافَحَانِ
إِلاَّ غُفِرَ لَهُمَا قَبْلَ أَنْ يَفْتَرِقَا ‘যখন দু’জন মুসলমান পরস্পরে
সাক্ষাৎকালে মুছাফাহা করে তখন তাদের পৃথক হওয়ার পূর্বেই উভয়ের পাপ ক্ষমা
করে দেয়া হয়’।[5]
মুছাফাহা সুন্নাত হওয়া
সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদীছটিও প্রণিধানযোগ্য। হযরত আনাস বিন মালিক (রাঃ)
বর্ণনা করেন,قَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللهِ الرَّجُلُ مِنَّا يَلْقَى
أَخَاهُ أَوْ صَدِيْقَهُ أَيَنْحَنِىْ لَهُ؟ قَالَ لاَ، قَالَ
أَفَيَلْتَزِمُهُ وَيُقَبِّلُهُ قَالَ لاَ قَالَ أَفَيَأْخُذُ بِيَدِهِ
وَيُصَافِحُهُ قَالَ، نَعَمْ. ‘এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের
কেউ তার ভাই বা বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করলে সে কি তার দিকে ঝুঁকবে? রাসূল
(ছাঃ) বললেন, না। সে বলল, তাহ’লে কি সে আলিঙ্গন করবে এবং চুম্বন করবে?
উত্তরে রাসূল (ছাঃ) বললেন, না। পুনরায় সে প্রশ্ন করল, তবে কি সে হাত ধরে
মুছাফাহা করবে? উত্তরে রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ’।[6]
উপরোক্ত
হাদীছদ্বয় মুছাফাহা সুন্নাত হওয়ার দলীল। রাসূল (ছাঃ)-এর অসংখ্য হাদীছ
দ্বারা এটাও প্রমাণিত রয়েছে যে, মুছাফাহা এক হাতে বরং ডান হাত দ্বারা করা
সুন্নাত। হযরত আব্দুল্লাহ বিন বুসর (রাঃ) বলেন,تَرَوْنَ كَفِّى هَذِهِ
فَأَشْهَدُ أَنِّى وَضَعْتُهَا عَلَى كَفِّ مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم
‘তোমরা আমার এই হাতের তালু দেখছ। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি এই হাতের
তালুকে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর হাতের তালুতে রেখেছি’।[7]
মুসনাদে
আহমাদের আরেক বর্ণনায় আছে, হযরত আনাস (রাঃ) বলেন,بَايَعْتُ رَسُولَ اللهِ
صلى الله عليه وسلم بِيَدِى هَذِهِ يَعْنِى الْيُمْنَى عَلَى السَّمْعِ
وَالطَّاعَةِ فِيْمَا اسْتَطَعْتُ ‘আমি আমার এই হাত দ্বারা রাসূল (ছাঃ)-এর
নিকটে সাধ্যমত নেতার কথা শোনার ও মান্য করার উপর বায়‘আত করেছি’।[8]
উপরোক্ত হাদীছ দু’টিতেيد ও كف শব্দের উল্লেখ রয়েছে। যার মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, বায়‘আতের জন্য এক হাত ব্যবহার করা হয়েছে। আর মুছাফাহার জন্যও এটিই সুন্নাতী পদ্ধতি।
ছাহাবায়ে কেরাম সাধারণতঃ নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে আসতেন এবং তাঁর কাছে বায়‘আত ও মুছাফাহা করতেন। হযরত আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
فَلَمَّا جَعَلَ اللهُ الإِسْلاَمَ فِىْ قَلْبِىْ أَتَيْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَقُلْتُ ابْسُطْ يَمِينَكَ فَلأُبَايِعْكَ. فَبَسَطَ يَمِينَهُ قَالَ : فَقَبَضْتُ يَدِى. قَالَ : مَا لَكَ يَا عَمْرُو. قَالَ قُلْتُ أَرَدْتُ أَنْ أَشْتَرِطَ. قَالَ : تَشْتَرِطُ بِمَاذَا. قُلْتُ أَنْ يُغْفَرَ لِى. قَالَ : أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ الإِسْلاَمَ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ-
‘অতঃপর যখন
আল্লাহ আমার মনে ইসলাম গ্রহণের আগ্রহ সৃষ্টি করলেন, তখন আমি নবী করীম
(ছাঃ)-এর নিকটে এসে বললাম, আপনার ডান হাত বাড়িয়ে দিন, আমি আপনার নিকটে
বায়‘আত করতে চাই। তিনি তার ডান হাত বাড়িয়ে দিলে আমি আমার হাত টেনে নিলাম।
নবী করীম (ছাঃ) বললেন, হে আমর! তোমার কি হ’ল? আমি বললাম, আমি কিছু শর্ত
আরোপ করতে চাই। তিনি বললেন, কি শর্ত? আমি বললাম, আল্লাহ যেন আমার গুনাহ
ক্ষমা করে দেন। তিনি বললেন, হে আমর! তুমি কি জান না যে, ইসলাম পূর্ববর্তী
সব গুনাহকে মিটিয়ে দেয়’।[9]
প্রকাশ থাকে যে, হাতের উপর হাত রাখাকে বায়‘আত বলে। মুছাফাহারও এটাই সুন্নাতী তরীকা। মুছাফাহাও এক হাতের তালুর সাথে আরেক হাতের তালু মিলানোকে বলা হয়।[10] এজন্য মুছাফাহারও সুন্নাতী তরীকা সেটাই, যেটা উক্ত হাদীছে উল্লিখিত হয়েছে।
হযরত
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,لَقِيَنِى رَسُوْلُ اللهِ صلى
الله عليه وسلم وَأَنَا جُنُبٌ، فَأَخَذَ بِيَدِىْ، فَمَشَيْتُ مَعَهُ
حَتَّى قَعَدَ فَانْسَلَلْتُ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার সাথে সাক্ষাৎ করলেন,
তখন আমি অপবিত্র ছিলাম। তিনি আমার হাত ধরলেন। তারপর আমি তাঁর সাথে হাঁটতে
থাকলাম। তিনি যখন বসলেন, তখন আমি সরে পড়লাম’।[11]
অন্য
আরেকটি বর্ণনায় নিম্নোক্ত শব্দ আছে, لَقِيتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَنَا جُنُبٌ، فَمَدَّ يَدَهُ إِلَيَّ فَقَبَضْتُ
يَدِي عَنْهُ وَقُلْتُ: إِنِّي جُنُبٌ. فَقَالَ: سُبْحَانَ اللهِ إِنَّ
الْمُسْلِمَ لاَ يَنْجُسُ- ‘আমি অপবিত্র অবস্থায় রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে
সাক্ষাৎ করলাম। তিনি আমার দিকে তাঁর হাত বাড়ালেন আমি তাঁর কাছ থেকে আমার
হাত টেনে নিলাম এবং বললাম, আমি অপবিত্র। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,
সুবহানাল্লাহ। মুসলমান অপবিত্র হয় না’।[12]
উপরোক্ত হাদীছদ্বয়ের শব্দগুলি সম্পর্কে চিন্তা করুন! হাদীছ দু’টিতেই يد শব্দটি একবচন ব্যবহৃত হয়েছে। এজন্য এ দু’টি হাদীছই এক হাতে মুছাফাহা করা সুন্নাত হওয়ার অকাট্য দলীল। উক্ত হাদীছ দু’টি থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, নবী করীম (ছাঃ) মুছাফাহার জন্য তাঁর এক হাত বাড়িয়েছেন। আর দ্বিতীয় হাদীছে একথাও পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে যে, হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) তাঁর যে এক হাতকে মুছাফাহা করার জন্য বাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন অপবিত্রতার কারণে তা টেনে নিয়েছিলেন। এজন্য অধিকাংশ বিদ্বান এই হাদীছগুলিকে এক হাতে মুছাফাহা সম্পর্কে অকাট্য দলীল মনে করেন। এখানে এই ব্যাখ্যারও কোন সুযোগ নেই যে, এটা বায়‘আতের নির্দিষ্ট অবস্থা ছিল। বরং এখানে পারস্পরিক সাক্ষাতের বিষয়টা পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট।
এক হাতে মুছাফাহা সম্পর্কে উল্লেখিত হাদীছগুলি
ছাড়াও আরো অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে কিছু হাদীছে দুর্বলতা থাকায়
মাত্র কয়েকটি হাদীছ উল্লেখ করা হ’ল। আসুন এখানে উক্ত হাদীছগুলির সমর্থনে
কতিপয় হানাফী বিদ্বানের মতও উল্লেখ করছি, যাতে মাসআলাটি একেবারে স্পষ্ট হয়ে
যায়। ফিক্বহে হানাফীর প্রসিদ্ধ ও প্রচলিত গ্রন্থ ‘হেদায়াতে’ আল্লামা
মারগীনানী লিখেছেন, ولا بأس بالمصافحة لأنه هو المتوارث- ‘মুছাফাহা করাতে
কোন দোষ নেই। কারণ এটা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মাসআলা’।[13]
উপরোক্ত উক্তিতে একথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই যে, মুছাফাহা এক হাতে হবে, না দুই হাতে? সেকারণ বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য অন্যান্য ফক্বীহদের মতামতের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যরূরী। আল্লামা ইবনু আবেদীন শামী হানাফী লিখেছেন,
قوله : فان لم يقدر أي علي تقبيله إلا بالإيذاء او مطلقا يضع يديه عليه ثم يقبلهما أو يضع احداهما والاولي أن تكون اليمني لانها المستعملة فيما فيه شرف ولما نقل عن البحر العميق من ان الحجر يمين الله يصافح بها عباده والمصافحة باليمني-
‘এর সারকথা এই যে, যদি মানুষ হাজারে আসওয়াদকে
চুম্বন করতে সক্ষম না হয় তাহ’লে স্বীয় দুই হাত পাথরের উপরে রাখবে। অতঃপর
দুই হাতকে চুম্বন করবে। অথবা স্রেফ এক হাত রাখবে। আর ডান হাত রাখাই
সর্বোত্তম। কেননা যে কোন সম্মানজনক কাজে এই হাতই ব্যবহার করা হয়। কারণ
‘আল-বাহরুল আমীক্ব’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, হাজারে আসওয়াদ আল্লাহর ডান হাত। এর
দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের সাথে মুছাফাহা করেন। আর মুছাফাহা ডান হাত
দ্বারা হয়ে থাকে।[14]
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী
হানাফীর নিম্নোক্ত উক্তিও এক্ষেত্রে লক্ষণীয়,اتفق العلماء علي أنه يستحب
تقديم اليمني في كل ما هو من باب التكريم كالوضوء والغسل و لبس الثوب
والنعل والخف والسراويل ودخول المسجد والسواك والاكتحال وتقليم الأظفار وقص
الشارب ونتف الابط وحلق الرأس والسلام من الصلاة والخروج من الخلاء
والأكل والشرب والمصافحة واستيلام الحجر الأسود والأخذ والإعطاء وغير ذالك
مما هو في معناه ويستحب تقديم اليسار في ضد ذلك- ‘আলেমগণ এ বিষয়ে ঐক্যমত
পোষণ করেছেন যে, যেকোন সম্মানজনক কাজে ডান হাতকে এগিয়ে দেয়া মুস্তাহাব।
যেমন- ওযূ, গোসল, কাপড়, জুতা, মোজা অথবা পাজামা পরিধান করা, মসজিদে প্রবেশ
করা, মিসওয়াক করা, চোখে সুরমা লাগানো, নখ কাটা, গোঁফ ছাঁটা, বগলের লোম তুলে
ফেলা, মাথা মুন্ডন করা, ছালাতে সালাম ফিরানো, পায়খানা থেকে বের হওয়া,
পানাহার, মুছাফাহা করা, হাজারে আসওয়াদকে চুম্বন করা, আদান-প্রদান প্রভৃতি।
এছাড়া অন্যান্য কাজে বাম হাতকে অগ্রবর্তী করা মুস্তাহাব।[15]
উপরোক্ত বক্তব্যের স্পষ্ট মর্ম এই যে, আল্লামা আইনী (রহঃ) মুছাফাহা করার সময় ডান হাত অগ্রসর করাকে মুস্তাহাব আখ্যা দিচ্ছেন। যা সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের অনুকূলে।
আল্লামা যিয়াউদ্দীন হানাফী নকশাবন্দী (রহঃ) স্বীয়
لوامع العقول গ্রন্থে রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছإِذَا الْتَقَى الْمُسْلِمَانِ
فَتَصَافَحَا وَحَمِدَا اللهَ -এর ব্যাখ্যায় বলেন,وَالظَّاهِرُ مِنْ آدَابِ
الشَّرِيعَةِ تَعَيُّنُ الْيُمْنَى مِنَ الْجَانِبَيْنِ لِحُصُولِ
السُّنَّةِ- ‘অর্থাৎ শারঈ আদব থেকে স্পষ্টভাবে এটা বুঝা যায় যে, মুছাফাহা
সুন্নাতী তরীকায় হওয়ার জন্য উভয় পক্ষের ডান হাত নির্ধারিত। যদি উভয়ের বাম
হাত মিলানো হয় অথবা একজনের ডান হাত এবং অন্য জনের বাম হাত তবুও মুছাফাহা
সুন্নাত সম্মত হবে না।[16]
হানাফী ফক্বীহদের গ্রন্থসমূহ থেকে উল্লেখিত উদ্ধৃতি সমূহ দ্বারা একথা স্পষ্ট হচ্ছে যে, ফুক্বাহায়ে কেরাম ডান হাতে মুছাফাহা করাকে সুন্নাত ও মুস্তাহাব মনে করেন। এ ধরনের স্পষ্ট উদ্ধৃতি থাকা সত্ত্বেও কেন কিছু মানুষ এক হাতে মুছাফাহা করাকে ইহুদী-নাছারাদের সাদৃশ্য আখ্যা দিতে গিয়ে এক হাতে মুছাফাহাকারীদেরকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্ত্ততে পরিণত করে?
এক হাতে মুছাফাহা সম্পর্কে ফক্বীহ ও মুহাদ্দিছগণের আরো স্পষ্ট উদ্ধৃতি সমূহ ফিক্বহী বই-পুস্তক সমূহে এবং হাদীছের ব্যাখ্যা গ্রন্থগুলিতে মওজূদ রয়েছে। সংক্ষিপ্ততার দিকে খেয়াল রেখে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করাই যথেষ্ট মনে করা হচ্ছে।
শেষে এই মাসআলাটিও
খোলাসা করা যরূরী যে, ইমাম বুখারী কি দুই হাতে মুছাফাহা করার প্রবক্তা এবং
তিনি স্বীয় ছহীহ বুখারীতে যে হাদীছটি উল্লেখ করেছেন, সেটা কি দুই হাতে
মুছাফাহার দলীল হ’তে পারে? হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন,عَلَّمَنِىْ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم التَّشَهُّدَ
وَكَفِّى بَيْنَ كَفَّيْهِ- ‘রাসূল (ছাঃ) আমাকে তাশাহহুদ শিক্ষা দিয়েছেন।
তখন আমার হাত তার দুই হাতের তালুতে ছিল’।[17]
প্রকাশ থাকে যে, এই হাদীছের সম্পর্ক সাক্ষাতের সময় মুছাফাহার সাথে নয়। বরং এ হাদীছে একথার উল্লেখ রয়েছে যে, নবী করীম (ছাঃ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-কে তাশাহহুদ শিক্ষা দিচ্ছিলেন। আর এটা শিক্ষা দানের সময় ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর এক হাত রাসূল (ছাঃ)-এর দুই হাতের মধ্যে ছিল। বুঝা যাচ্ছে যে, উপরোক্ত অবস্থায় তিন হাতে মুছাফাহা আবশ্যক হচ্ছে। আর এ পদ্ধতির প্রবক্তা দুই হাতে মুছাফাহা করার মত পোষণকারীও নয়। দু’হাতে মুছাফাহার প্রবক্তারা উভয়ের দুই হাতে মুছাফাহার পক্ষে মত পোষণ করেন।
হানাফী ফক্বীহদের
উদ্ধৃতি সমূহ থেকে একথা স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, উপরোক্ত পদ্ধতি শিক্ষা দান
ও মনোযোগ আকর্ষণের জন্য ছিল। হানাফী ফিক্বহের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘হেদায়া’র
পাদটীকায় বলা হয়েছে, أخذ ليكون حاضرا فلا يفوته شيئ ‘নবী করীম (ছাঃ) এজন্য
ইবনু মাসঊদের হাত ধরেছিলেন, যাতে তিনি সচেতন থাকেন এবং রাসূল (ছাঃ)-এর কোন
কথা তার থেকে ছুটে না যায়’।[18]
আল্লামা যায়লাঈ হানাফী (রহঃ) এ ব্যাপারে বলেন, ومنها أنه قال فيه علمني التشهد وكفي بيْن كفيه ولم يقل ذلك في غيره فدل علي مزيد الاعتناء والاهتمام-।[19] অর্থাৎ ইবনু আববাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত তাশাহহুদের উপর ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বর্ণিত তাশাহহুদ সম্পর্কিত বর্ণনা প্রাধান্য পাওয়ার অন্যতম কারণ এই যে, ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেছেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাকে তাশাহহুদ শিক্ষা দিয়েছেন। তখন আমার হাত রাসূল (ছাঃ)-এর দুই হাতের মধ্যে ছিল। এটি অধিক মনোযোগ ও গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে।
এখানে একথা সম্পূর্ণরূপে প্রতীয়মান হ’ল যে, নবী করীম (ছাঃ) কর্তৃক ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর হাত ধরা মুছাফাহার জন্য নয়; বরং গুরুত্ব প্রদান ও নিজের দিকে মনোযোগ আকর্ষণের জন্য ছিল। যাতে কোন কথা ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর স্মৃতিপট থেকে হারিয়ে না যায়।
প্রসিদ্ধ ও সুপরিচিত হানাফী আলেম মাওলানা আব্দুল হাই
লাক্ষ্ণৌবী (রহঃ)ও এমনটাই লিখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ইবনু মাসঊদের হাদীছ একথা
প্রমাণ করে যে, সাক্ষাৎ করার সময় যে মুছাফাহা করা হয় তার দ্বারা তা
উদ্দেশ্য নয়। বরং এই ধরনের হাতে হাত রাখা ঠিক তেমনি ছিল, যেমনটি গুরুজন
ছোটদেরকে কোন কিছু শিক্ষা দেওয়ার সময় তার হাতকে নিজের হাতে ধরে রাখে’।[20]
শিক্ষা দেওয়ার সময় হাত ধরার আরো কিছু বর্ণনা হাদীছের গ্রন্থসমূহে মওজূদ রয়েছে। হযরত মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদীছ এভাবে এসেছে,
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَخَذَ بِيَدِهِ وَقَالَ يَا مُعَاذُ وَاللهِ إِنِّىْ لأُحِبُّكَ وَاللهِ إِنِّىْ لأُحِبُّكَ. فَقَالَ أُوصِيْكَ يَا مُعَاذُ لاَ تَدَعَنَّ فِىْ دُبُرِ كُلِّ صَلاَةٍ تَقُوْلُ اللَّهُمَّ أَعِنِّى عَلَى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ-
‘রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) তার হাত ধরে বললেন, আল্লাহর কসম হে মু‘আয! আমি তোমাকে ভালবাসি
(দু’বার)। তিনি বললেন, হে মু‘আয! আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, তুমি প্রতি
ছালাতের পর এই দো‘আটা পড়তে ছাড়বে না। اَللَّهُمَّ أَعِنِّيْ عَلَى ذِكْرِكَ
وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ، ‘হে আল্লাহ! আপনাকে স্মরণ করার জন্য,
আপনার শুকরিয়া আদায় করার জন্য এবং আপনার সুন্দর ইবাদত করার জন্য আমাকে
সাহায্য করুন’।[21]
এই হাদীছটি একথার স্পষ্ট দলীল যে, আল্লাহর রাসূল ছাহাবায়ে কেরামকে কোন কথা বুঝাতে এবং তাঁর দিকে তাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তাদের হাত ধরতেন। শিক্ষার এ বিশেষ পদ্ধতি হানাফী ফক্বীহদের মাঝেও পাওয়া যায়।
আল্লামা জালালুদ্দীন খাওয়ারিযমী হানাফী হেদায়ার ব্যাখ্যা ‘কেফায়া’র মধ্যে ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর এ বর্ণনাটি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন,
وتأكيد التعليم فانه روي عن محمد بن الحسن أنه قال أخذ أبو يوسف بيدي وعلمني التشهد (وقال) أخذ أبو حنيفة بيدي فعلمني التشهد وقال ابوحنيفة : أخذ حماد بيدي وعلمني التشهد وقال حماد : أخذ علقمة بيدي وعلمني التشهد وقال علقمة : أخذ ابن مسعود بيدي وعلمني التشهد وقال ابن مسعود : أخذ رسول الله صلى الله عليه وسلم بيدي وعلمني التشهد-
‘ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর এই হাদীছটিকে শিক্ষার তাকীদ হিসাবে ধরা
হয়েছে। কারণ মুহাম্মাদ বিন হাসান শায়বানী (রহঃ) বলেন, ইমাম আবু ইউসুফ আমার
হাত ধরে আমাকে তাশাহহুদ শিখিয়েছেন। আবু ইউসুফ বলেছেন, ইমাম আবু হানীফা
আমার হাত ধরে আমাকে তাশাহহুদ শিক্ষা দিয়েছেন। ইমাম আবু হানীফা বলেন,
হাম্মাদ আমার হাত ধরে আমাকে তাশাহহুদ শিখিয়েছেন। হাম্মাদ বলেন, আলক্বামা
আমার হাত ধরে আমাকে তাশাহহুদ শিক্ষা দিয়েছেন। আলক্বামা বলেন, ইবনু মাসঊদ
(রাঃ) আমার হাত ধরে আমাকে তাশাহহুদ শিক্ষা দিয়েছেন। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন,
রাসূল (ছাঃ) আমার হাত ধরে আমাকে তাশাহহুদ শিখিয়েছেন’।[22]
উক্ত বর্ণনায় হানাফী ইমামগণের একে অপরের হাত ধরে তাশাহহুদ শিক্ষা দেয়ার বিষয়টি উপরোক্ত ইবনু মাসঊদের হাদীছের উপর আমল করা। আসলে সব ইমামই উক্ত হাদীছকে শিক্ষা দানের পদ্ধতি হিসাবে গ্রহণ করেছেন। শিক্ষার প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদান ও মনোযোগ আকর্ষণের জন্য এই পদ্ধতিকে স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এখতিয়ার করেছিলেন। এটি প্রচলিত মুছাফাহার সাথে কোনভাবেই সম্পৃক্ত নয়।
পরিশেষে আমরা আমাদের আলোচনাকে এমন একটি হাদীছ দিয়ে শেষ করতে চাই, যেটি উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন,كَانَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم يُحِبُّ التَّيَمُّنَ مَا اسْتَطَاعَ فِى شَأْنِهِ كُلِّهِ فِى طُهُوْرِهِ وَتَرَجُّلِهِ وَتَنَعُّلِهِ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সাধ্যমত তাঁর সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ তথা পবিত্রতা, মাথা অাঁচড়ানো, জুতা পরার ক্ষেত্রে ডান দিক থেকে শুরু করা পসন্দ করতেন।[23] এই হাদীছ থেকে দলীল গ্রহণ করতে গিয়ে হানাফী ফক্বীহদের মধ্য থেকে বড় বড় ইমাম ও ফক্বীহগণ যেমন আল্লামা ইবনু আবেদীন শামী হানাফী, আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী হানাফী, আল্লামা যিয়াউদ্দীন হানাফী প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমূহে এমনকি মুছাফাহার ক্ষেত্রেও ডান হাত অগ্রসর করাকে মুস্তাহাব ও সুন্নাত আখ্যা দিয়েছেন। যা উপরোক্ত উদ্ধৃতি সমূহ থেকে সুস্পষ্ট হ’ল। আল্লাহ আমাদেরকে হক্ব বুঝার ও তা মানার তাওফীক দিন।- আমীন!
[সৌজন্যে : মাসিক মুহাদ্দিছ, জামি‘আ সালাফিইয়াহ, বেনারস, ভারত, ৩৪/১২ সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০১৬, পৃঃ ১৮-২৩]
[1]. ফাৎহুল বারী, ১ম খন্ড, পৃঃ ৫৪, ‘মুছাফাহা’ অনুচ্ছেদ।
[2]. ইবনুল আছীর, আন-নিহায়া, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৮৮।
[3]. মিরক্বাত শরহে মিশকাত, ২য় খন্ড, পৃঃ ৮৪।
[4]. তাজুল আরূস শরহে কামূস, ২য় খন্ড, পৃঃ ১৮১।
[5]. তিরমিযী হা/২৭২৭ ‘অনুমতি প্রার্থনা’ অধ্যায় ‘মুছাফাহার বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ।
[6]. তিরমিযী হা/২৭২৮; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৬০-এর আলোচনা।
[7]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৭৭২৬, ৪/১৮৯; মাওয়ারিদুয যামআন হা/৯৪০; আরনাউত্ব বলেন, হাদীছটির রাবীগণ ছিকাহ (বিশ্বস্ত)। তবে এর সনদ ইযত্বিরাবের দোষে দুষ্ট।
[8]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৭৮৬, ছহীহ লি-গায়রিহি।
[9]. মুসলিম, হা/৩২১।
[10]. &আন-নিহায়াহ ফী গারীবিল হাদীছ, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৪৩।
[11]. বুখারী হা/২৮৫ ‘গোসল’ অধ্যায়।
[12]. শারহু মা‘আনিল আছার, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৬।
[13]. হেদায়া, ২য় খন্ড, পৃঃ ১৫৫ ‘অপসন্দ’ অধ্যায়।
[14]. রাদ্দুল মুহতার হাশিয়া দুর্রুল মুখতার, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৪৪৭। উল্লেখ্য, ‘হাজারে আসওয়াদ আল্লাহর ডান হাত’ মর্মে মারফূ‘, মওকূফ ও মাকতূ সূত্রে বর্ণনা পাওয়া যায়। যার মধ্যে কোনটি মওযূ‘, কোনটি মুনকার, কোনটি যঈফ। (বিস্তারিত দ্রঃ আলবানী, সিলসিলা যঈফাহ হা/২২৩, ২৬৮৬)।
[15]. আন-নিহায়া, ১ম খন্ড, ২৪৮ পৃঃ ‘ওযূ’ অধ্যায়।
[16]. লাওয়ামিউল উকূল-এর বরাতে তুহফাতুল আহওয়াযী ৩/৩৯৭।
[17]. বুখারী হা/৬২৬৫ ‘অনুমতি প্রার্থনা’ অধ্যায়।
[18]. হিদায়া, ১ম খন্ড, পৃঃ ৯৩।
[19]. নাছবুর রায়াহ ১/৪২১।
[20]. মাজমূ‘আ ফাতাওয়া, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৩৪।
[21]. আবুদাঊদ হা/১৫২২; মুসনাদে আহমাদ ৫/২৪৪; হাদীছ ছহীহ।
[22]. কেফায়া শরহে হেদায়া, ১ম খন্ড, পৃঃ ৫৯।
[23]. বুখারী হা/৪২৬ ‘ছালাত’ অধ্যায়; মুসলিম হা/৬১৭ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়।