শর্ত সাপেক্ষে বিতর্ক করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বিতর্কের সময় করণীয় বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। করণীয়গুলো নিম্নে তুলে ধরা হ’ল।-
বিতর্কের সময় করণীয় :
(১) বিতর্কের উত্তম লক্ষ্য স্থির করা :
বিতর্কের উদ্দেশ্য হ’তে হবে উত্তম এবং কল্যাণকর। যদি বিতর্কের উদ্দেশ্য বজায় রাখতে না পারেন, তবে চুপ থাকাই উত্তম কাজ। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا، أَوْ لِيَسْكُتْ، ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং ক্বিয়ামত দিবসে বিশ্বাস রাখে, সে যেন উত্তম কথা বলে, অথবা চুপ থাকে’।[1]
(২) সংযত কথা বলা :
মুখের কথা খুবই বিপজ্জনক। কেননা আমরা যাই বলি তা আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে থাকেন। মহান আল্লাহ বলেন,مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ، ‘সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তা গ্রহণ করার জন্য তার কাছে সদা প্রস্ত্তত প্রহরী রয়েছে’ (ক্বাফ ৫০/১৮)।
আর রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে সতর্ক করে বলেছেন যে,إِنَّ الْعَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ رِضْوَانِ اللهِ لاَ يُلْقِى لَهَا بَالاً، يَرْفَعُ اللهُ بِهَا دَرَجَاتٍ، وَإِنَّ الْعَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ سَخَطِ اللهِ لاَ يُلْقِى لَهَا بَالاً يَهْوِى بِهَا فِى جَهَنَّمَ، ‘নিশ্চয়ই বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টির কোন কথা উচ্চারণ করে অথচ সে কথার গুরুত্ব সম্পর্কে সে জানে না। এ কথার দ্বারা আল্লাহ তার মর্যাদা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেন। আবার বান্দা আল্লাহর অসন্তুষ্টির কোন কথা বলে ফেলে যার পরিণতি সম্পর্কে সে জানে না, অথচ সে কথার কারণে সে জাহান্নামে পতিত হবে’।[2]
(৩) সহজবোধ্য শব্দ ব্যবহার এবং দুর্বোধ্য শব্দ পরিহার :
কথা হবে স্পষ্ট, সহজবোধ্য। হবে দুর্বোধ্য শব্দমুক্ত। প্রয়োজন না হ’লে বিতর্ক পরিহার করতে হবে এবং মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে কিছু বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ রাসূল (ছাঃ) এধরনের কথা অপসন্দ করতেন।
(৪) বুঝার সুবিধার্থে কথার পুনরাবৃত্তি :
কথা হবে শান্ত প্রকৃতির, সুস্পষ্ট, শ্রুতিগোচর এবং সর্বসাধারণের নিকট বোধগম্য। রাসূল (ছাঃ) সকলের বুঝার সুবিধার্থে একটি কথা তিনবার পুনরাবৃত্তি করতেন। তাঁর কথা ছিল সহজ, যা সকলেই বুঝতে পারতেন। হাদীছে এসেছে, عَنْ أَنَسٍ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ كَانَ إِذَا تَكَلَّمَ بِكَلِمَةٍ أَعَادَهَا ثَلاَثًا حَتَّى تُفْهَمَ عَنْهُ- ‘আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন কোন কথা বলতেন তখন তা তিনবার বলতেন, যাতে তা বুঝা যায়’।[3]
(৫) অন্যকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া :
অন্যের কথায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করা যাবে না। কেউ কিছু বলতে চাইলে তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে এবং তাকে তার কথা শেষ করতে দিতে হবে। তার কথা শোনার পর যদি প্রয়োজনীয় কিছু বলার থাকে তবে বলতে হবে। শুধু বলতে চাওয়ার স্বার্থেই কথা বলা যাবে না।
(৬) সত্যগ্রহণ ও মিথ্যা বর্জন :
বিতর্কের সময় অবশ্যই সত্য কথা বলতে হবে এবং মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ মুমিন ব্যক্তি সর্বদা সত্যবাদী হন, কৌতুক করেও মিথ্যা বলেন না। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِى إِلَى الْبِرِّ وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِى إِلَى الْجَنَّةِ وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَصْدُقُ حَتَّى يَكُونَ صِدِّيقًا وَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِى إِلَى الْفُجُورِ وَإِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِى إِلَى النَّارِ وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَكْذِبُ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ كَذَّابًا ‘সত্যবাদিতা নেকীর দিকে পথ প্রদর্শন করে আর নেকী জান্নাতের পথের নির্দেশ করে। কোন মানুষ সত্য কথা রপ্ত করতে থাকলে অবশেষে আল্লাহর কাছে (সত্যবাদী) হিসাবে (তার নাম) লিপিবদ্ধ হয়। আর মিথ্যা পাপের পথে পরিচালিত করে এবং জাহান্নামের দিকে পথ দেখায়। কোন মানুষ মিথ্যা বলতে থাকলে এমনকি আল্লাহর কাছে (তার নাম) মিথ্যাবাদীরূপে লিপিবদ্ধ করা হ’ল।[4]
(৭) জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পরিসীমার মধ্যে কথা বলা :
নিজের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পরিসীমার মধ্যে থেকে কথা বলতে হবে। যে বিষয়ে জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে বিতর্ক করা উচিত নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا ‘যে বিষয়ে তোমার নিশ্চিত জ্ঞান নেই, তার পিছনে ছুটো না। নিশ্চয়ই তোমার কর্ণ, চক্ষু ও বিবেক প্রত্যেকটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’ (বনী ইস্রাঈল ১৭/৩৬)।
(৮) আত্মপ্রশংসা না করা :
বিতর্কের সময় মানুষের সামনে নিজের প্রশংসা করা যাবে না। যে আল্লাহ তা‘আলা নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,فَلَا تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى، ‘অতএব তোমরা আত্মপ্রশংসা কর না। তিনি সর্বাধিক অবগত কে তঁাকে ভয় করে’ (নজম ৫৩/৩২)।
(৯) গীবত তথা পরনিন্দা পরিত্যাগ করা :
গীবত হ’ল কোন মুসলিম ভাইয়ের অগোচরে তার ব্যাপারে এমন আলোচনা করা, যা সে অপসন্দ করে। কথা বলার সময় গীবত তথা পরনিন্দা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। কেননা বিতর্কের সময় সবচেয়ে যে বিষয়টা অধিক চর্চা হয় তা হ’ল গীবত বা পরনিন্দা। গীবত সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ قِيلَ أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِىْ أَخِى مَا أَقُولُ قَالَ إِنْ كَانَ فِيْهِ مَا تَقُولُ فَقَدِ اغْتَبْتَهُ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ فَقَدْ بَهَتَّهُ، ‘(গীবত হ’ল) তোমার ভাই-এর সম্পর্কে এমন কিছু আলোচনা করা, যা সে অপসন্দ করে। রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, আমি যা বলছি তা যদি আমার ভাই-এর মধ্যে থেকে থাকে তবে আপনি কি বলেন? তিনি বললেন, তুমি তার সম্পর্কে যা বলছ তা যদি তার মধ্যে থাকে তাহ’লেই তো তুমি তার গীবত করলে। আর যদি তা তার মধ্যে না থাকে তাহ’লে তো তুমি তার প্রতি অপবাদ আরোপ করলে’।[5] আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে গীবত করতে নিষেধ করেছেন এবং একে নিকৃষ্ট বস্ত্ত তথা আপন ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন’ (হুজুরাত ৪৯/১২)। অতএব এ থেকে বেঁচে থাকা সকলের জন্য অত্যাবশ্যক।
(১০) উত্তম যুক্তি উপস্থাপনা করা :
বিতর্কের সময় উত্তম কিছু যুক্তি শুনিয়ে দেওয়া যায়। যেমন আদম (আঃ) মূসা (আঃ)-এর সামনে উপস্থাপন করেছিলেন। হাদীছের ভাষায়, احْتَجَّ آدَمُ وَمُوسَى فَقَالَ لَهُ مُوسَى يَا آدَمُ أَنْتَ أَبُونَا خَيَّبْتَنَا وَ أَخْرَجْتَنَا مِنَ الْجَنَّةِ قَالَ لَهُ آدَمُ يَا مُوسَى اصْطَفَاكَ اللهُ بِكَلاَمِهِ وَخَطَّ لَكَ بِيَدِهِ أَتَلُومُنِى عَلَى أَمْرٍ قَدَّرَ اللهُ عَلَىَّ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَنِى بِأَرْبَعِينَ سَنَةً فَحَجَّ آدَمُ مُوسَى فَحَجَّ آدَمُ مُوسَى ثَلاَثًا، ‘আদম ও মূসা (আঃ) (পরস্পরে) কথা কাটাকাটি করেন। মূসা (আঃ) বলেন, হে আদম! আপনি তো আমাদের পিতা। আপনি আমাদেরকে বঞ্চিত করেছেন এবং আমাদেরকে জান্নাত থেকে বের করেছেন। আদম (আঃ) মূসা (আঃ)-কে বললেন, হে মূসা! আপনাকে তো আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় কালামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন এবং আপনার জন্য স্বীয় হাত দ্বারা লিখেছেন। অতএব আপনি কি আমাকে এমন একটি ব্যাপার নিয়ে তিরস্কার করছেন? যা আমার সৃষ্টির চল্লিশ বছর পূর্বেই আল্লাহ নির্ধারণ করে রেখেছেন। তখন আদম (আঃ) মূসা (আঃ)-এর উপর এই বিতর্কে জয়ী হ’লেন। উক্ত কথাটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিনবার বলেছেন’।[6]
(১১) বিতর্কে কৌশল অবলম্বন করা :
পবিত্র কুরআনে কাফের-মুশরিকদের মূর্তির অক্ষমতা বুঝানোর জন্য ইবরাহীম (আঃ) যে কৌশল অবলম্বন করেছিলেন সে সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,فَجَعَلَهُمْ جُذَاذًا إِلَّا كَبِيرًا لَهُمْ لَعَلَّهُمْ إِلَيْهِ يَرْجِعُونَ، ‘অতঃপর সে মূর্তিগুলি গুঁড়িয়ে দিল বড়টিকে ছাড়া। যাতে তারা তার কাছে ফিরে যায়’ (আম্বিয়া ২১/৫৮)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,قَالَ بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ هَذَا فَاسْأَلُوهُمْ إِنْ كَانُوا يَنْطِقُونَ، فَرَجَعُوا إِلَى أَنْفُسِهِمْ فَقَالُوا إِنَّكُمْ أَنْتُمُ الظَّالِمُونَ، ‘সে বলল, তাদের এই বড়টাই তো এ কাজ করেছে। অতএব তোমরা ভাঙ্গা মূর্তিগুলিকে জিজ্ঞেস কর যদি তারা কথা বলতে পারে। এতে লজ্জিত হয়ে তারা নিজেরা বলতে লাগল, আসলে তোমরাই তো অত্যাচারী’ (আম্বিয়া ২১/৬৩-৬৪)।
(১২) বিতর্কের সময় ধোঁকায় পতিত না হওয়া :
বিপক্ষীয় ব্যক্তির মন্দ যুক্তিতে কখনোই ধোঁকায় পতিত হওয়া যাবে না। মহান আল্লাহ বলেন, مَا يُجَادِلُ فِي آيَاتِ اللهِ إِلَّا الَّذِينَ كَفَرُوا فَلَا يَغْرُرْكَ تَقَلُّبُهُمْ فِي الْبِلَادِ، ‘আল্লাহর আয়াত সমূহে কেউ বিতর্ক করে না কেবল তারা ব্যতীত যারা এতে অবিশ্বাস করে। পৃথিবীতে এদের অবাধ বিচরণ যেন তোমাকে ধোঁকায় না ফেলে’ (মুমিন ৪০/৪)।
বিতর্কে মন্দ বাক্য শুনলে করণীয় :
যারা অনর্থক বিতর্ক করে কিংবা অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে তাদের এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। মহান আল্লাহ বলেন,وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ وَقَالُوا لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ لَا نَبْتَغِي الْجَاهِلِيْنَ، ‘তারা যখন অসার বাক্য শ্রবণ করে তখন তা উপেক্ষা করে এবং বলে, আমাদের কাজ আমাদের ও তোমাদের কাজ তোমাদের। তোমাদের প্রতি সালাম (অর্থাৎ পরিত্যাগ)। আমরা মূর্খদের সাথে কথায় জড়াতে চাই না (ক্বাছাছ ২৮/৫৫)।
সুতরাং যারা অনর্থক বিতর্ক করে তাদের এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। কেননা মহান আল্লাহ বলেন,وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا، ‘রহমান (দয়াময়)-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ লোকেরা (বাজে) সম্বোধন করে, তখন তারা বলে ‘সালাম’ (ফুরক্বান ২৫/৬৩)।
দ্বন্দ্ব-কলহ আল্লাহর নিকট খুবই অপসন্দনীয়। মহান আল্লাহ বলেন,وَقَالُوا أَآلِهَتُنَا خَيْرٌ أَمْ هُوَ مَا ضَرَبُوهُ لَكَ إِلَّا جَدَلًا بَلْ هُمْ قَوْمٌ خَصِمُونَ، ‘আর তারা বলে, আমাদের উপাস্যরা শ্রেষ্ঠ, না সে? তারা কেবল তোমার সাথে ঝগড়ার জন্যই একথা বলে। বরং তারা হ’ল ঝগড়াকারী সম্প্রদায়’ (যুখরুফ ৪৩/৫৮)।
মুসলমানদের সাথে বিতর্ক পরিহার করা :
মুসলমানদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হবে বিতর্ক বা ঝগড়া পরিহার করা। মহান আল্লাহ বলেন,وَأَطِيعُوا اللهَ وَرَسُولَهُ وَلا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ وَاصْبِرُوا إِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِينَ، ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। আপোষে ঝগড়া কর না। তাহ’লে তোমরা হীনবল হবে ও তোমাদের শক্তি উঠে যাবে। তোমরা ধৈর্য ধারণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে থাকেন’ (আনফাল ৮/৪৬)।
আর পরস্পর বিরোধিতার ফলে অন্তরগুলি বিভক্ত হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَلاَ تَخْتَلِفُوا فَتَخْتَلِفَ قُلُوبُكُمْ ‘তোমরা পরস্পরের বিরোধিতা কর না; তাহ’লে তোমাদের অন্তরগুলি বিভক্ত হয়ে যাবে’।[7] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَلاَ تَخْتَلِفُوا، فَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمُ اخْتَلَفُوا فَهَلَكُوا ‘তোমরা মতবিরোধ বা পরস্পরের বিরোধিতা কর না; কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীগণ মতবিরোধের কারণেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে’।[8]
যারা জেনে বুঝে বাতিল বিষয় নিয়ে বিতর্ক করবে তাদের পরিণতি হবে ভয়াবহ। নিম্নে বিতর্কের মর্মান্তিক পরিণতির কয়েকটি দিক তুলে ধরা হ’ল।
(১) অজ্ঞতাপূর্ণ ও দলীল বিহীন বিতর্কের পরিণতি :
যে কোন বিষয়ে যথার্থ জ্ঞান ছাড়া বিতর্ক করা অজ্ঞতার শামিল। এর পরিণামও ভয়াবহ। মহান আল্লাহ বলেন,وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُجَادِلُ فِي اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَلا هُدًى وَلا كِتَابٍ مُنِيْرٍ ثَانِيَ عِطْفِهِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللهِ لَهُ فِي الدُّنْيَا خِزْيٌ وَنُذِيقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَذَابَ الْحَرِيقِ ذَٰلِكَ بِمَا قَدَّمَتْ يَدَاكَ وَأَنَّ اللهَ لَيْسَ بِظَلَّامٍ لِلْعَبِيدِ ‘অথচ কিছু মানুষ আল্লাহ সম্পর্কে বাক-বিতন্ডা করে কোনরূপ জ্ঞান, পথনির্দেশ ও উজ্জ্বল কিতাব ছাড়াই। সে (অহংকার বশে) ঘাড় বাঁকিয়ে লোকদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য বাক-বিতন্ডা করে থাকে। তার জন্য লাঞ্ছনা রয়েছে দুনিয়াতে এবং ক্বিয়ামতের দিন আমরা তাকে জ্বলন্ত আগুনের শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাব’ (হজ্জ ২২/৮-১০)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُجَادِلُ فِي اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَلا هُدًى وَلا كِتَابٍ مُنِيرٍ وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنْزَلَ اللهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ الشَّيْطَانُ يَدْعُوهُمْ إِلَى عَذَابِ السَّعِيْرِ، ‘মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা কোনরূপ জ্ঞান, পথনির্দেশ বা উজ্জ্বল কিতাব ছাড়াই আল্লাহ সম্পর্কে ঝগড়া করে। যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তোমরা তা অনুসরণ কর। তখন তারা বলে, বরং আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের যে বিষয়ের উপর পেয়েছি, তারই অনুসরণ করব। শয়তান যদি তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তির দিকে আহবান করে, তবুও কি তারা এটা বলবে? (লোক্বমান ৩১/২০-২১)।
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُجَادِلُ فِي اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّبِعُ كُلَّ شَيْطَانٍ مَرِيْدٍ كُتِبَ عَلَيْهِ أَنَّهُ مَنْ تَوَلاَّهُ فَأَنَّهُ يُضِلُّهُ وَيَهْدِيهِ إِلَى عَذَابِ السَّعِيرِ، ‘কিছু মানুষ অজ্ঞতাবশে আল্লাহ সম্পর্কে ঝগড়া করে এবং অবাধ্য শয়তানের অনুসরণ করে। শয়তান সম্পর্কে একথাই লিপিবদ্ধ হয়েছে যে, যে ব্যক্তি তার সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাকে পথভ্রষ্ট করবে এবং তাকে জাহান্নামের শাস্তির দিকে পরিচালিত করবে’ (হজ্জ ২২/৩-৪)।
(২) তাক্বদীর নিয়ে বিতর্ক না করা :
তাক্বদীর নিয়ে বিতর্ক করতে নিষেধ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَنَحْنُ نَتَنَازَعُ فِى الْقَدَرِ فَغَضِبَ حَتَّى احْمَرَّ وَجْهُهُ حَتَّى كَأَنَّمَا فُقِئَ فِى وَجْنَتَيْهِ الرُّمَّانُ فَقَالَ أَبِهَذَا أُمِرْتُمْ أَمْ بِهَذَا أُرْسِلْتُ إِلَيْكُمْ إِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ حِينَ تَنَازَعُوا فِى هَذَا الأَمْرِ عَزَمْتُ عَلَيْكُمْ أَلاَّ تَتَنَازَعُوا فِيهِ- আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের কাছে বের হয়ে আসলেন। আমরা তখন তাকদীর বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক করছিলাম। তিনি অত্যন্ত রাগান্বিত হ’লেন। এমনকি তাঁর চেহারা লাল হয়ে উঠল, তাঁর দুই কপোলে যেন ডালিম নিংড়ে ঢেলে দেওয়া হয়েছে। তিনি বললেন, এই বিষয়েই কি তোমরা নির্ধারিত হয়েছ? আর এই নিয়েই কি আমি তোমাদের নিকটে প্রেরিত হয়েছি? তোমাদের পূর্ববর্তীরা যখন এ বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে তখনই তারা ধ্বংস হয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে তোমাদের বলছি, তোমরা যেন এ বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত না হও’।[9]
(৩) কুরআন ও কুরআনের আয়াত নিয়ে বিতর্ক ও পরিণতি :
(ক) কুরআনের আয়াত নিয়ে বিতর্ক ও এর পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,الَّذِينَ يُجَادِلُونَ فِي آيَاتِ اللهِ بِغَيْرِ سُلْطَانٍ أَتَاهُمْ كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللهِ وَعِنْدَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا كَذَلِكَ يَطْبَعُ اللهُ عَلَى كُلِّ قَلْبِ مُتَكَبِّرٍ جَبَّارٍ، ‘যারা নিজেদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত কোন প্রমাণ ছাড়াই আল্লাহর আয়াতসমূহ নিয়ে বিতর্ক করে, তাদের এ কাজ আল্লাহ ও মুমিনদের নিকট বড়ই ক্রোধাত্মক। এভাবেই আল্লাহ প্রত্যেক অহংকারী ও উদ্ধত ব্যক্তির অন্তরে মোহর মেরে দেন’ (মুমিন ৪০/৩৫)।
(খ) আল্লাহ তা‘আলার কিতাব মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা মোটেও বৈধ নয়। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত নবী করীম (ছাঃ) বলেন, الْمِرَاءُ فِي الْقُرْآنِ كُفْرٌ، কুরআন নিয়ে বিতর্ক করা কুফরী’।[10]
একদা কুরআনী কোন বিষয় নিয়ে কিছু ছাহাবীকে বিতর্ক করতে দেখে নবী করীম (ছাঃ) বললেন,مَهْلًا يَا قَوْمِ بِهَذَا أُهْلِكَتْ الْأُمَمُ مِنْ قَبْلِكُمْ بِاخْتِلَافِهِمْ عَلَى أَنْبِيَائِهِمْ وَضَرْبِهِمُ الْكُتُبَ بَعْضَهَا بِبَعْضٍ إِنَّ الْقُرْآنَ لَمْ يَنْزِلْ يُكَذِّبُ بَعْضُهُ بَعْضًا بَلْ يُصَدِّقُ بَعْضُهُ بَعْضًا فَمَا عَرَفْتُمْ مِنْهُ فَاعْمَلُوا بِهِ وَمَا جَهِلْتُمْ مِنْهُ فَرُدُّوهُ إِلَى عَالِمِهِ، ‘থাম হে লোক সকল! নবীদের ব্যাপারে মতভেদ এবং কিতাবের একাংশকে অন্য অংশের সাথে সংঘর্ষ সৃষ্টি করে তোমাদের পূর্বের বহু জাতি ধ্বংস হয়েছে। কুরআন এভাবে অবতীর্ণ হয়নি যে, তার একাংশ অন্য অংশকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে। বরং তার একাংশ অন্য অংশকে সত্যায়ন করে। সুতরাং যা তোমরা বুঝতে পার, তার উপর আমল কর এবং যা বুঝতে পার না, তা তার জ্ঞানীর দিকে ফিরিয়ে দাও’।[11]
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (রাঃ) বলেছেন,لَا تُجَادِلُوْا بِالْقُرْآنِ وَلَا تُكَذِّبُوْا كِتَابَ اللهِ بَعْضَهُ بِبَعْضٍ فَوَاللهِ إِنَّ الْمُؤْمِنَ لَيُجَادِلُ بِالْقُرْآنِ فَيُغْلِبُ وَإِنَ الْمُنَافِقَ لِيُجَادِلُ بِالْقُرْآنِ فَيَغْلِبُ، ‘তোমরা কুরআন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক কর না এবং আল্লাহর কিতাবের কিছু অংশ দ্বারা কিছু অংশকে মিথ্যাজ্ঞান কর না। আল্লাহর কসম! মুমিন কুরআন নিয়ে বিতর্ক করলে পরাজিত হবে এবং মুনাফিক কুরআন নিয়ে বিতর্ক করলে বিজয়ী হবে’।[12]
(৪) জ্ঞানীদের বিতর্ক ও পরিণতি :
প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি বিতর্কে জড়ায় না। আর বিতর্ক করার জন্য ইলম শিক্ষা করাও বৈধ নয়। ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُمَارِيَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ لِيُبَاهِيَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيَصْرِفَ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ فَهُوَ فِي النَّارِ، ‘যে ব্যক্তি মূর্খ লোকদের সাথে ঝগড়া করার জন্য অথবা আলেমদের উপর বাহাদুরী প্রকাশের জন্য অথবা তার প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জ্ঞানার্জন করে, সে জাহান্নামী’।[13] অপর হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ لِيُبَاهِيَ بِهِ الْعُلَمَاءَ وَيُمَارِيَ بِهِ السُّفَهَاءَ وَيَصْرِفَ بِهِ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللهُ جَهَنَّمَ، ‘যে ব্যক্তি আলেমদের উপর বাহাদুরী যাহির করার জন্য, নির্বোধদের সাথে ঝগড়া করার জন্য এবং নিজের দিকে সাধারণ মানুষের মনোযোগ আকৃষ্ট করার জন্য জ্ঞানার্জন করে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন’।[14]
জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,لاَ تَعَلَّمُوا الْعِلْمَ لِتُبَاهُوا بِهِ الْعُلَمَاءَ وَلاَ لِتُمَارُوا بِهِ السُّفَهَاءَ وَلاَ تَخَيَّرُوا بِهِ الْمَجَالِسَ فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَالنَّارُ النَّارُ، ‘তোমরা আলেমদের উপর বাহাদুরী প্রকাশের জন্য, নির্বোধদের সাথে ঝগড়া করার জন্য এবং জনসভার উপর বড়ত্ব প্রকাশ করার জন্য ইলম শিক্ষা কর না। যে ব্যক্তি এরূপ করবে, তার জন্য রয়েছে আগুন আর আগুন’।[15]
বিতর্কে অনেক সময় হককে বাতিল প্রতিপন্ন করা হয়। আর সেক্ষেত্রে ভ্রষ্টতা ছাড়া কিছু লাভ হয় না। সত্য জানার পরেও শুধু প্রতিপক্ষের উপর বিজয়ী হওয়ার উদ্দেশ্যে অথবা ব্যক্তি, দল, মত, বংশ ইত্যাদির স্বার্থে অন্যায় জেনেও তার সমর্থনে তর্ক-বিতর্ক গোমরাহীর একটি কারণ। আবু উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَا ضَلَّ قَوْمٌ بَعْدَ هُدًى كَانُوا عَلَيْهِ إِلَّا أُوتُوا الْجَدَلَ ثُمَّ تَلَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هَذِهِ الْآيَةَ مَا ضَرَبُوهُ لَكَ إِلَّا جَدَلًا بَلْ هُمْ قَوْمٌ خَصِمُونَ ‘কোন জাতি হেদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার পরে গোমরাহ হয় না যতক্ষণ না তারা তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) এই আয়াত পাঠ করলেন,مَا ضَرَبُوهُ لَكَ إِلَّا جَدَلًا بَلْ هُمْ قَوْمٌ خَصِمُونَ، ‘তারা তোমার সামনে যে উদাহরণ পেশ করে, তা কেবল বিতর্কের জন্যই করে। বস্তুতঃ তারা হ’ল এক বিতর্ককারী সম্প্রদায়’ (যুখরুফ ৪৩/৫৮)।[16]
বিতর্কে বাড়াবাড়ি হ’লে ক্ষমা চাওয়া :
বিতর্কে যদি কোন প্রকার বাড়াবাড়ি হয়েও যায় সেক্ষেত্রে ক্ষমা চাইতে হবে এবং তাৎক্ষণিক সে বিষয় মীমাংসা করে নিতে হবে। যাতে করে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে কোন প্রকার চিড় না ধরে। আবুদদারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আবু বকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ)-এর মধ্যে বিতর্ক হয়েছিল। আবুবকর (রাঃ) ওমর (রাঃ)-কে রাগিয়ে দিলেন। এরপর রাগান্বিত অবস্থায় ওমর (রাঃ) সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। আবুবকর (রাঃ) তার কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং তার পিছু ছুটলেন। কিন্তু ওমর (রাঃ) ক্ষমা করলেন না, বরং তাঁর সম্মুখে দরজা বন্ধ করে দিলেন। এরপর আবুবকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে আসলেন। আবুদদারদা (রাঃ) বলেন, আমরা তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে ছিলাম। ঘটনা শোনার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তোমাদের এই সাথী আবুবকর (রাঃ) অগ্রে কল্যাণ লাভ করেছে। তিনি বলেন, এতে ওমর লজ্জাবোধ করলেন এবং সালাম করে নবী করীম (ছাঃ)-এর পাশে বসে পড়লেন ও ইতিবৃত্ত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে সব বর্ণনা করলেন। আবুদদারদা (রাঃ) বলেন, এতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অসন্তুষ্ট হ’লেন। আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) বারবার বলছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি অধিক দোষী ছিলাম। অতঃপর রাসূলুললাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরা আমার জন্য আমার সাথীর ত্রুটি উপেক্ষা করবে কি? তোমরা আমার জন্য আমার সাথীর ত্রুটি উপেক্ষা করবে কি? এমন একদিন ছিল যখন আমি বলেছিলাম, ‘হে লোক সকল! আমি তোমাদের সকলের জন্য রাসূল, তখন তোমরা বলেছিলেন, ‘তুমি মিথ্যা বলেছ’ আর আবুবকর (রাঃ) বলেছিল, ‘আপনি সত্য বলেছেন’।[17]
বিতর্ক পরিহারে করণীয়
(১) অনর্থক কথা-বার্তা না বলা :
প্রয়োজন ছাড়া যে কোন ধরনের কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مِنْ حُسْنِ إِسْلاَمِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لاَ يَعْنِيهِ، ‘মানুষের জন্য ইসলামের সৌন্দর্য হচ্ছে তার অনর্থক কথাবার্তা পরিহার করা’।[18]
(২) বিতর্কপ্রিয় লোকদের বর্জন করা :
যারা তর্ক-বিতর্কে সব সময় জড়িয়ে পড়ে তাদেরকে এড়িয়ে চলতে হবে। কেননা হিশাম হাসান (রহঃ) ইবনু সীরীন (রহঃ) হ’তে বর্ণনা করেন তারা উভয়ে বলতেন,لاَ تُجَالِسُوا أَصْحَابَ الأَهْوَاءِ وَلاَ تُجَادِلُوهُمْ وَلاَ تَسْمَعُوا مِنْهُمْ، ‘তোমরা প্রবৃত্তির অনুসারীদের নিকটে বসবে না এবং তাদের সাথে ঝগড়া-বিতর্কে লিপ্ত হবে না। এমনকি তাদের নিকট থেকে কিছু শুনবে না’।[19]
(৩) যে কোন বিষয় সহজ করে নেওয়া :
কোন বিষয়কেই কঠিন করে নেওয়া যাবে না। বিবাদীয় বিষয়গুলি সহজ করে নিলে সমাধান হয়ে যাবে। কেননা রাসূল (ছাঃ) যখন ছাহাবীদেরকে কোন কাজে পাঠাতেন তখন বলতেন, بَشِّرُوا وَلاَ تُنَفِّرُوا وَيَسِّرُوا وَلاَ تُعَسِّرُوا ‘তোমরা লোকদের সুসংবাদ দিবে, দূরে ঠেলে দিবে না, আর সহজ করবে, কঠিন করবে না’।[20]
(৪) নেকীর কথা স্মরণ করা :
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,وَيَاسَرَ الشَّرِيكَ وَاجْتَنَبَ الْفَسَادَ فَإِنَّ نَوْمَهُ وَنَبْهَهُ أَجْرٌ كُلُّهُ ‘যে ব্যক্তি সঙ্গীর সহায়তা করে, ঝগড়া-ফাসাদ ও অপকর্ম হ’তে বেঁচে থাকে, তার নিদ্রা ও জাগ্রত অবস্থার সব কিছুই নেকীতে পরিণত হয়’।[21]
(৫) উত্তম সাথী হওয়া :
যে কোন ব্যক্তির উত্তম সাথী হ’তে হ’লে তার বিরোধিতা ও ঝগড়া-বিবাদ ছেড়ে দিতে হবে। তবেই উত্তম সাথী হওয়া যাবে। হাদীছে এসেছে,
عَنِ السَّائِبِ قَالَ أَتَيْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَجَعَلُوا يُثْنُونَ عَلَىَّ وَيَذْكُرُونِى فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَنَا أَعْلَمُكُمْ يَعْنِى بِهِ. قُلْتُ صَدَقْتَ بِأَبِى أَنْتَ وَأُمِّى كُنْتَ شَرِيكِى فَنِعْمَ الشَّرِيكُ كُنْتَ لاَ تُدَارِى وَلاَ تُمَارِى
সায়েব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি নবী (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে শুনতে পাই যে, লোকেরা আমার সম্পর্কে আলোচনা করছে এবং আমার প্রশংসা করছে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আমি তার সম্পর্কে তোমাদের চাইতে অধিক অবগত। তখন আমি বলি, আমার বাপ-মা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক! আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনি আমার উত্তম সাথী ছিলেন। আপনি আমার সাথে কোন দিন বিরোধিতা এবং ঝগড়া-ফাসাদ করেননি’।[22]
(৬) তিন দিনের মধ্যে সমাধান করে নেওয়া :
কোন কারণে কারো সাথে বিতর্ক বা ঝগড়া হয়ে গেলে তিন দিনের মধ্যে সমাধান করে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে যে আগে সালাম দিবে সেই উত্তম। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,لاَ يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقَ ثَلاَثٍ، يَلْتَقِيَانِ فَيَصُدُّ هَذَا، وَيَصُدُّ هَذَا، وَخَيْرُهُمَا الَّذِى يَبْدَأُ بِالسَّلاَمِ، ‘কোন মুসলমানের পক্ষে তার কোন ভাইয়ের সাথ তিন দিনের বেশী এমনভাবে সম্পর্কচ্ছেদ করে থাকা বৈধ নয় যে, তারা দু’জনের দেখা-সাক্ষাৎ হ’লেও একজন এদিকে, অপরজন অন্য দিকে চেহারা ফিরিয়ে নেয়। তাদের মধ্যে উত্তম ঐ ব্যক্তি যে প্রথম সালাম করবে’।[23]
উপসংহার :
আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে সেসব বিষয়ে বারণ করেছেন, যাতে বান্দার বর্তমান বা ভবিষ্যতে কোন ক্ষতি রয়েছে। তিনি মানুষকে বিতর্ক করতে নিষেধ করেছেন। কেননা এটা অনেক অনিষ্টের কারণ। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে মন্দ বিতর্ক থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!
আসাদুল্লাহ
এম.এ. দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
[1]. বুখারী হা/৬৪৭৬; মুসলিম হা/৭৭; ইবনু মাজাহ হা/৩৬৭২।
[2]. বুখারী হা/৬৪৭৮; মিশকাত হা/৪৮১৩।
[3]. বুখারী হা/৯৫; মিশকাত হা/২০৮; ছহীহাহ হা/৩৪৭৩।
[4]. বুখারী হা/৬০৯৪; মুসলিম হা/২৬০৭; মিশকাত হা/৪৮২৪।
[5]. মুসলিম হা/২৫৮৯; আবূদাঊদ হা/৪৮৭৪; মিশকাত হা/৪৮২৮।
[6]. বুখারী হা/৬৬১৪; মুসলিম হা/২৬৫২; ইবনু মাজাহ হা/৮০।
[7]. মুসলিম হা/৪৩২; আবূদাঊদ হা/৬৭৫; তিরমিযী হা/২২৮।
[8]. বুখারী হা/৩৪৭৬;
[9]. তিরমিযী হা/২১৩৩; মিশকাত হা/৯৮।
[10]. আবূদাঊদ হা/৪৬০৩; আহমাদ হা/৭৯৭৬; মিশকাত হা/২৩৬।
[11]. আহমাদ হা/৬৭০২, সনদ ছহীহ।
[12]. ছহীহাহ হা/৩৪৪৭।
[13]. ইবনু মাজাহ হা/২৫৩; সুনানুদ দারিমী হা/৩৭৪।
[14]. ইবনু মাজাহ হা/২৬০।
[15]. ইবনু মাজাহ হা/২৫৪; ছহীহুত তারগীব হা/১০২।
[16]. তিরমিযী হা/৩২৫৩, ইবনু মাজাহ হা/৪৮, ছহীহ আত-তারগীব হা/১৩৭; মিশকাত হা/১৮০, হাদীছ হাসান।
[17]. বুখারী হা/৪৬৪০।
[18]. মুসলিম হা/১৫৯৯; তিরমিযী হা/২৩১৭; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭৬।
[19]. সুনান আদ-দারেমী হা/৪০১, সনদ ছহীহ।
[20]. মুসলিম হা/১৭৩২; আবূদাঊদ হা/৪৭৯৪; মিশকাত হা/৩৭২২।
[21]. আবূদাঊদ হা/২৫১৫; নাসাঈ হা/৩১৮৮; মিশকাত হা/৩৮৪৬।
[22]. আবূদাঊদ হা/৪৮৩৬।
[23]. বুখারী হা/৬২৩৭; মুসলিম হা/২৫৬০; আবূদাঊদ হা/৪৯১১।