ভূমিকা :
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সৃষ্টিকুলের প্রতিপালক। আর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হৌক নবী-রাসূলকুলের শ্রেষ্ঠজন আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল ছাহাবীর উপর।
অতঃপর আমাদের জানা কর্তব্য যে, ঈমান দু’ভাগে বিভক্ত : অর্ধেক শোকর এবং অর্ধেক ছবর। অতএব যে ব্যক্তি নিজ জীবনের কল্যাণ কামনা করে, জীবনের জন্য দুনিয়া-আখিরাতে মুক্তি ভালবাসে এবং সৌভাগ্যকে প্রাধান্য দেয় তার জন্য এই দু’টি মৌলিক বিষয়কে উপেক্ষা করা মোটেও উচিত নয়। এই মধ্যপথ দু’টি থেকে দূরে সরে যাওয়াও তার জন্য সমীচীন নয়। বরং এ দু’টি রাস্তা ধরেই তাকে আল্লাহর দিকে যাত্রা করতে হবে। যাতে কিয়ামত দিবসে মহান আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময় তিনি তাকে দু’টি দলের উত্তম দলে জায়গা দেন।
শোকর সেসব সৌভাগ্যবানের জীবনের শ্রেষ্ঠ দিক, যারা কেবল শোকর আদায়ের মাধ্যমে তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যে আরোহণ করতে সমর্থ হয়েছেন। তারা ছবর ও শোকরের ডানায় ভর করে জান্নাতুন নাঈমের পথের যাত্রী হয়েছেন। এটা মহান আল্লাহর অনুগ্রহ। যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন। আল্লাহ তো মহা অনুগ্রহশীল। তাই আমাদের একান্ত কর্তব্য শোকরের সাথে পরিচিত হওয়া। শোকরের অর্থ কী? তার বিধান কী? তার ফলাফল কী? কোন কোন প্রক্রিয়ায় শোকর করা যায়? ইত্যাদি আমাদের জানতে হবে।
প্রিয় পাঠক! এসব প্রশ্নের উত্তর আপনি এই মূল্যবান পুস্তিকার মাঝে লিপিবদ্ধ পাবেন। পুস্তিকাটি অন্তরের আমল সমূহ সিরিজ (سلسلة أعمال القلوب)-এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে একটি শিক্ষা মজলিসে সিরিজভুক্ত বিষয়গুলির উপর বক্তৃতা দানের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এটি তৈরীতে যাদ গ্রুপের একদল নিবেদিতপ্রাণ কর্মী আমার সঙ্গে শরীক ছিলেন। আজ এটি পুস্তকাকারে প্রকাশ পাচ্ছে।
পরিশেষে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা জানাই, তিনি যেন আমাদেরকে ঐ শ্রেণীর লোকদের অন্তর্ভুক্ত করেন, যারা কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে এবং তন্মধ্যস্থিত উত্তমগুলো মেনে চলে। আর যেন আমাদেরকে শুকরিয়া আদায়কারীদের শ্রেণীভুক্ত করেন, অকৃতজ্ঞদের শ্রেণীভুক্ত না করেন। সাহায্য-সহযোগিতার কেন্দ্র তো তিনিই, তার উপরই সকল ভরসা।
শোকরের পরিচয়
অভিধানে শোকর :
শোকর অর্থ উপকার স্বীকার করা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। আরবীতে শব্দটি نصر বাব থেকে গঠিত ক্রিয়ামূল (مصدر)। شُكْرٌ، شُكُوْرٌ، شُكْرَانٌ তিনটি ধাতুরূপ রয়েছেشَكَرَ، يَشْكُرُ ক্রিয়ার।
এ শব্দ থেকে গঠিত ক্রিয়াপদ কখনো
সরাসরি সকর্মক ক্রিয়া হয় এবং কখনো لام حرف جار যোগে সকর্মক হয়। এজন্য
شَكَرْتُ لَهُ ও شَكَرْتُهُ উভয়ভাবেই বলা যায়। তবে ل যোগে সকর্মক বলা অধিক
শুদ্ধ। شَكَرَ ও تَشَكَّرَ একই অর্থবোধক। شُكْرَانٌ শব্দটি كُفْرَانٌ-এর
বিপরীত। شُكْرَانٌ অর্থ কৃতজ্ঞতা এবং كُفْرَانٌ অর্থ অকৃতজ্ঞতা। জীবদেহে
খাদ্যের প্রভাব ধরা পড়াকেও (شُكْرٌ) শোকর বলে। প্রাণীকুলে শোকর বলা হয় ঐ
প্রাণীকে যে অল্প খাবার খেয়েই মোটা-তাজা হয়। আকাশ থেকে ভারী বর্ষণ হ’লে বলা
হয় اِشْتَكَرَتِ السَّمَاءُ (মূষলধারে বৃষ্টি হয়েছে)। পশুর স্তন দুধে ভরে
উঠলে বলা হয়اَشْكَرَ الضَّرْعُ (স্তন দুধে ভরে গেছে)। দেখা যাচ্ছে শোকর
শব্দটি বেশী ও বৃদ্ধি অর্থে ঘুরপাক খায়।[1]
পরিভাষায় শোকর :
প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে
সর্বাবস্থায় আনুগত্যের চেষ্টা করা এবং অবাধ্যতা বা নাফরমানী থেকে বিরত
থাকাকে শোকর বলে। কেউ কেউ বলেছেন,الشُّكْرُ هُوَ الِْاعْتِرَافُ فِيْ
تَقْصِيْرِ الشُّكْرِ لِلْمُنْعِمِ- ‘অনুগ্রহকারীর শুকরিয়া আদায়ে অক্ষমতা
প্রকাশ করাই শোকর’।[2] ফার্রা বলেছেন,الشُّكْرُ مَعْرِفَةُ الْإِحْسَانِ
وَالتَّحَدُّثُ بِهِ- ‘অনুগ্রহ স্বীকার করা এবং জনসমক্ষে তা বলে বেড়ানোকে
শোকর বলে’।[3]
অতএব শোকর বলতে বুঝব যে, আল্লাহ প্রদত্ত নে‘মত সমূহের প্রভাব বান্দার অন্তরে প্রকাশ পাবে ঈমান রূপে; মুখে প্রকাশ পাবে প্রশংসা ও গুণগান রূপে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে প্রকাশ পাবে ইবাদত-বন্দেগী ও আনুগত্য হিসাবে।
হাম্দ ও শোকরের মধ্যে পার্থক্য :
হাম্দ :
প্রশংসাভাজন তথা যিনি প্রশংসা লাভের যোগ্য তার সত্তাগত (অনর্জিত) গুণাবলী
এবং অর্জিত গুণাবলীর জন্য মুখে উচ্চারিত প্রশংসাকে হাম্দ বলে।[4]
শোকর :
শোকর কেবল অর্জিত গুণাবলীর প্রেক্ষিতে করতে হয় এবং তা মুখের ভাষা দিয়ে যেমন করা যায়, তেমনি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারাও করা যায়।
সুতরাং হাম্দ মুখের কথা ব্যতীত হয় না। অন্য দিকে শোকর কথা, কাজ ও অন্তর দ্বারা করা যায়।
হামদ
অর্জিত ও অনর্জিত উভয় গুণের প্রেক্ষিতে করা হয়। কিন্তু শোকর শুধুই অর্জিত
গুণের জন্য করা হয়। যেমন কারো দৈহিক সৌন্দর্য ও পরোপকারের জন্য প্রশংসা
করলে তা হবে হাম্দ; আর কেবল পরোপকারের জন্য কৃতজ্ঞতা দেখালে তা হবে শোকর।
কখনো কখনো একটি শব্দ আরেক শব্দের স্থলে ব্যবহৃত হয়।[5] এমনও বলা হয়েছে যে, হাম্দ শব্দ শোকরের স্থলে ব্যবহৃত হ’তে পারে, তবে শোকর হাম্দ-এর স্থলে ব্যবহৃত হবে না।[6]
শোকরের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় সমূহ : ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি যে, শোকর হ’ল অন্তরে নে‘মতদাতা বা অনুগ্রহকারীর ভালবাসা স্থান দান; অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে তার আদেশ মান্য করা এবং মুখ দিয়ে তা প্রকাশ করা ও তার প্রশংসা করা। এ থেকে আমরা জানতে পারছি যে, শোকরের সঙ্গে তিনটি জিনিস জড়িয়ে আছে। অন্তর, জিহবা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
অন্তরের শোকর :
অন্তরের শোকর বলতে বুঝব যে, যত প্রকার নে‘মত মানুষ ভোগ করে তার সবই মহান আল্লাহ প্রদত্ত। তার দেওয়া জীবন-জীবিকা, সুযোগ-সুবিধাই আমরা প্রতি মুহূর্তে ভোগ করি। সুতরাং মন থেকে তা স্বীকার করে তার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশই অন্তরের শোকর। অনেক মানুষ আছে যারা ধনী কিংবা পদস্থ ব্যক্তির হাত থেকে কোন নে‘মত লাভ করলে ঐ ধনী কিংবা পদস্থ ব্যক্তিকে নে‘মতদাতা বলে গণ্য করে। তারা ভুলে যায় আল্লাহর কথা যিনি ঐ ধনীকে সম্পদ দান করেছেন তাকে তা দেওয়ার জন্য। ধনী শুধুমাত্র অসীলা। আমল দাতা তো আল্লাহ। আফসোস! মানুষ মাধ্যমের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কিন্তু উৎসকে কৃতজ্ঞতা জানায় না।
এজন্য শৈশবকাল থেকেই শিশুদেরকে কোথা থেকে জীবন-জীবিকা আসে এবং আল্লাহই যে আমাদের জীবিকার উৎস তা শিক্ষা দেওয়া অত্যন্ত যরূরী। এতে করে শিশুরা তাদের প্রতিপালকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে করতে বেড়ে উঠবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اذْكُرُوْا نِعْمَتَ اللهِ عَلَيْكُمْ هَلْ مِنْ خَالِقٍ غَيْرُ اللهِ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ فَأَنَّى تُؤْفَكُوْنَ-
‘হে মানুষ! তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর। আল্লাহ ব্যতীত কোন সৃষ্টিকর্তা আছেন কি যিনি তোমাদেরকে আসমান ও যমীন থেকে রূযী দান করেন? তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব তোমরা কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছ?’ (ফাতির ৩৫/৩)।
এই জ্ঞান লাভের পর শোকর আদায়কারীর প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য যত নে‘মত যিনি তাকে দিয়েছেন সেই নে‘মতদাতা ও অনুগ্রহকারী মহান আল্লাহকে ভালবাসা একান্ত কর্তব্য।
মুখে শোকর :
মানুষের মুখের ভাষা তার অন্তরের প্রতিনিধিত্ব করে। সুতরাং অন্তর যদি আল্লাহর কৃতজ্ঞতায় ভরা থাকে তাহ’লে জিহবায় আল্লাহর শোকর ও প্রশংসা উথলে উঠবে।
প্রিয় পাঠক! আপনি নবী করীম (ছাঃ) কর্তৃক তাঁর প্রতিপালকের হাম্দ-ছানা বা প্রশংসা কেন্দ্রিক যিক্র-আযকার ও দো‘আগুলো ভেবে দেখুন তাতে কী পরিমাণ শোকর ও কৃতজ্ঞতা রয়েছে।
১. নবী করীম (ছাঃ) যখন ঘুম থেকে জাগতেন তখন বলতেন,
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِىْ أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا وَإِلَيْهِ
النُّشُوْرُ ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে মৃত্যুর পর জীবন দান
করেছেন (জাগিয়ে তুলেছেন) এবং তার নিকটেই পুনরুত্থান হবে’।[7] তিনি আমাদেরকে
নিম্নোক্ত দো‘আ বলতে বলেছেন,الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِى عَافَانِىْ فِىْ
جَسَدِى وَرَدَّ عَلَىَّ رُوْحِى وَأَذِنَ لِىْ بِذِكْرِهِ- ‘সকল প্রশংসা
আল্লাহর, যিনি আমাকে দৈহিক সুস্থতা দান করেছেন, আমার রূহুকে আমার মাঝে
ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং আমাকে তার যিকর করার আদেশ দিয়েছেন’।[8]
২.
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, নবী করীম (ছাঃ) যখন শয্যা গ্রহণ
করতেন তখন বলতেন,الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِى أَطْعَمَنَا وَسَقَانَا
وَكَفَانَا وَآوَانَا فَكَمْ مِمَّنْ لاَ كَافِىَ لَهُ وَلاَ مُئْوِىَ-
‘সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদেরকে খেতে দিয়েছেন, আমাদেরকে পান করতে
দিয়েছেন, আমাদের অভাব পূরণ করেছেন এবং আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন। কত মানুষ তো
এমন আছে যাদের কোন অভাব পূরণকারী নেই এবং আশ্রয়দাতাও নেই’।[9]
৩.
আবু উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, নবী করীম (ছাঃ)-এর সামনে থেকে যখন তাঁর
খাবারের খাঞ্চা তুলে নেওয়া হ’ত তখন তিনি বলতেন,الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِىْ
كَفَانَا وَأَرْوَانَا، غَيْرَ مَكْفِىٍّ، وَلاَ مَكْفُوْرٍ وَقَالَ
مَرَّةً الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّنَا، غَيْرَ مَكْفِىٍّ، وَلاَ مُوَدَّعٍ،
وَلاَ مُسْتَغْنًى رَبَّنَا- ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে যথেষ্ট
খাইয়েছেন, আমাদেরকে পরিতৃপ্ত করেছেন, না এর থেকে বেশী প্রয়োজন আছে, না
অকৃতজ্ঞতার কোন কারণ আছে’। তিনি একবার বলেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক। সকল
প্রশংসা আল্লাহর। এর থেকে না বেশী প্রয়োজন, না এ (খাদ্য-পানীয়)
পরিত্যাগযোগ্য, না এর থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা যায়- হে আমাদের রব![10]
৪.
সাইয়িদুল ইস্তিগফার নামক দো‘আয় এসেছে,أَبُوْءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَىَّ
وَأَبُوْءُ بِذَنْبِى- ‘হে আল্লাহ! আমাকে আপনি যে নে‘মত দিয়েছেন তা আমি
স্বীকার করছি এবং আপনার নিকট আমার গুনাহও স্বীকার করছি’।[11]
৫.
তাহাজ্জুদ ছালাতের দো‘আর একাংশে বলা হয়েছে,اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ،
أَنْتَ نُورُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ ‘হে আল্লাহ! আপনারই
সকল প্রশংসা। আপনি আকাশমন্ডলী, মর্তলোক এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সকল কিছুর
আলো’।[12] اللهُ أَكْبَرُ كَبِيرًا وَالْحَمْدُ لِلَّهِ كَثِيرًا
وَسُبْحَانَ اللهِ بُكْرَةً وَأَصِيلاً- ‘আল্লাহ সবার চেয়ে অনেক অনেক বড়।
অনেক অনেক প্রশংসা আল্লাহর। আমি সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা
করি’।[13]
৬. আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি
বলেছেন, এক রাতে আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে (আমার) বিছানা থেকে নিখোঁজ
পেলাম। আমি তাঁকে খোঁজ করতে লাগলাম। হঠাৎই মসজিদের মধ্যে তাঁর দু’পায়ের
তলায় আমার হাত গিয়ে ঠেকল। পা দু’টো ছিল সিজদারত অবস্থায় খাড়া। আর তিনি মুখে
বলছিলেন, اللَّهُمَّ أَعُوْذُ بِرِضَاكَ مِنْ سَخَطِكَ وَبِمُعَافَاتِكَ
مِنْ عُقُوْبَتِكَ وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْكَ لاَ أُحْصِى ثَنَاءً عَلَيْكَ
أَنْتَ كَمَا أَثْنَيْتَ عَلَى نَفْسِكَ- ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার ক্রোধ থেকে
আপনার সন্তুষ্টির এবং আপনার শাস্তি থেকে আপনার ক্ষমার আশ্রয় চাচ্ছি। আমি
আপনার থেকে আপনার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। আমি আপনার তত প্রশংসা করতে পারি না,
যত প্রশংসা আপনি নিজেকে নিজে করেছেন’।[14]
৭.
পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের শেষে শোকর : মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) (একদিন) তার হাত ধরে বলেছিলেন,يَا مُعَاذُ
وَاللهِ إِنِّى لأُحِبُّكَ... لاَ تَدَعَنَّ فِىْ دُبُرِ كُلِّ صَلاَةٍ
تَقُوْلُ اللَّهُمَّ أَعِنِّى عَلَى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ
عِبَادَتِكَ- ‘হে মু‘আয! আল্লাহর কসম, নিশ্চয়ই আমি তোমাকে ভালবাসি...। তুমি
প্রত্যেক ফরয ছালাত অন্তে এ দো‘আ বলা কখনই ত্যাগ করো না, ‘হে আল্লাহ! আপনি
আমাকে আপনার যিকর, আপনার শোকর এবং আপনার সুন্দর পরিপাটিভাবে ইবাদত করতে
সাহায্য করুন’।[15]
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা শোকর :
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা শোকর নেক আমল বা সৎ কাজ দ্বারা হ’তে পারে। যার বয়স চল্লিশ ছুঁয়েছে কুরআন তাকে উপদেশ দিয়েছে এই বলে,حَتَّى إِذَا بَلَغَ أَشُدَّهُ وَبَلَغَ أَرْبَعِيْنَ سَنَةً قَالَ رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ- ‘এমনি করে যখন সে যৌবনে উপনীত হয় এবং চল্লিশ বছর বয়সে পৌঁছে তখন সে বলে, হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে সামর্থ্য দিন, যেন আপনি আমার ও আমার মাতাপিতার উপর যে অনুগ্রহ করেছেন আমি তার শোকর আদায় করতে পারি। তাছাড়াও এমন সব সৎ কাজ বা আমল করতে পারি যাতে আপনি রাযী-খুশী হয়ে যান’ (আহক্বাফ ৪৬/১৫)। এই বয়স্ক লোকটি আল্লাহর দেওয়া নে‘মতের শুকরিয়া আদায়ের সামর্থ্য প্রার্থনার পরক্ষণে তার কাছে নেক আমলের ক্ষমতা লাভের আবেদনও জানিয়েছে।
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ
দ্বারা শুকরিয়া আদায়ের আরেকটি উপায় মানবদেহের প্রতিটি গ্রন্থির বদলে
ছাদাক্বা করা। আবু যার (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,
يُصْبِحُ عَلَى كُلِّ سُلاَمَى مِنْ أَحَدِكُمْ صَدَقَةٌ ‘প্রতি ভোরবেলায়
তোমাদের যেকোন জনের প্রত্যেক গ্রন্থির উপর ছাদাক্বা প্রদান আবশ্যক হয়ে
দাঁড়ায়’। গ্রন্থির সংখ্যা তিন শত ষাট। এতগুলো গ্রন্থির পক্ষ থেকে কিভাবে
শোকর আদায় সম্ভব? উত্তরে তিনি বললেন,فَكُلُّ تَسْبِيحَةٍ صَدَقَةٌ وَكُلُّ
تَحْمِيْدَةٍ صَدَقَةٌ وَكُلُّ تَهْلِيْلَةٍ صَدَقَةٌ وَكُلُّ تَكْبِيْرَةٍ
صَدَقَةٌ وَأَمْرٌ بِالْمَعْرُوْفِ صَدَقَةٌ وَنَهْىٌ عَنِ الْمُنْكَرِ
صَدَقَةٌ- ‘প্রতিবার ‘সুবহানাল্লাহ’ উচ্চারণে একটি ছাদাক্বা, প্রতিবার
‘আলহামদুলিল্লাহ’ উচ্চারণে একটি ছাদাক্বা, প্রতিবার লা ‘ইলাহা ইল্লাল্লাহ’
বলায় একটি ছাদাক্বা, প্রতিবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলায় একটি ছাদাক্বা, কোন
একটি সৎ কাজের আদেশ দানে একটি ছাদাক্বা এবং কোন একটি অসৎ কাজ থেকে নিষেধে
একটি ছাদাক্বা হবে’।[16]
ইবনু আববাস (রাঃ)
থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,كُلُّ كَلِمَةٍ طَيْبَةٍ صَدَقَةٌ، وَعَوْنُ
الرَّجُلِ أَخَاهُ صَدَقَةٌ؛ وَالشَّرْبَةُ مِنَ الْمَاءِ يَسْقِيْهَا
صَدَقَةٌ، وَإِمَاطَةُ الْأَذَى عَنِ الطَّرِيْقِ صَدَقَةٌ- ‘প্রতিটি ভাল
কথায় একটি ছাদাক্বা, ব্যক্তির নিজ (আপন কিংবা দ্বীন সম্পর্কিত) ভাইকে
সাহায্য করা একটি ছাদাক্বা, কাউকে একবার পানি পান করানো একটি ছাদাক্বা এবং
রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক কোন জিনিস সরানো একটি ছাদাক্বা।[17]
এরূপ ছাদাক্বার সংখ্যা অনেক। হাফেয ইবনু রজব ইমাম নববীর ‘আল-আরবাঈন’ বা চল্লিশ হাদীছের উপর ‘জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম’ নামে যে ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন তাতে তিনি এগুলো সংকলন করেছেন।
দৈহিক শ্রমদানও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শোকরের মধ্যে পড়ে। যেমন বাদশাহ যুলকারনাইন প্রাচীর বানানোর কৌশল সম্বন্ধে অজ্ঞ একটি মানবগোষ্ঠীর জন্য নিজ পরিশ্রমে প্রাচীর বানিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে তারা তাদের শত্রু ইয়াজূজ-মা’জূজের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেয়েছিল। শোকরের সিজদাও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শোকরের আওতাভুক্ত।
আবু বাকরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে
যে, أَنَّهُ كَانَ إِذَا جَاءَهُ أَمْرُ سُرُورٍ أَوْ بُشِّرَ بِهِ خَرَّ
سَاجِدًا شَاكِرًا لِلَّهِ- ‘নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট যখন কোন খুশির খবর
আসত, তখন তিনি আল্লাহর সমীপে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নিমিত্তে সিজদায় লুটিয়ে
পড়তেন’।[18]
আবু বকর (রাঃ)-এর নিকট যখন
মুরতাদ ভন্ডনবী মুসায়লামা আল-কাযযাবের নিহত হওয়ার খবর পৌঁছে, তখন তিনি
আল্লাহর ওয়াস্তে সিজদায় লুটিয়ে পড়েছিলেন। এই বদমাশ (ভন্ডনবী) আরবের বহু
লোককে তার দলে ভিড়িয়েছিল। সে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তৎকালে খুবই ভয়াবহ
পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল।[19]
আবু মূসা আল-হামাযানী থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
كُنْتُ مَعَ عَلِيٍّ يَوْمَ النَّهْرَوَانِ، فَقَالَ: الْتَمِسُوْا ذَا الثُّدَيَّةِ، فَالْتَمَسُوْهُ فَجَعَلُوْا لاَ يَجِدُوْنَهُ، فَجَعَلَ يَعْرَقُ جَبِيْنُ عَلِيٍّ، وَيَقُوْلُ: وَاللهِ مَا كَذَبْتُ وَلاَ كُذِّبْتُ فَالْتَمِسُوْهُ قَالَ : فَوَجَدْنَاهُ فِيْ سَاقِيَةٍ أَوْ جَدْوَلٍ تَحْتَ قَتْلَى، فَأُتِيَ بِهِ عَلِيٌّ فَخَرَّ سَاجِدًا-
‘আমি খারেজীদের বিরুদ্ধে নাহরাওয়ানের যুদ্ধে আলী (রাঃ)-এর সাথে ছিলাম। যুদ্ধে আলী (রাঃ) জয় লাভের পর সৈনিকদের বললেন, তোমরা বড় স্তনওয়ালা পুরুষ লোকটিকে খুঁজে বের কর। তারা খুব খোঁজল কিন্তু পেল না। তখন আলী (রাঃ)-এর ললাট দিয়ে ঘাম ঝরতে লাগল, আর তিনি বলতে লাগলেন, আল্লাহর কসম! আমি তো মিথ্যা বলিনি আর আমাকেও মিথ্যা বলা হয়নি। তোমরা তাকে ভাল করে খোঁজ কর। পরে আমরা তাকে খোঁজতে খোঁজতে একটা নালার মধ্যে অনেক লাশের নিচে পেলাম। আলী (রাঃ)-এর কাছে তাকে নেওয়া হ’লে তিনি সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন’।[20] কেননা নবী করীম (ছাঃ) তাকে আগাম জানিয়েছিলেন যে, একজন বড় স্তনওয়ালা লোক খারেজীদের সাথে থাকবে।
কা‘ব
ইবনু মালিক (রাঃ) যখন শুনতে পেয়েছিলেন যে, আল্লাহ তাঁর তওবা কবুল করেছেন,
তখন তিনি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় সিজদায় লুটিয়ে পড়েছিলেন।[21]
জনৈক
পূর্বসূরী নেককার লোকের মা আছর ছালাতের পর ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এ সংবাদ
শুনে তিনি সিজদায় লুটিয়ে পড়েছিলেন এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনি সিজদাতেই
পড়েছিলেন।[22]
তবে সিজদায়ে শোকর প্রতিটি
নে‘মতের প্রেক্ষিতে প্রদান বিধেয় নয়। এ সিজদা কেবল গুরুত্বপূর্ণ কোন নতুন
নে‘মত লাভের জন্য প্রদেয়। আবু নছর আল-আরগাবানী বলেন, শোকরের সিজদা হঠাৎ কোন
(বড়) নে‘মত পেলে কিংবা কোন বড় বিপদ কেটে গেলে প্রদান করা সুন্নাত।
চিরাচরিত নে‘মতের জন্য তা প্রদান করা সুন্নাত নয়।[23]
যায়েদ
বিন জুদ‘আন থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা হাসান আল-বছরীর নিকট ছিলাম।
তিনি তখন আবু খালীফাহ আল-আবাদী নামক এক ব্যক্তির বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন। এমন
সময় এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আবু সাঈদ! (হাসান বছরীর উপনাম) হাজ্জাজ বিন
ইউসুফ মারা গেছে। এ কথা শুনে হাসান সিজদায় পতিত হন।[24]
ছালাতে শোকর আদায়ের তিনটি উপকরণই মওজূদ রয়েছে : আমরা যে ছালাত আদায় করি তাতে শোকর আদায়ের পূর্বে বর্ণিত তিনটি উপকরণই মওজূদ রয়েছে। ছালাত কলবের মাধ্যমে শোকর। কেননা ছালাতে রয়েছে ইখলাছ ও বিনয়। ছালাত জিহবা দ্বারা শোকর, কেননা তাতে রয়েছে কুরআন তিলাওয়াত এবং দয়াময় আল্লাহর যিকর-আযকার। ছালাত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শোকর। কেননা ছালাতে রুকূ, সিজদা, সালাম ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল রয়েছে। সুতরাং যথানিয়মে ছালাত আদায় মহান আল্লাহ তা‘আলার শোকর আদায়ের একটি বড় পন্থা।
তিন শোকরের অর্থ :
তিনটি জিনিস জানা-বুঝার উপর শোকরের অর্থ নির্ভর করে। সেই তিনটি জিনিস নিচে দেওয়া হ’ল-
১. নে‘মতের পরিচয় : কী নে‘মত বান্দা পেয়েছে তা মস্তিষ্কে সব সময় ধারণ করা। মনে গেঁথে রাখা এবং তা স্বতন্ত্রভাবে চিন্তা করা। একজন মুসলিম তো তার নে‘মতের পরিচয় জানার মাধ্যমে অনুগ্রহকারী মহান আল্লাহর পরিচয় পেয়ে থাকে। এভাবে যখন সে নে‘মতদাতার পরিচয় পায় তখন তাকে মন থেকে ভালবাসতে থাকে। আর যখন সে ভালবাসে তখন সে তার সান্নিধ্য পেতে এবং শোকর আদায়ে সচেষ্ট হবে এটা খুবই স্বাভাবিক। আর এভাবেই তা হয়ে যায় ইবাদত। কেননা ইবাদত হ’ল নে‘মতদাতার শোকরের পথ ও পদ্ধতি। আর নে‘মতদাতা তো আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নয়। সুতরাং আল্লাহর শোকর মানেই আল্লাহর ইবাদত।
২. নে‘মতকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ : বান্দাকে আল্লাহ তা‘আলা যে নে‘মতই দেন না কেন তাতে তাকে রাযী-খুশি থাকতে হবে। আল্লাহ প্রদত্ত কোন নে‘মতকেই সে নগণ্য ও তুচ্ছ ভাববে না।
৩. নে‘মতদাতার প্রশংসা করা : নে‘মতদাতার প্রশংসা দু’ভাগে বিভক্ত। (ক) আম বা সাধারণভাবে তাকে দানশীল, অনুগ্রহকারী, সৎ, পরোপকারী, প্রচুর দাতা ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা (খ) খাছ বা বান্দা নিজে যে যে অনুগ্রহ লাভ করেছে তা জনগণের মাঝে তুলে ধরা। আল্লাহ বলেছেন,وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ ‘অতঃপর তুমি তোমার পালনকর্তার অনুগ্রহের কথা বর্ণনা কর’ (যোহা ৯৩/১১)।
এখানে নে‘মত বর্ণনার যে আদেশ দেওয়া হয়েছে তাতে দু’টি কথা রয়েছে। প্রথম কথা : প্রিয় পাঠক! আপনার প্রাপ্ত নে‘মতকে আপনি আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতে ব্যবহার করবেন। দ্বিতীয় কথা : আল্লাহ আপনাকে যেসব নে‘মত দিয়েছেন তা স্মরণ করবেন এবং গুনে গুনে দেখবেন। আপনি বলবেন, আমাকে আল্লাহ এ নে‘মত দিয়েছেন, সে নে‘মত দিয়েছেন ... ইত্যাদি।
এজন্য জনৈক মুফাসসির উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, তোমার প্রভুর যে করুণা (তোমার উপর) তা তুমি বর্ণনা কর, অর্থাৎ এ সূরায় আল্লাহ তোমাকে যেসব অনুগ্রহের কথা বলেছেন তা স্মরণ করে তুমি শোকর আদায় করো। যেমন তিনি তোমাকে ইয়াতীম পেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন, সৎপথের সন্ধান থেকে দূরে থাকার পর সৎপথ প্রদান করেছেন এবং দরিদ্র থেকে ধনাঢ্য করেছেন।
আবু রাজা আল-আত্তারিদী (রহঃ) বলেন, ইমরান ইবনু হুছাইন
(রাঃ) আমাদের মাঝে আগমন করলেন। তার গায়ে ছিল নকশাদার একটি রেশমী চাদর। এ
পোশাকে আমরা তাকে আগেও কখনো দেখিনি, পরেও কখনো দেখিনি। পোশাকটা ছিল বেশ
দামী। তিনি বললেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ أَنْعَمَ اللهُ عَزَّ
وَجَلَّ عَلَيْهِ نِعْمَةً فَإِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يُحِبُّ أَنْ يُرَى
أَثَرُ نِعْمَتِهِ عَلَى عَبْدِهِ- ‘যাকে আল্লাহ কোন নে‘মত দান করেছেন। সে
যেন কোন না কোনভাবে তার চিহ্ন প্রকাশ করে। কেননা বান্দার দেহে আল্লাহ
প্রদত্ত অনুগ্রহের চিহ্নের প্রকাশকে আল্লাহ ভালবাসেন।[25] নু‘মান বিন বাশীর
(রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ لَمْ
يَشْكُرِ الْقَلِيْلَ لَمْ يَشْكُرِ الْكَثِيْرَ وَمَنْ لَمْ يَشْكُرِ
النَّاسَ لَمْ يَشْكُرِ اللهَ وَالتَّحَدُّثُ بِنِعْمَةِ اللهِ شُكْرٌ
وَتَرْكُهَا كُفْرٌ وَالْجَمَاعَةُ رَحْمَةٌ وَالْفُرْقَةُ عَذَابٌ- ‘অল্প
পেয়ে যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, বেশীতেও সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। যে
মানুষের (উপকার পেয়ে তার প্রতি) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে আল্লাহর প্রতি
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। আল্লাহর নে‘মতের আলোচনা করা কৃতজ্ঞতা এবং আলোচনা
না করা অকৃতজ্ঞতা। জামা‘আতবদ্ধ জীবন রহমত, আর বিচ্ছিন্ন জীবন আযাব।[26]
নবী
করীম (ছাঃ) আরো বলেছেন,كُلُوْا وَاشْرَبُوْا وَتَصَدَّقُوْا وَالْبَسُوْا
فِىْ غَيْرِ مَخِيْلَةٍ وَلاَ سَرَفَ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ أَنْ تُرَى
نِعْمَتُهُ عَلَى عَبْدِهِ- ‘তোমরা খাও, পান করো, দান করো, কাপড় পরো অহংকার
ও অপচয় ছাড়া। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা বান্দার দেহে তার প্রদত্ত নে‘মতের
চিহ্ন দেখতে ভালবাসেন’।[27] হাসান বাছরী বলেছেন,أَكْثِرُوْا ذِكْرَ هَذِهِ
النِّعْمَةِ فَإِنَّ ذِكْرَهَا شُكْرٌ- ‘এসব নে‘মতের আলোচনা তোমরা বেশী
বেশী করে কর। কেননা নে‘মতের আলোচনা এক প্রকার কৃতজ্ঞতা।[28]
কবি আল-হুবাইশী বলেন,
نُحدث بالنعماء شكرا لربنا
على مَا حبا من كل خير وَمَا وهب
نقُول بِهَذَا لَا لفخر ونخوة
وَلَكِن لشكر الله فالشكر قد وَجب-
‘নে‘মতের বর্ণনা যা আমরা করি,
সে তো মোদের রবের শোকর মানবে তুমি।
সর্বপ্রকার কল্যাণ যা দিচ্ছেন তিনি,
আমরা তো তার প্রকাশ মাঝে শোকর মানি।
নয় তা কোন অহংকার, নয় গর্ব কোন,
বরং সে তো রবের শোকর, ওয়াজিব জেনো।[29]
আল্লাহর নে‘মত প্রকাশকারীদের শ্রেণীবিভাগ :
প্রাপ্ত নে‘মত প্রকাশের দিক থেকে মানুষ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত।
১. নে‘মতের শোকর আদায়কারী এবং সেজন্য আল্লাহর প্রশংসাকারী।
২. নে‘মত অস্বীকারকারী এবং গোপনকারী।
৩. এমন ভাব প্রকাশকারী যে সে ঐ নে‘মত লাভের যোগ্য, অথচ সে তার যোগ্য নয়।
কিছু গোবরগণেশ লোক আছে যারা মনে করে আল্লাহর নে‘মত প্রকাশের অর্থ দামী কাপড় কেনা, বিলাসবহুল গাড়িতে চড়া, দামী ও উপাদেয় খাদ্য খাওয়া ইত্যাদি। অথচ এগুলোর সবই যথার্থই ভুল। কেননা আল্লাহর নে‘মত প্রকাশ করার অর্থ আল্লাহ আমাদেরকে যে জীবিকা দিয়েছেন তার প্রকাশ ঘটান। যদি তিনি আমাদেরকে অঢেল সম্পদ দিয়ে থাকেন তাহ’লে আমরা এমন পোষাক কিনব ও পরব যাতে আল্লাহ প্রদত্ত প্রাচুর্য প্রকাশ পায়। আর যদি আল্লাহ আমাদেরকে এমন পরিমাণ জীবিকা দেন যাতে আমাদের ও পরিবারের খাওয়া-পরা চলে যায়, প্রাচুর্যতা না থাকে তাহ’লে নিজেদের উপযুক্ত যা তাই কিনব। সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা নিজেদের উপর চাপিয়ে নেব না।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,الْمُتَشَبِّعُ بِمَا لَمْ يُعْطَ كَلاَبِسِ ثَوْبَىْ زُوْرٍ ‘যাকে যা দেওয়া হয়নি সে তা পাওয়ার ভান করলে সে মিথ্যার দুই প্রস্থ বস্ত্র পরিধানকারীর তুল্য হবে’।[30] আবুল আহওয়াছ (রহঃ) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন যে,أَتَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَنَا قَشِفُ الْهَيْئَةِ فَقَالَ هَلْ لَكَ مَالٌ؟ قَالَ قُلْتُ نَعَمْ. قَالَ : مِنْ أَىِّ الْمَالِ؟ قَالَ قُلْتُ مِنْ كُلِّ الْمَالِ منَ الإِبِلِ وَالرَّقِيْقِ وَالْخَيْلِ وَالْغَنَمِ. فَقَالَ : إِذَا آتَاكَ اللهُ مَالاً فَلْيُرَ عَلَيْكَ- ‘(একবার) আমি উষ্কখুষ্ক চেহারা ছুরতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এলাম। আমার অবস্থা দেখে তিনি বললেন, তোমার কি অর্থ-সম্পদ কিছু আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, কী ধরনের সম্পদ? আমি বললাম, উষ্ট্রপাল, দাস-দাসী, অশ্বদল, ছাগপাল ইত্যাদি জাতীয় সবই আছে। তিনি বললেন, যখন আল্লাহ তোমাকে এত সম্পদ দিয়েছেন তখন তার কিছু চিহ্ন তো তোমার মাঝে দেখা যাওয়া উচিত’।[31] হাদীছটিতে তিনি আল্লাহর নে‘মত বর্ণনা ও প্রকাশ করতে তখনই বলেছেন, যখন আল্লাহ তাকে ধন-সম্পদ প্রদান করবেন।
নে‘মত কখন গোপন করা যাবে :
আল্লাহর
দেওয়া নে‘মতের কথা প্রচারের যে আদেশ দেওয়া হয়েছে তা নেক্কার বান্দাদের
নিকট প্রকাশ করা ভাল। হিংসুটেদের সামনে যদি তা প্রকাশের প্রয়োজন পড়ে তারপর
নে‘মতপ্রাপ্ত ব্যক্তি তা গোপন রাখে তবে তা অন্যায় ও অকৃতজ্ঞতা বলে গণ্য হবে
না। সে তখন মূলতঃ কৃপণতা করে নে‘মতের আলোচনা গোপন করছে না আবার আল্লাহর
অধিকারও ক্ষুণ্ণ করছে না। সে একটা ক্ষতি রোধ করার স্বার্থেই বরং এমনটা
করছে। সে ক্ষতি হ’ল হিংসুটের হিংসা, চক্রান্ত ও ক্ষতিসাধনের অপচেষ্টা। আর
ক্ষতি রোধ শরী‘আতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত।[32]
শোকরের পদ্ধতি :
পাঁচটি জিনিস নিশ্চিত না করা পর্যন্ত বান্দা আল্লাহ থেকে প্রাপ্ত নে‘মতের শোকর পুরোপুরি আদায় করতে পারে না।
১.
তার নিকট নত হওয়া। কৃতজ্ঞ বান্দা তার উপকারকারী বিশ্বপ্রতিপালকের প্রতি নত
হয়ে থাকবে। আল্লামা বায়যাভী (রহঃ) বলেন,العمدة في شكرها استعمالها فيما
خلقت لأجله، والإذعان لمانحها ‘নে‘মতের শুকরিয়ার উত্তম পদ্ধতি হ’ল যেজন্য
নে‘মতকে সৃষ্টি করা হয়েছে তাকে সে কাজে লাগানো এবং নে‘মত দাতার প্রতি অনুগত
থাকা’।[33]
২. আল্লাহ তা‘আলাকে ভালবাসা। আল্লাহ যেহেতু দাতা তাই বান্দা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আল্লাহকে ভালবাসবে।
৩. আল্লাহর দেওয়া নে‘মত স্বীকার ও যাহির করা।
৪. নে‘মত প্রদানের জন্য আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করা।
৫.
তিনি যাতে নাখোশ হন তেমন ক্ষেত্রে নে‘মতকে ব্যবহার না করে বরং তিনি যাতে
খুশি হন তেমন ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করা। মুহাম্মাদ ইবনু কা‘ব
বলেন,الشُّكْرُ: تَقْوَى اللهِ، وَالْعَمَلُ بِطَاعَتِهِ ‘শোকর হ’ল,
আল্লাহকে ভয় করা এবং তার আনুগত্য মূলে আমল করা’।[34]
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘শোকর মূলতঃ নে‘মতদাতার দানকে বিনয়, নম্রতা ও ভালবাসার সাথে গ্রহণ ও স্বীকার করা। সুতরাং যে নে‘মত কী তাই চিনল না বরং অজ্ঞ থেকে গেল সে নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করেনি। আর যে নে‘মত চিনলেও তা প্রকাশ করেনি সেও শুকরিয়া আদায় করেনি।
যে নে‘মত ও নে‘মতদাতাকে চিনল কিন্তু নে‘মতদাতার নে‘মতকে অস্বীকারকারীর মতই অস্বীকার করল, সে তখন নে‘মতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশকারীর পর্যায়ভুক্ত হবে। আর যে নে‘মত ও নে‘মতদাতাকে চিনল, স্বীকার করল, অস্বীকার করল না, কিন্তু তার নিকট নত হ’ল না, তাকে ভালবাসল না, তার প্রতি রাযী-খুশী থাকল না সেও তার শুকরিয়া আদায় করল না।
যে
নে‘মত চিনল, নে‘মতদাতাকে চিনল, নে‘মত স্বীকার করল, নে‘মতদাতার নিকট নত
থাকল, তাকে ভালবাসল, তার প্রতি রাযী-খুশী থাকল এবং নে‘মতকে তার আনুগত্য ও
ভালবাসামূলক কাজে ব্যবহার করল সেই প্রকৃতপক্ষে তার শোকর আদায়কারী’।[35]
আল্লাহর প্রতি শোকরের স্তরভেদ :
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এই যে, নে‘মত যখন ছোট-বড় হয় তখন নে‘মতের মাত্রা অনুসারে শোকরের মধ্যে তারতম্য হবে কি না?
হ্যাঁ, বান্দার শোকর আদায়ের মধ্যেও মাত্রা অনুসারে তারতম্য হবে। অতএব নে‘মত যতই জোরদার হবে বান্দাও তত জোরালভাবে আল্লাহর শোকর আদায় করবে।
নে‘মতের প্রতিদান :
আল্লাহর প্রতি বান্দার শোকর আদায় নে‘মতের প্রতিদান হিসাবে নয়। কেননা নে‘মতের প্রতিদান দেওয়া অসম্ভব। আর আল্লাহ পাক পরওয়ারদিগারের নিকট বান্দাদের পক্ষ থেকে কোন কিছু পৌঁছায়ও না। যেমন আল্লাহ বলেছেন,لَنْ يَنَالَ اللهَ لُحُومُهَا وَلاَ دِمَاؤُهَا ‘ওগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর নিকটে পৌঁছে না’ (হজ্জ ২২/৩৭)।
বর্ণিত
আছে যে, দাঊদ (আঃ) একবার বলেছিলেন, يارب، كَيْفَ أَشْكُرُكَ وَشُكْرِيْ
لَكَ نِعْمَةٌ مِنْكَ عَلَيَّ؟ فَقَالَ اللهُ تَعَالَى: الْآنَ شَكَرْتَنِي
يَا دَاوُدُ، أَيْ: حِينَ اعْتَرَفْتَ بِالتَّقْصِيرِ عَنْ أَدَاءِ شُكْرِ
النِّعَمِ- ‘হে আমার রব! আমি কিভাবে আপনার শোকর আদায় করব! আমি যে আপনার
শোকর আদায় করছি সেও তো আপনার নে‘মত! তখন আল্লাহ বললেন, দাঊদ, এবারই তুমি
আমার শোকর আদায় করলে। অর্থাৎ নে‘মতদাতার শোকর আদায়ে তুমি যে অক্ষমতা
স্বীকার করছ এটাই তোমার শোকরের স্বীকৃতি’।[36]
ইমাম
শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর যার কোন একটি নে‘মতের শোকর
আদায়, আরেকটি নতুন নে‘মত ছাড়া সম্ভব নয়। যেই নে‘মত দ্বারা পূর্বের নে‘মতের
শোকর করা যায়।[37]
আসলেও সকল প্রশংসা
আল্লাহর, যিনি নে‘মতের মোকাবেলায় আমাদেরকে প্রতিদান দিতে বাধ্য করেননি; বরং
আমাদের এ বিষয়ে ক্ষমা করেছেন এবং আমাদের দুর্বলতার জন্য দয়া করেছেন। তিনি
আমাদের অঢেল নে‘মত দিয়েছেন। অথচ তার মোকাবেলায় অল্প শোকর কবুল করেছেন।
সুলায়মান তায়মী (রহঃ) বলেছেন,إِنَّ اللهَ أَنْعَمَ عَلَى الْعِبَادِ عَلَى
قَدْرِهِ، وَكَلَّفَهُمُ الشُّكْرَ عَلَى قَدْرِهِمْ- ‘আল্লাহ তার শান
অনুযায়ী বান্দাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন, আর বান্দাদের সামর্থ্য অনুযায়ী
তাদেরকে শোকর আদায়ের দায়িত্ব দিয়েছেন’।[38]
শোকরের বিধান :
প্রত্যেক মুসলিমের উপর শোকর আদায় করা অন্যতম ফরয কাজ। তার দায়িত্বই হল শোকরকে জানা, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং তার নিজের মধ্যে শোকরের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। শোকর ফরয হওয়া প্রসঙ্গে নানা প্রকার দলীল-প্রমাণ রয়েছে। নিচে কিছু প্রমাণ তুলে ধরা হ’ল:
সরাসরি শোকর করার আদেশ :
আল্লাহ তা‘আলা বলছেন,فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوا لِي وَلَا تَكْفُرُونِ ‘অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ কর আমি তোমাদের স্মরণ করব। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, অকৃতজ্ঞ হয়ো না’ (বাক্বারাহ ২/১৫২)।
এ আয়াতে সরাসরি এবং সুস্পষ্ট ভাষায় শোকর আদায়ের আদেশ দেওয়া হয়েছে- আর আদেশ ফরয বা অপরিহার্যতা নির্দেশ করে। আল্লাহ আরো বলেছেন,وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِير- ‘(আল্লাহ বলেন,) আর আমরা মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করেছে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। অতএব তুমি আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। (মনে রেখ, তোমার) প্রত্যাবর্তন আমার কাছেই’ (লোকমান ৩১/১৪)।
রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হল,يَا رَسُولَ اللهِ أَىَّ الْمَالِ نَتَّخِذُ
فَقَالَ : لِيَتَّخِذْ أَحَدُكُمْ قَلْبًا شَاكِرًا وَلِسَانًا ذَاكِرًا
وَزَوْجَةً مُؤْمِنَةً تُعِينُ أَحَدَكُمْ عَلَى أَمْرِ الآخِرَةِ- ‘আমরা
কোন সম্পদ গ্রহণ করব? তিনি বললেন, তোমাদের যে কেউ যেন, একটি শোকরকারী হৃদয়,
একটি যিকরকারী জিহবা এবং আখিরাতের কাজে সাহায্যকারী একজন স্ত্রীকে গ্রহণ
করে’।[39]
শোকর ত্যাগের নিন্দা :
আল্লাহ
তা‘আলা বলেছেন,لِيَأْكُلُوا مِنْ ثَمَرِهِ وَمَا عَمِلَتْهُ أَيْدِيهِمْ
أَفَلَا يَشْكُرُونَ ‘যাতে তারা তার ফল থেকে ভক্ষণ করতে পারে। অথচ তাদের
হাত এটি তৈরী করেনি। তবুও কি তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না?’ (ইয়াসীন ৩৬/৩৫)।
আল্লামা বায়যাভী (রহঃ) তাঁর তাফসীরে এ আয়াত প্রসঙ্গে বলেছেন, أمر بالشكر
من حيث أنه إنكار لتركه ‘এখানে শোকর বর্জনের নিষেধাজ্ঞা দ্বারা
প্রকারান্তরে শোকরের আদেশ দেওয়া হয়েছে’।[40]
নবীদের শোকর করতে আদেশ দান :
এমন নয় যে, শোকর করার আদেশ শুধু এই উম্মতকে দেওয়া হয়েছে, বরং আমাদের পূর্ববর্তী উম্মতকেও শোকর আদায়ের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা নবীদেরও শোকর করতে আদেশ দিয়েছিলেন বলে কুরআনে উল্লেখ রয়েছে। তিনি বলেছেন,قَالَ يَا مُوسَى إِنِّي اصْطَفَيْتُكَ عَلَى النَّاسِ بِرِسَالَاتِي وَبِكَلَامِي فَخُذْ مَا آتَيْتُكَ وَكُنْ مِنَ الشَّاكِرِينَ- ‘আল্লাহ বললেন, হে মূসা! আমি আমার রিসালাত ও বাক্যালাপের মাধ্যমে তোমাকে লোকদের মধ্য থেকে বাছাই করে নিয়েছি। অতএব যা তোমাকে দেই তা গ্রহণ কর এবং কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হও’ (আ‘রাফ ৭/১৪৪)।
ইবাদাতকে শোকরের সাথে যুক্তকরণ :
আল্লাহ তা‘আলার বাণী থেকে বুঝা যায় যে, ইবাদত-বন্দেগী শোকরের সাথে জড়িত তথা শোকরের উপর দন্ডায়মান। সুতরাং যে শোকরকারী সে আল্লাহর ইবাদতকারী। আর যে শোকরকারী নয় সে আল্লাহর ইবাদতকারী নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَاشْكُرُوا لِلَّهِ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ ‘হে বিশ্বাসীগণ! আমরা তোমাদের যে রূযী দান করেছি, সেখান থেকে পবিত্র বস্ত্ত সমূহ ভক্ষণ কর। আর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, যদি তোমরা কেবল তাঁরই দাসত্ব করে থাক’ (বাক্বারাহ ২/১৭২)।
সৃষ্টি ও হুকুমের চূড়ান্ত লক্ষ্য আল্লাহর শোকর :
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে জানিয়েছেন যে, তার সৃষ্টি ও তার আদেশ-নিষেধের চূড়ান্ত লক্ষ্য শোকর। শোকর যে সৃষ্টির চূড়ান্ত লক্ষ্য তা নিম্নের আয়াতে বর্ণিত হয়েছে,وَاللهُ أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ لَا تَعْلَمُونَ شَيْئًا وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ- ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে বের করে এনেছেন এমন অবস্থায় যে তোমরা কিছুই জানতে না। আর তিনি তোমাদেরকে দান করেছেন কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয়, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর’ (নাহল ১৬/৭৮)।
এখানে আল্লাহ বলেছেন, তিনি যে মানবজাতিকে তাদের মায়েদের পেট থেকে বের করেছেন এবং তাদের জন্য চোখ, কান ও হৃৎপিন্ড সৃষ্টি করেছেন তা এই উদ্দেশ্যে যে, তারা তার শোকর আদায় করবে। আবার হুকুম বা আদেশ-নিষেধেরও চূড়ান্ত লক্ষ্য যে শোকর তা ফুটে উঠেছে নিচের আয়াতে, وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللهُ بِبَدْرٍ وَأَنْتُمْ أَذِلَّةٌ فَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ- ‘আর আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছিলেন বদরের যুদ্ধে। যেদিন তোমরা দুর্বল ছিলে। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হ’তে পার’ (আলে ইমরান ৩/১২৩)। এখানে মুসলমানরা যাতে শোকর আদায় করতে পারে সেজন্য আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তাক্বওয়া অবলম্বনের আদেশ দিয়েছেন। সুতরাং শোকর সৃষ্টি ও হুকুমের চূড়ান্ত লক্ষ্য। তিনি সৃষ্টি করেছেন যাতে তার শোকর আদায় করা হয় এবং তিনি হুকুম দিয়েছেন- যাতে তা প্রতিপালনের মাধ্যমে তার শোকর আদায় করা হয়।
নিন্দা জানাতে কুফর (অস্বীকার ও অকৃতজ্ঞতা) শব্দের ব্যবহার :
কুরআনের বেশ কয়েকটি স্থানে আল্লাহ তা‘আলা তার নে‘মত অস্বীকার তথা কুফরকে নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, أَفَبِالْبَاطِلِ يُؤْمِنُونَ وَبِنِعْمَةِ اللهِ يَكْفُرُونَ ‘তাহ’লে কি তারা মিথ্যার উপর (অর্থাৎ শিরকের উপর) ঈমান আনবে এবং আল্লাহর নে‘মতকে (অর্থাৎ তাওহীদকে) অস্বীকার করবে?’ (আনকাবূত ২৯/৬৭)।
উক্ত নিন্দাবাদ থেকে এ কথাই প্রতিফলিত হয় যে, তার বিপরীত কাজ করা অপরিহার্য। আর কুফর বা অকৃতজ্ঞতার বিপরীত তো শোকর বা কৃতজ্ঞতা। এ কথা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, শোকর আদায় করা ফরয।
মানুষকে কৃতজ্ঞ ও অকৃতজ্ঞ ভাগে বিভাজন :
আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। এক ভাগ কৃতজ্ঞ, অন্য ভাগ অকৃতজ্ঞ। এখানে তৃতীয় কোন ভাগ নেই। আল্লাহ বলেন, إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا ‘আমরা তাকে সুপথ প্রদর্শন করেছি। এক্ষণে সে কৃতজ্ঞ হবে কিংবা অকৃতজ্ঞ হবে’ (দাহর ৭৬/৩)।
আল্লাহ তা‘আলা এ বার্তাও দিয়েছেন যে, নবী করীম (ছাঃ)-এর মৃত্যুতে মানুষ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাবে- একদল পশ্চাৎমুখী কাফির এবং অন্যদল শোকরকারী মুমিন যারা আল্লাহর ফায়ছালায় খুশী। তিনি ঐসব কাফিরের নিন্দা করেছেন এবং শোকরকারীদের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন,وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِنْ مَاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ وَمَنْ يَنْقَلِبْ عَلَى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَضُرَّ اللهَ شَيْئًا وَسَيَجْزِي اللَّهُ الشَّاكِرِينَ ‘আর মুহাম্মাদ একজন রাসূল বৈ তো নন। তাঁর পূর্বে বহু রাসূল বিগত হয়েছেন। এক্ষণে যদি তিনি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তাহ’লে তোমরা কি পশ্চাদপসরণ করবে? বস্ত্ততঃ যদি কেউ পশ্চাদপসরণ করে, সে আল্লাহর কোনই ক্ষতি করতে পারে না। আর আল্লাহ সত্বর তার কৃতজ্ঞ বান্দাদের পুরস্কৃত করবেন’ (আলে ইমরান ৩/১৪৪)।
উক্ত বিভাজন থেকে শোকরের ফরয হওয়া স্পষ্ট হয়ে গেছে। কেননা অকৃতজ্ঞতা হারাম ও নিষিদ্ধ। আল্লাহর নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত এই অকৃতজ্ঞতা। মানুষের জন্য তিনি তা মোটেও পসন্দ করেন না। তিনি বলেছেন,إِنْ تَكْفُرُوا فَإِنَّ اللهَ غَنِيٌّ عَنْكُمْ وَلَا يَرْضَى لِعِبَادِهِ الْكُفْرَ وَإِنْ تَشْكُرُوا يَرْضَهُ لَكُمْ ‘যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, তবে জেনে রেখ আল্লাহ তোমাদের মুখাপেক্ষী নন। আর তিনি তার বান্দাদের অকৃতজ্ঞতায় খুশী হন না। কিন্তু যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তাহ’লে তোমাদের শুকরিয়ার জন্য তিনি তোমাদের উপর খুশী হবেন’ (যুমার ৩৯/৭)।
(চলবে)
[1]. লিসানুল আরাব ৪/৪২৪।
[2]. তাফসীরে কুরতুবী ১/৪৩৮।
[3]. ঐ, ২/১৬৬।
[4]. সত্তাগত বা অনর্জিত গুণ যেমন লম্বা, ফর্সা সুডৌল চেহারার অধিকারী হওয়া, কণ্ঠস্বর মিষ্টি হওয়া, চেহারা আকর্ষণীয় হওয়া, প্রতিবন্ধী না হওয়া ইত্যাদি। অর্জিত গুণ যেমন জ্ঞান অর্জন ও বিতরণ করা, চরিত্র সুন্দর করা, আল্লাহর পথে নিষ্ঠা ও ইখলাছ বজায় রাখা, ইবাদত করা, অর্থবিত্ত, পদপজিশনের মালিক হওয়া, ধৈর্য-সহিষ্ণুতা অবলম্বন করা, দান করা, পরোপকার করা ইত্যাদি।-অনুবাদক।
[5]. তাফসীর ইবনে কাছীর ১/৪৩।
[6]. ইবনু কুতায়বা, আদাবুল কাতিব, পৃ. ৩১।
[7]. বুখারী হা/৬৩১২।
[8]. তিরমিযী হা/৩৪০১, হাদীছ হাসান।
[9]. মুসলিম হা/২৭১৫; মিশকাত হা/২৩৮৬।
[10]. বুখারী হা/৫৪৫৯।
[11]. বুখারী হা/৬৩০৬; মিশকাত হা/২৩৩৫।
[12]. বুখারী হা/৬৩১৭।
[13]. আবুদাঊদ হা/৭৬৪, হাকেম হাদীছটিকে ছহীহ ও আলবানী যঈফ বলেছেন।
[14]. মুসলিম হা/৪৮৬; মিশকাত হা/৮৯৩।
[15]. আবুদাঊদ হা/১৫২২, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত হা/৯৪৯।
[16]. মুসলিম হা/৭২০; মিশকাত হা/১৩১১।
[17]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৪২২, হাদীছ ছহীহ।
[18]. আবুদাঊদ হা/২৭৭৪, হাদীছ ছহীহ।
[19]. শামসুল হক আযীমাবাদী, ‘আওনুল মা‘বূদ ৭/৩২৮।
[20]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৫৯৬২।
[21]. মুসলিম হা/২৭৬৯; ইবনু মাজাহ হা/১৩৯৩।
[22]. হিলয়াতুল আওলিয়া ৫/১৬০।
[23]. আল-বা‘ইছু ‘আলা ইনকারিল বিদঈ, পৃঃ ৬১।
[24]. খারাইতী, ফাযীলাতুশ শুকর, পৃঃ ৬৬।
[25]. আহমাদ হা/১৯৯৪৮; হাদীছ ছহীহ; মিশকাত হা/৪৩৭৯।
[26]. আহমাদ হা/১৮৪৭২, হাদীছ হাসান।
[27]. আহমাদ হা/৬৭০৮, শু‘আইব আরনাঊত্ব এটিকে হাসান বলেছেন।
[28]. শু‘আবুল ঈমান হা/৪৪২১।
[29]. নাশরু ত্বাইয়িত তা‘রীফ, পৃঃ ১৫৪।
[30]. বুখারী হা/৫২১৯; মুসলিম হা/২১২৯; মিশকাত হা/৩২৪৭।
[31]. আহমাদ হা/১৫৯২৯, সনদ ছহীহ।
[32]. لاضرر ولاضرار অর্থাৎ ইসলামে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করা এবং অন্যের ক্ষতি সাধন করার কোন সুযোগ নেই (ইবনু মাজাহ হা/২৩৪১)।-অনুবাদক।
[33]. তাফসীরুল বায়যাভী, পৃঃ ১৬৪।
[34]. তাফসীরে ত্বাবারী ১০/৩৫৪ পৃঃ।
[35]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ত্বরীকুল হিজরাতাইন ১/১৬৮।
[36]. তাফসীর ইবনু কাছীর ২/৭১১।
[37]. ঐ।
[38]. ইবনু আবিদ দুনয়া, আশ-শোকর, পৃঃ ৮।
[39]. ইবনু মাজাহ হা/১৮৫৬, আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।
[40]. তাফসীরে বায়যাভী, পৃঃ ৪৩৩।