মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (৭ম কিস্তি)

পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫। পর্ব ৬

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর মা

‘আমার বয়স যখন দশ তখন আমার মা আমাকে কুরআনের হাফেয করে গড়ে তোলেন। ফজর ছালাতের আগেই তিনি আমাকে জাগিয়ে দিতেন। বাগদাদের শীতের রাতগুলোতে তিনি আমার জন্য পানি গরম করে রাখতেন, আমার পোশাক পরিয়ে দিতেন। তারপর নিজের উড়না ও হিজাব পরে আমাকে সাথে করে মসজিদে নিয়ে যেতেন। মসজিদ ছিল আমাদের বাড়ি থেকে দূরে, আর রাস্তা থাকত অন্ধকার। সেজন্য তিনি প্রতিনিয়ত আমার সাথে এভাবে যাতায়াত করতেন’। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) মায়ের প্রসঙ্গে তার অভিব্যক্তি এভাবেই প্রকাশ করতেন।

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর মায়ের নাম ছাফিয়া বিনতে মায়মূনা বিনতে আব্দুল মালেক। তার পিতার নাম মুহাম্মাদ বিন হাম্বল (রহঃ)। তিনি মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে যৌবনকালেই মৃত্যুবরণ করেন। ইমাম ছাহেবের মায়ের বয়স তখন ত্রিশের কম। তা সত্ত্বেও তিনি আর বিবাহে আগ্রহ প্রকাশ করেননি। পুত্রকে স্নেহ ও মায়া-মমতা দিয়ে বড় করে তোলার আকাঙ্ক্ষাই তাঁর মনে বড় হয়ে দেখা দেয়। ফলশ্রুতিতে তিনি মুমিনদের দুনিয়ায় তাওহীদবাদীদের বিশ্বে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ইমাম হিসাবে তার ছেলে আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-কে উপহার দিয়ে গেছেন। আর আল্লাহ ছিলেন তার ইচ্ছার পিছনে তাওফীক্বদাতা।

সেই শৈশবে মা তার মধ্যে ঈমানের বীজ বপণ করেছিলেন, যাতে উত্তরকালে তিনি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ইমাম হিসাবে বরিত হ’তে পারেন। তার ছেলে যেমন শারঈ ইলমে পারদর্শী হবে; তেমনি হবে সংসারে অনাসক্ত, আল্লাহভীরু মানুষ, মা হিসাবে তিনি তেমনটাই চাইতেন। কুরআন, হাদীছ ও ফিক্বহ শারঈ ইলমের শিরোভূষণ। আল্লাহভক্তি ও সংসারে অনাসক্তি কেবল তখনই মাহাত্ম্যের উঁচু মাকামে উঠতে পারে যখন তা কুরআন, হাদীছ ও ফিক্বাহের বিদ্যায় সুশোভিত হবে। এমন অবস্থাতেই কেবল বান্দা বাছিরত সহকারে জেনে-বুঝে আল্লাহর ইবাদত করতে পারে। এমন হ’লেই সে রাসূল (ছাঃ)-এর বিধিবদ্ধ শরী‘আত মেনে জীবন কাটাতে পারে এবং দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আতের অনুপ্রবেশ ঘটানো থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে। বিদ্যার সাথে কার্যকর অভিজ্ঞতাও বড় প্রয়োজন। তার মায়ের সেদিকেও সমান নযর ছিল।

আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহঃ) মাতৃগর্ভে থাকাকালেই তার পিতা ইহজগত ছেড়ে গিয়েছিলেন। জন্মসূত্রে তিনি ইয়াতীম ছিলেন। মায়ের প্রসঙ্গ উচ্চারিত হ’লে ইমাম মহোদয় তার মায়ের অনুগ্রহ বিশেষভাবে স্বীকার করতেন। তাকে প্রতিপালন ও বড় মানুষ হিসাবে গড়ে তোলায় মায়ের ভূমিকা নিয়ে তিনি গৌরব করতেন।

ইমামের বয়স ৭০ বছর হয়ে গেছে, তা সত্ত্বেও সময়ের পরিক্রমা তাকে মা ও মায়ের কুলের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদাচরণ করার কথা ভুলতে দেয়নি। মায়ের প্রশংসা করতে তিনি মোটেও কৃপণতা করতেন না। লোকেদের সামনে মায়ের কথা আলোচনা করতে গিয়ে বলতেন, ‘আল্লাহ আমার মায়ের উপর রহম করুন, আমি আজও যখনই ফজর ছালাতের প্রস্ত্ততি নেই তখনই তার কথা মনে করি। তিনি আমার পোষাক-পরিচ্ছদ ও ওযূর পানির বন্দোবস্ত করে দিতেন এবং নিরাপত্তা প্রহরীদের না দেখা পর্যন্ত দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। নিরাপত্তা প্রহরীদের দেখতে পেলে তখনই কেবল তার মনে স্বস্তি আসত এবং আমাকে ছালাতে যাওয়ার জন্য ছেড়ে দিতেন। তিনি আমার সাথে নাশতা দিয়ে দিতেন এবং ছালাতের পর আমি যেন শিক্ষকের পাঠে অংশ নেই সেজন্য উপদেশ দিতেন।

‘মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার কবীরা গুনাহের কাফফারা’- উক্তিটি ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহঃ)-এর বলে কথিত। মায়ের সঙ্গে অভাবনীয় সদাচরণ ও তার প্রতি অগাধ ভালবাসা তার জীবনব্যাপী এ কথার বাস্তব প্রতিচ্ছবি হয়ে রয়েছে।

ইমামের মা বেশী বেশী ছিয়াম পালনকারী এবং রাত জেগে বেশী বেশী ছালাত আদায়কারী ছিলেন। তিনি তার ছেলেকেও রাতের ছালাতে অভ্যস্ত করার জন্য ফজরের আগে তাকে জাগিয়ে তুলতেন। মায়ের সঙ্গে ছেলেও যাতে সমভাবে ছালাত আদায় করেন সেটাই ছিল তার উদ্দেশ্য।

ইমাম আহমাদ (রহঃ) যখন ১৬ বছর বয়সে পদার্পণ করেন তখন তার মা তাকে ইলমে হাদীছ অন্বেষণের উদ্দেশ্যে সফর করতে নির্দেশ দেন। যেখানে অধিকাংশ মা তাদের একমাত্র পুত্রধনকে নিজের অাঁচলতলে আবদ্ধ রাখেন, ঘরের বাইরে যেতে দেন না, সেখানে এই মা তার একমাত্র পুত্রধনকে নিজের কাছে আটকে রাখেননি এবং ছেলের দৃঢ় ইচ্ছাকে তিনি থামিয়ে দেননি। তিনি বরং বিষয়টি আল্লাহর নিকট ন্যস্ত করেছেন এবং বিদ্যা অন্বেষণে ইখলাছ ও তাক্বওয়া অবলম্বনের জন্য ছেলেকে অছিয়ত করছেন।

উম্মাহর মধ্যে নবজাগরণ সৃষ্টি, উম্মাহর উন্নতির জন্য কাজ করে যাওয়া, মুসলিমদের কল্যাণ সাধন এবং তাদের মর্যাদা সমুন্নত করার লক্ষ্যে আলেমদের যথার্থভাবে গড়ে তুলতে প্রতি যুগের মায়েদের ভূমিকা তো সর্বদা এমনই হওয়া উচিত।

ইমাম আহমাদ (রহঃ)-এর পিতা মুহাম্মাদ ইবনু হাম্বল মার্ভ শহরে মুসলিম সেনাবাহিনীর সেনাপতি পদে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে তিনি বাগদাদ আসেন। তখন তার বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। বাগদাদেই তিনি ছাফিয়া বিনতে মায়মূনা বিনতে আব্দুল মালেকের সাথে শুভ পরিণয়ে আবদ্ধ হন। এ সম্পর্কে আবু আব্দুল্লাহ ইবনু বাত্তাহ বলেন, আবু আব্দুল্লাহ আহমাদ ইবনু হাম্বলের মা ছিলেন শায়বানী বংশীয়। তার নাম ছিল ছাফিয়া বিনতে মায়মূনা বিনতে আব্দুল মালেক শায়বানী। শায়বানী বংশের বনু আমের গোত্রীয় নারী ছিলেন তিনি। ইমাম আহমাদ (রহঃ)-এর পিতা ছাফিয়া বিনতে মায়মূনাদের বাড়িতে মেহমান হন এবং তাকে বিবাহ করেন। তার দাদা আব্দুল মালেক বিন সাওয়াদা বিন হিন্দ শায়বানী ছিলেন শায়বানী বংশের অন্যতম নেতা। আরবের বিভিন্ন গোত্র তার বাড়িতে নানা সময়ে পা রাখতেন আর তিনি আনন্দিত চিত্তে তাদের মেহমানদারি করতেন।[1]

মুহাম্মাদ যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন তার বয়স ছিল ত্রিশের উপর। তার স্ত্রীর বয়স ছিল ত্রিশের কম।[2] এ সময়ে আহমাদ ছিলেন ছোট্টটি, কিছুই বুঝতেন না। তার পিতা ও দাদাকে দেখেছেন কি-না জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি ঘাড় নাড়তেন। তার বয়সই বা তখন কত ছিল? অনেকে তিন বছরের উপর জোর দিয়েছেন। এ বিষয়ে স্বয়ং ইমাম আহমাদ আমাদের বলেছেন, মার্ভ থেকে আমাকে গর্ভাবস্থায় নিয়ে আসা হয়। আমার পিতা মুহাম্মাদ বিন হাম্বল যখন মারা যান তখন তার বয়স ত্রিশ বছর। আমার মা তখন আমার লালন-পালনের দায়িত্ব নেন।[3]

অর্থসঙ্কট থাকা সত্ত্বেও আহমাদ (রহঃ)-এর মা ছেলের বিদ্যা শিক্ষার প্রতি খুবই আগ্রহী ছিলেন। তিনি কুরআন হেফয ও হস্তলিপি শেখার জন্য তাকে মক্তবে পাঠিয়ে দিতেন।

সেই শিশুকাল থেকে তার মধ্যে শরাফত, মাহাত্ম্য ও যোগ্যতার চিহ্ন ফুটে উঠেছিল। ইবনুল জাওযী (রহঃ) স্বীয় সনদে আবু আফীফের যবানিতে লিখেছেন, ‘মক্তবে আহমাদ আমাদের সাথে অধ্যয়ন করত। সে ছিল ছোট্ট শিশু। আমরা তার যোগ্যতা মাহাত্ম্য আগে থেকে জানতাম না। সমকালীন খলীফার রাক্কায় অবস্থানকালে তার সাথে সেনাবাহিনী থাকত। সেনা সদস্যরা তাদের অবস্থা জানিয়ে বাগদাদে নিজেদের পরিবারের নিকট পত্র দিত। সে পত্র পাঠ ও জবাবি পত্র লেখার জন্য মহিলারা আহমাদ ছাড়া অন্য কাউকে পসন্দ করত না। তারা মক্তবের শিক্ষকের নিকট এই বলে লোক পাঠাত যে, আপনি আমাদের নিকট আহমাদ ইবনু হাম্বলকে পাঠিয়ে দিন। সে তাদের নিকট আগত পত্র তাদেরকে পড়ে শুনাত এবং তাদের হয়ে পত্রের জবাব লিখে দিত। অনেক সময় তারা নেতিবাচক কোন কথা তাকে লিখতে বলত, কিন্তু সে তাদের সে কথা লিখত না’।

আবু সিরাজ ইবনু খুযাইমা বলেন, সে যখন মহিলাদের কাছে প্রবেশ করত তখন মাথা তুলে কখনও তাদের দেখত না। আমার পিতা তার আদব-আখলাক ও সুন্দর ব্যবহারের কথা শুনে তাজ্জব বনে যেতেন। তিনি বলতেন, আমি আমার ছেলেদের জন্য এত পয়সাকড়ি খরচ করি, শিষ্টাচার শিক্ষাদাতাদের নিকট শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার জন্য নিয়ে যাই, অথচ কাজের কাজ কিছু হ’তে দেখি না। অথচ এই ইয়াতীম বাচ্চা আহমাদকে দেখ, কিভাবে সে বেড়ে উঠছে! তিনি তাকে নিয়ে বিস্ময় মানতেন।[4]

ইমাম আহমাদ (রহঃ) আল্লাহর অনুগ্রহে ও মায়ের তরবিয়তে শিষ্টাচারের এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন যে লোকে তাকে ঈর্ষার চোখে দেখতে শুরু করে। ইয়াতীম হয়েও তিনি যে গুণের অধিকারী হয়েছেন মাতা-পিতার ছত্রছায়ায় থেকেও বহু শিশুর সে সৌভাগ্য হয়নি। ছোট্ট মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তিনি চেনা-পরিচিত নারী-পুরুষ সকলের ভরসার স্থল ছিলেন।

মা ছাফিয়া ছেলে আহমাদের মধ্যে ইলমের প্রতি ভালোবাসার চারা রোপণ করেছিলেন। সে চারা তার মনের মাঝে শক্তি সঞ্চয় ও জোরদার হ’তে থাকে। শারঈ বিদ্যার প্রতি তার মনের আকর্ষণ জয়যুক্ত হয় এবং সে বিদ্যার খেদমতে তিনি আজীবন অতিবাহিত করেন।

খতীব বাগদাদী তার রচিত ‘আল-জামে‘ লি-আখলাকির রাবী ওয়া আদাবিস সামে’ গ্রন্থে বিদ্যা শেখার জন্য তার ভোর সকালে ওঠা সম্পর্কে পুত্র আব্দুল্লাহ ইবনু আহমাদ ইবনে হাম্বল থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, প্রায়শ আমি ভোর বেলায় হাদীছের দরসে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতাম। তখন আমার মা আমার কাপড় ধরে বলতেন, লোকেরা আযান দিক, সকাল হোক। অনেক সময় আমি আবুবকর ইবনু আইয়াশ ও অন্যদের মজলিসে ভোর বেলায় হাযির হয়ে যেতাম।[5]

তার মা তাকে বিদ্যা অন্বেষণ ও তা অর্জনের চেষ্টায় ব্রতী হ’তে বরাবর উৎসাহিত করতেন, কিন্তু যখন দেখতেন ছেলে লেখাপড়া করতে গিয়ে সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ করছে তখন তিনি ছেলেকে নিজ শরীরের উপর করুণা করতে আহবান জানাতেন।

ইমাম আহমাদ (রহঃ) যাতে নিশ্চিন্তে খোলা মনে বিদ্যা অর্জন করতে পারেন সেজন্য তার মা অনেক ব্যয় করতেন এবং ছেলে যাতে আরামে লেখাপড়া করতে পারে সেজন্য যা কিছু যোগান দেওয়া দরকার সন্তুষ্ট চিত্তে তার ব্যবস্থা করতেন। আমরা যখন জানতে পারি যে, ইমাম আহমাদ (রহঃ) চল্লিশ বছর বয়সের পূর্বে বিয়ে করেননি তখন বুঝতে পারি যে, শিক্ষার প্রতি তার মায়ের অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান হেতুই তা বিলম্বিত হয়েছিল।[6]

ইমাম আহমাদের পিতা বাগদাদে তাদের জন্য দু’টি বাড়ি রেখে গিয়েছিলেন। তার একটিতে তারা বাস করতেন। আর দ্বিতীয়টি থেকে খুব সামান্য ভাড়া পেতেন। তাদের অন্য কোন আয়ের পথ ছিল না। ফলে প্রথম জীবনে ইমাম ছাহেবকে কঠিন অভাবের মোকাবেলা করতে হয়েছে। অভাবের মধ্যে তিনি প্রতিপালিত হয়েছেন, অভাবের মধ্য দিয়ে তিনি শিক্ষা লাভ করেছেন এবং এই অভাবকে সঙ্গে করে বিদ্যা ও বোধযোগে সংসারের প্রতি অনাসক্তি দেখিয়েছেন। তার শিক্ষক শাফেঈ (রহঃ) যেমন গাযায় জন্মগ্রহণ করেছেন, মক্কায় বেড়ে উঠেছেন তেমনি আহমাদ (রহঃ) বাগদাদে জন্মেছেন এবং বাগদাদে বেড়ে উঠেছেন। এক পর্যায়ে যখন তিনি কুরআন হেফয শেষ করেন এবং ভাষা শিক্ষা সম্পন্ন করেন তখন সরকারী কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। সেখানে তার যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল লেখালেখির অনুশীলন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, যখন আমি ছোট শিশু তখন থেকে বিভিন্ন মক্তবে যাতায়াত করতাম, তারপর বিভিন্ন অফিসে ঘোরাফেরা করতাম, তখন আমার বয়স ছিল চৌদ্দ।[7]

তারপর থেকে ইমাম আহমাদ (রহঃ) বাগদাদের শায়খদের নিকট থেকে হাদীছ অন্বেষণ ও সংগ্রহ শুরু করেন। যার থেকে তিনি প্রথম হাদীছ লিখেন তার নাম ছিল আবু ইউসুফ। ইমাম মহোদয় বলেন, আমি যখন হাদীছ অন্বেষণ শুরু করি তখন আমার বয়স ষোল বছর। আমার শিক্ষক হাশিম যখন মারা যান তখন আমার বয়স বিশ বছর। হাশিম থেকে আমি প্রথম হাদীছ শুনি ১৯৯ হিজরীতে।

তারপর ইমাম আহমাদ (রহঃ) হাদীছ অন্বেষণে কূফা, বছরা, মক্কা, মদীনা, ইয়ামন, শাম ও জাযিরা সফর করেন এবং প্রতিটি শহরের আলেমদের থেকে হাদীছ লিপিবদ্ধ করেন।

এভাবেই মহীয়সী মা অভাব-অভিযোগ সত্ত্বেও ছেলেকে বিদ্যা শিখতে অনুপ্রেণা যোগান এবং তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। এভাবে তিনি তার মহান প্রভুর সাথে ছেলের মাধ্যমে তিজারতি চালিয়া যান। ইমাম মহোদয় নিজের পারিবারিক অবস্থা সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন। ফলে অর্থকড়ি কম খরচ করতে তিনি সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন। তাতে যদি তাকে শারীরিকভাবে দ্বিগুণ কষ্ট ও দুর্বলতা মেনে নিতে হয় তবুও তিনি তা করতেন।

তার ছেলে আব্দুল্লাহ বলেন, আমার পিতা পায়ে হেঁটে তুস শহরে গিয়েছিলেন। আব্দুর রাযযাক ছান‘আনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তিনি পায়ে হেঁটে ইয়ামন গমন করেছিলেন। আমার পিতা বলেছেন, আমি আব্দুর রাযযাকের হেফয বা স্মৃতি থেকে প্রথম মজলিসে ছাড়া আর লিখিনি। কারণ আমরা রাতে তার কাছে প্রবেশ করেছিলাম, সেখানে এক জায়গায় আমরা তাকে বসা পেয়েছিলাম। তিনি আমাদের সত্তরটি হাদীছ লিখিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর তিনি জনতার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ইনি অর্থাৎ আমার পিতা যদি না থাকতেন তবে আমি তোমাদের হাদীছ শুনাতাম না।[8] সম্ভবত তিনি আহমাদ (রহঃ)-এর মাঝে বিনয়-ভদ্রতা ও সুন্দর ভাব-ভঙ্গি লক্ষ্য করেছিলেন, যা তাকে হাদীছ বর্ণনা করতে এবং উক্ত কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

হাত খাটো হওয়ার কারণে ইমাম আহমাদের জন্য অনেক সময় সফরে যাত্রা বাধা হয়ে দাঁড়াত। সফরের প্রতি ভীষণ আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও জীবিকার সংকীর্ণতা তাকে তা থেকে নিবৃত রাখত। একবার তিনি বলেন, আমার কাছে যদি ৫০ দিরহামও থাকত আমি রায় শহরে জারীর বিন আব্দুল হামীদের কাছে যেতাম। আমার কিছু সাথী-বন্ধু তার কাছে যাত্রা করেছিল। কিন্তু আমার কাছে কিছু না থাকায় আমি যেতে পারিনি। একবার তিনি বলেছিলেন, আমার কাছে যদি খরচের অর্থ থাকত তাহ’লে আমি আন্দালুসে ইয়াহইয়া বিন ইয়াহইয়া আন্দালুসীর নিকট যেতাম। ইয়াহইয়া ছিলেন ইমাম মালেকের বিশিষ্ট ছাত্র।[9]

বিদ্যা অন্বেষণের সফরে ইমাম আহমাদ অনেক কষ্ট ও ঝড়-ঝঞ্ঝার মোকাবেলা করেছেন। রাস্তা অনুকূল ছিল না এবং যানবাহনের জোগাড়-যন্তিও তেমন কিছু ছিল না। দিরহাম- শূন্য হাতের ফলে তার যানবাহনে ওঠার সুযোগ ঘটত না, ফলে অনেক সময় তিনি সফর করতে পারতেন না। আরেক দিকে তার মধ্যে সম্মানবোধ ছিল অত্যন্ত প্রখর। তিনি কারো থেকে দান কিংবা উপঢৌকন গ্রহণ করতেন না। পুরস্কার ও উপহারাদি গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন খুবই পরান্মুখ। কপালের ঘাম ঝরিয়ে যতটুকু হালাল উপার্জন করতে পারতেন তাতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকতেন। উটওয়ালাদের সাথে তিনি দৈহিক শ্রমের বিনিময়েও কাজ করতেন।

আবু নু‘আইম তার হিলইয়াতুল আওলিয়া গ্রন্থে ইসহাক বিন রাহওয়াইহ-এর বরাতে বলেছেন যে, আহমাদ বিন হাম্বল যখন আব্দুর রাযযাকের উদ্দেশ্যে ইয়ামন যাত্রা করেন তখন পথিমধ্যে তার অর্থ ফুরিয়ে যায়। তিনি তখন উট ওয়ালাদের মধ্যে মজদুরী করতে করতে ছান‘আ পৌঁছে যান। তার সাথীরা তার দিকে পারস্পরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তা তার রুচি-প্রকৃতির বিরুদ্ধ বিধায় তিনি তাদের দেওয়া কোন কিছুই গ্রহণ করেননি।

অনুরূপভাবে তিনি স্বীয় সনদে আব্দ বিন হুমাইদ হ’তে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি আব্দুর রাযযাককে বলতে শুনেছি, আমাদের এখানে আহমাদ বিন হাম্বল আগমন করেন এবং প্রায় দু’বছর অবস্থান করেন। আমি তাকে বললাম, হে আবু আব্দুল্লাহ, এই জিনিসটি নিন এবং আপনার কাজে লাগান। আমাদের এখানকার ভূমি তো ব্যবসার কেন্দ্রও নয়, আয়-উপার্জনের জায়গাও নয়। আব্দুর রাযযাক আমাদেরকে তার হাতের মুঠি খুলে দেখালেন, তাতে কিছু দীনার ছিল। কিন্তু আহমাদ বললেন, আমি ভালো আছি। তিনি আমার দেওয়া জিনিস গ্রহণ করেননি।[10]

আলী ইবনু জাহাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাদের একজন প্রতিবেশী ছিল। সে একদিন আমাদের সামনে একটি বই বের করে বলল, তোমরা কি এই লেখার সাথে পরিচিত? আমরা বললাম, হ্যাঁ, এ তো আহমাদ বিন হাম্বলের লেখা। আমরা বললাম, কিভাবে সে এ লেখা পেল? সে বলল, আমরা মক্কায় সুফিয়ান বিন উয়াইনার কাছে অবস্থান করছিলাম। কয়েকদিন ধরে আমরা আহমাদ বিন হাম্বলকে চাচ্ছিলাম, কিন্তু তাকে দেখছিলাম না। তার খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য তিনি যে বাড়িতে থাকতেন আমরা সে বাড়িতে গেলাম। বাড়িওয়ালা আমাদের বলল, তিনি এ ঘরে আছেন। আমরা গিয়ে দেখলাম ভিতর থেকে দরজা বন্ধ। হঠাৎ নযরে এল, দরজায় ছেঁড়া কাপড়। আমরা তাকে বললাম, হে আবু আব্দুল্লাহ!, আপনার খবর কি? বেশ ক’দিন ধরে আপনাকে যে আমরা দেখছি না। তিনি বললেন, আমার কাপড় চুরি হয়ে গেছে। আমি তাকে বললাম, আমার কাছে বেশ কিছু দীনার আছে। আপনি চাইলে তা কর্য নিতে পারেন, আবার চাইলে ভালোবাসার নিদর্শন হিসাবে নিতে পারেন। কিন্তু তিনি তা নিতে অস্বীকার করেন এবং বলেন, তুমি আমার জন্য একটা কাপড় কিনে দু’ভাগ করবে। এক ভাগ হবে লুঙ্গি এবং এক ভাগ হবে চাদর। বাকি যা থাকবে আমার নিকট নিয়ে আসবে। আমি তার কথামতো কাজ করলাম এবং কিছু কাগজপত্র নিয়ে এলাম। তিনি আমার জন্য এটা লিখে দিলেন। এটাই হচ্ছে তার লেখা লিপি।[11]

এমনিভাবে আল্লাহর উপর ভরসা করে এক সতেজ মন, কঠোর শ্রম ও কষ্টের জীবন সাথী করে আহমাদ (রহঃ) তার পথে বেরিয়ে পড়েছিলেন। অতিক্রম করেছিলেন কত জঙ্গল, মরুভূমি আর জনশূন্য বন্ধুর ময়দান। ঘাস, লতা-পাতাহীন ভূমি হয়েছে তার বিছানা, আকাশ হয়েছে আচ্ছাদনের চাদর, আর ইট-পাথর হয়েছে বালিশ। এমনি করে তিনি মাশায়েখদের সাথে মিলিত হয়েছেন, তাদের থেকে গ্রহণ করেছেন হাদীছ। ফলে তিনি হয়ে উঠেছেন অনুসরণীয় ইমাম, আঙুল তুলে ইশারাযোগ্য হুজ্জাত এবং হাদীছ শ্রবণ ও গ্রহণের জন্য আগ্রহী শিক্ষার্থীদের সফরের লক্ষ্যস্থল।[12]

এ ধরনের বহুল সফরের ফলে তার কাছে হাদীছ ও আছারের বিরাট একটা ভান্ডার সঞ্চিত হয়েছিল। আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বলেন, আমাকে আবু যুর‘আ বলেছেন, তোমার পিতা হাযার হাযার হাদীছ মুখস্থ করেছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, আপনি জানলেন কি করে? তিনি বললেন, তার প্রখর স্মৃতিশক্তি থেকে জানা গেছে। সকল অধ্যায় তো তার নামে গৃহীত। ইমাম যাহাবী সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা গ্রন্থে এ ঘটনা উল্লেখের পর বলেছেন, আবু আব্দুল্লাহর জানার ব্যাপকতা নিয়ে উল্লিখিত সংখ্যা সত্য। তবে তারা হিসাব করতে গিয়ে পুনরাবৃত্তি, ছাহাবীদের আছার, তাবেঈদের ফৎওয়া ও তাফসীরকেও হিসাবে ধরেছেন। নতুবা শক্তিশালী মারফূ‘ হাদীছের সংখ্যা এর দশ ভাগের এক ভাগও হবে না।[13]

ইমাম যাহাবী আবু যুর‘আ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, ইমাম আহমাদের মৃত্যুর দিন আমি তার রচিত গ্রন্থাবলির একটা আন্দায করেছিলাম। তা বার উটের বোঝার উপরে ছিল। তার বাইরে ‘অমুক বর্ণিত হাদীছ’ আর ভিতরে ‘অমুক আমাদেরকে বর্ণনা করেছেন’ বলে কোন কথা ছিল না। পুরোটাই তিনি মুখস্থ থেকে লিখেছিলেন।[14]

মায়ের সঙ্গে সন্তানের যতটা ভালো ব্যবহার করা সম্ভব ইমাম আহমাদ (রহঃ) নিজ মায়ের সাথে তা করতেন। মায়ের অনুগ্রহ তিনি যেমন জানতেন, তেমনি তা স্বীকার করতেন। তার দয়া-দাক্ষিণ্যের কথা মনে রাখতেন। এক্ষেত্রে ইবনুল জাওযী তার পুত্র ছালেহ থেকে যে কথা উদ্ধৃত করেছেন তা বলা প্রাসঙ্গিক। তার পিতা আহমাদ (রহঃ) তাকে বলেছেন, একবার আমি মাকে না জানিয়ে কূফার পথে যাত্রা করেছিলাম। পথে ইট মাথার তলে দিয়ে আমি রাত কাটাতাম। কিন্তু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আমি মায়ের কাছে ফিরে এসেছিলাম। তার অনুমতি আমি নেইনি বলে এ জ্বর হয়েছিল।[15]

দেখুন, মায়ের সঙ্গে কঠিন সদাচরণ এবং মায়ের সন্তোষ লাভের উদগ্র আকাঙ্ক্ষা থেকে তার বিশ্বাস জন্মেছিল যে, মায়ের অনুমতি না নেওয়ার জন্য তার জ্বর হয়েছে। যেন যাত্রাকালে তিনি মায়ের থেকে বরকত লাভ করেননি, তাই তিনি মায়ের অনুমতি লাভের জন্য যে রাস্তা ধরে গিয়েছিলেন সেই রাস্তাতেই ফিরে এসেছিলেন এবং তার দো‘আ ও যত্নে সুস্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার আশা করছিলেন।

এই নেককার পুত্র ও মহান ইমামের জন্য ঐ মহীয়সী মা যথেষ্ট। তেমনি মায়ের জন্য এটা যথেষ্ট যে, তিনি মুমিনদের দুনিয়ায় তাওহীদবাদীদের বিশ্বে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ইমাম হিসাবে তার ছেলে আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-কে উপহার দিয়ে গেছেন।

মা ও ছেলের উপর আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট থাকুন এবং পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তাদের উপর সালাম বর্ষণ অব্যাহত রাখুন।

[ইমাম আহমাদ ১৬৪ হিজরীতে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২৪১ হিজরীতে বাগদাদে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সংকলিত ও রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে মুসনাদে আহমাদ, কিতাবুয যুহদ, রিসালাতুস সানিয়া, আহকামুন নিসা, উছূলুস সুন্নাহ, কিতাবুল ঈমান, ফাযায়েলুছ ছাহাবা, আর-রাদ্দু ‘আলাল জাহমিয়াহ প্রভৃতি।]

ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর মা

ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর মায়ের কীর্তি ছেলের কীর্তির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। দুঃখের বিষয়, আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় আমরা তার মায়ের নাম উদ্ধার করতে পারিনি।

তিনি ছিলেন হাদীছ শাস্ত্রে ‘আমীরুল মুমিনীন’ নামে খ্যাত ও আল্লাহর কিতাব কুরআনের পরে সর্বাধিক ছহীহ গ্রন্থ ‘আল-জামেউছ ছহীহুল মুসনাদুল মুখতাছারু মিন উমুরি রাসূলিল্লাহি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়া সুনানিহী ওয়া আইয়ামিহী’ ওরফে ‘ছহীহ বুখারী’র সংকলক ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বুখারীর সম্মানিত মা।

হে আমাদের মায়েরা! আপনাদের মধ্যে এমন কেউ আছেন কি, যিনি এমন ইমামের জন্ম দিয়েছেন?

যে ছেলে এত বড় মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন তার কিছুটা তো আপনা থেকেই মাতা-পিতার ভাগে পড়ে। এতো তাদেরই প্রচেষ্টার ফসল। দ্বীন-ধর্মে ও ফযীলতে-মাহাত্ম্যে মাতা-পিতার হয়তো এমন কোন কৃতিত্ব ছিল যার জন্য আল্লাহ তা‘আলা ইমাম বুখারীকে তাদের পুত্র করেছিলেন, আর তারাও তার মাতা-পিতা হ’তে পেরেছিলেন। বাস্তবেও অবস্থা তাই ছিল। যে গৃহে ইমাম বুখারী জন্মেছিলেন সে গৃহ ছিল বিদ্যা, ফযীলত ও তারবিয়াতের কেন্দ্র।

তার পিতা ইসমাঈল ছিলেন মুহাদ্দিছ শ্রেণীর আলেম। তিনি হাদীছ সংগ্রহে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং এজন্য দেশ-বিদেশে সফর করেছিলেন। মালেক বিন আনাস ও হাম্মাদ বিন যায়েদ থেকে তিনি হাদীছ বর্ণনা করেছেন এবং ইবনুল মুবারকের দর্শন লাভ করেছেন, তার সাথে মুছাফাহ করেছেন।

ইসহাক বিন আহমাদ বিন খালাফ থেকে বর্ণিত, তিনি ইমাম বুখারীকে বলতে শুনেছেন, আমার পিতা মালেক বিন আনাস থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন ও হাম্মাদ বিন যায়েদকে দেখেছেন এবং ইবনুল মুবারকের সাথে মুছাফাহ করেছেন।[16]

ইসমাঈল বেশ-ভূষায় অত্যন্ত পরিপাটি ও তাক্বওয়া-পরহেযগারির সাথে কাজ-কর্মের জন্য জনসমাজে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি ব্যবসা করতেন এবং তার ইলম ও পরহেযগারি ব্যবসায়ের কাজে লাগাতেন। ফলে তার উপার্জন ছিল খাঁটি ও উত্তম।

ইমাম বুখারী (রহঃ) ১৯৪ হিজরীতে বুখারা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পুত্র মুহাম্মাদের উপর পিতা ইসমাঈলের যিন্দেগীর ছায়া দীর্ঘায়িত হয়নি। তিনি যখন দুনিয়া ছেড়ে যান তখন ছেলের বয়স সবেমাত্র কয়েক বছর হয়েছিল। অবশ্য বুঝার মতো বয়সে তিনি উপনীত হয়েছিলেন।

মৃত্যুশয্যায় তিনি ছেলে বুখারীকে ডেকে বলেছিলেন, আমি তোমার জন্য এক লাখ দিরহাম রেখে গেলাম, এর একটি দিরহামও হারাম উপায়ে অথবা সন্দেহমূলক পন্থায় অর্জিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই।[17]

আমরা কল্পনা করতে পারি, ইমাম বুখারীর পিতা ইসমাঈল (রহঃ) যে ইলম আয়ত্ব করেছিলেন সেই ইলমই তাকে এত জোরালো কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করেছে। না তিনি তার সম্পদে একটা হারাম দিরহাম প্রবেশের সুযোগ দিয়েছেন, না তাতে একটি সন্দেহজনক দিরহামের অবকাশ রেখেছেন।

ইমাম বুখারীর ইসলামী দুনিয়ায় অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার পিছনে তার পিতার এ উক্তিকে ইলহাম হিসাবে মনে করার দুঃসাহস আমরা দেখাতেই পারি। নির্ভেজাল হালাল সম্পদের একটি মহতী প্রভাব তো দেহ-মনের উপর অবশ্যই আছে।

আবার এ অর্থের পুরোটাই পিতা রেখে গিয়েছিলেন পুত্রের ইলম শেখার জন্য। এ অর্থ কার্যত ঐ পথেই ব্যয়িত হয়েছিল। ইমাম বুখারী (রহঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছ শোনা ও শেখার জন্য যে নানা শহর ও অঞ্চল সফর করেছিলেন সেক্ষেত্রে তিনি এ অর্থ ব্যয় করেছিলেন।

এতো গেল ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর পিতার দিক। এমন আদর্শ পিতার সন্তান তো তার মতই হবে। আমরা তার মহীয়সী মায়ের মধ্যেও একই আদর্শের ছোঁয়া লক্ষ্য করি।

পিতার মৃত্যুর পর ইমাম বুখারী (রহঃ) ইয়াতীম হিসাবে তার মায়ের কোলে লালিত-পালিত হন। তিনি তার তারবিয়াত ও শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করেন। ফলে মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি কুরআন হেফয সম্পন্ন করেন।

অনেক আলেম-ওলামা ও বড় মানুষ, এমনকি নবী-রাসূলদেরও ইয়াতীম হিসাবে প্রতিপালিত হ’তে দেখা যায়। অনেক সময় আল্লাহর রীতি এমনই হয়ে থাকে।

ঐতিহাসিকগণ শিশুকালে ইমাম বুখারীর জীবনে এক বিস্ময়কর ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। একবার রোগাক্রান্ত হওয়ার দরুন তার দু’চোখের জ্যোতি নিভে গিয়েছিল। তিনি চোখে দেখতে পেতেন না। মায়ের মন এতে বড়ই ব্যথিত হয়। ছেলের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবার জন্য তিনি আল্লাহর নিকটে বেশী বেশী সকাতর কান্নাকাটি ও দো‘আ-খায়ের করতে থাকেন। একদিন স্বপ্নে তিনি ইব্রাহীম খলীল (আঃ)-কে দেখতে পান। তিনি তাকে ডেকে বললেন, হে মেয়ে! তোমার বেশী বেশী কান্নাকাটি বা দো‘আর ফলে আল্লাহ তোমার ছেলের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। এ কাহিনীর বর্ণনাকারী আহমাদ বিন ফযল বলখী বলেন, আমরা সকাল বেলা উঠে দেখি, মহান আল্লাহ তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন।[18]

সন্দেহ নেই যে, এমন দুর্ঘটনা ঘটলে অনেক হুঁশিয়ার, জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান পুরুষেরও বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়, সেখানে একজন মহিলা যে কিনা ছেলের মা, তার অবস্থা কেমন হ’তে পারে? যেখানে ছেলের চেহারা একটু আহত হ’লে কত মায়ের অন্তর বিদীর্ণ হয়ে যায় সেখানে যে মায়ের পুত্রের দু’টি চোখ অন্ধ হয়ে গেছে, দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে গেছে তার অবস্থা কেমন হ’তে পারে? ঐ ছেলের জীবন তো এমন দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে কাটবে। এহেন অবস্থা কি কোন মায়ের কাম্য হ’তে পারে?

কিন্তু ইমাম বুখারীর মা, তিনি না অস্থির হয়েছেন, না হতাশ হয়েছেন। তিনি বরং তাঁর কাছে নিজের প্রয়োজন তুলে ধরেছেন, যিনি প্রার্থীদের প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। তাঁর কাছেই মনের আকুতি পেশ করেছেন, আহাজারি ও কান্নাকাটি করেছেন। তাঁর দরজায় নিরন্তর করাঘাত করে ছেলের সুস্থতার জন্য দো‘আ-প্রর্থনা করেছেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা তার দো‘আ কবুল করেছেন এবং তার কান্না শুনেছেন। যেন এই অসহায় মা ভীষণ কষ্ট ও দুর্বলতা নিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন কিংবা ঘুমিয়ে পড়ার এক পর্যায়ে তার সন্তানের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার সুস্বপ্ন দেখেছেন। খোশখবর হিসাবে শুধু সুস্থতার স্বপ্ন দেখলেই যেখানে যথেষ্ট হ’ত, সেখানে আল্লাহর নবী ও অন্তরঙ্গ বন্ধু ইব্রাহীম (আঃ)-এর মুখ থেকে তাকে সেই খোশখবরের কথা জানানো হয়েছে। স্বপ্নে তিনি তাকে ডেকে বলেছেন, হে মেয়ে! তোমার বেশী বেশী কান্নাকাটি বা দো‘আর ফলে আল্লাহ তোমার ছেলের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তিনি আল্লাহ প্রদত্ত এহেন সুযোগের অধিকারী কিভাবে হ’লেন তার কারণও ইব্রাহীম (আঃ) তাকে স্বপ্নে জানিয়ে দিয়েছেন। বেশী বেশী কান্নাকাটি বা দো‘আর কারণে মায়ের এ অর্জন হয়েছে।

এ স্বপ্নের মধ্যে ইমাম বুখারীর মায়ের জন্য যেমন, তেমনি অন্যদের জন্যও বার্তা মেলে যে, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দো‘আ কল্যাণ বয়ে আনে এবং তা আল্লাহর দরবারে শ্রুত ও গৃহীত হয়ে থাকে। একই সাথে এ বার্তাও মেলে যে, মহান রাববুল আলামীনের নিকটে নতজানু হয়ে কান্নাকাটির আলাদা মর্যাদা রয়েছে। যাবতীয় বিষয় তো আল্লাহরই হাতে, সবকিছু তো তাঁর হুকুমেই হয়, রাজ্য-রাজপাট তো তাঁরই। তিনি যখন কিছু করতে ইচ্ছা করেন তখন বলেন, ‘হও’, আর অমনি তা হয়ে যায়।

এ ঘটনার মধ্যে ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর মায়ের কারামত নিহিত রয়েছে। তার কারামত এজন্য যে, তার ছেলের দৃষ্টিশক্তি চলে যাওয়ার পর আল্লাহ তা‘আলা তা ফিরিয়ে দিয়েছেন। কারামত এজন্য যে, নিজেকে নগণ্য মনে করে স্বীয় প্রভুকে একমাত্র ভরসাস্থল ভেবে তার নিকট ছেলের জন্য দো‘আ করেছেন এবং তা মঞ্জুর হয়েছে। কারামত এজন্য যে, ছেলের সুস্থতা লাভের সুসংবাদ স্বপ্নে তিনি ইব্রাহীম খলীল (আঃ)-এর মাধ্যমে লাভ করেছেন।

ইমাম বুখারীর পিতা ছেলের ভবিষ্যতের জন্য সন্দেহমুক্ত হালাল অর্থের যে ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায়, ‘তিনি ছিলেন যোগ্য পুত্রের যোগ্য পিতা’। ঠিক একইভাবে মায়ের কারামতে পুত্রের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ায় আমরা মায়ের ক্ষেত্রেও পুনরাবৃত্তি করতে পারি, ‘তিনি ছিলেন যোগ্য পুত্রের যোগ্য মাতা। ইমাম বুখারীর মত মনীষীর মা হওয়া কেবল তারই সাজে’।

পিতার মৃত্যুর ফলে ইমাম বুখারীর মাকে ছেলের লালন-পালনে ও শিক্ষা-দীক্ষায় একই সাথে পিতা ও মাতার ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। তিনি সে দায়িত্ব অত্যন্ত সুন্দর ও সুচারুরূপে আঞ্জাম দিয়েছেন। তিনি তার জন্মস্থান বুখারাতে তার প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বুখারার আলেমদের থেকে আরবী ভাষা, কুরআন মাজীদ হেফয ও হাদীছ হেফয সহ অন্যান্য জ্ঞান অর্জন সম্পন্ন হ’লে তিনি বড় ও ছোট ছেলেকে নিয়ে মক্কা রওয়ানা করেন। সেখানে যাতে তিনি ইলমের দরিয়া থেকে নিজের ইলমের পরিধি বৃদ্ধি করতে পারেন এবং ইলমের নহর থেকে অঞ্জলি ভরে ইলমের সুধা পান করতে পারেন সেটাই ছিল মায়ের বাসনা ও প্রত্যাশা। মায়ের মক্কা যাত্রাকালে ছোট ছেলের বয়স ছিল ১৬ বছর। হজ্জের ফরয দায়িত্ব পালন শেষে মা বড় ছেলেকে সাথে করে দেশে ফিরে আসেন, ছোট ছেলেকে রেখে আসেন ইলম শিক্ষার জন্য।

মুহাম্মাদ বিন আবু হাতেম ইমাম বুখারীর শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন তা যেন আমরা খামোশ হয়ে শুনি। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার ইলমী কাজের সূচনা কিভাবে হয়েছিল? উত্তরে তিনি বলেন, আমি যখন মক্তবে পড়ি তখনই আমার মাঝে হাদীছ মুখস্থ করার আকাঙ্ক্ষা জাগে। আমি বললাম, এ সময় আপনার বয়স কত ছিল? তিনি বললেন, ১০ বছর কিংবা তারও কম। ১০ বছর বয়সের পরে আমি মক্তবের পড়া শেষ করি। তারপর আমি দাখেলী ও অন্যান্যদের নিকট আসা-যাওয়া করতে থাকি। একদিন দাখেলী লোকদের পড়াতে গিয়ে বললেন, ‘সুফিয়ান আবু যুবায়ের থেকে, আবু যুবায়ের ইবরাহীম থেকে’। তখন আমি তাকে বললাম, আবু যুবায়ের ইবরাহীম থেকে বর্ণনা করেননি। আমার কথায় তিনি আমাকে ধমকালেন। আমি তাকে বললাম, আপনি আপনার মূল গ্রন্থ পুনরায় দেখুন। তিনি তার ঘরে গিয়ে মূল লেখা দেখলেন; তারপর বেরিয়ে এসে বললেন, ওহে বাচ্চা, সনদটা কেমন হবে? আমি বললাম, তিনি হ’লেন যুবায়ের বিন আদী, যিনি ইবরাহীম থেকে শুনেছেন। তিনি তখন আমার থেকে কলম নিলেন এবং তার বই ঠিক করে নিলেন। আর আমাকে বললেন, তুমি সত্য বলেছ। বুখারীকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, এ সময় আপনার বয়স কত ছিল? তিনি বললেন, এগার বছর। ষোল বছর বয়সে উপনীত হওয়ার মাঝেই আমি ইবনুল মুবারক ও ওকী‘য়ের লেখা বইসমূহ মুখস্থ করে ফেলি এবং তাদের কথা বুঝে নেই। তারপর আমি আমার মা ও ভাই আহমাদের সাথে মক্কা গমন করি।

আমাদের হজ্জ সম্পন্ন হ’লে আমার ভাই মাকে সাথে করে দেশে ফিরে যান। আর আমি হাদীছ অন্বেষণের জন্য মক্কায় থেকে যাই। ১৮ বছর বয়সকালে আমি ছাহাবী ও তাবেঈদের ঘটনাবলী ও বচনাদির উপর বই রচনায় প্রবৃত্ত হই। এটি ছিল ওবায়দুল্লাহ বিন মূসার শাসনকাল। আমি ইতিহাস বিষয়ে কিতাবুত তারিখ লিখি। আমি বইটি লিখেছিলাম চাঁদনী রাতগুলোতে নবী করীম (ছাঃ)-এর কবরের পাশে বসে। ইতিহাসে এমন নাম কমই আছে যার বিষয়ে কোন না কোন কাহিনী আমার জানা নেই। কিন্তু বইয়ের কলেবর বৃদ্ধি আমার পসন্দ নয় বিধায় তাদের সকলের প্রসঙ্গ আমি তুলে ধরিনি।[19]

হাদীছ সংগ্রহের জন্য ইমাম বুখারী জানাশোনা তামাম দুনিয়া ঘুরেছেন। তিনি মদীনা, ইরাক, শাম, মার্ভ, নিশাপুর, বলখ, রায়, মিশর ইত্যাদি এলাকা সফর করেছেন। এসব জায়গা থেকে তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছ শুনেছেন এবং সংগ্রহ করেছেন। এমনি করে তিনি ১০৮০ জন বর্ণনাকারী থেকে হাদীছ গ্রহণ করেছেন এবং তাদের বরাতে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। এই বর্ণনাকারীদের সকলেই হাদীছ ও সুন্নাহর লোক।[20]

আমরা ফিরে যাই সে আলোচনায়, যেখানে ইমাম বুখারী হাদীছ সংগ্রহের জন্য নানা দেশ ও অঞ্চল সফর করতে সক্ষম হয়েছিলেন সেখানে তাকে সহায়তা করেছিল তার পিতার রেখে যাওয়া অর্থ। আমরা ভাবতে পারি, একজন পিতা মারা যাচ্ছেন, রেখে যাচ্ছেন স্ত্রী, সন্তান ও অর্থ। মা সে অর্থ হাতে করেছেন তারপর ছেলেদেরকে ইলম শিখতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন আর সে অর্থ থেকে তাদের জন্য ব্যয় করছেন। তিনি অর্থ দিয়ে তাদের সাহায্য করছেন, কোন কৃপণতা করছেন না। এভাবে মা কল্যাণ ও পূর্ণতার এক অনন্য গুণে বিভূষিত হয়েছেন। তিনি অর্থ-সম্পদ পুঞ্জিভূত করেননি, ইলম শিক্ষার পথে ব্যয়িত অর্থ বিনষ্ট হওয়ার ভয় করেননি এবং আজকের অনেক মায়ের মতো এমন কথা বলেননি যে, আমি এ অর্থ-সম্পদ তাদের জন্য জমিয়ে রাখব, যাতে বয়সকালে তারা উপকৃত হ’তে পারে। অথবা একটা সময় পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব, প্রাপ্ত অর্থ ব্যয়ে তাড়াহুড়া করব না। বরং তিনি সরাসরি তা সন্তানের শিক্ষায় ব্যয় আরম্ভ করেছেন।

দেশে ব্যয় করেছেন, আবার তাকে মক্কায় নিয়ে গিয়েছেন, যাতে তিনি শারঈ ইলমের মূলকেন্দ্র ও তথাকার নেতৃস্থানীয় আলেমদের থেকে তাদের ভাষায় বিদ্যা আহরণ করতে পারেন। তিনি এ পথে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছেন। তারপর ইসলামী শরী‘আতের মূল ইলম ও শাখা ইলম জানার জন্য তিনি যে সমস্ত শহর-নগর সফর করেছেন তাতে তার মা মোটেও কোন আপত্তি করেননি। আর তিনি করবেনই বা কেন? তিনিই তো তাকে ইলম অর্জনে সাহস যোগাচ্ছেন, সে পথে তাকে দেখভাল করছেন। ছেলের সাধনার পিছনে তার সকল আশা-আকাঙ্ক্ষা নিবেদন করেছেন। ছেলেও মায়ের সে আশা পূরণ করেছেন। হয়তো মা ছেলের সফলতা অর্জন পর্যন্ত বেঁচে থাকলে তার শ্রেষ্ঠত্বে তিনি অভিভূত হতেন, অথবা বাল্যকালেই ছেলের মধ্যে ভোরের সূর্যের মতো প্রতিভা স্ফূরিত হ’তে দেখে ভবিষ্যতে তিনি যে বড় প্রতিভাধর হবেন সে খোশখবর মা আগেই বুঝে গিয়েছিলেন।

এ ধরনের কাজ সুচারুরূপে শক্তপোক্তভাবে আঞ্জাম দিতে সকল মা পারেন না। কেবল সেই খাঁটি মনের অধিকারী মুখলিছ মা-ই তা পারেন, যাকে আল্লাহ তা‘আলা যথার্থ পথ বাতলে দেন।

যে মজবূত প্রাসাদের উপর ইমাম বুখারীর মায়ের সীরাত প্রতিষ্ঠিত তা অধ্যয়ন করলে মহাজ্ঞানী শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গের আবির্ভাব কিভাবে কোত্থেকে হয় তার গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিমূল আমরা জানতে পারব। জেনে রাখা ভাল, তা হচ্ছে মায়ের দ্বীনদারী, যোগ্যতা ও তার রবের সাথে নিরন্তর যোগসাধনা। সন্তানের উপর মাতা-পিতার দ্বীনদারী ও যোগ্যতার বিরাট প্রভাব রয়েছে।

সন্তানদের দ্বীনদার ও যোগ্য হয়ে গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ মাতা-পিতার দ্বীনদারী ও যোগ্যতা। সূরা কাহফে উল্লিখিত দুই ইয়াতীমের সম্পদ হেফাযতের কারণ ছিল তাদের পিতার দ্বীনদারী বা সততা। আল্লাহ বলেন, ‘আর দু’জনের পিতা ছিলেন সৎ দ্বীনদার’ (কাহফ ১৮/৮২)

সে ভিত্তির মধ্যে আরো রয়েছে, দো‘আ, যা কি-না মায়ের বড় অস্ত্র। আল্লাহ যাতে পুত্র কেন্দ্রিক তার প্রয়োজন পূরণ করেন। তার ইচ্ছা ও চাহিদা পূরণে সাহায্য করেন এবং আল্লাহর সান্নিধ্য পেতে যথাযথ পথ পেতে যেন তাওফীক্ব দেন সেজন্য তিনি অবিরত দো‘আ করেছেন। আল্লাহ যার সহায় তার জন্য পথ কতই না সংক্ষিপ্ত ও সহজ! আর আল্লাহ যার পক্ষে নেই তার জন্য পথ কতই না দীর্ঘ ও কঠিন! যেমন হযরত আলী (রাঃ) তাঁর কবিতায় বলেছেন,

‘ব্যক্তির সাফল্যের জন্য আল্লাহর সাহায্য ও আল্লাহর উপর ভরসা সর্বক্ষণ আবশ্যক। নিজের ক্ষমতার উপর ভরসা করে ধোঁকায় পড়া মোটেও কাম্য নয়। যদি কেউ তা করে তবে আল্লাহর সাহায্য সে পাবে না। আর সেটাই হবে তার ব্যর্থতার প্রথম কারণ’।

সুতরাং যে মা নিজ সন্তানদের তা‘লীম-তারবিয়াতে উচ্চ লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার আশা পোষণ করেন তাকে সঠিক পথ ও প্রয়োজনীয় সামর্থ্য লাভের জন্য আল্লাহর নিকট কাকুতি-মিনতিসহ দো‘আ করা থেকে গাফেল থাকা মোটেও সমীচীন নয়।

ইমাম বুখারীর দৃষ্টিশক্তি লোপ এবং মায়ের কাকুতি-মিনতি সহকারে আল্লাহর নিকট দো‘আর মাধ্যমে তা ফিরে পাওয়া ঐ মায়ের কারামতের প্রকৃষ্ট দলীল। যে কারো উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার পথে দো‘আ যে শক্তিশালী অস্ত্র সে প্রমাণও এ ঘটনার মধ্যে রয়েছে।

এখানে আরো কিছু শিক্ষণীয় দিক রয়েছে যার দিকে ইঙ্গিত করা সমীচীন মনে করছি। হয়তো কোন মুমিন মা তার সন্তানদের কার্যকর তারবিয়াতে তা থেকে উপকৃত হ’তে পারবে।

যে মক্তবে ইমাম বুখারী কুরআন হেফয করেছিলেন এবং যেখানে তার মধ্যে সুন্নাহ ও হাদীছের প্রতি ভালোবাসার উন্মেষ ঘটেছিল তার খবর আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। বিগত দিনের মক্তব বর্তমান কালের হাফেযী মাদরাসা বা হেফযখানা। সুতরাং হে মা! আপনি এই বুনিয়াদি প্রতিষ্ঠানের প্রতি উন্নাসিকতা দেখাবেন না এবং তাকে তুচ্ছ ভাববেন না। বরং নিজের সন্তানকে এরূপ প্রতিষ্ঠানের বরকতের একটু ভাগীদার করতে সচেষ্ট থাকুন। কেননা এটিই দ্বীনের ক্ষেত্রে বিবেচ্য সব থেকে অগ্রণী, সবচেয়ে বরকতময় ও সব থেকে মহৎ প্রতিষ্ঠান। সে সকল মানবগোষ্ঠী কতই না ভালো, যারা এসব প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করে, নিজেদের সন্তানদের এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে, উন্নতির চেষ্টা অব্যাহত রাখে এবং এগুলোর উপর ভরসা রাখে!

ইমাম বুখারী (রহঃ) যখন কুরআন হেফয শেষ করেন তখন তার বয়স ছিল সাত বছর। আর যখন সুন্নাহ বা হাদীছ অধ্যয়ন শুরু করেন তখন তার বয়স ছিল দশের নীচে। যখন হাদীছ সংগ্রহ ও সংকলনের জন্য নিজ শহর ও এলাকা ত্যাগ করেন তখন তার বয়স ছিল ষোল বছর। এর দু’বছর পর তিনি প্রথম গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। অর্থাৎ তখন তার বয়স ছিল আঠার বছর।

সুতরাং তোমরা যুবকদের যত্ন নিতে এবং তাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা দানে খুব খেয়াল রাখবে। ‘সন্তানদের কুরআন হেফয করতে দিয়ে তাদের মান নীচে নামিয়ে দিও না এবং তাদের মেধা নষ্ট করো না’ এ জাতীয় অর্থহীন কথা বার বার শোনা থেকে তোমাদের কানকে বধির করে রাখবে। পশ্চিমা ধাঁচের এই ভনভন শব্দ না বুঝে-শুনে, না খেয়াল করে আমাদের লোকেরা বার বার বলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। অথচ মক্তবে পড়া ইমাম বুখারী (রহঃ) যুবক বয়সে যে সৃষ্টিকর্ম বা রচনাবলি রেখে গেছেন তার শত ভাগের এক ভাগের উপর গবেষণামূলক বড় বড় ডিগ্রী নেওয়ার জন্য আধুনিক কালের এমন সব বয়স্ক গবেষক কাজ করছেন, বার্ধ্যক্যে যাদের দাঁত নড়বড়ে হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

এক পর্যায়ে ইমাম বুখারী (রহঃ) ইলমের জন্য ইরাক, শাম, মিশর প্রভৃতি দেশে গিয়েছেন এবং তথাকার মাশায়েখের থেকে হাদীছ গ্রহণ করেছেন। তার শায়েখ সংখ্যা ১০৮০ জন। এভাবে ইলমের জগতে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সমসাময়িক সাথী-বন্ধুদের মাঝে তার একটি পৃথক আসন তৈরি হয়। তার নাম দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি চমৎকার সব বই লিখেছেন, যার শিরোভাগে রয়েছে ‘আল-জামেউছ ছহীহুল মুসনাদুল মুখতাছারু মিন উমুরি রাসূলিল্লাহি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়া সুনানিহী ওয়া আইয়ামিহী’, যা ছহীহ বুখারী নামে সমধিক পরিচিত। এ গ্রন্থ প্রশংসায় ভরপুর। বলা হয়ে থাকে, ‘এটা আল্লাহর গ্রন্থের পর সর্বাধিক ছহীহ গ্রন্থহ’।

‘আল-আদাবুল মুফরাদ’ নামে তার আরেকটি গ্রন্থ রয়েছে। গ্রন্থটিতে সংকলিত হাদীছসমূহ ছহীহ হওয়ার সাথে আদব বা শিষ্টাচার সংক্রান্ত গ্রন্থাবলির মধ্যে অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। গ্রন্থটি তার নামের সার্থকতা বহন করছে। উল্লেখ্য, ‘আল-আদাবুল মুফরাদ’ অর্থ অনন্য শিষ্টাচার। যে মুসলিম ইসলামী আদব-আখলাকে সমৃদ্ধ হ’তে চায় তাকে এ গ্রন্থ অধ্যয়ন ভিন্ন অন্য কোন উপায় নেই।

ইলমী যোগ্যতার সাথে সাথে তিনি তিরন্দাযীতেও ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। তার লেখক বা সচিব মুহাম্মাদ বিন আবু হাতেম বলেছেন, মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বহুবার তীরন্দাযীর উদ্দেশ্যে বাহনে আরোহণ করেছেন। তার সঙ্গে আমার দীর্ঘ সাহচর্য কালে আমি দু’বারের বেশী তার তীর লক্ষ্যচ্যুত হ’তে দেখিনি। প্রতিবারই তিনি লক্ষ্যভেদ করতেন, লক্ষ্যচ্যুত হ’তেন না।


তিনি একের পর এক ইলমের স্তরগুলোতে আরোহণ করেছেন, আমলের মনযিলগুলো পার হয়েছেন, মহত্ত্বের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেছেন। এক পর্যায়ে তার সত্তাই হয়ে ওঠে মুসলিম উম্মাহর আভরণ। তার জীবনের দিনগুলো হয়ে দাঁড়ায় কল্যাণের মৌসুম। শহরে-নগরে তার পদার্পণে মাহফিল জমে উঠত। আলেম-ওলামা তাকে দেখার জন্য বাসনা পোষণ করতেন।

অনেক মানুষ নিজের আয়ু থেকে তাকে আয়ু দান করতে চাইত। মহান আলেম ইয়াহইয়া বিন জা‘ফর আল-বায়কান্দী বলেন, ‘আমি যদি মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈলের আয়ুতে আমার আয়ু থেকে কিছু দান করতে পারতাম তবে তা করতাম। কেননা আমার মৃত্যু একজন মানুষের মৃত্যু মাত্র; আর মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈলের মৃত্যু ইলমের মৃত্যু’।

২৫৬ হিজরীর ঈদুল ফিতরের রাতে ইমাম বুখারী (রহঃ) এ নশ্বর জগত ত্যাগ করে তার রবের সান্নিধ্যে গমন করেন।

আল্লাহ তা‘আলা করুণা বর্ষণ করুন ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বুখারীর উপর। করুণা বর্ষণ করুন তার পিতার উপর, যিনি তাকে হালাল ছাড়া কিছু খাওয়াননি। করুণা বর্ষণ করুন তার মায়ের উপর, যিনি তাকে উত্তমভাবে লালনপালন করেছেন, যিনি কিনা তার চোখের আলো ফিরে পাওয়ার উপলক্ষ ছিলেন। ফলে তিনি দুনিয়াকে ভরে দিয়েছেন নূর ও জ্ঞান-গরিমা দিয়ে।

[ইমাম বুখারী (রহঃ) ১৯৪ হিজরীর শাওয়াল মাসে খুরাসানের অন্তর্গত বুখারায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ২৫৬ হিজরীর ১লা শাওয়াল তারিখে সমরকন্দের খরতঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন। বুখারা ও সমরকন্দ বর্তমান মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। ছহীহ বুখারী ও আল-আদাবুল মুফরাদ ছাড়াও তার অন্যান্য রচনা ও সংকলনের মধ্যে রয়েছে কিতাবু খালকি আফ‘আলিল ‘ইবাদ, আত-তারীখুল কাবীর, আত-তারীখুল ওয়াসাত, আত-তারীখুছ ছগীর, কাযাইয়া ছাহাবা ওয়াত-তাবেঈন, জুযউল কিরাআতি খালফাল ইমাম, রিসালাতু রাফ‘ইল ইয়াদায়েন ফিছছালাত, আল-মুসনাদুল কাবীর, কিতাবুল বিজদান প্রভৃতি।]

-মূল (আরবী) : ইউসুফ বিন যাবনুল্লাহ আল-‘আতীর

-অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক


[1]. ইবনুল জাওযী, মানাকিবুল ইমাম আহমাদ পৃ. ২১।

[2]. আল-আয়েম্মাতুল আরবা‘আহ, পৃ. ১৪-১৫।

[3]. আহমাদ, মুকাদ্দামাতুল ইলাল ওয়া মা‘রিফাতুর রিজাল পৃ. ১/৫১।

[4]. ইবনুল জাওযী, মানাকিবুল ইমাম আহমাদ পৃ. ৩১।

[5]. আল-জামে‘ লি-আখলাকির রাবী ওয়া আদাবিস সামে‘ পৃ. ১/১৫১।

[6]. আল-আয়েম্মাতুল আরবা‘আহ পৃ. ১৪-১৫।

[7]. ইবনুল জাওযী, মানাকিবুল ইমাম আহমাদ পৃ. ৩১।

[8]. তারীখু মাদীনাতি দিমাশক, ৩৬/১৭৩-১৭৪।

[9]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১০/৫১৪।

[10]. তাহযীবু তাহযীবিল কামাল ১/১৯২।

[11]. আবু নু‘আইম, হিলইয়াতুল আওলিয়া ৯/১৭৯।

[12]. আহমাদ, মুকাদ্দামাতুল ইলাল ওয়া মা‘রিফাতুর রিজাল পৃ. ১/৫১। তার ছেলে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত।

[13]. ইমাম যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১১/১৮৭।

[14]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১১/১৭৭।

[15]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১১/১৮৫।

[16]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১২/৩৯২।

[17]. তারীখুল ইসলাম ১৮/২৩৯।

[18]. তাবাকাতুল হানাবিলা ১/২৭৪; মুকাদ্দামা ফাৎহুল বারী, পৃ. ৪৭৮।

[19]. তারীখু বাগদাদ, ২/০৭; মুকাদ্দামা ফাৎহুল বারী পৃ. ৪৭৮-৪৭৯; তাবাকাতুশ শাফেঈয়াতুল কুবরা ২/২১৭।

[20]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১২/৩৯৫; ফাৎহুল বারী ১/৪৪।






সীমালংঘন ও দুনিয়াপূজা : জাহান্নামীদের দুই প্রধান বৈশিষ্ট্য (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
ইবাদতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মুহাররম মাসের সুন্নাত ও বিদ‘আত - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
আল্লাহর উপর ভরসা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
পেরেনিয়ালিজম এবং ইসলাম - প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া
মুমিন কিভাবে দিন অতিবাহিত করবে (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
যাকাত সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
যাকাত ও ছাদাক্বা - আত-তাহরীক ডেস্ক
দাজ্জাল : ভ্রান্তি নিরসন - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
মানুষের সাথে আচার-ব্যবহারের আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ইখলাছ - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আরও
আরও
.