ধৈর্যশীলা মুজাহিদ উম্মু আম্মারা (রাঃ)
ধৈর্যশীলা মুজাহিদ উম্মু আম্মারা (রাঃ) একজন নামকরা মহিলা ছাহাবী। তার নাম নুসাইবা আনছারিয়া। পিতার নাম কা‘ব বিন আমর। স্বামীর নাম যায়েদ বিন আছেম আনছারী।
ইমাম যাহাবী সিয়ারু আ‘লামিননুবালা গ্রন্থে তার পরিচয় দিয়েছেন, উম্মু আম্মারা নুসাইবা বিনতে কা‘ব বিন আমর আনছারিয়া। তিনি আকাবার বায়‘আতের রাতে উপস্থিত ছিলেন। অংশ নিয়েছিলেন ওহোদ, হুদায়বিয়া, হুনাইন ও ইয়ামামার যুদ্ধে।[1]
এই মহিয়সী নারীর গুণপনা ও মাহাত্ম্য লিখে শেষ করার মতো নয়। দ্বিতীয় আকাবার বায়‘আতে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে যারা বায়‘আত নিয়েছিলেন তাদের প্রথম সারিতে ছিলেন উম্মু আম্মারা। এই বায়‘আতের মধ্য দিয়ে তিনি ইসলামে নারী জাতির মর্যাদা নিরূপণে নতুন এক ধারা সংযোজন করেছিলেন। যে ধারার সাথে জড়িয়ে আছে উচ্চাঙ্গের অনেক মূল্যবোধ, যা মেনে চললে নারীর মর্যাদা উন্নত হবে, তাদের শানশওকত উঁচু হবে।
দ্বীন ও সমাজের খেদমতে মুসলিম নারীদের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তা তিনি স্পষ্ট করে গেছেন। যুগে যুগে বাস্তবতার নিরিখে মুসলিম নারীদের জীবনযাত্রা কিরূপ হওয়া আবশ্যক তার আলোকময় নানা শিক্ষণীয় দিক তিনি রেখে গেছেন। মেয়েদের তথাকথিত স্বাধীনতার অলীক দাবী এবং ভিনজাতির অবিবেচনাপ্রসূত অন্ধ অনুকরণের ভ্রান্ত পথের মাঝে যে পার্থক্য নির্দেশক সীমারেখা আছে তা তিনি নির্ধারণ করেছেন; যাতে করে ইসলামের মধ্যপন্থাভিত্তিক সঠিক জীবনধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যার মধ্য দিয়ে মুসলিম নারীর আল্লাহর তরফ থেকে যে বহু স্বর্ণালী অধিকার ও ভান্ডারসম বহু উপহার মিলেছে তা পরিষ্কার ফুটে উঠেছে।
ইমাম আবু নু‘আইম ইস্পাহানী তার ‘হিলইয়াতুল আওলিয়া’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে বলেছেন, উম্মু আম্মারা ছিলেন আকাবার প্রান্তরে শপথকারিনী, সামর্থ্যবান পুরুষ ও বৃদ্ধদের হয়ে যুদ্ধকারী। তিনি যেমন ছিলেন পরিশ্রমী তেমনি ছিলেন ইজতিহাদকারী ভাবুক। অধিকন্তু নিয়মিত ছিয়াম পালনকারী, ইবাদতগুযার ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি।[2]
তিনি এমন একজন নারী, যিনি তার সমস্ত শক্তি নিয়োগ ও ব্যয় করেছিলেন একজন মায়ের মতো করে নিজের পরিবারকে গড়ে তুলতে। সেই ভীতিকর প্রতিকূল পরিবেশে পরিবারের দেহে যথার্থরূপে রক্তসঞ্চালন এবং পরিবারের সদস্যদের ইসলামী সমাজে উত্তমভাবে অভিযোজনে তাঁর ভূমিকা কম ছিল না।
তিনি এমন মহিলা যার অন্তর ছিল আল্লাহর ভালবাসা ও তার নবীর মহববতে টইটুম্বুর। দ্বীন ইসলামের প্রতি ভালবাসা ও তার খেদমতে তাকে প্রবাদপ্রতিম গণ্য করা হয়। এই ভালবাসা অটুট রাখার খাতিরে তিনি তার জীবনের মূল্যবান সময় ও মহতী প্রচেষ্টা উৎসর্গ করেছেন এবং দুর্লভ ও উৎকৃষ্ট সকল কিছু ব্যয় করেছেন।
সন্তান প্রতিপালনে তিনি অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। সন্তানদেরকে ইসলামের নানা দিক শেখানোর মধ্য দিয়ে তিনি তাদের হৃদয়কন্দরে ইসলাম ও তার মূল দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল করে দিয়েছিলেন। ফলে তারা এই নির্মল ঝরণা থেকে পানি পান করতে থাকেন। এমনি করে তিনি তাদের সত্যের পথের বীরপুরুষ করে গড়ে তোলেন। তারা যাতে জিহাদে ও সাহসিকতায় বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন সেটাই ছিল তার কাম্য।
যে আত্মত্যাগ উম্মু আম্মারার তনু-মন ভরে ছিল তা এমন ছিল না যে সময়ের আবর্তনে তা নিঃশেষ হয়ে যাবে; বরং তার উৎস ছিল গভীর ঈমান এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি সুদৃঢ় বিশ্বাস। স্থির এ ঈমান কোন যালিম শক্তির সামনেই নতজানু হবার নয়। যার ফলে তিনি এমন অনেক কৃতিত্ব ও মাহাত্ম্যপূর্ণ কাজ করে গেছেন যার দৃষ্টান্ত আমাদের এ যুগে খুব বিরল। তিনি যে বিরাট সাহসিকতা ও বীরত্বের নযীর স্থাপন করেছেন ইতিহাস তা চিরকাল স্মরণ করবে এবং নূরের কালিতে তা লিখে রাখবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম সে ইতিহাস আপনজনদের নিকট বর্ণনা করবে।
আসলে পরিবার হচ্ছে সন্তানদের প্রতিপালন, শিক্ষাদীক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠান। পরিবারই প্রথম বীজ যেখানে পরিবারের সদস্যগণ তাদের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। এভাবে এক একটি পরিবার সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে গড়ে উঠলে পুরো সমাজ সুষ্ঠু ও সুন্দর হয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে পরিবারগুলো খারাপ হয়ে গেলে পুরো সমাজ কলুষিত হয়ে পড়ে।
উম্মু আম্মারা বুঝতে পেরেছিলেন, প্রত্যেক মায়ের প্রথম দায়িত্ব হকের পথে দাওয়াত তথা হক গ্রহণ ও পালনের জন্য মানুষকে আহবান জানান। তিনি অনুধাবন করেছিলেন, এ কাজটা শুরু করতে হবে পরিবারের ভিতর থেকে, নিজের সন্তানদের মাধ্যমে। তার বিশ্বাস ছিল, নিজ সন্তানদের প্রতি নযর না দিয়ে পরিবারের বাইরের লোকদেরকে যেকোন ধরনের দাওয়াতই দেওয়া হোক না কেন তা এক প্রকার বোকামী বলে গণ্য হবে। এজন্য তিনি চেষ্টা করেছেন এবং অবিচল থেকেছেন তার সন্তানদের শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে যোগ্য ও ভালো মুসলিম হিসাবে গড়ে তুলতে। ইসলাম কি, আর তার মূলভিত্তিই বা কি, এ বিষয়টি তিনি তার সন্তানদের ভালো করে তালকীন দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, বরং তাদের অন্তরে তা প্রোথিত করে দিয়েছেন। তিনি তার সন্তানদের উত্তমরূপে প্রতিপালন করেছেন। ফলে তিনি তাদের অন্তর ভরে দিয়েছেন ঈমান দিয়ে; বক্ষ ভরে দিয়েছেন সাহস ও বীরত্ব দিয়ে এবং বাহু ভরে দিয়েছেন শক্তি দিয়ে। এই যোগ্য প্রতিপালনের ফল ফলতে খুব একটা দেরি হয়নি। দ্রুতই বাস্তব জগতে তার ফল পরিপক্ক হয়ে ওঠে। তার ফলে সমাজে আবির্ভূত হয় এমন সব যুবক, যারা ভালবাসেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে; ঝাঁপিয়ে পড়েন তাদের ভালবাসার খাতিরে ইসলামের যেকোন কাজে। বস্ত্তত তিনি, তার দুই পুত্র হাবীব ও আব্দুল্লাহ এবং স্বামী যায়েদ আনছারী জিহাদ ও ত্যাগের ক্ষেত্রে উঁচু নমুনা রেখে গেছেন। আমরা অন্তত দু’টি ঘটনায় সে নমুনা স্পষ্টত দেখতে পাই।[3]
প্রথম ঘটনা : ওহোদ যুদ্ধের ঘটনা। উম্মু আম্মারা বলেন, ওহোদ যুদ্ধের সময় আমি দিনের প্রথম ভাগে ওহোদ প্রান্তর পানে বের হ’লাম। লোকেরা কে কি করছে তা আমি খেয়াল করছিলাম। আমার সাথে ছিল পানি ভর্তি একটা পাত্র। যেতে যেতে আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে পৌঁছলাম। তিনি তখন ছাহাবীদের মাঝে অবস্থান করছিলেন। বিজয় তখন ছিল মুসলিমদের পক্ষে। তারপর মুসলিম বাহিনী যখন পরাজয়ের মুখোমুখি হ’ল তখন আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ঘিরে দাঁড়ালাম এবং সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হ’লাম। তলোয়ার হাতে আমি তাঁর উপর আগত আক্রমণ ক্রমাগত প্রতিহত করছিলাম, আর তীর ছুঁড়ছিলাম। একপর্যায়ে আমি আহত হই। বর্ণনাকারী জামিলা বিনতে সা‘দ বিন রবী‘ বলেন, আমি তার কাঁধে একটা ক্ষত দেখেছি, যা ছিল গভীর এবং ভেতরটা ফাঁফাঁ।
উম্মু আম্মারা বলেন, যুদ্ধক্ষেত্র হ’তে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে রেখে লোকেরা পালিয়ে গেল। দশ জনের বেশী লোক তখন তাঁর আশেপাশে ছিল না। আমার দুই পুত্র, আমার স্বামী এবং আমি ছিলাম তাঁর সামনে। আমরা তাঁর উপর আপতিত আক্রমণ প্রতিহত করছিলাম। অথচ লোকেরা পরাস্ত হয়ে ময়দান ছাড়তে ছোটাছুটি করছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দেখলেন, আমার হাতে কোন ঢাল নেই। তিনি একজনকে ফেরার হ’তে দেখলেন, যার হাতে ঢাল ছিল। তিনি ঢালওয়ালাকে বললেন, যে যুদ্ধ করছে তোমার ঢালটা তার কাছে ফেলে দাও। সে ঢাল ফেলে দিলে আমি তা হাতে নিলাম। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে সেই ঢালের মাধ্যমে সুরক্ষা করে যাচ্ছিলাম।
বিরোধী পক্ষের অশ্বারোহী বাহিনী আমাদের নিয়ে যাচ্ছেতাই করছিল। তারা যদি আমাদের মতো পদাতিক হ’ত তাহ’লে আল্লাহ চাহেন তো আমরাও তাদের মতো আঘাত হানতে পারতাম। এমন সময় এক অশ্বারোহী আমার উপর তলোয়ারের আঘাত হানে। আমি ঢাল দিয়ে তা প্রতিহত করি, ফলে তার তলোয়ার আমার উপর কোন ক্রিয়া করতে পারেনি। সে পালিয়ে যাচ্ছিল। তখন আমি তার ঘোড়ার গোড়ালি বরাবর আঘাত হানি। সে আঘাতে সে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যায়। তখন নবী করীম (ছাঃ) ডেকে ডেকে বলতে লাগলেন, হে উম্মু আম্মারার ছেলে! তোমার মাকে সাহায্য করো, তোমার মাকে সাহায্য করো। ছেলে এসে তার বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য করে। ফলে আমি তাকে মৃত্যুর দুয়ারে পৌছে দেই।[4]
এদিনে উম্মু আম্মারার দেহে ১৩টি যখম লেগেছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে প্রশংসা করে বলেন, ‘এদিন নুসাইবা বিন কা‘বের ভূমিকা অমুক অমুকের ভূমিকা থেকে শ্রেয় ছিল’।
ওহোদ যুদ্ধে উম্মু আম্মারার ছেলে আব্দুল্লাহর বাম বাহু ভীষণভাবে আহত হয়। ফলে আহত স্থান দিয়ে প্রচুর রক্ত ঝরতে থাকে। মা তখন তার সেবা-শুশ্রূষায় লেগে যান এবং ব্যান্ডেজ দিয়ে রক্ত বন্ধে সচেষ্ট হন। এক পর্যায়ে ছেলের বিষয়ে নিশ্চিন্ত হ’লে তিনি বললেন, প্রিয় বৎস, ওঠো এবং শত্রুর মোকাবেলা করো। নবী করীম (ছাঃ) তখন বলতে লাগলেন, উম্মু আম্মারা, তোমার যে তাকত (শক্তিবল) আছে অমন তাকত ক’জনের আছে?
আমার ছেলেকে যে আঘাত হেনেছিল এক পর্যায়ে সে সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। তাকে দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘এই লোকটা তোমার পুত্রের আঘাতকারী’। আমি সুযোগ বুঝে তার উপর চড়াও হ’লাম এবং তার পায়ে তলোয়ারের আঘাত হানলাম। ফলে সে লুটিয়ে পড়ল। এসময় আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে দেখলাম তিনি মিটিমিটি হাসছেন। হাসিতে তাঁর চোখা দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়েছে। তিনি বলছিলেন, ‘হে উম্মু আম্মারা! তুমি ঠিকই প্রতিশোধ নিয়েছ’। তারপর উপর্যুপরি আঘাত হেনে আমি তাকে হত্যা করি।
এতদপ্রেক্ষিতে নবী করীম (ছাঃ) আল্লাহর শোকর আদায় করে বললেন, প্রশংসা আল্লাহর, যিনি তোমাকে বিজয়ী করেছেন, তোমার শত্রুকে বধের মাধ্যমে তোমার চোখ শীতল করেছেন এবং তোমার নিজ চোখে তোমার ছেলের আহতকারী থেকে প্রতিশোধপ্রাপ্তি দেখিয়ে দিয়েছেন। তারপর তিনি এই মহান পরিবারের কল্যাণ চেয়ে আল্লাহর নিকট দো‘আ আরম্ভ করলেন, হে খান্দান, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের মঙ্গল করুন। হে খান্দান, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের উপর দয়া করুন। যেহেতু উম্মু আম্মারার চাওয়া আরও বড় ছিল, তার কাম্য পুঁজিও দুনিয়া বিষয়ক ছিল না, তাই তিনি বললেন, আমরা যেন জান্নাতে আপনার সাথী হ’তে পারি আপনি আমাদের জন্য সেই দো‘আ করুন। তখন তিনি বললেন, ‘ইয়া আল্লাহ! তুমি তাদেরকে জান্নাতে আমার সাথী কারা’। যুদ্ধের উত্তপ্ত ময়দানে এ দো‘আ শোনার পর উম্মু আমারার চোখ দিয়ে আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। তিনি কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘এর পর দুনিয়ার যত বিপদাপদই আমার উপর চাপুক, আমি তার কোন পরোয়া করি না’।
ওহোদ দিবসে তিনি কোমরে কাপড় পেঁচিয়ে কঠিন যুদ্ধ করছিলেন। তার দেহের ১৩টি জায়গায় তীর, বল্লম, তলোয়ার ইত্যাদির আঘাতে মারাত্মক যখম হয়েছিল। সবচেয়ে বড় যখমটা হয়েছিল নরপশু মুশরিক ইবনু কামিয়ার দ্বারা। এই বদবখত অশ্বারোহী অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর তলোয়ারের আঘাত হানতে উদ্যত হয়। এসময় উম্মু আম্মারা (রাঃ) তার দেহকে ঢাল বানিয়ে তা প্রতিহত করেন। আঘাতটি তার দেহে লাগায় তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। পুরো এক বছর তাকে এই ক্ষতের চিকিৎসা নিতে হয়েছিল।
ওহোদ যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ঘোষক ছাহাবীদের মাঝে হামরাউল আসাদ পানে অভিযানে বের হওয়ার ঘোষণা দেন। তা শুনে তিনি তার যখমের উপর পট্টি বেঁধে তৈরি হ’তে চেষ্টা করেন। কিন্তু তার ক্ষত থেকে তখনও রক্ত ঝরছিল। ফলে তার পক্ষে অংশগ্রহণ সম্ভব হয়নি। এ সময় অন্যান্য ছাহাবীগণও সকাল হওয়া পর্যন্ত রাতভর তাদের আহত স্থানের পরিচর্যায় লিপ্ত ছিলেন। হামরাউল আসাদ থেকে ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উম্মু আম্মারার অবস্থা জানার জন্য আব্দুল্লাহ বিন কা‘ব আল-মাযিনীকে তার বাড়িতে পাঠান। তিনি ফিরে এসে তার ছহীহ-সালামতে থাকার কথা জানান। এ সংবাদে তিনি খুবই খুশী হন।
উম্মু আম্মারাকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, কুরাইশ রমণীরা কি ওহোদ যুদ্ধের দিন তাদের স্বামীদের সাথে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল? উত্তরে তিনি বললেন, না, আউযুবিল্লাহ, আল্লাহ পানাহ! আল্লাহর কসম! আমি তাদের একজন মহিলাকেও না একটা তীর ছুঁড়তে দেখেছি, না একটা পাথর ছুঁড়তে। বরং দেখেছি, তারা তাদের সাথে থাকা দফ-ঢোল বাজাচ্ছে আর বদর যুদ্ধে তাদের নিহতদের স্মরণে মর্ছিয়া গাচ্ছে।
দ্বিতীয় ঘটনা :
মিথ্যা নবুঅতের দাবীদার ভন্ড মুসায়লামা ছিল ইয়ামামা অঞ্চলের বনু হানীফা গোত্রের লোক। মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নবুঅতের সাফল্য দেখে তার মাথা খারাপ হয়ে যায়। সে নিজ গোত্রের মধ্যে নবুঅতের ঘোষণা দিয়ে তাদের দলে ভিড়ায়। তাদের জান্নাতের মিথ্যা আশ্বাস শোনায়। শরী‘আতের হালাল-হারামের কোন তোয়াক্কা তার নবুঅতে ছিল না।
‘মদ-জুয়া, যেনায় মেতে থাক, আর খাও-দাও ফুর্তি করো’ এমন গোছের দাওয়াত ছিল তার। সে মিথ্যা অহী নাযিলের কথাও শুনাত। মানুষ তো কষ্ট না করে এমনিতেই মজা লুটতে চায়। ফলে তার দলেও বহু লোক ভিড়ে যায়। এক পর্যায়ে সে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট পত্র প্রেরণ করে। তাতে লেখা ছিল-
আল্লাহর রাসূল মুসায়লামার পক্ষ হ’তে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের প্রতি। আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হৌক! অতঃপর আমাকে আপনার সাথে রাজত্বে শরীক করা হয়েছে। জনপদের অর্ধেক আমাদের জন্য এবং বাকী অর্ধেক কুরায়েশদের জন্য। কিন্তু কুরায়েশরা এমন কওম, যারা সীমালংঘন করে।[5]
তার জবাবী পত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) লিখলেন : আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে মুসায়লামা আল-কাযযাব সমীপে। সালাম হিদায়াতের পথের অনুসারীদের উপর। অতঃপর এ বিশ্বজগৎ আল্লাহর। তিনি তাঁর বান্দাগণের মধ্য হ’তে যাকে ইচ্ছা তার মালিক বানান। শুভ পরিণাম কেবল মুত্তাকী আল্লাহভীরুদের জন্য (আ‘রাফ ৭/১২৮)।
এ পত্র বহনের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে উম্মু আম্মারার পুত্র হাবীব বিন যায়েদ আনছারী (রাঃ)-কে মনোনীত করেন। এই পরিবারের কুরবানী, দান-দক্ষিণা ও আল্লাহর পথে আত্মত্যাগের অনুপম দৃষ্টান্তের জন্যই নবী করীম (ছাঃ) এই যুবককে এ কাজে নির্বাচন করেছিলেন।
যুবক কোন ভয়-ভীতি ও দ্বিধা-সংশয় ছাড়াই রওনা দেন এবং মুসায়লামার সাথে দেখা করে তাকে রাসূলের পত্র হস্তান্তর করেন। পত্র পাঠান্তে মুসায়লামা ক্ষুব্ধ হয়ে হাবীবকে শিকল পরিয়ে বন্দি করে রাখতে আদেশ দেয়। পরদিন ভরা দরবারে তারা তাকে হাযির করে। মুসায়লামা তাকে বলল, তুমি কি সাক্ষ্য দাও যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি তো সাক্ষ্য দেই যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। তারপর বলল, তুমি কি এ সাক্ষ্যও দাও যে, আমি আল্লাহর রাসূল? হাবীব উত্তরে বললেন, আমি বধির, ঠিকমত শুনতে পাই না। তখন আক্রোশে মুসায়লামার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। সে জল্লাদকে তার দেহের একটি অঙ্গ কেটে ফেলার আদেশ দিল। কিছুক্ষণ পর সে তার থেকে একই উত্তর শোনার আশায় পুনরায় একই প্রশ্নের অবতারণা করল। এবার সে জল্লাদকে হাবীব (রাঃ)-এর দেহের অন্য একটি অঙ্গ কেটে ফেলার আদেশ দিল। উপস্থিত লোকেরা তা চেয়ে চেয়ে দেখছিল। এভাবে মুসায়লামার জিজ্ঞাসা চলতে থাকে, উত্তরে হাবীব (রাঃ) বলতে থাকেন ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ, আর জল্লাদ দেহের এক একটা অংশ কেটে ফেলতে থাকে। দেহের প্রায় অর্ধেকটা যখন কাটা পড়ল তখন তার প্রাণপাখি তার দেহপিঞ্জর ছেড়ে উড়ে গেল। তখনও তার কলবে ও কণ্ঠে সাইয়্যেদুল আলামীন মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পবিত্র নাম উচ্চারিত হচ্ছিল।[6]
পুত্রের শাহাদাতের খবর মা উম্মু আম্মারার কাছে পৌঁছলে তিনি বলেছিলেন, এরূপ কাজের জন্যই আমি তাকে তৈরি করেছিলাম। আল্লাহর কাছে আমি তার প্রতিদান আশা করেছিলাম। ছোট্ট বয়সে সে আকাবার রাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাতে বায়‘আত (আনুগত্যের শপথ) করেছিল, আজ বড় হয়ে সে তা পূরণ করেছে। আল্লাহ যদি মুসায়লামাকে আমার বাগে পাইয়ে দেন তাহ’লে আমি তার এমন গতি করব যে, তার মেয়েরা বাপের জন্য গাল চাপড়িয়ে চাপড়িয়ে কাঁদবে।
এই ধৈর্যশীলা মহামতী মায়ের আরজ আল্লাহ পূরণ করেছিলেন। ইয়ামামার যুদ্ধে স্বয়ং তার উপস্থিতিতে মহান আল্লাহ মুসায়লামা থেকে তার আল্লাহভীরু নেককার নওজোয়ান পুত্রের হত্যার বদলা নিয়ে দিয়েছিলেন।
ইয়ামামা অভিযানে যখন খালিদ (রাঃ)-এর বাহিনী প্রস্ত্ততি নিচ্ছিল তখন উম্মু আম্মারা (রাঃ) খলীফা আবুবকর (রাঃ)-এর নিকট আসেন এবং অভিযানে অংশগ্রহণের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন। তিনি বললেন, আমরা যুদ্ধে আপনার অবদানের কথা জানি। আপনি আল্লাহর নাম নিয়ে বের হন। তিনি খালিদ বিন ওয়ালিদকে তার বিষয়ে বিশেষভাবে অছিয়ত করেন। তিনি তার প্রতি সে নির্দেশ রক্ষা করেছিলেন। ইয়ামামার ময়দানে উম্মু আম্মারা (রাঃ) চরম বীরত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। যুদ্ধে তার একটি হাত কাটা গিয়েছিল।
উম্মু সা‘দ বিনতে সা‘দ বিন রবী‘ বলেন, আমি নুসাইবা বিনতে কা‘বকে দেখেছি। তার একটা হাত কাটা ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার হাত কখন কবে কাটা গিয়েছিল? তিনি বললেন, ইয়ামামার দিনে। আমি আনছারদের সাথে ছিলাম। আমরা প্রাচীর ঘেরা একটা বাগিচার ধারে পৌঁছলাম। সেটা দখলে নেওয়ার জন্য তারা ঘণ্টাখানেক যুদ্ধ করে। কিন্তু সাফল্য আসে না। তখন আবু দুজানা আনছারী বললেন, তোমরা আমাকে একটা ঢালের উপর তুলে ধর এবং ওদের মাঝে আমাকে ফেলে দাও। আমি ওদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলব। তারা তার কথামতো ঢালের উপর তুলে তাকে তাদের মাঝে ফেলে দিল। তিনি তাদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এক পর্যায়ে তাদের হাতে নিহত হন। আল্লাহ তার উপর রহম করুন।
আমি তখন আল্লাহর শত্রু মুসায়লামা আল-কাযযাবকে নাগালে পাওয়ার নিয়তে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। এসময় তাদের একজন পুরুষ লোক আমার দিকে এগিয়ে আসে। সে আমাকে আক্রমণ করে আমার হাত কেটে ফেলে। কিন্তু আল্লাহর কসম! আমি তার পরোয়া না করে খবীছটাকে উপর্যুপরি আঘাত হেনে পরপারে পাঠিয়ে দেই। পাশেই আমার ছেলে কাপড় দিয়ে তার তলোয়ার মুচ্ছিল। আমি বললাম, পুত্র আমার, আমি কি তাকে হত্যা করেছি? সে বলল, হ্যঁা, আম্মা। তখন আমি আল্লাহর দরবারে শুকরিয়ার সিজদা আদায় করলাম। তার এ পুত্রের নাম ছিল আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ বিন আছেম।[7]
নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে তিনি যেসব যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন আমরা তার এক ঝলক দেখে নিতে পারি।
হিজরী চতুর্থ সনে তিনি বনু কুরাইযার যুদ্ধে অংশ নেন এবং এমন গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন যে, তার জন্য গনীমতের স্পেশাল ভাগ রাখা হয়েছিল।
হিজরী ষষ্ঠ সনে হুদায়বিয়ার সন্ধিকালে তিনি বায়‘আতুর রিযওয়ানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট বায়‘আত হয়েছিলেন। হুদায়বিয়া থেকে ফিরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খায়বারের ইহুদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলে তিনি সে বাহিনীতে শরীক হন। সেনাদলে মোট বিশজন নারী ছিলেন, যাদের পুরোভাগে ছিলেন উম্মু আম্মারা। তাদের কাজ ছিল আহতদের ওষুধপথ্য দেওয়া ও সেবা করা, তীর যুগিয়ে দেওয়া এবং ছাতু খাবার তৈরি করে দেওয়া। যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর রসদ যোগান ও সেবার ক্ষেত্রেও তিনি আরেক নযীর স্থাপন করে গেছেন।
আক্বীদা সুরক্ষাতেও উম্মু আম্মারা (রাঃ) এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হাওয়াযিন গোত্রের মোকাবেলার জন্য হুনায়ন প্রান্তর অভিমুখে যাত্রা করেন। এ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল বার হাযার। অন্যদিকে প্রতিপক্ষের সৈন্য ছিল ছয় হাযার। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে পাহাড়ী গুহা থেকে কাফেরদের চোরাগুপ্তা হামলায় মুসলিম বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা আত্মরক্ষার্থে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। যুদ্ধের এই ভীষণ প্রতিকূল মুহূর্তে উম্মু আম্মারা (রাঃ) সরাসরি অংশ নিয়ে মধ্যমণির ভূমিকা পালন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজেও আহত হয়েছিলেন। উম্মু আম্মারা (রাঃ) সহ বেশ কিছু ছাহাবী তাঁর পাশে থেকে পলায়নপর ছাহাবীদের ডেকে তাঁর পাশে জড় করেন। এ সময় আল্লাহর অদৃশ্য সাহায্যও নেমে আসে- যেমনটা সূরা তওবার ২৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে। ফলে বনু হাওয়াযিন তাদের পশুপাল, ধন-সম্পদ, স্ত্রী-কন্যা ও শিশুদের সহ মুসলিমদের হাতে বন্দী হয়। বনু হাওয়াযিন পরে ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের বন্দীদের মুক্তি প্রদান করা হয়।
উম্মু আম্মারা (রাঃ) বলেন, হুনাইন যুদ্ধের দিন লোকেরা যখন পরাস্ত হয়ে দিগ্বিদিক পালিয়ে যাচ্ছিল তখন আমার হাতে ছিল ধারাল তলোয়ার। আমরা ছিলাম চারজন মহিলাু আমি, উম্মু সুলাইম, উম্মু সালীত ও উম্মুল হারিছ। উম্মু সুলাইম এ সময়ে গর্ভবতী ছিল। তাই সে ফিতা দিয়ে তার পেট বেঁধে নিয়েছিল। আমি তলোয়ারের খাপ খুলে ফেললাম এবং আনছারদের লক্ষ্য করে চীৎকার দিয়ে বলতে লাগলাম, এ কেমনতর আচরণ? তোমরা পালাচ্ছ কেন? এ সময় আমি উটের পিঠে আরোহী হাওয়াযিন গোত্রীয় জনৈক মুশরিককে দেখতে পেলাম। তার হাতে একটা পতাকা ছিল। সে তার উট নিয়ে মুসলিমদের পিছু ধাওয়া করার ইচ্ছা করছিল। আমি তার দিকে লক্ষ্য স্থির করলাম এবং উটের গোড়ালিতে তলোয়ারের আঘাত হানলাম। সে চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেল। আমি তার উপর হামলে পড়লাম এবং আঘাতের পর আঘাত হেনে তাকে হত্যা করলাম। আমি তার তলোয়ারটা নিয়ে নিলাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন হাতে খোলা তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি তলোয়ারের খাপ ফেলে দিয়ে তার স্বরে ডাকছিলেন, হে সূরা বাক্বারার সাথীগণ![8]
ছাহাবীগণ উম্মু আম্মারার মর্যাদা জানতেন। ইসলামের জন্য তার বালা-মুছীবত মোকাবেলার তারা মূল্য দিতেন।
একবারের ঘটনা। খলীফা ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ)-এর নিকট কিছু চাদর আসে। তন্মধ্যে একটা চাদর ছিল লম্বা-চওড়া ও দামী। চাদরটা দেখে কেউ একজন বলল, এ চাদরের দাম এত এত হবে। আপনি চাদরটা আপনার পুত্রবধু আব্দুল্লাহ বিন ওমরের স্ত্রী ছাফিয়া বিনতে উবায়েদকে দিতে পারেন। এ সময়ে আব্দুল্লাহ বিন ওমরের জীবনে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। কিন্তু খলীফা বললেন, ‘এটা তুমি তার থেকেও যোগ্য যিনি তার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা কর। তিনি হচ্ছেন উম্মু আম্মারা নুসাইবা বিনতে কা‘ব। আমি ওহোদ দিবসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, আমি ডানে বামে যেদিকেই তাকাচ্ছিলাম সেদিকেই আমি তাকে আমার রক্ষার্থে যুদ্ধ করতে দেখছিলাম।[9]
বছরের পর বছর উম্মু আম্মারা নিজ কক্ষে ইবাদতে সিজদায় সময় অতিবাহিত করেন। তিনি ছিলেন দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত। বিগত বছরগুলোর ঘটনাবলি, জিহাদের কাফেলা, জীবনের কুরবানী ইত্যাদির স্মৃতিচারণ করে তাঁর দিন কাটত। এভাবেই এই মহীয়সী মহিলা তাঁর প্রভুর ইবাদত করতে করতে এক সময় মৃত্যুর ডাক তার দোরগোড়ায় এসে হাযির হয়।
মৃত্যুর পেয়ালা পান করে এই প্রশান্ত আত্মা তার স্রষ্টার সান্নিধ্যে উপনীত হন। সময়টা ছিল হিজরী ত্রয়োদশ বর্ষ। কাফন পরানোর আগে যখন তাকে গোসল দেওয়া হয় তখন তার দেহের যখমগুলো এক এক করে গণনা করা হয়। মোট তেরটি যখম পাওয়া যায়। তার পবিত্র দেহ বাকী কবরস্থানে তার পূর্বে বিগত ছিদ্দীক, শহীদ ও ছালেহদের পাশে শুইয়ে দেওয়া হয়।
আমাদের সমসাময়িক প্রজন্ম বর্তমানে এসব উজ্জ্বল নক্ষত্রের আদর্শ অবলম্বনে কতই না মুখাপেক্ষী! তারা সেসব মানুষের জন্য মহান দৃষ্টান্ত ও আলোকময় প্রমাণাদি রেখে গেছেন যারা নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য জানতে, বুঝতে ও পালন করতে চান। তবেই তো তারা আল্লাহর দ্বীনের পথে প্রচুর ত্যাগ ও কুরবানী করতে পারবেন; যার মাধ্যমে আল্লাহর দেয়া প্রতিশ্রুতি সত্যে রূপায়িত হবে।
হে মুসলিম মহিলা! তাদের আদর্শ মেনে চলা কত প্রয়োজন! আপনি মা হউন, আর স্ত্রী হউন, কন্যা হউন, আর বোন হউন তাদের আদর্শ উপেক্ষা করতে পারেন না। বিশেষ করে বর্তমান যুগে যেখানে নানা রকম ফিৎনা ঢেউয়ের প র ঢেউ আকারে
আমাদের সমাজ-পরিবারে আছড়ে পড়ছে। আজকের সকল প্রকার গণমাধ্যম যেভাবে সকল পথ ও পদ্ধতি নিয়ে তাদের ভ্রষ্ট ও নষ্ট মতাদর্শ আমাদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে তা থেকে বাঁচতে চাইলে আপনাদের মতো মায়েদের অবশ্যই উম্মু আম্মারা (রাঃ)-এর মতো করে সন্তানদের দ্বীনের জন্য গড়ে তুলতে হবে। তারা সমসাময়িক জ্ঞান ও প্রতিভা আত্মস্থ করবে দ্বীনের উপর অবিচল ও সুদৃঢ় থেকে, দ্বীন বিকিয়ে দিয়ে নয়।
হে মুসলিম মহিলা! এসব সম্মানিত ও উঁচু মর্যাদা সম্পন্ন মহিলা ছাহাবীদের পবিত্র জীবনী পাঠ করা আপনার আজ কতই না প্রয়োজন। তবেই না আপনি জানতে পারবেন কোন পথ ধরে আপনি চলছেন। যদি আপনি দেখতে পান যে, আপনি কুরআন করীম যে পথ এঁকে দিয়েছে এবং নবী করীম (ছাঃ) যে পথের কথা বলে গিয়েছেন আপনি সেই পথ ধরে চলছেন তাহ’লে আল্লাহর বরকতের উপর ভর করে আপনি সে পথ অনুসরণ করুন। পথিকের সংখ্যার স্বল্পতা দেখে ঘাবড়ে যাবেন না। আর যদি আপনার চলার পথ তার উল্টোটা হয় তাহ’লে আপনার সামনের দিনগুলোতে আল্লাহর পথে ফিরে আসার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। খাঁটি মনে তওবা করে সত্যই আল্লাহর পথের পথিক হ’লে আপনি স্বামী-সন্তানাদি নিয়ে দুনিয়া-আখেরাতে নিঃসন্দেহে সাফল্য লাভ করবেন।
মুসলিম বোন আমার! ‘এই করছি, সেই করব’ থেকে আপনি সতর্ক থাকুন। কেননা ‘এই করছি, সেই করব’ বা ‘পরে করব’ বলে ফেলে রাখা মানুষের জন্য ধ্বংস বয়ে আনে, তার সংকল্প টলে যায় এবং তার মনমাঝে দ্বীন পালনে অলসতা দেখা দেয়। বোন আমার! এমনটা কখনই হ’তে দিবেন না।
[ক্রমশঃ]
-মূল (আরবী) : ইউসুফ বিন যাবনুল্লাহ আল-‘আতীর
-অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
[1]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২/২৭৮।
[2]. আবু রাগেব আস্ফাহানী, হিলইয়াতুল আওলিয়া ২/৬৪।
[3]. ওয়াকেদী, মাগাযী ১/২৬৮।
[4]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২/২৭৯।
[5]. সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৬০০।
[6]. প্রাগুক্ত ১/৪৬৬।
[7]. আর-রাওযুল উনফ শরহে সীরাতে ইবনে হিশাম ৫/৩১৬।
[8]. ওয়াকেদী, মাগাযী ৩/৯০৩।
[9]. ইবনু সা‘দ ৮/৪১৫।