পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । শেষ পর্ব 

১৮তম দলীল : আমরা গোশত, পোষাক ও খাদ্য ক্রয়ের সময় তা হালাল হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস না করেই শুধুমাত্র মালিকের কথার উপর ভিত্তি করে ক্রয় করে থাকি, যার বৈধতা ইজমায়ে উম্মাহ দ্বারা প্রমাণিত। যদি তাক্বলীদ বৈধ না হ’ত, তাহ’লে হালাল হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করা ওয়াজিব হ’ত।

জবাব : এক্ষেত্রে হালাল হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস না করে যবেহকারী ও বিক্রেতার কথা গ্রহণ করাই যথেষ্ট, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ইত্তেবা হিসাবে গণ্য। যদিও যবেহকারী ও বিক্রেতা ইহুদী, নাছারা অথবা পাপী হয়। যেমন হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ أُمِّ الْمُؤْمِنِيْنَ أَنَّ قَوْمًا قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ قَوْمًا يَأْتُوْنَا بِلَحْمٍ لاَ نَدْرِيْ ذُكِرَ اسْمُ اللهِ عَلَيْهِ أَمْ لاَ قَالَ سَمُّوْا أَنْتُمْ وَكُلُوْا-

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই এক সম্প্রদায় রাসূল (ছাঃ)-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এক সম্প্রদায় আমাদের নিকটে গোশত নিয়ে এসেছে, আমরা জানি না তাতে বিসমিল্লাহ বলা হয়েছে কি-না। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তোমরা ‘বিসমিল্লাহ’ বল এবং খাও’।[1]

ইমাম ইবনে হাযম (রহঃ) বলেন, উল্লিখিত যুক্তি স্পষ্ট মূর্খতা অথবা ঈমানের স্বল্পতা প্রমাণ করে। তাকে বলতে হবে যে, তোমার উল্লিখিত যুক্তি যদি তাক্বলীদ হয়, তবে সকল ফাসেকের রায় বা মতের তাক্বলীদ কর এবং তাক্বলীদ কর ইহুদী ও নাছারদের। আর তাদের দ্বীনের অনুসরণ কর। কেননা আমরা তাদের থেকে গোশত ক্রয় করি এবং বিশ্বাস করি যে তারা বিসমিল্লাহ বলে যবেহ করেছে, যেমনভাবে আমরা মুসলমানদের থেকে ক্রয় করে থাকি। এক্ষেত্রে সংসারত্যাগী ইবাদতকারী এবং পাপী ইহুদীর নিকট হ’তে ক্রয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। অতএব তুমি পৃথিবীর সকল প্রবক্তার তাক্বলীদ কর, যদিও তাদের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। যেমন- আমরা মুমিন অথবা করদাতা অমুসলিম (আহলে কিতাব) কসাইয়ের যবেহকৃত বস্ত্ত খেয়ে থাকি।[2] মূলতঃ যেসব বিষয়ে কুরআন-হাদীছে সুস্পষ্ট দলীল থাকে, সেসব বিষয়ের অনুসরণ করা তাক্বলীদ নয়; বরং সেটাই ইত্তেবা।

১৯তম দলীল : তাক্বলীদপন্থীগণ বলে থাকে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ثُمَّ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ أَنِ اتَّبِعْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيْمَ حَنِيْفًا ‘অতঃপর আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করলাম, তুমি একনিষ্ঠ ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর’ (নাহল ১২৩)

অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে ইবরাহীম (আঃ)-এর ধর্মাদর্শের অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব তাক্বলীদ বৈধ যা কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত।

জবাব : ইবনু হাযম (রহঃ) বলেন, এ কেমন নির্লজ্জতা! কেননা আল্লাহ তা‘আলা যে বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন তা তাক্বলীদ নয়। বরং তা অবশ্য পালনীয় দলীল। আর তাক্বলীদ হ’ল, এমন বিষয়ের অনুসরণ করা যা আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দেননি। অনুরূপভাবে আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত অন্য কারো কথা, যা অনুসরণ করার নির্দেশ আল্লাহ তা‘আলা দেননি তার বিরোধিতা করি। অতএব তাক্বলীদপন্থীরা উল্লিখিত দলীল দ্বারা ইবরাহীম (আঃ)-এর অনুসরণ করার বৈধতা প্রমাণ করতে চাইলে সেটা সঠিক হবে। কিন্তু তারা উল্লেখিত দলীল দ্বারা ইমাম আবু হানীফা (রহঃ), ইমাম শাফেঈ (রহঃ), ইমাম মালেক (রহঃ) এবং ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর তাক্বলীদের বৈধতা প্রমাণ করতে চাইলে সেটা হারাম হবে। কেননা তাঁরা ইবরাহীম (আঃ) নন, যার অনুসরণ করার নির্দেশ আল্লাহ তা‘আলা দিয়েছেন। আর আমরা কখনই উল্লিখিত ইমামগণের অনুসরণের নির্দেশ প্রাপ্ত হইনি।

২০তম দলীল : তাক্বলীদপন্থীগণ বলে, ইমামগণ তাক্বলীদ জায়েয হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। যেমন- সুফিয়ান (রহঃ) বলেছেন, إذا رأيت الرجل يعمل العمل وأنت ترى غيره فلا تنهه ‘যদি কেউ কোন আমল করে আর তুমি অন্যকে তার বিপরীত আমল করতে দেখ, তাহ’লে তাকে নিষেধ কর না’।[3]

মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান (রহঃ) বলেছেন, يجوز للعالم تقليد من هو أعلم منه ولا يجوز له تقليد مثله ‘আলেমের জন্য তাঁর চেয়ে অধিক জ্ঞানী ব্যক্তির তাক্বলীদ করা বৈধ। কিন্তু তাঁর সমতুল্য ব্যক্তির তাক্বলীদ করা বৈধ নয়’।[4] ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন, قلته تقليدا لعمر وقلته تقليدا لعطاء ‘আমি ওমর (রাঃ)-এর তাক্বলীদ করে তাকে বলেছি এবং আতা (রাঃ)-এর তাক্বলীদ করে তাকে বলেছি’।[5]

জবাব : প্রথমতঃ ছাহাবীগণ কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির তাক্বলীদের নিন্দা করেছেন। এমকি তাঁরা মুক্বাল্লিদকে চামচা অথবা অন্ধ আখ্যায়িত করেছেন।

দ্বিতীয়ত : পূর্বেই ইমাম শাফেঈর বক্তব্য তুলে ধরেছি, যেখানে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির তাক্বলীদ করতে নিষেধ করা হয়েছে।

তৃতীয়ত : তাক্বলীদপন্থীগণই তাক্বলীদ অস্বীকারকারী। কেননা তারা বল যে, ইমাম শাফেঈ (রহঃ) আবু বকর (রাঃ) এবং ওমর (রাঃ)-এর তাক্বলীদ করতেন। অথচ ইমাম শাফেঈ (রহঃ) যাদের তাক্বলীদ করতেন, তারা তাঁদের তাক্বলীদ না করে ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর তাক্বলীদ করে থাকে।[6] ইসলামী বিধান মানার ক্ষেত্রে যুক্তির অবতারণা না করে দলীল মেনে নেওয়াই মুমিনের বৈশিষ্ট্য। সুতরাং কুরআন-হাদীছে কোন দলীল পাওয়া গেলে কোন ইমাম বা ব্যক্তির অভিমতের দিকে লক্ষ্য করার কোন অবকাশ নেই।

তাক্বলীদের অপকারিতা :

১-তাক্বলীদ করলেকুরআন ও ছহীহ হাদীছ প্রত্যাখ্যান করা হয় : তাক্বলীদপন্থীগণ নির্দিষ্ট কোন এক ব্যক্তি বা মাযহাবের তাক্বলীদ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে যঈফ এবং মাওযূ হাদীছের উপর আমল করে থাকে। কারণ সেটা তাদের অনুসরণীয় ইমাম বলেছেন। ইমামের অন্ধানুসরণের ফলে তাদের রায়ের বিপরীতে ছহীহ হাদীছ বিদ্যমান থাকলেও তাদের পক্ষে তা মানা সম্ভব হয় না। বরং তারা তাদের মাযহাবকে বিজয়ী করার জন্য কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বিরুদ্ধে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করতে সচেষ্ট হয়।

ইমাম রাযী (রহঃ) বলেন, আমি মুক্বালিলদদের একটি জামা‘আতের সাথে সাক্ষাৎ করেছি এবং বিভিন্ন মাসআলা সম্পর্কে তাদের সামনে পবিত্র কুরআনের অনেকগুলি আয়াতকে দলীল হিসাবে পেশ করেছি। কিন্তু তাদের অনুসরণীয় মাযহাব কুরআনের আয়াতগুলির বিপরীত হওয়ায় তারা তা গ্রহণ করেনি এবং তারা কুরআনের আয়াতের দিকে ফিরেও দেখেনি। বরং তারা অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল এবং বলল, কিভাবে আমরা এর উপর আমল করব, আথচ আমাদের অনুসরণীয় মাযহাব এর বিপরীত’?[7]

২- তাক্বলীদের কারণে যঈফ হাদীছ প্রসার লাভ করে এবং ছহীহ হাদীছের উপর আমল বন্ধ হয়ে যায় : তাক্বলীদপন্থীগণ তাদের ইমামদের রায় বা মত থেকে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে আসে না, যদিও তারা ভুলের উপরে থাকে। আর এরূপ অন্ধানুসরণের ফলে ছহীহ হাদীছের উপর আমল বন্ধ হয়ে যায় এবং যঈফ হাদীছ প্রসার লাভ করে। যেমন হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ : إِذَا قَهْقَهَ أَعَادَ الْوُضُوْءَ وَأَعَادَ الصَّلاَةَ- أخرجه الدارقطني

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘যখন তিনি অট্টহাঁসি দিলেন তখন পুনরায় ওযূ করলেন এবং ছালাত পুনরায় আদায় করলেন’।[8]

হানাফী মাযহাবের বিশিষ্ট মুহাদ্দিছ যায়লাঈ (রহঃ) বলেন, উল্লিখিত হাদীছের একজন রাবী, যার নাম আব্দুল আযীয তিনি যঈফ এবং হাদীছটি মুনকাতে‘।[9] অতএব হাদীছটি যঈফ, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তাক্বলীদপন্থীগণ নির্দিষ্ট কোন এক মাযহাবের অন্ধানুসরণ করতে গিয়ে এই হাদীছটির উপর আমল করেন।

৩- মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে বিভক্তির মূল কারণ তাক্বলীদ : মুসলমানরা যখন খাঁটি ও পূর্ণ মুমিন ছিলেন, তখন তারা ছিলেন সাহায্যপ্রাপ্ত, দেশ বিজয়ী, দ্বীনের পতাকা সমুন্নতকারী। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় খুলাফায়ে রাশেদীন ও তাঁদের একনিষ্ঠ অনুসারীগণের মধ্যে। কিন্তু যখন মুসলমানরা আল্লাহ তা‘আলার আদেশ সমূহ বদলে ফেলেন, তখন তিনি তাদেরকে নে‘মতের বদলে শাস্তি দেন, কেড়ে নেন তাদের রাজত্ব, মুছে ফেলেন তাদের খেলাফত। আর এর মূলে রয়েছে নির্দিষ্ট এক মাযহাবের অন্ধানুসরণ এবং তার জন্য বাতিলের আশ্রয় নিয়ে হ’লেও পক্ষপাতিত্ব করা। যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর তিন শত বছর পর আবিষ্কৃত হয়েছে। বিগত যুগের সৎকর্মশীল ব্যক্তিগণ কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নির্দেশিত পথ দৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে ধরে থাকতেন। তাঁরা ছিলেন খাঁটি মুসলমান। আল্লাহ তাদেরকে জান্নাত নছীব করুন। কিন্তু যখন থেকে মাযহাবের সৃষ্টি হয়, তখন থেকে শুরু হয় একে অপরকে পথভ্রষ্ট বলাবলি। এমনকি ফৎওয়া দেওয়া হয় যে, শাফেঈ ইমামের পিছনে হানাফীদের ছালাত হবে না, যদিও তারা বলে থাকে যে, চার মাযহাবের অনুসারীগণ সকলেই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তাদের কর্মকান্ড তাদের এ উক্তির বিরোধিতা করে এবং এর অসারতা প্রমাণ করে। সাথে সাথে তাদেরকে মিথ্যুকও প্রমাণ করে। কারণ এ মাযহাবকে কেন্দ্র করে পবিত্র কা‘বা গৃহে সৃষ্টি হয়েছিল চার মুছল্লা। একই কা‘বা গৃহে একই ছালাতে চার মাযহাবের চার জামা‘আত ক্বায়েম হয়েছিল। প্রত্যেক মাযহাবের অনুসারী নিজ মাযহাবের জামা‘আতে ছালাত আদায়ের জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করে। তাই দেখা যাচ্ছে যে, ইবলীস এই মাযহাবকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে স্বীয় উদ্দেশ্য হাছিল করতে সক্ষম হয়েছে। কারণ তার উদ্দেশ্যই হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা এবং তাদের ঐক্য বিনষ্ট করা। অথচ কোন ইমামই বলেননি যে, তোমরা আমার মতের অনুসরণ কর। বরং তাঁরা এর বিপরীতে বলেছেন, তোমরা সেখান থেকে শরী‘আত গ্রহণ কর, যেখান থেকে আমরা গ্রহণ করেছি। তদুপরী এ সকল মাযহাবের সাথে যুক্ত হয়েছে পরবর্তীকালের বহু মনীষীর অনেক চিন্তা-চেতনা। যার মধ্যে অনেক ভুল রয়েছে এবং এমন বহু কাল্পনিক মাসআলা রয়েছে যা ঐসব ইমামগণ যদি দেখতেন, যাঁদের মাযহাবের নাম দিয়ে এগুলো চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাহ’লে অবশ্যই তাঁরা ঐ সকল মাসআলা ও তার আবিষ্কারকদের থেকে নিজেদেরকে সম্পূর্ণ মুক্ত বলে ঘোষণা করতেন।

৪- তাক্বলীদ সুন্নাতের অনুসারীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে : তাক্বলীদপন্থীগণ নিজেদের অনুসরণীয় মাযহাব ছাড়া অন্য কারো নিকট থেকে হক গ্রহণ করে না এবং তারা কামনা করে না যে, কোন সুন্নাতের অনুসারীর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হোক। এমনকি তারা সুন্নাতের অনুসারীকে যে কোন মূল্যে অপমান করার চেষ্টায় রত থাকে। যার ফলে সুন্নাতের অনুসারীগণ তাদের সুন্নাতী আমল বিদ‘আতীদের সামনে প্রকাশ করতে ভয় পায়। তা সত্ত্বেও সুন্নাতের অনুসারীগণ তাদের সুন্নাতী আমল প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। ফলে উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এমনকি সুন্নাতের অনুসারীগণ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। অবশেষে মসজিদ পৃথক করতে বাধ্য হয়।

৫- তাক্বলীদ অমুসলিমকে ইসলামে প্রবেশ করতে বাধা প্রদান করে : কোন অমুসলিম যখন ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মুসলিম হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে, তখন তার সামনে উদ্ভাসিত হয় চার মাযহাব। সে চিন্তা করে কোন মাযহাব ছহীহ, যাতে সে প্রবেশ করবে? হানাফী মাযহাবের আলেমের নিকটে গেলে সে নিজ মাযহাবকে ছহীহ বলে আখ্যা দেয় এবং তাতে প্রবেশ করার আহবান জানায়। শাফেঈ মাযহাবের আলেমের নিকট গেলে সে নিজ মাযহাবকে ছহীহ বলে আখ্যা দেয় এবং তাতে প্রবেশের আহবান জানায়। মালেকী মাযহাবের আলেমের নিকটে গেলে, সে নিজ মাযহাবকেই ছহীহ বলে অখ্যা দেয় এবং তাতে প্রবেশ করার আহবান জানায়। হাম্বলী মাযহাবের আলেমের নিকটে গেলে সে নিজ মাযহাবকেই ছহীহ বলে আখ্যা দেয় এবং তাতে প্রবেশ করার আহবান জানায়। তখন অমুসলিম ব্যক্তির মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ফলে সে এক পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করা হ’তে বিরত থাকতে বাধ্য হয়।

৬- তাক্বলীদ হ’ল বিনা ইলমে আল্লাহ সম্বন্ধে কথা বলা : বিনা ইলমে আল্লাহ সম্বন্ধে কথা বলা সবচেয়ে বড় হারাম সমূহের মধ্যে একটি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوْا بِاللهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَنْ تَقُولُوْا عَلَى اللهِ مَا لاَ تَعْلَمُوْنَ.

‘বল, নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক হারাম করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা আর পাপ এবং অসংগত বিরোধিতা এবং কোন কিছুকে আল্লাহর শরীক করা, যার কোন সনদ তিনি প্রেরণ করেননি এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যা তোমরা জান না’ (আ‘রাফ ৩৩)। আর বিনা ইলমে আল্লাহ সম্বন্ধে কথা বলার অনেক ঘটনা রয়েছে। তন্মধ্য হ’তে একটি হ’ল, যারা হানাফী মাযহাবের তাক্বলীদ করে তারা একটি মিথ্যা বানোয়াট ঘটনা বর্ণনা করে থাকে। ঘটনাটি হ’ল খিযির (আঃ) ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর নিকট হ’তে শারঈ ইলম অর্জন করেছেন। খিযির (আঃ) ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর নিকট পাঁচ বছর অবস্থান করেন। অতঃপর যখন ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) মৃত্যুবরণ করলেন, তখন খিযির (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার নিকটে অনুমতি চাইলেন যে, তিনি ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর নিকটে তার কবর হ’তেই ফিকহী ইলম অর্জন করবেন। তারপরে তিনি ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর নিকটে তার কবর হ’তে পঁচিশ বছর যাবত ফিকহী ইলম অর্জন করেছেন।[10]

ইমামদেরকে সম্মান করা আবশ্যক :

আললাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে তাদের পূর্বপুরুষ তথা ছাহাবীগণ, ইমামগণ ও নেক্কার ব্যক্তিগণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, وَالَّذِيْنَ جَاءُوْا مِنْ بَعْدِهِمْ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِيْنَ سَبَقُوْنَا بِالْإِيْمَانِ وَلاَ تَجْعَلْ فِيْ قُلُوْبِنَا غِلاً لِّلَّذِيْنَ آمَنُوْا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوْفٌ رَّحِيْمٌ- ‘যারা তাদের পরে এসেছে, তারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এবং ঈমানে অগ্রগামী আমাদের ভাইদেরকে ক্ষমা কর এবং মুমিনদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে বিদ্বেষ রেখ না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তো দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু’ (হাশর ১০)

অতএব মুমিনদের কর্তব্য হ’ল ইমামদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, তাঁদের মাগফিরাতের জন্য দো‘আ করা, তাঁদের ইলম দ্বারা নিজে উপকৃত হওয়া এবং অহি-র বিধানকে ইমামদের কথার উপর বিনা দ্বিধায় প্রাধান্য দেয়া। কিন্তু অহি-র বিধানকে উপেক্ষা করে ইমামদের কথাকে প্রাধান্য দেয়া কখনই বৈধ নয়। কেননা ইমামগণ কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। সকলেই তাদের ইজতিহাদে কিছু না কিছু ভুল করেছেন। কিন্তু ভুল করলেও তাঁরা নেকী পেয়েছেন। হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ أَنَّهُ سَمِعَ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ : إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ، وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ.

আমর ইবনুল আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে এ কথা বলতে শুনেছেন, ‘কোন বিচারক ইজতিহাদে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছলে তার জন্য আছে দু’টি নেকী। আর বিচারক ইজতিহাদে ভুল করলে তার জন্যও রয়েছে একটি নেকী’।[11]

সুতরাং ইমামদেরকে যথাযথ সম্মান করতে হবে। কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ তাদের অভিমতকে সাদরে গ্রহণ করতে হবে। পক্ষান্তরে তাঁদের কোন কথা কুরআন-হাদীছের বিপরীত হ’লে তা বর্জন করতে হবে এবং কুরআন-হাদীছের নির্দেশকে অবনত মস্তকে মেনে নিতে হবে।

মাযহাবী দ্বন্দ্ব অবসানের উপায় :

মাযহাবী দ্বন্দ্ব অবসানের অন্যতম উপায় হ’ল- (ক) মাযহাবী গোঁড়ামিকে পদদলিত করে কিতাব ও সুন্নাহর যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমে আললাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী-تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ، لَنْ تَضِلُّوْا مَا إِنْ تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ. ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি বস্তু ছেড়ে যাচ্ছি, যতদিন পর্যন্ত তোমরা ঐ দু’টি বস্তুকে দৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে ধরে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। তা হচ্ছে- ১. আললাহর কিতাব (কুরআন) ও ২. তাঁর রাসূলের সুন্নাত (হাদীছ)’।১২

(খ) কোন বিষয়ে মতভেদ দেখা দিলে নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের তাক্বলীদ না করে একমাত্র আললাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরে যাওয়া। আললাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আললাহ ও পরকালে বিশবাস কর, তবে তোমরা আনুগত্য কর আললাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং আনুগত্য কর আমীরের। কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে, তা সোপর্দ কর আললাহ এবং তাঁর রাসূলের নিকটে। এটাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর’ (নিসা ৫৯)

(গ) সার্বিক জীবনে অহি-র বিধান বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাপ-দাদার দোহাই না দিয়ে কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে নিঃশর্তভাবে

মেনে নেয়া। আললাহ তা‘আলার বাণী, ‘যখন তাদেরকে বলা হয়, আললাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তোমরা তার অনুসরণ কর, তখন তারা বলে, না, বরং আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে যার উপর পেয়েছি তার অনুসরণ করব। এমনকি তাদের পিতৃপুরুষগণ যদিও কিছুই বুঝত না এবং তারা সৎপথেও পরিচালিত ছিল না তথাপিও’? (বাক্বারাহ ১৭০)

উপসংহার :

পরিশেষে বলা যায় যে, আললাহ রাববুল আলামীন মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁর ইবাদতের উদ্দেশ্যে। তিনি বলেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلاَّ لِيَعْبُدُوْنِ. ‘আমি সৃষ্টি করেছি জিন এবং মানুষকে এজন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে’ (যারিয়াত ৫৬)। আর ইবাদত কিভাবে করতে হবে তাও তিনি অহী মারফত জানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং ইবাদতের মূল দিক নির্দেশিকা হ’ল কুরআন ও হাদীছ; মানুষের রায় বা মত নয়। তাই মাযহাবী গোঁড়ামি ত্যাগ করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে কেবলমাত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসরণ করলেই সকল সমস্যার সমাধান পাওয়া সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন নিরপেক্ষ মনমানসিকতা। অর্থাৎ কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সামনে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণের মানসিকতা, যা মানুষকে হক্ব গ্রহণে সহায়তা করবে এবং মাযহাবী দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাবে ইনশাআললাহ। আললাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!

মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম

লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।

[1]. ছহীহ ইবনে মাজাহ, হা/৩১৬৫

[2]. আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম, পৃঃ ৮৯৭।

[3]. আবু আব্দুর রহমান সাঈদ মা‘শাশাহ, আল-মুক্বাল্লিদূন ওয়াল আইম্মাতুল আরবা‘আ, পৃঃ ১১৬।

[4]. ঐ।

[5]. ঐ।

[6]. ইবনুল কাইয়িম, ইলামুল মুয়াক্কিঈন, ২/১৮৪।

[7]. ইমাম রাযী, তাফসীরে কাবীর ৪/১৩১।

[8]. সুনানে দারাকুতনী, হা/৬১১।

[9]. আয-যায়লাঈ, নাছবুর রেওয়াইয়াহ, (মাকতাবুল ইসলামী, বৈরূত), ১/৪৮।

[10]. মুহাম্মাদ ঈদ আববাসী, বিদ‘আতুত তা‘আছ্ছুবিল মাযহাবী, ২/৭০।

[11]. বুখারী, হা/৭৩৫২ ‘বিচারক ইজতিহাদে ঠিক করুক বা ভুল করুক তার প্রতিদান পাবে’ অধ্যায়।

১২. সিলসিলা ছহীহাহ, ৪/১৭৬১।






বিষয়সমূহ: তাহারাত-পবিত্রতা
মানব জাতির সাফল্য লাভের উপায় (৪র্থ কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
বিশ্ব ভালবাসা দিবস - আত-তাহরীক ডেস্ক
দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকার (৫ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
এক নযরে হজ্জ
ইসলামে প্রবীণদের মর্যাদা - মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম
বিদ‘আতে হাসানার উদাহরণ : একটি পর্যালোচনা - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা (শেষ কিস্তি) - মীযানুর রহমান মাদানী
পিতা-মাতার উপর সন্তানের অধিকার (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ শফীকুল আলম
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ভালবাসা (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ইহসান ইলাহী যহীর
পবিত্রতা অর্জন সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল (৬ষ্ঠ কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
শায়খ আলবানীর তাৎপর্যপূর্ণ কিছু মন্তব্য (শেষ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ : একটি পর্যালোচনা - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আরও
আরও
.