মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (২য় কিস্তি)

যুবায়ের বিন আওয়াম (রাঃ)-এর মা

যুবায়ের বিন আওয়াম (রাঃ) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আপন ফুফাত ভাই। তার মায়ের নাম ছাফিয়া বিনতে আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ)। এই মহিয়সী রমণী বংশ পরিচয়ে চারিদিক থেকে শরাফত ও আভিজাত্যের অধিকারী ছিলেন। তার মায়ের নাম হালা বিনতে ওয়াহ্হাব। যিনি ছিলেন নবী করীম (ছাঃ)-এর মা আমীনা বিনতে ওয়াহ্হাবের বোন।

তার পিতা আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন কুরাইশদের সর্দার ও যমযম কূপের আবিষ্কর্তা।[1] তার প্রথম স্বামীর নাম হারিছ বিন হারব। তিনি ছিলেন কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের ভাই। পরবর্তীতে আওয়াম বিন খুয়াইলিদের সাথে তার বিবাহ হয়। আওয়াম ছিলেন বিশ্বরমণীকূলের নেত্রী খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদ (রাঃ)-এর ভাই। নবী করীম (ছাঃ) ছিলেন তার ভাতিজা। তার পুত্র যুবায়ের ছিলেন নবী করীম (ছাঃ)-এর হাওয়ারী বা অত্যধিক সাহায্যকারী এবং যুগের বিস্ময়। তার বংশ ছিল এক সম্মাননার পদক (Medal of Honor)। যা একাধারে তার বুকে লকেট ও মাথায় মুকুট হিসাবে শোভা পেত। তার বংশমর্যাদার আলোচনা যেমন তার জীবদ্দশায় হ’ত, তেমনি তার জীবনাবসানের পরেও তা অক্ষুন্ন ছিল। তার মায়ের ইসলাম গ্রহণ মর্যাদার এ মুকুটকে আরও উঁচুতে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি সেই অসামান্য নারী এবং বীর মহিলা ছাহাবী হ’তে পেরেছিলেন যার গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন ইসলামের প্রথম অশ্বারোহী বীরপুরুষ যিনি আল্লাহর রাহে যুদ্ধে প্রথম তলোয়ার কোষমুক্ত করেছিলেন।

এই মহাপুরুষের বীরত্ব ও পৌরুষের খ্যাতি এত দূর পৌঁছেছিল যে, হযরত ওমর (রাঃ) তাকে এক হাযার পুরুষের সমতুল্য গণ্য করতেন। আমর বিন আছ (রাঃ) যখন মিশর থেকে মুসলিম বাহিনীর সাহায্যের জন্য ওমর (রাঃ)-কে পত্র দেন তখন তিনি উত্তরে লিখেছিলেন, ‘আমি তোমাকে চার হাযার সৈন্য দিয়ে সাহায্য করছি, যাদের প্রতি হাযারের নেতৃত্বে থাকবেন এমন একজন, যিনি একাই এক হাযার। তারা হ’লেন যুবায়ের বিব আওয়াম, মিকদাদ বিন আমর, উবাদা বিন ছামিত ও মাসলামা বিন খালিদ’।

যুবায়ের (রাঃ)-এর মা যেমন চারিকুল থেকে মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী ছিলেন তেমনি যুবায়ের (রাঃ)ও চতুর্দিক থেকে মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন। তার স্ত্রী ছিলেন ছিদ্দীকে আকবারের কন্যা আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ)। মা ছিলেন নবী করীম (ছাঃ)-এর ফুফু ছাফিয়া বিনতে আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ)। তার পুত্র আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ) হিজরতের পর মদীনাতে জন্মগ্রহণকারী প্রথম মুসলিম শিশু। তার ফুফু ছিলেন খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদ (রাঃ)।

শৈশবেই যুবায়ের (রাঃ)-এর পিতা মারা যান। ফলে তিনি মায়ের হাতেই লালিত পালিত হন। তিনি খুব কড়াকড়িভাবে ছেলেকে প্রতিপালন করেন। অশ্বচালনা ও যুদ্ধবিদ্যায় তিনি তাকে পারদর্শী করে তোলেন। তিনি মায়ের আঁচল তলে যৌবন লাভ করেন। মায়ের স্বভাব-প্রকৃতি তার মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়েছিল। মায়ের গতিবিধিই ছিল তার গতিবিধি। যাতে তার নিক্ষিপ্ত তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয় সেজন্য তিনি তাকে নিয়মিত তীর-ধনুক চালনার অনুশীলন করাতেন। সঠিক মানের তীর কিভাবে তৈরি করা যায় সে কৌশল রপ্ত করার পদ্ধতি তিনি তাকে শিখাতেন। বীরত্ব ও সাহসিকতামূলক যে কোন অনুষ্ঠানে তার বীরত্ব ও সাহস বৃদ্ধির জন্য তিনি তাকে নামিয়ে দিতেন। যখন দেখতেন ছেলে নামতে চাচ্ছে না, দ্বিধা প্রকাশ করছে তখন তিনি তাকে মার লাগাতেন। এজন্য মাকে অনেক সময় তিরস্কারের মুখোমুখি হ’তে হ’ত। কিন্তু তার সংকল্প তাতে টলত না। তিনি চাইতেন তার ছেলে একদিন এমন বীরপুরুষ হবে, যে বহু সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করবে। তারপর তিনি তাকে বেশ কিছু কঠিন কাজে নিযুক্ত করেন যাতে তার দেহ মযবূত ও শক্তপোক্ত হয়।

ছাফিয়া বিনতে আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ) ছেলেসহ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং মুমিনদের কাফেলায় যোগ দিয়েছিলেন। ইসলাম গ্রহণের ফলে অন্যান্য মুসলমানদের যেসব বালা-মুছীবত, যুলুম-অত্যাচার, বাধা-বিপত্তি, শাস্তি-সাজা, সমাজচ্যুতি, বাস্ত্তত্যাগ ইত্যাদির সম্মুখীন হ’তে হয়েছিল তাদেরও সেসব কিছুর সম্মুখীন হ’তে হয়েছিল। একসময় তিনি আল্লাহ ও রাসূলের পথে হিজরতের ঘোষণা দেন। পথে তার সাহসিকতা তার হিজরতের সাথী হয়েছিল। স্বীয় দ্বীন রক্ষার খাতিরে তিনি মক্কাভূমিকে পিছনে ফেলে মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

যে ব্যক্তিই ছাফিয়া (রাঃ)-এর জীবনী পড়বে ও তার আদর্শ ভেবে দেখবে সেই দেখতে পাবে যে, তিনি হাযার মানুষের সমতুল্য এক শক্তিশালী সাহসী নারী। শান্তিতে-যুদ্ধে বহু ক্ষেত্রেই তার এই বীরত্ব লক্ষ্য করা গেছে। তিনি তার পুত্রকেও এই পথের পথিক করে তোলেন।

ওহোদ যুদ্ধে তিনি সৈনিকদের জন্য পানি বয়ে আনছিলেন, তীর যোগান দিচ্ছিলেন, পিপাসিতদের হাতে পানি তুলে দিচ্ছিলেন এবং ধনুক ঠিক করে দিচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তার ভাই হামযাহ (রাঃ)-এ যুদ্ধে নিহত হন। যিনি ছিলেন তারই মতো অসম সাহসী পুরুষ। শক্তি, বীরত্ব ও দ্বীনের জন্য লড়াই-সংগ্রামে দু’ভাই-বোন ছিলেন একই কাতারের মানুষ। দ্বীনের মর্যাদা সমুন্নত রাখতেই ভাইকে জীবন কুর বানী করতে হয়েছিল। এ মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই তাকে ব্যথিত করেছিল।

তিনি ছিলেন যেন এক নারী সিংহী। সিংহীর মতই শিকারের উপর নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। আবার তার আবাসে রেখে আসা সিংহ শাবকের কথাও তার মন থেকে উধাও হ’ত না। বরং শিকার ধরে তিনি শাবকের সামনে নিক্ষেপ করতেন। যাতে শাবকও মায়ের অর্জিত যুদ্ধবিদ্যার কৌশল চাক্ষুষভাবে রপ্ত করতে পারে। ছেলে মাকে তাকিয়ে দেখছেন, বল্লম হাতে কাতারকে কাতার ভেদ করে এগিয়ে চলছেন, আর সিংহের মতো গর্জে উঠে বলছেন, তোমরা করছটা কি? আল্লাহ তোমাদের উপর রহম করুন। তোমরা আল্লাহর রাসূলকে ফেলে রেখে পালাচ্ছ?

নবী করীম (ছাঃ) এ দৃশ্য দেখে শঙ্কিত হ’লেন। তিনি সিংহ শাবককে আদেশ দিলেন, সে যেন তাকে আল্লাহ ও তার রাসূলের সিংহ মযলূম হামযাহ (রাঃ)-এর নিথর দেহ যেখানে পড়ে আছে সেখানে যেতে না দেয়। তারা নারকীয় তান্ডব চালিয়ে তাঁর পেট ফেড়ে দেহ বিকৃত করে তাদের জিঘাংসা চরিতার্থ করেছিল। এ খবর শুনে তিনি অভ্যাসমতই অবিচল থেকেছেন এবং সিংহনাদে বলেছেন, আল্লাহর সিংহের দেহ মুছলা (বিকৃত) করা হয়েছে! ঠিক আছে, তাতে কোন অসুবিধা নেই।[2]

খন্দক যুদ্ধ। সে ছিল আরেক জিহাদ। আরেক সাহসিকতার ক্ষেত্র। মদীনায় দুর্গের অভ্যন্তরে যেখানে নারী ও শিশুরা আশ্রয় নিয়েছিল সেখানে এক ইহুদীর ছায়ামূর্তি তার নযরে আসে। দুর্গের ভিতরে কারা আছে, তাদের সংখ্যাই বা কত ইত্যাদি বিষয়ে ঐ ইহুদী গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছিল। তিনি তীক্ষ্ণ নযরে তাকে দেখছিলেন এবং কান পেতে তার কথা শোনার চেষ্টা করছিলেন। তাদের চারপাশে যে বিপদ ঘনিয়ে আসছে তা তিনি আঁচ করতে পারলেন। তিনি বুঝতে পারলেন দুষ্টুচক্র এখন যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে তাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তার ভিতরে সুপ্ত সাহস জেগে উঠল, ইসলামী জোশ টগবগ করে উঠল, ধী শক্তি দ্রুত কাজ করল। মাথায় উড়না পেঁচিয়ে নিলেন, যুদ্ধের পোশাক পরে নিলেন এবং তাঁবুর একটা খুঁটি কাঁধে তুলে নিলেন। দুর্গের দরজায় তিনি সতর্ক অবস্থান নিলেন। সেই ছায়ামূর্তির দেখা পেলে তিনি তাকে এমন শিক্ষা দিবেন যে, মহিলাদের বীরত্বের কথা সে কোন দিন ভুলবে না। তাকে দেখতে পেয়ে তিনি খুব আনন্দিত হ’লেন এবং বীরবিক্রমে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তার মাথায় খুঁটি দিয়ে সজোরে আঘাত হানলে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তিনি তার দু’হাত ও কব্জি পেঁচিয়ে বেঁধে ফেললেন। তারপর একের পর এক আঘাত হেনে তার আত্মা দেহছাড়া করে দিলেন। তারপর ছুরি বের করে তার মাথা ধর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দুর্গের উপর দিয়ে ইহুদিপল্লীর দিকে ফেলে দেন। মাথাটি গড়িয়ে গড়িয়ে যেখানে গিয়ে থামে সেখান থেকে ইহুদীরা তা দেখতে পায়। এ দৃশ্য দেখে ইহুদীদের মনে ভয় ঢুকে যায়। তাদের বিশ্বাস জন্মে, দুর্গের মধ্যে অনেক পুরুষ প্রতিরোধ যোদ্ধা রয়েছে। ফলে তারা সে স্থান ছেড়ে চলে যায়। এভাবেই আল্লাহ তা‘আলা এক পুরুষ প্রতিরোধ যোদ্ধার হাত ধরে মুসলমানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন, যদিও বাস্তবে তা ছিল একজন নারী প্রতিরোধ যোদ্ধার হাত।[3]

ইসলাম গ্রহণের ফলে যুবায়ের (রাঃ) প্রচন্ড নিপীড়নের শিকার হন। তাকে নানাভাবে শাস্তি দেওয়া হয়। এ কাজে দায়িত্ব পালন করেছিল তারই আপন চাচা। তিনি দু’বার হিজরত করেছিলেন, একবার ইথিওপিয়ায়, আরেকবার মদীনায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে যুদ্ধের সবক’টিতে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধের প্রথম সারিতে তার নাম থাকত।

সম্মুখ সারিতে থাকার ফলে যুদ্ধে শত্রু পক্ষের তীর-বল্লমের আঘাত তাকে ব্যাপকভাবে সইতে হয়েছিল। আঘাতের চিহ্নে তার দেহ ভরে গিয়েছিল। কিছু চিহ্ন তো স্মারক আকারে তার দেহে জ্বলজ্বল করত। দর্শকমাত্রেই তা দেখে তার বীরত্ব আঁচ করতে পারত। তার সম্পর্কে তার জনৈক সাথী বলেছেন, এক সফরে আমি যুবায়েরের সঙ্গী হয়েছিলাম। আমি দেখলাম তলোয়ারের আঘাতের দাগে তার দেহ ভর্তি। তার বুকে বল্লম ও তীরের আঘাত লেগে এমন সব গর্ত সৃষ্টি হয়েছে যেন দেবে যাওয়া একেকটি ঝরণা। আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমি আপনার শরীরে যে দৃশ্য দেখছি এমনটি আর কারও শরীরে কখনো দেখিনি। উত্তরে তিনি আমাকে বললেন, শোন, আল্লাহর কসম করে বলছি, এর একটি আঘাতও রাসূলুল্লাহর সাথে এবং আল্লাহর পথে যুদ্ধ ব্যতীত অন্য কোন ক্ষেত্র থেকে লাগেনি।

ইয়ারমুক যুদ্ধে তো যুবায়ের (রাঃ) ছিলেন একাই একটি সেনাদল। তিনি দেখলেন, মুসলিম যোদ্ধারা যুদ্ধের ময়দান থেকে পিছু হটে যাচ্ছে। তখন তিনি ‘আল্লাহু আকবার’ বলে ভীষণ রবে এক চিৎকার দিলেন, তারপর বড় বড় ঢেউয়ের মত অগ্রসরমান রোমক সেনাদের ব্যুহ ভেদ করে একাই সিংহবিক্রমে তলোয়ার নিয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সূর্যের তেযে যেন তিনি জ্বলে উঠছেন; না হাল ছেড়ে দিচ্ছেন, না ভেঙে পড়ছেন। তার মাঝে শাহাদতের তামান্না ছিল অত্যন্ত প্রখর। তাই তিনি শহীদদের নামে সন্তানদের নাম রাখেন। তারা যুদ্ধে শহীদ হবে সেই আকাঙ্ক্ষায় তিনি তাদের যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করে গড়ে তোলেন। তিনি না শাসনকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন, না কর-খাজনা আদায় করেছেন, না অন্য কোন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তার কাজ ছিল কেবলই আল্লাহর রাহে যুদ্ধ করা। তিনি ছিলেন উন্নত স্বভাব ও মহৎ চরিত্রের অধিকারী। তার বীরত্ব ও দানশীলতা ছিল যেন প্রতিযোগী দুই ঘোড়া- কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। তার সম্পদও ছিল প্রচুর। কিন্তু সব কিছুই তিনি ইসলামের জন্য দান করে যান এবং শেষ পর্যন্ত ঋণ রেখে ইহলোক ত্যাগ করেন।

তিনি আল্লাহর উপর ভরসা করে দরাজ হাতে দান করতেন। এমনকি নিজের জীবনকেও তিনি আল্লাহর রাহে দান করে দেন। তিনি তার ছেলে আব্দুল্লাহকে তার ঋণ পরিশোধ করতে নির্দেশ দিয়ে যান। তিনি তাকে বলেন, ঋণ পরিশোধে কখনো অপারগ হ’লে আমার মনিবের কাছে সাহায্য চেয়ো। ছেলে বলল, কোন মনিবের কথা আপনি বলছেন? তিনি উত্তর দিলেন, ‘আল্লাহ, তিনি কতই না ভালো মনিব, আর কতই না ভালো সাহায্যকারী’! আব্দুল্লাহ বলেন, এরপর থেকে তার ঋণ পরিশোধে কোন সমস্যায় পড়লে আমি বলতাম, হে যুবায়েরের মনিব! তুমি তাঁর ঋণ পরিশোধ করে দাও। তখন তিনি তার ঋণ পরিশোধ করে দিতেন।[4]

উষ্ট্রের যুদ্ধে তিনি নিহত হন। তাকে হত্যাকারী আলী (রাঃ)-এর নিকটে এসে তার শত্রুর দফারফা করার সুসংবাদ শুনাতে ও তার কাছে প্রবেশের অনুমতি চায়। যুবায়েরের হত্যাকারী তার কাছে প্রবেশের অনুমতি চাচ্ছে শুনে আলী (রাঃ) চিৎকার দিয়ে উঠলেন এবং তাকে তাড়িয়ে দিতে আদেশ দিলেন। তিনি তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, তোমরা ছাফিয়ার পুত্রের হত্যাকারীকে জাহান্নামের সুসংবাদ দাও। তারা আলী (রাঃ)-এর নিকটে তার তলোয়ার নিয়ে এলে তিনি তাতে চুমু খান, চিৎকার দিয়ে কেঁদে ফেলেন এবং বলেন, এই তলোয়ার কতবার যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে ঘনায়মান বিপদ দূর করেছে! ‘ছাফিয়ার পুত্র’ এভাবেই আলী (রাঃ) তাকে সম্বোধন করেছেন। মায়ের সাথে এ সম্বন্ধ পিতার সাথে সম্বন্ধের মতই তার জন্য সমান সম্মাননার কথা বলে। আল্লাহ তাদের সবার উপর রাযী থাকুন- আমীন!

আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ)-এর মা

আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ)-এর মায়ের নাম আসমা বিনতে আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ)। আর আসমা (রাঃ)-এর মায়ের নাম কুতাইলা বিনতে আব্দুল উয্যা আমেরী। ইসলামের প্রথম যুগে মক্কায় যখন সবেমাত্র সতের জন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছেন তখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।[5] ইসলাম গ্রহণের ফলে তাকে নানাবিধ নিপীড়ন সইতে হয়েছিল। ধৈর্যের সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে তিনি সকল প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করতেন। তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ) হিজরতের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান তখন আবু জাহলসহ কুরাইশদের কিছু লোক আমাদের বাড়িতে আসে। তারা ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আবুবকরকে ডাক দিলে আমি বেরিয়ে এলাম। তারা বলল, তোমার আববা কোথায়? আমি বললাম, আল্লাহর কসম, আমার আববা কোথায় আমি তা জানি না। আবু জাহল যে কিনা ছিল বেহায়া কদর্য চরিত্রের, সে আমার গালে এত জোরে চপেটাঘাত করে যে আমার কানের দুল খুলে পড়ে যায়। তারপর তারা চলে গেল। এভাবে তিন রাত কেটে গেল, আমরা জানতে পারিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কোথায় আছেন।[6]

আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা ৫৮টি। তন্মধ্যে তেরটি হাদীছ ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়েই স্ব স্ব গ্রন্থে সংকলন করেছেন এবং এককভাবে ইমাম বুখারী পাঁচটি ও ইমাম মুসলিম চারটি হাদীছ সংকলন করেছেন।[7] তিনি তার স্বামী ও পুত্রের সাথে ইয়ারমুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।[8]

ইবনু জারীর তাবারী (রহঃ) আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ)-এর বরাতে তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ) সম্পর্কে কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে। ঘটনা এই যে, তার মা কুতাইলা বিনতে আব্দুল উয্যা জাহিলিয়াতের মধ্যে ছিল। একবার সে ছিনাব (কিশমিশ ও সরিষা যোগে তৈরি এক রকম খাদ্য), পনির, ঘি ও কিছু উপঢৌকন নিয়ে মেয়েকে দেখতে আসে। তিনি তাকে বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যতক্ষণ অনুমতি না দিবেন ততক্ষণ আমি না তোমার উপঢৌকন গ্রহণ করব, না তুমি আমার সাক্ষাৎ পাবে। এ কথা আয়েশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জানালে আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেন, ‘যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে লড়াই করেনি এবং বাড়ি থেকে তোমাদের তাড়িয়ে দেয়নি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদের ভালবাসেন’ (মুমতাহিনা ৬০/৮)[9]

হিজরতের পর মদীনাতে তিনিই হন প্রথম নবজাতকের মা। ছহীহ বুখারীতে উরওয়া বিন যুবায়েরের বরাতে আসমা বিনতে আবু বকর (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ)-কে মক্কায় থাকতে গর্ভে ধারণ করেন। তিনি বলেন, আমি যখন মক্কা থেকে বের হই তখন আমার গর্ভকাল পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। মদীনায় এসে আমি কুবায় অবতরণ করি এবং কুবাতেই প্রসব করি। তারপর তাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট নিয়ে আসি এবং তাঁর কোলে দেই। তিনি একটা খেজুর চেয়ে নিয়ে দাঁতে চিবিয়ে নেন। তারপর তার মুখের মধ্যে থুথু দেন। তার পেটে প্রথম যে জিনিস ঢুকেছিল তা ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর থুথু। তারপর চিবান খেজুর দিয়ে তিনি তার তাহনীক করেন। অতঃপর তিনি তার কল্যাণ চেয়ে আল্লাহর নিকট দো‘আ করেন। তিনি ছিলেন ইসলামে (মদীনায় মুহাজিরদের মধ্যে) জন্মগ্রহণকারী প্রথম শিশু। এতে মুসলমানরা খুবই খুশি হন। কারণ তাদের বলা হয়েছিল, ইহুদীরা তোমাদের উপর জাদু করেছে, ফলে তোমাদের কোন সন্তান হবে না।[10]

নবী করীম (ছাঃ) তার নাম রাখেন আব্দুল্লাহ। সাত কিংবা আট বছর বয়সকালে তিনি আবার নবী করীম (ছাঃ)-এর হাতে বায়‘আত হ’তে আসেন। তার পিতা যুবায়ের তাকে এ আদেশ দিয়েছিলেন। নবী করীম (ছাঃ) তাকে এগিয়ে আসতে দেখে মৃদু হাসেন এবং তাকে বায়‘আত করান।[11]

তার জন্মলাভের মধ্য দিয়ে ইহুদীদের জাদুর দাবী বাতিল প্রমাণিত হয়। তারা বলে বেড়াত, আমরা ওদের পাকড়াও করেছি, ফলে মদীনাতে ওদের মাঝে আর কোন ছেলে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে না। এজন্যে আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর (রাঃ) জন্মগ্রহণ করলে মুসলমানরা খুবই আনন্দিত হয়। তারা এত জোরে তাকবীর ধ্বনি করে ওঠে যে দিগন্তব্যাপী তার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে। আবুবকর (রাঃ) তাকে কোলে করে মদীনা শহর ঘুরিয়ে আনেন। ইহুদীদের দাবী বাতিল করে ধরাধামে মুসলমানদের মাঝে তার মতো ছেলে সন্তানের যে জন্ম হয়েছে সে কথা চারিদিকে ছড়িয়ে দেন। এর মাধ্যমে তিনি মদীনায় ইহুদীদের ছড়ানো গুজবের যবনিকাপাতও ঘটাতে চেয়েছিলেন।

নবী সহধর্মিনী আয়েশা (রাঃ) ছিলেন ইবনু যুবাইর (রাঃ)-এর খালা। তার নামে তাকে ‘আব্দুল্লাহর মা’ বলে ডাকা হ’ত। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পরিবারের সদস্য হিসাবে তাঁর গৃহে তার সার্বক্ষণিক অবাধ যাতায়াত ছিল।[12]

হিজরতের কার্যাবলিতে আসমা (রাঃ)-এর সবিশেষ অংশ ছিল। পুত্র আব্দুল্লাহকে পেটে নিয়ে তিনি এসব কাজ আঞ্জাম দিয়েছিলেন। বরকতময় শিশুর সেই দামী মুহূর্তগুলো ছিল কতই না সুন্দর, যখন তিনি এমন মায়ের উদরে অবস্থান করছিলেন! এভাবেই আল্লাহ তা‘আলা আব্দুল্লাহ ও তার মায়ের মাধ্যমে মুসলমানদের এক মহাবিজয় দান করেন। এ ঘটনায় যেমন মা ও ছেলের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মুসলমানদের বিজয়ী করেছিলেন তেমনি তাদের কারণে তিনি মুসলমানদের মনে আনন্দ ও খুশীর সঞ্চার করেছিলেন। তাদের মাধ্যমে মুসলমানদের দুশ্চিন্তা-হতাশা দূরীভূত হয়েছিল এবং কাফের-মুশরিকদের প্রভাব-প্রতিপত্তি খর্ব হয়েছিল। ইহুদীদের জাদুটোনা ও তাদের দাবী অমূলক প্রমাণে এই মা ও ছেলের ভূমিকা ছিল অনন্য।

মা ও ছেলে মুসলমানদের নিকটে সম্মানের আসনে আসীন হয়েছিলেন, পরিবারের সদস্যদের প্রিয়ভাজন হ’তে পেরেছিলেন। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এমনি করে কেটে গেছে; তাদের দু’জনের মান-মর্যাদা ও ভালোবাসা কেবল বেড়েছে, বিন্দুমাত্র কমেনি।

আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যুবায়ের যখন আমাকে বিয়ে করেছিল তখন ধরাপৃষ্ঠে তার না কোন ধন-সম্পদ ছিল, না দাস-দাসী ছিল, না কোন কিছু ছিল। ছিল কেবল পানি বহনকারী একটা উট ও একটা ঘোড়া। আমি তার ঘোড়ার খাবার যোগাতাম এবং ঝরণা থেকে পানি বয়ে আনতাম। পানি তোলা ও বহনের জন্য তার একটা বড় মশক ছিল। আমি সেটা সেলাই করে দিতাম। আমি রুটির জন্য আটা ছানতাম। কিন্তু রুটি বানাতে পটু ছিলাম না। আমার কিছু আনছারী মহিলা প্রতিবেশী একাজে আমাকে সাহায্য করত। তারা ছিল খুব বন্ধুবৎসল।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যুবায়েরকে এক খন্ড জমি দিয়েছিলেন। জমিটা ছিল আমাদের বাড়ি হ’তে দুই-তৃতীয়াংশ ফারসাখ[13] দূরে। আমি যুবায়েরের জমি থেকে খেজুরের বীজ সংগ্রহ করতাম এবং তা আমার মাথায় তুলে বাড়ি নিয়ে আসতাম। একবার পথিমধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়। তাঁর সাথে ছিল আনছারদের কয়েকজন লোক। আমার মাথায় ছিল খেজুর বীজ। তিনি আমাকে তাঁর পিছনে তুলে নেওয়ার জন্য ডাকলেন এবং তাঁর সওয়ারিকে বসানোর জন্য ‘ইখ ইখ’ শব্দ করলেন। কিন্তু পুরুষদের সাথে যেতে আমার লজ্জা লাগছিল। তাছাড়া যুবায়েরের আত্মমর্যাদাবোধের কথাও আমার মনে জাগছিল। তার মর্যাদাবোধ ছিল অত্যন্ত প্রখর। আমার সংকোচ বুঝতে পেরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) চলে গেলেন। আমি যুবায়েরের কাছে এসে বললাম, আমার মাথায় ছিল খেজুর বীজের পোটলা, এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়। তাঁর সাথে তাঁর কিছু ছাহাবী ছিল। তিনি আমাকে তাঁর পিছনে সওয়ার হওয়ার জন্য তাঁর উট বসিয়েছিলেন। কিন্তু আমার লজ্জা লাগছিল, আবার তোমার মর্যাদাবোধের কথাও আমার মনে জাগছিল। সে বলল, আল্লাহর কসম! তোমার বীজের পোটলা বহন করা আমার নিকট তাঁর পিছনে আরোহণ থেকে বেশী বেদনা- দায়ক। পরে আবুবকর (রাঃ) আমাকে একটা খাদেম প্রদান করেন। সে আমার হয়ে ঘোড়ার দেখভালের কাজ আঞ্জাম দিত। যেন এভাবে সে আমাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিল।[14]

তাবেঈ ইকরিমা (রহঃ) বলেন, আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ) ছিলেন যুবায়ের বিন আওয়ামের স্ত্রী। তিনি তার প্রতি কঠোর আচরণ করতেন। এজন্য তিনি তার পিতার কাছে অনুযোগ করলে তার পিতা তাকে বুঝিয়ে বলেন, বেটি আমার! তুমি ধৈর্য ধরো। কেননা যখন কোন মহিলার নেককার স্বামী থাকে, আর সেই স্বামী তাকে রেখে মারা যায়, আর পরবর্তীতে ঐ মহিলা অন্য কোথাও বিয়ে না করে তাহ’লে তাদের দু’জনকে জানণাতে একত্রিত করা হবে।[15]

ইবনু যুবায়ের (রাঃ) বলেন, আমি আয়েশা ও আসমা থেকে অধিক দানশীলা আর কোন মহিলাকে দেখিনি। তবে উভয়ের দানের প্রকৃতি ছিল আলাদা। আয়েশা (রাঃ) একটু একটু করে বেশ খানিকটা জমিয়ে নিয়ে ক্ষেত্রমত দান করতেন। পক্ষান্তরে আসমা (রাঃ) হাতে পাওয়ামাত্রই দান করতেন। আগামীকালের জন্য জমিয়ে রাখতেন না।[16]

আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (রাঃ) তার মায়ের তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন। মা তাকে লালন-পালন করতেন, যত্ন করতেন। ভালো গুণপনা বলতে যা বুঝায় তাই তাকে খাইয়ে ও পান করিয়ে দিতেন। ইসলামিক চেতনা, উচ্চ মূল্যবোধ ও সৎস্বভাব তার মধ্যে ছোটকাল থেকে বিকাশ লাভ করেছিল। এভাবেই তিনি শিশুকাল থেকে বেড়ে উঠেছেন, যৌবনে পদার্পণ করেছেন এবং বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন। বিবিধ গুণাবলি অর্জনে তার উপর তার মা, তার পিতা, তার নানা সিদ্দীকে আকবার (রাঃ), তার খালা উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ) ও তার দাদী ছাফিয়া (রাঃ)-এর বিরাট প্রভাব ছিল। আর তাঁরা এসব গুণ লাভ করেছিলেন স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) থেকে। ফলে ইবনু যুবায়ের (রাঃ) হ’তে পেরেছিলেন একজন পরহেযগার, মহিমান্বিত, গাম্ভীর্যময়, অত্যধিক বিনয়ী, ইবাদতগুযার, অধিকহারে ছালাত ও ছিয়ামপালনকারী, বড় বিদ্বান, ফিকাহবিদ ও শক্তিশালী শাসক। ইবনু কাছীর (রহঃ) তার ইতিহাসে এমনটাই তুলে ধরেছেন।[17]

আবু নু‘আইম তার ‘হিলইয়াতুল আওলিয়া’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, একদিন আসমা (রাঃ)-এর ছেলে উরওয়া তার নিকট গিয়ে দেখতে পান, তিনি ছালাত আদায় করছেন। তাকে তিনি ছালাতে এই আয়াত পড়তে শুনলেন,فَمَنَّ اللهُ عَلَيْنَا وَوَقَانَا عَذَابَ السَّمُومِ ‘অনন্তর আল্লাহ আমাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন এবং দগ্ধকারী আযাব থেকে আমাদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন’ (তূর ৫২/২৭) আয়াত পড়তে গিয়ে তিনি কেঁদে ফেলেন এবং কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহর আশ্রয় চাইতে লাগলেন। একইভাবে তিনি আশ্রয় চেয়ে চলছিলেন। এভাবে তার ছালাত দীর্ঘায়িত হয়ে চললে উরওয়া বাজারে গেলেন। সেখানে প্রয়োজন পূরণ শেষে ফিরে এসে দেখেন, তার মা একইভাবে কেঁদে চলেছেন আর আল্লাহর আশ্রয় চাইছেন।[18]

এভাবে আসমা (রাঃ) তার ছেলে আব্দুল্লাহকে হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়ে লালন-পালন করেছিলেন। শুধু মুখের কথা ও নছীহত করে দায়িত্ব শেষ করেননি। মায়ের ইবাদত-বন্দেগী ও স্বভাব-চরিত্রের ধারা প্রতিটি ক্ষেত্রে তার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছিল। পিতৃপুরুষদের ও শিক্ষকদের আদর্শিক ও নেতৃত্বসুলভ গুণও তাঁর মধ্যে ভালমতো ছিল। ইবনু আববাস (রাঃ) আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (রাঃ) সম্পর্কে বলেন, ‘ইবনু যুবায়ের ছিলেন আল্লাহর কিতাবের কারী (পাঠক), রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাহর অনুসারী, আল্লাহর অনুগত, আল্লাহর ভয়ে ছিয়ামপালনকারী। তার পিতা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাওয়ারী, মা ছিদ্দীকে আকবারের মেয়ে, খালা আল্লাহর হাবীবের প্রিয় সহধর্মিণী আয়েশা (রাঃ)। সুতরাং তার মর্যাদা জ্ঞানান্ধ ছাড়া কেউ অস্বীকার করতে পারে না’।[19]

অচিরেই হয়ত একদিন মুসলমানরা বুঝতে পারবে, তাদের বর্তমান সংকট থেকে মুক্তি, পদস্খলন থেকে উদ্ধার, পতন থেকে নিষ্কৃতি এবং অতীত মর্যাদা ও সভ্যতা পুনরুদ্ধার করতে নারী জাতির যত্ন নিতে হবে এবং তাদের প্রতি বড় রকমের গুরুত্ব দিতে হবে। যেমনটা প্রথম দিকের মুসলমানরা গুরুত্ব দিয়ে ছিলেন। যতক্ষণ তারা এক্ষেত্রে অবহেলা করবে, উদাসীনতা দেখাবে, সঠিক পথ না ধরবে এবং তাদের যথোচিৎ যত্ন না নেবে ততদিন তারা একটা বন্ধ্যা নিষ্ফলা ছন্নছাড়া জাতি হিসাবে থেকে যাবে। পরাজয়ের গ্লানি তাদের কুড়ে কুড়ে খাবে। দীর্ঘ যাত্রায় তারা অথৈ ভুল আর ভ্রান্তির বেদনা বয়ে বেড়াবে।

ইবনু যুবায়ের (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগে আল্লাহর পথে যুদ্ধে প্রথম সারির মুজাহিদ ছিলেন। খুলাফায়ে রাশেদীন ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর যুগে আফ্রিকায় ইসলামী বিজয়ের প্রথম কাতারের সৈনিক ছিলেন। কনস্টান্টিনোপল অভিযানেও তিনি জোরালভাবে অংশ নিয়েছিলেন।

ছেলেদের প্রতিপালনে আসমা (রাঃ)-এর বড় প্রভাব ছিল। তারা সকলেই ইসলামের মহাজন পদে বরিত হয়েছিলেন। তার ছেলেদের ক্ষেত্রে তিনি অনেক সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকা রেখে গেছেন। তন্মধ্যে নিম্নের সিদ্ধান্তটি বিশেষ গুরুত্বের দাবী রাখে।

উমাইয়া বংশীয় শাসক গোষ্ঠীর লোকেরা যখন মক্কা অবরোধ করে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ)-কে অপমান-অপদস্থ করছিল তখন একদিন তিনি তার মায়ের সাথে দেখা করে বললেন, আম্মাজান! লোকেরা আমাকে তো অপমান-অপদস্থ করছেই এমনকি আমার সন্তান ও পরিবারকেও করছে। আমার সাথে এখন গুটিকয়েক লোক ব্যতীত কেউ নেই। তাদেরও ঘণ্টাখানেক ধৈর্যধারণ ব্যতীত প্রতিরোধ করার কোন সামর্থ্য নেই। এদিকে লোকেরা দুনিয়ার যা কিছু আমি চাইব তা দিতে প্রস্ত্তত। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি? মা বললেন, প্রিয় পুত্র আমার! তুমি নিজের বিষয়ে নিজে বেশী জান। তুমি যদি মনে কর যে, তুমি হকের উপর আছ এবং হকের দিকে মানুষকে আহবান জানাচ্ছ তাহ’লে তুমি তোমার কাজ চালিয়ে যাও। এই হকের উপরেই তো তোমার সঙ্গী-সাথীগণ নিহত হয়েছেন। সুতরাং তুমি নিজেকে উমাইয়া বংশীয় ছেলে-ছোকরাদের ক্রীড়নকে পরিণত করো না। আর যদি তুমি দুনিয়া চাও, তবে তুমি কতই না নিকৃষ্ট মানুষ! তুমি নিজেকে তো ধ্বংস করছই, তোমার সাথে যারা নিহত হয়েছে তাদেরও ধ্বংস করেছ। আর যদি তুমি বল, আমি হকের উপর ঠিকই আছি, তবে আমার সাথীরা যখন সাহস হারিয়ে ফেলেছে তখন আমি দুর্বল হয়ে গেছি, তাহ’লে এটা না কোন স্বাধীনচেতা মানুষের কথা হ’তে পারে, না দ্বীনদার মানুষের কথা হ’তে পারে। দুনিয়াতে তুমি কতকাল আর বাঁচবে! নিহত হওয়াই বরং উত্তম।

ইবনু যুবায়ের (রাঃ) এগিয়ে এসে মায়ের মাথায় চুমু খেলেন এবং বললেন, আল্লাহর কসম! আমার অভিমতও তাই। আমি যে পথ ও মতের উপর দাঁড়িয়ে আছি আজ পর্যন্ত আমি তারই দাওয়াত দিয়ে চলেছি। আমি দুনিয়ার স্বার্থের দিকে ঝুঁকিনি, দুনিয়াতে বেঁচে থাকতেও লালায়িত নই। আল্লাহর নিষিদ্ধ হারামকে আজ হালাল করে দেওয়া হচ্ছে। তাই আল্লাহর খাতিরে ক্রোধান্বিত আমি যালেম শাসকচক্রের বিরুদ্ধে বের হ’তে বাধ্য হয়েছি। তবে আমি আপনার মতামতও জানা ভাল মনে করেছি। এখন আমার মতের সাথে আপনার মত মিলে যাওয়ায় সিদ্ধান্ত আরও পাকাপোক্ত হ’ল। আম্মাজান, আপনি আজ থেকেই জানবেন যে, আপনার ছেলে নিহত। তাতে আপনার মনোকষ্ট লাঘব হবে, আর বিষয়টা আপনি আল্লাহর হাতে অর্পণ করবেন। আপনার ছেলে ইচ্ছা করে কোন অন্যায় করেনি এবং কোন অশ্লীল কাজে অংশ নেয়নি। আল্লাহর হুকুম পালনে সে যোর-যবরদস্তি করেনি এবং সন্ধি-নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গাদ্দারী করেনি। ইচ্ছাপূর্বক সে কোন মুসলিম কিংবা চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের উপর যুলুম করেনি। আমার কোন কর্মচারী যুলুমের সংবাদ আমার কানে পৌঁছে থাকলে আমি তাতে সন্তোষ প্রকাশ করিনি বরং নাখোশ হয়েছি এবং তাকে নিষেধ করেছি। আমার রবের সন্তুষ্টি অর্জনের তুলনায় আমার কাছে কোন কিছুই অগ্রগণ্য নয়। ইয়া আল্লাহ! আমি এসব কথা নিজের ছাফাই গাওয়ার উদ্দেশ্যে বলছি না; তুমি আমার বিষয়ে আমার থেকেও বেশী জান। কিন্তু কথাগুলো আমি বলছি, আমার মাকে সমবেদনা জানানোর জন্য; তিনি আমার পক্ষ হ’তে সান্ত্বনা মানবেন।

তার মা তখন তাকে বললেন, যদি তুমি আমার আগে চলে যাও তবে আল্লাহর হুযূরে আমি তাতেই সমবেদনা মানব; আর যদি আমি তোমার আগে যাই তাহ’লে আমার মনের কথা মনেই রইল। তুমি বেরিয়ে পড়। আমি তোমার শেষ পরিণতি দেখতে চাই। ছেলে বললেন, মা আমার, আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন। এখন থেকে আমার মৃত্যুর আগে বা পরে কখনই আমার জন্য দো‘আ করা বাদ দিবেন না। মা বললেন, আমি কখনই তা বাদ দিব না। কতজন তো বাতিল পথে নিহত হয়, আর সেখানে তুমি হকের পথে নিহত হচ্ছ। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, হে আল্লাহ! দিঘল রাতে এই লম্বা সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকার প্রতি তুমি করুণা করো। তুমি করুণা করো মক্কা ও মদীনার উত্তপ্ত বালিরাশিতে সেই বিলাপ ও তৃষ্ণার প্রতি। তুমি তার পিতা ও আমার সৌজন্যে তার প্রতি সদাচরণ করো। হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে তাকে সমর্পণ করছি, তোমার ফায়ছালায় সন্তোষ প্রকাশ করছি। সুতরাং আব্দুল্লাহর বিষয়ে তুমি আমাকে ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞদের ন্যায় প্রতিদান দিও।[20]

বর্বর ও নিষ্ঠুর হাজ্জাজ বাহিনী যখন আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ)-এর ছেলে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ)-এর লাশ শুলিবিদ্ধ করে রেখেছিল তখন আব্দুল্লাহ বিন ওমর বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) তার সাথে দেখা করেন এবং এ কথা সান্ত্বনা স্বরূপ বলেন, এ দেহ তো কোন কিছু নয়, তার রূহ তো এখন আল্লাহর হুযূরে উপস্থিত। সুতরাং আপনি আল্লাহকে ভয় করুন এবং ধৈর্যধারণ করুন। তিনি তা শুনে বলেছিলেন, যেখানে আল্লাহর নবী ইয়াহইয়া বিন যাকারিয়া (আঃ)-এর মাথা কেটে বনু ইসরাঈলের এক গণিকাকে উপহার দেওয়া হয়েছিল সেখানে আমার ছেলেকে শুলিবিদ্ধ করায় ধৈর্য ধরতে আমার বাধা কোথায়?[21]

হাকেম মুছ‘আব বিন আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ)-এর বরাতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ) তার পুত্র আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ)-এর নিহত হওয়ার কয়েক রাত পর মারা যান। তার হত্যাকান্ড ঘটেছিল ৭৩ হিজরীর জুমাদাল উলা মাসের ১৭ তারিখ মঙ্গলবার।[22] আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ) ছিলেন মুহাজির রমণীদের মধ্যে মৃত্যুবরণকারী সর্বশেষ মহিলা।[23] [ক্রমশঃ]

-মূল (আরবী) : ইউসুফ বিন যাবনুল্লাহ আল-আতির

-অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক


[1]. ছফীউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রহীকুল মাখতূম, পৃঃ ৪১।

[2]. আব্দুর রহমান পাশা, ছুয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবিয়াত, পৃঃ ১/৩৮।

[3]. ছুয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবিয়াত, পৃঃ ১/৩৩।

[4]. বুখারী হা/৩১২৯।

[5]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮/৩৫২।

[6]. সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৪৮৭।

[7]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২/২৯৬।

[8]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮/৩৫২।

[9]. তাফসীরে তাবারী ২৫/৬১০।

[10]. বুখারী হা/৫৪৬৯।

[11]. মুসলিম, হা/২১৪৬।

[12]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৩/৩৬৪-৬৫।

[13]. ফারসাখ বর্তমান কিলোমিটার অনুসারে চার থেকে ছয় কিলোমিটার দূরত্বের পথ।

[14]. বুখারী হা/৫২২৪; মুসলিম হা/৫৫৮৫।

[15]. ইবনু সা‘দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা ৮/১৯৭।

[16]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২/২৯২।

[17]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১১/২০৪।

[18]. হিলইয়াতুল আওলিয়া ২/৫৫।

[19]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৩/৩৬৭; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১১/১৯১; আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের পৃঃ ১২।

[20]. তারীখুত তাবারী ৬/১৮৮-১৮৯।

[21]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮/৩৫২।

[22]. হাকেম, আল-মুস্তাদরাক ৪/৭২।

[23]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২/২৯৬।






বিজ্ঞান ও ধর্মের কি একে অপরকে প্রয়োজন? - প্রকৌশলী মুহাম্মাদ আরীফুল ইসলাম - টাঙ্গাইল
জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের আবশ্যকতা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
পবিত্রতা অর্জন সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
মরণ বাঁধ ফারাক্কা
আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর পাঁচ দফা মূলনীতি : একটি বিশ্লেষণ (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
বাজারের আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ওয়াহ্হাবী আন্দোলন : উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ এবং মুসলিম বিশ্বে এর প্রভাব (৩য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
পাপ বর্জনের শিষ্টাচার সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ভুল সংশোধনে নববী পদ্ধতি (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
মানব জাতির সাফল্য লাভের উপায় (৮ম কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
ইয়াতীম প্রতিপালন (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
শবেবরাত - আত-তাহরীক ডেস্ক
আরও
আরও
.