মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (৫ম কিস্তি)

পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ ।

ইমাম মালেক বিন আনাস (রহঃ)-এর মা

ইমাম মালেক বিন আনাস (রহঃ)-এর মায়ের নাম আলেয়া বিনতে শুরাইক। তার পিতার নাম শুরাইক বিন আব্দুর রহমান বিন শুরাইক। তিনি বনু আযদ গোত্রের মানুষ ছিলেন।

ইলমের ওযন বুঝা, আলেমদের মর্যাদা অনুধাবন করা, তাদের মান-ইয্যত কতখানি দেওয়া যরূরী, একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে ইলম অন্বেষণের জন্য কতটা আদব-আখলাক থাকা অত্যাবশ্যক ইত্যাদির জ্ঞানে ইমাম মালেকের মাকে প্রবাদ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। তার চেয়েও বড় কথা, ইলম কার থেকে শেখা যাবে এবং কার থেকে শেখা যাবে না; কোন ইলমের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশী, যাকে অন্য বিদ্যার উপর প্রাধান্য দিতে হবে এবং অগ্রগণ্য ভাবতে হবে সে বিষয়ে তার সুস্পষ্ট ধারণা ছিল।

ইমাম মালেক (রহঃ)-এর ইলম শেখার প্রতি যে অত্যুচ্চ আগ্রহ ছিল এবং যেসব আলেম থেকে তিনি ধৈর্য সহকারে ইলম অর্জন করেছিলেন, তার সবকিছুর পিছনে ছিলেন তার মা। তিনি কাদের নিকট থেকে ইলম শিখবেন তা তার মা-ই নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তার মায়ের নির্বাচিত আলেমগণই কেবল তাকে ইলম শিখিয়েছেন, তারাই তার মধ্যে ইলমের শিখা জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন এবং জ্ঞানের সঠিক ধারা তাদের থেকেই তিনি লাভ করেছিলেন।

ইলম অর্জন সম্পর্কিত মায়ের নছীহত প্রসঙ্গে ইমাম মালেক (রহঃ) নিজে বর্ণনা করেছেন যে, আমার মা আমার মাথায় পাগড়ি পরিয়ে দিয়ে বলছিলেন, তুমি রবী‘আর কাছে যাবে এবং ইলম শেখার আগে তার থেকে আদব-আখলাক শিখবে।[1] এই ছোট্ট বাক্যটির মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের নিকট অনেক প্রজ্ঞার কথা তুলে ধরেছেন এবং আমাদেরকে অনেক দামী দামী মুক্তা উপহার দিয়েছেন।

প্রথমতঃ ছোট্ট বয়সে মা তাকে ইলম শিখতে পাঠান। সে সময় ইলম শেখার ভালো ভালো জায়গা ছিল। বুদ্ধিমতী ধী-শক্তির অধিকারী মা নবীদের ওয়ারিছ বানানোর ময়দানে ছেলেকে দেওয়ার মনস্থ করেছিলেন। এতে তিনি যে ইলমের মাহাত্ম্য এবং বিদ্বানদের কদর ভালভাবেই জানতেন, তা বুঝা যায়।

দ্বিতীয়তঃ তিনি তাকে ইলম শিখতে যখন পাঠাচ্ছেন তখন যে কোন ইলম শিখতে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে বরং শ্রেষ্ঠ, উত্তম ও সবচেয়ে মাহাত্ম্যপূর্ণ যে ইলম তাই শেখার জন্য ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন। সেকালে কুরআন ও হাদীছ ভিত্তিক ফিক্বহকে সবচেয়ে দামী ইলম গণ্য করা হ’ত। শরী‘আর মগয ও সার হচ্ছে ফিক্বহ শাস্ত্র। তার মায়ের যে সূক্ষ্ম বোধশক্তি ও সুন্দর উপলব্ধি ক্ষমতা ছিল রবী‘আতুর রায়ের কাছে ফিক্বহ শেখার জন্য ছেলেকে পাঠানোর মাঝে তার বিশেষ প্রমাণ মেলে।

তৃতীয়তঃ তৎকালীন সময়ে বহু ফক্বীহ ছিলেন। তাদের মধ্যে যিনি এ শাস্ত্রে নামকরা, খ্যাতিমান ও উঁচু স্তরের অধিকারী সেই রবী‘আকে তিনি ছেলের জন্য মনোনীত করেছিলেন, যিনি মদীনার মুফতী, যুগশ্রেষ্ঠ বিদ্বান ও ইমাম পদে বরিত ছিলেন।[2]

ইলম শিখতে যাওয়ার মুহূর্তে ইমাম মালেকের মা ছেলের যে সাজগোজ করে দিতেন ইমাম মালেকের পরবর্তী জীবনেও তার প্রভাব থেকে গিয়েছিল। মা যেমন চাইতেন ছেলে তেমনটাই করতেন। ওযূ-গোসল, পোষাক-পরিচ্ছদ, কেশ বিন্যাস, সুগন্ধি ব্যবহার ইত্যাদি বাহ্যিক বেশ-ভূষায় পরিপাটি হয়ে তিনি শিক্ষকের দরসে হাযির হ’তেন। এতে তার মায়ের সযত্ন ছেঁায়া থাকত। এই পরিপাটি বেশ-ভূষা শিক্ষক, সহপাঠী ও সাধারণ মানুষের প্রথম নযর কাড়ে। তাই শিক্ষক তাকে দেখে সহাস্য বদনে স্বাগত জানাতেন, সাথী-সহপাঠীরা তঁার পাশে বসতে স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করতেন। শৈশব থেকেই লোকেরা তার মধ্যে বিদ্যা ও বিদ্বানদের প্রতি খুব আকর্ষণ লক্ষ্য করতেন। ফলে তাদের অন্তরে তিনি জায়গা করে নিয়েছিলেন, তার প্রশংসায় তারা ছিল পঞ্চমুখ। এসব কিছুই তার মধ্যে ইলম অর্জনে প্রেরণা যোগাত, তাকে বিদ্যা অর্জনে আরও উৎসাহিত করত এবং তার হিম্মত অনেক উঁচুতে উঠে যেত। মা প্রতিনিয়ত তাকে পাগড়ি পরিয়ে দিতেন, সবচেয়ে যে পোষাকটা উত্তম সেটা পরিয়ে দিতেন। বলাবাহুল্য তার আগে তিনি তার ওযূ-গোসল করিয়ে সুগন্ধি মাখিয়ে দরসে যাওয়ার জন্য প্রস্ত্তত করে দিতেন।

এই পরিপাটির অভ্যাস ইমাম মালেক (রহঃ)-এর আজীবন বহাল ছিল। তাই যখনই তিনি লোকেদের সামনে হাদীছ বর্ণনার জন্য বের হ’তেন তখনই ছালাতের ন্যায় ওযূ করতেন, সুন্দর পোষাক পরতেন, টুপি পরতেন, চুল-দাড়ি চিরুনি করতেন। কেউ একজন তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, এর দ্বারা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছের প্রতি সম্মান জানাই।[3]

অন্য এক বর্ণনাকারী তার হাল বর্ণনায় বলেছেন, মালেক বিন আনাস যখন হাদীছ বর্ণনার জন্য বসতে চাইতেন তখন প্রথমে গোসল করতেন, সুগন্ধি মাখতেন, তারপর হাদীছের দরস শুরু করতেন। কেউ যদি তার দরসে উচ্চকণ্ঠ হ’ত তিনি তাকে ধমক লাগাতেন।[4]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছ হিসাবে ইমাম মালেক এই ইলমের সম্মান প্রদান ও সংরক্ষণের দায়িত্ব আজীবন উত্তরাধিকার হিসাবে বয়ে গিয়েছেন। কুরআনুল কারীমের পর তো এই হাদীছই শ্রেষ্ঠ ইলম। এই সম্মানের দিক চেয়েই তিনি তার উস্তাদদের থেকে হাদীছ লেখার সময় কখনই দঁাড়িয়ে লিখতেন না। আবার অন্যদেরও হাদীছ শুনানোর সময় দঁাড়িয়ে শুনাতেন না। মার্জিতভাবে বসে গাম্ভীর্যের সাথে তা শুনতেন ও বলতেন।

তাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি কি আমর বিন দীনার থেকে হাদীছ শুনেছেন? উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, আমি তাকে দেখেছি, তিনি হাদীছ বর্ণনা করছেন আর লোকেরা দঁাড়িয়ে দঁাড়িয়ে তা লিখছে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছ আমি দঁাড়িয়ে লিখব, সেটা আমার রুচিতে আসেনি।[5]

সেই শৈশবে ইলম শিক্ষার উদ্দেশ্যে বের হ’তে ইমাম মালেকের মা ছেলের জন্য যে নিয়ম নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন বড় হয়েও তার কোন হেরফের তিনি করেননি। মুতাররিফ বলেন, ইমাম মালেক বলছিলেন, ‘আমি আমার মাকে বললাম, আমি ইলম শিখতে যেতে চাই’। মা বললেন, ‘এস, তোমাকে বিদ্যা শেখার পোষাক পরিয়ে দেই’। তিনি আমার গায়ে হাতা গুটিয়ে জামা পরিয়ে দিলেন, মাথায় একটা লম্বা টুপি পরিয়ে তার উপর পাগড়ি জড়িয়ে দিলেন। তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে, এখন ইলম অর্জনে যাও’।

ওহে আজকের মুহাম্মাদ, আনাস, মু‘আয, আলী, রেযওয়ান, যায়েদ, আহমাদ প্রমুখের মা উপরের বর্ণনা থেকে কিছু শিক্ষা পেয়েছেন কি?

ইমাম মালেকের মায়ের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। তিনি প্রজন্ম পরম্পরায় মায়েদের জন্য তাদের সন্তানদের কিভাবে যথাযথ মানুষ করে গড়ে তোলা যায় সে বিষয়ে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রেখে গেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান প্রজন্মের মায়েদের কাছে কি সে শিক্ষা পৌঁছেছে? পৌঁছলে তারা জানতে পারতেন, মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শিশুকাল। এটি তাদের উপলব্ধিতে এলে তারা ইমাম মালেকের মায়ের মতই আমল করতেন। শিশুকালই তো মায়েদের হাতে সন্তানদের গড়ে তোলার কাল। আজকের মায়েরা, আপনারা কি লক্ষ্য করেছেন যে, আপনারা সন্তানদের যেভাবে পালন করবেন তারা সেভাবেই বড় হবে? আপনাদের ছোটরা আপনাদের দেখানো পথেই যুবক হয়ে বেড়ে উঠবে?

ইমাম মালেক কে? উম্মতের মাঝে তার মার্যাদাই বা কি? উম্মতে মুহাম্মাদীর তিনি কি পরিমাণ উপকার করে গেছেন? যুগ যুগ ধরে তার মাযহাবের অনুসারীর সংখ্যাই বা কত? এসব প্রশ্নের উত্তর কি কারও অজানা থাকতে পারে? তার নানামুখী অবদান থেকে আশা করা যায় যে, ক্বিয়ামত দিবসে হাশরের ময়দানে যারা অধিক ছওয়াব নিয়ে উঠবেন তাদের কাতারে তিনি শামিল থাকবেন। যেহেতু তার এ অবদানের পিছনে তার মাতাপিতার অসামান্য ভূমিকা ছিল তাই তাদের ওযনের পাল্লাতেও সমান ছওয়াব যোগ হবে ইনশাআল্লাহ্।

এত বড় ও ব্যাপক ছওয়াব লাভের বিষয়ে এখনকার মুসলিম মায়েদের কঠিন উদাসীনতা ও নির্লিপ্ততা বড়ই বেদনাদায়ক। আজকের মায়েরাও এক বা একাধিক ছেলে-মেয়ের মা হওয়ার ফলে ইমাম মালেকের মায়ের অবস্থান লাভের সুযোগ পেতে পারেন, যদি কি-না তারা তার মত করে নিজেদের সন্তানদের পালন করেন। (‘এস, তোমাকে ইলম শেখার পোষাক পরিয়ে দেই’) দৃঢ় প্রত্যয়ের এ উচ্চারণ ছিল আলেয়া বিনতে শুরাইক আযদীু ইমাম মালেকের মহীয়সী মায়ের। ইলম কি, তার পোষাকই বা কি, এ উত্তর তার ভাল জানা ছিল। যে বা যারা তার মতো ইলমের পোষাক, সৌন্দর্য, গৌরব ও সম্মান লাভে ইচ্ছুক তার বা তাদেরও ইমাম মালেকের মায়ের ন্যায় ভূমিকা পালন কাম্য।

ইমাম মালেক কেনই বা এমন হবেন না! তার পিতা, চাচারা এবং দাদা ছিলেন মুহাদ্দিছ আলেম। তারা সবাই শ্রেষ্ঠ নবীর সুন্নাতের বাহক। তার দাদা মালেক বিন আমের ছিলেন জ্যেষ্ঠ তাবেঈদের অন্যতম। যারা নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীদের থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন তিনি তাদের একজন। এসব ছাহাবীর প্রথম সারিতে রয়েছেন ওমর, ওছমান, তালহা ও আয়েশা (রাঃ)। তার পিতা আনাসও তার দাদার মতই হাদীছ বর্ণনাকারী আলেম ছিলেন, যদিও তিনি হাদীছের ক্ষেত্রে তার সমমর্যাদার ছিলেন না। বুঝাই যাচ্ছে, গোটা পরিবারটাই ছিল শিক্ষিত এবং হাদীছে আত্মনিয়োগকৃত।[6]

ইমাম মালেক ইয়ামনের যূ-আছবাহ বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার মাও ছিলেন ইয়ামনের বনু আযদ গোত্রের মেয়ে। ফলে মাতা-পিতা উভয় দিক দিয়ে তিনি ছিলেন ইয়ামনী আরব।[7] হাদীছে আসছে, ‘প্রজ্ঞা হ’ল ইয়ামানী’।[8] তাই ইয়ামনী হিসাবে ইমাম মালেকের মা সে প্রজ্ঞার অনেকটাই পেয়েছিলেন। তার কিছুটা আমাদের আলোচনায় স্পষ্ট ফুটে উঠছে।

স্বীয় সন্তানের শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়ে ইতিপূর্বে ইমাম মালেকের মায়ের যে উক্তি আমরা উল্লেখ করেছি তা তার উক্ত প্রজ্ঞার নিদর্শন বহন করে। একজন নতুন শিক্ষার্থী যে অচিরেই শিক্ষালাভের জন্য বের হবে সে ইলমের অনেক মজলিস গুলযার করবে, পবিত্র ইলম শিখবে। তার অছিয়ত কেবল ইলম শিখতে যেতে বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এ অছিয়তের মধ্যে আদব-আখলাক, শিষ্টাচার যা বিদ্যার মজলিসে মেনে চলা আবশ্যক সেটা অর্জনও নিহিত। সুতরাং ছেলে যখন ইলম শিক্ষার পোষাক পরে নিয়েছে তখন তার কর্তব্য হবে দ্রুত ইলমের মজলিসে হাযির হওয়া। এ মজলিস থেকে দূরে থাকা বা পিছিয়ে থাকা তার জন্য মোটেও শোভনীয় হবে না। লেখাপড়া শিখতে যাওয়ার আগে গৃহ থেকে তার লক্ষ্য স্থির করবে। কোথায় যাবে, কি-ই বা অর্জন করবে তা তাকে জানতে বুঝতে হবে। এসব কিছু ইমাম মালেকের মায়ের কথার মধ্যে সূর্যালোকের মত দেদীপ্যমান। এসব জানা থাকলে শিক্ষার্থী যখন তার শিক্ষকের পাঠে বসবে তখন সে অনর্থক কোন কাজে মশগূল হবে না। এই ফায়দার কথা ভেবেই ইমাম মালেকের মা ছেলেকে বলেছিলেন, ‘তুমি রবী‘আর কাছে যাবে এবং ইলম শেখার আগে তার থেকে আদব-আখলাক শিখবে’। তিনি তার ছেলের জীবনের লক্ষ্য হিসাবে দু’টি বিষয় চেয়েছেন। এক. ইলম শিক্ষা। দুই. আদব শিক্ষা।

সুতরাং শিক্ষার্থী মাত্রই এ দু’টি বিষয়ের প্রতি পূর্ণ মাত্রায় আগ্রহ রাখবে। যা কিছু শিখবে তার জন্য আবার যা যা প্রয়োজন তাও তাকে শিখতে হবে। যেমন সকাল সকাল ওঠা, শিক্ষকের কাছাকাছি বসা, মন অন্য সবদিক থেকে মুক্ত রাখা, পড়ার সময় নীরবতা পালন করা, শিক্ষকের কথা মনোযোগ দিয়ে হুঁশিয়ার হয়ে শোনা, শিক্ষক থেকে তার দেয় ইলম, জ্ঞান-বুদ্ধি ও আদব-আখলাক রেকর্ড করা, তার মুখের বক্তব্য ও আলোচনা পান্ডুলিপি আকারে লিপিবদ্ধ করা ইত্যাদি। লক্ষ্য দু’টি ছেড়ে কোন কারণেই সে আর কোন কিছুতে লিপ্ত হবে না। ইলম ও আদব শিখতে এ ধরনের আর যা যা প্রয়োজন সবকিছুর প্রতি সে খেয়াল রাখবে।

একই সাথে তিনি ছেলেকে এ বিষয়েও সতর্ক করেছিলেন যে, ইলম ও আদব শিক্ষা লক্ষ্য হ’লেও দু’টি কিন্তু সমান নয়। একটি অন্যটি থেকে অগ্রণী, তার থেকে বেশী মর্যাদাময় এবং মহত্বের অধিকারী। সন্দেহ নেই যে, সেটি আদব বা শিষ্টাচার। এই আদব অর্জনই বিদ্যা লাভের কাম্য ফল এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য। ইমাম মালেকের জন্য যখন এ লক্ষ্য নির্ধারণ করা হ’ল, তখন সিদ্ধান্ত হয়ে গেল তিনি তার শিক্ষকের বক্তব্য ও আলোচনা থেকে ভাষা ভিত্তিক বিদ্যা যখন শিখবেন তখন তিনি ভাষিক ইলম অর্জনের উপর যতটা জোর দিবেন তার থেকেও বেশী জোর দিবেন শায়খের আদব-শিষ্টাচার আয়ত্ব করার উপর। এ আদব তিনি শিখবেন শিক্ষকের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি এবং শিক্ষার্থীকে শিক্ষক কিভাবে গড়ে তুলতে চান তা জানা-বুঝার মাধ্যমে। আদব অর্জনের জন্যই তো বিদ্যা। এ দু’টি ছাড়াও ইমাম মালেকের মায়ের অছিয়তে অনেক ফায়দার কথা রয়েছে। কান পেতে শোনা ও অন্তরে গেঁথে রাখার যোগ্যতাধারী যে কোন চিন্তাশীল ব্যক্তির নিকট তা অবিদিত নয়।

সন্তানদের অছিয়ত-উপদেশ যেন মুমিন মায়ের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকে তার প্রতি মায়েদের লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। জীবনপথে তারা কিভাবে চলবে সে বিষয়ে তারা সন্তানদের প্রেরণা যোগাবেন। এজন্য প্রস্ত্ততি হিসাবে তারা শিখনযোগ্য ইলমের পরিচয় ও নানাদিক তুলে ধরবেন, আয়ত্ব করবার পরিকল্পনা জানাবেন এবং এক্ষেত্রে বিশেষে যেসব তথ্য তাদের জানা আছে তা সরবরাহ করে তাদের সহযোগিতা করবেন। সেই সঙ্গে সন্তান যাতে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে সেজন্য আল্লাহর সাহায্য তো হরহামেশাই চাইবেন। যে মা সন্তানের মাধ্যমে ভবিষ্যতে উল্লেখযোগ্য কিছু হ’তে চান এবং আগামী দিনে জান্নাতের অধিকারী হয়ে আল্লাহর দেওয়া চিরস্থায়ী নে‘মত ভোগ করতে চান, তার জন্য সন্তানকে নিয়ে এমন পরিকল্পনা অবশ্যই করতে হবে। তবেই তিনি তার সন্তান ও পরিবারের প্রতি তার প্রভুর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন বলে বিবেচিত হবে।

শিক্ষার্থী থাকাকালে ইমাম মালেককে অনেক সংকট মোকাবেলা করতে হয়েছে। তার লক্ষ্যের সামনে অনেক প্রতিবন্ধকতা এসে দঁাড়িয়েছিল। অভাব-অভিযোগ, আর্থিক সংকটে তাকে জর্জরিত হ’তে হয়েছিল। কিন্তু এই সংকটময় অবস্থায় কি ইমাম মালেকের মা তার লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে গিয়েছিলেন? কখনই না। তিনি ছেলে মালেককে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করে গেছেন। এজন্য তিনি তার বাসগৃহের কড়িকাঠ পর্যন্ত বেচতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকেছিলেন এবং তা বাস্তবে রূপায়িত করে ছেড়েছিলেন।

ইবনুল কাসেম বলেন, ইলম অন্বেষণের আগ্রহ ইমাম মালেককে এতদূর পেয়ে বসেছিল যে তিনি এ কাজে ব্যয় নির্বাহের জন্য তার ঘরের ছাদ ভেঙে ফেলে তার কাঠ বেঁচে দিয়েছিলেন।[9] এ সময়ে ইমাম মালেক ইলম অন্বেষণে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ইলমের মজলিসগুলোতে দিন-রাত তিনি উপস্থিত থাকতেন। কখনও তিনি আব্দুর রহমান ইবনু হারমুযের পাঠে উপস্থিত আছেন তো পরে ইবনু ওমরের আযাদকৃত গোলাম নাফে‘-এর দরসে আছেন। রবী‘আর দরসে দেখা গেল তো পরে ইবনু শিহাব যুহরীর পাঠে হাযির।

ইবনু হারমুযের দরসে তিনি এক নাগাড়ে সাত বছর শরীক থেকেছেন। তার নির্দেশনা ও পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। তার থেকে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে লোকেদের মতানৈক্য ও প্রবৃত্তির অনুসারী বাতিলপন্থীদের জবাব কিভাবে দিতে হবে সে ইলম আয়ত্ব করেন।

শিক্ষকের বাড়িতে তার যাতায়াত ছিল অনেক বেশী। একদিন তিনি শিক্ষকের দরজায় কড়া নাড়লে তিনি তার দাসীকে বলেন, দেখ তো কে? সে মালেক ছাড়া আর কাঊকে দেখতে পেল না। তখন সে ফিরে গিয়ে বলল, ওখানে সেই লালচে ফর্সা বর্ণের ছেলেটা ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি বললেন, তাকে ডাক, সে জনগণের আলেম। ইবনু হারমুযের গৃহদ্বারে পাথরের উষ্ণতা ও ঠান্ডা থেকে নিজেকে রক্ষার্থে ইমাম মালেক কুশন জাতীয় একটা আসন বানিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি নিজে বলেছেন, ‘আমি সকাল সকাল ইবনু হরমুযের বাড়িতে হাযির হ’তাম এবং রাত না হওয়া পর্যন্ত তার বাড়ি থেকে বের হ’তাম না’।[10]

তিনি ইবনু ওমরের আযাদকৃত গোলাম নাফে‘-এর দরসে নিয়মিত হাযির থাকতেন। দুপুরের দিকে তিনি তার নিকট যেতেন। যে সময় সূর্যালোক থেকে বাঁচতে গাছের ছায়া মিলত না তখন নাফে‘র কাছে বের হওয়ার জন্য তার সময় নির্ধারিত ছিল। নাফে‘র কাছে গেলে তিনি কিছু সময় এমনভাবে ক্ষেপণ করতেন যেন তাকে তিনি দেখতে পাননি। তারপর তার সাথে সালাম বিনিময় করতেন। পড়া শুরু হ’লে মালেক তাকে বলতেন, ‘অমুক অমুক ক্ষেত্রে ইবনু ওমর (রাঃ) কিভাবে কি বলেছেন? নাফে‘ তার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতেন। এ পরিমাণ প্রশ্নের পর মালেক থেমে যেতেন। নাফে‘র মধ্যে ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা। মালেক তার শিক্ষকের স্মৃতির উপর প্রভাব না খাটিয়ে এভাবে কৌশল করে তার থেকে ইলম শিখতেন।[11]

তিনি রবী‘আর দরসে সর্বদা যোগ দিতেন, যেমন যুহরীর দরসে যোগ দিতেন। যুহরীর কাছে তার সার্বক্ষণিক অবস্থানের জন্য যুহরীর কাছের মানুষগুলো তাকে তার দাসই ভাবতেন।

ইমাম মালেক বর্ণনা করেছেন, আমি ঈদের ছালাতে হাযির ছিলাম। ছালাত শেষে আমার মনে হ’ল, আজ এমন দিন যে, ইবনু শিহাব এ দিনে নিরিবিলি আছেন। আমি ঈদগাহ থেকে ফিরে সোজা তার বাড়ির দরজায় গিয়ে বসে পড়লাম। আমি শুনতে পেলাম, তিনি তার দাসীকে বলছেন, দেখ তো দরজায় কে? সে দেখে গেল। ভিতর থেকে আমি তাকে বলতে শুনলাম, ‘আপনার সেই লালচে ফর্সা দাস মালেক এসেছে’। তিনি বললেন, তাকে ভিতরে আসতে দাও। আমি ভিতরে ঢুকলে তিনি আমাকে বললেন, কি ব্যাপার, তুমি এখনও বাড়ি ফেরনি! আমি বললাম, না। তিনি বললেন, কিছু খেয়েছ কি? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তাহ’লে খেয়ে নাও। আমি বললাম, আমার খাবার দরকার নেই। তিনি বললেন, তাহ’লে কেন এসেছ? আমি বললাম, আমাকে আপনি হাদীছ বর্ণনা করুন। তিনি বললেন, প্রস্ত্তত হও। আমি আমার খাতাপত্র নিয়ে রেডি হ’লাম। তিনি আমাকে চল্লিশটি হাদীছ বর্ণনা করে শুনালেন। আমি বললাম, আমাকে আরও বলুন। তিনি বললেন, যদি তুমি এই চল্লিশটা হাদীছ এখনই বর্ণনা করতে পার তবে তুমি হাফেযদের মধ্যে গণ্য হবে। আমি বললাম, আমি এগুলো বর্ণনা করছি। এ কথা শুনে তিনি খাতাটা আমার কাছ থেকে টেনে নিলেন। তারপর বললেন, এবার বর্ণনা শুরু কর। আমি তাকে সবগুলো হাদীছ বলে শুনালাম। তিনি খাতা ফেরত দিয়ে আমাকে বললেন, ‘ওঠ, তুমি তো ইলমের ভান্ডার বনে গেছ’।[12]

এই মহীয়সী মায়ের পক্ষে সম্ভব ছিল তার ছেলের লেখাপড়া আপাতত বন্ধ রাখা। ছেলে এক্ষেত্রে সাধ্যের অতিরিক্ত পরিশ্রম করে চলেছিল। আবার চাইলে অল্প সময়ের জন্য পড়ায় তিনি সাময়িক ছেদও টানতে পারতেন। তাতে ঐ সময়ের মধ্যে কাজ বন্ধ রেখে ছেলে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারে। পরে পুরো উদ্যমে লক্ষ্য পানে এগিয়ে যেতে পারে এবং লক্ষ্য পূরণে সক্ষম হয়। কিন্তু তিনি তার কিছুই করেননি। অথচ পরিস্থিতির এতদূর অবনতি ঘটেছিল যে, ঘরের চাল, বেড়া, খুঁটি ইত্যাদি বিক্রি করে পড়ার খরচ চালাতে হয়েছিল।

তিনি তার ছেলেকে লোকেদের থেকে প্রাপ্য ইলম পুরোটাই আয়ত্ব করার জন্য পুরোপুরি দায়িত্বমুক্ত ও অবসর দিয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে তিনি হাদীছ ও ফিক্বহের ইলমের বিশাল ভান্ডার আয়ত্ব করতে পেরেছিলেন এবং ইমামতের আসনে আসীন হয়েছিলেন। দুনিয়ার আনাচ-কানাচ সব স্থান থেকে মানুষ সওয়ারী হঁাকিয়ে তার দরবারে ইলম শিখতে এসেছে। তার সংগৃহীত ইলমের কিছুটা অর্জনে তাদের কতই না আকাঙ্ক্ষা ছিল!

ওমর বিন খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর পর ইলমের জগতে ইমাম হয়েছিলেন যায়েদ বিন ছাবিত (রাঃ)। তারপরে এ পদে বরিত হয়েছিলেন আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ)। যায়েদ বিন ছাবিত (রাঃ) থেকে একুশ জন আলেম ইলম শিখেছিলেন। তারপর তাদের সকলের ইলম তিনজনের মধ্যে জমা হয়েছিল। তারা হ’লেন ইবনু শিহাব যুহরী, বুকায়ের বিন আব্দুল্লাহ ও আবুযযিনাদ (রাঃ)। পরে এ তিনজনের পুরো বিদ্যা ইমাম মালেকের মাঝে সঞ্চিত হয়।[13]

প্রিয় পাঠক! আপনার জানা থাকা দরকার যে, ইমাম মালেক হাদীছ ও হাদীছ থেকে উদ্ভাবিত ফিক্বহের সারৎসার নিজের লক্ষ্য অনুযায়ী ভালমতো আয়ত্ব করেছিলেন। তারপর তার শিক্ষকদের অনুমতিক্রমে তিনি মসজিদে নববীতে ফৎওয়া দানের আসনে বসেন। এ সময় তার বয়স ছিল মাত্র সতের বছর। এ সম্পর্কে তিনি নিজে বলেছেন, ‘মসজিদে নববীতে যে কেউ চাইলেই হাদীছ বর্ণনা ও ফৎওয়া প্রদানের আসনে বসতে পারতেন না। তাকে এজন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ের জ্ঞানী-গুণী, যোগ্য ও নিষ্ঠাবানদের পরামর্শ ও অনুমতি নিতে হ’ত। তারা যদি তাকে এ কাজের যোগ্য বলে সিদ্ধান্ত দিতেন তাহ’লেই কেবল তিনি বসতে পারতেন। আর আমি এ আসনে কেবল তখনই বসেছি, যখন সত্তর জন শিক্ষক আমাকে এ পদের যোগ্য বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন’।[14]

বিস্ময়ে বিমূঢ় হ’তে হয় যে, প্রথম জীবনে ইমাম মালেক ইলম শেখায় আগ্রহী ছিলেন না। বরং ইলম আহরণ থেকে যতটা দূরে থাকা যায় তিনি ততটাই দূরে থাকতেন। সে সময় একজন গায়ক হওয়া ছিল তার মনোবাসনা। ধন্যবাদ দিতে হয় সেই মাকে, যিনি ছেলেকে বিচ্যুতি ও গানের পথ থেকে ইলম ও জ্ঞানের পথে ফিরিয়ে এনেছিলেন। এ সম্পর্কে তিনি নিজে বলেছেন, ‘আমি তখন ছোট্ট বালক। গায়কদের গান আমার খুব ভাল লাগত। তাদের থেকে আমি গান শিখতে চাইতাম। কিন্তু আমার মা আমাকে একদিন বললেন, প্রিয় পুত্র আমার! গায়ক কুৎসিত বদ শেকেল হ’লে তার গানের দিকে ফিরেও তাকানো হয় না। তুমি গান-বাদ্য ছেড়ে দাও এবং ফিক্বহ শেখ। মায়ের কথা মতো আমি গায়কদের ত্যাগ করলাম এবং ফক্বীহদের অনুসরণ শুরু করলাম। তারপর আল্লাহ তা‘আলা আমাকে কতদূর পৌঁছিয়েছেন তা তো তুমি দেখতেই পাচ্ছ’।[15]

এই মহীয়সী মা তার ছেলেকে মিথ্যা বলেননি। তিনি তাকে কুৎসিত বদ শেকেলের কথা বলেছিলেন। কিন্তু ইমাম মালেক তেমন ছিলেন না। তিনি ছিলেন বরং খুবই সুদর্শন লালচে ফর্সা। (লালচে ফর্সাকে বাংলায় গোলাপী রঙও বলা হয়।) তিনি আসলে এ কথা বলে ছেলের আগ্রহ ও ঝোঁক গানের থেকে সরিয়ে দিতে চাইছিলেন। তাই তিনি হিসাব করে ছেলেকে কথাটি বলেছিলেন।[16]

ছোটকালে লেখাপড়া না করে কবুতর পালন ও তা নিয়ে খেলাধূলায়ও তিনি মত্ত থাকতেন। কিন্তু একটা কথা তার কানে খুব লাগে এবং তার মনে ক্ষোভের উদয় হয়। তিনি সব ছেড়েছুড়ে প্রথমে আলেমদের এবং পরে ফক্বীহদের সভায় গিয়ে ইলম শেখা আরম্ভ করেন।

এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ইবনু শিহাবের সমবয়স্ক আমার একটি ভাই ছিল। একদিন আমার পিতা আমাদের দু’জনকে একটি মাসআলা জিজ্ঞেস করলেন। আমার ভাই সঠিক উত্তর দিল, কিন্তু আমি ভুল করলাম। তখন আমার পিতা আমাকে বললেন, ‘এই কবুতরবাজিই তোমার লেখাপড়ার মুন্ডুপাত করেছে’! এ কথায় আমার মনে খুব রাগ হয়। আমি সব ত্যাগ করে ইবনু হারমুযের দরসে সাত/আট বছর এক নাগাড়ে সময় দেই। তার সাথে ছাড়া অন্য কারও সাথে আমি মিশতাম না। আমার জামার হাতায় আমি কিছু খেজুর নিয়ে যেতাম। সেগুলো শিশুদের হাতে দিয়ে তাদের বলতাম, কেউ তোমাদেরকে শায়খ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলবে, শায়খ এখন ব্যস্ত আছেন।[17]

এভাবে কৌশল খাটিয়ে তিনি শায়খের সময়ের সিংহভাগ যথাসম্ভব নিজের দখলে রাখতেন। এটি বিদ্যা অন্বেষণে তার সবিশেষ আগ্রহই তুলে ধরে। শুধু তাই নয়, বরং পড়া শেষে তিনি গাছের ছায়াতলে গিয়ে বসতেন এবং যা পড়েছেন তা পুনরাবৃত্তি করতেন এবং মুখস্থ করতেন। এরূপ আচরণ তার নিয়মে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। একদিন তার বোন তাকে এ অবস্থায় দেখে পিতার নিকট গিয়ে তা বলে। তিন বললেন, বেটি আমার! এভাবে সে আল্লাহর রাসূলের হাদীছ মুখস্থ করে।[18] এটাই ছিল বরাবরের মতো তার অভ্যাস। এটা করতে করতেই তিনি উচ্চ মর্যাদার আসনে পৌঁছেছেন।

এভাবে ছোট্ট বালক মালেক বিন আনাসের বিদ্যার পথে যাত্রা শুরু হয়েছিল, যার শেষ দঁাড়িয়েছিল যে, তিনি মুসলমানদের একজন অনন্য ইমামে পরিণত হয়েছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন তার মায়ের দেওয়া সবচেয়ে দামী ও আক্রা উপহার। যে মা তাকে যেমন উত্তমভাবে লালনপালন করেছিলেন, তেমনি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও সহযোগিতা যুগিয়েছিলেন প্রতিনিয়ত জীবনপথে চলতে। হাদীছ ও ফিক্বহের জগতের সমকালীন ও পরবর্তীকালীন উজ্জ্বল নক্ষত্রগণ তার যোগ্যতার স্বীকৃতি পঞ্চমুখে প্রদান করেছেন।

সুফিয়ান বিন উয়ায়না বলেন, কোথায় আমরা, আর কোথায় মালেক! আমরা তো কেবল মালেকের পদচিহ্ন অনুসরণ করি। আমরা শায়খকে দেখি আর অপেক্ষা করি; মালেক তার থেকে লিখলে তবেই আমরা শায়খ থেকে লিখি। আমার তো মনে হয়, মালেক বিন আনাসের মৃত্যুর পর মদীনা বিরান হয়ে যাবে![19]

ইমাম শাফেঈ বলেন, যখন মালেকের বর্ণনায় তোমার কাছে কোন হাদীছ আসবে তখন তুমি তা দ্রুত গ্রহণ করবে। যখন কোন হাদীছ আসবে সেখানে মালেক হবেন নক্ষত্র। যখন আলেমদের আলোচনা উঠবে তখন মালেক হবেন তারকা। বিদ্যা মুখস্থ রাখা, দৃঢ়ভাবে ধরে রাখা ও তা হেফাযত করার ক্ষেত্রে মালেকের পর্যায়ে কেউ পৌঁছতে পারেনি। যিনি ছহীহ হাদীছ তালাশ করতে চান তাকে অবশ্যই ইমাম মালেক (রহঃ)-এর দ্বারস্থ হ’তে হবে।[20]

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল বলেন, ইমাম মালেক ছিলেন নেতৃস্থানীয় আলেমদের নেতা। তিনি হাদীছ ও ফিক্বহের ইমাম ছিলেন। মালেকের মতো আর কে আছেন! যিনি বুঝেশুনে শিষ্টতা সহকারে হাদীছের পূর্ণ অনুসরণ করে গেছেন।[21]

আমরা লক্ষ্য করলে দেখব, ইমাম মালেকের মধ্যে সেই শৈশব থেকে তার মায়ের প্রভাব বিদ্যমান। ইলমের মজলিসে ছেলেকে বসানো, ইলম ও বিদ্বান আলেমদের কদর করা, ইলম দ্বারা নিজেকে বিভূষিত করা, ইলমের খোশবুতে মাতোয়ারা হওয়ার মতো পথে মা তাকে বিশেষ প্রেরণা যুগিয়েছিলেন। এসব কারণে মহান ইমামের মধ্যে আরো অনেক মহৎ গুণের সমাবেশ ঘটেছিল। যেমন- ব্যাপক মুখস্থশক্তি, বিশাল ধৈর্য, তীক্ষ্ণ মেধা, প্রখর অন্তর্দৃষ্টি, অকৃপণভাবে মানুষকে সম্মান দান ইত্যাদি।

মহান আল্লাহ তা‘আলা ইমাম মালেক ও তার মায়ের উপর দয়া করুন এবং মুসলিম মায়েদের ও তাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে আমরা আজ যে আশা-আকাঙ্ক্ষা পোষণ করি তা পূরণে মা ও ছেলের আদর্শ অনুসরণে আমাদের তাওফীক্ব দিন।[22]

[ক্রমশঃ]

মূল (আরবী) : ইউসুফ বিন যাবনুল্লাহ আল-‘আতীর

অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

[1]. আল-মাদারিক, পৃ ১১৫।

[2]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৬/৮৯।

[3]. তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত ২/৮০।

[4]. তাযহীবু তাহযীবিল কামাল ৮/৩৫৪।

[5]. আল-মাদারিক ১/১২৩।

[6]. আব্দুল গনী আদ্দাকার, মালেক ইবনু আনাস পৃঃ ২৬-২৭, ঈষৎ পরিবর্তিত।

[7]. মালেক, হায়াতুহূ ওয়া আছারুহূ ওয়া আরাউহূ ওয়া ফিকহুহূ পৃঃ ২৭-২৮।

[8]. বুখারী হা/৪৩৮৮; মুসলিম হা/৫২।

[9]. আদ-দীবাজুল মুযাহহাব (স্বর্ণখচিত রেশম), পৃ. ৬২।

[10]. আল-মাদারিক ১/১২০; আত-তাবাকাতুল কুবরা ৫/৪৬৬।

[11]. আদ-দীবাজুল মুযাহহাব পৃ. ১১৭।

[12]. আল-মাদারিক ১/১২২।

[13]. আল-মাদারিক ১/৬৮।

[14]. আল-মাদারিক ১/১২৭।

[15]. শারহুল ‘উয়ূন পৃঃ ১৭১; শাকয়াহ, আল-আয়েম্মাতুল আরবা‘আহ, পৃঃ ৬-৭।

[16]. শাকয়াহ, আল-আয়েম্মাতুল আরবা‘আহ, পৃঃ ৭।

[17]. আল-মাদারিক ১/১২০।

[18]. তাহের মুহাম্মাদ আদ্দুরাদীরী, তাখরীজু আহাদীছিল মুদাওয়ানাহ পৃঃ ৬২।

[19]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৮/৭৩।

[20]. মানাযিলুল আয়িম্মাতিল আরবা‘আহ, পৃঃ ১৭৩।

[21]. মালেক : হায়াতুহু ওয়া আছরুহু, পৃঃ ৮৮।

[22]. ইমাম মালেক বিন আনাস ৯৩ হিজরীতে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৭৯ হিজরীতে মদীনাতেই মৃত্যুবরণ করেন। বাকী গারকাদে তাকে দাফন করা হয়। তার রচিত আল-মুয়াত্তা হাদীছের একটি সর্বজন সমাদৃত একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ। এছাড়া কিতাবুল মানাসিক, রিসালাতুন ফিল কাদর ওয়ার রদ্দি আলাল কাদারিয়া, কিতাবুস সিররি, কিতাবুল মাজালাসাত, কিতাবুন ফিন নুজুমি ওয়া হিসাবি সাদারিয যামানি ওয়া মানাযিলিল ক্বামার প্রভৃতি।






বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
ইসলামী বাড়ীর বৈশিষ্ট্য - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আহলেহাদীছ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
চিন্তার ইবাদত (৫ম কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
তাহরীকে জিহাদ : আহলেহাদীছ ও আহনাফ (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ভালবাসা (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ইহসান ইলাহী যহীর
বিদায়ের আগে রেখে যাও কিছু পদচিহ্ন (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
হাদীছ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পরিক্রমা (৬ষ্ঠ কিস্তি) (জুলাই ২০২৩-এর পর) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মানব সৃষ্টি : ইসলাম ও বিজ্ঞানের আলোকে - লিলবর আল-বারাদী - যশপুর, তানোর, রাজশাহী
মানব জাতির সাফল্য লাভের উপায় (২য় কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
হাদীছ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পরিক্রমা (শেষ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
১৬ মাসের মর্মান্তিক কারা স্মৃতি (৬ষ্ঠ কিস্তি) - মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম
শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কর্তব্য (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.