পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । শেষ পর্ব ।

পূর্বসূরি মনীষীদের কথা :

বর্ণিত আয়াত ও হাদীছসমূহ অধ্যয়ন করে আমাদের পূর্বসূরিরা ইখলাছের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। ইখলাছশূন্যতার কুফল কী এবং ইখলাছ রক্ষায় কী সুফল পাওয়া যায় তা তাঁরা ভালভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এজন্য তাঁরা তাঁদের রচনাবলীর শুরুতেই নিয়ত সংক্রান্ত হাদীছ তুলে ধরেছেন। যেমন ইমাম বুখারী (রহঃ) নিম্নোক্ত হাদীছ দ্বারা তাঁর ছহীহ বুখারীর সূচনা করেছেন, إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ ‘নিশ্চয়ই সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল’।[1]

আব্দুর রহমান বিন মাহদী (রহঃ) বলেছেন,لَوْ صَنَّفْتُ كِتَابًا فِي الْأَبْوَابِ، لَجَعَلْتُ حَدِيْثَ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ فِي الْأَعْمَالِ بِالنِّيَّاتِ فِي كُلِّ بَابٍ- ‘আমি যদি একাধিক অধ্যায় সম্বলিত গ্রন্থ রচনা করতাম তাহ’লে আমি প্রত্যেক অধ্যায়ের সূচনাতে ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বর্ণিত নিয়তের হাদীছটি উল্লেখ করতাম’।[2]

তাঁরা তো কাজের থেকে নিয়তের গুরুত্ব বেশী বলেছেন। ইয়াহইয়া ইবনু আবু কাছীর বলেছেন, তোমরা কিভাবে নিয়ত করতে হয় তা শেখ। কেননা তা আমলের থেকেও বেশী গুরুত্ব বহন করে।[3] 

মনীষীগণ সাধারণ লোকদের ইখলাছ শিক্ষাদানের উপর খুব গুরুত্ব দিতেন। ইবনু আবী জামরা (রহঃ) বলেন, আমার মন বলে ফক্বীহদের মধ্যে এমন কেউ হওয়া চাই যার কাজই হবে কেবল লোকদের আমলের উদ্দেশ্য শেখানো। কোন আমলের নিয়ত কী হবে কেবল তা শিক্ষাদানে সে নিজেকে সর্বদা নিয়োজিত রাখবে।[4] কেননা অনেকেই অনেক কিছু পায় বটে, কিন্তু তাদের নিয়ত শুদ্ধ থাকে না।

এর বিপরীতে যারা লোক দেখানো কাজ করে এবং যারা দুনিয়ার সুবিধা লাভের জন্য কাজ করে আল্লাহ তা‘আলা তাদের নিন্দা করেছেন এবং তাদের পরিণাম কী দাঁড়াবে তা বর্ণনা করেছেন।

আল্লাহ বলেন,مَنْ كَانَ يُرِيْدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لاَ يُبْخَسُونَ- أُولَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ إِلاَّ النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ‘যে ব্যক্তি পার্থিব জীবন ও তার জাঁকজমক কামনা করে, আমরা তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফল দুনিয়াতেই পূর্ণভাবে দিয়ে দিব। সেখানে তাদেরকে কোনই কমতি করা হবে না’। এরা হ’ল সেইসব লোক যাদের জন্য পরকালে জাহান্নাম ছাড়া কিছুই নেই। দুনিয়াতে তারা যা কিছু (সৎকর্ম) করেছিল আখেরাতে তা সবটাই বরবাদ হবে এবং যা কিছু উপার্জন করেছিল সবটুকুই বিনষ্ট হবে (বাতিল আক্বীদা ও লোক দেখানো সৎকর্মের কারণে)’ (হূদ ১১/১৫-১৬)

অন্যত্র তিনি বলেছেন,مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيْهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُرِيْدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلاَهَا مَذْمُوْمًا مَدْحُوْرًا- ‘যে ব্যক্তি দুনিয়া কামনা করে, আমরা সেখানে যাকে যা ইচ্ছা করি দিয়ে দেই। পরে তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত করি। সেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত ও লাঞ্ছিত অবস্থায়’ (ইসরা ১৭/১৮)। তিনি আরও বলেন,مَنْ كَانَ يُرِيْدُ حَرْثَ الْآخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِيْ حَرْثِهِ وَمَنْ كَانَ يُرِيْدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ نَصِيْبٍ- ‘যে ব্যক্তি আখেরাতের ফসল কামনা করে, আমরা তার ফসল বৃদ্ধি করে দেই। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার ফসল কামনা করে, আমরা তাকে সেখান থেকে কিছু দেই। কিন্তু আখেরাতে তার জন্য কোনই অংশ থাকবে না’ (শূরা ৪২/২০)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمُ الشِّرْكُ الأَصْغَرُ. قَالُوْا وَمَا الشِّرْكُ الأَصْغَرُ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ: الرِّيَاءُ، يَقُوْلُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا جُزِىَ النَّاسُ بِأَعْمَالِهِمْ اذْهَبُوْا إِلَى الَّذِيْنَ كُنْتُمْ تُرَاءُوْنَ فِى الدُّنْيَا فَانْظُرُوْا هَلْ تَجِدُوْنَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً-

‘সবচেয়ে ভয়ংকর যে জিনিসের ভয় আমি তোমাদের জন্য করি তা হ’ল ছোট শিরক। তারা বললেন, ছোট শিরক কী হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, রিয়া বা লোক দেখানো কাজ। ক্বিয়ামতের দিন যখন মানুষকে তাদের আমলের প্রতিদান দেওয়া হবে, তখন আল্লাহ তাদের বলবেন, তোমরা তাদের কাছে যাও, দুনিয়াতে তোমরা যাদের দেখিয়ে দেখিয়ে আমল করতে। দেখ তাদের কাছে কোন প্রতিদান পাও কি-না’।[5]

সুতরাং হে আমার মুসলিম ভাই-বোন! আপনি নিজের জন্য উল্লিখিত দু’টি পন্থার একটি নির্বাচন করুন। হয় আল্লাহর জন্য ইখলাছ ও তাঁর সন্তোষ লাভের জন্য ইবাদত হবে, নয় রিয়া বা লোক দেখানো কাজ ও দুনিয়ার স্বার্থ থাকবে। আপনি আরও জেনে রাখুন, মানুষ তাদের নিয়ত অনুযায়ী হাশরের ময়দানে উত্থিত হবে। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّمَا يُبْعَثُ النَّاسُ عَلَى نِيَّاتِهِمْ ‘মানুষ কেবলই তাদের নিয়ত অনুসারে উত্থিত হবে’।[6]

এসব জানার পর ভাই-বোন আমার! আপনি নিজেকে যেন কখনই ভৎর্সনা না করেন। যদি কিনা আপনি রিয়াকারীদের সাথে ধ্বংসপ্রাপ্তদের তালিকাভুক্ত হয়ে পড়েন।

ইখলাছের ফল :

ইখলাছের যেমন অনেক উপকারিতা রয়েছে, তেমনি বহু ফলও রয়েছে। নেককার ঈমানদার বান্দার অন্তরে যখন ইখলাছ বিদ্যমান থাকে তখন সে এসব উপকারিতা ও ফল লাভ করে থাকে। এখানে ইখলাছের কিছু ফল তুলে ধরা হ’ল :

১. আল্লাহর নিকট আমল কবুল হওয়া :

আবু উমামা আল-বাহেলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلاَّ مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا وَابْتُغِىَ بِهِ وَجْهُهُ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ঐ আমল কবুল করেন না, যা তার জন্য খালেছ হয় না এবং যা স্রেফ তাঁর চেহারা অন্বেষণের লক্ষ্যে না হয়’।[7]

২. ছওয়াব লাভ :

সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,إِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِى بِهَا وَجْهَ اللهِ إِلاَّ أُجِرْتَ عَلَيْهَا- ‘তুমি যা কিছু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে খরচ করবে অবশ্যই তার পুরস্কার পাবে’।[8]

৩. ইখলাছ গুণে ছোট আমলও বড় আমলে রূপান্তরিত :

ইবনুল মুবারক (রহঃ) বলেন,رُبَّ عَمَلٍ صَغِيْرٍ تُعَظِّمُهُ النِّيَّةُ، وَرُبَّ عَمَلٍ كَبِيْرٍ تُصَغِّرُهُ النِّيَّةُ ‘নিয়ত গুণে অনেক ছোট আমলও বড় আমলে পরিণত হয়; আবার অনেক বড় আমলও ছোট আমলে পরিণত হয়’।[9]

৪. পাপ ক্ষমা :

ইখলাছ গোনাহ মাফের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়। ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন, একটা আমলও যদি বান্দা এমনভাবে করতে পারে, যাতে আল্লাহর জন্য পরিপূর্ণভাবে ইখলাছ ও ইবাদত বজায় থাকে, তাহ’লে আল্লাহ তা‘আলা তার বিনিময়ে ঐ বান্দার কবীরা গোনাহ পর্যন্ত মাফ করে দিতে পারেন। যেমন আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

يُصَاحُ بِرَجُلٍ مِنْ أُمَّتِىْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى رُءُوْسِ الْخَلاَئِقِ فَيُنْشَرُ لَهُ تِسْعَةٌ وَتِسْعُوْنَ سِجِلاًّ كُلُّ سِجِلٍّ مَدَّ الْبَصَرِ ثُمَّ يَقُوْلُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ هَلْ تُنْكِرُ مِنْ هَذَا شَيْئًا فَيَقُوْلُ لاَ يَا رَبِّ فَيَقُولُ أَظَلَمَتْكَ كَتَبَتِى الْحَافِظُوْنَ ثُمَّ يَقُوْلُ أَلَكَ عُذْرٌ أَلَكَ حَسَنَةٌ فَيُهَابُ الرَّجُلُ فَيَقُولُ : لاَ. فَيَقُولُ : بَلَى إِنَّ لَكَ عِنْدَنَا حَسَنَاتٍ وَإِنَّهُ لاَ ظُلْمَ عَلَيْكَ الْيَوْمَ فَتُخْرَجُ لَهُ بِطَاقَةٌ فِيهَا أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ قَالَ فَيَقُولُ يَا رَبِّ مَا هَذِهِ الْبِطَاقَةُ مَعَ هَذِهِ السِّجِلاَّتِ، فَيَقُولُ : إِنَّكَ لاَ تُظْلَمُ. فَتُوضَعُ السِّجِلاَّتُ فِى كِفَّةٍ وَالْبِطَاقَةُ فِى كِفَّةٍ فَطَاشَتِ السِّجِلاَّتُ-

‘ক্বিয়ামতের দিন আমার উম্মতের একজনকে সমগ্র সৃষ্টির সামনে ডাকা হবে। তারপর তার সামনে ৯৯টি ভলিউম খুলে ধরা হবে। প্রতিটি ভলিউমের দৈর্ঘ্য একজন মানুষের দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত। অতঃপর আল্লাহ তাকে বলবেন, তুমি কি এর কোনটা অস্বীকার করতে চাও? সে বলবে, না হে আমার রব! তিনি বলবেন, সংরক্ষণকারীরা কি এ লিখনে তোমার প্রতি কোন যুলুম করেছে? অতঃপর তিনি বলবেন, তোমার কি কোন ওযর আছে? তোমার কি কোন নেকী আছে? তখন লোকটি ভীত হয়ে বলবে, না (কোন নেকী নেই)। এ সময় আল্লাহ বলবেন, আমাদের কাছে তোমার কিছু নেকী আছে। আজ তোমার উপর কোন যুলুম করা হবে না। তারপর তার জন্য একটা চিরকুট বের করা হবে; তাতে লেখা থাকবে কালেমা শাহাদত- আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসূলুহু। এ দেখে সে বলবে, এতগুলো ভলিউমের মুকাবেলায় এই চিরকুটের কতটুকু মূল্য আছে? তখন আল্লাহ বলবেন, তোমার প্রতি যুলুম করা হবে না। অতঃপর এ চিরকুট এক পাল্লায় রাখা হবে এবং ভলিউমগুলো অন্য পাল্লায় রাখা হবে। তখন ভলিউমের পাল্লা হাল্কা হয়ে যাবে।[10]

যে ইখলাছের সাথে সত্য মনে কালেমা লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ পড়বে তার অবস্থা এই চিরকুটওয়ালার মত হবে। নচেৎ জাহান্নামী কবীরা গুনাহগার মাত্রই তো কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ উচ্চারণ করে। কিন্তু তাদের উচ্চারিত কালেমা তাদের পাপের পাল্লা থেকে ভারী হবে না, যেমন ভারী হবে এই চিরকুটওয়ালার পাল্লা।

অন্য হাদীছে এসেছে,أَنَّ امْرَأَةً بَغِيًّا رَأَتْ كَلْبًا فِىْ يَوْمٍ حَارٍّ يُطِيْفُ بِبِئْرٍ قَدْ أَدْلَعَ لِسَانَهُ مِنَ الْعَطَشِ فَنَزَعَتْ لَهُ بِمُوقِهَا فَغُفِرَ لَهَا ‘জনৈক পতিতা মহিলা এক গরমের দিনে একটি কুকুরকে একটা কূপের পাশে চক্কর দিতে দেখল। পিপাসায় তার জিহবা বেরিয়ে পড়েছিল। তখন সে তার মোযা খুলে কুকুরটিকে পানি পান করায়। এজন্যে তাকে মাফ করে দেওয়া হয়’।[11]

এই মহিলা তার অন্তরে অবস্থিত নির্ভেজাল ঈমানের তাকীদে কুকুরটিকে পানি পান করিয়েছিল। ফলে তাকে মাফ করে দেওয়া হয়। নচেৎ যখনই কোন পতিতা কুকুরকে পানি পান করাবে আর অমনি ক্ষমা পেয়ে যাবে, তা কখনই হবে না।[12]

আমল বাস্তবায়ন করতে না পারলেও শুধু ইখলাছের খাতিরে ছওয়াব লাভ :

ইখলাছ দ্বারা মানুষ যে আমল করতে ইচ্ছুক তা সম্পাদনে অক্ষম হ’লেও তার ছওয়াব ঠিকই পেয়ে যায়। এমনকি বিছানায় মরেও সে শহীদ ও মুজাহিদদের সমমর্যাদায় পৌঁছে যায়। নবী করীম (ছাঃ) যাদেরকে অর্থাভাবে তার সঙ্গে জিহাদে নিতে পারেননি তাদের প্রশংসায় আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, وَلاَ عَلَى الَّذِيْنَ إِذَا مَا أَتَوْكَ لِتَحْمِلَهُمْ قُلْتَ لاَ أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ تَوَلَّوْا وَأَعْيُنُهُمْ تَفِيْضُ مِنَ الدَّمْعِ حَزَنًا أَلاَّ يَجِدُوْا مَا يُنْفِقُوْنَ- ‘আর ঐসব লোকদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই যারা তোমার নিকট এজন্য আসে যে, তুমি তাদের (জিহাদে যাবার) জন্য বাহনের ব্যবস্থা করবে। অথচ তুমি বলেছ যে, আমার নিকটে এমন কোন বাহন নেই যার উপর তোমাদের সওয়ার করাব। তখন তারা এমন অবস্থায় ফিরে যায় যে, তাদের চক্ষুসমূহ হ’তে অশ্রু প্রবাহিত হ’তে থাকে এই দুঃখে যে, তারা এমন কিছু পাচ্ছে না যা তারা ব্যয় করবে’ (তওবা ৯/৯২)

আনাস বিন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ أَقْوَامًا بِالْمَدِينَةِ خَلْفَنَا، مَا سَلَكْنَا شِعْبًا وَلاَ وَادِيًا إِلاَّ وَهُمْ مَعَنَا فِيْهِ، حَبَسَهُمُ الْعُذْرُ- ‘মদীনাতে আমাদের পিছে এমন কিছু লোক রয়েছে যে, আমরা যেই গিরিপথ কিংবা উপত্যকাই অতিক্রম করি না কেন, সেখানে তারা আমাদের সাথে থাকে; ওযরবশতঃ তারা আটকা পড়ে গেছে’।[13] অন্য বর্ণনায় এসেছে,إِلاَّ شَرِكُوْكُمْ فِى الأَجْرِ ‘তারা (প্রতিটি ক্ষেত্রে) ছওয়াবে তোমাদের সাথে শরীক থাকে’।[14] 

আনাস বিন মালেক কর্তৃক নবী করীম (ছাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেছেন,مَنْ سَأَلَ اللهَ الشَّهَادَةَ بِصِدْقٍ بَلَّغَهُ اللهُ مَنَازِلَ الشُّهَدَاءِ وَإِنْ مَاتَ عَلَى فِرَاشِهِ- ‘যে ব্যক্তি খাঁটি মনে শাহাদত লাভের দো‘আ করবে, আল্লাহ তাকে শহীদদের স্তরে পৌঁছে দিবেন, যদিও সে বিছানায় শুয়ে মারা যায়’।[15]

এমনিভাবে নিয়ত গুণে একজন গরীব লোকও দানশীল ধনী লোকের সমতুল্য ছওয়াব লাভ করতে পারে। আবু কাবশা আল-আনমারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَثَلُ هَذِهِ الأُمَّةِ كَمَثَلِ أَرْبَعَةِ نَفَرٍ : رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالاً وَعِلْمًا فَهُوَ يَعْمَلُ بِعِلْمِهِ فِىْ مَالِهِ يُنْفِقُهُ فِىْ حَقِّهِ وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ عِلْمًا وَلَمْ يُؤْتِهِ مَالاً فَهُوَ يَقُوْلُ : لَوْ كَانَ لِىْ مِثْلُ هَذَا عَمِلْتُ فِيْهِ مِثْلَ الَّذِىْ يَعْمَلُ. قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَهُمَا فِى الأَجْرِ سَوَاءٌ...، ‘এই উম্মতের উদাহরণ চারজন লোকের ন্যায়। একজন যাকে আল্লাহ অর্থ-বিত্ত ও বিদ্যা প্রদান করেছেন। সে তার অর্থ ব্যয় করে এবং অর্থের হক যথাযথ পরিশোধ করে। আরেকজনকে আল্লাহ শুধু বিদ্যা দিয়েছেন, অর্থ-সম্পদ দেননি। সে বলে, আমার যদি এ লোকের মত সম্পদ থাকত, তাহ’লে আমিও তার মত আমল করতাম। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ছওয়াব লাভে এরা দু’জনই সমান...।[16]

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে যা আলোচনার দাবী রাখে। কোন লোক হয়তো কোন আমল করতে আসলে অক্ষম নয়, কিন্তু সে মনে মনে ঐ আমল করার ইচ্ছা করে আর ভাবে, তার এই ইচ্ছার জন্য সে ছওয়াব পাবে এবং সেই ইচ্ছাকে সে নেক নিয়ত মনে করে। কিন্তু আসলে তা তার কুপ্রবৃত্তির অলীক আশা ও শয়তানী প্রবঞ্চনা মাত্র।

আমরা অনেককে দেখতে পাই, হয়তো সে বাড়িতে বসে কিংবা শুয়ে আছে, মসজিদে ছালাতে যাচ্ছে না, কিন্তু মনে মনে বলছে, আমি ছালাতে যেতে ভালবাসি। আর ভাবছে, আমার এই বলাতেই আমি মসজিদে গিয়ে জামা‘আতে ছালাতের ছওয়াব পাব। এ ধরনের লোক আমাদের বর্ণিত ছওয়াব অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং হাদীছের আওতায়ও তারা পড়ে না। সুতরাং এ সম্বন্ধে হুঁশিয়ার থাকতে হবে।

ইখলাছের বদৌলতে মুবাহ ও অভ্যাস জাতীয় কাজও ইবাদতে রূপান্তরিত হয়, যার মাধ্যমে উচ্চমর্যাদা অর্জিত হয়:

عَنْ سَعْدِ بْنِ أَبِىْ وَقَّاصٍ أَنَّهُ أَخْبَرَهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : إِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِى بِهَا وَجْهَ اللهِ إِلاَّ أُجِرْتَ عَلَيْهَا، حَتَّى مَا تَجْعَلُ فِىْ فِىْ امْرَأَتِكَ-

সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে তুমি যে কোন প্রকার ব্যয়ই কর না কেন, সেজন্য তুমি ছওয়াব পাবে। এমনকি তোমার স্ত্রীর মুখে যে খাদ্যের গ্রাস তুলে দিয়ে থাক সেজন্যও’।[17]

কল্যাণ লাভের এ এক মহৎ উপায়। যখনই কোন মুসলিম এ পথে প্রবেশ করবে তখনই সে মহা কল্যাণ ও অঢেল ছওয়াব লাভ করবে। আমরা যদি আমাদের নিত্যকার অভ্যাসে ও মুবাহমূলক কাজে আল্লাহর নৈকট্য লাভের নিয়ত করি তাহ’লে অবশ্যই আমরা মহা পুরস্কার ও প্রচুর ছওয়াব লাভ করব।

যুবাইদ আল-ইয়ামী (রহঃ) বলেছেন, প্রতিটি কথায় ও কাজে আমার আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিয়ত থাকা আমি খুব পসন্দ করি, এমনকি খাদ্য-পানীয় গ্রহণের ক্ষেত্রেও।[18]

প্রিয় পাঠক! আপনি বাস্তব থেকে গৃহীত এই দৃষ্টান্তগুলো গ্রহণ করুন, আপনার প্রাত্যহিক জীবনে এগুলো কাজে আসতে পারে।

১. অনেকে খোশবু ব্যবহার করতে পসন্দ করে। সে যদি মসজিদে যাওয়ার আগে খোশবু মাখার সময় আল্লাহর ঘরের সম্মান করা এবং মানুষ ও ফেরেশতাদের তার মুখ ও দেহের গন্ধ দ্বারা কষ্ট দেওয়া থেকে হেফাযত করার নিয়ত করে তাহ’লে অবশ্যই ছওয়াব পাবে।

২. আমরা সবাই খাদ্য ও পানীয়ের মুখাপেক্ষী। কিন্তু যে খাদ্য-পানীয় গ্রহণ দ্বারা আল্লাহর ইবাদতে শক্তি অর্জনের নিয়ত করবে সে ছওয়াব পাবে।

৩. অধিকাংশ মানুষের বিবাহ করা প্রয়োজন। জৈবিক চাহিদা মিটাতে সাধারণত তারা বিবাহ করে। কিন্তু যদি বিবাহ দ্বারা তারা স্বামী-স্ত্রীর চারিত্রিক পবিত্রতা এবং এমন সন্তান কামনা করে যারা তাদের অবর্তমানে আল্লাহর ইবাদত করবে তাহ’লে সেজন্য তারা ছওয়াবের অধিকারী হবে।

৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের লেখা-পড়ায় ভাল নিয়তের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। একজন মেডিকেল ছাত্র তার অধ্যয়নে ভবিষ্যতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা দানের নিয়ত করতে পারে। অনুরূপভাবে প্রকৌশল ও অন্যান্য শাখার শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকেই তাদের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের জ্ঞান দ্বারা ইসলাম ও মুসলিমদের সেবার নিয়ত করতে পারে।

এরূপ আরো অনেক বিষয় রয়েছে। আমাদের মধ্যে তো এমন কেউ নেই যার জীবন-জীবিকার জন্য কোন শ্রম দিতে হয় না বা পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করতে হয় না। আবার ঘুমানোর প্রয়োজন নেই এমনও কেউ নেই। তাহ’লে হে পাঠক! এসব মুবাহ কাজে খাঁটি নিয়ত আর ছওয়াবের প্রত্যাশা হ’তে পারে বিচার দিবসে আপনার মুক্তির অসীলা।

শয়তান থেকে আত্মরক্ষা :

শয়তান যখন আল্লাহর বান্দাদের বিপথগামী করার জন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে অঙ্গীকার করেছিল তখন সে আল্লাহর খাঁটি বান্দাদের তা থেকে বাদ রেখেছিল। সে বলেছিল, إِلاَّ عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِيْنَ ‘তবে তাদের মধ্য থেকে তোমার নির্বাচিত বান্দারা ব্যতীত’ (হিজর ১৫/৪০)

তাহ’লে দেখা যাচ্ছে, যে ইখলাছের দুর্গে আশ্রয় নেয় শয়তান তাকে বিপথগামী করার সুযোগ পায় না। মা‘রূফ কারখী (রহঃ) নিজের মনকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, হে মন! তুই ইখলাছ অবলম্বন কর বা খাঁটি হয়ে যা, তাহ’লে তুই মুক্তি পাবি।[19]

কুমন্ত্রণা ও লৌকিকতা থেকে নিরাপদ থাকা :

আবু সুলাইমান আদ-দারানী (রহঃ) বলেছেন, বান্দা যখন ইখলাছের সাথে কাজ করে তখন কুমন্ত্রণা ও লৌকিকতা থেকে সে বহুলাংশে নিরাপদ থাকে।[20]

ফিৎনা-ফাসাদ হ’তে মুক্তি :

ইখলাছ বা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি নিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষ ফিৎনা থেকে মুক্তি পায়। প্রবৃত্তির লালসার শিকার হওয়া থেকে সে আত্মরক্ষা করতে পারে, পাপাচারী দুর্নীতিবাজদের খপ্পর থেকে তার রেহাই মেলে। ইখলাছের ফলেই আল্লাহ তা‘আলা ইউসুফ (আঃ)-কে মিশরীয় মন্ত্রীর স্ত্রীর কুপ্রস্তাব থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে তাঁকে পাপাচার ও অন্যায়ের পাঁকে পড়তে হয়নি। আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا لَوْلاَ أَنْ رَأَى بُرْهَانَ رَبِّهِ كَذَلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاءَ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِينَ- ‘উক্ত মহিলা তার বিষয়ে কুচিন্তা করেছিল এবং সেও তার প্রতি কল্পনা করত যদি না সে স্বীয় পালনকর্তার প্রমাণ অবলোকন করত। এভাবেই এটা একারণে যাতে আমরা তার থেকে যাবতীয় মন্দ ও অশ্লীল বিষয় সমূহ সরিয়ে দেই। নিশ্চয়ই সে ছিল আমাদের মনোনীত বান্দাগণের অন্তর্ভুক্ত’ (ইউসুফ ১২/২৪)

দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি, জীবিকা বৃদ্ধি :

মুখলেছ ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা যেমন দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেন, তেমনি জীবিকাতে প্রাচুর্য দান করেন। এ বিষয়ে আনাস বিন মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ كَانَتِ الآخِرَةُ هَمَّهُ جَعَلَ اللهُ غِنَاهُ فِىْ قَلْبِهِ وَجَمَعَ لَهُ شَمْلَهُ وَأَتَتْهُ الدُّنْيَا وَهِىَ رَاغِمَةٌ وَمَنْ كَانَتِ الدُّنْيَا هَمَّهُ جَعَلَ اللهُ فَقْرَهُ بَيْنَ عَيْنَيْهِ وَفَرَّقَ عَلَيْهِ شَمْلَهَ وَلَمْ يَأْتِهِ مِنَ الدُّنْيَا إِلاَّ مَا قُدِّرَ لَهُ- ‘যার জীবনের লক্ষ্য হবে আখিরাত আল্লাহ তার অন্তরকে ধনী করে দিবেন। তার সব সুযোগ-সুবিধা একত্রিত করে দিবেন এবং দুনিয়া (ধন-সম্পদ) তার পায়ে লুটিয়ে পড়বে। আর যার জীবনের লক্ষ্য হবে দুনিয়া আল্লাহ তা‘আলা দারিদ্র্যকে তার নিত্যসঙ্গী করে দিবেন। তার গোছানো বিষয় ছিন্নভিন্ন করে দিবেন এবং তার জন্য যতটুকু বরাদ্দ তার বাইরে সে দুনিয়ার কিছুই পাবে না’।[21]

বিপদ থেকে উদ্ধার :

ইহজীবনে মানুষ নানা বিপদাপদের সম্মুখীন হয়। ইখলাছপূর্ণ জীবন-যাপন করলে আল্লাহ সেসব বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করেন। বিপদগ্রস্ত এমন তিনজন মানুষের কথা হাদীছে এসেছে যারা ইখলাছ বা সততার গুনে বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছিলেন।

ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তি পথে হাঁটছিল। এমন সময় বৃষ্টি শুরু হ’লে তারা একটি পাহাড়ী গুহায় আশ্রয় নিল। এ সময় একটি পাথর গড়িয়ে পড়ে তাদের গুহার মুখ বন্ধ করে দিল। তখন তারা পরস্পরে বলাবলি করল, তোমাদের জীবনের সর্বোত্তম আমলের অসীলা দিয়ে আল্লাহর নিকট দো‘আ কর। তখন তাদের একজন বলল, ইয়া আল্লাহ, আমার দু’জন অতি বৃদ্ধ মাতা-পিতা ছিলেন। আমি পশু চরাতে বাড়ী থেকে বের হয়ে যেতাম। তারপর বাড়ী ফিরে দুধ দোহন করতাম। সেই দুধ নিয়ে আমার মাতা-পিতাকে দিতাম তারা তা পান করতেন। পরে শিশুদের এবং আমার স্ত্রী-পরিজনদের পান করতে দিতাম। এক রাতে আমি আটকা পড়ে গেলাম। যখন বাড়ি এলাম তখন মাতা-পিতা দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমি তাদের জাগাতে অপসন্দ করলাম। এদিকে ছোট ছেলে-মেয়েরা আমার পায়ের কাছে ক্ষুধায় কাতরাচ্ছিল। কিন্তু ভোর পর্যন্ত মাতা-পিতা ঘুমিয়েই রইলেন, আর আমিও তাদের অপেক্ষায় জেগে রইলাম। হে আল্লাহ! তোমার যদি মনে হয়, আমি একাজ তোমাকে সন্তুষ্ট করার জন্য করেছি তাহ’লে তুমি আমাদের জন্য গুহাটা এতটুকু ফাঁকা করে দাও যাতে আমরা আকাশ দেখতে পারি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, অতঃপর তাদের জন্য গুহার এক তৃতীয়াংশ ফাঁকা করে দেওয়া হ’ল।

এবার দ্বিতীয়জন বলল, হে আল্লাহ! তোমার জানা আছে- আমি আমার এক চাচাতো বোনকে ততোধিক ভালবাসতাম যতটা একজন পুরুষ কোন নারীকে ভালবাসে। সে আমাকে বলেছিল, একশ’ দীনার না দেওয়া পর্যন্ত তার মনোস্কামনা পূরণ হবে না। আমি চেষ্টা করে ঐ পরিমাণ অর্থ জমা করলাম। অতঃপর আমি যখন তার সঙ্গে মিলিত হ’তে গেলাম এবং তার দু’পায়ের মাঝে বসলাম তখন সে আমাকে বলল, আল্লাহকে ভয় কর এবং অবৈধভাবে মোহর ছিন্ন কর না। আমি তখন তাকে ছেড়ে উঠে পড়লাম। (হে আল্লাহ) এখন যদি তোমার মনে হয়, আমি ঐ কাজ তোমাকে সন্তুষ্ট করার জন্য করেছি তাহ’লে আমাদের জন্য গুহার মুখটা আরেকটু ফাঁকা করে দাও। এবার গুহার মুখটা দুই-তৃতীয়াংশ ফাঁকা হয়ে গেল।

পরিশেষে তৃতীয়জন বলল, হে আল্লাহ, তোমার জানা আছে, আমি এক ফারাক (ওযন বিশেষ) ভুট্টার বিনিময়ে একজন মজুর নিয়োগ করেছিলাম। আমি তাকে ভুট্টা দিতে গেলে সে তা নিতে অস্বীকার করে। আমি সেই এক ফারাক ভুট্টা জমিতে বপন করি। তাতে যে ফসল হয় তা দিয়ে এক পাল গরু কিনি এবং একজন রাখাল নিয়োগ করি। অনেককাল পরে লোকটা এসে বলল, ওহে আল্লাহর বান্দা! আমার পাওনা আমাকে দাও। আমি বললাম, ঐ যে গরুর পাল ও তাদের রাখালকে দেখছ, ওখানে যাও। ওগুলো সবই তোমার। সে বলল, তুমি কি আমার সাথে তামাশা করছ? আমি বললাম, আমি তোমার সঙ্গে তামাশা করছি না। আসলে ওগুলো তোমারই। হে আল্লাহ! তুমি যদি মনে কর, আমি একাজ তোমার সন্তোষ অর্জনের মানসে করেছি তাহ’লে আমাদের মুক্ত করে দাও। অতঃপর আল্লাহ তাদের মুক্ত করে দিলেন’।[22]

নিষ্ঠাবান ও মানুষের মাঝে সংঘটিত বিষয়ে আল্লাহই যথেষ্ট :

ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, হক যদি কোন ব্যক্তির নিজের বিরুদ্ধেও যায় আর সে খালেছ বা খাঁটি নিয়তে ঐ হকের পক্ষে থাকে, তাহ’লে তার ও অন্যান্য মানুষের মাঝে যত যা কিছু হবে তাতে আল্লাহ তা‘আলা তার সহায় থাকবেন’।[23]

ইখলাছওয়ালা প্রজ্ঞার অলঙ্কারে ভূষিত :

ইমাম মাকহূল (রহঃ) ছিলেন একজন খ্যাতিমান হাদীছবেত্তা। তিনি বলেছেন, কোন বান্দা যদি কখনো একাধারে চল্লিশ দিন যাবৎ ইখলাছের সাথে আমল করে তাহ’লে তার অন্তর থেকে মুখ পর্যন্ত প্রজ্ঞার ঝর্ণাধারা উৎসারিত হবে।[24]

ইখলাছের বদৌলতে বান্দা ভুল করলেও ছওয়াব পায় :

একজন গবেষক মুজতাহিদ, দ্বীনের আলিম, ফক্বীহ কিংবা ন্যায়বিচারক যখন তার গবেষণা বা ইজতিহাদে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের নিয়ত করে এবং সত্য ও সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হ’তে যথাসাধ্য চেষ্টা করে, তখন যদি সে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে নাও পারে তবুও সে ছওয়াব লাভ করবে।

ইখলাছেই যাবতীয় কল্যাণ :

ইমাম দাঊদ আত-তাঈ (রহঃ) বলেছেন, আমি দেখেছি, সদিচ্ছা বা ভাল নিয়তই কেবল সকল কল্যাণকে জড়ো করতে পারে। নিয়ত মোতাবেক কাজ করতে না পারলেও শুধু নিয়ত গুণেই কল্যাণ তোমার হাতে ধরা দিবে।[25] মুখলিছ বান্দাদের জন্য যখন এতসব ফায়েদা তখন আমাদের উচিত হল মুখলিছ হওয়া।

[চলবে]


[1]. বুখারী হা/১; মুসলিম হা/১৯০৭; মিশকাত হা/১।

[2]. জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম ১/৮।

[3]. হিলয়াতুল আওলিয়া ৩/৭০; জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম ১/১৩।

[4]. আল-মাদখাল ১/১।

[5]. আহমাদ হা/২৩৬৮০, ২৩৬৮৬; মিশকাত হা/৫৩৩৪; ছহীহ আত-তারগীব হা/৩২।

[6]. ইবনু মাজাহ হা/৪২২৯; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৩।

[7]. নাসাঈ হা/৩১৪০, হাদীছ ছহীহ।

[8]. বুখারী হা/৫৬; মুসলিম হা/১৬২৮; মিশকাত হা/৩০৭১।

[9]. জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম ১/১৩।

[10]. তিরমিযী হা/২৬৩৯; ইবনু মাজাহ হা/৪৩০০; হাকেম হা/১৯৩৭।

[11]. মুসলিম হা/২২৪৫।

[12]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৬/২১৮-২২১।

[13]. বুখারী হা/২৮৩৯।

[14]. মুসলিম হা/১৯১১।

[15]. মুসলিম হা/১৯০৯; মিশকাত হা/৩৮০৮। 

[16]. ইবনু মাজাহ হা/৪২২৮; আহমাদ হা/১৮০৫৩; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৬।

[17]. বুখারী হা/৪৫; মুসলিম হা/১৬২৮; মিশকাত হা/৩০৭১।  

[18]. আল-ইখলাছ ওয়ান নিয়্যাত, পৃঃ ৬২।

[19]. গাযালী, ইইয়াউ উলূমিদ্দীন ৩/৪৬৫।

[20]. মাদারিজুস সালিকীন ২/৯২।

[21]. তিরমিযী হা/২৪৬৫; দারেমী হা/২২৯; ছহীহাহ হা/৯৪৯।

[22]. বুখারী হা/২১০২; মুসলিম হা/২৭৪৩।

[23]. বায়হাকী, সুনানুল কুবরা ১০/২৫০।

[24]. মাদারিজুস সালিকীন ২/৯২।

[25]. আল ইখলাছ ওয়ান নিয়্যাত ৬৪; জামিউল উলূম ওয়াল হিবাম-১৩। 





আল্লাহ যার কল্যাণ চান - আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইসলামী বাড়ীর বৈশিষ্ট্য - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
সীমালংঘন - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
যুবসমাজের অধঃপতন : কারণ ও প্রতিকার (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর পাঁচ দফা মূলনীতি : একটি বিশ্লেষণ (৫ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
ধন-সম্পদ : মানব জীবনে প্রয়োজন, সীমালংঘনে দহন (১ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা : মুমিনের দুই অনন্য বৈশিষ্ট্য - ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
জুম‘আর পূর্বে সুন্নাতে রাতেবা : একটি পর্যালোচনা - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
দো‘আর আদব বা শিষ্টাচার সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ইসলামে তাক্বলীদের বিধান (৩য় কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
শায়খ আলবানীর তাৎপর্যপূর্ণ কিছু মন্তব্য (১ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
আদর্শ পরিবার গঠনে করণীয় (৫ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আরও
আরও
.