আধুনিককালে পারস্পরিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে মোবাইল ফোন। তারবিহীন এ ফোন এখন মানুষের হাতে হাতে। পারস্পরিক যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, কেনাকাটা, পড়ালেখাসহ বিভিন্ন তথ্য মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই আদান-প্রদান করা হয়ে থাকে। কম্পিউটারের মত মোবাইল এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। এর কল্যাণে ক্রমশঃ বদলে যাচ্ছে পৃথিবী। ব্যাপক পরিবর্তন এসছে মানুষের চাল-চলন, আচার-আচরণ, বুদ্ধি ও মননে। মোবাইল আমাদের জীবন চলার পথ সাবলীল করেছে। জীবনে এনে দিয়েছে এক গতিময়তা। বিশ্বায়নের এ যুগে মোবাইলের কল্যাণে দুনিয়া মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। অত্যাধুনিক নানা প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হয়ে বাযারে আসছে নিত্য-নতুন মোবাইল। ইন্টারনেটও যুক্ত হয়েছে এ মোবাইলে। তাই এ মোবাইল ফোনেই মানুষের জন্য ইমেইল, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করা সহজসাধ্য হয়েছে। নানা প্রয়োজনীয় তথ্য আদান-প্রদান করতে পারছে। কম্পিউটার, টিভি, রেডিও, ভিসিডি, ক্যামেরা, টর্চ লাইট সব কিছুর কাজই করছে মোবাইল। তাই মোবাইল এক উপকারী যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এই উপকারী যন্ত্রটি ব্যবহারে কিছু আদব বা শিষ্টাচার মেনে চলা সকলের জন্য যরূরী। যাতে কেউ ক্ষতির স্বীকার না হয়। নিম্নে মোবাইল ব্যবহারের কিছু আদব উল্লেখ করা হ’ল।-

ক. পালনীয় :

১. সালাম দিয়ে কথা শুরু করা :

কারো সাথে কথা বলার প্রারম্ভে সালাম বিনিময় করা ইসলামের সুমহান আদর্শ। এ সালামে রয়েছে একে অপরের জন্য দো‘আ ও শান্তির প্রার্থনা। তাই পারস্পরিক সাক্ষাতের ন্যায় মোবাইল ফোনে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে কথাবার্তা শুরু করতে হবে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ بَدَأَ بِالْكَلاَمِ قَبْلَ السَّلاَمِ فَلاَ تُجِيْبُوْهُ، ‘যে ব্যক্তি সালামের পূর্বে কথা শুরু করে তার কথার উত্তর দিও না’।[1] অনুরূপভাবে একজনের সাথে একাধিকবার ফোন করা হ’লেও প্রতিবারই সালামের মাধ্যমে কথা বলা উচিত। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِذَا لَقِىَ أَحَدُكُمْ أَخَاهُ فَلْيُسَلِّمْ عَلَيْهِ فَإِنْ حَالَتْ بَيْنَهُمَا شَجَرَةٌ أَوْ جِدَارٌ أَوْ حَجَرٌ ثُمَّ لَقِيَهُ فَلْيُسَلِّمْ عَلَيْهِ أَيْضًا، ‘তোমাদের কেউ যখন তার ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, তখন সে যেন তাকে সালাম দেয়। অতঃপর দু’জনের মাঝে যদি গাছ, দেয়াল বা পাথর আড়াল হয়ে যায় এবং তারপর আবার সাক্ষাৎ হয়, তাহ’লেও যেন তাকে সালাম দেয়’।[2]

অন্যত্র তিনি বলেন, إِذَا انْتَهَى أَحَدُكُمْ إِلَى الْمَجْلِسِ فَلْيُسَلِّمْ

فَإِذَا أَرَادَ أَنْ يَقُوْمَ فَلْيُسَلِّمْ فَلَيْسَتِ الأُولَى بِأَحَقَّ مِنَ الآخِرَةِ، ‘তোমাদের কেউ মজলিসে উপস্থিত হ’লে যেন সালাম দেয় এবং মজলিস থেকে বিদায়ের সময়ও যেন সালাম দেয়। প্রথম সালাম শেষ সালাম অপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নয়’।[3]

২. নিজের পরিচয় পেশ করা :

ফোনে বা মোবাইলে কল রিসিভ করে সালাম বিনিময়ের পর নিজের পরিচয় পেশ করা অন্যতম শিষ্টাচার। যেমন জাবের (রাঃ) বলেন,أَتَيْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فِى دَيْنٍ كَانَ عَلَى أَبِى فَدَقَقْتُ الْبَابَ فَقَالَ مَنْ ذَا فَقُلْتُ أَنَا فَقَالَ أَنَا أَنَا كَأَنَّهُ كَرِهَهَا. ‘আমার পিতার কিছু ঋণ ছিল। এ সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে আসলাম এবং দরজায় আঘাত করলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে? আমি বললাম, আমি। তখন তিনি বললেন, আমি আমি, যেন তিনি তা অপসন্দ করলেন’।[4] অনুরূপভাবে মোবাইল ফোনে কথা বলার ক্ষেত্রেও উভয়ে কাঙ্খিত ব্যক্তি কি-না তা যাচাই করে নেয়া উচিত। অতঃপর প্রয়োজনীয় কথা বলাই সমীচীন। কেননা নাম-পরিচয়বিহীন লোকের সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলায় ক্ষতির সম্ভাবনা বেশী থাকে।

৩. অনুমতি নিয়ে কথা বলা :

কোন কোন লোক অনেক ক্ষেত্রে ফোনে বা মোবাইলে কল করেই কথা বলা শুরু করে দেন। এরূপ না করে কথা বলার আগেই অনুমতি নেয়া কিংবা তিনি কথা বলার জন্য প্রস্ত্তত কি-না অথবা কথা বলার মত তার পর্যাপ্ত সময় আছে কি-না তা জেনে নেয়া উচিত। অতঃপর প্রয়োজনীয় কথা দ্রুত সেরে নেয়া প্রয়োজন।

৪. নিম্ন আওয়াজে কথা বলা :

জনবহুল স্থানে যেমন রাস্তা-ঘাট, যানবাহন, হাসপাতাল, মসজিদ কিংবা বাযার বা সর্ব সাধারণের জন্য নির্ধারিত স্থানে উচ্চ আওয়াজে কথা বলা শালীনতা পরিপন্থী কাজ। অনুরূপ ভাবে মোবাইল ফোনের কথাবার্তায়ও যেন অন্যের অসুবিধা না হয় সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা যরূরী। আবার নিজেদের একান্ত প্রয়োজনীয় কথাগুলো অন্য কেউ শুনলে তা যেমন দৃষ্টিকটু তেমনি তাতে ক্ষতির সম্ভাবনাও থাকে। উপরোক্ত স্থানগুলোতে কথা বলার ক্ষেত্রে সংযত হওয়া একান্ত প্রয়োজন।

তাছাড়া কথা বলার সময় আওয়াজ এমন হওয়া উচিত যা অপর প্রান্তের মানুষ শুনতে পায়। অযথা অধিক উচ্চ আওয়াজে কথা বলে মানুষকে বিরক্ত করা এবং তাদের অসুবিধা করা সমীচীন নয়। কেননা অনর্থক চিৎকার করাকে গাধার আওয়াজের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ إِنَّ أَنْكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيْرِ- ‘তুমি পদচারণায় মধ্যপন্থা অবলম্বন কর এবং তোমার কণ্ঠস্বর নীচু কর। নিশ্চয়ই সবচেয়ে বিকট স্বর হ’ল গাধার কণ্ঠস্বর’ (লোক্বমান ৩১/১৯)

৫. প্রয়োজনীয় কথা বলা :

ফোন বা মোবাইল কোন গল্প-গুজব করার যন্ত্র নয়। বরং এতে একান্ত প্রয়োজনীয় কথা বলতে হবে। কেননা অধিক কথা বলাতে কোন উপকারিতা নেই। তাছাড়া অপ্রয়োজনীয় কাজ পরিহার করাই ইসলামের নির্দেশ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيهِ- ‘মানুষের জন্য ইসলামের সৌন্দর্য হচ্ছে তার অনর্থক বিষয় পরিহার করা’।[5] এছাড়া অপ্রয়োজনে অধিক কথা বলা আল্লাহর নিকটে অপসন্দনীয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,وَيَكْرَهُ لَكُمْ قِيْلَ وَقَالَ وَكَثْرَةَ السُّؤَالِ وَإِضَاعَةَ الْمَالِ- ‘আর তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য অপসন্দ করেন অনর্থক কথাবার্তা বলা, অধিক প্রশ্ন করা এবং ধন-সম্পদ বিনষ্ট করা’।[6]

মানুষের বলা প্রতিটি কথা রেকর্ড হয়। যার হিসাব পরকালে নেওয়া হবে। যেমন আল্লাহ বলেন,مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيْبٌ عَتِيْدٌ، ‘সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তা গ্রহণ করার জন্য তার কাছে সদা প্রস্ত্তত প্রহরী রয়েছে’ (ক্বাফ ৫০/১৮)। তিনি আরো বলেন,وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِيْنَ، كِرَامًا كَاتِبِيْنَ، يَعْلَمُوْنَ مَا تَفْعَلُوْنَ، ‘অথচ তোমাদের উপরে অবশ্যই তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত আছে। সম্মানিত লেখকবৃন্দ। তারা জানেন তোমরা যা কর’ (ইনফিতার ৮২/১০-১২)। সুতরাং অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয় কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে।

৬. আস্তে আস্তে কথা বলা :

মোবাইল ফোনে কথাবার্তা বলার ক্ষেত্রে আস্তে আস্তে বলা উচিত। যাতে তা অপর প্রান্তের লোকের নিকটে বোধগম্য হয়। কারণ দ্রুত কথা বলার কারণে অনেক সময় অপর প্রান্ত থেকে সঠিকভাবে কথা বুঝা যায় না। আর অতি দ্রুত কথা বলা শিষ্টাচারও নয়। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُحَدِّثُ حَدِيْثًا لَوْ عَدَّهُ الْعَادُّ لَأَحْصَاهُ- ‘নবী করীম (ছাঃ) এমনভাবে কথা বলতেন যে, কোন গণনাকারী গুণতে চাইলে তাঁর কথাগুলি গণনা করতে পারত’।[7] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আয়েশা (রাঃ) বলেন, আবূ হুরায়রার আচরণ কি তোমাকে অবাক করে না? সে এসে আমার ঘরের এক পাশে বসে আমাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একটি হাদীছ পড়ে শুনাতে লাগল। আমি তখন ছালাতরত ছিলাম। আমার ছালাত শেষ হওয়ার পূর্বেই সে উঠে চলে গেল। আমি যদি তাকে পেতাম তবে তাকে বলতাম, لَمْ يَكُنْ يَسْرُدُ الْحَدِيْثَ كَسَرْدِكُمْ، ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তোমাদের ন্যায় তাড়াহুড়া করে কথা বলতেন না’।[8]

আনাস (রাঃ) বলেন,أَنَّهُ كَانَ إِذَا تَكَلَّمَ بِكَلِمَةٍ أَعَادَهَا ثَلَاثًا حَتَّى تُفْهَمَ عَنْهُ- ‘নবী করীম (ছাঃ) যখন কথা বলতেন, তখন তিনি তা তিনবার বলতেন, যাতে তা বুঝা যায়’।[9]

৭. অন্যের বোধগম্য ভাষায় কথা বলা :

ফোনে বা মোবাইলে কথা বলার ক্ষেত্রেও মানুষের সাথে তাদের বোধগম্য ভাষায় কথা বলা উচিত। দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলা সমীচীন নয়। কারণ এতে মানুষ কথা বুঝতে না পেরে কষ্ট পায়। আলী (রাঃ) বলেন,حَدِّثُوا النَّاسَ بِمَا يَعْرِفُوْنَ أَتُحِبُّوْنَ أَنْ يُكَذَّبَ اللهُ وَرَسُولُهُ، ‘মানুষের নিকট সেই ধরনের কথা বল, যা তারা বুঝতে পারে। তোমরা কি পসন্দ কর যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি মিথ্যা আরোপ করা হোক’?[10]

৮. হাসিমুখে কথা বলা :

কারো সাথে মুখ ভারী করে কথা বলা উচিত নয়; বরং হাসিমুখে কথা বলা উচিত। কেননা এতে নেকী রয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, تَبَسُّمُكَ فِىْ وَجْهِ أَخِيْكَ لَكَ صَدَقَةٌ ‘তোমার হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে তোমার ভাইয়ের সামনে উপস্থিত হওয়া তোমার জন্য ছাদাক্বাস্বরূপ’।[11] তিনি আরো বলেন,لاَ تَحْقِرَنَّ مِنَ الْمَعْرُوفِ شَيْئًا وَلَوْ أَنْ تَلْقَى أَخَاكَ بِوَجْهٍ طَلْقٍ، ‘কল্যাণমূলক কোন কর্মকেই অবজ্ঞা করো না, যদিও তা তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করেও হয়’।[12]

৯. মানুষের অবস্থান ও মর্যাদা অনুযায়ী কথা বলা :

যার কাছে কল করা হচ্ছে তার মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে কথা বলা উচিত। যে ব্যক্তি যতটুকু সম্মান পাওয়ার হকদার তাকে ঐভাবে সম্মান দিয়ে কথা বলা শালীনতার পরিচায়ক। এ মর্মে হাদীছে এসেছে, আয়েশা (রাঃ) বলেন,أَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ نُنَزِّلَ النَّاسَ مَنَازِلَهُمْ. ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে আদেশ করেছেন মানুষকে তার পদমর্যাদা অনুযায়ী স্থান দিতে’।[13]

খ. বর্জনীয় :

১. ছালাতের একাগ্রতায় বিঘ্ন না ঘটানো :

দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের জামা‘আত অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় নির্ধারিত। এ নির্ধারিত সময়ে মোবাইল ফোনে কাউকে কল করা বা ম্যাসেজ পাঠানো উচিত নয়। কারণ জামা‘আত চলাকালে কোন কল কিংবা নোটিফিকেশন আসলে তা মুছল্লীর একাগ্রতায় বিঘ্ন ঘটায়। অনুরূপভাবে তার পার্শ্ববর্তী মুছল্লীর মনোযোগেও বিঘ্ন ঘটে। আর ছালাতে মানুষের একাগ্রতাই মূল। আল্লাহ বলেন,قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ، الَّذِيْنَ هُمْ فِيْ صَلَاتِهِمْ خَاشِعُوْنَ، ‘নিশ্চয়ই সফলকাম হবে মুমিনগণ। যারা তাদের ছালাতে তন্ময়-তদ্গত’ (মুমিনূন ২৩/১-২)

২. ঘুমের সময় কল না করা :

সারাদিনের কর্মক্লান্তির পর রাতে ঘুমানোর মাধ্যমে মানুষ তার ক্লান্তি-শ্রান্তি দূর করার চেষ্টা করে এবং পরবর্তী দিন পূর্ণ উদ্যমে কাজ করার জন্য মানসিক ও দৈহিক প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে। বিধায় ঘুম মানুষের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। এজন্য যরূরী প্রয়োজন ব্যতীত ঘুমের সময় কাউকে ফোন দেওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। তাছাড়া কারো কারো একবার ঘুম ভেঙে গেলে পরবর্তীতে আর ঘুম আসে না। তাই একান্ত প্রয়োজন বা বিপদ-আপদ না হ’লে ঘুমের সময়ে ফোন দেয়া থেকে বিরত থাকা কর্তব্য।

৩. সময় ও অবস্থা না জেনে কথা না বলা :

অনেক সময় মানুষ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে কিংবা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করে। যখন ফোন করলে তারা যেমন বিরক্ত হয় তেমনি কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করে। অনেক সময় কথা বলতে না পারা তাদের মনঃকষ্টের কারণ হয়। তাই অবস্থা জেনে কথা শুরু করা উচিত। রাসূল (ছাঃ) বলেন, نِعْمَتَانِ مَغْبُوْنٌ فِيْهِمَا كَثِيْرٌ مِنَ النَّاسِ، الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ ‘এমন দু’টি নে‘মত আছে, যে দু’টোতে অধিকাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তা হচ্ছে, সুস্থতা ও অবসর’।[14] সুতরাং অবস্থা বিবেচনায় কথাবার্তা বলতে হবে। যাতে কারো কথা অন্যের বিরক্তি ও অসুবিধার কারণ না হয়।

৪. বিরতিহীন কল না দেয়া :

কাউকে কল দেয়ার পর রিসিভ না হ’লে কিংবা ম্যাসেজ পাঠালে কোন উত্তর না পেলে কিছু সময় অপেক্ষা করা উচিত। কল রিসিভ না হ’লে কিংবা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর না পেলে লাগাতার কল কিংবা ম্যাসেজ পাঠানো অনুচিত। কারণ যাকে কল বা ম্যাসেজ দেয়া হয়, তিনি কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকলে এ কল ও ম্যাসেজ তার কাজে বিঘ্ন ঘটাবে। বেশি প্রয়োজন হ’লে বিরতি নিয়ে সর্বোচ্চ ২/৩ বার কল দেয়া অথবা ম্যাসেজ পাঠিয়ে যরূরী প্রয়োজনের বিষয় অবহিত করা যায়। অন্যথা পরবর্তীতে যোগাযোগের চেষ্টা করতে হবে।

৫. সালাম বিনীময় না করে সংযোগ বিচ্ছিন করা ঠিক নয় :

মোবাইলে কথা শেষ করার পর একে অপরকে সালাম দিতে হয়। সালামের উত্তর শোনার পূর্বেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া ঠিক নয়। কেননা সালাম দেয়া সুন্নাত আর উত্তর দেয়া ওয়াজিব (নিসা ৪/৮৬)। তাই সালাম দিয়েই কল না কেটে দিয়ে সালামের উত্তর শুনে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা উচিত।

৬. অসংযত কথা না বলা :

মোবাইল ফোনে কিংবা পর্দার আড়ালে কথা বলার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ যথাযথ সতর্কতা ও সংযত হওয়া আবশ্যক। নারী-পুরুষ মাহরাম না হ’লে তাদের কথা বলার প্রয়োজনীয়তা ও ধরন বিবেচনা করা উচিত। কেননা অপরিচিত নারী-পুরুষ পর্দার আড়ালে কিংবা মোবাইল ফোনে কথা বলার ক্ষেত্রে আকর্ষণ সৃষ্টি হ’লে কিংবা ফিৎনার আশংকা থাকলে উভয়ে কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ বলেন,فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِيْ فِيْ قَلْبِهِ مَرَضٌ، ‘তবে পর পুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে কথা বলো না। তাহ’লে যার অন্তরে রোগ আছে, সে প্রলুব্ধ হয়ে পড়বে’ (আহযাব ৩৩/৩২)

৭. মিথ্যা তথ্য পরিবেশন না করা :

মোবাইল ফোনে অবস্থান সম্পর্কে অনেকেই মিথ্যাচার করে থাকেন। অনেক সময় দেখা যায়, কোথায় আছেন প্রশ্ন করা হ’লে, উত্তরে সঠিক স্থানের নাম না বলে অন্য কোন স্থানের নাম বলে। এটিও মিথ্যাচার। আর মিথ্যা বলা কবীরা গোনাহ। সুতরাং এ থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ فَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِى إِلَى الْفُجُوْرِ وَإِنَّ الْفُجُوْرَ يَهْدِى إِلَى النَّارِ وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَكْذِبُ وَيَتَحَرَّى الْكَذِبَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ كَذَّابًا، ‘তোমরা মিথ্যা বর্জন কর। কেননা মিথ্যা পাপাচারের দিকে ধাবিত করে এবং পাপাচার জাহান্নামে নিয়ে যায়। কোন ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা বলতে থাকলে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নিকট তার নাম মিথ্যুক হিসাবেই লেখা হয়’।[15] আরেকটি হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَسْمَاءَ أَنَّ امْرَأَةً قَالَتْ يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّ لِى ضَرَّةً، فَهَلْ عَلَىَّ جُنَاحٌ إِنْ تَشَبَّعْتُ مِنْ زَوْجِى غَيْرَ الَّذِى يُعْطِينِى فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الْمُتَشَبِّعُ بِمَا لَمْ يُعْطَ كَلاَبِسِ ثَوْبَىْ زُورٍ-

আসমা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক মহিলা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার সতীন আছে। তাকে রাগানোর জন্য যদি আমার স্বামী আমাকে যা দেয়নি তা বাড়িয়ে বলি, তাতে কি কোন দোষ আছে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, যা তোমাকে দেয়া হয়নি, তা দেয়া হয়েছে বলা ঐরূপ প্রতারকের কাজ, যে প্রতারণার জন্য দু’প্রস্থ মিথ্যার পোষাক পরিধান করল’।[16]

৮. ফ্রি মিনিটের অপব্যবহার :

মোবাইল কোম্পানী কখনও কখনও ফ্রি মিনিট কিংবা স্বল্প মূল্যে কথা বলার সুযোগ দেয়। এ সুযোগ গ্রহণ করে কোন ব্যক্তির পক্ষে অহেতুক কথা বলে সময় কাটানো কিংবা অনর্থক অর্থ খরচ করা ঠিক নয়। কোম্পানীর পক্ষ থেকে কোন সুযোগ পেলে তা ভালো কথা ও কাজে ব্যবহার করা উচিত। যেমন আত্মীয়দের খোঁজ-খবর নেওয়া, কোন দ্বীনী বিষয়ে জানার প্রয়োজন হ’লে বিজ্ঞ কোন আলেমের নিকট থেকে তা জেনে নেওয়া বা অনুরূপ কোন বৈধ প্রয়োজনে ফ্রি মিনিট বা কোম্পানী প্রদত্ত সুযোগ ব্যবহার করা উচিত। কোন মুমিন ব্যক্তি কখনো অহেতুক কাজে সময় ও অর্থ বিনষ্ট করতে পারে না। কেননা তা অপচয়-অপব্যয়ের শামিল। যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيْرًا، إِنَّ الْمُبَذِّرِيْنَ كَانُوْا إِخْوَانَ الشَّيَاطِيْنِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُوْرًا، ‘আর তুমি মোটেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় কৃতজ্ঞ’ (বনী ইসরাঈল ১৭/২৬-২৭)

৯. কাজের সময় কথা না বলা :

কর্মক্ষেত্রে যথাসাধ্য মোবাইলে কথা বলা থেকে বিরত থাকা উচিত। বিশেষ করে যেসব কাজে হাত ও চিন্তাশক্তি ব্যবহৃত হয়, এ ধরনের কাজের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোনে কথা বলা মোটেই উচিত নয়। যেমন গাড়ি চালানোর সময় কিংবা অপারেশন থিয়েটারে বা ফায়ার সার্ভিসের কাজ করার সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা আদৌ ঠিক নয়। এসব স্থানে ফোন রিসিভ করা একেবারেই অনুচিত। কারণ এসব স্থানে কথা বলায় ঘটে যেতে পারে অনেক বড় দুর্ঘটনা। যাতে জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।

১০. বিনা কারণে মোবাইল সাইলেন্ট বা ভাইব্রেশন না করা :

গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বা কাজের সময় অনেকেই মোবাইল সাইলেন্ট কিংবা ভাইব্রেশন করে রাখেন। এমনটি না করে কল এলার্ট নোটিফিকেশন সেট করে রাখা উচিত। এতে মোবাইল বন্ধ থাকলেও খোলার সঙ্গে সঙ্গে কলকারী ব্যক্তির কাছে নোটিফিকেশন চলে যাবে। এতে কারো কোন চিন্তা থাকে না। কেননা সাইলেন্ট কিংবা ভাইব্রেশন অবস্থায় যদি কেউ কল রিসিভ না করে তবে এটিও একটা চিন্তার কারণ।

১১.বিনা অনুমতিতে কারো মোবাইলের দিকে না তাকানো এবং ম্যাসেজ না দেখা :

কারো মোবাইলের স্ক্রীনে এমন কিছু থাকতে পারে যা অন্যের দেখা ঠিক নয়। সেজন্য মালিকের বিনা অনুমতিতে তার মোবাইলের দিকে তাকানো অথবা তার মোবাইলের ম্যাসেজ পড়া ঠিক নয়। কেননা এতে তার গোপনীয়তা প্রকাশ হয়ে পড়ে।

মোবাইলের ক্ষতিকারক দিক সমূহ :

মোবাইলে যে ক্ষতি হচ্ছে তা টের পাওয়া যায় না। এজন্য একে সাইলেন্ট কিলার বলা যায়। মোবাইলের রেডিয়েশন অত্যন্ত ক্ষতিকারক। মোবাইলে ১৫ থেকে ২০ মিনিট কথা বলার পর মাথা ঝিম ঝিম করে, অস্থিরতা বেড়ে যায়। মোবাইলে অধিক কথা বলার ফলে এক সময় ব্রেইন ক্যান্সার পর্যন্ত হ’তে পারে। বড়দের তুলনায় শিশুদের ক্ষতি বেশি হয়। তাই শিশুদের মোবাইল থেকে দূরে রাখা যরূরী। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে বলে এদের ক্ষতির পরিমাণ বেশি থাকে। রেডিয়েশনের হাত থেকে রক্ষা পেতে মোবাইল বুক পকেটে রাখা ঠিক নয়।

যোগাযোগের ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি ও অভূতপূর্ব অগ্রগতি আনয়নই মোবাইলের সবচেয়ে বড় অবদান। তাই এটি আধুনিককালের একটি অতি প্রয়োজনীয় নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। যে তথ্যের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা, লম্বা সফর, অধিক শ্রম ও অর্থ ব্যয় করতে হ’ত, মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই দু’চার টাকা ব্যয়ে তা অর্জন করা সহজসাধ্য হয়েছে। হাযার মাইলের দূরত্ব মুহূর্তে ঘুচিয়ে দিচ্ছে এ মোবাইল। মোবাইলে ইন্টারনেট সেবা যোগ হওয়ায় এর কার্যকারিতা ও সেবা পরিধি বহুগুণ বিস্তৃত হয়েছে। বলাবাহুল্য যে, ‘দুষ্টের দমনে ও শিষ্টের লালনে’ ব্যবহৃত হচ্ছে এ আধুনিক প্রযুক্তি। আজ এই মোবাইল নামক ক্ষুদ্র যন্ত্রটি যেমন সুকর্মে ব্যবহৃত হচ্ছে তেমনি অপকর্মেও হচ্ছে এবং মন্দ বিস্তারে সমভাবে ভূমিকা রাখছে। মোবাইলের মন্দকর্ম প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হ’লে, সমাজকে চরম মূল্য দিতে হবে। নিম্নে মোবাইলের কয়েকটি নেতিবাচক দিক তুলে ধরা হ’ল।-

১. অবৈধ সম্পর্কের অবাধ বিস্তার :

মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তরুণ-তরুণীরা। এর বদৌলতে অবৈধ প্রেম ও মেকি ভালোবাসার প্রসাদ পুরো তরুণ যুব সমাজের জন্য যেন অবারিত হয়ে পড়েছে। পারিবারিক শাসনের কারণে যারা এতদিন প্রেম বা ভালোবাসার মহার্ঘ ছুঁয়ে দেখতে পারেননি, তারাও আজ তা অনায়াসে ছুঁয়ে দেখতে পারছে। মোবাইলের যে কোন দোকানে গিয়ে রাত ৮-টার পর দাঁড়ালে দেখা যাবে অবৈধ সম্পর্কের তোড়ে ভেসে যাওয়া তরুণ-তরুণীরা গ্লাসের আড়ালে কিংবা দোকানের বাইরে এক/দুই ঘন্টা ধরে নিচু স্বরে কথা বলে যাচ্ছে। কোন কোন দোকানদার গল্পচ্ছলে এ কথা স্বীকার করেন যে, এই তরুণ-তরুণীদের গল্প-প্রেমালাপের বিলেই ওদের দোকান টিকে আছে। অবশ্য দোকানে গিয়ে কথা বলার এখন প্রয়োজন ফুরিয়ে এসেছে। এখন যে যুবক টাকার অভাবে ভালোমত লেখাপড়া করতে পারে না, সেও টিউশনি করে একটি স্মার্ট ফোনের মালিক বরেছে। একটু ঝড়-বৃষ্টিতেই যারা নীড়হারা হয়ে পড়ে তাদেরও দেখা যায় পথ চলতে গিয়ে নিজের মোবাইল সেটে সজোরে লেটেস্ট গান শুনছে। স্বল্প মূল্যের চায়না সেটগুলোর প্রতিটিতে মাল্টিমিডিয়া সুবিধাগুলো অবারিত করে দেয়ায় এমনটি ঘটছে।

এই মোবাইলের কারণে অনেক রক্ষণশীল পরিবারের পর্দানশীল মহিলারাও প্রতারণার শিকার হয়। ভেঙ্গে যায় পরিবার। আর এর অসহায় বলি হয় ঐ পরিবারের অবুঝ শিশু সন্তানরা। এমনকি এতে অনেকের জীবনও ঝরে যায়। বংশের মান-মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়, সৃষ্টি হয় সমাজে বিশৃংখলা।

২. পারিবারিক অশান্তি :

অনেক শান্তিপূর্ণ ও সুখময় দাম্পত্য জীবনে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে এ মোবাইল। ধ্বংস হয়েছে সংসার। স্বামীর প্রবাসে বা কর্মস্থলে অবস্থানের সুযোগে বাড়ির মোবাইলে অনেক বিবাহিতা নারী পরপুরুষের সাথে প্রেমে বা পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন। অনেক ক্ষেত্রে যা দাম্পত্য কলহ এমনকি বিবাহ বিচ্ছেদেরও কারণ হচ্ছে। আবার অনেক পরিবারে বিবাহিত পুরুষ পরনারীর সাথে মোবাইলে খোশালাপ বা প্রেমালাপ করেন। এভাবে শুরু হয় সন্দেহ, অবিশ্বাস ও কলহ। যা বিবাহিত জীবনে ক্যান্সারের মতো এক মারাত্মক ব্যাধির রূপ পরিগ্রহ করে। সমাজে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে।

৩. অপরাধের বিস্তার :

সমাজে যারা আঁধার জগতের বাসিন্দা, ক্রাইম জগতেই যাদের সতত বিচরণ, যারা অনৈতিক, অসামাজিক কাজে অহরহ জড়িত হয়, মোবাইল তাদের জন্য এক মোক্ষম হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। পত্রিকায় প্রতিদিনই খবর আসছে মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীরা কি করে নিজেদের মধ্যে মোবাইলে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। গ্রেফতারি পরোয়ানায় থাকা অপরাধী যেমন মোবাইলের মাধ্যমে তথ্য পেয়ে মুহূর্তেই নিজেকে আড়াল করতে পারছে, তেমনি কারাগারে বন্দি অনেক দাগী অপরাধী জেলখানার চার দেওয়ালের মধ্যে বসেই তাদের চাঁদাবাজি ও অপরাধ কর্ম চালিয়ে নিতে পারছে তাদের অনুচর বা অধীনস্তদের মাধ্যমে। এছাড়াও মোবাইলের মাধ্যমে মানুষকে হুমকি-ধমকি দেয়ার ঘটনা তো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

৪. অশ্লীলতার বিস্তার :

মোবাইলের মাধ্যমে অশ্লীল ছবি, ভিডিও ইত্যাদি আদান-প্রদান ও প্রদর্শিত হচ্ছে। ইন্টারনেট, ভার্চুয়াল ও সাইবার ক্রাইম সম্পর্কে যাদের ন্যুনতম জ্ঞান আছে, তারা জানে এ দু’টোতে অশ্লীলতা ও চরিত্র বিধ্বংসী কত কিছুই না সহজলভ্য। আগে সিনেমা হলে কিংবা ডিসের মাধ্যমে অশ্লীল ছবি প্রদর্শিত হ’ত। আর বর্তমানে প্রতিটি মোবাইল একেকটি সিনেমা হল। ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ার টেবিল, আবাসিক হলের নিজস্ব কক্ষ, চলাচলের ক্ষেত্রে যানবাহনে, বিনোদন কেন্দ্রে অবসর সময় কাটাতে সবখানেই সুযোগ আছে মোবাইলে অশ্লীল ছবি, ভিডিও, গান ইত্যাদি দেখার। এসব অশ্লীলতা হতে নিজেদের বিরত রাখা আবশ্যক।

৫. গান-বাদ্যের বিস্তার :

মোবাইল এখন পুরোপুরি গানের টেপ রেকর্ডার বা অডিও-ভিডিও প্লেয়ার। অধিকাংশ মানুষ এখন মোবাইলে রেকর্ড করা গান বা ইন্টারনেট চালু করে গান শোনে। কখনও হেডফোন লাগিয়ে, কখনও হেড ফোন ছাড়া উচ্চ আওয়াজে গান-বাজনা শোনে। অথচ গান-বাদ্যে অংশগ্রহণ করা বা শোনা উভয়ই গুনাহের কাজ। অশ্লীল গান আরো অধিক পাপের বিষয়। অধুনা কোন কোন মোবাইল অপারেটর গান-বাদ্যের এ পাপকে আরো বেশি অপরিহার্য করে তুলেছে। ওয়েলকাম টিউন-এর নামে আউটগোয়িংয়ে বাধ্যতামূলক ভাবে সরাসরি গান-বাদ্য শোনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তেমনি অনেক মোবাইলে এমন সিস্টেম করা আছে যে, সেখান থেকে পাঠানো কল (ইনকামিং) রিসিভ করা মাত্র কয়েক সেকেন্ড গান শুনানো হয়, এরপর কথা শুরু হয়। অনুরূপভাবে একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির অফিসে কোন তথ্যের জন্য ফোন করলেই প্রথমে অর্ধ মিনিট বাদ্য-বাজনা শুনিয়ে দেয়া হয়। যারা কোনদিন স্বেচ্ছায় গান-বাজনা শুনেন না এবং নিজেকে পাপ থেকে রক্ষা করেছেন, তারাও এ পর্যায়ে মোবাইলে গান বা মিউজিক শুনতে একরকম বাধ্যই হন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আল্লাহর পবিত্র ঘর মসজিদে পর্যন্ত গানের রিংটোন বেজে উঠে। মোবাইল বন্ধ না করে ছালাত শুরু করলে, কল এসে পড়লে গানের আওয়াজ শুধু এর বাহকেরই নয়; বরং পার্শ্ববর্তী সকল মুছল্লীর ছালাতে ব্যঘাত ঘটায়।

মোবাইলের অপকারিতা রোধে কিছু প্রস্তাবনা :

১. তরুণ শিক্ষার্থীদের মোবাইল না দেওয়া :

শিক্ষার্থীদের হাতে মোবাইল না দিয়ে বই-খাতায় তাদের মনোযোগী করে তোলা আবশ্যক। এতে তাদের মন ও মনন কেবল শিক্ষার্জনের মধ্যে থাকবে। তারা অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকবে।

২. স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা অমলান রাখতে :

স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পরের প্রতি অধিক ভালোবাসাপরায়ণ হ’তে হবে। ধর্মীয় দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে দ্বিতীয় কোন পুরুষ বা নারীর মায়াজালে আবদ্ধ হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ইসলামের পর্দা ব্যবস্থা মেনে চলা খুবই আবশ্যক। পরপুরুষ বা পরনারীর সাথে কথা বলার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

৩. সমাজের অবক্ষয় ও অপরাধ রোধে :

আড়িপাতা আইন কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করা দরকার। বাংলাদেশ, আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক দেশে আড়িপাতা আইন নিয়ে অনেক বিতর্ক বা ভিন্ন মত রয়েছে। এক্ষেত্রে মানুষের প্রাইভেসি নষ্ট হয়ে যাবে এ যুক্তির চেয়ে অসৎ লোকদের প্রাইভেসি নিয়ে বেশি চিন্তা করা উচিত। মোবাইল ফোন সংযোগ ক্রয়-বিক্রয় ও হস্তান্তরের প্রশ্নে ন্যাশনাল আইডি কার্ডের ফটোকপি ও রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৪. গান-বাদ্য, ফটো প্রভৃতি পাপকর্ম রোধে :

মোবাইল কোম্পানিকে ইসলাম সম্মত বৈধ রিংটোনের সহজ ব্যবস্থা করতে হবে এবং অবৈধ গান-বাদ্যের রিংটোনের ব্যবহার থেকে মুসলমানদেরকে হেফাযতের ব্যবস্থা নিতে হবে। অশ্লীল ও অবৈধ সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ে আল্লাহভীতি ও তাকওয়ার চর্চা বাড়াতে হবে। মসজিদের ইমাম ও খত্বীবগণ এ ব্যাপারে মুছল্লীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন।

পরিশেষে বলব, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে সকল অপকারী আচরণ ও অনিষ্টকর সামগ্রী থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দিন। প্রয়োজনীয় সব কিছুর ইতিবাচক ও উপকারী ব্যবহার সহজ করে দিন-আমীন!


[1]. ছহীহুল জামে হা/৬১২২; ছহীহাহ হা/৮১৬-এর আলোচনা দ্র.।

[2]. আবূদাঊদ হা/৫২০০; মিশকাত হা/৪৬৫০; ছহীহাহ হা/১৮৬।

[3]. আবূদাঊদ হা/৫২০৮; তিরমিযী হা/২৭০৬; মিশকাত হা/৪৬৬০; ছহীহাহ হা/১৮৩।

[4]. বুখারী হা/৬২৫০; মুসলিম হা/২১৫৫।

[5]. ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭৬, কলহ-বিপর্যয় চলাকালে জিহবা সংযত রাখা অনুচ্ছেদ; তিরমিযী হা/২৩১৭-১৮; মিশকাত হা/৪৮৩৯; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৮৮১, সনদ ছহীহ।

[6]. মুসলিম হা/১৭১৫; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৪৪২।

[7]. বুখারী হা/৩৫৬৭; মিশকাত হা/৫৮১৫।

[8]. বুখারী হা/৩৫৬৮; মুসলিম হা/২৪৯৩; মিশকাত হা/৫৮১৫

[9]. বুখারী হা/৯৫; মিশকাত হা/২০৮।

[10]. বুখারী হা/১২৭, তা‘লীক।

[11]. তিরমিযী হা/১৯৫৬; মিশকাত হা/১৯১১; ছহীহাহ হা/৫৭২।

[12]. মুসলিম হা/২৬২৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৭২৪৫।

[13]. মুসলিম তা‘লীক; রিয়াযুছ ছালেহীন হা/৩৬০।

[14]. বুখারী হা/৬৪১২; মিশকাত হা/৫১৫৫।

[15]. আহমাদ হা/৪১০৮; আবূদাঊদ হা/৪৯৮৯, সনদ ছহীহ।

[16]. বুখারী হা/৫২১৯; মুসলিম হা/২১৩০; আহমাদ হা/২৬৯৮৭।






বিষয়সমূহ: শিষ্টাচার
তাহরীকে জিহাদ : আহলেহাদীছ ও আহনাফ (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ঈদে মীলাদুন্নবী - আত-তাহরীক ডেস্ক
হাদীছ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পরিক্রমা (৩য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মুহাসাবা (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত (৯ম কিস্তি) - মুযাফফর বিন মুহসিন
ইসলামে ভ্রাতৃত্ব (৫ম কিস্তি) - ড. এ এস এম আযীযুল্লাহ
যাকাত ও ছাদাক্বা - আত-তাহরীক ডেস্ক
ধন-সম্পদ : মানব জীবনে প্রয়োজন, সীমালংঘনে দহন (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পদ্ধতিতে পানি পান এবং আধুনিক বিজ্ঞান - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
এক নযরে হজ্জ - আত-তাহরীক ডেস্ক
সমাজ সংস্কারে ইমামগণের ভূমিকা - ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
কুরআন শিক্ষা ও তেলাওয়াতের ফযীলত - ইহসান ইলাহী যহীর
আরও
আরও
.