ভূমিকা :
প্রাক ইসলামী যুগে দাস প্রথার প্রচলন ছিল। ইসলাম আগমনের পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দাস প্রথাকে বিলুপ্ত না করলেও, বিভিন্নভাবে এই প্রথাকে নিরুৎসাহিত করেছেন এবং দাস মুক্ত করার ফযীলত বর্ণনা করেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন পাপের কাফ্ফারা আদায়ের জন্য দাস মুক্ত করার বিবিধ পন্থা ইসলামী শরী‘আতে বিধিবদ্ধ আছে। যেমন- হত্যা, কসম ভঙ্গ, যিহার এবং রামাযান মাসে দিনের বেলায় সহবাস প্রভৃতির কাফ্ফারা আদায়ের অন্যতম উপায় হ’ল দাস মুক্ত করা।[1] গোলাম আযাদ বা দাস মুক্ত করা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভের অন্যতম একটি মাধ্যম। কিন্তু এযুগের কোন কোটিপতি ব্যক্তিও যদি দাস মুক্ত করার এই ফযীলতপূর্ণ আমল সম্পাদনের ইচ্ছা করেন, তার সে ইচ্ছা পূরণ করার সুযোগ নেই বললেই চলে। কেননা বর্তমান যুগে দাস প্রথার প্রচলন নেই। কিন্তু মহান আল্লাহ ইসলামী শরী‘আতের এমন কিছু আমলের বিধান দিয়েছেন, যা দাস মুক্ত করার ন্যায় ফযীলতপূর্ণ। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা সে বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।-
দাস মুক্ত করার ফযীলত :
গোলাম আযাদ করা বা দাসমুক্ত করার অনেক ফযীলত রয়েছে। এ কাজের সবচেয়ে বড় ফযীলত হ’ল জাহান্নাম থেকে মুক্তি। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,مَنْ أَعْتَقَ رَقَبَةً مُؤْمِنَةً، أَعْتَقَ اللهُ بِكُلِّ عُضْوٍ مِنْهُ عُضْوًا مِّنَ النَّارِ، حَتَّى يُعْتِقَ فَرْجَهُ بِفَرْجِهِ، ‘যে ব্যক্তি কোন মুমিন দাসকে আযাদ করবে, আল্লাহ তা‘আলা এর প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে আযাদকারীর প্রতিটি অঙ্গকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দিবেন। এমনকি এর (দাসের) লজ্জাস্থানের বিনিময়ে তার (মুক্তকারীর) লজ্জাস্থানকে মুক্তি দিবেন’।[2] অপর বর্ণনায় তিনি বলেন, مَنْ أَعْتَقَ رَقَبَةً مُؤْمِنَةً كَانَتْ فِدَاءَهُ مِنَ النَّارِ، ‘যে ব্যক্তি একজন মুমিন দাসকে আযাদ করে দিবে, এর বিনিময়ে তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত করে দেওয়া হবে’।[3]
ছাহাবায়ে কেরাম এই হাদীছগুলো থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গোলাম আযাদ করার জন্য পরস্পর প্রতিযোগিতা করতেন। নাফে‘ (রহঃ) বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) তার জীবদ্দশায় একশত দাস আযাদ করেছিলেন।[4] অনুরূপভাবে সচ্ছল ছাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর পথে নির্যাতিত গোলাম ছাহাবীদেরদে কিনে আযাদ করে দিতেন। কল্পনায় নিজেকে একজন পরাধীন ক্রীতদাস ভেবে সেই দাস প্রথা প্রচলিত সমাজের দিকে নযর দিলে এর গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।
দাস মুক্ত করার ন্যায় ফযীলতপূণ আমল সমূহ
১. কা‘বা ঘর তাওয়াফ করা :
উমাইর (রহঃ) বলেন, ইবনু ওমর (রাঃ) ভিড় ঠেলে হ’লেও হাজারে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানীর নিকটে যেতেন (তা স্পর্শ করার জন্য)। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অন্য কোন ছাহাবীকে আমি এরূপ করতে দেখিনি। আমি বললাম,يَا أَبَا عَبْدِ الرَّحْمَنِ، إِنَّكَ تُزَاحِمُ عَلَى الرُّكْنَيْنِ زِحَامًا مَا رَأَيْتُ أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُزَاحِمُ عَلَيْهِ ‘হে আবূ আব্দুর রহমান! আপনি ভিড় ঠেলে হ’লেও এই দুই রুকনে গিয়ে পৌঁছেন, কিন্তু আমি তো রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অন্য কোন ছাহাবীকে এভাবে ভিড় ঠেলে সেখানে যেতে দেখিনি। তিনি বললেন, আমি এরূপ কেন করব না? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে আমি বলতে শুনেছি,إِنَّ مَسْحَهُمَا كَفَّارَةٌ لِلْخَطَايَا وَسَمِعْتُهُ، يَقُولُ: مَنْ طَافَ بِهَذَا البَيْتِ أُسْبُوعًا فَأَحْصَاهُ كَانَ كَعِتْقِ رَقَبَةٍ وَسَمِعْتُهُ يَقُولُ: لَا يَضَعُ قَدَمًا وَلَا يَرْفَعُ أُخْرَى إِلَّا حَطَّ اللهُ عَنْهُ خَطِيْئَةً وَكَتَبَ لَهُ بِهَا حَسَنَةً، ‘এই দুইটি রুকন স্পর্শ করলে গুনাহসমূহের কাফ্ফারা হয়ে যায়। আমি তাঁকে আরো বলতে শুনেছি যে, সঠিকভাবে যদি কোন লোক বায়তুল্লাহ সাতবার তাওয়াফ করে, তাহ’লে তার জন্য একটি ক্রীতদাস আযাদ করার সমান নেকী হবে’। আমি আরো বলতে শুনেছি যে, যখনই কোন ব্যক্তি তাওয়াফ করতে গিয়ে এক পা রাখে এবং অপর পা তোলে, তখন আল্লাহ তার একটি করে গুনাহ মাফ করে দেন এবং একটি করে ছওয়াব লিখে দেন’।[5] সুতরাং মুমিন বান্দাদের কর্তব্য হ’ল নেকী লাভের এই সুযোগ হাতছাড়া না করা। কেননা অনেকে এমন আছেন, যারা হজ্জ বা ওমরাহ করতে গিয়ে ঘোরাঘুরি, অধিক খানাপিনা এবং বাযারে কেনাকাটায় প্রচুর সময় অপচয় করেন। মহান আল্লাহ আমাদের নেকীর কাজে অগ্রগামী হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন।
২. তাওয়াফের পর দু’রাক‘আত ছালাত আদায় ও ছাফা-মারওয়ায় সাঈ করা :
ছাফা ও মারওয়া দু’টি পাহাড়ের নাম, যা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত (বাক্বারাহ ২/১৫৮)। হজ্জের অন্যতম একটি রুকন হ’ল ছাফা-মারওয়ায় সাঈ করা, যার মাধ্যমে গোলাম আযাদ করার নেকী লাভ করা যায়। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, আমি নবী কারীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,وَأَمَّا رَكْعَتَاكَ بَعْدَ الطَّوَافِ كَعِتْقِ رَقَبَةٍ مِنْ بَنِي إِسْمَاعِيلَ وَأَمَّا طَوَافُكَ بِالصَّفَا وَالْمَرْوَةِ بَعْدَ ذَلِكَ كَعِتْقِ سَبْعِيْنَ رَقَبَةً، ‘জেনে রাখ! তওয়াফের পর দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করার নেকী ইসমাঈলের বংশ থেকে একজন দাস আযাদ করার মত। এরপর ছাফা-মারওয়ায় সাঈ করার ছওয়াব সত্তর জন দাস মুক্ত করার সমান’।[6]
৩. আল্লাহর পথে জিহাদ করা :
গোলাম আযাদের নেকী লাভের অন্যতম উপায় হ’ল আল্লাহর পথে জিহাদ করা। আমর ইবনু আবাসাহ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,مَنْ رَمَى الْعَدُوَّ بِسَهْمٍ، فَبَلَغَ سَهْمُهُ الْعَدُوَّ، أَصَابَ أَوْ أَخْطَأَ، فَعَدْلُ رَقَبَةٍ، ‘যে ব্যক্তি শত্রুবাহিনীর প্রতি একটি তীর নিক্ষেপ করল। অতঃপর সেই তীর শত্রুর নিকটে পৌঁছে ঠিক লক্ষ্যে আঘাত হানুক বা লক্ষ্যচ্যুত হোক, এর বিনিময়ে একজন দাস মুক্ত করার নেকী রয়েছে’।[7] অপর বর্ণনায় তিনি বলেন,مَنْ رَمَى بِسَهْمٍ فِي سَبِيلِ اللهِ فَهُوَ لَهُ عَدْلُ مُحَرَّرٍ، ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে একটি তীর নিক্ষেপ করবে, তার জন্য একটি গোলাম আযাদের নেকী রয়েছে’।[8]
৪. ঋণ দেওয়া এবং পথহারাকে পথ দেখানো :
বারা ইবনু আযেব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ مَنَحَ مِنْحَةَ وَرِقٍ أَوْ مِنْحَةَ لَبَنٍ أَوْ أَهْدَى زُقَاقاً فَهُوَ كَعِتْقِ نَسَمَةٍ، ‘যে ব্যক্তি একবার দহন করা দুধ দান করে অথবা টাকা-পয়সা ধার দেয় অথবা পথহারা ব্যক্তিকে সঠিক পথ দেখায়, তার জন্য রয়েছে একটি গোলাম মুক্ত করার সমপরিমাণ ছওয়াব’।[9] আলোচ্য হাদীছে ঋণ বলতে কর্যে হাসানাহ এবং পথহারা বলতে রাস্তা ভুলে যাওয়া ব্যক্তিকে সঠিক পথের সন্ধান দেওয়া, অন্ধ ব্যক্তিকে পথ দেখানো প্রভৃতি বুঝানো হয়েছে।
৫. অসহায় আত্মীয়-স্বজনদেরকে দান করা :
আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং তাদের জন্য দান করা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম একটি মাধ্যম, যার মাধ্যমে গোলাম আযাদ করার নেকী অর্জন করা যায়। একবার উম্মুল মু’মিনীন মায়মূনা বিনতে হারেছ (রাঃ) নবী কারীম (ছাঃ)-এর অনুমতি না নিয়ে নিজের দাসীকে আযাদ করে দেন। তারপর তার ঘরে রাসূল (ছাঃ)-এর অবস্থানের দিন তিনি বললেন, أَشَعَرْتَ يَا رَسُولَ اللهِ أَنِّي أَعْتَقْتُ وَلِيدَتِي ‘হে রাসূল (ছাঃ)! আপনি কি জানেন আমি আমার দাসীকে আযাদ করে দিয়েছি? তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, أَوَفَعَلْتِ؟ ‘তুমি কি তাই করেছ?’ মায়মূনা (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, أَمَا إِنَّكِ لَوْ أَعْطَيْتِهَا أَخْوَالَكِ كَانَ أَعْظَمَ لِأَجْرِكِ، ‘শোন! যদি তুমি তোমার মামাদেরকে এটা দান করতে তাহ’লে তোমার জন্য তা অধিক নেকীর কাজ হ’ত’।[10] এই হাদীছের ব্যাখ্যায় ইবনু বাত্ত্বাল (রহঃ) বলেন, أن صلة الرحم أفضل من العتق، ‘দাস মুক্ত করার চেয়েও ফযীলতপূর্ণ আমল হ’ল আত্মীয়তার সুসম্পর্ক বজায় রাখা’।[11]
৬. পরিবারের জন্য খরচ করা :
সাধারণ দান-ছাদাক্বার চেয়ে উত্তম দান হ’ল পরিবার-পরিজনের জন্য খরচ করা। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,دِينَارٌ أَنْفَقْتَهُ فِي سَبِيلِ اللهِ وَدِينَارٌ أَنْفَقْتَهُ فِي رَقَبَةٍ، وَدِينَارٌ تَصَدَّقْتَ بِهِ عَلَى مِسْكِيْنٍ، وَدِينَارٌ أَنْفَقْتَهُ عَلَى أَهْلِكَ، أَعْظَمُهَا أَجْرًا الَّذِي أَنْفَقْتَهُ عَلَى أَهْلِكَ، ‘কোন একটি দীনার তুমি আল্লাহর পথে ব্যয় করেছ, একটি দীনার তুমি ব্যয় করেছ ক্রীতদাসকে মুক্ত করার জন্য, একটি দীনার তুমি ছাদাক্বাহ করেছ মিসকীনের জন্য এবং একটি দীনার তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করেছ। এর মাঝে ছওয়াবের দিক দিয়ে সর্বোত্তম হ’ল সেটি, যা তুমি তোমার পরিবারের জন্য খরচ করেছ’।[12]
ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেন,فيه دليل على أن إنفاق الرجل على أهله أفضله من الإنفاق في سبيل الله، ومن الإنفاق في الرقاب ومن التصدق على المساكين، ‘এই হাদীছে দলীল রয়েছে যে, আল্লাহর পথে ব্যয় করা, দাস মুক্তির জন্যে দান করা এবং মিসকীনদেরকে ছাদাক্বাহ করার চেয়েও কোন ব্যক্তির জন্য উত্তম কাজ হ’ল পরিবার-পরিজনের জন্য খরচ করা’।[13]
৭. শ্রমিকের কাজে সাহায্য করা এবং বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা :
ইসলাম ছোট-বড়, ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকলকে পরস্পর সহযোগিতা করতে অনুপ্রাণিত করেছে। আবূ যার (রাঃ) বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
يَا رَسُولَ اللهِ، أَيُّ الْأَعْمَالِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: الْإِيمَانُ بِاللهِ وَالْجِهَادُ فِي سَبِيلِهِ قَالَ: قُلْتُ: أَيُّ الرِّقَابِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: أَنْفَسُهَا عِنْدَ أَهْلِهَا وَأَكْثَرُهَا ثَمَنًا قَالَ: قُلْتُ: فَإِنْ لَمْ أَفْعَلْ؟ قَالَ: تُعِينُ صَانِعًا أَوْ تَصْنَعُ لِأَخْرَقَ قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَرَأَيْتَ إِنْ ضَعُفْتُ عَنْ بَعْضِ الْعَمَلِ؟ قَالَ: تَكُفُّ شَرَّكَ عَنِ النَّاسِ فَإِنَّهَا صَدَقَةٌ مِنْكَ عَلَى نَفْسِكَ.
‘হে আল্লাহর রাসূল! কোন আমল সর্বোত্তম? তিনি বললেন, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং তাঁর পথে জিহাদ করা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোন ধরনের গোলাম আযাদ করা উত্তম? তিনি বললেন, যে গোলামের মূল্য অধিক এবং যে গোলাম তার মনিবের কাছে অধিক আকর্ষণীয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমি যদি এটা করতে না পারি? তিনি বললেন, তাহ’লে কাজের লোককে (তার কাজে) সাহায্য করবে কিংবা বেকারকে কাজের সংস্থান করে দিবে। আমি (আবারও) বললাম, যদি আমি এটাও করতে না পারি? তিনি বললেন, ‘তাহ’লে মানুষকে তোমার অনিষ্টতা থেকে মুক্ত রাখবে। বস্ত্ততঃ এটা তোমার নিজের জন্য তোমার পক্ষ থেকে ছাদাক্বাহ’।[14] বোঝা গেল, শ্রমিক বা কাজের লোককে তার কাজে সহযোগিতা করা এবং অদক্ষ ও কর্মহীন লোকের জন্য কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া দাস মুক্ত করার ন্যায় মর্যাদাপূর্ণ আমল।
৮. অপরকে খানাপিনা করানো এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ :
দাস মুক্ত করার নেকী লাভের অন্যতম বিকল্প মাধ্যম হ’ল ক্ষুধার্তকে খাদ্য খাওয়ানো, তৃষ্ণার্তকে পান করানো এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা। বারা ইবনু আযেব (রাঃ) বলেন, একদিন এক গ্রাম্য লোক রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল,يَا رَسُولَ اللهِ عَلِّمْنِي عَمَلًا يُدْخِلُنِي الْجَنَّةَ، ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাকে এমন একটি আমলের কথা বলে দিন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। দারা-কুৎনীর বর্ণনায় এসছে, সে বলল,دُلَّنِي عَلَى عَمَلٍ يُقَرِّبُنِي مِنَ الْجَنَّةِ وَيُبَاعِدُنِي مِنَ النَّارِ، ‘আমাকে এমন একটি আমলের সন্ধান দিন, যা আমাকে জান্নাতের নিকটবর্তী করবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে।[15] তিনি বললেন,لَئِنْ كُنْتَ أَقَصَرْتَ الْخُطْبَةَ، لَقَدْ أَعْرَضْتَ الْمَسْأَلَةَ. أَعْتِقِ النَّسَمَةَ، وَفُكَّ الرَّقَبَةَ، قَالَ: أَوَلَيْسَا وَاحِدًا؟ قَالَ: لَا، عِتْقُ النَّسَمَةِ: أَنْ يَنْفَرِدَ بِعِتْقِهَا، وَفُكُّ الرَّقَبَةِ أَنْ يُعِينَ فِي ثَمَنِهَا، وَالْمِنْحَةُ الْوَكُوفُ، أَظُنُّهُ قَالَ: وَالْفَيْءُ عَلَى ذِي الرَّحِمِ الظَّالِمِ، فَإِنْ لَمْ تُطِقْ ذَلِكَ، فَأَطْعِمِ الْجَائِعَ، وَاسْقِ الظَّمْآنَ، وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ، وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ، فَإِنْ لَمْ تُطِقْ ذَلِكَ، فَكُفَّ لِسَانَكَ إِلَّا مِنْ خَيْرٍ، ‘যদিও তুমি অল্প কথায় বলে ফেললে, কিন্তু তুমি ব্যাপক বিষয় জানতে চেয়েছ। তুমি একটি প্রাণী মুক্ত কর এবং গোলাম মুক্ত কর। সে বলল, এ কাজ দু’টি কি একই নয়? তিনি বললেন, (অবশ্যই) না। কেননা প্রাণী মুক্ত করার অর্থ হ’ল একাকী একটি প্রাণ মুক্ত করা, আর গোলাম মুক্ত করার অর্থ হ’ল তার মুক্তিপণের মাধ্যমে সাহায্য করা। অধিক দুগ্ধদানকারী প্রাণী দান করা এবং অত্যাচারী আত্মীয়-স্বজনের প্রতি দয়াশীল হওয়া। যদি তুমি এসব কাজ করতে সক্ষম না হও, তাহ’লে ক্ষুধার্তকে খাদ্য খাওয়াও এবং তৃষ্ণার্তকে পান করাও। সৎকর্মের আদেশ দাও এবং মন্দ কাজে বাধা দাও। আর যদি তুমি এ কাজ করতেও অক্ষম হও, তাহ’লে উত্তম কথোপকথন ছাড়া তোমার জিহবাকে সংযত রাখ’।[16]
৯. মাগরিব ও ফজর ছালাতের পর দশ বার তাহ্লীল বা কালেমা তাওহীদ পাঠ করা :
যে ব্যক্তি মাগরিব ও ফজরের ফরয ছালাতের পর দশবার করে বিশেষ তাহলীল পাঠ করে, তার আমলনামায় দশজন মুমিন ক্রীতদাস মুক্ত করার নেকী লিপিবদ্ধ করা হয়। উমারাহ ইবনু শাবীব আস-সাবাঈ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ قَالَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الـمُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ، يُحْيِي وَيـُمِيتُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ عَشْرَ مَرَّاتٍ عَلَى إِثْرِ الـمَغْرِبِ بَعَثَ اللهُ لَهُ مَسْلَحَةً يَحْفَظُونَهُ مِنَ الشَّيْطَانِ حَتَّى يُصْبِحَ، وَكَتَبَ اللهُ لَهُ بِهَا عَشْرَ حَسَنَاتٍ مُوجِبَاتٍ، وَمَحَا عَنْهُ عَشْرَ سَيِّئَاتٍ مُوبِقَاتٍ، وَكَانَتْ لَهُ بِعَدْلِ عَشْرِ رِقَابٍ مُؤْمِنَاتٍ، ‘যে ব্যক্তি মাগরিবের ছালাতের পর দশবার বলবে, ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহূ লা-শারীকা লাহূ লাহুল মুল্কু ওয়া লাহুল হাম্দু ইয়ুহ্ঈ ওয়া ইয়ুমীতু ওয়াহুয়া ‘আলা-কুল্লি শাইয়িন ক্বদীর’ (আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ্ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই, সকল রাজত্ব তাঁর এবং তিনিই সকল প্রশংসার অধিকারী, তিনিই জীবন দান করেন ও মৃত্যু দেন এবং প্রতিটি জিনিসের উপর তিনিই মহা ক্ষমতাশালী)’, তাহ’লে আল্লাহ তার (পাঠকারীর) নিরাপত্তার জন্য একদল ফেরেশতা পাঠান, যারা তাকে শয়তানের ক্ষতি হ’তে ভোর পর্যন্ত নিরাপত্তা দান করেন, তার জন্য (আল্লাহর অনুগ্রহ) আবশ্যক করার ন্যায় দশটি নেকী লিখে দেন, তার দশটি ধ্বংসাত্মক গুনাহ মুছে দেন এবং তার জন্য দশজন ঈমানদার দাস মুক্ত করার সমপরিমাণ ছওয়াব রয়েছে’।[17]
১০. প্রতিদিন একশত বার কালেমা তাওহীদ পাঠ করা :
আবূ হুরায়ারা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ قَالَ: لاَ إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الـمُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، فِي يَوْمٍ مِائَةَ مَرَّةٍ، كَانَتْ لَهُ عَدْلَ عَشْرِ رِقَابٍ، وَكُتِبَتْ لَهُ مِائَةُ حَسَنَةٍ، وَمُحِيَتْ عَنْهُ مِائَةُ سَيِّئَةٍ، وَكَانَتْ لَهُ حِرْزًا مِنَ الشَّيْطَانِ يَوْمَهُ ذَلِكَ حَتَّى يُمْسِيَ، وَلَمْ يَأْتِ أَحَدٌ بِأَفْضَلَ مِمَّا جَاءَ بِهِ، إِلَّا أَحَدٌ عَمِلَ أَكْثَرَ مِنْ ذَلِكَ، ‘যে ব্যক্তি এই দো‘আটি দিনে একশ’ বার পড়বে যে, ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্দাহূ লা-শারীকা লাহূ লাহুল মুল্কু ওয়া লাহুল হাম্দু ওয়াহুয়া ‘আলা-কুল্লি শাইয়িন ক্বদীর’, তাহ’লে তার জন্য দশটি গোলাম আযাদ করার সমপরিমাণ নেকী অর্জিত হবে, তার জন্য একশটি নেকী লিপিবদ্ধ করা হবে এবং একশটি গুনাহ মোচন করা হবে। আর সেই দিনের সন্ধ্যা অবধি এই দো‘আটি তার জন্য শয়তান থেকে বাঁচার রক্ষাকবচ হবে এবং তার চেয়ে সেদিন কেউ উত্তম আমল করতে পারবে না। তবে তার কথা স্বতন্ত্র, যে এর চেয়ে আরো বেশী আমল করে’।[18]
১১. একশত বার সুবহানাল্লাহ, আল্হামদুলিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার পাঠ করা :
মহিলা ছাহাবী উম্মু হানী (রাঃ) বলেন, একবার আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললাম,يَا رَسُولَ اللهِ، دُلَّنِي عَلَى عَمَلٍ فَإِنِّي قَدْ كَبِرْتُ وَضَعُفْتُ وَبَدُنْتُ، ‘হে আল্লাহর
রাসূল (ছাঃ)! আমাকে একটা আমলের কথা বলে দিন। কেননা এখন আমি তো বৃদ্ধ হয়ে পড়েছি, দুর্বল হয়ে গেছি এবং আমার দেহও ভারী হয়ে গেছে। তখন তিনি (ছাঃ) বলেন, كَبِّرِي اللهَ مِائَةَ مَرَّةٍ، وَاحْمَدِي اللهَ مِائَةَ مَرَّةٍ، وَسَبِّحِي اللهَ مِائَةَ مَرَّةٍ خَيْرٌ مِنْ مِائَةِ فَرَسٍ مُلْجَمٍ مُسْرَجٍ فِي سَبِيلِ اللهِ، وَخَيْرٌ مِنْ مِائَةِ بَدَنَةٍ، وَخَيْرٌ مِنْ مِائَةِ رَقَبَةٍ ‘তুমি একশত বার আল্লাহু আকবার, একশত বার আল-হামদুলিল্লাহ এবং একশত বার সুবহা-নাল্লাহ পড়। এটা তোমার জন্য জিনপোষ ও লাগামসহ একশত ঘোড়া আল্লাহর পথে (জিহাদে) দান করার চেয়ে উত্তম, একশত উটের চেয়ে উত্তম এবং একশত গোলাম আযাদ করার চেয়ে উত্তম’।[19] বর্তমান যুগে যদি দাস প্রথা থাকত, তাহ’লে একশটি দাস আযাদ করতে কোটি কোটি টাকার প্রয়োজন হ’ত। অথচ পাঁচ-সাত মিনিটের মাধ্যেই আমরা এই আমলটি করতে পারি।
উপসংহার :
সম্মানিত পাঠক! যে সকল আমল সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল, তা সম্পাদন করা আমাদের কাছে আদৌ কোন কঠিন কাজ নয়। কিন্তু আবহেলা ও অলসতার দরূন নেকীর ভান্ডার সমৃদ্ধ করার এই সুযোগগুলো আমাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। কোন কোন আমল একটু ইচ্ছা করলেই স্বল্প সময়ে করা সম্ভব হয়। তাই আসুন! নেকী লাভের সকল সুযোগকে আমরা যথাযথভাবে কাজে লাগাই এবং উপরোক্ত আমলসমূহ সম্পাদনের মাধ্যমে গোলাম আযাদ করার নেকী অর্জনে ব্রতী হই। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!
আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
এম.এ (অধ্যয়নরত), আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. হত্যার কাফ্ফারা (সূরা নিসা ৪/৯২), যিহারের কাফ্ফারা (মুজাদালাহ ৫৮/০৩), কসম ভঙ্গের কাফ্ফারা (মায়েদা ৫/৮৯), রামাযানে দিনের বেলায় সহবাসের কাফ্ফারা (বুখারী হা/১৯৩৬; মুসলিম হা/১১১), দাসকে প্রহার করার কাফ্ফারা (মুসলিম হা/১৬৫৭; আবূদাঊদ হা/৫১৬৮) প্রভৃতি।
[2]. মুসলিম হা/১৫০৯; তিরমিযী হা/১৫৪১; ইরওয়াউল গালীল হা/১৭৪২।
[3]. আবূদাঊদ হা/৩৯৬৬, সনদ ছহীহ।
[4]. ছিফাতুছ ছাফওয়া, ১/২৪০ পৃ.।
[5]. তিরমিযী হা/৯৫৯; মিশকাত হা/২৫৮০, সনদ ছহীহ।
[6]. মুসনাদে বায্যার হা/৬১৭৭; ছহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/১১১২, সনদ হাসান।
[7]. ইবনু মাজাহ হা/২৮১২; ছহীহুত তারগীব হা/১২৮৬, সনদ ছহীহ্।
[8]. তিরমিযী হা/১৬৩৮; নাসাঈ হা/৩১৪৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৬২৬।
[9]. তিরমিযী হা/১৯৫৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৫৫৯, ছহীহ হাদীছ।
[10]. বুখারী হা/২৫৯২; মিশকাত হা/১৯৩৫।
[11]. মির‘আতুল মাফাতীহ্, ৬/৩৭২ পৃ.।
[12]. মুসলিম হা/৯৯৫; মিশকাত হা/১৯৩১।
[13]. মির‘আতুল মাফাতীহ্, ৬/৩৬৭ পৃ.।
[14]. বুখারী হা/২৫১৮; মুসলিম হা/৮৪, শব্দাবলী মুসলিমের।
[15]. দারাকুৎনী হা/২০৫৫; শু‘আইব আরনাঊত হাদীছটি ছহীহ বলেছেন।
[16]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৪০২৬; মিশকাত হা/৩৩৮৪; ছহীহুত তারগীব হা/১৮৯৮, সনদ ছহীহ্।
[17]. তিরমিযী হা/৩৫৩৪; নাসাঈ হা/১০৩৩৮; ছহীহুত তারগীব হা/৬৬০, ছহীহ হাদীছ।
[18]. বুখারী হা/৩২৯৩; মুসলিম হা/২৬৯১; মিশকাত হা/২৩০২।
[19]. ইবনু মাজাহ হা/৩৮১০; ছহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/১৫৫৩; সনদ হাসান।