(৫) আম ও খাছের মাধ্যমে ব্যাখ্যা প্রদান :
হাদীছ দ্বারা যেমন কুরআনের আহকাম মানসূখ হ’তে পারে, তেমনি হাদীছ দ্বারা কুরআনের কোন আম হুকুমকে খাছ বা খাছ হুকুমকে আম করা যায়। এ বিষয়ে চার ইমামসহ জমহূর ওলামায়ে কেরাম ঐক্যমত পোষণ করেছেন।[1] যেমনভাবে ইমাম শাফেঈ তাঁর الرسالة গ্রন্থে এই শিরোনামে অনুচ্ছেদ নির্ধারণ করেছেন,باب ما نزل عاما دلت السنة خاصة علي أنه يراد به الخاص অর্থাৎ ‘যে আয়াতটি ‘আম’ হিসাবে নাযিল হয়েছে, কিন্তু সুন্নাহ দ্বারা তা থেকে খাছ উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে’।[2] এই অনুচ্ছেদ রচনা করে ইমাম শাফেঈ বুঝাতে চেয়েছেন যে, কুরআনের ‘আম’ভাবে উল্লেখিত কোন বিষয়ও সুন্নাহ দ্বারা ‘খাছ’ হ’তে পারে। ইবনু হাযম আল-আমিদীও এ মতের সপক্ষে অনেক প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন।[3]
এতে কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যে কোন প্রকার বিরোধ বা বৈপরীত্য সৃষ্টি হয় না। বরং এতে সুন্নাহ ব্যাখ্যাকারের ভূমিকা পালন করে। যারা কুরআন ও সুন্নাহকে আলাদা করে দেখেন এবং উভয়ের মধ্যে স্তরবিন্যাস করেন তারা প্রকারান্তরে সুন্নাহর অবস্থানকে ক্ষুণ্ণ করার অপপ্রয়াস চালান। যা মোটেই যথার্থ নয়। আল্লাহ তাঁর রাসূলকে মানবজাতির নিকটে আদর্শ হিসাবে প্রেরণ করেছেন (আহযাব ৩৩/২১) এবং তাঁর মাধ্যমে স্বীয় ইচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সেজন্য কুরআন ও হাদীছের মধ্যে কোন বৈপরীত্যে সৃষ্টির সুযোগ নেই। আর ইসলামী শরী‘আতে হাদীছের অবস্থানকে কুরআন থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করার সুযোগ নেই। সুতরাং যারা মনে করেন ‘খবরে আহাদ’ দ্বারা কুরআনী হুকুমকে ‘খাছ’ করা যাবে না, তাদের মতামত গ্রহণযোগ্য নয়।[4] সাঈদ ইবনু জুবায়ের থেকে বর্ণিত, একদা তিনি রাসূল (ছাঃ) থেকে একটি হাদীছ বর্ণনা করছিলেন। তখন এক ব্যক্তি বলল, ‘কিন্তু আল্লাহর কিতাবে এর বিপরীত রয়েছে’। তখন সাঈদ ইবনু জুবায়ের তাকে (ধমক দিয়ে) বললেন,لا أراني أحدثك عن رسول الله صلى الله عليه وسلم وتعرض فيه بكتاب الله، كان رسول الله صلى الله عليه وسلم أعلم بكتاب الله تعالى منك، ‘আমি যেন এমন না দেখি যে, তোমাকে আমি রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ বর্ণনা করছি আর তুমি আল্লাহর কিতাব পেশ করে তার বিরোধিতা করছ। কারণ রাসূল (ছাঃ) আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে তোমার চেয়ে অধিক অবগত ছিলেন’।[5]
নিম্নে এর কিছু উদাহরণ উল্লেখ করা হ’ল।-
ক. আল্লাহ বলেন, فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ ‘তোমরা ছালাত কায়েম কর’ (নিসা ৪/১০৩)। এই ‘আম’ আয়াতটিকে রাসূল (ছাঃ) পরে ‘খাছ’ করেছেন মুক্বীমের জন্য যোহরের ছালাত চার রাক‘আত এবং মুসাফিরের জন্য ২ রাক‘আত নির্ধারণ করার মাধ্যমে।[6]
খ. মাহরাম নারী সম্বন্ধে উল্লেখ করার পর আল্লাহ বলেন, وَأُحِلَّ لَكُمْ مَا وَرَاءَ ذَلِكُمْ، ‘এরা ছাড়া সকল নারীকে তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে’ (নিসা ৪/২৪)।
ছাহাবীদের ঐক্যমতে এই আয়াতের ‘আম’ নির্দেশনাকে রাসূল (ছাঃ) খাছ করেছেন এবং কোন নারীকে তার ফুফু ও খালার সাথে একত্রে বিবাহ করা নিষিদ্ধ করেছেন। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,نَهَى رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم، أَنْ تُنْكَحَ الْمَرْأَةُ عَلَى عَمَّتِهَا أَوْ خَالَتِهَا، ‘রাসূল (ছাঃ) কোন নারীকে তার ফুফু বা খালার সাথে একত্রে বিবাহ করতে নিষেধ করেছেন।[7] এই হাদীছটি খবরে ওয়াহিদ।
গ. মহান আল্লাহর বাণী : حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالْدَّمُ ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জন্তু ও রক্ত’ (মায়েদাহ ৫/৩)। অথচ হাদীছে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, মৃত টিড্ডি ও মাছ এবং কলিজা ও প্লীহার রক্ত হালাল। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন,أُحِلَّتْ لَنَا مَيْتَتَانِ وَدَمَانِ : فَأَمَّا الْمَيْتَتَانِ فَالْجَرَادُ وَالْحُوْتُ، وَأَمَّا الدَّمَانِ فَالْكَبِدُ وَالطِّحَالُ، ‘দু’প্রকারের মৃত জন্তু এবং দু’প্রকারের রক্ত আমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। মৃত জন্তু দু’টি হ’ল টিড্ডি ও মাছ। আর দু’প্রকারের রক্ত হ’ল কলিজা ও প্লীহা’। ইমাম বায়হাক্বী ও অন্যরা মারফূ‘ ও মাওকূফ উভয় সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। মাওকূফ হাদীছের সনদটি ছহীহ এবং এটি মারফূ‘র হুকুমে (যেহেতু ছাহাবী নিজস্ব মতের আলোকে এমনটি বলতে পারেন না)।[8] সুতরাং হাদীছে দু’প্রকার মৃত অর্থাৎ মাছ ও টিড্ডি পাখি[9] এবং দু’প্রকার রক্ত অর্থাৎ কলিজা ও প্লীহাকে হালাল করা হয়েছে।[10]
উল্লিখিত হাদীছ দ্বারা কুরআনে আমভাবে বর্ণিত রক্ত ও মৃত জন্তুর হারাম হওয়ার হুকুম থেকে মৃত টিড্ডি, মাছ, কলিজা ও প্লীহাকে খাছ করা হয়েছে। অর্থাৎ এগুলি হাদীছ দ্বারা হালাল সাব্যস্ত করা হয়েছে।
ঘ. উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আয়াত নাযিল করে আল্লাহ বলেন, يُوصِيكُمُ اللهُ فِي أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ، ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন যেন একজন পুরুষ দু’জন নারীর সমপরিমাণ অংশ পায়’ (নিসা ৪/১১)।
এই ‘আম’ আয়াতটি থেকে ছাহাবীগণ হত্যাকারী এবং কাফিরদেরকে ‘খাছ’ করে নিয়েছেন। কেননা রাসূল (ছাঃ) থেকে বর্ণিত, لاَ يَرِثُ الْقَاتِلُ شَيْئًا ‘হত্যাকারী উত্তরাধিকারী হয় না’।[11] অন্য বর্ণনায় এসেছে,لاَ يَرِثُ الْمُسْلِمُ الْكَافِرَ، وَلاَ الْكَافِرُ الْمُسْلِمَ، ‘কোন মুসলিম কাফেরের সম্পদের উত্তরাধিকারী হয় না, কোন কাফিরও মুসলিমের সম্পদের উত্তরাধিকারী হয় না।[12]
(৬) দু’টি বিষয়ের মধ্যবর্তী সমস্যার সমাধান :
পবিত্র কুরআনে সাধারণত একটি বিষয়ে হালাল-হারামের মত পরস্পর বিপরীতমুখী হুকুম প্রদান করা হয় না। তবে অনেক সময় এমন কিছু বিষয় থাকে যাকে হালালও বলা যায় না, আবার হারামও বলা যায় না। এ সকল বিষয়ে হাদীছ বা সুন্নাহ হালাল রাস্তা অবলম্বন করা বা হারাম থেকে বাঁচার জন্য কিছু মূলনীতি ব্যাখ্যা করেছে। নিম্নোক্ত উদাহরণসমূহে যা পরিস্ফুট হয়।
ক. আল্লাহ উত্তম জিনিসসমূহ হালাল করেছেন এবং মন্দ জিনিসসমূহ হারাম করেছেন। কিন্তু ভালো ও মন্দের মাঝে এমন কিছু রয়েছে যা সম্পর্কে সন্দেহ থেকে যায়। রাসূল (ছাঃ) এ সকল সন্দেহজনক বিষয়াদিকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। যেমন গৃহপালিত গাধা, দন্ত-নখরওয়ালা হিংস্র পশু ও পাখি কুরআনে হারাম করা হয়নি, অথচ হাদীছে তা হারাম করা হয়েছে।[13] অনুরূপভাবে টিড্ডি[14] এবং খরগোশকে[15] উত্তম জিনিস হিসাবে গণ্য করে হালাল করা হয়েছে।
খ. আল্লাহ সাধারণ পানীয়কে হালাল করেছেন এবং মাদককে হারাম করেছেন। কিন্তু সাধারণ পানীয় ও মাদকের মাঝে এমন কিছু পানীয় রয়েছে যা মৌলিকভাবে মাদক নয়, কিন্তু মাদকতা আনতে পারে এমন সম্ভাবনা আছে। যেমন দুববা, মুযাফ্ফাত, নাকীর প্রভৃতি মাদক বানানোর পাত্রে প্রস্ত্ততকৃত নাবীয (এক প্রকার তরল খাবার)। রাসূল (ছাঃ) এ সকল জিনিসকে নিষিদ্ধ করেছিলেন মাদকতার সম্ভাবনা থেকে বাঁচার জন্য। পরবর্তীতে তিনি যখন দেখলেন নাবীযের মূল উপাদান পানি ও মধু তথা হালাল বস্ত্ত; তখন তিনি নাবীযকে হালাল করেন এবং বলেন,وَنَهَيْتُكُمْ عَنْ الِانْتِبَاذِ فَانْتَبِذُوا وَكُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ، ‘ইতোপূর্বে আমি তোমাদেরকে নাবীয তৈরী করতে নিষেধ করেছিলাম, তবে এখন করতে পার। আর প্রতিটি নেশা আনয়নকারী বস্ত্তই হারাম।[16]
গ. আল্লাহ মুসলমানদের জন্য প্রশিক্ষিত প্রাণীর শিকারকৃত হালাল প্রাণীর গোশত খাওয়া বৈধ করেছেন। এখান থেকে বোঝা যায়, প্রাণী যদি প্রশিক্ষিত না হয়, তবে তার শিকার করা প্রাণী খাওয়া যাবে না। কেননা সেটা সে নিজের জন্য শিকার করেছে। এখন যদি কোন প্রাণী প্রশিক্ষিত হয়, আবার নিজের শিকার করা প্রাণী থেকে নিজে কিছু ভক্ষণ করে, তবে তা কি খাওয়া বৈধ হবে? কেননা প্রাণীটি নিজের জন্যই তা শিকার করেছে। এ দ্বন্দ্বের সমাধান সুন্নাহ দিয়েছে। রাসূল (ছাঃ) এর সমাধানে বলেন, فَإِنْ أَكَلَ فَلاَ تَأْكُلْ فَإِنِّى أَخَافُ أَنْ يَكُونَ إِنَّمَا أَمْسَكَ عَلَى نَفْسِهِ، ‘যদি প্রাণী নিজে খায়, তাহ’লে তোমরা তা খেয়ো না। কেননা আমার ভয় হয় যে সেটা সে নিজের জন্য শিকার করেছে’।[17]
(৭) কুরআনে বর্ণিত কোন মূলনীতির সাথে নতুন কোন শাখা সংযুক্ত করে ব্যাখ্যা করা :
কুরআনে যে সকল মূলনীতি এসেছে তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বর্ধিত শাখা হিসাবে অনেক বিধান সংযুক্ত করেছে সুন্নাহ। যা নিম্নোক্ত উদাহরণসমূহে প্রতীয়মান হয়।
ক. আল্লাহ সূদকে হারাম করেছেন। জাহিলী যুগে প্রচলিত সূদ ছিল ঋণের উপর। সূদদাতা বলত, হয় তুমি ঋণ ফেরৎ দেবে, নতুবা সূদ প্রদান করবে। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণে বললেন,أَلاَ وَإِنَّ كُلَّ رِبًا مِنْ رِبَا الْجَاهِلِيَّةِ مَوْضُوعٌ، ‘সাবধান! জাহিলী যুগে প্রচলিত সকল প্রকার সূদ বাতিল ঘোষিত হ’ল’।[18] সূদকে হারাম করার কারণ ছিল কোন বিনিময় ছাড়াই অতিরিক্ত গ্রহণের নীতি। ফলে পরবর্তীতে এই অর্থে যত প্রকার বৃদ্ধি রয়েছে তা সবই নিষিদ্ধ করেছে সুন্নাহ। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন,الذَّهَبُ بِالذَّهَبِ وَالْفِضَّةُ بِالْفِضَّةِ وَالْبُرُّ بِالْبُرِّ وَالشَّعِيرُ بِالشَّعِيرِ وَالتَّمْرُ بِالتَّمْرِ وَالْمِلْحُ بِالْمِلْحِ مِثْلاً بِمِثْلٍ سَوَاءً بِسَوَاءٍ يَدًا بِيَدٍ فَإِذَا اخْتَلَفَتْ هَذِهِ الأَصْنَافُ فَبِيعُوا كَيْفَ شِئْتُمْ إِذَا كَانَ يَدًا بِيَدٍ ‘স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ, রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর, লবণের বিনিময়ে লবণ, সমমানের জিনিসের বিনিময়ে সমমানের জিনিস, সমপরিমাণের জিনিসের বিনিময়ে সমপরিমাণ জিনিস, হাতে হাতে (পণ্যের অনুপস্থিতিতে মৌখিকভাবে) লেনদেন করা নিষিদ্ধ। তবে যদি এ সকল জিনিস সমজাতীয় না হয়, তাহ’লে তোমরা ইচ্ছামত বিক্রয় করতে পার, যদি তা (পণ্যের উপস্থিতিতে) হাতে হাতে লেনদেন হয়ে থাকে’।[19]
পরবর্তীতে সূদের এই মূলনীতিকে বর্ধিত করে রাসূল (ছাঃ) সমজাতীয় জিনিসের দেরীতে বিক্রয়ে অতিরিক্ত গ্রহণকেও সূদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।[20] কেননা সূদের মত দেরীতে বিক্রয়েও অতিরিক্ত অর্থ দাবী করা হয়ে থাকে।
খ. আল্লাহ হারাম করেছেন মা, মেয়ে বা দু’বোনকে একত্রে বিবাহ করা (নিসা ৪/২৩)। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) এই মূলনীতির শাখা বৃদ্ধি করে কোন নারীকে তার ফুফু বা খালার সাথে একত্রে বিবাহ করাও নিষিদ্ধ করেছেন।[21] কেননা মা ও মেয়ের বিবাহে যে সমস্যাটি বর্তমান, তা একজন মেয়ে ও তার ফুফু-খালার বিবাহেও বিদ্যমান। সেটি হ’ল قطع الأرحام বা রক্তসম্পর্কে বিচ্ছিন্নতা।
গ. আল্লাহ কুরআনে মানবহত্যার জন্য রক্তপণ নির্ধারণ করেছেন (নিসা ৪/৯২)। কিন্তু অঙ্গহানীর জন্য কোন পণ নির্ধারণ করেননি। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) এ মূলনীতির অতিরিক্ত হিসাবে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্যও ভিন্ন ভিন্ন পণ নির্ধারণ করেছেন।[22]
ঘ. কুরআনে কেবল দুধ সম্পর্কীয় আত্মীয়দেরকে বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে (নিসা ৪/২৩)। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) দুধসম্পর্কীয় সকল আত্মীয়কে মুহাররামাতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যাদেরকে রক্তসম্পর্কীয় কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।[23] তিনি বলেন, إِنَّ اللهَ حَرَّمَ مِنَ الرَّضَاعَةِ مَا حَرَّمَ مِنَ النَّسَبِ، ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ দুধসম্পর্কীয়দের বিবাহ করা হারাম করেছেন, যেমন হারাম করেছেন রক্তসম্পর্কীয়দের’।[24]
(৮) কুরআনে উল্লেখিত কোন মূলনীতির অংশবিশেষকে সাধারণীকরণ :
কুরআনে অনেক হুকুম বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছে, যা পরে রাসূল (ছাঃ) সাধারণ মূলনীতি হিসাবে ধারণ করেছেন। উদাহরণ নিম্নরূপ :
ক. রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, لَا ضَرَرَ وَلَا ضِرَارَ ‘কাউকে ক্ষতি করো না এবং নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ো না’।[25] এই মূলনীতিসূচক হাদীছটি কুরআনের বিভিন্ন স্থানে (বাইয়েনাহ ৯৮/৫; যুমার ৩৯/৩; কাহাফ ১৮/১১০; নিসা ৪/১৪২, ১৪৫) বর্ণিত নীতিমালার সারনির্যাস। এই মূলনীতির আলোকে মানুষের জান-মাল, সহায়-সম্পদ, মান-সম্মানের উপর আঘাত করা হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। একইভাবে আত্মসাৎ, যুলুম, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি যাবতীয় পাপ যাতে মানুষের জান-মালের ক্ষতি হয় এবং যা তার মনুষ্যত্ব ও বংশধারাকে বিনষ্ট করে তা এই মূলনীতির আওতাভুক্ত হয়ে হারাম হিসাবে পরিগণিত হয়।
খ. রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، ‘নিশ্চয়ই প্রতিটি আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তা-ই প্রাপ্য যা সে নিয়ত করেছে’।[26] এই প্রসিদ্ধ মূলনীতিটি কুরআনে বর্ণিত আমলে ইখলাছ অর্জন ও রিয়া বর্জন সংক্রান্ত আয়াতসমূহ (বাক্বারাহ ২/২৩১ ও ২৩৩; ত্বালাক ৬৫/৬) এবং মানুষ তা-ই পায় যার জন্য সে প্রচেষ্টা করে (নাজম ৫৩/৯; নিসা ৪/১০০) সংক্রান্ত আয়াতসমূহের সারনির্যাস।
গ. রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ حَامَ حَوْلَ الحْمَى يُوْشِكُ أنْ يَقَعَ فِيْهِ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমারেখার আশ-পাশে ঘুরাঘুরি করে, সে তাতে নিক্ষিপ্ত হয়’।[27] অপর একটি হাদীছে এসেছে তিনি বলেন, دَعْ مَا يَرِيبُكَ إِلَى مَا لاَ يَرِيبُكَ ‘যা তোমাকে সন্দেহে নিক্ষেপ করে তা পরিত্যাগ করে সন্দেহমুক্ত বিষয়ের দিকে ধাবিত হও’।[28]
সাধারণ মূলনীতিসূচক উপরোক্ত হাদীছদ্বয়ের মর্মার্থ হ’ল ফিতনা-ফাসাদের পথ বা সুযোগ বন্ধ করা, যা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে প্রতিভাত হয়েছে (নূর ২৪/৩১; বাক্বারাহ ২/১০৪ ও নিসা ৪/৯৪)। এভাবে পবিত্র কুরআনের বিবিধ আয়াতের সারমর্মকে একত্রে শামিল করে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে যা কুরআনের নীতিকে আরো সহজবোধ্য ও ব্যাখ্যামূলকভাবে প্রকাশ করেছে।
(৯) কুরআনের সঠিক মর্ম অনুধাবন :
হাদীছ ছাড়া পবিত্র কুরআনের সঠিক মর্ম অনুধাবন করা প্রায়শঃই সম্ভব নয়।[29] যেমন আল্লাহর বাণী :وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُواْ أَيْدِيَهُمَا، ‘পুরুষ চোর ও নারী চোর, তাদের উভয়ের হাত কেটে দাও’ (মায়েদাহ ৫/৩৮)। এ আয়াতে হাত কাটা ও চোর শব্দ দু’টি ‘মুতলাক’ বা সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) চোরের সংজ্ঞা দিয়েছেন এবং যে এক-চতুর্থাংশ দীনার চুরি করে তার সাথে ‘মুকাইয়াদ’ বা শর্তযুক্ত করেছেন। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, لاَ قَطْعَ إِلاَّ فِيْ رُبُعِ دِيْنَارٍ فَصَاعِدًا ‘এক দীনারের এক-চতুর্থাংশ বা তার বেশি চুরি না করলে চোরের হাত কাটা যাবে না’।[30] অনুরূপভাবে ছাহাবীগণের কর্ম ও তাতে রাসূল (ছাঃ)-এর অনুমোদনসূচক হাদীছগুলো চোরের হাত কতটুকু কাটতে হবে তার ব্যাখ্যা করেছে। কারণ ছাহাবীগণ চোরের হাতের কব্জি পর্যন্ত কেটে ফেলতেন। হাদীছের গ্রন্থাবলীতে যার স্পষ্ট বিবরণ রয়েছে।
অনুরূপই বর্ণিত হয়েছে আল্লাহর বাণী : فَامْسَحُواْ بِوُجُوْهِكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ مِّنْهُ، ‘তোমরা পবিত্র মাটি দ্বারা তোমাদের মুখমন্ডল ও হাত মাসেহ করবে’ (মায়েদাহ ৫/৬)। তায়াম্মুম সম্পর্কিত এ আয়াতে উল্লিখিত হাত সম্পর্কে কওলী হাদীছ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে যে, তা হ’ল হাতের তালু, পুরো হাত নয়। যেমন- রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,اَلتَّيَمُّمُ ضَرْبَةٌ لِلْوَجْهِ وَالْكَفَّيْنِ ‘তায়াম্মুম হ’ল মুখমন্ডল ও দুই হাতের তালুর জন্য একবার মাটিতে হাত মারা’।[31]
নিম্নে আরো কিছু উদাহরণ প্রদত্ত হ’ল-
ক. আল্লাহর বাণী :اَلَّذِيْنَ آمَنُواْ وَلَمْ يَلْبِسُوْا إِيْمَانَهُم بِظُلْمٍ أُوْلَـئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُّهْتَدُوْنَ، ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে যুলুম দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই সৎপথপ্রাপ্ত’ (আন‘আম ৬/৮২)। আল্লাহ তা‘আলার বাণী بِظُلْمٍ দ্বারা ছাহাবায়ে কেরাম সাধারণভাবে সকল প্রকার যুলুম বা অত্যাচার বুঝেছিলেন। সেটা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন। এজন্য এ আয়াতটির মর্ম তাদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হ’লে তারা বলেছিলেন, يَا رَسُوْلَ اللهِ! أَيُّنَا لاَ يَظْلِمُ نَفْسَهُ؟ ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে তার নফসের উপর যুলুম করে না। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছিলেন,لَيْسَ ذَلِكَ، إِنَّمَا هُوَ الشِّرْكُ، أَلَمْ تَسْمَعُوْا مَا قَالَ لُقْمَانُ لِاِبْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ: يَبُنَيَّ لاَ تُشْرِكْ بِاللهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ ‘তোমরা যে যুলুমের কথা ভাবছ সেটা উদ্দেশ্য নয়। বরং ওটা হচ্ছে শিরক। তোমরা কি লোকমান তার সন্তানকে যে উপদেশ দিয়েছেন তা শোননি- ‘হে বৎস! আল্লাহর সাথে শিরক কর না। নিশ্চয়ই শিরক চরম যুলুম?’ (লুকমান ৩১/১৩)।[32]
ছাহাবীগণ আয়াতে উল্লিখিত ظلم শব্দের প্রকাশ্য অর্থ বুঝেছিলেন। অথচ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ)-এর ভাষ্য অনুযায়ী তাঁরা ছিলেন,أفضل هذه الأمة، وأبرها قلوبا، وأعمقها علما، وأقلها تكلفا ‘এই উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, সবচেয়ে নিষ্কলুষ অন্তরের অধিকারী, সবচেয়ে গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী এবং সবচেয়ে কম বাহুল্য প্রদর্শনকারী’।[33] এতদসত্ত্বেও তারা ظلم শব্দের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে ভুল করেছিলেন। যদি রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে তাদের ভুল থেকে উদ্ধার না করতেন এবং বুঝিয়ে না দিতেন যে, আয়াতে উল্লিখিত ظلم দ্বারা শিরক উদ্দেশ্য, তাহ’লে আমরাও তাদের ভুলের অনুসরণ করতাম। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ছাঃ)-এর দিকনির্দেশনা ও হাদীছ দ্বারা আমাদেরকে এই বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করেছেন।
খ. আল্লাহর বাণী :وَإِذَا ضَرَبْتُمْ فِي الْأَرْضِ فَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَقْصُرُوْا مِنَ الصَّلاَةِ إِنْ خِفْتُمْ أَنْ يَّفْتِنَكُمُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا، ‘তোমরা যখন যমীনে সফর করবে তখন যদি তোমাদের আশংকা হয় যে, কাফিররা তোমাদের জন্য ফিতনা সৃষ্টি করবে, তবে ছালাত সংক্ষিপ্ত করলে তোমাদের কোন দোষ নেই’ (নিসা ৪/১০১)। এই আয়াতের প্রকাশ্য অর্থ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, সফরে ছালাত ক্বছর বা সংক্ষিপ্ত করার শর্ত হচ্ছে শত্রুভীতি। এজন্য কতিপয় ছাহাবী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নিরাপদ অবস্থায় ছালাত ক্বছর করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন,صَدَقَةٌ تَصَدَّقَ اللهُ بِهَا عَلَيْكُمْ، فَاقْبَلُوْا صَدَقَتَهُ، ‘এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য ছাদাক্বা বা দান। সুতরাং তোমরা তার দান গ্রহণ কর’।[34]
উল্লিখিত হাদীছ যদি না থাকত তাহ’লে আয়াতের প্রকাশ্য ভাব অনুযায়ী শত্রুভীতির শর্ত আরোপ না করলেও অন্তত নিরাপদ অবস্থায় সফরে ছালাত ক্বছর করার ব্যাপারে আমরা সন্দিগ্ধ থেকে যেতাম, যেমনটি কিছু ছাহাবী বুঝেছিলেন। যদি ছাহাবীগণ রাসূল (ছাঃ)-কে সফর অবস্থায় ছালাত ক্বছর করতে না দেখতেন, তাহ’লে তারাও ক্বছর করতেন না। মুসলিম উম্মাহও করত না।
গ. আল্লাহর বাণী : قُلْ لاَّ أَجِدُ فِيْ مَا أُوْحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّماً عَلَى طَاعِمٍ يَّطْعَمُهُ إِلاَّ أَنْ يَّكُوْنَ مَيْتَةً أَوْ دَماً مَّسْفُوْحاً أَوْ لَحْمَ خِنزِيْرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ أَوْ فِسْقًا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللهِ بِهِ ‘বল, আমার প্রতি যে অহী হয়েছে তাতে, লোকে যা আহার করে তার মধ্যে আমি কিছুই হারাম পাই না, মৃত, বহমান রক্ত ও শূকরের গোশত ব্যতীত। কেননা এগুলি অবশ্যই অপবিত্র অথবা যা অবৈধ, আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গের কারণে’ (আন‘আম ৬/১৪৫)। অতঃপর এই আয়াতে উল্লেখ নেই এমন কিছু প্রাণী খাওয়া হাদীছ দ্বারা হারাম সাব্যস্ত হয়েছে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, كُلُّ ذِىْ نَابٍ مِنَ السِّبَاعِ، فَأَكْلَهُ حَرَامٌ ‘তীক্ষ্ণ দাঁতওয়ালা প্রত্যেক হিংস্র জন্তু খাওয়া হারাম’।[35]
অপর হাদীছে ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,نَهَى رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ كُلِّ ذِيْ نَابٍ مِنَ السِّبَاعِ وَعَنْ كُلِّ ذِيْ مِخْلَبٍ مِنَ الطَّيْرِ، ‘প্রত্যেক তীক্ষ্ণ দাঁতওয়ালা হিংস্র জন্তু এবং ধারালো নখ বিশিষ্ট পক্ষী খেতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিষেধ করেছেন’।[36] এমনভাবে আরও কিছু প্রাণী হারাম হওয়া সম্পর্কে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। যেমন খায়বারের দিন রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ وَرَسُوْلَهُ يَنْهَيَانِكُمْ عَنْ لُحُوْمِ الْحُمُرِ الْأَهْلِيَّةِ، فَإِنَّهَا رِجْسٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল গৃহপালিত গাধার গোশত খেতে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন। কেননা ওটা অপবিত্র’।[37]
উল্লিখিত হাদীছসমূহ যদি না থাকত তাহ’লে আল্লাহ তাঁর নবী (ছাঃ)-এর যবানে আমাদের জন্য যেসব প্রাণী হারাম করেছেন, সেগুলোকে আমরা হালাল গণ্য করতাম। যেমন হিংস্র জন্তু ও ধারালো নখ বিশিষ্ট পাখি।
ঘ. মহান আল্লাহর বাণী : قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِيْنَةَ اللهِ الَّتِيْ أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالْطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ ‘বল, আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্ত্ত ও পবিত্র জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে’? (আ‘রাফ ৭/৩২)। অথচ হাদীছ থেকে হারাম সাব্যস্ত হয়েছে কিছু শোভার বস্ত্ত। যেমন রাসূল (ছাঃ) থেকে ছহীহ সূত্রে বর্ণিত আছে যে, একদিন তিনি তাঁর ছাহাবীদের নিকট আসলেন। তখন তার এক হাতে রেশম ও অন্য হাতে স্বর্ণ ছিল। তিনি বললেন,إِنَّ هَذَيْنِ حَرَامٌ عَلَى ذُكُوْرِ أُمَّتِىْ، حِلٌّ لِإِنَاثِهِمْ ‘এ দু’টো জিনিস আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য হারাম, কিন্তু মহিলাদের জন্য হালাল’।[38] এ মর্মে বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। উল্লিখিত হাদীছগুলো যদি না থাকত তাহ’লে আল্লাহ তাঁর নবী (ছাঃ)-এর যবানে যেসব বিষয় হারাম সাব্যস্ত করেছেন, সেগুলোকে আমরা হালাল মনে করতাম। যেমন স্বর্ণ ও রেশম।
উপরোক্ত উদাহরণসমূহ থেকে ইসলামী শরী‘আতে হাদীছের গুরুত্ব দিবালোকের ন্যায় প্রতিভাত হয়। হাদীছ ছাড়া সঠিকভাবে কুরআন বোঝা আদৌ সম্ভব নয়। মুহাদ্দিছ এবং ফক্বীহ পন্ডিতগণ এ বিষয়ে বহু উদাহরণ দিয়েছেন। কতিপয় পূর্বসূরী বিদ্বান যথার্থই বলেছেন, السنة تقضى علي الكتاب، ‘হাদীছ কুরআনের উপর ফায়ছালা করে’।
সারকথা :
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, হাদীছ হ’ল পবিত্র কুরআনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ততম ব্যাখ্যা। পবিত্র কুরআনকে মানব সমাজে বাস্তবায়নের যে মহান দায়িত্ব নিয়ে রাসূল (ছাঃ) রিসালাত প্রাপ্ত হয়েছিলেন, যে সকল নীতি অবলম্বন করে তিনি মানবজাতির চিরন্তন হেদায়াত পবিত্র কুরআনের আদর্শ বাস্তবায়ন করেছিলেন, তারই সারসম্ভার হ’ল হাদীছের এই বিশাল সংগ্রহ। কুরআনের সংক্ষিপ্ত, দুর্বোধ্য এবং মৌলিক বিধানসমূহের বিপরীতে বিস্তারিত, সুস্পষ্ট ও মৌলিক বিধানাবলী সম্বলিত এই হাদীছ শাস্ত্র ব্যতীত ইসলামী শরী‘আত কল্পনাই করা যায় না।
এজন্য ড. মুহাম্মাদ আলী আছ-ছাবূনী (জন্ম ১৯৩০খ্রি.) যথার্থই বলেছেন, সংযুক্ত সনদে সুরক্ষিত হাদীছ শাস্ত্র মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর দেয়া এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক। এ এক অমূল্য ধন, এক অনন্য নবুঅতী উত্তরাধিকার- যা মুসলিম উম্মাহর জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া এক চিরন্তন উপহার। মুসলিম উম্মাহ স্বচ্ছ, অবিমিশ্রভাবে সে উত্তরাধিকারকে সযত্নে সংরক্ষণ করে রেখেছে যুগের পর যুগ ধরে। যদিও রাসূল (ছাঃ)-এর বিদায়ের পর পেরিয়ে গেছে চৌদ্দশ বছর, অথচ আমরা এখন পঞ্চদশ শতকের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ পড়ছি, শুনছি, হৃদয়ঙ্গম করছি ঠিক সেভাবে, যেভাবে রাসূল (ছাঃ) তা উচ্চারণ করেছিলেন, খুৎবায় বর্ণনা দিয়েছিলেন। যেন রাসূল (ছাঃ) অদ্যাবধি আমাদের মাঝে জীবিত আছেন এবং আমাদের সাথে সার্বক্ষণিক আলাপচারিতায় মগ্ন রয়েছেন। পৃথিবীর কোন জাতি-গোষ্ঠী তাদের নবীর বাণীকে এভাবে সংরক্ষণ করতে পারেনি, যেভাবে পেরেছে মুসলিম উম্মাহ। যা আল্লাহর দ্বীনকে যুগের পরিক্রমায় চিরজাগ্রত এবং চিরস্থায়ী রাখার পথকে রেখেছে মসৃণ ও সুগম।[39]
অতএব হাদীছের ব্যাপারে কোন সংশয় ও সন্দেহ রাখার তো প্রশ্নই আসে না, বরং কুরআনের ন্যায় হাদীছকেও এলাহী বিধান হিসাবে যথাযথ অনুসরণ করতে হবে এবং এতেই রয়েছে মানবজাতির পরকালীন মুক্তির সনদ।
[1]. আল-আমিদী, আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম, ২/৩৪৭ পৃ.।
[2]. ইমাম শাফেঈ, আর-রিসালাহ, পৃ. ৬৪।
[3]. আল-আমিদী অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন (يجوز تخصيص عموم القرآن بالسنة), আল ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম, ২/৩৪৭ পৃ.; ইবনু হাযম অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন (فيمن قال لا يجوز تخصيص القرآن بالخبر والرد عليه) আল ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম, ২/১৯৬ পৃ.।
[4]. ড. মুহাম্মাদ লোকমান আস-সালাফী, মাকানাতুস সুন্নাহ ফিল ইসলাম, পৃ. ১৩৭।
[5]. দারেমী হা/৬১০।
[6]. বুখারী হা/৩৫০; নাসাঈ হা/৪৫৪।
[7]. বুখারী হা/৫১০৮-১০।
[8]. ইবনু মাজাহ হা/৩৩১৪; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১১১৮।
[9]. এক প্রকার ছোট মরুপক্ষী; যা সচরাচর আরবরা শিকার করে খেত।
[10]. আহমাদ হা/৫৭২৩; ইবনু মাজাহ হা/৩২১৮, ৩৩১৪।
[11]. আবূদাউদ হা/৪৫৬৪; নাসাঈ হা/৪৮০১, সনদ হাসান।
[12]. বুখারী হা/৬৭৬৪; মুসলিম হা/১৬১৪।
[13]. (عن أبي ثعلبة قال : حرم رسول الله صلى الله عليه وسلم لحوم الحمر الأهلية) ছহীহুল বুখারী হা/৫৫৩০; ছহীহ মুসলিম হা/১৯৩২।
[14]. বুখারী হা/৫৫৩৬; মুসলিম হা/১৯৪৩।
[15]. বুখারী হা/৫৫৩৫; মুসলিম হা/১৯৫৩।
[16]. মুওয়াত্ত্বা মালিক (তাহক্বীক : মুছত্বফা আল-আ‘যামী), হা/১৭৬৭। অন্য বর্ণনায় এসেছে, (نهيتكم عن النبيذ إلا في سقاء فاشربوا في الأسقية كلها ولا تشربوا مسكرا) -মুসলিম হা/৯৭৭)।
[17]. বুখারী হা/৫৪৭৬, ৫৪৮৭; মুসলিম হা/১৯২৯।
[18]. আবূদাউদ হা/৩৩৩৪; ইবনু মাজাহ হা/৩০৫৫।
[19]. মুসলিম হা/১৫৮৭।
[20]. মুসলিম হা/১৫৯৬।
[21]. বুখারী হা/৫১০৮-১০।
[22]. বুখারী হা/৬৮৯৫, (أصابع اليدين والرجلين سواء); আবূদাউদ হা/৪৫৬১।
[23]. বুখারী হা/৫১০৫।
[24]. মুসলিম হা/১৪৪৭।
[25]. মুওয়াত্ত্বা মালিক (তাহক্বীক : মুসত্বফা আ‘যামী) হা/২৭৫৮।
[26]. বুখারী, হা/১, ৫৪, ৩৫২৯ প্রভৃতি; মুসলিম হা/১৯০৭।
[27]. বুখারী হা/২০৫১।
[28]. মুসনাদ আহমাদ হা/১৭২৩, ১৭২৭; তিরমিযী হা/২৫১৮; নাসাঈ হা/৫৭১১।
[29]. নাছিরুদ্দীন আলবানী, মানযিলাতুস সুন্নাহ ফিল ইসলাম, পৃ. ৭।
[30]. বুখারী হা/৬৭৮৯; মুসলিম হা/১৬৮৪; ছহীহ ইবনু হিববান, হা/৪৪৬৫।
[31]. মুসনাদ আহমাদ, হা/১৮৩৪৫; বুখারী হা/৩৪৭; মুসলিম হা/৩৬৮; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৬৯৪।
[32]. বুখারী, হা/৩৪২৯, ৪৬২৯, ৬৯১৮; মুসলিম হা/১২৪।
[33]. ইবনু তায়মিয়া, মিনহাজুস সুন্নাহ ৬/৮১ পৃ.।
[34]. ছহীহ মুসলিম হা/৬৮৬।
[35]. মুসলিম হা/১৯৩৩।
[36]. মুসলিম হা/১৯৩৪।
[37]. বুখারী হা/৫৫২৮; মুসলিম হা/১৯৪০।
[38]. ইবনু মাজাহ হা/৩৫৯৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩৭।
[39]. ড. মুহাম্মাদ আলী আছ-ছাবূনী, আস-সুন্নাহ (মক্কা : রাবেতাতুল আলামিল ইসলামী, ১৪১৭ হি.), পৃ. ৮৩।