ইসলামের মূল ভিত্তি হচ্ছে ‘ঈমান’। প্রত্যেক নবী-রাসূলের প্রথম দাওয়াত ছিল ঈমানের দাওয়াত। ঈমান ব্যতীত বান্দার কোন আমল আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। ঈমানের উপর নির্ভর করেই বান্দার জান্নাত-জাহান্নাম ও পরকালীন মুক্তি। আলোচ্য প্রবন্ধে ঈমানের সংক্ষিপ্ত পরিচয়, গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।-
ঈমানের পরিচয় : ঈমান (الإيمان) শব্দটি আম্ন (امن) শব্দ থেকে নির্গত। আমন অর্থ- নিরাপত্তা, আশংকামুক্তি, নিশ্চিন্তত্রা ইত্যাদি।[1] যা ভীতির বিপরীত। আর মুমিন শব্দের অর্থ হ’ল- বিশ্বাসী, আস্থাশীল, আস্থাবান। যেমন হাদীছে এসেছে, المُؤْمِنُ مَن أمِنَهُ النّاسُ، ‘মুমিন তো তিনিই যাকে মানুষ নিরাপদ মনে করে’।[2] পরিভাষায় ঈমান বলা হয়,الْإِيْمَانُ هُوَ التَّصْدِيْقُ بِالْجَنَانِ وَالْإِقْرَارُ بِاللِّسَانِ وَالْعَمَلُ بِالْأَرْكَانِ، يَزِيْدُ بِالطَّاعَةِ وَيَنْقُصُ بِالْمَعْصِيَّةِ، اَلْإِيْمَانُ هُوَ الْأَصْلُ وَالْعَمَلُ هُوَ الْفَرْعُ، ‘ঈমান’ হ’ল হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়নের সমন্বিত নাম। যা আনুগত্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ও গোনাহে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। বিশ্বাস ও স্বীকৃতি হ’ল মূল এবং কর্ম হ’ল শাখা।
ঈমান কি? জিব্রীল (আঃ)-এর এমন প্রশ্নের জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أَنْ تُؤْمِنَ بِاللهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ ‘ঈমান হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ, পরকালকে সত্য বলে বিশ্বাস করা এবং এছাড়া তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপর বিশ্বাস করা’।[3]
ঈমানের গুরুত্ব ও ফযীলত :
ঈমানের গুরুত্ব ও ফযীলত অপরিসীম। নিম্নে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হ’ল-
(১) ইসলামের প্রথম ভিত্তি ঈমান : ইসলামের পাঁচটি ভিত্তির প্রথমটি হ’ল ঈমান তথা ‘আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল’ এই সাক্ষ্য দেওয়া। ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالْحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ-
‘ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে পাঁচটি। ১. আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন উপাস্য নেই এবং নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা। ২. ছালাত প্রতিষ্ঠা করা। ৩. যাকাত আদায় করা। ৪. হজ্জ সম্পাদন করা এবং ৫. রামাযানের ছিয়াম পালন করা’।[4]
যুগে যুগে সমাজে নানাবিধ খারাপ কাজ বিদ্যমান থাকলেও প্রত্যেক নবী-রাসূলের প্রথম দাওয়াত ছিল ঈমানের। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ، ‘আর তোমার পূর্বে আমরা এমন কোন রাসূল প্রেরণ করিনি যার নিকটে এই অহি করিনি যে, আমি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। অতএব তোমরা আমার ইবাদত কর’ (আম্বিয়া ২১/২৫)। ক্বাতাদা (রাঃ) বলেন, তাওরাত, ইঞ্জীল ও কুরআনে শরী‘আত ভিন্ন ভিন্ন থাকলেও সকল নবীকে তাওহীদ (তথা ঈমান) দিয়ে পাঠানো হয়েছে।[5] অন্য আয়াতে প্রত্যেক নবীর দাওয়াতের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ ‘হে আমার কওম! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই’ (আ‘রাফ ৭/৫৯)।[6] রাসূল (ছাঃ)-এর প্রথম দাওয়াতও ছিল ঈমানের। তিনি বলতেন, قُوْلُوْا لآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ تُفْلِحُوْا، ‘তোমরা বল আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তাহ’লে তোমরা সফলকাম হবে’।[7]
(২) ঈমানের পর অন্যান্য বিধান : যারা কালেমার সাক্ষ্য দিবে তথা ঈমান আনয়ন করবে তাদের উপরই ইসলামের পরবর্তী বিধানগুলো অর্পিত হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ)-কে ইয়ামানে পাঠাবার সময় বললেন,
إِنَّك تَأتي قوما من أهل الْكتاب. فَادْعُهُمْ إِلَى شَهَادَةِ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ. فَإِنْ هُمْ أطاعوا لذَلِك. فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِي الْيَوْمِ وَاللَّيْلَةِ. فَإِنْ هم أطاعوا لذَلِك فأعلمهم أَن الله قد فرض عَلَيْهِم صَدَقَة-
‘মু‘আয! তুমি আহলে কিতাবদের (ইয়াহূদী ও খৃস্টান) নিকট যাচ্ছ। প্রথমতঃ তাদেরকে এ দাওয়াত দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল। যদি তারা এটা মেনে নেয় তাহ’লে তাদের সামনে এই ঘোষণা দিবে যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর দিন-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেছেন। তারা এটাও মেনে নিলে তাদেরকে জানাবে যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন’।[8]
(৩) ইবাদত কবুলের অন্যতম শর্ত ইখলাছ তথা ঈমান[9] : আল্লাহর নিকটে আমল কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত হ’ল ঈমান আনয়ন করা। কেননা ঈমানহীন আমল পত্র-পল্লবহীন নেড়া বৃক্ষের ন্যায়, যা কোন উপকারে আসে না। মহান আল্লাহ বলেন, مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ، ‘পুরুষ হৌক বা নারী হৌক মুমিন অবস্থায় যে ব্যক্তি সৎকর্ম করে, আমরা তাকে অবশ্যই পবিত্র জীবন দান করব এবং অবশ্যই তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম অপেক্ষা অধিক উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করব’ (নাহল ১৬/৯৭)। আবু উমামা বাহিলী (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ اللهَ لا يَقْبَلُ مِنَ العَمَلِ إِلَّا ما كان لهُ خالِصًا، وابْتُغِيَ بهِ وجْهُهُ، ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা কোন আমল কবুল করেন না, যদি তাঁর জন্য তা খালেছ অন্তরে ও তাঁর সন্তুষ্টির জন্য করা না হয়’।[10] হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) (৭০০-৭৭৪ হিঃ) সূরা কাহাফের ১১০নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য রুকন রয়েছে। অবশ্যই এটা একমাত্র আল্লাহর জন্য খালেছ হ’তে হবে এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শরী‘আতের মধ্যে হবে।[11] ইবনুল ক্বাইয়িম (রহ.) বলেন,العمل بغير إخلاص ولا اقتداء كالمسافر يملأ جرابه رملاً يثقله ولا ينفعه، ‘ইখলাছহীন আমল ও (সুন্নাহর) অনুসরণবিহীন সৎকাজ করা ঐ মুসাফিরের ন্যায় যে বালুভর্তি বস্তার বোঝা বহন করে, যা তার কোন উপকারে আসে না’।[12] অতএব মৌলিকভাবে আমল কবুলের শর্ত তিনটি : (১) আক্বীদা বিশুদ্ধ হওয়া (২) তরীকা সঠিক হওয়া এবং (৩) ইখলাছে আমল। অর্থাৎ কাজটি নিঃস্বার্থভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য হওয়া (যুমার ৩৯/২)।[13]
(৪) ঈমানদাররাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ : সৃষ্টির মধ্যে মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হ’লেও (বনু ইস্রা্ঈল ১৭/৭০) যারা ঈমান আনবে প্রকৃতপক্ষে তারাই হবে শ্রেষ্ঠ। মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِيْنَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ هُمْ خَيْرُ الْبَرِيَّةِ، ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে, তারাই হ’ল সৃষ্টির সেরা’ (বাইয়েনাহ ৯৮/৭)। এ আয়াতের উপর ভিত্তি করে আবু হুরায়রাহ (রাঃ) ও একদল বিদ্বান মুমিনদের মর্যাদা ফেরেশতাদের উপরে নির্ধারণ করেছেন’।[14]
ঈমানের কারণে বান্দা সাহায্যপ্রাপ্ত হয় (বাক্বারাহ ২/২৪৯)। সুতরাং আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার জন্য ঈমানী বলে বলীয়ান হওয়া যরূরী। মহান আল্লাহ বলেন,وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِينَ، ‘আর আমাদের দায়িত্ব তো মুমিনদের সাহায্য করা’ (রূম ৩০/৪৭)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় শায়খ ছালেহ আল-উছায়মীন (রহঃ) বলেন, আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার অন্যতম কারণ হ’ল ঈমান’।[15]
ঈমানের কারণে মুমিনকে আল্লাহ তা‘আলা যাবতীয় ক্ষতি, অনিষ্ট ও কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা করেন। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللهَ يُدَافِعُ عَنِ الَّذِيْنَ آمَنُوا، ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের পক্ষে শত্রুদের প্রতিহত করেন’ (হজ্জ ২২/৩৮)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,قَاتِلُوهُمْ يُعَذِّبْهُمُ اللهُ بِأَيْدِيْكُمْ وَيُخْزِهِمْ وَيَنْصُرْكُمْ عَلَيْهِمْ وَيَشْفِ صُدُوْرَ قَوْمٍ مُؤْمِنِيْنَ، ‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর। আল্লাহ তোমাদের হাত দিয়ে তাদের শাস্তি দিবেন ও লাঞ্ছিত করবেন। তিনি তোমাদেরকে তাদের বিরুদ্ধে সাহায্য করবেন এবং মুমিনদের অন্তরগুলিকে প্রশান্ত করবেন’ (তওবাহ ৯/১৪)।
(৫) ঈমান হ’ল সর্বোত্তম আমল : আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, ‘কোন্ কাজটি উত্তম?’ তিনি বললেন, إيمَانٌ بِالله وَرَسُولِهِ. قِيلَ: ثُمَّ مَاذَا؟ قال: الجِهَادُ فِي سَبِيلِ الله. قِيلَ: ثُمَّ مَاذَا؟ قال: حَجٌّ مَبْرُورٌ، ‘আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা। জিজ্ঞেস করা হ’ল, অতঃপর কোন্টি? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। প্রশ্ন করা হ’ল, অতঃপর কোন্টি? তিনি বললেন, মাকবূল হজ্জ সম্পাদন করা’।[16] আব্দুল্লাহ ইবনু আবূ ক্বাতাদা (রহঃ) হ’তে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা (ক্বাতাদা রাঃ)-কে বর্ণনা করতে শুনেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কোন এক সময় তাদের মাঝে দাড়াঁলেন। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন,أَنَّ الْجِهَادَ فِي سَبِيلِ اللهِ وَالإِيمَانَ بِاللهِ أَفْضَلُ الأَعْمَالِ، ‘আল্লাহ তা‘আলার পথে জিহাদ এবং আল্লাহর উপর ঈমান হ’ল সর্বোত্তম আমল’।[17] আবূ যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-কে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোন্ আমল উত্তম? তিনি বললেন, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং তাঁর পথে জিহাদ করা।[18]
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহর বাণী, {مَن جاءَ بِالحَسَنَةِ فَلَهُ خَيْرٌ مِنها} قال هي لا إلهَ إلّا اللهُ {ومَن جاءَ بِالسَّيِّئَةِ فَكُبَّتْ وُجُوهُهُمْ فِي النّارِ} قال هي الشِّركُ. ‘যে ব্যক্তি সৎকর্ম নিয়ে (আমার কাছে) আসবে, সে তার চাইতে উত্তম প্রতিদান পাবে’ (নামল ২৭/৮৯) এটা হ’ল- লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ তথা ঈমান। ‘আর যে ব্যক্তি মন্দকর্ম নিয়ে আসবে, তাকে মুখে ভর দেওয়া অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’ (নামল ২৭/৯০), তিনি বলেন, এটা হ’ল- শিরক’।[19]
অনুরূপভাবে ঈমানের ঘোষণাও সর্বোত্তম নেকী। আবু যার (রাঃ) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি আমাকে অছিয়ত করুন। তিনি বললেন, إذا عمِلْتَ سيِّئةً فأتْبِعْها حَسَنةً تَمْحُها، قال: قُلْتُ: يا رسولَ اللهِ، أمنَ الحَسَناتِ لا إلهَ إلّا اللهُ؟ قال: هي أفضَلُ الحَسَناتِ، ‘যখন তোমার দ্বারা কোন পাপকাজ সংঘটিত হয়ে যাবে তখন সাথে সাথে নেকীর কাজ করবে, ফলে তা তোমার পাপকে মিটিয়ে দিবে। রাবী বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলাও কি নেকীর কাজ? তিনি বললেন, সেটি সর্বোত্তম নেকী’।[20]
(৬) ঈমানের কারণে ভালবাসা : মহান আল্লাহ ঈমানের কারণে একজন মুমিনের অন্তরের সাথে অন্য মুমিনের ভালবাসা সৃষ্টি করে দেন। সাথে সাথে দুনিয়ার মানুষের অন্তরেও তার জন্য ভালবাসা সৃষ্টি করে দেন। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِيْنَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَيَجْعَلُ لَهُمُ الرَّحْمَانُ وُدًّ، ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে, তাদের জন্য দয়াময় সৃষ্টি করে দেন পরস্পরে ভালবাসা’ (মারিয়াম ১৯/৯৬)। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, দুনিয়ার মানুষের মধ্যে ভালবাসা সৃষ্টি করে দেন।[21] ঈমানের কারণেই আনছার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভালবাসা সৃষ্টি করেছিলেন। আল্লাহ বলেন,
وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيْمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلاَ يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
‘আর যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে এ নগরীতে বসবাস করত এবং ঈমান এনেছিল। যারা মুহাজিরদের ভালবাসে এবং তাদেরকে (ফাই থেকে) যা দেওয়া হয়েছে, তাতে তারা নিজেদের মনে কোনরূপ আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে না। আর তারা নিজেদের উপর তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তাদেরই রয়েছে অভাব। বস্ত্ততঃ যারা হৃদয়ের কার্পণ্য হ’তে মুক্ত, তারাই সফলকাম’ (হাশর ৫৯/৯)।
(৭) ঈমানের কারণে মর্যাদা বৃদ্ধি : ঈমানের কারণে আল্লাহ মুমিনদেরকে অন্যান্য মানুষের উপর মর্যাদাবান করেন। আল্লাহ বলেন,يَرْفَعِ اللهُ الَّذِيْنَ آمَنُوْا مِنْكُمْ وَالَّذِيْنَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ، ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে উচ্চ মর্যাদা দান করবেন’ (মুজাদালাহ ৫৮/১১)। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إنّ اللهَ يرفعُ بِهَذا الكتابِ أقوامًا، ويضعُ بِهِ آخرينَ، ‘আল্লাহ তা‘আলা এ কিতাব দ্বারা অনেক জাতিকে মর্যাদায় উন্নীত করেন আর অন্যদের অবনত করেন’।[22]
(৮) গুনাহের কাফফারা : ঈমান আনার ফলে পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মিটে যায়। মহান আল্লাহ বলেন, وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَنُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَحْسَنَ الَّذِي كَانُوا يَعْمَلُونَ، ‘আর যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে আমরা অবশ্যই তাদের মন্দ কর্মগুলি মিটিয়ে দেব এবং তাদের কাজের সর্বোত্তম ফলাফল দান করব’ (আনকাবূত ২৯/৭)। ঈমানের সাথে বান্দা কোন ভালো কাজ করলে আল্লাহ বান্দার গুনাহ মাফ করে থাকেন। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللهِ وَيَعْمَلْ صَالِحًا يُكَفِّرْ عَنْهُ سَيِّئَاتِهِ وَيُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ، ‘অতঃপর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে, তিনি তার পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। যার তলদেশ দিয়ে নদী সমূহ প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর সেটাই হ’ল মহা সফলতা’ (তাগাবুন ৬৪/৯)। আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ الإِسْلاَمَ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ وَأَنَّ الْهِجْرَةَ تَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهَا وَأَنَّ الْحَجَّ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ، ‘তুমি কি জান না যে, ইসলাম (ঈমান) পূর্ববর্তী সকল অন্যায় মিটিয়ে দেয়। আর হিজরত পূর্ববর্তী সকল অন্যায় মিটিয়ে দেয়? আর হজ্জ পূর্ববর্তী সকল অন্যায় মিটিয়ে দেয়’?[23]
(৯) ঈমানের অসীলায় প্রার্থনা করা : ঈমান এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার অসীলায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা যায়।[24] মহান আল্লাহ বলেন, رَبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلْإِيْمَانِ أَنْ آمِنُوْا بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِ، ‘হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয়ই আমরা একজন আহবানকারীকে (মুহাম্মাদ) ঈমানের প্রতি আহবান জানাতে শুনেছি এই বলে যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর। অতঃপর তাতে আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি। সুতরাং হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদের পাপসমূহ ক্ষমা কর ও আমাদের দোষ-ত্রুটিসমূহ মার্জনা কর এবং আমাদেরকে সৎকর্মশীলদের সাথে মৃত্যুদান কর’ (আলে ইমরান ৩/১৯৩)।
আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘ইব্রাহীম (আঃ) সারাকে সঙ্গে নিয়ে হিজরত করলেন এবং এমন এক জনপদে প্রবেশ করলেন, যেখানে এক বাদশাহ ছিল অথবা বললেন, এক অত্যাচারী শাসক ছিল। তাকে বলা হ’ল যে, ইবরাহীম (নামক এক ব্যক্তি) এক পরমা সুন্দরী নারীকে নিয়ে (আমাদের এখানে) প্রবেশ করেছে। সে তখন তাঁর নিকট লোক পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করল, হে ইবরাহীম! তোমার সঙ্গে এ নারী কে? তিনি বললেন, আমার বোন। অতঃপর তিনি সারার নিকট ফিরে এসে বললেন, তুমি আমার কথা মিথ্যা মনে করো না। আমি তাদেরকে বলেছি যে, তুমি আমার বোন। আল্লাহর শপথ! দুনিয়াতে (এখন) তুমি আর আমি ব্যতীত আর কেউ মুমিন নেই। সুতরাং আমি ও তুমি দ্বীনী ভাই-বোন। এরপর ইবরাহীম (আঃ) (বাদশাহর নির্দেশে) সারাকে বাদশাহর নিকট পাঠিয়ে দিলেন। বাদশাহ তাঁর দিকে অগ্রসর হ’ল। সারা ওযূ করে ছালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং এ দো‘আ করলেন,اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتُ آمَنْتُ بِكَ وَبِرَسُولِكَ وَأَحْصَنْتُ فَرْجِي إِلاَّ عَلَى زَوْجِي فَلاَ تُسَلِّطْ عَلَيَّ الْكَافِرَ، ‘হে আল্লাহ! যদি আমি তোমার উপর এবং তোমার রাসূলের উপর ঈমান এনে থাকি এবং আমার স্বামী ব্যতীত অন্যদের নিকট আমার লজ্জাস্থানের হেফাযত করে থাকি তাহ’লে তুমি এই কাফেরকে আমার উপর বিজয়ী করো না। তখন বাদশাহ বেহুঁশ হয়ে পড়ে মাটিতে পায়ের আঘাত করতে লাগলো। তখন সারা বললেন, হে আল্লাহ! এ অবস্থায় যদি সে মারা যায় তবে লোকেরা বলবে, স্ত্রীলোকটি একে হত্যা করেছে। তখন সে সংজ্ঞা ফিরে পেল। এভাবে দু’বার বা তিনবারের পর বাদশাহ বলল, আল্লাহর শপথ! তোমরা তো আমার নিকট এক শয়তানীকে পাঠিয়েছ। একে ইব্রাহীমের নিকটে ফিরিয়ে দাও এবং তার জন্য হাজেরাকে হাদিয়া স্বরূপ দান কর। সারাহ তখন ইব্রাহীম (আঃ)-এর নিকটে ফিরে এসে বললেন, আপনি জানেন কি? আল্লাহ তা‘আলা কাফেরকে লজ্জিত ও নিরাশ করেছেন এবং সে এক বাঁদী হাদিয়া হিসাবে দিয়েছে’।[25]
(১০) শয়তান থেকে বাঁচার অন্যতম মাধ্যম হ’ল ঈমান : শয়তান মানুষকে বিভিন্নভাবে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে (আ‘রাফ ৭/১৬-১৭)। বিশেষ করে ঈমানের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করে। শয়তানের সন্দেহ হ’তে বাঁচার অন্যতম উপায় ঈমানের ঘোষণা। আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘মানুষের মনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে এমন প্রশ্নেরও সৃষ্টি হয় যে, এ সৃষ্টিজগত তো আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, তাহ’লে আল্লাহকে সৃষ্টি করল কে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, فَمَنْ وَجَدَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَلْيَقُلْ آمَنْتُ بِاللهِ، ‘যার অন্তরে এমন প্রশ্নের উদয় হয় সে যেন বলে, আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি’।[26]
(১১) ঈমান সফলতার পথ দেখায় : ঈমানদারদের জন্য রয়েছে হেদায়াত ও দুনিয়া-আখিরাতে সফলতা। ঈমানের আলোচনা করার পর মহান আল্লাহ বলেন, أُولَئِكَ عَلَى هُدَىً مِنْ رَبِّهِمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ، ‘এরাই হ’ল তাদের প্রতিপালকের প্রদর্শিত পথের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এরাই হ’ল সফলকাম’ (বাক্বারাহ ২/৫)। মহান আল্লাহ বলেন,وَعَدَ اللهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ عَظِيمٌ، ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে, আল্লাহ তাদের জন্য ক্ষমা ও মহা পুরস্কারের ওয়াদা করেছেন’ (মায়েদাহ ৫/৯)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللهِ وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللهِ يَهْدِ قَلْبَهُ وَاللهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ، ‘কেউ কোন বিপদে পতিত হয় না আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত। বস্ত্তত যে ব্যক্তি আল্লাহকে বিশ্বাস করে, তিনি তার হৃদয়কে সুপথে পরিচালিত করেন। আর আল্লাহ সকল বিষয়ে বিজ্ঞ’ (তাগাবুন ৬৪/১১)। তিনি বলেন,وَإِنَّ اللهَ لَهَادِ الَّذِينَ ءَامَنُوا إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ ‘আর নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বাস স্থাপনকারীদেরকে সরল পথে পরিচালিত করেন’ (হজ্জ ২২/৫৪)।
ঈমান মুমিনকে জান্নাতের পথ দেখায়। মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ يَهْدِيهِمْ رَبُّهُمْ بِإِيمَانِهِمْ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهِمُ الْأَنْهَارُ فِي جَنَّاتِ النَّعِيمِ، ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে, তাদের প্রতিপালক তাদেরকে তাদের ঈমানের মাধ্যমে নে‘মতপূর্ণ জান্নাত সমূহের দিকে পথ প্রদর্শন করেন। যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়’ (ইউনুস ১০/৯)। মুজাহিদ (রাঃ) বলেন, তাদের জন্য আলোর ব্যবস্থা করবেন ফলে তারা সে আলোতে আলোকিত হয়ে পথ চলতে পারবে।[27] পথ দেখানোটা দুনিয়া ও আখেরাতে হবে। দুনিয়াতে জান্নাতের পথ, ক্ষমার পথ দেখাবেন (আন‘আম ৬/১২২, শুরা ৪২/৫২, হাদীদ ৫৭/২৮)।
ক্বাতাদা ও ইবনু জুরাইজ বলেন, ঈমানদারের আমল তার জন্য সুন্দর আকৃতি ও সুগন্ধিযুক্ত বাতাসের আকৃতি ধারণ করবে, আর যখন সে কবর থেকে উঠবে তখন তার সম্মুখীন হয়ে তাকে যাবতীয় কল্যাণের সুসংবাদ জানাবে। সে তখন তাকে জিজ্ঞেস করবে, তুমি কে? সে বলবে, আমি তোমার আমল। তখন তার সামনে আলোর ব্যবস্থা করবে যতক্ষণ না সে জান্নাতে প্রবেশ করে। পক্ষান্তরে অবিশ্বাসীদের জন্য তার আমল কুৎসিত আকৃতি ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে আসবে এবং তার সার্বক্ষণিক সাথী হবে যতক্ষণ না সে তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবে।[28]
(১২) ঈমানদারদেরকে শয়তান প্রভাবিত করতে পারে না : শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শক্র।[29] সে মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য সামনে ও পিছনে, ডাইনে ও বামে (সবদিক দিয়ে) আক্রমণ করে। কিন্তু প্রকৃত ঈমানদারদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করতে পারে না। আল্লাহ বলেন,إِنَّهُ لَيْسَ لَهُ سُلْطَانٌ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ، ‘নিশ্চয়ই শয়তানের কোন আধিপত্য চলে না তাদের উপর, যারা ঈমান আনে ও তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে’ (নাহল ১৬/৯৯)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘সে বলল, আপনার ইয্যতের কসম! আমি অবশ্যই তাদের সবাইকে বিপথগামী করব। তবে তাদের মধ্যে আপনার একনিষ্ঠ বান্দারা ব্যতীত’ (ছোয়াদ ৩৮/৮২-৮৩)।
(১৩) মুমিনের জন্য সুখ-দুঃখ দু’টিই কল্যাণকর : সত্যিকারের ঈমানদারদের জীবনের সুখ-দুঃখ দু’টিই কল্যাণকর। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, عجبا لأمر الْمُؤمن كُله خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَلِكَ لِأَحَدٍ إِلَّا لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ ‘ঈমানদারের ব্যাপারটাই অদ্ভূত। বস্তলুত ঈমানদারের প্রতিটি কাজই তার জন্য কল্যাণকর। আর এটা একমাত্র মুমিনদেরই বৈশিষ্ট্য। তার সচ্ছলতা অর্জিত হ’লে সে শোকরিয়া আদায় করে, এটা তার জন্য কল্যাণকর। আর তার উপর কোন বিপদ আসলে সে ধৈর্যধারণ করে, এটাও তার জন্য কল্যাণকর’।[30] আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَا يُصِيبُ الْمُؤْمِنَ مِنْ شَوْكَةٍ فَمَا فَوْقَهَا إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ بِهَا دَرَجَةً أَوْ حَطَّ عَنْهُ بِهَا خَطِيئَةً، ‘কোন ঈমানদার ব্যক্তির শরীরে একটি মাত্র কাটার আঘাত কিংবা তার চাইতেও নগণ্য কোন আঘাত লাগলে আল্লাহ তা‘আলা তার একটি মর্যাদা বাড়িয়ে দেন কিংবা তার একটি গুনাহ মোচন করে দেন’।[31]
(১৪) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বন্ধুত্ব লাভ : ঈমানদারগণ মহান আল্লাহর বন্ধু। মহান আল্লাহ বলেন,أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ، الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ، ‘মনে রেখ (আখেরাতে) আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না। যারা ঈমান আনে ও সর্বদা আল্লাহকে ভয় করে’ (ইউনুস ১০/৬২-৬৩)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,
اللهُ وَلِيُّ الَّذِيْنَ آمَنُوْا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُمْ مِنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ-
‘আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক। তিনি তাদেরকে অন্ধকার হ’তে আলোর দিকে বের করে আনেন। আর শয়তান হ’ল অবিশ্বাসীদের বন্ধু। তারা তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারের দিকে বের করে নিয়ে যায়। ওরা হ’ল জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/২৫৭)। তিনি আরো বলেন,إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِإِبْرَاهِيمَ لَلَّذِينَ اتَّبَعُوهُ وَهَذَا النَّبِيُّ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَاللهُ وَلِيُّ الْمُؤْمِنِينَ ‘নিশ্চয়ই লোকদের মধ্যে ইব্রাহীমের নিকটতম ব্যক্তি তারাই, যারা তার অনুসারী হয়েছে এবং এই নবী (মুহাম্মাদ) ও যারা তার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছে। আর আল্লাহ হ’লেন বিশ্বাসীদের অভিভাবক’ (আলে ইমরান ৩/৬৮)।
মুমিনগণ যেমন আল্লাহর বন্ধু তেমনি তারা রাসূল (ছাঃ)-এরও বন্ধু। আমর ইবনু আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে উচ্চৈঃস্বরে বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেন, إِنَّ آلَ أَبِيْ لَيْسُوا بِأَوْلِيَائِي، إِنَّمَا وَلِيِّيَ اللهُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘অমুকের বংশ আমার বন্ধু নয়। বরং আমার বন্ধু আল্লাহ ও নেককার মুমিনগণ’।[32]
(১৫) মুমিনরে জন্যই সুসংবাদ : মুমিনদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে সুসংবাদ রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,وَبَشِّرِ الَّذِيْنَ آمَنُوا وَعَمِلُوْا الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ كُلَّمَا رُزِقُوْا مِنْهَا مِنْ ثَمَرَةٍ رِزْقًا قَالُوا هَذَا الَّذِي رُزِقْنَا مِنْ قَبْلُ وَأُتُوا بِهِ مُتَشَابِهًا وَلَهُمْ فِيهَا أَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَهُمْ فِيهَا خَالِدُونَ، ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে, তাদেরকে তুমি জান্নাতের সুসংবাদ দাও, যার তলদেশ দিয়ে নদী সমূহ প্রবাহিত। যখন তারা সেখানে কোন ফল খাদ্য হিসাবে পাবে, তখন বলবে, এটা তো সেইরূপ, যা আমরা ইতিপূর্বে পেয়েছিলাম। এভাবে তাদেরকে দেওয়া হবে দুনিয়ার সাদৃশ্যপূর্ণ খাদ্যসমূহ। এছাড়া তাদের জন্য সেখানে থাকবে পবিত্রা স্ত্রীগণ। সেখানে তারা থাকবে অনন্তকাল’ (বাক্বারাহ ২/২৫)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,أَكَانَ لِلنَّاسِ عَجَبًا أَنْ أَوْحَيْنَا إِلَى رَجُلٍ مِنْهُمْ أَنْ أَنْذِرِ النَّاسَ وَبَشِّرِ الَّذِينَ آمَنُوا أَنَّ لَهُمْ قَدَمَ صِدْقٍ عِنْدَ رَبِّهِمْ قَالَ الْكَافِرُونَ إِنَّ هَذَا لَسَاحِرٌ مُبِينٌ، ‘এটা কি লোকদের জন্য বিস্ময়কর হয়েছে যে, আমরা তাদেরই মধ্যকার একজন ব্যক্তির নিকট প্রত্যাদেশ করেছি যে, তুমি লোকদের (জাহান্নাম থেকে) সতর্ক কর এবং বিশ্বাসীদের সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে যথার্থ মর্যাদার স্থান’ (ইউনুস ১০/২)।
(১৬) মৃত্যুর সময় প্রশান্তি ও আখেরাতে জান্নাত লাভ : ঈমান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা মানুষের সবচেয়ে বড় পাওয়া। তাই রাসূল (ছাঃ) মুমূর্ষু ব্যক্তিকে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ তথা ঈমানের তালক্বীন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।[33] ঈমানদার ব্যক্তির মৃত্যুর সময় প্রশান্তি লাভ করবে। ত্বালহা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন, إنِّي لأَعلَمُ كلمةً لا يَقولُها عبدٌ عِندَ موتِه إلّا أشرَقَ لونُه، ونفَّسَ اللهُ عنه كُربتَه: لا إلهَ إلَّا اللهُ، ‘আমার এমন একটি কালেমার কথা জানা আছে, যা কোন ব্যক্তি মৃত্যুর সময় পাঠ করলে, তা তার চেহারাকে উজ্জ্বল করে এবং আল্লাহ তা‘আলা তার থেকে বিপদাপদ দূর করে দেন’ তাহলে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।[34] আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,من قالَ: لا إلَهَ إلا اللهُ أنجَتهُ يومًا مِن دَهْرِهِ، أصابَهُ قبلَ ذلِكَ ما أصابَهُ ‘যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (তথা ঈমানের ঘোষণা) বলবে এই কালিমা তাকে ঐ সময়ে মুক্তি দিবে যখন তার উপর মুছীবত আসবে’।[35]
ঈমান অবস্থায় কারো মৃত্যু হ’লে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ كَانَ آخِرُ كَلاَمِهِ لَا إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ دَخَلَ الْجَنَّةَ ‘যার শেষ কথা ’লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ হবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[36] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ مَاتَ وَهُوَ يَشْهَدُ أَنْ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًارَسُولُ اللهِ صَادِقًا مِنْ قَلْبِهِ دَخَلَ الْجَنَّةَ، ‘যে মৃত্যুর সময় সত্যচিত্তে অন্তর দিয়ে (ইখলাছের সাথে) এ সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[37]
ঈমান অবস্থায় মহান আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করলে আল্লাহ জান্নাত দিবেন। আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنِّي رَسُولُ اللهِ لاَ يَلْقَى اللهَ بِهِمَا عَبْدٌ غَيْرَ شَاكٍّ فِيهِمَا إِلاَّ دَخَلَ الْجَنَّةَ ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল। যে ব্যক্তি এ বিষয় দু’টোর প্রতি নিঃসন্দেহে বিশ্বাস রেখে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[38] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنِّي رَسُولُ اللهِ لاَ يَلْقَى اللهَ بِهِمَا عَبْدٌ غَيْرَ شَاكٍّ فَيُحْجَبَ عَنِ الْجَنَّةِ، ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল’ যে ব্যক্তি নিঃসন্দেহ এ কথা দু’টোর উপর ঈমান রেখে আল্লাহর নিকট উপস্থিত হবে সে জান্নাত থেকে বঞ্চিত হবে না’।[39]
ক্বিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থা থেকেও মুমিনগণ মুক্ত থাকবেন। আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ اللهَ يَبْعَثُ رِيحًا مِنَ الْيَمَنِ أَلْيَنَ مِنَ الْحَرِيرِ فَلاَ تَدَعُ أَحَدًا فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةٍ مِنْ إِيمَانٍ إِلاَّ قَبَضَتْهُ ‘আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের আগে ইয়ামান থেকে এক বাতাস প্রবাহিত করবেন যা হবে রেশম অপেক্ষাও নরম। যার অন্তরে দানা পরিমাণ ঈমান থাকবে তার রূহ ঐ বাতাস কবয করে নিয়ে যাবে’।[40]
ক্বিয়ামতের দিন ঈমানদারগণ আলো লাভ করবে। আল্লাহ বলেন, يَوْمَ تَرَى الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ يَسْعَى نُورُهُمْ بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ بُشْرَاكُمُ الْيَوْمَ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ، ‘যেদিন তুমি ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীদের দেখবে তাদের সম্মুখে ও ডাইনে তাদের ঈমানের জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। (এ সময় তাদের) বলা হবে, তোমাদের জন্য আজ সুসংবাদ হ’ল জান্নাতের, যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত। যেখানে তোমরা চিরকাল থাকবে। আর এটাই হ’ল মহা সফলতা’ (হাদীদ ৫৭/১২)।
(১৭) মীযানের পাল্লায় সবচেয়ে ভারী হবে ঈমান : ক্বিয়ামতের দিন সকলের আমল ওযন করা হবে। (আ‘রাফ ৭/৮)। আর ঈমানের ওযনই সবচেয়ে বেশী হবে। আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ), ‘নূহ (আঃ)-এর মৃত্যুর সময় তাঁর দুই ছেলেকে অছিয়ত করে বলেন,
إِنِّي قَاصِرٌ عَلَيْكُمَا الْوَصِيَّةَ آمُرُكُمَا بِاثْنَتَيْنِ وَأَنْهَاكُمَا عَن اثْنَتَيْنِ أَنْهَاكُمَا عَن الشِّرْكِ وَالْكِبْرِ وَآمُرُكُمَا بِلَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ فَإِنَّ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا فِيهِمَا لَوْ وُضِعَتْ فِي كِفَّةِ الْمِيزَانِ وَوُضِعَتْ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ فِي الْكِفَّةِ الْأُخْرَى كَانَتْ أَرْجَحَ وَلَوْ أَنَّ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا حَلْقَةً فَوُضِعَتْ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ عَلَيْهَا لَفَصَمَتْهَا أَوْ لَقَصَمَتْهَا ‘আমি তোমাকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (বলার) আদেশ করছি। কেননা সাত আসমান এবং সাত যমীনকে যদি মীযানের এক পাল্লায় রাখা হয় আর ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’কে অপর পাল্লায় রাখা হয়, তাহ’লে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র পাল্লা বেশী ভারী হবে। যদি সাত আসমান এবং সাত যমীন নিরেট গোলাকার বস্ত্ত হয়, তাহ’লেও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তা চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবে’।[41]
আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন আমার উম্মতের একজনকে সমস্ত সৃষ্টির সামনে আলাদা করে উপস্থিত করবেন। তিনি তার সামনে নিরানববইটি আমলনামার খাতা খুলে ধরবেন। প্রতিটি খাতা দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। তারপর তিনি প্রশ্ন করবেন, তুমি কি এগুলো হ’তে কোন একটি (গুনাহ) অস্বীকার করতে পার? আমার লেখক ফেরেশতারা কি তোমার উপর যুলুম করেছে? সে বলবে, না, হে প্রভু! তিনি আবার প্রশ্ন করবেন, তোমার কোন অভিযোগ আছে কি? সে বলবে, না, হে আমার প্রভু! তিনি বলবেন, আমার নিকট তোমার একটি ছওয়াব আছে। আজ তোমার উপর এতটুকু যুলুমও করা হবে না। তখন ছোট একটি কাগজের টুকরা বের করা হবে। তাতে লিখা থাকবে, ‘আমি সাক্ষ্য প্রদান করি যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আর কোন প্রভু নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দেই যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল’। তিনি তাকে বলবেন, মীযানের সামনে যাও। সে বলবে, হে প্রভু! এতগুলো খাতার বিপরীতে এই সামান্য কাগজটুকুর কি আর ওযন হবে? তিনি বলবেন, তোমার উপর কোন যুলুম করা হবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তারপর খাতাগুলো এক পাল্লায় রাখা হবে এবং উক্ত টুকরাটি আরেক পাল্লায় রাখা হবে। ওযনে খাতাগুলোর পাল্লা হালকা হবে এবং কাগজের টুকরার পাল্লা ভারী হবে। আর আল্লাহ তা‘আলার নামের বিপরীতে কোন কিছুই ভারী হ’তে পারে না’।[42]
(১৮) খালেছ ঈমানের কারণে বান্দা রাসূল (ছাঃ) শাফা‘আত লাভে ধন্য হবেন : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শাফা‘আত মুমিনের জন্য আখেরাতে সবচেয়ে বড় নে’মত। আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল! ক্বিয়ামতের দিন আপনার সুফারিশ লাভের ব্যাপারে কে সবচেয়ে অধিক সৌভাগ্যবান হবে? তিনি বললেন, আবূ হুরায়রাহ! আমি মনে করেছিলাম, এ বিষয়ে তোমার পূর্বে আমাকে আর কেউ জিজ্ঞেস করবে না। কেননা আমি দেখেছি হাদীছের প্রতি তোমার বিশেষ লোভ রয়েছে।أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ أَوْ نَفْسِهِ ‘ক্বিয়ামতের দিন আমার শাফা‘আত লাভে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান হবে সেই ব্যাক্তি যে একনিষ্ঠভাবে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে’।[43]
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত শাফা‘আতের দীর্ঘ হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেন, দুনিয়ার সমস্ত মানুষ যখন শাফা‘আতের জন্য তাঁর কাছে আসবে তখন আল্লাহ তাঁকে বলবেন, يَا مُحَمَّدُ ارْفَعْ رَأْسَكَ وَقُلْ يُسْمَعْ لَكَ وَسَلْ تُعْطَ وَاشْفَعْ تُشَفَّعْ فَأَقُولُ يَا رَبِّ أُمَّتِي أُمَّتِي فَيَقُولُ انْطَلِقْ فَأَخْرِجْ مِنْهَا مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ أَوْ خَرْدَلَةٍ مِنْ إِيمَانٍ فَأَخْرِجْهُ فَأَنْطَلِقُ فَأَفْعَلُ ‘হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। তোমার কথা শোনা হবে। চাও, দেয়া হবে। সুফারিশ কর, গ্রহণ করা হবে। তখনো আমি বলব, হে আমার রব! আমার উম্মাত! আমার উম্মাত! তখন বলা হবে, যাও, যাদের এক অণু কিংবা সরিষা পরিমাণ ঈমান আছে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের কর। আমি গিয়ে তাই করব। আমি আবার ফিরে আসব এবং সেসব প্রশংসা বাক্য দিয়ে আল্লাহর প্রশংসা করবো। আর সিজদায় পড়ে যাবো। আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। বল, তোমার কথা শোনা হবে। চাও, দেয়া হবে। সুফারিশ কর, গ্রহণ করা হবে। আমি তখন বলবো, হে আমার রব! আমার উম্মাত, আমার উম্মাত, এরপর আল্লাহ্ বলবেন, যাও, যাদের অন্তরে সরিষা দানার চেয়েও ক্ষুদ্র পরিমাণ ঈমান আছে, তাদেরকেও জাহান্নাম থেকে বের করে আন। আমি যাবো এবং তাই করবো’।[44]
(১৯) ঈমান ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে বের করে আনবে : মুমিন ব্যক্তি কোন পাপের কারণে জাহান্নামে গেলেও ঈমানের কারণে যে জাহান্নাম থেকে বের হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,من قال لا إله إلا اللهُ، نفعَتْه يومًا من دهرِه، يُصيبُه قبلَ ذلك ما أصابَه. ‘যে ব্যক্তি ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলবে একদিন না একদিন এই কালেমা অবশ্যই তার উপকারে আসবে। যদিও ইতিপূর্বে তাকে কিছুটা শাস্তি ভোগ করতে হবে’।[45] আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,يَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَفِي قَلْبِهِ وَزْنُ شَعِيرَةٍ مِنْ خَيْرٍ، وَيَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَفِي قَلْبِهِ وَزْنُ بُرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ، وَيَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَفِي قَلْبِهِ وَزْنُ ذَرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ ‘যে ব্যক্তি ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলবে আর তার অন্তরে একটি যব পরিমাণও পুণ্য থাকবে, তাকে জাহান্নাম হ’তে বের করা হবে এবং যে ব্যক্তি ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলবে আর তার অন্তরে একটি গম পরিমাণও পুণ্য থাকবে তাকে জাহান্নাম হ’তে বের করা হবে এবং যে ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলবে আর তার অন্তরে একটি অণু পরিমাণও নেকী থাকবে তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে’।[46]
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘জান্নাতীরা জান্নাতে এবং জাহান্নামীরা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদেরকে বলবেন, যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণও ঈমান আছে, তাকে জাহান্নাম হ’তে বের করে আনো। তারপর তাদের জাহান্নাম হ’তে এমন অবস্থায় বের করা হবে যে, তারা (পুড়ে) কালো হয়ে গেছে। অতঃপর তাদের বৃষ্টিতে বা হায়াতের নদীতে নিক্ষেপ করা হবে। ফলে তারা সতেজ হয়ে উঠবে, যেমন নদীর তীরে ঘাসের বীজ গজিয়ে উঠে। তুমি কি দেখতে পাও না সেগুলো কেমন হলুদ বর্ণের হয় ও ঘন হয়ে
গজায়’?[47] ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, إنِّي لأعلَمُ كلِمةً لا يقولُها عبدٌ حقًّا من قلبِه فيموتُ على ذلِك إلّا حُرِّمَ على النّارِ لا إلهَ إلّا اللهُ ‘নিশ্চয়ই আমি একটি বাক্য জানি যা কোন বান্দা অন্তরে বিশ^াস করে বলবে এবং এর উপর মৃত্যুবরণ করবে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, (বাক্যটি হ’ল) ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।[48]
পরিশেষে বলব, ঈমান হচ্ছে পরকালীন জীবনে মুক্তির একমাত্র সোপান। রাসূল (ছাঃ)-এর শাফা‘আত লাভ ও জান্নাতের প্রবেশের চাবিকাঠিই হ’ল ঈমান। সুতরাং ঈমান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই ঈমান খালেছ হ’লে পরকালে মুক্তি মিলবে। অন্যথা জাহান্নামে যেতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ঈমান বিশুদ্ধ করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!
মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
তুলাগাঁও (নোয়াপাড়া), দেবিদ্বার, কুমিল্লা।
[1]. ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, মু‘জামুল ওয়াফী, পৃ. ১৫৮।
[2]. ইবনু মাজাহ হা/৩৯৩৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৬৫৮।
[3]. মুসলিম হা/৮; আবু দাঊদ হা/৪৬৯৫।
[4]. বুখারী হা/৮; মুসলিম হা/১৬।
[5]. তাফসীরে কুরতবী, সূরা আম্বিয়া ২৫নং আয়াতের তাফসীর দ্র:।
[6]. আ‘রাফ ৭/৫৯, ৬৫, ৭৩, ৮৫; হূদ ১১/৫০, ৬১, ৮৪; মুমিনূন ২৩/২৩; আনকাবূত ২৯/৩৬।
[7]. আহমাদ হা/১৬০৬৬; হাকেম হা/৩৯, ৪২১৯, হাদীছ ছহীহ।
[8]. মুসলিম, হা/১৯; আবু দাউদ, হা/১৫৮৪; মিশকাত, হা/১৭৭২।
[9]. উল্লেখ্য যে, ইখলাছই হ’ল ঈমান। আবু ফারাস আল-আসলামী বলেন, نادى رجل فقال يا رسول الله ما الإيمان قال الإخلاص ‘একজন লোক ডাকলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! ঈমান কী? তিনি বললেন, ইখলাছ (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৬৪৪১; ছহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৩; শু‘আবুল ঈমান হা/৬৪৪২; ছহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৩)।
[10]. নাসাঈ হা/৩১৪০; ছহীহুত তারগীব হা/১৩৩১।
[11]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, সূরা কাহাফ ১১০নং আয়াতে ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[12]. আল-ফাওয়ায়েদ পৃ. ৪৯; গৃহীত: মাসিক আত-তাহরীক, মার্চ ২০১৮ পৃ. ৬৩।
[13]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, তাফসীরুল কুরআন, সূরা আছর ৩ নং আয়াতের তাফসীর দ্র:।
[14]. তাফসীরে কুরতুবী, তাফসীরে ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআন, ৩০তম পারা ৪০৮ পৃঃ।
[15]. তাফসীরে উছায়মীন সূরা রূম ৪৭নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র:।
[16]. বুখারী হা/২৬; মুসলিম হা/৮৩।
[17]. মুসলিম হা/১৮৮৫; তিরমিযী হা/১৭১২।
[18]. বুখারী হা/২৫১৮; মুসলিম হা/৮৪।
[19]. শাওকানী, ফাতহুল ক্বাদীর ৪/২২০; ইবনে জারীর, হা/২৭১৩০; মুসনাদে ইসহাক্ব ইবনু রাহওয়াইহ, হা/১৯২।
[20]. আহমাদ, হা/২১৫২৫; ছহীহুত তারগীব, হা/৩১৬২।
[21]. তাফসীরে তাবারী, সূরা মারিয়াম ৯৬ নং আয়াতের তাফসীর দ্র.।
[22]. মুসলিম হা/৮১৭; ইবনে মাজাহ হা/১৮০।
[23]. মুসলিম হা/১২১; ছহীহুল জামে হা/১৩২৯।
[24]. এছাড়া যে সকল বিষয় দ্বারা অসীলা চাওয়া যায় সেগুলো হল- আল্লাহর নাম ও গুণাবলী (আ‘রাফ ৭/১৮০, নাসাঈ হা/১৩০৫); সৎআমল (বুখারী হা/২২১৫); জীবিত সৎ ব্যক্তির নিকট দো‘আ চাওয়া (বুখারী হা/৬৩৪২) ইত্যাদি।
[25]. বুখারী, হা/২২১৭, ২৬৩৬।
[26]. মুসলিম হা/১৩৪।
[27]. তাফসীরে তাবারী, সূরা ইউনুস ৯ নং আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
[28]. তাফসীরে তাবারী; তাফসীরে ইবনে কাছীর, সূরা ইউনুস ৯ নং আয়াতের তাফসীর দ্র.।
[29]. বাকারা ২/১৬৮, ২০৮; আন‘আম ৬/১৪২; আ‘রাফ ৭/২২; ইউসুফ ১২/৫; ইয়াসীন ৩৬/৬০; যুখরুফ ৪৩/৬২।
[30]. মুসলিম হা/২৯৯৯; মিশকাত হা/৫২৯৭।
[31]. মুসলিম হা/২৫৭২; বুখারী হা/৫৬৪০নং হাদীছে ঈমানদারের পরিবর্তে মুসলিম শব্দ এসেছে।
[32]. বুখারী হা/৫৯৯০; মুসলিম হা/২১৫।
[33]. মুসলিম হা/৯১৭; ইবনে মাজাহ হা/১৪৪৪।
[34]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩৮৪; ইবনু মাজাহ, হা/৩৭৯৫; নাসাঈ সুনানুল কুবরা, হা/১০৯৩৮।
[35]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৯৩২।
[36]. আবু দাউদ হা/৩১১৮; ছহীহুল জামে হা/৬৪৭৯।
[37]. আহমাদ হা/২২০০৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২২৭৮।
[38]. মুসলিম হা/২৭ (হাদীছ একাডেমি হা/৪৫)।
[39]. মুসলিম হা/২৭ (হাদীছ একাডেমি হা/৪৫)।
[40]. মুসলিম হা/১১৭।
[41]. আহমাদ ৭১০১; ত্বাবরানী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২১৯; ছহীহাহ ১৩৪।
[42]. সুনান তিরমিযী হা/২৬৩৯; ইবনু মাজাহ হা/৪৩০০; ছহীহ ইবনে হিববান হা/২২৫; ছহীহাহ হা/১৩৫।
[43]. বুখারী হা/৯৯; ছহীহুল জামি‘ হা/৯৬৭।
[44]. বুখারী হা/৭৫১০।
[45]. ত্বাবারানী কাবীর হা/১৪০; আল জামে‘ উছ ছাগীর হা/৮৮৭৬।
[46]. বুখারী হা/৪৪; মুসলিম হা/১৯৩।
[47]. বুখারী হা/২২; মুসলিম হা/১৮৪।
[48]. আহমাদ হা/৪৪৭; ছহীহ ইবনে হিববান হা/২০৪; ছহীহ তারগীব হা/১৫২৮।