পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫। পর্ব ৬। পর্ব ৭।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ)-এর মা
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) শারঈ ইলমে অত্যুচ্চ আসনে আসীন হয়েছিলেন। তার জ্ঞানগরিমার জন্য ইসলামী দুনিয়া তাকে ‘শায়খুল ইসলাম’ উপাধিতে ভূষিত করে। সমসাময়িক ও পরবর্তীকালে আগত যেসব মনীষী তার বিদ্যা-বুদ্ধি সম্পর্কে অবগত হয়েছেন, তারা সকলে তাঁর এ উপাধি একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন। ইবনু নাছের দিমাশকী তার ‘আর-রাদ্দুল ওয়াফির’ গ্রন্থে ইবনু তায়মিয়া (রহঃ)-এর সময়কালে ও তার পরবর্তীতে যে সকল বড় বড় আলেম তাকে ‘শায়খুল ইসলাম’ নামে উল্লেখ করেছেন তাদের জীবনালেখ্য তুলে ধরেছেন।
ইমাম তাকিউদ্দীন আহমাদ ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বহু গুণে গুণান্বিত ছিলেন। এ সম্পর্কে অনেক মনীষীর উক্তি প্রনিধানযোগ্য। হাফেয ইবনু রজব বলেন, তার আলোচনা যতই করা হোক না কেন তা বাহুল্য হবে না এবং তার কার্যাবলীর বর্ণনা যে ভাষাতেই করা হোক তা কোন বাড়-বাড়ন্ত হবে না। তার এই উঁচু মর্যাদার পিছনে তাঁর মায়ের বড় অবদান ছিল।
শায়খুল ইসলাম একসময় মিশরে আর তার মা শামে অবস্থান করছিলেন। তখন মা ও ছেলের মধ্যে পত্র বিনিময় হ’ত। এমনি একটি পত্রে ছেলে ওযরখাহি করে মাকে লিখেন:
‘আহমাদ বিন তায়মিয়ার পক্ষ থেকে আমার সৌভাগ্যবতী মায়ের প্রতি। মহান আললাহ তার অনুগ্রহরাজি দিয়ে তার দু’চোখ শীতল করুন এবং তাকে তার শ্রেষ্ঠ দাসী ও সেবিকাদের একজন করুন।
সালামুন আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। আমি তোমার সমীপে আল্লাহর প্রশংসা করছি, যিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। প্রশংসার একমাত্র অধিকারী তিনিই। তিনি সর্বশক্তিমান। আমি তাঁর কাছে মিনতি করি যে, তিনি যেন দয়া ও করুণা বর্ষণ করেন মুত্তাক্বীদের নেতা শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর, যিনি তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ পাক তাঁর ও তাঁর পরিবারের উপর অজস্র ধারায় রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন। তোমার নিকট আমার পত্র প্রেরণের সুযোগ আল্লাহ তা‘আলার এক মহা অনুগ্রহ, তাঁর অসীম দান এবং মোটা দাগের করুণা। সেজন্য আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি, তঁাকে ধন্যবাদ জানাই। আমি তাঁর নিকট এ অনুগ্রহ বেশী বেশী কামনা করি। আল্লাহর অনুগ্রহ তো যখন আসে বেশী মাত্রায়ই আসে, তা গোনাগুনতির ধার ধারে না।
তোমার জানা আছে যে, এ মুহূর্তে আমার এ দেশে অবস্থান কেবলই দ্বীনের খেদমত ও এমন কিছু যরূরী কাজের স্বার্থে, যে কাজগুলো যতই আমাদের থেকে ছাড়া পড়বে ততই আমাদের দ্বীন ও দুনিয়া বিগড়ে যাবে। আল্লাহর কসম! দূরত্বের কারণেই আমি তোমার কাছে ছুটে যেতে পারি না। পাখি যদি আমাকে বয়ে নিয়ে যেত তবে আমি তোমার কাছে উড়ে যেতাম। কিন্তু গায়েবের হাতেই তার বাগডোর। যদি তুমি আমার ভিতরের অবস্থা জানতে পারতে তবে এ মুহূর্তে কেবল সেই উড়ে আসা কামনা করতে। আমিও এই শহরে একটা মাসও বাস করতে চাইতাম না। আল্লাহরই সকল প্রশংসা।
আমি বরং প্রতিদিন আমার ও তোমার কল্যাণ চেয়ে আল্লাহর নিকট দো‘আ করছি, তুমিও আমার জন্য দো‘আ কর মা। আমরা সবাই মহান আল্লাহর নিকট দো‘আ করি, তিনি যেন আমাদেরকে ও সকল মুসলিমকে নিরাপদে ও শান্তিতে রাখেন। আল্লাহ তা‘আলা যে আমাদের জন্য তাঁর রহমত, বরকত ও হেদায়াতের কত দরজা খুলে রেখেছেন তার ইয়ত্তা আমরা করতে পারি না, আমাদের মনেও তাঁর ছবি ভেসে ওঠে না।
আমরা সর্বদাই সফর নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি, আমাদের সব কিছু যাতে কল্যাণকর হয় সেজন্য আল্লাহর দরবারে মিনতি করছি। তাই বলে কেউ যেন না ভাবে, আমি তোমার সান্নিধ্য থেকে পার্থিব অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাকে প্রাধান্য দিচ্ছি। আমি তো বরং তোমার সান্নিধ্য থেকে উত্তম নয় এমন দ্বীনী কাজকেও প্রাধান্য দিতে ইচ্ছুক নই। কিন্তু এখানে এমন কিছু বড় বিষয় রয়েছে, যা সম্পাদন ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো বরবাদ হ’লে আমাদের ভয় হয় যে, তাতে আম-খাছ সব শ্রেণীর লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উপস্থিত লোকেরা যা দেখতে পায় ও বুঝতে পারে অনুপস্থিত লোকেরা তা দেখতে ও বুঝতে পারে না। কল্যাণ লাভের জন্য বেশী বেশী দো‘আ প্রার্থনীয়। কেননা আল্লাহ জানেন, আমরা জানি না। আল্লাহ ক্ষমতা রাখেন, আমরা রাখি না। গায়েবের জ্ঞান একমাত্র তাঁর কাছে।
ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
তোমাদের উপর শান্তি, রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক বেশী বেশী মাত্রায়। শান্তি, দয়া ও মঙ্গল বর্ষিত হোক বাড়ির ছোট-বড় সকলের উপর এবং প্রতিবেশী, পরিবার-পরিজন ও সাথী-বন্ধুদের এক এক করে সকলের উপর। সকল প্রশংসা রাববুল আলামীনের জন্য। আল্লাহ তা‘আলা করুণা ও শান্তি বর্ষণ করুন মুহাম্মাদের উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও ছাহাবীদের উপর’।[1]
এ পত্র লেখার প্রায় পঁচিশ বছর আগে শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ)-এর পিতা ইমাম আব্দুল হালীম বিন আব্দুস সালাম বিন তায়মিয়া মৃত্যুবরণ করেন। তারপর মায়ের স্নেহ-ভালোবাসার ছায়াতলেই ইমাম ছাহেবের দিন গুযরান হ’তে থাকে। মায়ের প্রতি শায়খুল ইসলামের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা যে কত প্রগাঢ় ছিল পত্রে তার চিহ্ন ফুটে উঠেছে। বস্ত্ততঃ মাকে তিনি ভীষণ ভালোবাসতেন। কথায় ও কাজে মায়ের মহত্ত্ব ও বড়ত্ব তুলে ধরতে তিনি ছিলেন অকৃপণ।
মাও ছেলের মতো তীক্ষ্ণ ধী ও ক্ষুরধার বোধসম্পন্ন এবং দ্বীনদার মানুষ ছিলেন। ছেলেকে নিয়ে মায়ের ইচ্ছা ও মনোবাসনা যে কত ইখলাছ ও সততাপূর্ণ ছিল সে কথার আভাস মায়ের লেখা পত্রে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তাই তো ছেলে দৃঢ় প্রত্যয় সহকারে বলতে পারছেন, তার মা রাববুল আলামীনের শরী‘আতের চাওয়া-পাওয়ার বাইরে একদমই যাবেন না।
মায়ের কাছে ইমাম ইবনু তায়মিয়ার যে পত্র উল্লেখ করা হয়েছে তার ভাষা অত্যন্ত সহজে বোধগম্য। শব্দ চয়নও খুবই সহজ সরল। তারপরও তাতে গভীর জ্ঞানের কথা ফুটে উঠেছে। তিনি পত্রে মাকে উদ্দেশ্য করে যেমন দ্বীন-ধর্মের কথা বলেছেন তেমনি দুনিয়ার কথাও বলেছেন। জীবনপথে চলতে গিয়ে কোন কাজকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং কোন কাজকে নয়, কোনটা লাভজনক কোনটা ক্ষতিকর, কোনটা সার্বজনীন কোনটা ব্যক্তিগতভাবে খাছ তারও উল্লেখ করেছেন। একই সাথে উপস্থিতির আকুতি ও অনুপস্থিতির কারণ তুলে ধরেছেন।
তার চেয়েও বড় কথা, আমরা যদি তার পত্রের ভেতরের তত্ত্ব উদঘাটনে সচেষ্ট হই তবে দেখতে পাব যে, তিনি পত্রটিতে অনেক ক’টি পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। তার মায়ের নিশ্চয়ই এ পরিভাষাগুলোর সম্যক জ্ঞান ছিল। নতুবা এগুলো ব্যবহারের কোন অর্থ হয় না। এ থেকে তার মায়ের ইলমের গভীরতা অনুমান করা যায়।
আর তিনি জ্ঞানী হবেনই বা না কেন? তিনি তো একটি বিদ্বাজন পরিবারের সদস্য। যে পরিবারে ইবনু তায়মিয়া, তার পিতা, দাদা, নাতি সবাই ছিলেন শ্রেষ্ঠ বিদ্বান, সাথে তার চাচা, মামা ও ভাইয়েরাও ছিলেন সুপন্ডিত। ফলে এ পরিবারটাই ছিল একটি স্বতন্ত্র বিদ্যায়তন। তাই পারিবারিক পরিবেশেই তার মায়ের জ্ঞানচর্চা অনেক বেশী হওয়া স্বাভাবিক।
ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ)-এর উক্ত পত্রের জবাবে তার মা লিখেছিলেন :
‘পুত্র আমার! এমন দায়িত্ব পালন ও কাজের জন্যই আমি তোমাকে লালন-পালন করেছি। আমি তোমাকে ইসলাম ও মুসলমানদের খেদমতে উৎসর্গ করেছি। দ্বীনের বিধি-বিধান মেনে চলতে আমি তোমাকে শিক্ষাদান করেছি।
বাছা আমার! তুমি ভেবো না যে, দ্বীনের সাথে তোমার সংশ্লিষ্ট থাকা এবং নানান দেশে ইসলাম ও মুসলমানদের খেদমত আঞ্জাম দেওয়ার তুলনায় আমার কাছে তোমার পড়ে থাকা আমার নিকট অধিক প্রিয়। বরং বৎস আমার! দ্বীন ও ইসলামের খেদমতে তোমার অবদানের পরিমাণ বিবেচনায় তোমার প্রতি আমার সন্তোষ চূড়ান্তভাবে নির্ণীত হবে।
পুত্র আমার! কাল ক্বিয়ামতে আমি আল্লাহর সামনে তোমাকে আমার থেকে দূরে থাকা নিয়ে কখনই প্রশ্ন তুলব না। কেননা আমি জানি তুমি কোথায় আছ, কি করছ? তবে হে আহমাদ! তুমি আল্লাহর দ্বীনের খেদমত এবং তাঁর দ্বীনের অনুসারী মুসলিম ভাইদের খেদমতে কোন ত্রুটি ও গাফলতি করলে আল্লাহর সামনে আমি অবশ্যই তোমার নিকট কৈফিয়ত তলব করব।
ছেলে আমার! আল্লাহ তোমার প্রতি রাযী-খুশী থাকুন। তোমার জীবনপথকে কল্যাণ দিয়ে ভরপুর করুন। তোমার ভুল-ভ্রান্তি দূর করে সবকিছু ঠিকঠাক করে দিন। তোমাকে ও আমাকে দয়াময় রহমানের আরশের ছায়াতলে সেদিন একত্রে রাখুন, যেদিন তার ছায়া ব্যতীত অন্য কোন ছায়া থাকবে না। ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’।[2]
এই মায়ের হিম্মত দেখে হতবাক হ’তে হয়! একটি মহান উদ্দেশ্যকে সামনে করে যিনি সন্তানকে জন্ম দিয়েছেন। বিশেষ একটি লক্ষ্য অর্জনার্থে সন্তানকে লালন করেছেন। সে লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য প্রতিটি পর্যায়ে সরল-সোজা পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। এখন সন্তানের পালনীয় ভূমিকার মাধ্যমে বিজয় ও সাফল্য অর্জনের অপেক্ষায় আছেন। এত যে পরিশ্রম, কষ্টভোগ আর ত্যাগ-তিতিক্ষা আগে করা হয়েছে তার সুমিষ্ট ফল লাভের অপেক্ষা বড়ই আনন্দদায়ক।
শায়খুল ইসলামের মা যখন বলেন, ‘পুত্র আমার! কাল ক্বিয়ামতে আমি আল্লাহর সামনে তোমাকে আমার থেকে দূরে থাকা নিয়ে কখনই প্রশ্ন তুলব না। কেননা আমি জানি তুমি কোথায় আছ, কি করছ? তবে হে আহমাদ! তুমি আল্লাহর দ্বীনের খেদমত এবং তাঁর দ্বীনের অনুসারী মুসলিম ভাইদের খেদমতে কোন ত্রুটি ও গাফলতি করলে আল্লাহর সামনে আমি অবশ্যই তোমার নিকট কৈফিয়ত তলব করব’ তখন সে কথা শুনে বুকের হৃদস্পন্দন থেমে যায়।
শায়খুল ইসলামের মা তাকে এবং সকল বিশ্ববাসীকে এই বার্তা দিচ্ছেন যে, তিনি তার সন্তানকে দ্বীনের সেবক বানানোর মানসে লালন করেছেন। দ্বীনের যাতে হেফাযত হয়, তার মর্যাদা উঁচু হয়, তার বিজয় ও সাহায্য অর্জিত হয় সে চেষ্টা তার ছেলে করবেন। এজন্য শুরু থেকেই তিনি ছেলের জীবনকে শারঈ বিধানের ছকে গড়ে তুলতে প্রয়াস পেয়েছেন। ফলত তিনি তাকে শারঈ ইলমের তা‘লীম দিয়েছেন, শারঈ ধঁাচে তাকে মানুষ করেছেন। এজন্যই এখন তিনি ছেলের জন্য অপেক্ষা করছেন যে, ছেলে যখন নিজেকে দ্বীনের কাজে লাগাতে সমর্থ হবে তখন অন্য সবকিছু কুরবানী করে দ্বীনের কল্যাণে আগুয়ান হ’তে যেন সে মোটেও দ্বিধা না করে। তা সে কুরবানী যত রকমেরই হোক না কেন, এমনকি মায়ের সান্নিধ্যও যেন তার কাছে তুচ্ছ হয়। ছেলে মায়ের সান্নিধ্যে থাকবে, সেটা তো মায়ের নিকট অতি প্রিয়। কিন্তু ছেলে তাঁর রবের ও দ্বীনের সান্নিধ্যে বেশী থাকুক, শায়খুল ইসলামের মায়ের নিকট সেটাই ছিল অধিক প্রিয়। ছেলের দেশে দেশে ইসলাম ও মুসলমানদের খেদমতে সময় ব্যয় মায়ের কাছে ছেলের অন্য যে কোন কিছু করার চেয়ে অধিক প্রিয় ছিল। এজন্যই ইসলাম ও মুসলমানদের সেবায় ছেলের আত্মনিয়োগ ছাড়া মায়ের চূড়ান্ত সন্তোষ আর কিছুতে নেই বলে মা ছেলেকে জানিয়ে দেন। ছেলে দ্বীন ও মুসলমানদের সেবা যতখানি করবে মায়ের সন্তোষও তার উপর ততখানি বর্তাবে। দ্বীন ও মুসলমানদের খেদমতকে মা ছেলের প্রতি তার সন্তুষ্টির মাপকাঠি গণ্য করেছেন, ছেলেকে যা মেনে চলা কর্তব্য। সম্পর্কের মানদন্ডও দ্বীন ও মুসলমানদের খেদমত, যার বন্ধনে মা ও ছেলে আবদ্ধ থাকবেন। মা ও ছেলের মধ্যকার মমত্ব বা অন্য কিছু তার সন্তুষ্টি ও সম্পর্কের মানদন্ড নয়।
আমরা যদি মনের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাব, মানব মনের লালিত সম্মানজনক চিন্তা-ভাবনা মানুষের জন্য সম্মান বয়ে আনে, আর অসম্মানজনক চিন্তাভাবনা মানুষের জন্য অসম্মান বয়ে আনে। সুতরাং হে পাঠক! আপনি ভাববেন না যে, শায়খুল ইসলামের মায়ের মনে মুহূর্তের জন্য এ কথাগুলো উদিত হয়েছিল। বরং এ ছিল আল্লাহর নিকট প্রিয় এক পাক-পবিত্র মনের বহু দিনের চিন্তার লালিত ফসল। আমরা কেবল তার শেষ চিত্রটাই দেখতে পেয়েছি।
হয়তো ইমাম ইবনু তায়মিয়ার মায়ের মনের এক ছোট্ট কোণে যে কল্যাণপ্রসূ চিন্তা কার্যকর ছিল তা দৃশ্যত অনেক মোটা মোটা বইতেও মেলে না। যে চিন্তা আমাদেরকে জানান দেয় এক বিরাট প্রতিদানের কথা, যা সন্তান প্রতিপালনের সাথে এক গভীর বন্ধনে আবদ্ধ। একই সাথে তা সকল মায়েদের সতর্ক করে যে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সন্তান লালন-পালনে তাদের ভূমিকা অকার্যকর থাকা সমূহ ক্ষতির কারণ।
আল্লাহ তা‘আলা ইমাম ইবনু তায়মিয়া ও তার মায়ের উপর রহম করুন। আমাদেরকেও তিনি এমন মা ও ছেলে দান করুন যারা দ্বীনের জন্য তাদের ন্যায় ভূমিকা পালন করবেন এবং শ্রেষ্ঠ নবীর উম্মাতের মাঝে নবজাগরণ ঘটাবেন- আমীন! [3]
হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ)-এর বোন সিতর রাকব (৭৭১ হি.-৭৮৯ হি.)
সিতর রাকব ছিলেন ছহীহ বুখারীর বিশ্ব বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফাতহুল বারী’র লেখক হাফেয আহমাদ ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ)-এর সহোদর বোন। বয়সে তিনি ভাইয়ের থেকে তিন বছরের বড় ছিলেন। তার পিতা আসক্বালানের বাসিন্দা ছিলেন। আসক্বালান মিশরের একটি বিখ্যাত শহর।
তিনি ছিলেন এমন এক নারী, যিনি জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক অনন্য জীবন যাপন করে গেছেন। তার নামটাও ছিল অনন্য। এ নামের পিছনে একটি সুন্দর কাহিনী আছে। তার পিতা নূরুদ্দীন আলী বিন মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাজার আসক্বালানী হজ্জের উদ্দেশ্যে তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে মিশরীয় এক কাফেলায় শরীক হন। পথিমধ্যে তার স্ত্রী একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। কাফেলার একটি আরবী প্রতিশব্দ ‘রাকবুন’। আল্লাহ বলেন, وَالرَّكْبُ أَسْفَلَ مِنْكُمْ ‘আর কাফেলা ছিল তোমাদের নিম্নাঞ্চলে’ (আনফাল ৮/৪২)। আরবীতে ‘রাকব’ বলা হয় এমন কাফেলাকে যার লোকসংখ্যা ১০ বা ততোধিক। আর ‘সিত’ অর্থ ছয়। ‘সিতর রাকব’ অর্থ কাফেলার ষষ্ঠজন। এভাবে রাকব বা কাফেলার চলার পথে তার জনম হওয়ায় মাতাপিতা তার নাম রাখেন ‘সিতর রাকব’। তবে তাকে সবাই উম্মু মুহাম্মাদ বা মুহাম্মাদের মা নামে ডাকত। সিত’র রাকবের মাতাপিতা উভয়েই বড় আলেম ছিলেন। অল্প বয়সেই পিতা তাকে শিক্ষাদানের কাজ শুরু করেন। তিনি মেয়েকে সাথে করে মসজিদে নিয়ে যেতেন। কিন্তু মৃত্যু তাকে নিজ হাতে মেয়েকে বড় আলেম করে তোলার ফুরসত দেয়নি। মেয়ের মাত্র সাত বছর বয়সে ৭৭৭ হিজরীতে তিনি ইহলোক ত্যাগ করে রবের সান্নিধ্যে গমন করেন। তবে তিনি ছোট্ট মেয়ের মনে জ্ঞানের পিপাসা জ্বেলে দিয়ে যান। রেখে যান মূল্যবান পুস্তকের এক সমৃদ্ধ লাইব্রেরী। ইতিমধ্যে তার মাও মৃত্যুবরণ করেন।
বিস্ময়কর মেধার অধিকারী এই বোন একাধারে ছিলেন পড়ুয়া ও লিপিকার। পিতৃমাতৃহীন হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানীর জগৎজোড়া প্রসিদ্ধির পিছনে এই মহিয়সী নারীর সবিশেষ অবদান ছিল। হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) তার প্রশংসায় বলেছেন, আমার মায়ের মৃত্যুর পর তিনিই ছিলেন আমার মা। তিনি অনেক স্থানের বিজ্ঞ আলেমদের থেকে জ্ঞানার্জন করেছিলেন। ইবনু হাজার (রহঃ) তার বোনের শিক্ষকদের তালিকায় মিশর, মক্কা, দিমাশক ও বালবাক শহরের আলেমদের নাম উল্লেখ করেছেন। তাকে জ্ঞান বিতরণের অনুমতিও যে তারা দিয়েছিলেন, সে কথাও তিনি বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, আমার বোন ছিলেন একজন লিপিকার। [সে যুগে ছাপাখানা ছিল না। লিপিকারগণ হাতে বই লিখতেন। ফলে সমাজে লিপিকারদের আলাদা মূল্য ছিল।] কুরআনের অনেকখানি তার মুখস্থ ছিল। বই-পুস্তকও তিনি প্রচুর অধ্যয়ন করেছিলেন। বিদ্যাজনিত অভিজ্ঞতাও তার অনেক ছিল। ছোট ভাই ইবনু হাজারের উপর বোন সিত’র রাকবের বিরাট প্রভাব ছিল।
মাত্র ২৮ বছর তিনি হায়াত লাভ করেছিলেন। এত অল্প বয়স সত্ত্বেও তিনি তার ভাই ইবনু হাজার আসক্বালানীকে হাদীছ শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ আলেম বানাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
স্বীয় সহোদরকে একজন খ্যাতনামা জ্ঞানী হিসাবে গড়ে তুলতে সিত’র রাকবের অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই সেসকল নারীর জন্য অনুপ্রেরণা ও দিশারী হয়ে থাকবে যারা নিজেদের সদাই ক্ষুদ্র ও অযোগ্য ভাবেন কিংবা সময়ের সংকীর্ণতার অজুহাত তোলেন, অথবা দোহাই দেন যে, কাজের অত্যধিক চাপে, স্বামী-সন্তান-ঘর শামলিয়ে তাদের পক্ষে কোন কিছু কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না।
সিত’র রাকবের পারিপার্শ্বিক অবস্থা যে খুব অনুকূল ছিল তা মোটেও নয়। তারও দৈনন্দিন কাজকর্ম ও ব্যস্ততা যথেষ্ট ছিল। তা সত্ত্বেও তিনি অত্যন্ত ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার সাথে তার সামর্থ্য ও সময় কাজে লাগাতেন। স্বামী ও সন্তানদের প্রতি কর্তব্য পালনে তিনি কিছুমাত্র ত্রুটি করতেন না।
এতদসঙ্গে ছোট ভাই ইবনু হাজার আসক্বালানী যাতে মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতে পারেন সেজন্য তিনি তার পিছনে সযত্ন প্রয়াস পেয়েছেন। ছোট ভাইয়ের প্রতি তার স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। পিতার মৃত্যুকালে ভাইয়ের বয়স ছিল ৪ বছর। তিনি নিজেও ছিলেন ছোট। ছোট হয়েও তিনি ভাইটিকে মায়ের মমতায় আগলিয়ে রাখেন। ভাইকে পড়ানোর দায়িত্ব তিনি নিজের কঁাধে তুলে নিয়েছিলেন। আগেই বলা হয়েছে, তার পিতার একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরী ছিল। তাতে অনেক নামী দামী বই ছিল। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের আগে বই-পুস্তক ছিল খুবই সীমিত, দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান। কারণ সে যুগে বই হাতে লেখা হ’ত। যাকে বলা হয় পান্ডুলিপি- আরবীতে ‘মুসওয়াদ্দাহ’। এসব পান্ডুলিপি কালেকশনের জন্য সমাজের আমীর, শাসক ও জ্ঞানপিপাসু মানুষের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত।
সিত’র রাকবের পিতা কেবল পারিবারিক লাইব্রেরীই রেখে যাননি তিনি সন্তানদের জন্য মোটা অঙ্কের সম্পদও রেখে গিয়েছিলেন। যেহেতু সিত’র রাকব অবিবাহিত ছোট্ট মেয়ে ছিলেন সেহেতু তার পক্ষে এসব বই বেঁচে পয়সাকড়ির মালিক হওয়া বিচিত্র কিছুই ছিল না। কিন্তু তিনি সেসব না করে লাইব্রেরী হেফাযতের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার ছোট ভাই যাতে লাইব্রেরী ব্যবহার করে জ্ঞানার্জন করতে পারেন সেজন্য তার চেষ্টার অন্ত ছিল না।
শুধু লাইব্রেরীর তত্ত্বাবধান ও ঘরকন্না নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও তা তার জন্য যথেষ্ট হ’ত। কিন্তু তিনি এসব করেও ছোট ভাইয়ের পড়ানোর দায়িত্ব নিজের কঁাধে তুলে নিয়েছিলেন। তিনিই ছিলেন ছোট ভাই ইবনু হাজার আসক্বালানীর প্রথম শিক্ষক। সুশিক্ষিত যোগ্য বোনের অঁাচলতলে শিক্ষালাভে ইবনু হাজার আসক্বালানীর জন্য সৌভাগ্যের দ্বার খুলে গিয়েছিল। আল্লামা আসক্বালানী বলেন, আমার বোন ছিলেন আমার উপকার করতে সদা মুক্তহস্ত, আমার উপর অত্যন্ত সদয় এবং আমাকে চোখে চোখে রাখতে সদা তৎপর। আল্লাহ তা‘আলা আমার পক্ষ থেকে তাকে উত্তম প্রতিদানে সিক্ত করুন। তার বয়স অল্প হওয়া সত্ত্বেও আমি তার থেকে লাভবান হয়েছি, তার বিনয়-নম্র আচরণ আমাকে উপকৃত করেছে।[4]
তিনি মৃত্যুবরণ করলে ইবনু হাজার (রহঃ) তার বিচ্ছেদে খুবই মর্মাহত ও ব্যথিত হন। একটি কাছীদা বা গীতিকবিতায় তিনি শোকার্ত হৃদয়ে বলেছেন,
আমি কঁাদছি সেই দুর্লভ গুণাবলীর অধিকারিণীর জন্য, কি করে মাটি তার অনুগ্রহ ও মায়ামমতা থেকে আমাকে দূরে ঠেলে দিল!
আমি কঁাদছি সেই সহিষ্ণু, বিদূষী, সতী-সাধ্বীর জন্য যার সাথে যুক্ত হয়েছিল হেদায়াতের মর্যাদা ও বুদ্ধির ঝলকানি।
আমি কঁাদছি সেই শাখা-প্রশাখার জন্য, যা সমূলে উপড়ে পড়েছে, অথচ আজও আমি তার ফুল-ফল চয়ন করতে পারিনি।
ভগ্নি আমার! তোমাকে হারিয়ে আমি হারিয়েছি আত্মীয়-স্বজনের ভালোবাসা। তাই তোমার দুনিয়া ছেড়ে যাওয়ার পর আমার সকল সম্পদ আমি তোমার স্নেহের খাতিরে অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছি।[5]
কাযী শুরাইহ (রহঃ)-এর শ্বাশুড়ি
কাযী শুরাইহ ছিলেন একজন নেতৃস্থানীয় তাবেঈ। যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফক্বীহ, মহাসম্মানের অধিকারী, উঁচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন, মহাজ্ঞানী ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন দূরদর্শী, বিচক্ষণ, তীক্ষ্ণ ধী-শক্তি সম্পন্ন ও বিচার কাজে সর্বাধিক জ্ঞাত। প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও সঠিক সিদ্ধান্ত দানে তার জুড়ি মেলা ভার। তার পিতার নাম হারিছ আল-কিন্দী।
জাহেলী যুগে বনু কিন্দা গোত্রে তার জন্ম। নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে তার সাক্ষাৎ হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর তিনি ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন। ইসলামী জীবনকাল তার অত্যন্ত সুন্দর ছিল। ইসলামী আইনশাস্ত্রে তার চূড়ান্ত ব্যুৎপত্তি অর্জিত হয়েছিল।
ঘটনাক্রমে আমীরুল মুমিনিন ওমর বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) তার ইনছাফপূর্ণ বিচারের নমুনা স্বয়ং নিজের বেলায় প্রত্যক্ষ করে তাকে বিচারক পদে নিয়োগদানের সিদ্ধান্ত দেন। বিচারককে তখনকার দিনে কাজী ও মুন্সিফ বলা হ’ত। তাকে কূফার বিচারক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ পদে তিনি ৭৫ বছর অধিষ্ঠিত ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে তার থেকে অবিচার ও দুর্নীতির কোন একটা ঘটনাও ঘটেনি। আল্লাহ তা‘আলা তাকে দীর্ঘ জীবন দান করেছিলেন। শতায়ু এই তাবেঈ ৮৭ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
বংশলতা অনুসারে তার নাম শুরাইহ বিন হারিছ বিন ক্বায়েস বিন জাহাম। তার গোত্রের নাম বনু কিন্দা। লোকসমাজে তার দূরদর্শিতা ও সঠিক সিদ্ধান্ত দানের বিষয়টি সুবিদিত ছিল। ফলে তার সম্পর্কে জানাশোনা লোকেরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজে তার পরামর্শ না নিয়ে হাত দিতেন না। তিনি যে মত দিতেন তাই তারা সঠিক ও চূড়ান্ত বিবেচনা করে কাজ শুরু করতেন।
বিখ্যাত হাদীছ বর্ণনাকারী কূফাবাসী তাবেঈ আবু আমর আমের বিন শুরাহবিল ছিলেন তার বন্ধু। কূফা শহরে তার জ্ঞান-গরিমার খ্যাতি ছিল। সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই ব্যক্তি শা‘বী নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি বিয়ে করার ইচ্ছে করলে তার পরামর্শ কামনা করেন। তিনি তাকে বললেন, ‘বনু তামীম গোত্রের মেয়ে ছাড়া তুমি বিয়ে করো না। আমি দেখেছি, তারা খুব বুদ্ধিমতী, আদব-আখলাকে সুন্দর, সতীসাধ্বী, স্বামীর সাথে উত্তম ব্যবহারকারী এবং স্বামীর প্রতি অনুগতপ্রাণ’।
কাজী শুরাইহ নিজেও বনু তামীমের যয়নাব নাম্নী এক মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। পূর্বপরিচয় ও জানাশোনা ছাড়াই আল্লাহ তাকে এমন এক সুন্দর স্ত্রী জুটিয়ে দিয়েছিলেন।
ঘটনাচক্রে একদিন দুপুরবেলা তিনি এক জানাযার ছালাত শেষে বাড়ী ফিরছিলেন। দুপুরের প্রচন্ড গরমে সবাই ছায়ায় আশ্রয় নিতে চেষ্টা করছিল। তিনি তখন বনু তামীমের একটা বাড়ীর পাশ দিয়ে নিজ বাড়ীর উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন। হঠাৎই দেখতে পেলেন বাড়ীর দরজায় এক বৃদ্ধা দঁাড়িয়ে আছেন এবং তার পাশে এক তরুণী। রাস্তা ছেড়ে তিনি বৃদ্ধার দিকে গেলেন। দৃশ্যত তিনি তাদের কাছে পানি পানের আরয করলেন, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তিনি চাইছিলেন তরুণীটির খেঁাজ নিতে।
বৃদ্ধা বলল, কি ধরনের পানীয় তোমার পসন্দ? তিনি বললেন, যা জোটে। বৃদ্ধা তখন তরুণীটিকে বলল, ‘ওহে মেয়ে! তাকে দুধ এনে দাও। আমার মনে হচ্ছে লোকটা ভিন্ন এলাকা থেকে এসেছে’। এবার তিনি মেয়েটির খেঁাজ নিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তরুণীটি কে? বৃদ্ধা বলল, বনু হানযালা গোত্রের যয়নাব বিনতে হুদাইর। তিনি বললেন, বিবাহিত, না অবিবাহিত? বৃদ্ধা বলল, অবিবাহিত। তিনি বললেন, আপনি কি তাকে আমার সাথে বিয়ে দিবেন? সে বলল, তুমি যদি তার কুফু বা যোগ্য হও তাহ’লে হবে।
এরই মধ্যে দুধ চলে এলো। শুরাইহ তা পান করে ভাবতে ভাবতে বাড়ীর দিকে রওনা হ’লেন। ইচ্ছে ছিল দুপুরের দিবানিদ্রাটা একটু সেরে নিবেন। কিন্তু তরুণীর ভাবনা তার অন্তরে জেঁকে বসেছিল। ফলে ঘুমানো আর হ’ল না। যোহর ছালাত শেষে গায়ে চাদর জড়িয়ে তিনি বের হ’লেন। উদ্দেশ্য স্থানীয় কিছু গণ্যমান্য লোকের সাথে সাক্ষাৎ এবং বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা। হয়তো তারা তরুণীটির চাচার সাথে কথা বলে বিয়ের ব্যবস্থা করে দেবে। খবর পেয়ে মেয়েটির চাচা তাদের সাথে দেখা করতে এলো এবং শুরাইহকে বলল, আবু উমাইয়া! তুমি কি বলছ? তিনি বললেন, যয়নাব তো আপনার ভাতিজী। সে বলল, তুমি কি তাকে বিয়ে করতে চাও? যাহোক, শুরাইহের সাথে চাচা তার ভাতিজিকে বিয়ে দিয়ে দিলেন।
শা‘বী বললেন, আবু উমাইয়া! তাহ’লে আপনার শ্বশুরকূল বনু তামীমের কোন একটা মেয়েকে আমার জন্য পসন্দ করুন। আপনি যাকেই নেককার ও আমার জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করবেন আমি তাতেই রাযী। শুরাইহ বললেন, বনু তামীমের মধ্যে এমন কোন উপযুক্ত অবিবাহিত মেয়ে পাওয়া গেলে তুমি তো হবে মহাভাগ্যবান। আল্লাহ ভরসা, তিনিই ব্যবস্থাকারী।
শা‘বী বললেন, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে তামীম বংশীয় স্ত্রীকে নিয়ে আপনি খুবই সুখী ও ভাগ্যবান।
তিনি বললেন, আসলেই তাই। আমি তোমাকে কিছু লুকাব না। বিয়ের পর আমার মধ্যে কিছুটা অনুশোচনাই দেখা দিয়েছিল। আমি খুব তাড়াহুড়া করে ফেলেছিলাম। আমার মনে ভেসে উঠতে লাগল বনু তামীমের মহিলাদের মধ্যকার অহংকার, দেমাগ ও কঠোর মন-মানসিকতার কথা। ভাবতে লাগলাম, আমি আরবের সবচেয়ে নিঠুর মনা বদরাগী কাউকে বিয়ে করে ফেললাম না তো? আমার মন তাকে তালাক দেওয়ার জন্য বার বার ফুসলাচ্ছিল। পরে আমি সিদ্ধান্ত নেই তার কাছে যাব- তারপর যদি দেখি ভালো এবং আমার ভালো লাগা কিছু তার মাঝে পাই তাহ’লে তাকে রেখে দেব, না হলে ছেড়ে দেব। কিন্তু আমার এ অনুশোচনা যথার্থ ছিল না।
ওহে শা‘বী! বনু তামীমের মহিলারা যখন তাকে আমার কামরায় দিয়ে গেল তখন যদি তুমি আমাকে দেখতে তবে তোমার মন খুশিতে ডগমগ করে উঠত। সে ঘরে এলে আমি সুন্নাত অনুযায়ী আমলের প্রস্ত্ততি নিলাম। আমি ওযূ করে দু’রাকা‘আত ছালাত আদায় করলাম। সেও উঠে গিয়ে ওযূ সেরে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করল।
তারপর তার সাথী কিশোরী মেয়েরা এসে আমার পরিধেয় কাপড় বদলে নিল এবং আমাকে যাফরান রঙের একটা কমপ্লিট (আরবীতে ‘হুল্লাহ’) পরিয়ে দিল। তারা চলে গেলে আমরা দু’জন যখন একান্তে হ’লাম তখন আমি তার দিকে হাত বাড়ালাম। সে বলল, একটূ থামুন। তারপর সে যা বলেছিল তার কিছু নিম্নরূপ: আমি আপনার কাছে একটা অপরিচিত মেয়ে। আপনার স্বভাব-চরিত্র, রুচি-মর্জির কিছুই আমার জানা নেই। আপনার যা পসন্দ তা আমাকে বলুন, আমি সেগুলো করব। আর যা পসন্দ নয় তা আমি করব না। আপনার বংশের মধ্যে এমন মেয়ে আপনার জন্য ছিল, যাকে আপনি বিয়ে করতে পারতেন। আমারও নিজ বংশের কাউকে না কাউকে বিয়ে করার সুযোগ ছিল। কিন্তু আল্লাহ যখন কোন ফায়ছালা করেন তা তো না হয়ে পারে না। সুতরাং আল্লাহ আপনাকে যে আদেশ দিয়েছেন আপনি তাই করুন- হয় ভালো মনে রেখে দিন, অথবা সুন্দরভাবে ছেড়ে দিন।
এই কথাগুলো শুনে ওহে শা‘বী! আমাকেও কিছু বলতে হ’ল। আমি বললাম, তুমি এমন কিছু কথা বলেছ যদি তুমি তাতে অবিচল স্থির থাক তবে তা হবে আমার সৌভাগ্যের বাহন। আর যদি তুমি তার ব্যতিক্রম করো তবে তা তোমার বিরুদ্ধে যাবে। আমি এই এই জিনিস পসন্দ করি এবং এই এই জিনিস অপসন্দ করি। ভালো কিছু দেখলে তুমি তা বলবে, আর খারাপ কিছু দেখলে তা গোপন রাখবে।
সে বলল, আপনার শ্বশুর বাড়ির কেউ বেড়াতে এলে আপনি তা কতটুকু ভালো মনে নিবেন? আমি বললাম, তাদের যখন মনে চায় আসবে। আমার শ্বশুরকূল আমাকে বিব্রত করবে এমনটা আমি চাই না।
সে বলল, আপনার প্রতিবেশীদের মধ্যে কার সঙ্গে আপনার সখ্যতা আছে, আর কাকে আপনি অপ্রিয় জানেন? আমি বললাম, অমুক অমুক পরিবার ভালো এবং অমুক অমুক পরিবার খারাপ।
আল্লাহর কসম হে শা‘বী! সে রাতটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা রাত। আমি তার কাছে তিন দিন কাটালাম। তারপর বিচারালয়ের কাজে যোগ দিলাম। আমি খেয়াল করছিলাম, যে দিনটা কাটাচ্ছি তা বিগত দিন থেকে উত্তম কাটছে। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার ছিল যে, তার মা এক বছরের মাথায় আমাদের দেখতে এসেছিলেন। আদালত থেকে বাড়ী ঢুকে আমি এক বৃদ্ধার আওয়াজ শুনতে পেলাম, তিনি আমার স্ত্রীকে কিছু আদেশ-নিষেধ করছেন। আমি সালাম দিলাম। সালামের উত্তর দিয়ে তিনি বললেন, তোমার স্ত্রীকে কেমন পেয়েছ? বললাম, উত্তম স্ত্রী, উপযুক্ত সঙ্গিনী, আপনি তাকে খুব ভালোমতো আদব-আখলাক শিখিয়েছেন। জাযাকাল্লাহু খায়রান- আল্লাহ আপনাকে উত্তম বদলা দিন। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, হে আবু উমাইয়া! কোন মহিলার মাঝে খুব খারাপ অবস্থা কেবল দু’টি সময়ে দেখা যায়। এক. যখন সে সন্তান জন্ম দেয়। দুই. যখন সে স্বামীর উপর খবরদারী করে। সুতরাং যখন তুমি সন্দেহের দোলায় দুলবে তখন চাবুক হাতছাড়া করবে না। আল্লাহর কসম! পুরুষরা তাদের ঘরে ত্রাস সৃষ্টিকারী, খবরদারিকারী তেজি মহিলা থেকে খারাপ আর কিছু স্থান দেয় না। তিনি আমার বাড়ীতে প্রতি বছরের মাথায় একবার আসতেন এবং আমাকে একই নছীহত করতেন।
শুরাইহ বলেন, আমার স্ত্রী আমার সাথে বিশ বছর ধরে আছে। এ সময়ে আমি তার কোন দোষ পাইনি এবং কখনও সে আমার রাগের কারণ হয়নি।
বনু কিন্দা গোত্রীয় মাইসারা বিন আদি নামে আমার এক প্রতিবেশী ছিল। প্রতিদিন আমি তার বিরুদ্ধে তার স্ত্রীকে মারার ও গালাগালি করার অভিযোগ শুনতে পেতাম। এ নিয়ে আমি একদিন কবিতার ক’টি পঙ্কতি আওড়ালাম:
আমি বহু পুরুষকে দেখেছি, তারা নিজের স্ত্রীদের মারধর করে।
আমার ডান হাত যেন অবশ হয়ে যায়, যখন আমি যয়নাবকে মারতে উদ্যত হব।
সে কোন অপরাধ না করা সত্ত্বেও কি আমি তাকে মারব?
কোন নিরপরাধ মানুষকে মারধর আমার মতে সুবিচার নয়।
যয়নাব হ’ল সূর্য, আর অন্য মহিলারা তারকা
সূর্য উদিত হ’লে আকাশে কোন তারা দেখা যায় না।
প্রত্যেক প্রেমিকের ভালোবাসা প্রেমাস্পদের ভালোবাসাকে আপনা থেকে টেনে আনে।
যদি কোন দিন সে অপরাধ করে বসে তবে প্রেমিক তা উপেক্ষা করে যায়।
এ কথা শুনে শা‘বী বললেন, এমন স্ত্রীভাগ্য আমার কোত্থেকে হবে? এমন মেয়ে ভাগ্যে কদাচিৎই জোটে।
কাজী শুরাইহ বললেন, আল্লাহ তোমার জন্যও এমন মেয়ে জুটিয়ে দিবেন ইনশাআল্লাহ।
আল্লামা আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রহঃ)-এর মা
আল্লামা আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রহঃ) ১৩৩০ হিজরীর যিলহজ্জ মাসের ১২ তারিখে সউদী আরবের রিয়াদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের তিন বছর পর তার পিতা মারা যান। শায়খ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন সাঈদ ছিলেন শায়খ বিন বায থেকে প্রায় দশ বছরের বড়। তিনি বলেন, শৈশবে ছোট ছোট শিশুরা তার সাথে মিশত না। তার মা-ই তাকে সঙ্গ দিতেন। তার স্নেহ-যত্নে তিনি লালিত-পালিত হ’তে থাকেন। গামলায় পানি নিয়ে তিনি তাকে গোসল করিয়ে দিতেন। সন্তানের মঙ্গল কামনা করে মা বেশী বেশী দো‘আ করতেন।
এভাবেই শায়খের জীবনের শুরুটা বেশ কষ্টের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। তার অন্য দুই ভাই ইব্রাহীম ও মুহাম্মাদ ঘরের কাজ করতেন এবং তাদের গুণবতী মায়ের সেবাযত্ন করতেন।
১০ বছর বয়ক্রমকালে তার মা তাকে কুরআন হিফয ও শারঈ ইলম অর্জনের জন্য বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। তিনি শায়খ আব্দুল্লাহ বিন নাছির বিন মুফাইরিজ (১২৬৭ হি.-১৩৫০ হি.) (রহঃ)-এর মক্তবে ভর্তি হন। অল্প বয়সেই তিনি কুরআন হিফয সম্পন্ন করেন। তার মা তার প্রতি খুব খেয়াল রাখতেন। কখন তিনি মসজিদ থেকে ফিরবেন তা নিয়ে উদগ্রীব থাকতেন। মসজিদ থেকে ফেরামাত্রই তিনি তাকে তার শিক্ষকের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। এমনও হয়েছে যে, কঠিন বৃষ্টির দিনে কেবল তিনিই বিদ্যালয়ে হাযির হয়েছেন, অথচ অন্য কেউ উপস্থিত হয়নি।
শৈশব থেকেই তার স্বভাব-চরিত্রে দানশীলতা ও পরোপকারিতার গুণ ফুটে উঠেছিল। তদুপরি তার মা তাকে কল্যাণমূলক কাজে অংশ নিতে বেশী করে উৎসাহিত করতেন। তিনি নিজে বলেছেন, যখন তিনি বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন তখন রিয়াদে যেসকল নতুন ছাত্র পড়তে আসত তাদের প্রত্যেকের সাথে তিনি বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে চেষ্টা করতেন। তিনি তাদের সাথে ওঠাবসা করতেন এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। অন্য স্থান থেকে আগমন হেতু তাদের কম-বেশী সমস্যার মুখোমুখি হ’তে হ’ত। অবস্থা এতদূর গড়িয়েছিল যে, তিনি দুপুরের কিংবা রাতের খাবার খাওয়াতে তাদের সাথে করে বাড়ি নিয়ে আসতেন। তিনি তার মাকে তার খাবারটুকু দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতেন। যদি তার মা কখনও বলতেন, এটুকু খাদ্য ছাড়া আমাদের ঘরে আর কিছুই নেই তখন তিনি বলতেন, এ ভাইটা বহিরাগত ও অভাবী ছাত্র; বিদ্যা চর্চায় তাকে সহযোগিতা করা আমাদের কর্তব্য। পরোপকারের প্রতি ছোট্ট ছেলের এরূপ আকর্ষণ দেখে তার মা খুবই আনন্দবোধ করতেন। তাই তিনি এসব ছাত্রের খানাপিনা যোগানো, পোষাক-পরিচ্ছদ সেলাই ও অন্যান্য টুকিটাকি সহযোগিতা অকুণ্ঠচিত্তে করতেন। পরিবার থেকে দূরদেশে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীদের আসলেই এমন অনেক সমস্যার মোকাবেলা করতে হয় যা তাদের মনে বিশেষভাবে দাগ কাটে।
শায়খ বিন বায তার ‘আল-কাওলুল ওয়াজিয’ বা ‘সংক্ষিপ্ত কথা’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, তাকে লালন-পালন ও বড় করে তোলায় তার মায়ের বড় ভূমিকা ছিল। তিনি খুবই গুরুত্ব দিয়ে ছেলের দেখ-ভাল করতেন। ছেলের প্রতি তার আগ্রহ ছিল অত্যধিক। তার মঙ্গল কামনা করে তিনি আল্লাহর দরবারে যথাসাধ্য দো‘আ করতেন।
তার বয়স যখন ষোল তখন থেকে চক্ষুরোগে তার দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে। চোখের সমস্যা দিন দিন বাড়তে থাকে এবং এক পর্যায়ে ১৩৫০ হিজরীতে এসে তিনি একেবারে অন্ধ হয়ে যান। এ ঘটনায় তার মা যারপরনেই ব্যথিত হন।
শায়খ আব্দুল আযীয বিন নাছের বিন বায বলেন, আমাকে শায়খ আল-মামার সা‘দ বিন আব্দুল মুহসিন বিন বায বলেছেন যে, শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায-এর মায়ের এক আল্লাহওয়ালা প্রতিবেশিনী ছিলেন। শায়খ বিন বাযের চোখ দু’টি নষ্ট হওয়ায় তার মা মানসিকভাবে খুবই আঘাত পান। তখন এই নেককার প্রতিবেশিনী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, আপনি মনোকষ্টে ভুগবেন না। আপনি বরং তার জন্য আল্লাহর দরবারে প্রাণ খুলে দো‘আ করতে থাকুন। তিনি যেন তার বাহ্যচক্ষুর বদলে জ্ঞানচক্ষু খুলে দেন। তিনি কাকুতি-মিনতি সহকারে মা‘বূদের নিকট তার জন্য ঐ দো‘আই জারী রাখেন। হ’তে পারে ইয়াতীম অসহায় কিশোরের জন্য সতী-সাধ্বী মুহসিনা মায়ের দো‘আ আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়েছিল। ফলে উত্তরকালে তার ছেলে মুসলিম উম্মাহর বড় আলেম ও যুগের মুজাদ্দিদ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন। সুতরাং কেউ যেন আল্লাহর নিকটে দো‘আ করতে কৃপণতা না করে।
শায়খ তার বিভিন্ন আলোচনায় তার উপর তার মায়ের অনুগ্রহের কথা সদাই বলতেন। শিশুকাল থেকেই তার মা ছালাত আদায়ের জন্য তাকে মসজিদে দিয়ে আসতেন। তারপর ছেলের ফিরে আসার অপেক্ষায় বাড়ির দরজায় দঁাড়িয়ে থাকতেন। এমনি করে কি শীত, কি বৃষ্টি, কি বিদ্যুৎহীন অন্ধকার- সর্বাবস্থায় তিনি ছালাত আদায়ে মসজিদে যেতেন। আবার ছালাত শেষে মসজিদে বিভিন্ন আলেমের যে ক্লাস চলে তাতে শরীক হ’তেন। এমনও দেখা যেত যে, অত্যধিক ঠান্ডার কারণে অধিকাংশ মুছল্লী ছালাত শেষে বাড়ি ফিরে গেছে। শায়খের ক্লাস বা হালাকায় তিনি ছাড়া আর কোন ছাত্র হাযির নেই। তারপরও শিক্ষক জিজ্ঞেস করছেন, ক্লাসে কেউ আছে কি? সে সময়েও ছোট্ট আব্দুল আযীয বলে উঠতেন, শায়খ! আমি আব্দুল আযীয আছি। শায়খ তখন বলতেন, আব্দুল আযীয, তোমার মধ্যে বরকত হোক। তারপর তিনি তাকে আক্বীদা বিষয়ে পড়াতেন। তার শৈশব কেমন ছিল জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমার শৈশব সম্পর্কে ঠিক করে সব কিছু আমার স্মরণে নেই, তবে এটা ঠিক মনে আছে যে, আমি আলেমদের মজলিসে বসতে এবং কুরআন পড়তে খুবই আগ্রহী ছিলাম।
শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায (রহঃ) ১৪২০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। মক্কার হারামে তার জানাযার ছালাত অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ১০ লক্ষ লোক তার জানাযায় অংশ নিয়েছিলেন। এ জানাযা ছিল হৃদয় বিদারক। তার বিচ্ছেদে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ বেদনার্ত হয়েছিল।
মহান আল্লাহ তার উপর দয়া করুন, তাকে ক্ষমা করুন, তার মর্যাদা উঁচু করুন, উম্মাহর পক্ষ থেকে তাকে ও তার মাকে উত্তম প্রতিদান দিন। [মুহাম্মাদ মূসা রচিত জাওয়ানিবু মিন সিরাতিল ইমাম আবদিল আযীয বিন বায রাহিমাহুল্লাহ][6]
-মূল (আরবী) : ইউসুফ বিন যাবনুল্লাহ আল-‘আতীর
-অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
[1]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৮/৪৮।
[2]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৮/৪৮।
[3]. ইমাম ইবনু তায়মিয়ার আসল নাম আহমাদ ইবনু আব্দুল হালীম। ৬৬১ হিজরীর ১০ রবীউল আউয়াল তারিখে হাররান নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬৪/৬৫ বছর বয়সে ৭২৮ হিজরীর ২০ যিলক্বদ তারিখে দামেশকে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বহুবিধ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক তার চিন্তাধারার প্রভাব আজও বিদ্যমান এবং ভবিষ্যতেও তা প্রেরণা যুগিয়ে যাবে। তার রচিত ও সংকলিত বইয়ের সংখ্যা ৫০০ এর অধিক বলে উল্লেখ করা হয়। বহু খন্ডে রচিত মাজমূ‘উল ফাতাওয়া তাকে অমর করে রেখেছে।
[4]. আল-জাওয়াহির ওয়াদ্দুরার ফি তারজামাতি শায়খিল ইসলাম ইবনে হাজার ১/১১৪।
[5]. হাফেয আহমাদ ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) ৭৭৩ হিজরী মোতাবেক ১৩৭২ খৃষ্টাব্দে মিশরের কায়রোতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৮৫২ হিজরী মোতাবেক ১৪৪৯ খৃষ্টাব্দে কায়রোতে মৃত্যুবরণ করেন। তার রচিত গ্রন্থাদির সংখ্যা দেড় শতাধিক। তন্মধ্যে ফাতহুল বারী, বুলূগুল মারাম, আল-ইছাবাহ ফী তাময়িযিছ ছাহাবা, নুখবাতুল ফিকার, তাহযীবুত তাহযীব, তা‘লীকুত তা‘লীক, তাবাকাতুল মুদাল্লিসীন, আত-তালখীছুল হাবীব, তাজীলুল মানফাআত, সিলসিলাতুয যাহাব, আল-কাওলুল মুসাদ্দাদ ফিয-যাবিব আন মুসনাদি আহমাদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
[6]. শায়খ আবদুল আযীয বিন বায রাহিমাহুল্লাহ খৃষ্টীয় ১৯১২ সালের ২১শে নভেম্বর তারিখে রিয়াদে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৮৮ বছর বয়সে খৃষ্টীয় ১৯৯৯ সালের ১৩ই মে তারিখে মক্কা মুকাররামায় মৃত্যুবরণ করেন। কুরআন, হাদীছ, ফিক্বহ, সিয়াসাত ইত্যাদি বিষয়ে তার রচিত গ্রন্থ সংখ্যা ষাটের অধিক।