[আহলেহাদীছ
আন্দোলন-এর উপর ডক্টরেট থিসিসের তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহের জন্য ভারত,
পাকিস্তান ও নেপালে ৫২ দিনের স্টাডি ট্যুরের এক পর্যায়ে ২.১.১৯৮৯ ইং তারিখে
লাহোরের বিখ্যাত লাইব্রেরী দারুদ দা‘ওয়াতিস সালাফিইয়াহ থেকে ফার্সী ভাষায়
লিখিত ১০ পৃষ্ঠার এই দুর্লভ অছিয়তনামাটি ফটোকপি করে আনি। যা ১২৭৩ হিজরীতে
ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুরে মুদ্রিত হয়।]
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি প্রজ্ঞাসমূহ নিক্ষেপকারী ও অনুগ্রহসমূহ প্রবাহিতকারী। অতঃপর দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক আরব ও আজমের নেতার উপর এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও ছাহাবীগণের উপর। যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ার অধিকারী। অতঃপর আমি ফকীর অলিউল্লাহ (আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন!) আমার সন্তানাদি ও বন্ধুদের প্রতি অছিয়ত স্বরূপ এই কথাগুলি বলছি। যার নাম আমি রেখেছি الْمَقَالَةُ الْوَضِيَّةُ فِي النَّصِيْحَةِ وَالْوَصِيَّةِ ‘নছীহত ও অছিয়তের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল বক্তব্য’। আমাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক! তিনিই সরল পথের প্রদর্শক।
১ম অছিয়ত :
এই ফকীরের প্রথম অছিয়ত এই যে, আক্বীদা ও আমলে কিতাব ও সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধর এবং এ দু’টির গবেষণায় রত থাক। প্রতিদিন এ দু’টির কিছু অংশ পাঠ কর। যদি পড়ার ক্ষমতা না রাখ, তাহ’লে প্রত্যেকটি থেকে এক পৃষ্ঠা করে অনুবাদ শ্রবণ কর। আক্বীদার ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাতের প্রথম যুগের বিদ্বানগণের মযহাব অবলম্বন কর। সেসব বিষয়ের ব্যাখ্যা ও সূক্ষ্ম অনুসন্ধান থেকে দূরে থাক, যেসব বিষয়ে তাঁরা অনুসন্ধান করেননি। জ্ঞানপূজারীদের ত্রুটিপূর্ণ সন্দেহ সমূহের দিকে ভ্রুক্ষেপ করো না। শাখা-প্রশাখাগত বিষয়ে মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণের অনুসরণ করবে। যারা ছিলেন ফিক্বহ ও হাদীছের মধ্যে সমন্বয়কারী। ব্যবহারিক প্রশাখাগত বিষয়গুলিকে সর্বদা কিতাব ও সুন্নাতের সম্মুখে পেশ করবে। যেটি তার অনুকূলে হবে, সেটি গ্রহণ করবে। নইলে পিছনে ফেলে রাখবে। উম্মতের জন্য ইজতিহাদী বিষয় সমূহকে কিতাব ও সুন্নাতের সম্মুখে পেশ করা ব্যতীত কোন উপায় থাকতে পারে না। আর যেসব কাটমোল্লা ফক্বীহ একজন আলেমের তাক্বলীদকে দলীল বানিয়ে নিয়েছে এবং সুন্নাতের অনুসন্ধান থেকে বিরত রয়েছে, তাদের কথা শুনবে না এবং তাদের দিকে ফিরেও তাকাবে না। ওদের থেকে দূরে থেকেই আল্লাহর নৈকট্য সন্ধান কর।
২য় অছিয়ত :
ন্যায় কাজে আদেশ-এর সীমারেখা সম্পর্কে এই ফকীরের অন্তরে যা নিক্ষিপ্ত হয়েছে তা এই যে, ফরয সমূহ, কবীরা গোনাহ সমূহ এবং ইসলামের নিদর্শন সমূহের ব্যাপারে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ শক্তভাবে কর। যারা এসব বিষয়ে অলসতা দেখায়, তাদের সাথে উঠাবসা করো না। বরং তাদের শত্রু হয়ে যাও। পক্ষান্তরে ঐ সকল বিষয়ে বিশেষ করে যেখানে পূর্বেকার ও পরবর্তী বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন, সে সকল বিষয়ে আদেশ-নিষেধে এতটুকুই যথেষ্ট যে, উক্ত বিষয়ে কেবল হাদীছ পৌঁছে দিতে হবে। চাপ সৃষ্টি করা ঠিক হবে না।
৩য় অছিয়ত :
এ যুগের মাশায়েখদের যারা নানাবিধ বিদ‘আতে লিপ্ত, তাদের হাতে কখনোই হাত রাখা যাবে না এবং তাদের নিকট বায়‘আত করা যাবে না। সাধারণ লোকদের ভক্তির বাড়াবাড়ি ও কারামত দেখে ধোঁকা খাওয়া যাবে না। কেননা সাধারণ লোকের অতিভক্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রে রেওয়াজের কারণে হয়ে থাকে। আর সত্যের বিপরীতে রেওয়াজের কোন মূল্য নেই। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এ যুগের কারামত ব্যবসায়ীরা তেলেসমাতি ও ভেল্কিবাজিকে ‘কারামত’ বলে মনে করে। এই সংক্ষিপ্ত কথার ব্যাখ্যা এই যে, অলৌকিক ক্রিয়াকর্ম সমূহের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বিষয় হ’ল, মানুষের মনের কথা জানা ও ভবিষ্যৎ ঘটনাবলী প্রকাশ পাওয়া। আর এই ইশরাফ ও কাশফ তথা মানুষের মনের কথা জানা ও ভবিষ্যৎ ঘটনাবলী প্রকাশ পাওয়ার বহু পদ্ধতি রয়েছে। যেগুলির মধ্যে গোপন ভেদ জানা (باب ضمير) নক্ষত্র বিদ্যা ও জ্যোতিষ শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত। এটা বুঝে রেখ না যে, নক্ষত্র বিদ্যা মতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ঘর সমূহের সমতা (تسوية البيوت)-এর উপর নির্ভরশীল। আর জ্যোতির্বিদ্যার জন্য জন্মতারিখ ও সময় জানা আবশ্যক। কেননা আমাদের অভিজ্ঞতা এই যে, নক্ষত্র বিদ্যায় দক্ষ ব্যক্তি যখন জেনে নেয় যে, দিনের সময় সমূহের মধ্যে এখন সময় কোন্টি, তখন সেখান থেকেই তার কল্পনা রাশিচক্রের (طَالِع) দিকে ফিরে যায়। অতঃপর সকল ঘর ও নক্ষত্রের ঠিকানা সমূহ তার সামনে এমনভাবে ভেসে ওঠে, যেন ঘরগুলির পৃষ্ঠা তার সামনে রাখা হয়েছে। একইভাবে জ্যোতিষ শাস্ত্রে দক্ষ ব্যক্তি যখন অন্তরে নির্দিষ্ট করে নেয় যে, আমার অমুক আঙ্গুলকে অমুক ঘুঁটি (شكل) এবং অমুক আঙ্গুলকে অমুক ঘুঁটি ধরে নেব, তখন জ্যোতিষীর কল্পনায় এসে যায়, এইসব ঘুঁটি থেকে কি সৃষ্টি হয়। এমনকি তার সামনে পুরা জন্মপঞ্জী এসে যায়। এর মধ্যে ভাগ্য গণনা বিদ্যা অন্যতম। যা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত এবং এ শাস্ত্রটি খুবই বিস্তৃত। এটি কখনো জিনের উপস্থিতিতে ও কখনো অনুপস্থিতিতে হয়। এর মধ্যে জাদু বিদ্যা অন্যতম। যা নক্ষত্রের শক্তিকে একভাবে বন্দী করে এবং সে এর মাধ্যমে ‘ইশরাফ’ তথা অন্যের মনের কথা জেনে নেয়। জাদু বিদ্যার মধ্যে যোগ সাধনাও অন্যতম। কোন কোন যোগ সাধকের মধ্যে ইশরাফ ও কাশফ তথা অন্যের মনের কথা জানার ও ভবিষ্যৎ ঘটনাবলী প্রকাশ করার ব্যাপারে যথেষ্ট দক্ষতা রয়েছে। যে ব্যক্তি এ বিষয়ে ভালভাবে জানতে চায়, সে যেন এসব বিষয়ের বই সমূহ অধ্যয়ন করে।
অন্যের কাজের উপর চাপ সৃষ্টি করা, ভয়াবহ আকৃতিতে নিজেকে প্রকাশ করা, অন্যের হৃদয়ে নিজের হৃদয়ের চাপ প্রয়োগ করা, টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে অনুগত বানানো, এসবই প্রতারণামূলক (نيرنج) বিষয় সমূহের অন্তর্ভুক্ত। এরূপ কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে, যা মানুষকে উক্ত স্তর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। কিন্তু এতে কল্যাণ-অকল্যাণ, সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য, কবুল হওয়া বা প্রত্যাখ্যাতর মধ্যে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করে না। একইভাবে উপস্থিতগণের মধ্যে বেহুঁশী (‘হাল’) ও আকর্ষণ, অস্থিরতা ও আনন্দ সৃষ্টি করা কোন ব্যাপারই নয়। এসব অবস্থা সৃষ্টির উদ্দেশ্য হ’ল পশু প্রবৃত্তিকে উত্তেজিত করা। সেকারণ যার পশু প্রবৃত্তি যত বেশী শক্তিশালী, তার ‘হাল’ও তেমনি জোশের হয়ে থাকে। অবশ্য এরূপ কাজ কখনো কোন সৎ লোক সৎ নিয়তে করে থাকে। যা এই কাজগুলিকে ‘কারামত’ বানিয়ে দেয় না। আর এটি গোপন নয়। আমরা বহু সরল প্রাণ লোককে দেখেছি যে, তারা যখন এইসব কাজ কোন শায়খের মধ্যে দেখে, তখন তারা সেটিকে ‘কারামত’ বলে নিশ্চিত ভাবে বিশ্বাস করে নেয়।
এক্ষেত্রে করণীয় হ’ল এই যে, হাদীছের কিতাব সমূহ যেমন ছহীহ বুখারী, মুসলিম, সুনানে আবুদাঊদ, তিরমিযী এবং হানাফী ও শাফেঈ ফিক্বহের কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করা। আর প্রকাশ্য সুন্নাত (ظاہر سنہ)-এর উপর আমল করা। অতঃপর যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা হৃদয়ে সত্যিকারের আগ্রহ সৃষ্টি করে দেন এবং তার রাস্তা অনুসন্ধানের আকাঙ্খা বিজয়ী হয়, তাহ’লে ইহসানের কিতাব (كتاب عوارف) থেকে ছালাত-ছিয়াম ও যিকর-আযকার দিয়ে নিজের সময়গুলিকে আলোকিত করবে।[1] নকশবন্দী তরীকার পুস্তিকাসমূহ পথনির্দেশ নেওয়ার ব্যাপারে উপকারী।[2] এইসব বুযর্গগণ ইবাদত ও আযকার উভয় বিষয়ে এমন পথনির্দেশ দান করেছেন যে, কোন পীর-মুর্শিদের তালক্বীনের প্রয়োজন বাকী থাকে না।
যখন ইবাদতের জ্যোতি ও স্মরণ রাখার বিষয়টি হাছিল হয়ে যায়, তখন তার উপর নিয়মিত আমল করা উচিত। আর যদি এরি মধ্যে কোন বন্ধু মিলে যায়, যার সাহচর্য আকর্ষণের চাবি স্বরূপ হয় এবং তার সাহচর্যের প্রভাব লোকদের উপর পড়ে, তাহ’লে তার সাহচর্য গ্রহণ করবে। যতক্ষণ না উক্ত অবস্থা, স্বভাবে পরিণত হয়ে নিজের মধ্যে দৃঢ়তা লাভ করে। এরপর গৃহকোণে বসে যাবে এবং উক্ত স্বভাবগত ক্ষমতা রক্ষায় লিপ্ত হবে। এ যুগে এমন কেউ নেই যে সকল দিক দিয়ে পূর্ণতা রাখে, কেবল আল্লাহ যাকে চান তিনি ব্যতীত। যদি কেউ এক দিকে পূর্ণ হয়, তো অন্য দিকে সে শূন্য। অতএব যতটুকু পূর্ণতা মওজূদ আছে, সেটুকুই অর্জন করে নেওয়া উচিৎ। এবং অন্য বিষয়গুলি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়া আবশ্যক। خُذْ مَا صَفَا وَدَعْ مَا كَدُرَ ‘তুমি স্বচ্ছটুকু গ্রহণ কর এবং ময়লাটুকু ছেড়ে দাও’।
ছূফীদের প্রতি সম্বন্ধ বড়ই গণীমতের। কিন্তু তাদের রীতিসমূহ ফালতু মাত্র। একথা অধিকাংশ লোকের মধ্যে বড়ই কষ্টদায়ক হবে। কিন্তু আমাকে একটি কাজের উপর আদেশ করা হয়েছে। আমাকে সে অনুযায়ী কথা বলতে হবে। কোন যায়েদ-ওমরের কথার উপর আবদ্ধ থাকা যাবে না।
৪র্থ অছিয়ত :
জানা উচিৎ যে, আমাদের ও এ যামানার মাশায়েখদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ছূফীমনস্ক লোকেরা বলে থাকেন যে, আসল উদ্দেশ্য হ’ল ফানা, বাক্বা, ইস্তিহলাক ও ইনসিলাখ (অর্থাৎ আল্লাহর সত্তার মধ্যে লীন হয়ে যাওয়া, সেখানে স্থায়ী হওয়া, আত্মচেতনাকে ধ্বংস করা ও তা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া)। আর জীবিকার বিষয়গুলি দেখা ও দৈহিক ইবাদতগুলি বজায় রাখা, যেগুলির বিষয়ে শরী‘আত নির্দেশ দান করেছে। এগুলি কেবল এজন্য যে, সকলে উক্ত মূল উদ্দেশ্য পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। অতএব مَا لاَ يُدْرَكُ كُلُّهُ لاَ يُتْرَكُ كُلُّهُ ‘যার সম্পূর্ণটা অর্জন করা সম্ভব নয়, তার সম্পূর্ণটা বর্জন করাও উচিৎ নয়’।
কালাম শাস্ত্রবিদগণ বলেন,
যেটুকু শরী‘আতে এসেছে, এটুকু ব্যতীত কিছুই উদ্দেশ্য নয়। আর আমরা বলি যে,
মানুষের বাহ্যিক আকৃতিকে সামনে রেখে শরী‘আত ব্যতীত অন্য কিছুই উদ্দেশ্য নয়।
শরী‘আত প্রণেতা উক্ত মূল বিষয়কে (অর্থাৎ ফানা, বাক্বা ইত্যাদিকে) বিশেষ
ব্যক্তিদের জন্য বর্ণনা করেছেন।[3]
এই সারকথার ব্যাখ্যা এই যে, মনুষ্য জাতিকে এভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে যে, তার মধ্যে ফেরেশতা শক্তি ও পশু শক্তি একত্রিত হয়েছে। তার সৌভাগ্য নির্ভর করে ফেরেশতা শক্তি বৃদ্ধি করার মধ্যে। আর দুর্ভাগ্য নিহিত থাকে পশুশক্তি বৃদ্ধি করার মধ্যে। সে এমনভাবে সৃষ্টি হয়েছে যে, তার কর্মসমূহের চিত্র ও চরিত্রের রং সমূহ সে নিজের মধ্যে গ্রহণ করে নেয় ও তা নিজের অধিকারে রাখে। আর মৃত্যুর পর সেগুলি সে সাথে নিয়ে যায়; ঠিক সেইভাবে যেভাবে তার দেহ খাদ্যের প্রতিক্রিয়া সমূহ নিয়ে চলে এবং তার ফলে সে বদহযম, জ্বর ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়। তাছাড়া তার সৃষ্টি এমনভাবে হয়েছে যে, সে জান্নাতে (حظيرة القدس) ফেরেশতাদের সাথে মিলে সেখান থেকে ‘ইলহাম’ এবং ইলহামের মত কিছু হাছিল করে। অতঃপর যদি ঐ ফেরেশতাদের সাথে তার কিছু সম্পর্ক তৈরী হয়, তাহ’লে ইলহাম পাওয়ার কারণে সে খুশী ও মঙ্গল আকাঙ্ক্ষা লাভ করে। কিন্তু যদি তাদের থেকে ঘৃণার অবস্থায় থাকে, তাহ’লে সে সংকীর্ণতা ও কষ্টের মধ্যে থাকে। মোটকথা যেহেতু মানুষ ঐভাবেই অস্তিত্ব লাভ করেছে, সেহেতু যদি তাকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দেওয়া হ’ত, তাহ’লে অধিকাংশ মানুষকে আত্মিক রোগ সমূহ ক্ষতিগ্রস্ত করত। এজন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা স্রেফ নিজের অনুগ্রহ ও দয়ায় তাকে পরিচ্ছন্ন করেছেন এবং তার নাজাতের জন্য একটি রাস্তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি তাঁর অদৃশ্য যবানের মুখপাত্র হিসাবে রাসূল (ছাঃ)-কে তাদের মধ্য থেকেই তাদের নিকট প্রেরণ করেছেন। যাতে নে‘মত পরিপূর্ণ হয়ে যায় এবং মানুষ সৃষ্টির যে উদ্দেশ্য ছিল (অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদত করা), সেটা পুনরায় তাদের হস্তগত হয়। অতঃপর মানুষ তার বর্তমান অবয়বে বর্তমান ভাষা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলার নিকট শরী‘আত প্রার্থনা করে। যেহেতু সমস্ত মানুষ একই অবয়বে সৃষ্ট, সেহেতু তার হুকুম সকল মানুষের জন্য অপরিহার্য হয় এবং সকলের মধ্যে একই হুকুম জারী হয়। এতে কারু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কোন দখল নেই। ফানা, বাক্বা, ইস্তিহলাক প্রভৃতি, যা হয়ে থাকে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি থেকে; তা এজন্য যে, কিছু কিছু মানুষ চূড়ান্ত উচ্চতা ও দুনিয়া ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে থাকেন। আল্লাহ তাদেরকে তাদের রাস্তায় পৌঁছে দেন। এটি আল্লাহর অহি-র নির্দেশ নয়; বরং ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী হয়ে থাকে। শরী‘আত প্রণেতার কালাম উক্ত অর্থ বহন করে না। না প্রকাশ্যে, না ইঙ্গিতে।
একটি দল উক্ত বিষয়গুলিকে শরী‘আত প্রণেতার কালাম বলে বুঝে রেখেছেন। যেমন কোন ব্যক্তি লায়লী-মজনুর কাহিনী শোনে। আর তার প্রতিটি কথাকে নিজের উপর চাপিয়ে নেয়। ঐ লোকদের পরিভাষায় একে ই‘তিবার (إعتبار) অর্থাৎ প্রভাব গ্রহণ বলা হয়।
মোটকথা ইনসিলাখ ও ইস্তিহলাক-এর বিষয়ে বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যাওয়া এবং এতে যোগ্য-অযোগ্য যেকোন ব্যক্তির লিপ্ত হয়ে পড়া একটি দুরারোগ্য ব্যাধি(داء عُضال)।[4] মিল্লাতে মুছত্বফাবিয়াহর মধ্যে যে কেউ এগুলি মিটাতে চেষ্টা করবেন, আল্লাহ তার উপর রহম করবেন। যদিও অনেকে সত্তাগতভাবেই এর ক্ষমতা রাখেন। যাই হোক এ কথাগুলি এ যমানার অনেক ছূফীর নিকট কঠিন মনে হবে। কিন্তু আমাকে একটি কাজের আদেশ করা হয়েছে, সে মোতাবেক বলছি। যায়েদ-ওমরের সাথে আমার কোন কাজ নেই।
৫ম অছিয়ত :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীদের সম্পর্কে উত্তম ধারণা পোষণ করা উচিত। তাদের মর্যাদা বর্ণনা ব্যতীত মুখ খোলা উচিৎ নয়। এ বিষয়ে দু’টি দল ভুল করেছে। একদল ধারণা করেছেন যে, তারা পরস্পরে পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। তাদের মধ্যে কোনরূপ ঝগড়াই হয়নি। এটি স্রেফ ধারণা মাত্র। কেননা এ বিষয়ে মুতাওয়াতির তথা অবিরত ধারায় বর্ণিত হাদীছসমূহ সাক্ষী রয়েছে। যেগুলিকে অস্বীকার করা যায় না। দ্বিতীয় দল যখন তাদের দিকে ঝগড়ার কথাগুলি সম্পর্কিত দেখেছেন, তখন তাদের বিরুদ্ধে গালি-গালাজের যবান খুলে দিয়েছেন এবং ধ্বংসের ময়দানে পৌঁছে গিয়েছেন। এই ফকীরের অন্তরে একথা নিক্ষেপ করা হয়েছে যে, যদিও ছাহাবীগণ মা‘ছূম বা নিষ্পাপ ছিলেন না এবং তাদের কাজ কোন কোন সাধারণ মানুষ থেকেও সম্ভব ছিল। যদি অন্যদের থেকে একাজ সংঘটিত হ’ত, তাহ’লে তারা নিন্দা-সমালোচনার শিকার হ’তেন। কিন্তু একটি কল্যাণের স্বার্থে তাঁদের ত্রুটি সমূহ বর্ণনা থেকে বিরত থাকতে আদিষ্ট হয়েছি এবং তাঁদের নিন্দা-সমালোচনা থেকে নিষেধ করা হয়েছে, সেটি হ’ল এই যে, যদি তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনার দরজা খুলে যায়, তাহ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে (হাদীছের) সকল বর্ণনাসূত্র ছিন্ন হয়ে যাবে। আর এই ছিন্ন হওয়ার মধ্যে উম্মতের বিপর্যয় নিহিত রয়েছে। পক্ষান্তরে যখন সকল ছাহাবী[5] থেকে রেওয়ায়াত গ্রহণ করা হবে, তখন অধিকাংশ হাদীছ (مستفيض) গ্রহণীয় হয়ে যাবে এবং উম্মতের জন্য দলীলে পরিণত হবে। তাঁদের থেকে বর্ণনা সূত্রে কোনরূপ সমালোচনা তখন দোষের হবে না।
এই ফকীর রাসূল (ছাঃ)-এর সফলকাম রূহ-এর নিকট প্রশ্ন করেছিল যে, হুযূর শী‘আদের বিষয়ে কি বলেন, যারা রাসূল পরিবারের প্রতি ভালোবাসার দাবীদার এবং ছাহাবীদের গালি-গালাজ করে? তখন হুযূর (ছাঃ) রূহানী কালামের একটি ধারার মাধ্যমে আমার আত্মায় নিক্ষেপ করেন যে, ‘ওদের মাযহাব বাতিল। আর তাদের মাযহাব বাতিল হওয়াটা ইমামের কথা থেকেই জানা যায়’।
অতঃপর যখন ঐ অবস্থা থেকে আমার হুঁশ ফিরে আসে, তখনই আমি ইমামের কথাগুলি চিন্তা করি এবং বুঝতে পারি যে, তাদের পরিভাষায় ইমাম হ’লেন,مَعْصُوْمٌ مُفْتَرَضُ الطَّاعَةِ مَنْصُوْبٌ لِلْخَلْقِ ‘নিষ্পাপ; যার আনুগত্য করা ফরয এবং যিনি সৃষ্টিকুলের জন্য নিযুক্ত’। আর তার জন্য বাতেনী অহি সিদ্ধ মনে করা হয়। অতএব বাস্তবে এরা খতমে নবুঅতকে অস্বীকারকারী। যদিও তারা মুখে রাসূল (ছাঃ)-কে শেষনবী বলে। অতএব যেভাবে ছাহাবীগণ সম্পর্কে সুধারণা রাখা উচিৎ, একইভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পরিবারবর্গ সম্পর্কে সুধারণা রাখা উচিৎ। আর তাদের মধ্যেকার সৎকর্মশীলদের অধিক সম্মানের দ্বারা নির্দিষ্ট হিসাবে বিবেচনা করা উচিৎ। আর قَدْ جَعَلَ اللهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا‘আল্লাহ প্রত্যেক বস্ত্তর জন্য পৃথক পৃথক মর্যাদা নির্ধারণ করেছেন’ (তালাক ৬৫/৩)।
এই ফকীর এটা বুঝতে পেরেছে যে, বারোজন ইমাম (আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট হউন) পরস্পরে কোন না কোন সম্বন্ধে ‘কুতুব’ ছিলেন। আর তাছাউওফের রেওয়াজ তাদের গত হয়ে যাওয়ার পরে হয়েছে। আক্বীদা ও শরী‘আতে নবীর হাদীছ ব্যতীত অন্য কোন স্থান থেকে নেওয়া যায় না। তাদের কুতুবিয়াত একটি বাতেনী বিষয়। শরী‘আতের বাধ্যবাধকতার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। আর তাদের প্রত্যেকের হুকুম ও ইশারা পরবর্তীর উপর কুতুবিয়াত হিসাবে নির্ণীত হয়। আর ইমামতের ইঙ্গিতও তাদের বর্ণনামতে উক্ত কুতুবিয়াতের দিকে প্রত্যাবর্তিত হয়। যে ব্যাপারে তারা তাদের কিছু খালেছ বন্ধুকে জানিয়ে দিতেন। অতঃপর কিছুদিন পর একটি গ্রুপ অধিক চিন্তা-ভাবনার সাথে কাজ করে এবং তাদের কথাগুলি অন্যভাবে ঢেলে সাজায়। আল্লাহর নিকটেই সকল সাহায্য প্রার্থনা।
৬ষ্ঠ অছিয়ত :
ইলম অর্জনের পদ্ধতি সম্পর্কে, যা অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে যে, সর্বপ্রথম ছরফ-নাহুর সংক্ষিপ্ত পুস্তিকা পড়বে। ছাত্রের মেধা অনুপাতে প্রতিটি বিষয়ে তিন-তিনটি বা চার-চারটি পুস্তিকা পড়াবে। এরপর ইতিহাস অথবা নৈতিক ও ব্যবহারিক বিষয়ে (حكمت عملى) কোন বই, যা আরবী ভাষায় হবে, তা পড়াবে। এরি মধ্যে অভিধান পড়বে এবং কঠিন শব্দগুলি ব্যাখ্যা করার যোগ্যতা অর্জন করবে। যখন আরবী ভাষায় দখল এসে যাবে, তখন ‘মুওয়াত্ত্বা’ হাদীছের কিতাব পড়বে, যা ইয়াহ্ইয়া বিন ইয়াহ্ইয়া মাছমূদী সূত্রে বর্ণিত। আর একে কখনোই বেকার ছেড়োনা। কেননা আসল ইলম হ’ল হাদীছ শিক্ষা করা। এই ইলম শিক্ষার মধ্যে বহু কল্যাণ রয়েছে। আমাদের হাদীছ সমূহের ধারাবাহিক শ্রবণ অর্জিত হয়েছে। অতঃপর কুরআন পড়াবে এমন পদ্ধতিতে যে, তা তাফসীর ও তরজমা ছাড়াই হবে। আর যেসব কথা কঠিন মনে হবে, সেসব স্থানে ইলমে নাহু ও শানে নুযূলে মনোযোগ দিবে এবং গবেষণা করবে। পাঠদান থেকে ফারেগ হয়ে পাঠদানের কায়দায় তাফসীরে জালালায়েন পড়বে। এই পদ্ধতিতে অনেক কল্যাণ অর্জিত হবে। এরপর এক সময় ছহীহ বুখারী ও মুসলিম প্রভৃতি হাদীছের কিতাব সমূহ এবং ফিক্বহ, আক্বায়েদ ও সুলূকের[6] কিতাবসমূহ পড়বে। আর একটি সময় ইলমে মা‘কূলাতের কিতাব, যেমন শরহ মোল্লা, কুৎবী প্রভৃতি কিতাব সহ যতদূর আল্লাহ চান অধ্যয়ন করবে। আর যদি সম্ভব হয় তাহ’লে একদিন মিশকাত ও পরের দিন অত পরিমাণ শরহ ত্বীবী পড়বে। এটা খুব উপকারী হবে।
৭ম অছিয়ত :
আমরা আরবী লোক। আমাদের বাপ-দাদারা মুসাফির অবস্থায় হিন্দুস্থানের মাটিতে এসেছিলেন। বংশগত ও ভাষাগত উভয় দিক দিয়ে আরবী হওয়ার গৌরব আমাদের রয়েছে। কারণ এ দু’টি সম্বন্ধ আমাদেরকে প্রথম ও শেষ যামানার শ্রেষ্ঠ মানুষ ও নবীকুল শিরোমণি হযরত মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহ ‘আলাইহে ওয়া সাল্লামের নৈকট্যের সম্মান দান করে। এই মহান নে‘মতের শুকরিয়া এই যে, আমরা ইসলামী মর্যাদাকে ভুলবো না। যখন জিহাদের কারণে আরবরা আজমীদের (অনারবদের) দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন হযরত ওমর (রাঃ)-এর মধ্যে এই আশংকা সৃষ্টি হয় যে, এরা আজমীদের রীতি সমূহের অনুসারী হয়ে যাবে এবং আরবদের জীবনধারা ভুলে যাবে। সেকারণ তিনি তাদের উদ্দেশ্যে ফরমান লিখে পাঠান। যেমন-
عَنْ قَتَادَةَ قَالَ سَمِعْتُ أَبَا عُثْمَانَ النَّهْديَّ يَقُولُ : أَتَانَا كِتَابُ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ وَنَحْنُ بِأَذْرَبِيجَانَ مَعَ عُتْبَةَ بْنِ فَرْقَدٍ، أَمَّا بَعْدُ : فَاتَّزِرُوا وَارْتَدُوا وَانْتَعِلُوا وَارْمُوا بِالْخِفَافِ وَأُلْقُوا السَّرَاوِيلاَتِ، وَعَلَيْكُمْ بِلِبَاسِ أَبِيكُمْ إِسْمَاعِيلَ وَإِيَّاكُمْ وَالتَّنَعُّمَ وَزِيَّ الْعَجَمِ، وَعَلَيْكُمْ بِالشَّمْسِ فَإِنَّهَا حَمَّامُ الْعَرَبِ، وَتَمَعْدَدُوا وَاخْشَوْشِنُوا وَاخْلَوْلَقُوا وَاقْطَعُوا الرُّكَبَ وَانْزَوْا عَلَى الْخَيْلِ نَزْوًا وَارْمُوا الْأَعْرَاضَ-
ক্বাতাদাহ (রাঃ) বলেন, আমি ওছমান
আন-নাহদীকে বলতে শুনেছি যে, আমরা যখন আযারবাইজানে ওতবা বিন ফারক্বাদ-এর
নেতৃত্বে ছিলাম, তখন আমাদের নিকট খলীফা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর পত্র
এল। যেখানে তিনি হাম্দ ও ছানার পর লিখেছেন, তোমরা লুঙ্গি ও চাদর পরো। জুতা
পরো, মোযা ছাড়ো। পায়জামা ফেল। আর তোমাদের উপর তোমাদের পিতা ইসমাঈলের পোষাক
আবশ্যিক করে নাও। নিজেদেরকে বিলাসিতা ও আজমীদের অনুকরণ থেকে দূরে রাখো।
রৌদ্রে থাকাকে আবশ্যিক করে নাও। কেননা এটি আরবদের জন্য গোসলখানা স্বরূপ।
মা‘দ (বিন ‘আদনান)[7] জাতির কষ্টকর রীতি-নীতির উপর কায়েম থাকো। মোটা ও
পুরানো পোষাক পরিধান করো। উটগুলিকে কব্জায় রাখো। ঘোড়াগুলির উপর জোশ দিয়ে
সওয়ার হও এবং নিশানা তাক করে তীর নিক্ষেপ কর’।[8]
হিন্দুদের মন্দ রীতি সমূহের মধ্যে একটি এই যে, যখন কোন মহিলার স্বামী মারা যায়, তাকে তারা দ্বিতীয়বার বিয়ে করার অনুমতি দেয় না। এ রীতি আরবদের মধ্যে কখনো নেই। না রাসূল (ছাঃ)-এর পূর্বে, না তাঁর সময়ে, না তাঁর পরে। আল্লাহ তার উপর রহম করুন, যিনি এটি মিটিয়ে দিবেন। যদি সাধারণ লোকদের থেকে এটি মিটানো সম্ভব না হয়, তবে কমপক্ষে নিজ গোত্রের মধ্যে আরবদের এই রীতির প্রচলন অবশ্যই ঘটাবে। যদি সেটাও সম্ভব না হয়, তাহ’লে এই রীতিকে অবশ্যই মন্দ মনে করবে এবং অন্তর থেকে এর শত্রু হবে। কেননা এটি হ’ল নাহি ‘আনিল মুনকার তথা অন্যায় কাজে নিষেধ করার সর্বনিম্ন স্তর।
আমাদের মন্দ রীতি সমূহের মধ্যে অন্যতম এই যে, স্ত্রীর মোহরানা খুব বেশী পরিমাণ ধার্য করা হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যার আবির্ভাবই ছিল দ্বীন ও দুনিয়ার চূড়ান্ত সম্মান, তিনি তাঁর পরিবার, যারা সব মানুষের চাইতে উত্তম মানুষ ছিলেন, তাদের মোহরানা সাড়ে ১২ উক্বিয়া নির্ধারণ করেছেন, যা ৫০০ দিরহাম (রৌপ্য মুদ্রা) হয়ে থাকে।
আমাদের মন্দ রীতি সমূহের মধ্যে আরেকটি হ’ল বিবাহে অতিরিক্ত খরচ করা এবং তাতে অনেক বাহুল্য রীতি পালন করা। খুশীর ক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ) দু’টি খুশী নির্ধারণ করেছেন। একটি অলীমার খুশী, অন্যটি আক্বীক্বার খুশী। কেবল এ দু’টিই গ্রহণ করা উচিত। এ ব্যতীত সবকিছু ত্যাগ করা উচিত। অথবা সেগুলির ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব না দেওয়া উচিত।
আমাদের বদভ্যাস ও কুসংস্কার সমূহের মধ্যে রয়েছে শোক প্রকাশে সীমালংঘন করা। মৃত্যুর তৃতীয় দিনে কুলখানী, চল্লিশ দিনে চেহলাম, অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক ফাতেহাখানী ইত্যাদি রেওয়াজসমূহের কোন নাম-গন্ধ আরবদের মধ্যে ছিল না। কল্যাণ এতেই রয়েছে যে, মাইয়েতের উত্তরাধিকারীদের প্রতি সমবেদনা ও শোক প্রকাশ তিন দিন পর্যন্ত হবে এবং তাদেরকে এক রাত ও একদিন খাওয়ানো ব্যতীত অন্য কোন রীতি পালন না করা। তিন দিনের পর গোত্রের সব মেয়েরা একত্রিত হবে এবং মাইয়েতের বাড়ীর মেয়েদের পোষাকে সুগন্ধি মাখাবে।[9] আর মাইয়েতের স্ত্রী থাকলে ইদ্দতকাল (৪ মাস ১০ দিন) অতিক্রান্ত হওয়ার পর শোক পালন শেষ করবে।
আমাদের মধ্যে সৎ ও সৌভাগ্যবান ঐ ব্যক্তি, যে আরবী ভাষা, ছরফ-নাহু ও সাহিত্যের কিতাবসমূহের সাথে সম্পর্ক তৈরী করে এবং হাদীছ ও কুরআন বুঝতে চেষ্টা করে। কাব্য বিদ্যা ও মা‘কুলাত তথা দর্শন ও তর্কশাস্ত্রের ফার্সী-হিন্দী বইসমূহ এবং যেসব অপ্রয়োজনীয় বস্ত্ত সৃষ্টি করা হয়েছে; আর বাদশাহদের ইতিহাস ও কাহিনীসমূহ এবং ছাহাবীদের ঝগড়ার বই সমূহ পাঠ করা, স্রেফ গোমরাহী আর গোমরাহী মাত্র।
যদি যামানার রীতি মোতাবেক অন্য বিদ্যাসমূহ শিখতে হয়, তাহ’লে কমপক্ষে এটি যরূরী যে, এগুলিকে স্রেফ দুনিয়াবী বিদ্যা বলে জানবে এবং এতে অসন্তুষ্ট থাকবে। সর্বদা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে ও লজ্জা অনুভব করবে।
আর আমাদের জন্য অবশ্যই যরূরী হ’ল, মহা সম্মানিত দুই হারামে গমন করবে এবং সেখানকার দরজা সমূহের উপর চেহারা রগড়াবে।[10] এর মধ্যেই রয়েছে আমাদের সৌভাগ্য এবং এড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে রয়েছে আমাদের দুর্ভাগ্য।
৮ম অছিয়ত :
হাদীছে
এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ أَدْرَكَ مِنْكُمْ عِيسَى ابْنَ
مَرْيَمَ فَلْيُقْرِئْهُ مِنِّي السَّلاَمَ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِمَا
وَسَلَّمَ- ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ঈসা ইবনু মারিয়ামকে পাবে, সে যেন
তাকে আমার পক্ষ হ’তে সালাম দেয়’।[11]
এই ফকীর পূর্ণ আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে যে, যদি রূহুল্লাহ্-র যামানা পাই, তাহ’লে যে ব্যক্তি তাকে সবার আগে সালাম পৌঁছাবে, সে ব্যক্তি আমি হব’। আর যদি আমি তাকে না পাই, তবে আমার সন্তানদের ও আমার অনুসারীদের মধ্যে যে ব্যক্তি তাঁর সেই আনন্দময় পবিত্র যামানা পাবে, তাঁকে সালাম পেঁŠছানোর জন্য পূর্ণ চেষ্টা চালাবে। যাতে মুহাম্মাদী সেনাবাহিনীর শেষ কাতারে শামিল হ’তে পারি।
وَالسَّلاَمُ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى
(হেদায়াতের অনুসারী ব্যক্তিদের উপর শান্তি বর্ষিত হৌক!)
[1]. ‘ইহসানের কিতাব’ বলতে ইবাদতের কিতাব বুঝানো হয়েছে। যা পাঠ করলে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছানো সহজ হয়।
[2]. ছাহাবী ও তাবেঈগণের স্বর্ণযুগের পর ভ্রষ্টতার যুগে কথিত ছূফী ও পীর-আউলিয়াদের মাধ্যমে যেসব মা‘রেফতী তরীকা সমাজে চালু হয়েছে, সেগুলি কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দীয়া ও মুজদ্দেদিয়া নামে প্রধান চারটি তরীকায় বিভক্ত। শেখ বাহাউদ্দিন মোহাম্মদ বুখারী নকশবন্দী (৭১৮-৭৯১ হি.) মুরীদদেরকে ‘আল্লাহ’ শব্দের নকশা লিখে দিতেন। যাতে তারা ধ্যানের মাধ্যমে এ নামের নকশা স্বীয় ক্বলবে প্রতিফলিত করতে পারে। ‘নক্বশবন্দ’ শব্দের অর্থ ‘চিত্রকর’। এ তরীকার ছূফীরা আল্লাহর মহিমার চিত্র হৃদয়ে ধারণ করেন। এ অর্থে তাদের বলা হয় নকশবন্দী। এইসব তরীকার বই পাঠ করা থেকে দূরে থাকতে হবে। তাতে পথভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর সম্মুখে ওমর (রাঃ)-এর তওরাত পাঠ করাকে বরদাশত করেননি (আহমাদ হা/১৫১৯৫; সনদ হাসান, ইরওয়া হা/১৫৮৯; মিশকাত হা/১৭৭)। -অনুবাদক।
[3]. যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তুমি আল্লাহর ইবাদত কর এমনভাবে যেন তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ (মুসলিম হা/৮; মিশকাত হা/২)। যেটি কেবল বিশেষ মুত্তাক্বীরাই পাবেন। তবে এর দ্বারা ফানা, বাক্বা ইত্যাদি নামে পৃথক কোন ইবাদতের তরীকা বুঝানো হয়নি। -অনুবাদক।
[4]. এখানে কানাডার প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় ‘ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি’র ইনষ্টিটিউট অব ইসলামিক স্টাডিজ কর্তৃক প্রকাশিত উর্দূ অনুবাদে অনুবাদকের পক্ষ থেকে যোগ করা হয়েছে, اگرچہ بعض استعدادوں كى بنسبت انكى كچھ اصل ہے تاہم عوام كيلئے ايك لاعلاج مرض ہے- ‘যদিও কোন কোন ব্যক্তি সম্পর্কে এটির কিছু ভিত্তি আছে, তথাপি সাধারণ লোকদের জন্য এটি একটি দুরারোগ্য ব্যাধি’। অথচ মূল লেখক এটি বলেননি। কারণ ইসলামী শরী‘আতে ইবাদতের যে বিধান রয়েছে, তা সবার ক্ষেত্রে সমান। সেগুলিতে ইনসিলাখ-ইস্তিহলাক প্রভৃতির কোন সুযোগ নেই। কেবলমাত্র ইত্তেবায়ে সুন্নাহ ও খুশূ-খুযূ ব্যতীত। একইভাবে তিনি ৭ম অছিয়তে শাদী সমূহের (شادياں) অর্থ শাদীই লিখেছেন এবং বলেছেন, দুই শাদীর মধ্যে একটি হ’ল অলীমা ও একটি হ’ল আক্বীক্বা। অথচ এর অর্থ হবে দুই খুশীর মধ্যে। কারণ ফার্সীতে শাদী অর্থ খুশী ও আনন্দোৎসব। এই ভুলটি আরো তিনজন উর্দূ অনুবাদক করেছেন। এছাড়া অনেকে অনুবাদ ছেড়ে গেছেন। অনেকে মর্ম পরিবর্তন করেছেন। অনেকে কঠিন শব্দ বা বাক্য ঐভাবেই রেখে দিয়েছেন। যা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক।-অনুবাদক।
[5]. হাদীছ বর্ণনার ক্ষেত্রে সকল ছাহাবী ন্যায়নিষ্ঠ (সুয়ূত্বী, তাদরীবুর রাবী)। তাঁদের থেকে যারা বর্ণনা করেন, সেইসব সনদে অনেক সময় সমালোচনা হয়। আর সেকারণেই হাদীছ ছহীহ-যঈফ হয়ে থাকে। এজন্য ছাহাবী দায়ী নন। -অনুবাদক।
[6]. তাছাউওফের পরিভাষায় ‘সুলূক’ হ’ল আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের পথ’।
[7]. মা‘দ বিন ‘আদনান হ’লেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উর্ধ্বতন ২১তম দাদা। -অনুবাদক।
[8]. বাগাভী, শারহুস সুন্নাহ হা/৩১১৭; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৫৪৫৪, সনদ ছহীহ; বায়হাক্বী হা/২০২৩০, ১০/১৪ পৃ.; মুসনাদে আবু ইয়া‘লা হা/২১৩।
[9]. এটাও মন্দ রীতির অন্তর্ভুক্ত। -অনুবাদক।
[10]. সম্ভবতঃ এর দ্বারা মাননীয় লেখক হাজারে আসওয়াদ ও কা‘বাগৃহের দরজার নিম্নের চৌকাঠের মধ্যবর্তী স্থান ‘মুলতাযাম’-কে বুঝিয়েছেন। যেখানে দাঁড়িয়ে দো‘আ করা সম্পর্কে বর্ণিত হাদীছসমূহ যঈফ। যদিও অনেক ছাহাবী এটি করেছেন। -অনুবাদক।
[11]. হাকেম, আল-মুসতাদরাক হা/৮৬৩৫; ছহীহাহ হা/২৩০৮।