সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা : আমাদের দেশে মাদ্রাসা শিক্ষায় হিফয মাদ্রাসার সংখ্যা অনেক বেশী। পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় হাফিযিয়া মাদ্রাসা তৈরি হচ্ছে অহরহ। এর কারণ মূলত কয়েকটি। প্রথমত হিফয বিভাগের জন্য অনেক বেশী জায়গার দরকার হয় না। একটা ফাঁকা ঘর হ’লেই চলে। যেকোন মসজিদের দ্বিতীয় তলা তো হ’তে পারে আলিশান হিফয বিভাগ। আবার হিফয প্রাথমিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় হিফযের শিক্ষক পাওয়া যায় খুবই কম বেতনে। অনেকে তো উচ্চ শিক্ষায় অধ্যয়নরত ছাত্র দিয়েই মাদ্রাসা চালিয়ে নেন। এই সবকিছুর ওপরে বাঙ্গালী মুসলিম বাবা-মা সন্তানকে নিয়ে সর্বপ্রথম যে স্বপ্নটা দেখেন সেটা হ’ল, আমাদের সন্তান কুরআনের হাফেয হবে। 

এই সবগুলো ইতিবাচক দিক মিলে বাংলাদেশে হিফয বিভাগ বেশ রমরমা। চাইলেই একটি হিফয মাদ্রাসা চালু করা যায়। এখন সবাই হিফয মাদ্রাসা চালু করায় এই অঙ্গনে পরিচালকও বেড়ে গেছে। যে যার ইচ্ছামত নিজ নিয়মে হিফয বিভাগ পরিচালনা করছেন। এদিকে ছাত্ররা তো ভোক্তা সম্প্রদায়। তারা কিছু বলতেও পারে না। কারণ, পরিচালকগণ ওলামায়ে কেরামের অন্তর্ভুক্ত। আর ওলামায়ে কেরাম অসন্তুষ্ট হন এমন কিছু বলা বেআদবী। এই ধারায় ছাত্রদের জীবন নষ্ট হ’ল কিনা সেটা কেউ ভেবে দেখে না। দিন শেষে পরিচালকগণের একটিই চিন্তা, মাদ্রাসা চললেই হ’ল।

আমরা মনে করি, এই পরিস্থিতিতে সংস্কারের কথা বলা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা না হয় কিছু মানুষের কাছে খারাপ হ’লাম। বেআদব হ’লাম। ইঁচড়েপাকা হ’লাম। ছোট মুখে বড় কথা না হয় কিছু হয়েই গেল। তাতে যদি এ অঙ্গনে সংস্কার আসে তবে আমরা যে কোন দায় মাথা পেতে নিব। সেই খেয়াল থেকেই আজকের এই আলোচনা। আমরা পর্যায়ক্রমে সবগুলো দিক নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। আমাদের আলোচনায় সব বিষয়গুলোর সমাধান আসবে, এমন নয়। আমরা শুধু উদ্যোগ নিলাম। প্রস্তাবনাগুলো পরিমার্জন করে বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব আপনাদের।

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের হিফয পদ্ধতি : হিফয বিভাগ নিয়ে কথা বলার পূর্বে আমাদেরকে জানতে হবে, সারা বিশ্বে কি একই পদ্ধতিতে কুরআন হিফয করা হয়, নাকি পদ্ধতির ভিন্নতা রয়েছে। পদ্ধতিগত দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা একেক অঞ্চলের একেক পদ্ধতি দেখতে পাবো। পাশাপাশি ভিন্নতা দেখতে পাবো তাদের ফলাফলেও। যেমন মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে সরকারী শিক্ষাব্যবস্থায় হিফয সেকশন রয়েছে। সেখানে সপ্তাহে ৫ দিন পূর্ণ ক্লাস হয়। প্রতিদিনের রুটিনকে ৫ থেকে ৭ ঘন্টা ক্লাস টাইম দিয়ে সাজানো হয়। তারা তাজবীদের ওপরে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেন। পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার সুযোগ রাখেন। এই পদ্ধতিতে বাচ্চারা ২ থেকে ৪ বছরে হিফয সম্পন্ন করে। এই নিয়মে তারা বেশ সফল। কারণ, তাদের এই পদ্ধতিতে আরবের বেশিরভাগ হাফেয কুরআন ইয়াদ রাখতে সক্ষম হন।

আফ্রিকা মহাদেশের বাচ্চারা ৫ থেকে ৭ বছর সময়ে হিফয সম্পন্ন করে। তারা আধুনিকতা থেকে অনেক পিছিয়ে। আজো তারা পুরাতন ধারায় কুরআন মুখস্থ করে। কাঠের ফলকে কুরআনের আয়াত লিখে সেটা হিফয করে। এভাবে তারা কুরআন মুখস্থ করার পাশাপাশি লেখাও শিখে যায়। আফ্রিকার হফেযগণ কুরআন নির্ভুল মুখস্থের পাশাপাশি নির্ভুল লিখতেও পারেন। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের হাফেযগণের মধ্যে এই গুণটি তেমন পাওয়া যায় না। সুতরাং বলা যায়, সময় কিছুটা বেশী লাগলেও তারা তাদের পদ্ধতিতে সফল।

ইউরোপিও দেশগুলোতে বাচ্চারা পার্ট-টাইম হিফয করে থাকে। সাধারণত মসজিদভিত্তিক হিফয কোর্সগুলো পরিচালিত হয়। যেগুলোর রুটিনে প্রতিদিন দুই থেকে তিন ঘন্টা ক্লাস দিয়ে সাজানো হয়। আবার অনলাইন হিফয কোর্সগুলোও এখানে বেশ জনপ্রিয়। এই দেশগুলোতে অধিকাংশ মানুষ অমুসলিম। ফলে সরকারিভাবে হিফয করণে কোন সহায়তা না থাকায় বাচ্চারা হিফযের উপযোগী পরিবেশ পায় না। এজন্য অধিকাংশ বাচ্চার সম্পূর্ণ হিফয হয় না। যদিও বা হয় তবুও ইয়াদের ক্ষেত্রে দুর্বল থেকে যায়। বলা যায়, তারা তাদের পদ্ধতিতে সফল নয়। এটা তাদের গাফিলতী নয়, অপারগতা।

আমাদের এই উপমহাদেশে এককালে নিজস্ব হিফয পদ্ধতি ছিল। সেটা বেশ ফলদায়কও ছিল। তবে এখন বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের অনুসরণ শুরু করায় আমাদের ফলাফলের স্থানে কিছুটা ভাটা পড়েছে। বাহ্যিকভাবে দেখা যাচেছ, আমরা পূর্বের তুলনায় অনেক বেশী হাফেয তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছি। হাফেয বেশী তৈরি হওয়ার কারণ, হিফয বিভাগ বেশী হওয়া। হাফেয বা আলেম বেশী তৈরি হওয়ার ওপরে একটি কারিকুলাম বা পদ্ধতির সফলতা নির্ভর করে না। পদ্ধতির সফলতা নির্ভর করে যোগ্যতার ওপরে। সেখানেই আমরা পিছে পড়ে গেছি। অর্থাৎ আমরা হাফেয তৈরি করছি ঠিকই কিন্তু তারা সার্টিফিকেট হাতে নিচ্ছে কুরআন ভুলে যাওয়া অবস্থায়।

আমাদের দেশের পাঁচমিশালি পদ্ধতি : আমাদের দেশের শিক্ষা উদ্যোক্তাগণ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হিফয পদ্ধতি কর্য নিয়েছেন। তবে সফলতা তেমন কিছুই আসেনি। ইউরোপিও দেশগুলোতে যেমন অনলাইন হিফয কোর্স প্রচলিত আছে, তেমনই আমাদের দেশেও প্রচলিত রয়েছে অনেক অনলাইন হিফয কোর্স। তবে সেখানে হিফয করে হাফেয হচ্ছেন বা পূর্ণ কুরআন আয়ত্ব করছেন এমন মানুষের সংখ্যা ০.০১ ভাগের বেশী নয়। কারণ, সেই দেশগুলোর মানুষের মন-মানসিকতা, ইন্টারনেট ব্যবহারের ধরণ ও প্রবণতা আমাদের দেশের মানুষের মত নয়। সুতরাং ফলাফল এক না হওয়াটাই স্বাভাবিক।

আবার আরব দেশগুলোকে অনুসরণ করে আমাদের দেশেও হিফযের পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষা চালু করা হয়েছে। এতেও ছাত্রদের হিফয করতে বিলম্ব হওয়ার পাশাপাশি ইয়াদ কমে যাচ্ছে। কারণ, সাধারণ শিক্ষায় সময় দিতে গিয়ে ছাত্রদের পেছনের পড়া তিলাওয়াত কম হচ্ছে। আরব দেশগুলোর ছাত্ররা আরবী ভাষা বোঝে। যদিও কুরআনের আরবী তাদের মুখের আরবীর মত নয়। তবুও তারা কুরআন পাঠের সময় অধিকাংশ অর্থগুলো ধারণা করতে সক্ষম হয়। এজন্য তাদের তিলাওয়াতের প্রয়োজন কম হয়। 

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আরবের কোন বাচ্চাকে রাতে ঘুমানোর সময় মূসা (আঃ)-এর কাহিনী শোনানো হ’লে এরপর সে যখন সূরা ত্ব-হা মুখস্থ করে তখন তার কয়েকবার পাঠের মাধ্যমেই সেটা মুখস্থ হয়ে যায়। এটাকে ইয়াদ রাখার জন্য তার ততটা তিলাওয়াতের প্রয়োজন হয় না, যতটা আমাদের দেশের হাফেযদের দরকার হয়। কারণ, আমাদের দেশের হাফেযরা একটা শব্দের অর্থও বোঝে না। তাদেরকে সম্পূর্ণ বিদেশী শব্দগুলো মুখস্থ করতে হয়। এটা মন্ত্র মুখস্থ করার মত সকাল-বিকাল পড়ে মস্তিষ্কে গেঁথে নিতে হয়। কিছুটা শব্দ মুখস্থ করবে, কিছুটা অর্থের দিকে খেয়াল করে বলবে এমনটা হয় না।

আমাদের দেশের হিফয প্রতিষ্ঠানগুলোর যাত্রা শুরু হয়েছিল আবাসিক সিস্টেমে। ছাত্ররা মাদ্রাসায় ২৪ ঘন্টা অবস্থান করেই পড়াশোনা করত। এই আবাসিক সিস্টেম বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে তেমন প্রচলিত নয়। সেজন্য আমরাও আমাদের হিফয বিভাগগুলোকে অনাবাসিক করেছি। অনাবাসিক করায় আমাদের ছাত্র হয়ত কিছুটা বেড়েছে। তবে আমরা সফল হইনি। আমাদের নিয়মপ্রণেতাগণ কেন বোঝেন না, সব নিয়ম সব স্থানে সমান ফলদায়ক হয় না। আরবের বাচ্চারা অনাবাসিক হয়ে, হিফযের পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষা লাভ করে দুই থেকে চার বছরে হাফেয হচেছ এবং তাদের কুরআনও ইয়াদ থাকছে। অথচ আমাদের দেশে আবাসিকের তুলনায় অনাবাসিক বাচ্চারা হিফযে বেশী সময় নিচ্ছে। ইয়াদে দুর্বল হচ্ছে।

এই সবগুলো বিষয়ে দৃষ্টিপাত করে হয়ত বোঝা যাচ্ছে, বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের অনুসরণ নয় বরং আমাদের দরকার নিজস্ব পদ্ধতি। যা আমাদের মাটি ও মানুষের অনুকূলে হবে। যে পদ্ধতি আমাদেরকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিবে। এ সম্পর্কিত কিছু প্রস্তাবনা নিম্নে তুলে ধরা হলো, যা আমাদের হিফয বিভাগকে আরো সুন্দর ও ফলদায়ক করবে ইনশাআল্লাহ।

নিয়তের পরিশুদ্ধতা :

হিফয শুরু করার পূর্বেই ছাত্রদেরকে নিয়তের তা‘লীম দিতে হবে। আমরা হিফয করছি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। কুরআনের মাধ্যমে রিযিক অন্বেষণের জন্য নয়। আন্তর্জাতিক হিফয প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার জন্য নয়। ভবিষ্যতে একটি হিফয বিভাগ খুলে ব্যবসা করার জন্য নয়। তাদেরকে শেখাতে হবে, যদি আযান শোনার জন্য জানালা খোলা হয় তবে জানালা দিয়ে আলো বাতাস আসবে না, এমন নয়। আবার আলো বাতাসের জন্য জানালা খুললে আযানের শব্দ আসবে না, এমনও নয়। তবে আল্লাহ সেটাই গ্রহণ করবেন যা তুমি অন্তরে লালন কর। আযান শোনার জন্য জানালা খুললে ছওয়াব হবে। আলো বাতাসের জন্য খুললে ছওয়াব হবে না। হাফেয ছাহেব যখনই ছাত্রদের নিয়ে আলোচনা করবেন তখনই নিয়তের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিবেন। তাহ’লেই তারা ধিরে ধিরে বিষয়টি অন্তরে গেঁথে নিবে ইনশাআল্লাহ।

আক্বীদার পাঠ : শৈশবকালকে হিফয করার জন্য উত্তম সময় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সেটা সাধারণত ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সের ভেতরে হয়ে থাকে। আবার এই সময়টাতে একজন মানুষের দুনিয়ার সকল বিষয়ের সাথে পরিচিতি ঘটে। বলা যায়, এই বয়সেই আল্লাহ, রাসূল ও ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক ধারণা অন্তরে বদ্ধমূল হয়। এই সময়ে যদি আমরা আমাদের সন্তানদের সঠিক আক্বীদার শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হই, তবে তারা সারা জীবন নিজেদের আক্বীদা ও বিশ্বাস নিয়ে দ্বিধায় থাকবে। আমরা দেখেছি, প্রথম যে আক্বীদার বীজ মানুষের মনে বপণ করা হয় সেটা কখনো দূর হয় না। এজন্যই লোকমুখে প্রচলিত আছে, ‘এক গাছের ছাল আরেক গাছে জোড়া লাগে না’। আরবীতে একটি প্রবাদ আছে, ‘প্রত্যেক জিনিস তার মূলের দিকে ফেরত যায়’। এজন্য আমরা মনে করি, আক্বীদার শিক্ষাই হবে প্রাথমিক শিক্ষা।

পার্ট-টাইম হিফয : আমাদের দেশে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি পার্ট-টাইম হিফয করানোর প্রচলন শুরু হয়েছে। এটা নিসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে। তবে আমাদের পার্ট-টাইম হিফয মানেই শুধু সবক শুনিয়ে হাফেয হওয়া। যা নিন্দনীয়। এভাবে হাফেয হওয়ার পরে যদি কারো কুরআন ইয়াদ থাকে তবে সেটা আল্লাহর বিশেষ রহমত। কারণ, যেখানে সবগুলো নিয়ম মেনেই হিফয ধরে রাখা যায় না, সেখানে শুধু সবক শুনিয়ে কিভাবে কুরআন ইয়াদ থাকে!

পার্ট-টাইম উদ্যোক্তাদের বলতে চাই, কুরআন হিফয করা কোন আবেগী বিষয় নয়। কুরআন হিফয করার পরে ভুলে যাওয়ার শাস্তি রয়েছে। আপনি একজন কুরআন প্রেমীকে কেন এই ধরণের শাস্তির উপযুক্ত করছেন! যদি পার্ট-টাইম হিফয বিভাগ চালু করতেই হয় তবে সেই হিফয বিভাগের ফোকাস থাকতে হবে পেছনের পড়ার ওপরে। সামনের পড়ায় নয়। যেমন, একজন ছাত্রের ৫ পারা হিফয হয়েছে। সে মুখস্থকৃত ৫ পারা একসাথে না শোনান পর্যন্ত ৬ নং পারায় সবক শোনাতে পারবে না। যদি এভাবে পার্ট-টাইম হিফয সম্ভব হয় তবে চলুক। অন্যথায় এই সিস্টেম বন্ধ হওয়া আবশ্যক।

অনলাইন হিফয কোর্স : অনলাইন হিফয কোর্সের বিষয়টিও একই। সারাদিনে হয়ত শুধু আধা ঘন্টা বা এক ঘন্টা ওস্তাযের সাথে অনলাইন মিট হয়। যে সময়টাতে সামনের সবক শোনানো হয়। সেখানেও পেছনের পড়া শুনানো বা তিলাওয়াতের তেমন গুরুত্ব আছে বলে আমাদের মনে হয় না। এভাবে আসলে হাফেয হওয়া যায় না। হ্যঁা, সবক শেষ করা যায়। তবে সবক শেষ করা আর হাফেয হওয়া কখনোই এক বিষয় নয়। যারা অনলাইন হিফয কোর্স পরিচালনা করেন তাদেরকেও আমরা একই আহবান করব। আপনারা পেছনের পড়ার ওপর ফোকাস করুন। পেছনের পড়া যদি ইয়াদ না থাকে তবে সামনের পড়া মুখস্থের অনুমতি দিবেন না। দিন শেষে শুধু কিছু উপার্জন করা মুখ্য হওয়া উচিত নয়।

গ্রামের হিফয মাদ্রাসাগুলোর কালেকশন প্রথা : শহরের হিফয মাদ্রাসাগুলো যেমন অতি আধুনিক হ’তে গিয়ে নিজেদের মান ক্ষুণ্ণ করেছে তেমনি গ্রামের হিফয মাদ্রাসাগুলো নিজেদের চিন্তার সংকীর্ণতার কারণে আজও পিছনে পড়ে আছে। গ্রামের হিফয মাদ্রাসাগুলো ১২ মাসে ৫ মাস শুধু আদায়ের ওপরেই থাকে। ধানের সময় ধান আদায়। আলুর সময় আলু, পেঁয়াজের সময় পেঁয়াজ আদায়। রামাযানে ফিতরা আদায়। কুরবানীতে চামড়া আদায়। এছাড়াও বার্ষিক মাহফিলে তো সাধারণ আদায় আছেই।

দেখুন! আদায়ের প্রয়োজন আছে। রাসূল (ছাঃ) বিভিন্ন যুদ্ধের পূর্বে মসজিদে চাদর বিছিয়ে বলেছেন, যার যা সামর্থ্য আছে দাও। এই চাদর বিছানো পদ্ধতি ছিল দেড় হাযার বছর আগের পদ্ধতি। আজকের যুগে সবকিছু আধুনিক হয়েছে। সবকিছুতেই যদি আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে তবে আদায়ের পদ্ধতি আধুনিক করলে দোষ কোথায়! আমরা আপনাদের আদায় বন্ধ করতে বলব না। তবে আমরা কিছু প্রস্তাবনা দেব। আশা করব, এটার মাধ্যমে আদায়ের যে ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে সেখান থেকে প্রজন্ম রক্ষা পাবে।

প্রথমেই আমাদেরকে ছাত্র ও শিক্ষকদের আদায় থেকে দূরে সরাতে হবে। কারণ, ছাত্রদের কাজ পড়াশোনা করা। শিক্ষকের কাজ পড়ানো। আদায় করা তাদের আত্মসম্মানের সাথে মিলে না। আদায় করবে মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি। এটাই আধুনিকতা। এটাই সময়ের দাবী। কারণ, তারা যখন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন তখন একটি ফান্ডকে সামনে রেখেই প্রতিষ্ঠা করেছেন। হোক সেটা মাদ্রাসার নিজস্ব ফসলী জমি বা ছাত্রদের বেতন অথবা ভিন্নকিছু। প্রতিমাসে মাদ্রাসা পরিচালনায় যে পরিমাণ অর্থ ঘাটতি থাকবে ততটুকুই কালেকশন করতে হবে। এর বেশি নয়। এভাবে দেখলে কালেকশনের প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই কমে আসবে।

গ্রামের হিফয মাদ্রাসাগুলোতে এখনো জায়গীর প্রথা চলমান রয়েছে। ছাত্ররা শুধু মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে এবং ঘুমায়। খাবার আসে জায়গীরের বাড়ি থেকে। এই ধরণের মাদ্রাসায় দেখা যায় এক থেকে দুইজন শিক্ষক থাকেন। যাদের বেতন দশ থেকে বার হাযার টাকা। এই মাদ্রাসাগুলো পরিচালনা করতে মাসে বিশ থেকে ত্রিশ হাযারের বেশী খরচ হয় না। তারপরও এই শিক্ষককে ছাত্রদের নিয়ে মৌসুমী কালেকশনে যেতে হয়। কতটা আফসোসের বিষয়! আমরা বুঝি না, ত্রিশ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি তৈরি হয়েছে কি সকাল-বিকাল হাফেয ছাহেবের কাছে সালাম নেয়ার জন্য! যদি এই ন্যূনতম খরচে মাদ্রাসা পরিচালনা করা কোন এলাকার মানুষের পক্ষে সম্ভব না হয় তবে সেখানে মাদ্রাসা রাখার কোন প্রয়োজন নেই। ছাত্ররা দ্বীন শেখার জন্য ভিন্ন এলাকায় যাবে। তবুও মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্ররা মৌসুমী কালেকশন করবে এটা মেনে নেয়া যায় না।

আমরা আপনাদের কাছে আবেদন করি, যে মাদ্রাসায় বোডিং ব্যবস্থা নেই তারা মৌসুমী কালেকশন প্রথা বন্ধ করুন। আদায় করে করে অনেক বড় মাদ্রাসা বানানোর দায়িত্ব আপনাকে দেয়া হয়নি। তবে আপনার মাদ্রাসার ছাত্রদের মন-মানসিকতা আপনাদের কাছে আমানত। এই আমানত নষ্ট করবেন না। ছাত্রদেরকে হাত পাতা শেখাবেন না। তাদেরকে অমুখাপেক্ষী হ’তে শেখান।

হিফয বিভাগের প্রস্তাবিত নিয়ম : একজন হিফযের ছাত্রকে ফজরের পূর্বেই সবক শোনাতে হবে। ফজরের পরে শুনালে যে বারাকাহ কমে যাবে এমন নয়। তবে সারাদিনে আর যে সকল কাজ রয়েছে সেগুলো সম্পন্ন করা কঠিন হবে। ফজরের পর থেকে নাশতার আগ পর্যন্ত সাত সবক শোনাবে। নাশতা যদি সকাল আটটার ভেতরে সম্ভব হয় তবে আটটা থেকে নয়টা পর্যন্ত আনুসাঙ্গিক শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। যেটার আলোচনা পরবর্তীতে আসবে।

যদি ভোর চারটা থেকে সবক শুনানো শুরু হয়ে থাকে তবে ফজরের ছালাত ও নাশতার সময় ছাড়া তার ৫ ঘন্টা ক্লাস হয়ে গেছে। এখন তার ঘুমের প্রয়োজন। নয়টা থেকে ১১-টা পর্যন্ত ঘুমাবে। এর পরে আধা ঘন্টায় গোসল সেরে সাড়ে এগারটা নাগাদ আমুখতা শুনানো শুরু করবে। আমুখতা শোনানোর সময় থাকবে ঠিক আছর পর্যন্ত। মাঝে যোহর ছালাত ও দুপুরের খাবারের বিরতী থাকবে। বুদ্ধিমান ছাত্ররা যোহরের আগেই আমুখতা শুনিয়ে যোহরের পর থেকে আছর পর্যন্ত পেছনের পড়াগুলো তিলাওয়াত করবে।

আছরের পরে কোন ক্লাস থাকবে না। মাগরিব পর্যন্ত ছাত্রদের ব্যক্তিগত সময়। মাগরিবের পর থেকে তিন ঘন্টা ক্লাস হবে। দুই ঘন্টা সবক মুখস্থের জন্য। এক ঘন্টা সাত সবক ইয়াদের জন্য। এশার ছালাতের পূর্বে যদি তিন ঘন্টা হয়ে যায় তবে এশার পরে কোন ক্লাসের প্রয়োজন নেই। আর এশার ছালাত আগে হ’লে এশার পরেও ক্লাসের দরকার আছে। এই রুটিন প্রায় ১০ ঘন্টা ক্লাস টাইম দিয়ে সাজানো। এটাই আদর্শ হিফয বিভাগের রুটিন হ’তে পারে বলে আমরা মনে করি।

আবাসিকের গুরুত্ব ও প্রস্তাবিত পরিবেশ : হিফযের শিক্ষার্থীদের আবাসিকে অবস্থান বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। কারণ, আবাসিকে অবস্থান ব্যতীত প্রস্তাবিত রুটিন ফলো করা আদৌ সম্ভব নয়। অনাবাসিক শিক্ষার্থী এশার পরে ও ফজরের আগে ক্লাস করতে পারবে না। যা তার জন্য পিছিয়ে পড়ার বড় কারণ হবে। সাথে সাথে মাগরিব পরে মুখস্থ করা সবক মাথায় নিয়ে সে যখন বাসায় যাবে তখন বাসায় বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক কথা তার কানে আসবে। ফলে সে সেটাই ভাববে। মুখস্থ করা পড়াগুলো ভুলে যাবে। ফজরের পরে ভালভাবে সবক শোনাতে পারবে না।

এছাড়াও বাসায় অবস্থান করার অনেক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। যেমন, বাসায় থাকার কারণে শয়তান তাকে খুব সহজেই ধোঁকা দিতে পারে। ক্লাসে অনুপস্থিত হওয়া তার জন্য সহজ হয়। বাড়ির বিভিন্ন ছোট-খাট ইভেন্টগুলো এড়িয়ে যাওয়া তার পক্ষে কঠিন হয়। মোবাইল, টিভি, বন্ধু-বান্ধব তার কাছে সহজলভ্য হয়। এগুলো একজন হিফযের ছাত্রের জন্য ঠিক কতটা ক্ষতিকর সেটা আমরা বুঝি। সুতরাং ছাত্র আবাসিকেই অবস্থান করবে। খাবারের যদি কোন সমস্যা হয় তবে প্রয়োজনে প্রতিবেলা বাড়ি থেকে খাবার দিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সে বাড়িতে যাবে না।

আনুসঙ্গিক শিক্ষা প্রস্তাবনা : আনুসাঙ্গিক শিক্ষায় আক্বীদার পাঠ রাখা অপরিহার্য। এর পরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার ভাষা শিক্ষা ও হাতের লেখাতে। আমি একটি খারাপ অভিজ্ঞতা শেয়ার করি, যারা শুধু হিফয শেষ করে আর কোন পড়ালেখা করেননি এমন অনেক হাফেয ছাহেবকে আমরা দেখেছি, যারা ঠিকমত বাংলা লিখতে পারেন না। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, আনুসাঙ্গিক পাঠ যেন কোনভাবেই সকাল আটটা থেকে নয়টার বাইরে বের না হয়। তাদের যা লেখানো হবে, পড়ানো হবে তা সেই সময়ের মধ্যেই হবে। এর বাইরে তাদের কোন বাড়ির কাজ থাকবে না।

পাঠ্য বই হিসাবে বাংলা ভাষায় লেখা প্রাথমিক আক্বীদার কিতাব, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় মাসায়েলের কিতাব যেখানে ছালাত, ছিয়াম, পবিত্রতা ইত্যাদি বিষয়ে মৌলিক ধারণা থাকবে, প্রাথমিক গণিতের বই, ইংরেজী শিক্ষার বই অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। যেন হিফযের পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজী দেখে পড়ার যোগ্যতা তৈরি হয়। আক্বীদা ও বিভিন্ন ইবাদত সম্পর্কে মৌলিক মাসআলাগুলো জানা থাকে। পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজী লেখায় যেন কোন সমস্যা না থাকে। এতটুকুই উদ্দেশ্য। বাচ্চাকে হিফয পড়ার পাশাপাশি ফাইভ পাশ করতে হবে বা এইট পাশ করতে হবে এই ধরণের চাপ যেন না থাকে।

সাপ্তাহিক শবিনার গুরুত্ব : প্রচলিত ধারায় বৃহস্পতিবার মানেই ছাত্রদের ঈদের দিন। এই দিন কোন পড়াশোনা নেই। যাদের আশেপাশে বাড়ি তারা বাড়িতে চলে যাচ্ছে। আর যারা মাদ্রাসায় অবস্থান করছে তারা পিকনিকের আয়োজন করছে। এটা কোন আদর্শ নিয়ম হ’তে পারে না। বৃহস্পতিবারে বাধ্যতামূলক সবাইকে শবিনাতে অংশগ্রহণ করতে হবে। যাদের ৫ পারার নিচে হিফয হয়েছে তাদের পেছনের পূর্ণ পড়া শবিনা করতে হবে। যাদের ১০ পারা বা তার ওপরে হয়েছে তারা প্রতি সপ্তাহে ধারাবাহিক ৫ পারা শবিনা করবে। যাদের ২০ পারা হয়ে গেছে তাদের শবিনা ন্যূনতম ১০ পারা হ’তে হবে।

শবিনার জন্য আলাদা খাতা থাকতে হবে। কত পারা শবিনা হ’ল, কোন পারায় কতটি ভুল হ’ল সেটা লেখা থাকতে হবে। শনিবার রিপোর্ট নেয়া হবে। শবিনার পারাগুলো থেকে পরীক্ষা নেয়া হবে। খারাপ পারফমেন্সে ইয়াদের জন্য তাগীদ দিতে হবে। কেউ ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করলে তাকে লঘু শাস্তি দিতে হবে। এই শবিনা হ’ল পেছনের পারাগুলো আয়ত্বে রাখার একমাত্র মাধ্যম। সুতরাং শবিনায় কোন গড়িমসি চলবে না।

তিলাওয়াতের গুরুত্ব : আমার উস্তায বলতেন, ‘দশ পারা করে তিলাওয়াত করা তোমার প্রতিদিনের দায়িত্ব। সামনের পড়া শুনাতে পারো বা না পারো দশ পারা তিলাওয়াত যেন প্রতিদিন আদায় হয়ে যায়। এ বিষয়টি খেয়াল রাখবে’। তিনি তিলাওয়াতের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে একটি উদাহরণ দিতেন। বলতেন, মনে কর, ঘাসে ভরা একটি মাঠ। এই মাঠের মাঝ দিয়ে তুমি প্রতিদিন একবার যাতায়াত কর। কিছুদিন পরে দেখবে, তুমি যেদিক দিয়ে যাও সেখানে ঘাস নেই। পায়ে চলা রাস্তা তৈরি হয়ে গেছে। ঠিক তিলাওয়াত এমনই। যদি তুমি নিয়মিত তিলাওয়াত কর তবে তোমার ভুলে যাওয়া পারাগুলো কখন ইয়াদ হয়ে যাবে তুমি বুঝতেও পারবে না।

আরেকজন মুরুববী হাফেয ছাহেব বলতেন, হাফেয নয় এমন কোন ব্যক্তি যদি প্রতিদিন ১৫ পারা তিলাওয়াত করতে পারে তবে সে তিন বছরের মাঝে হাফেয হয়ে যাবে এবং তার কুরআনের ইয়াদ হবে ঈর্ষনীয়। সেখানে তোমরা তো হাফেয। তোমরা প্রতিদিন রিপোর্টে লিখছো ১০ পারা তিলাওয়াত হয়েছে। কিন্তু সারা বছরে তোমাদের কুরআন ইয়াদ হচ্ছে না। এটা কেমন কথা! কেউ যদি কুরআনের প্রতিটি সূরা সমানভাবে ইয়াদ করতে চায় তবে তাকে টানা এক বছর নিয়মিত ১০ পারা করে তিলাওয়াত করতে হবে। সেটা দেখে হোক বা না দেখে।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, প্রতিদিন ১০ পারা তিলাওয়াতের সময় কোথায়! আমি বলব, এটা অসম্ভব কিছুই নয়। আমি নিজেও এটা করেছি। ১০ পারা তিলাওয়াতে সময় লাগে মাত্র সাড়ে তিন ঘন্টা। আযানের সাথে সাথে যদি আমরা মসজিদে যেতে পারি তবে ছালাতের আগে ও পরে মিলিয়ে ২০ মিনিট সময় খুব সহজেই পাওয়া যায়। আমাদের শুধু ছোট কুরআন সাথে রাখতে হবে। ছালাতের সময়গুলোতেই ৫ পারা তিলাওয়াত হয়ে যাবে। বাকি ৫ পারা ক্লাসে বসে করা খুবই সহজ।

কেউ যদি নিয়মিত ১০ পারা তিলাওয়াত শুরু করে তবে কিছুদিন পরেই সে মুখস্থ তিলাওয়াত করতে পারবে। আর মুখস্থ তিলাওয়াতের সামর্থ্য হওয়ার সাথে সাথেই তার জন্য প্রতিদিন ১৫ পারা তিলাওয়াত করা সহজ হয়ে যাবে। কারণ, তখন সে চলতে ফিরতে, ঘুমানোর আগে শুয়ে শুয়ে কয়েক পারা তিলাওয়াত করে নিতে পারবে। আমি অসম্ভব কোন রূপকথা শোনাচ্ছি না। আমরা প্রতিদিন ১৫ পারা তিলাওয়াত করতে দেখেছি এবং নিজেরাও করেছি। ফলাফলে শুনানী শেষে অনেকের পক্ষেই এক বৈঠকে পূর্ণ কুরআন শোনানো সম্ভব হয়েছে।

শুনানীর গুরুত্ব : আরবীতে একটি প্রবাদ আছে, ‘মানুষের অভ্যাসই হ’ল ভুলে যাওয়া’। কুরআন হিফযের বিষয়ে কথাটা আরেকটু কঠিন। অর্থাৎ কুরআন মুখস্থ থাকাটাই একটা আশ্চর্য বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে শুনানী দিয়ে, তিলাওয়াত করেও কুরআনের হিফয অটুট রাখা সম্ভব হয় না। আমি যে বছর হিফয শেষ করলাম সে বছরই কিতাব শাখায় ভর্তি হয়েছিলাম। শুনানী দেয়া হয়েছিল না। এদিকে আমার আববু বিভিন্ন হাফেয ছাহেবের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন, শুনানী দিতেই হবে। শুনানী দেয়ার নিমিত্তে মাদ্রাসা পরিবর্তন করলাম। যেখানে ভর্তি হ’লাম সেখানে হাফেয ছাহেব বিভিন্ন পারা থেকে প্রশ্ন করার পরে বললেন, ইয়াদ তেমন কিছুই নেই। আবার সবক পড়তে হবে। এই কথা শুনে পড়ালেখার শেষ আগ্রহটুকু হারিয়ে ফেললাম। বাড়িতে জানালাম, আর হিফয পড়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে বাড়ি থেকে স্পষ্টভাবে বলা হ’ল, এখানে আমার কোন ইচ্ছা চলবে না। শিক্ষক বলেছেন, আবার সবক পড়তে হবে। এর মানে সবক পড়তে হবে। বিন্দুমাত্র ইচ্ছা এবং আগ্রহ ছাড়াই আমি আবার হিফয শুরু করলাম। প্রথম খতম শুনালাম ৫ পৃষ্ঠা করে। কোন কোন পারায় সেটাও সম্ভব হয়নি। এই খতম চলাকালীন সবকের সাথে সাত সবক আমুখতা সবকিছুই শুনাতে লাগলাম। এভাবে আমাকে দুইবার হাফেয হ’তে হয়েছে।

শুনানী ছাড়া আমাদের যে ছাত্রগুলো কিতাব বিভাগে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে তাদের অবস্থা ঠিক এমনই। তাদের যদি শুনানী দিতে বলা হয় তবে আবার সবক পড়তে হবে। এছাড়া উপায় নেই। এই মহামারী থেকে নিজেদের রক্ষা করতে ও শুনানীকে বাধ্যতামূলক করতে আমরা একটা পদক্ষেপ নিতে পারি। সেটা হ’ল, হিফয শাখা ও শুনানী শাখাকে আলাদা করা। যেমনভাবে অধিকাংশ মাদ্রাসায় আমরা নাযেরা বিভাগ ও হিফযকে আলাদা করেছি। তেমনিভাবে আমরা হিফয ও শুনানী বিভাগ আলাদা করতে পারি। যখন একজন ছাত্রের হিফয শেষ হবে তখনই সে শুনানী বিভাগে চলে যাবে। শুনানী বিভাগ চলবে তার নিজস্ব নিয়মে। সে হিফয বিভাগকে ফলো করবে না। সেখানে ছাত্রদের ইয়াদ বাড়ানোর যত পদক্ষেপ সবই গ্রহণ করা হবে। আর হিফযের যে সার্টিফিকেট দেয়া হয় সেটা শুনানী বিভাগ থেকেই দেয়া হবে। অর্থাৎ শুনানী শেষ না হ’লে কেউ হিফযের সনদ পাবে না। যদি এমন নিয়মে আসা যায় তবে আমরা কুরআন ভুলে যাওয়া থেকে অনেকটাই রক্ষা পাবো ইনশাআল্লাহ।

শিক্ষার্থীরা শুনানী দিতে চায় না কেন : আমরা খেয়াল করেছি, অধিকাংশ হাফেয হিফযের পরে শুনানীতে অনাগ্রহী হয়। তারা চায়, দ্রুত সবক শেষ করে ভিন্ন পড়ায় মনোনিবেশ করতে। অনেকেই এর কারণ ইতিবাচকভাবে ব্যখ্যা করতে পারে। বলতে পারে, তাদের অনেকগুলো বছর হিফয বিভাগে শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা পরের ধাপে খুব দ্রুত আসতে চায়। তবে আমি মনে করি, এই ধারণা সঠিক নয়।

মূলত তারা কুরআনের প্রতিটি পারা ভুলে গেছে। যা ইয়াদ করতে এখন তার সবক মুখস্থ করার মতই কষ্ট হবে। এজন্যই সে শুনানীতে আগ্রহী নয়। আপনিও বিষয়টি খতিয়ে দেখলে এটাই পাবেন। আর কুরআন ভুলে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে নিয়মিত তিলাওয়াত না করা। হয়ত সে এমন প্রতিষ্ঠানে হিফয করেছে যেখানে তাকে তিলাওয়াতের গুরুত্বই বোঝানো হয়নি। তবে কুরআন ভুলে যাওয়ার কারণ যেটাই হোক, কুরআনকে আবারো ইয়াদ করাই হবে ভুলের ক্ষতিপূরণ। আর কুরআন ভুলে যাওয়ার পরে শুনানী না দিয়ে কুরআনকে চিরতরে বিদায় জানানো হবে ভুলের ওপর সিলমোহর যুক্ত করা।

হিফয করলে কি সময় নষ্ট হয়? : অনেকেই বলেন, ছেলে হিফয করেছে। ওদিকে চার বছর সময় নষ্ট হয়েছে। দেখুন! হিফযের মাধ্যমে যদি সময় নষ্ট হয় তবে এই দুনিয়ায় সময়ের সৎ ব্যবহার করার আর কোন পথ বাকি থাকে না। বরং হিফযে যে সময়টি অতিবাহিত হয়েছে সেটাই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলোর মাঝে অন্তর্ভূক্ত। এমন চিন্তাধারা যদি কোন অভিভাবকের না থাকে তবে তিনি আর যাই হোন, হাফেযের পিতা হওয়ার উপযুক্ত নন। আল্লাহ তাআলা হাশরের ময়দানে হাফেযের পিতা-মাতাকে যে নূরের তাজ পরাবেন সেটা তো আর এমনিই নয়।

একজন মানুষ জীবনের শ্রেষ্ঠতম ইবাদতমন্ডিত সময় অতিবাহিত করে হিফয বিভাগে। হাদীছের ভাষায় তখন সে থাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষদের মাঝে গণ্য। এই অনুভূতি অন্তরে সদা সজাগ থাকতে হবে। আর হিফয করার মাধ্যমে মুখস্থ শক্তি যে পরিমাণ শাণিত হয় তার ফলাফল একজন হাফেয সারাজীবন ভোগ করে। এটা দুনিয়াবী লাভ। অন্যান্য আর দশজন ছাত্রের তুলনায় হাফেয ছাত্ররা কম সময়ে সবকিছু মুখস্থ করতে পারে। যা তাকে জীবনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। 

হিফয বিভাগের তদারকী কারা করবেন? : হাফেযদের ভাল-মন্দের বিষয়টি বোঝার জন্য হাফেয হওয়াটা যরূরী বলেই আমরা মনে করি। আমরা অনেক বড় মাদ্রাসা দেখেছি। বিশেষত যেখানে অনেকগুলি মৌলিক বিভাগের সাথে হিফয শাখাও থাকে। এই মাদ্রাসাগুলোতে হিফয বিভাগের নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করে থাকেন যারা নিজেরা হাফেয নন। আবার একক হিফয মাদ্রাসাগুলোতে কমিটির জেনারেল শিক্ষিত বা অশিক্ষিত ব্যাক্তিবর্গ এসে হাফেয ছাহেবের ওপর নাক গলান। এটাও সঠিক নয়। এর ফলে অনেক এমন নিয়ম তৈরি হয়, যা হিফযের জন্য উপযোগী নয়।

আমরা মনে করি, হিফয বিভাগের দেখভালের দায়িত্ব হাফেয ছাহেবদেরই দেয়া ভাল। তারা কমিটির সাথে পরামর্শ করবেন। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন কমিটির দায়িত্বশীলগণ। তারা যদি নিজেদের স্থানে আমানতদার হোন তবে লেখাপড়ার মান তারাই নিশ্চিত করতে সক্ষম হবেন বলে আশা করা যায়। যদি হিফয বিভাগের শিক্ষকগণ পড়াশোনার মান সম্পর্কে না বোঝেন তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা সবাই এগিয়ে আসলে একটি ফলপ্রসূ হিফয বিভাগ চালু করা সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ। 

শেষ কথা : আমাদের কথাগুলো শেষ হয়নি। এটা হয়ত আপনারাও বুঝতে পারছেন। মন চায় আরো বিস্তারিত বলতে। প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে বলতে। তবে সংক্ষিপ্ত পরিসরে সব বলা সম্ভব হয় না। তারপরও যতটুকু বলেছি তার সবটাই মস্তিষ্ক প্রসূত। এখানে ভুল থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। অবাঞ্ছনীয় কথাও চলে আসতে পারে। ভুলগুলো পরিমার্জন করে নিবেন। তবে প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন। হিফয বিভাগগুলো থেকে শতভাগ ইয়াদসহ হাফেযরা আমাদের সামনে আসবে আমরা এটাই কামনা করি। যখন আমরা তাদেরকে কুরআনের আয়াত জিজ্ঞেস করি আর তারা বলতে পারে না, তখন আমরা খুবই কষ্ট পাই। বড় আশাহত হই।

সারওয়ার মিছবাহ

 শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।






আরও
আরও
.