ভূমিকা :

সবার কাছে সফল জীবনের চিত্রটা এক রকম নয়। অধিকাংশের কাছেই একটি ভাল বাড়ি, ভাল গাড়ি, উন্নত জীবন ব্যবস্থা, দামী খাবার-দাবারের সমাহার সফল জীবন। অনেকের কাছে আবার দরিদ্র অবস্থায় শুধুমাত্র ইবাদত করে জীবন পার করে দেয়াই সফলতা। আহাল-পরিবারের হক ঠিকমত আদায় হ’ল কি-না, দুনিয়ার বুকে তার আগমনে দুনিয়াবাসী কোন উপকার পেল কি-না সেটার তোয়াক্কা খুব একটা করা হয় না। আবার অনেকের কাছে নিজের জীবন সঠিক রাস্তায় পরিচালিত করার পাশাপাশি ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের জন্য সমাজে অবদান রাখা এবং হালালভাবে যতটুকু সম্ভব সচ্ছলতার সাথে জীবন-যাপনই একটি সফল জীবন। এই বহুমাত্রিক চিন্তার ভিড়ে খেই হারিয়ে ফেলে অনেকেই। মসজিদে ঘুমিয়ে স্বপ্নে মন্দির দেখা মানুষের সংখ্যা নেহায়াত কম নয়। মন্দিরে ঘুমিয়ে মসজিদ দেখা মানুষও আছে। তবে তা অতি নগণ্য। মুসলিম হিসাবে আপনাকে মনে রাখতে হবে, পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছই একমাত্র সঠিক চিন্তাধারা ও অভ্রান্ত সত্যের একমাত্র মানদন্ড। আর সফল জীবন সেটাই যেখানে দুনিয়ার উপরে আখেরাতকে প্রাধান্য দেয়া হয়। শুধু নিজের জন্য নয়, বরং দেশ ও দশের জন্য কাজ করা হয়।

ইহকালীন সফলতা যাদের কাছে মূখ্য তাদের চোখের কালো পর্দা হয়ত আমরা কলম দিয়ে সরিয়ে দিতে পারবো না। তবে যারা সঠিক পথ খুঁজে পেতে চান তাদেরকে পথ দেখাতে পারবো ইনশাআল্লাহ। সে ধারায়, আপনিও যদি বস্ত্তবাদের এই করাল গ্রাসে গোগ্রাসিত হন তবে আজকের লেখা আপনার জন্য নয়। আজকের লেখা সেসকল তালিবুল ইলমের জন্য যারা মানুষের ইহকালীন শান্তি এবং পরকালীন মুক্তির জন্য নিরন্তর কাজ করে যেতে চায়। যারা অবদান রাখতে চায় মানবতার জন্য। যারা দুনিয়ায় পঞ্চাশ বছর পেটপূজা করে বিলিন হয়ে যেতে চায় না বরং তারা বেঁচে থাকতে চায় তাদের অমর কীর্তির মাধ্যমে যুগের পরে যুগ। আপনিও যদি এই কাফেলার একজন গর্বিত সদস্য হ’তে চান তবে আজকের লেখা আপনার জন্যই। উম্মাহর সেবায় নিবেদিতপ্রাণ কাফেলায় আপনাকে স্বাগতম।

দুর্বলতার সৃষ্টি যেভাবে :

প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার একটা নিজস্ব গতি আছে। সে নিজ গতিতেই এগিয়ে যায়। আমরা অসুস্থতায়, অমনোযোগিতায় বা অনুপস্থিতিতে সেই গতির কাছে পরাজিত হই এবং পিছিয়ে পড়ি। সেখান থেকেই তৈরি হয় আমাদের দুর্বলতা। যেকোন বিষয়ে দুর্বলতা সৃষ্টি হওয়া দোষের কিছু নয়। তবে সেটাকে কাটিয়ে না ওঠাই চরম অভিশাপের এবং ভোগান্তির।

কারণ একটি দুর্বলতা পুষে রাখলে সে একসময় হাযার দুর্বলতার জন্ম দেয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কেউ আরবীতে দুর্বল হয়েছিল প্রাথমিকে। তবে কখনো সেটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেনি। ফলাফলে পড়ালেখার শেষপ্রান্তে উপস্থিত হয়ে সে হাদীছ, তাফসীর, ফিক্বহ, উছূল সব বিষয়েই দুর্বল। সেদিন তার দুর্বলতা ছিল একটি, আজ তার মাথায় দুর্বলতার পাহাড়। তাই আজকের দুর্বলতা আজকেই কাটাতে হবে। কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলে সে সবল হয়ে আপনাকেই দুর্বল করে ফেলবে।

যে কারণে আমরা দুর্বলতা কাটানোর প্রয়োজন বোধ করি না :

মোটাদাগে দুইটি কারণের কথা বলা যায়। প্রথমত: আমরা নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে অসচেতন। আমরা জানি না যে, উম্মাহর জন্য আমাদের কিছু করণীয় আছে এবং সেই করণীয় পূরণ করতে নিখাঁদ যোগ্যতার দরকার আছে। আর শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক সিলেবাসে সীমাবদ্ধ থেকে সেই যোগ্যতা অর্জন করা কখনোই সম্ভব নয়। এজন্যই হয়ত দুর্বলতা কাটানোর প্রয়োজন অনুভূত হয় না।

দেখুন! সিলেবাস তৈরি হয় সব ধরনের মেধার দিকে লক্ষ্য করে। বিশেষভাবে লক্ষ্য করা হয় দুর্বলদের প্রতি। তাদের জন্য সিলেবাস যেন ভারি না হয়ে যায়। এখন একজন মেধাবী ছাত্রও যদি সিলেবাস শেষ করে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলে তবে সেই ঢেকুরই একদিন তার হতভাগ্যের কারণ হবে। তার মাধ্যমে জাতির যে খেদমত পাওয়ার কথা ছিল সেটা ব্যাহত হবে। তবে জাতির যোগ্য খাদেম হ’তে আরো জ্ঞানের, আরো পড়াশোনার প্রয়োজন আছে এটা আমরা অনেকেই জানি। এটাও জানি, এই জ্ঞান, এই পড়াশোনায় কিছু হবে না। তারপরও আমাদের এই জানা কোন কাজে আসে না। কারণ জাতির খাদেম হওয়ার মানসিকতাই আজ আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছে। বহুমাত্রিক সেই চিন্তার ভিড়ে কবেই আমরা হারিয়ে গেছি তা বুঝতেও পারিনি। বড়ই আফসোসের বিষয়!

দ্বিতীয় কারণ হিসাবে বলা যায়, বর্তমানের অসুস্থ শিক্ষাব্যবস্থা। পরীক্ষার ফলাফল নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় যখন ন্যূনতম পড়াশোনা করা একজন ছাত্র গোল্ডেন মার্কে পাশ করে তখনই প্রমাণিত হয়ে যায়, এই ব্যবস্থার শিক্ষা, পরীক্ষা, ফলাফল সবকিছুই নিজের ভারসাম্য হারিয়েছে। এই ব্যবস্থার অধীনে থেকে একজন ছাত্রের দুর্বলতা কাটানোর মানসিকতা তৈরি না হওয়াটাই স্বাভাবিক। সে কেন নিজের দুর্বলতা কাটাবে? যেখানে সম্মান, পদমর্যাদা কোন কিছুই যোগ্যতার ওপরে নির্ভর করে না সেখানে যোগ্যতার দামই বা কতটুকু! দুর্বলতা কাটানোর প্রয়োজন অনুভূত না হওয়ার এটাও হ’তে পারে একটি পোক্ত কারণ।

দুর্বলতা কাটানোর প্রয়োজনীয়তা :

বরাবরই আমরা দুনিয়াকে সেভাবে দেখি না যেভাবে দুনিয়াদাররা দুনিয়াকে দেখে। এজন্যই আমরা যে পরিবেশেই থাকি, যে শিক্ষাব্যবস্থার অধীনেই লেখাপড়া করি, আমাদের যোগ্যতার বাছবিচারে কোন আপোষ নেই। কারণ আমরা যদি দ্বীনের খাদেম হ’তে চাই তবে ইলম, তাদাববুর ও হিকমায় পরিপূর্ণ হওয়ার কোন বিকল্প নেই। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া ব্যতীত কোন পথ নেই। দিন যত যাচ্ছে সময় ততই কঠিন হয়ে আসছে। সেই কঠিন সময়ের মোকাবেলা করার জন্য যদি নিজেকে তৈরি করতে না পারি তবে অঘোষিতভাবেই আমি নিজের উপযুক্ততা হারাবো। উচ্ছিষ্ট হয়ে পড়ে থাকব স্রোতধারার বাইরে। এজন্য আমাকে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হ’তে হবে যে, উলূমে শরী‘আহর এমন কোন শাখা-প্রশাখা যেন বাকী না থাকে যেখানে আমার পদচারণা হয়নি। আমার পড়া কোন বইয়ের কোন পাতা যেন এমন না থাকে যেটা আমি বুঝিনি। ইলম-সাগরের সব পানি হয়ত আমি পান করতে পারবো না, তবে আকন্ঠ পান করতে পারব। আমি সেটাই করব। পৃথিবী কদর করল কি-না, প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেলাম কি-না সেটা দেখার বিষয় নয়। আমার টার্গেট একটাই, জাতিকে কিছু দিতে হবে। কিছু খেদমত করে যেতে হবে।

নদী গিয়ে কখনো পুকুরের সাথে মিলে না। নদী সাগরের দিকে ছুটে যায়। পুকুর হয়ে যদি আশায় থাকি একসময় নদী এসে আমাতে মিলবে, তবে তা দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। নদীকে নিজের দিকে টানতে হ’লে নিজেকে সাগর বানাতে হবে। এতটুকু সঞ্চয় নিজের ভেতরে রাখতে হবে যা দ্বারা নদী, খাল, বিল, পুকুর সবাই পরিতৃপ্ত হ’তে পারবে। এজন্য নিজের যত বিষয়ে যত দুর্বলতা আছে তার তালিকা তৈরি করে একে একে দূর করতে হবে। নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করতে যা করা লাগে তাই করতে হবে। পড়াশোনায় রাত অতিবাহিত করতে হবে। নিজের সর্বশক্তি ব্যয় করে যখন নিস্তেজ হয়ে যাবো তখন শেষ রাতের ছালাতে আল্লাহর কাছে নিজের অপারগতা প্রকাশ করে সাহায্য চাইতে হবে। অন্যথা দ্বীনের যোগ্য খাদেম হওয়া সম্ভব নয়। যোগ্য মানুষ হয়ে সমাজের জন্য অবদান রাখা সম্ভব নয়। 

দুর্বলতা কাটানোর কার্যকরী মাধ্যম :

প্রতিষ্ঠান ছুটি থাকলে যেহেতু একাডেমিক পড়া বন্ধ থাকে তাই ছুটিই হ’তে পারে দুর্বলতা কাটানোর একটি কার্যকরী সমাধান। প্রত্যেকটি ছুটি যদি আমরা একেকটি দুর্বলতা কাটাতে ব্যয় করি তবে দুই-চার বছরের মাঝে দেখা যাবে দুর্বলতা বলতে আর কিছুই নেই। তখন সময় আসবে স্কিল ডেভেলপ করার। আবার প্রত্যেক ছুটিতে যদি আমরা একটি বিষয়ে পারদর্শী হই তবে লেখাপড়া শেষেই আমরা নিজেদের যোগ্য হিসাবে জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারব। তবে এজন্য অবশ্যই কঠোর অধ্যবসায়ের প্রয়োজন।

ছুটির দিনগুলোতে তিনটি সময় আমাদেরকে দুর্বলতা কাটানোর জন্য ব্যয় করতে হবে। প্রথমত: একাডেমিক ক্লাসের সময়। যে সময়টিতে আমরা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ক্লাস করতাম তা পূর্ণ কাজে লাগাতে হবে। দ্বিতীয়ত: ক্লাসের পড়া এবং লেখা তৈরির সময়। সর্বশেষ দুর্বলতা কাটানোর জন্য আমার অতিরিক্ত বরাদ্দকৃত সময়। খেয়াল রাখতে হবে, দুর্বলতা যত বেশী হবে, সময়ের বরাদ্দও তত বৃদ্ধি পাবে। এভাবে যদি একটি সপ্তাহ কোন বিষয়ের পেছনে ব্যয় করা যায় তবে সপ্তাহ শেষে সেখান থেকে একটি সুন্দর ফলাফল অবশ্যই পাওয়া যাবে। এভাবে যদি প্রত্যেকটি ছুটিকে কাজে লাগানো যায় তবে বছর শেষে অনেকগুলো অর্জন নিজের ঝুলিতে জ্বলজ্বল করবে। এই অর্জনগুলি কতটা আনন্দদায়ক হয় তা কেবল সেই বুঝবে যে এই স্বাদ গ্রহণ করেছে।

শেষকথা :

দুনিয়াবী শিক্ষার উদ্দেশ্য এবং দ্বীনী শিক্ষার উদ্দেশ্য কখনোই এক নয়। দুনিয়াবী শিক্ষার উদ্দেশ্য দুনিয়া অর্জন। সেখানে হালাল-হারামের কোন পরোয়া নেই। ইবাদতের কোন বালাই নেই। জাতিকে বাঁচানো দূর কি বাত, নিজেই জাহান্নাম থেকে বাঁচার কোন পথ বাতলানো নেই। পক্ষান্তরে একজন হাদীছ পড়ুয়া তালিব যদি মনে করে, মাদ্রাসায় পড়ছি, ভবিষ্যতে একটা চাকুরি করবো, পরিবার সন্তান নিয়ে সুখে থাকব। তবে আমি বলব, তার হাদীছের কিতাবগুলো আলমারীতে তুলে রেখে কোন দুনিয়াবিমুখ আলেমের সান্নিধ্যে কিছুদিন অতিবাহিত করে চিন্তা-চেতনা সংশোধন করা অতি যরূরী। কেননা দ্বীনী শিক্ষার উদ্দেশ্যই হ’ল, দুনিয়ার উপরে আখেরাতকে প্রাধান্য দেয়া। নবীদের রেখে যাওয়া কাজের মাধ্যমে জীবন অতিবাহিত করা। কোন আলেমে দ্বীন যদি দ্বীনের জন্য ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা লালন না করেন, জাতির খেদমতের বাসনা না রাখেন তবে তিনি যত বড়ই জ্ঞানী হোন না কেন, তিনি ওয়ারাছাতুল আম্বিয়া নন।

প্রকৃত আলেম হ’তে অবশ্যই উম্মাহর খেদমতে নিবেদিত প্রাণ হ’তে হবে। দুনিয়ার বুকে অবদান রেখে যাওয়ার অদম্য স্পৃহা থাকতে হবে। সেই অদম্য ইচ্ছা এবং স্পৃহা নিয়ে যখন মাঠে নামা হবে তখনই নিজের দুর্বলতাগুলো চোখে পড়বে। সময়গুলো নষ্ট করার জন্য আফসোস হবে। তবে সে সময়ের কান্না কোন কাজে আসবে না। এজন্য সময়ের সঠিক ব্যবহার প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক ছুটিগুলো কাজে লাগানো প্রয়োজন। ছাত্র জীবনে ছুটিকে উপভোগের সময় মনে না করে যদি দুর্বলতা কাটানোর সুযোগ মনে করা হয়, তবেই আমাদের উত্তরসূরীদের জন্য নতুন ইতিহাস লেখা সম্ভব হবে। সে ইতিহাস হবে আমাদের গৌরবের ইতিহাস। ইলমের সাধনায় জীবন উৎসর্গকারী এক কাফেলার ইতিহাস। আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনের খাদেম এবং উম্মাহর একনিষ্ঠ সেবক হিসাবে কবুল করুন এবং সেজন্য যথোপযুক্ত যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনের তাওফীক দান করুন- আমীন!

সারওয়ার মিছবাহ

শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।






বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
আরও
আরও
.