বছর ঘুরে আসে বসন্ত। জানান দিয়ে যায়, পৃথিবীটা সুন্দর। তেমনই যুগের পরিক্রমায় আসে উত্থান। আসে বিপ্লব। জানান দিয়ে যায়, জাতি চিরশায়িত নয়। তাদের মাঝেও আছে যোগ্যতা। আছে শক্তি ও সামর্থ্য। তেমনই এক বিপ্লবের স্বপ্ন বুনছি হৃদয়ের গহীন কোণে। সে বিপ্লব হবে বাংলার বুকে আরবী ভাষা ও সাহিত্যের বিপ্লব। যে পথ ধরে বিপ্লব আসবে; সে পথ তৈরি হবে একদল শিক্ষা-উদ্যোক্তার নির্ঘুম রাত ও অক্লান্ত পরিশ্রম দ্বারা। তাদের উদ্দেশ্যেই আজকের উপাখ্যান। আমরা চাই, আপনিও আমাদের কাফেলার একজন গর্বিত সদস্য হৌন। আমরা অনাগত বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তেই রয়েছি। আল্লাহ চাইলে খুব শীঘ্রই এর আগমন ঘটবে। আসবে শিক্ষাধারার বসন্তকাল।
আমাদের এই জীবন কতইনা গল্পে সাজানো। একেকটা গল্পের রং একেক রকম। জীবনের বিন্দু বিন্দু নানা রঙা গল্পগুলো একসাথে জোড়া দিয়ে তৈরি হয় উপন্যাস। সফলতা এবং ব্যর্থতার দিকে লক্ষ্য করে সেই উপন্যাসের শিরোনাম লেখা হয়। আমাদের চূড়ান্ত জীবন কাহিনী সফলতার হবে নাকি ব্যর্থতার হবে সেটা নির্ভর করে আমাদের জীবন-ধারণ, চিন্তাধারা, কর্মপদ্ধতি, আমানতদারীতা ইত্যাদির ওপরে। যে অঙ্গনেই আমরা থাকি না কেন, হিসাব-নিকাশটা একই রকম। যেমন, আমরা শিক্ষক। শিক্ষকতা আর দশটা চাকুরীর মত নয়। এই পেশা সম্মানিত হয়েছে তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা মহান দায়িত্বের কারণে। সে দায়িত্ব শিক্ষিত জাতি গড়ার দায়িত্ব। এই গুরুদায়িত্ব কাঁধে না নিয়ে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে নিজেকে সম্মানিত ভাবা বোকামী। আপনি যতই প্রাতিষ্ঠানিক শৃংখলা মেনে চলেন, সময়মত ডিউটিতে যান, প্রতিষ্ঠানের কোন সম্পদ নষ্ট না করেন, অপচয় না করেন, ঠিকঠাক ক্লাসে উপস্থিত হন; তারপরও আপনি যদি ছাত্র তৈরিতে ব্যর্থ হন তবে আপনার জীবন উপন্যাসের শিরোনাম হবে ‘একজন ব্যর্থ শিক্ষকের জীবনকথা’। এটাই অপ্রিয় সত্য।
শুধু প্রতিষ্ঠানিক নিয়ম রক্ষাই আমাদের দায়িত্ব নয়, যে ছাত্রগুলো তাদের জীবনের মূল্যবান সময় আমাদের হাতে দিয়ে, আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সকাল আটটা থেকে দুপুর ১-টা পর্যন্ত বসে থাকে, আমরা দাঁড়াতে বললে দাঁড়ায়, বসতে বললে বসে, পড়তে বললে পড়ে, চুপ থাকতে বললে চুপ থাকে; তাদের জীবন গড়ে দেয়াই আমাদের দায়িত্ব! অথচ আমাদের এই বিষয়ে কোন জবাবদিহিতা নেই! ছাত্রদের জীবনের বিষয়ে আমাদের কোন আমানতদারীতা আছে বলে আমরা জানি না। যে কোন মূল্যে তাদেরকে যোগ্য করে তুলতে হবে, তারা যা শিখতে আমাদের কাছে এসেছে তাদেরকে তা শিখাতে হবে; এই ধরনের মানসিকতাই আমাদের নেই। কোন ধরনের শিক্ষক আমরা!
একজন তালিবুল ইলম যখন মাদ্রাসায় ভর্তি হয় তখন শিক্ষক তাকে বোঝান, দুনিয়ার জীবনটা ক্ষণস্থায়ী আর আখিরাতের জীবনটা চিরস্থায়ী। পড়াশোনার তাকীদ দিতে গিয়ে তাকে বড় বড় ইমাম ও আলেমের গল্প শোনানো হয়। মানসপটে এঁকে দেয়া হয় বরেণ্য আলেমদের কষ্ট করে লেখাপড়া করার চিত্র। কিভাবে তারা বড় হয়েছেন। কিভাবে তারা জাতির জন্য অবদান রেখেছেন। এই কথাগুলোর মাধ্যমেই তাকে স্বপ্ন দেখোনো হয়। এভাবেই তারা স্বপ্ন দেখতে শিখে। স্বপ্ন লালন করতে শিখে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম করতে শিখে। স্বপ্ন দেখার ধারাবাহিকতায় আমাদের শিক্ষকগণ তাদের শিক্ষকদের কাছে স্বপ্ন দেখতে শিখেছেন। আমরা শিখেছি আমাদের শিক্ষকদের কাছে। আমাদের ছাত্ররা শিখবে আমাদের কাছে। যুগ যুগ ধরেই এই ধারাবাহিকতা চলে আসছে।
তবে এখন আর ছাত্ররা বড় আলেম হওয়ার স্বপ্ন দেখে না। কেউ তাদেরকে স্বপ্ন দেখায়ও না। শিক্ষক হিসাবে এই জায়গায় আমরা ব্যর্থ। আমরা তাদেরকে ইমাম বুখারী হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে পারিনি। আলেম হওয়ার জন্য যে ইলমী পরিবেশ দরকার; সে পরিবেশও দিতে পারিনি। এদিকে কথিত কিছু সচেতন অভিভাবক আমাদের ব্যর্থতার আগুনে ঘি ঢেলেছেন। তারা সন্তানদের দুনিয়াদার হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তবে ব্যর্থতা আমাদের। কারণ ছাত্ররা বাবা মায়ের তুলনায় শিক্ষকের কথা মান্য করে বেশী। তবুও আমরা তাদের বুকে ইলমের ভালোবাসার বীজ রোপণ করতে পারিনি। জানি না এই আনুগত্যের পরিবেশ কতদিন টিকবে। আমাদের অবহেলার কারণে যেন ছাত্ররা শিক্ষকদের প্রতি আস্থাহীন হয়ে না পড়ে, সেই দো‘আই করি।
অনেক আগ্রহী ও মেধাবী ছাত্র যখন আমাদেরই দুর্বলতার জন্য নষ্ট হয়ে যায় তখন নিজের শিক্ষকতার পরিচয় লজ্জায় পরিণত হয়। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা দেখেছি, ছাত্ররা বইয়ের অনুশীলনীর বাইরে কিছুই পারে না। একজন মীযানের ছাত্র শুধু সেই ছীগাগুলোই পারে যেগুলো বইয়ের অনুশীলনীতে আছে। একজন সাহিত্যের ছাত্র শুধু ক্লাসের বইয়ের ইবারত পড়তে পারে, সমমানের কোন আরবী কিতাব খুলে সে কিছুই বুঝতে পারে না। একজন নাহুর ছাত্র শুধু সেই তারকীবগুলোই পারে যেগুলো তার বইয়ে রয়েছে। অনুরূপ নতুন কোন বাক্য গঠন করে দিলে সেটার তারকীব করতে পারে না। যদি এমনই হয় পড়াশোনার অবস্থা তবে আমাদের স্বার্থকতা কোথায়? আমরা তো অবুঝ নই। আমরা বুঝতে পারছি, আমাদের ছাত্রদেরকে কিতাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে! তারা যা কিছু পড়েছে অচিরেই তা ভুলে যাবে। কারণ তারা সবকিছুই মুখস্থ করেছে। কোন কিছুই শেখেনি। আর মুখস্থ বিদ্যা বেশীদিন স্থায়ী হয় না।
তারা তারকীব না শিখে মুখস্থ করে। তারা পরীক্ষার আগে তারকীবের খাতা আগাগোড়া হিফয করে এবং একে অপরের সাথে শোনাশুনি করে। অথচ তারকীব মুখস্থ করে পরীক্ষা দেয়া পুরা বইয়ের গণিত মুখস্থ করে পরীক্ষায় ১০০ নম্বর পাওয়ার মত। এই গণিত ভবিষ্যতে না অপরের কোন কাজে আসবে, না নিজের কোন কাজে আসবে। তাকে ভবিষ্যতে জিজ্ঞাসা করা হবে, ৩ আর ২ কত হয়? সে বলবে, পাঁচ। তবে যদি বলা হয়, ২ আর ৩ কত হয়? সে বলবে, আমি জানি না। এটা বইয়ে নেই। সে ইসম ও ফে‘লের আলামত বুলেটের গতিতে মুখস্থ বলতে পারবে। কিন্তু এক লাইন আরবী থেকে কোন ইসম বা ফে‘ল নির্ণয় করতে পারবে না। এটা কেমন পড়াশোনা? অথচ সবকিছু বুঝেও আমাদের কোনই অনুশোচনা নেই।
দেখুন! একজন কবি এবং একজন কবিতা মুখস্থ করা ছাত্রের ভেতরে বেশ পার্থক্য রয়েছে। হাযারটা কবিতা মুখস্থ করানোর চেয়ে একজন কবি তৈরি করা উত্তম। কারণ মুখস্থ কবিতার সংখ্যা লক্ষাধিক হ’লেও সেটা সীমিত। তবে কবির বুকে জমানো কবিতার সংখ্যা অসীম। আমাদেরকে সেই অসীমের পথে হাঁটতে হবে। ছাত্রদেরকে দশটা তারকীব মুখস্থ না করিয়ে একটা তারকীব শেখাতে হবে। যেন সমমানের যে কোন বাক্যের তারকীব সে করতে পারে। আমাদের সাহিত্য যেন শুধু ‘আদ-দুরুসুল আরাবিয়্যাহ’ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ না হয়। ছরফ যেন মীযানুছ ছরফ, পাঞ্জেগাঞ্জ, ইলমুছ ছীগার ভেতরে গুটিয়ে না যায়। নাহু যেন নাহবেমীর, হিদায়াতুন্নাহু, কাফিয়ার ভেতরে সীমিত হয়ে না যায়। এর বাইরেও রয়েছে ইলমের সুবিশাল দুনিয়া। বিচরণ থাকতে হবে সেই দুনিয়ায়। অথচ সেই দুনিয়ায় বিচরণ করা তো দূরের কথা, পরীক্ষার আগে বই দাগিয়ে না দিলে আমাদের ছাত্ররা পাশ করতে পারে না। কতটা সংকীর্ণতায় আমাদের বসবাস!
আমরা আজ থেকেই পরীক্ষার আগে বই দাগিয়ে দেয়ার আবহমান ধারা বন্ধ করতে চাই। আমরা বলতে চাই, পরীক্ষায় বই দাগিয়ে দেয়া ছাত্রদেরকে পংগু করে ফেলার মতই। আপনি সর্বদা পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্ন করবেন এবং সারা বছর ছাত্রদের সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য তৈরি করবেন। যদি আপনি প্রশ্ন বলে দেন তবে ছাত্র যতই মেধাবী হোক, সে আপনার বলে দেয়া প্রশ্নের সাহায্য নিবেই। কারণ সে ছাত্র। সে এখনো যোগ্যতার প্রয়োজন দুইচোখে দেখেনি। সে কখনোই পুরো বই পড়বে না। পিড়ির পরে পিড়ি প্রশ্ন বলে নিয়ে পরীক্ষায় পাস করা ছাত্রদের এটা মেনে নিতে প্রথমত কষ্ট হবে। তবে তারাই পরবর্তীতে বলবে, আমাদের সময় এটা চালু হওয়ার জন্য আজকে কিছু শিখেছি। সাবেকরা বলবে, আমাদের সময় কেন এটা চালু হয়নি?
সৃজনশীল প্রশ্ন চালু করতে অনেক বাধা পার হ’তে হবে। এটাই আরবীর বিপ্লবের প্রথম এবং সবচেয়ে কঠিন ধাপ। প্রথমেই আপনার চোখে পড়বে সিলেবাসের সমস্যা। হ্যঁা, যদি সিলেবাসে সমস্যা থাকে তবে সিলেবাস সংশোধন করতে হবে। যদি পাঠ্যপুস্তকে সমস্যা থাকে তবে সেই পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করতে হবে। ছাত্রদের যোগ্যতার বিষয়ে কোন কিছুর সাথে আপোষ চলবে না। তাদেরকে যোগ্য করে তোলার জন্য কখনো নিয়ম তৈরী করা হ’তে পারে, আবার কখনো নিয়ম ভাঙ্গা লাগতে পারে। এটা কোন বিদ্রোহীর মত কথা নয়। কারণ ইসলাম আমাদের শিখায় ‘আল-হুববু ফিল্লাহ ওয়াল বুগযু ফিল্লাহ’। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন সব কাজের উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি, তেমনই একজন শিক্ষকের শিক্ষকতায় সকল কাজের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে ছাত্র গড়ে তোলা। তবেই তিনি আদর্শ শিক্ষক হবেন বলে আমরা মনে করি।
তবে সমস্যা এখানেই শেষ নয়। আপনি যখন ধারা পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন তখন ছাত্রমহল এবং শিক্ষকমহলেরও অনেকেই আপনার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। তারা আপনার অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা এবং অপ্রাসঙ্গিক কিছু দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। সে পরিস্থিতিকে যদি আপনি মোকাবিলা করতে না পারেন তবে আপনি শিক্ষকই থেকে যাবেন। শিক্ষা-উদ্যোক্তা হ’তে পারবেন না। তবে আমরা চাই, আপনি শিক্ষা-উদ্যোক্তা হোন। আমাদের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা-উদ্যোক্তা তৈরি হোক। তা না হ’লে বিপ্লব সাধিত হবে কিভাবে? এজন্য আমরা আপনার বিবেচনার জন্য কিছু প্রস্তাবনা করার চেষ্টা করব। যদি আমাদের কথাগুলো অহেতুক মনে হয় তবে আপনার কাছে আমাদের কোনই আবেদন নেই। আর যদি সঠিক মনে হয় তবে আপনাকে অনুরোধ করব, নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হৌন।
দেখুন! মানুষ মাত্রই তার ব্যক্তিত্ব রয়েছে। প্রতিটি বিষয়ে তার নিজস্ব মূল্যবোধ রয়েছে। তার বিবেক ও বিচারশক্তি রয়েছে। তার দায়িত্ববোধ ও আমানতদারীতা রয়েছে। এগুলো কোনটিই না রেখে শুধুমাত্র শিরদাঁড়া পিঠে ধারণ করে মানুষ দাবী করা হাস্যকর। আমরা আপনাকে প্রথমেই বলতে চাই, মেরুদন্ড আবশ্যক। যোগ্য জাতি গড়তে প্রথমেই আপনাকে শিরদাঁড়া সম্পন্ন একজন মানুষ হ’তে হবে। আপনাকে অমুখাপেক্ষী হ’তে হবে। আপনি না ছাত্রদের মুখাপেক্ষী হবেন, না ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। আপনার পকেটভরা টাকা না থাকুক, হৃদয় ভরা প্রাচুর্য থাকতে হবে। শিক্ষক হিসাবে আপনি ছাত্রদের দিয়ে টুকটাক খেদমত নিবেন। এটা আপনার অধিকার। তবে নিজের কাজ নিজে করতে পারলে সেটা আপনার জন্য গর্বের বিষয়। মনে রাখবেন, ছাত্ররা সেই শিক্ষকের কাপড় পরিষ্কার করে গর্ববোধ করে যে শিক্ষক কখনো কাউকে কাপড় ধুতে দেয় না। ছাত্ররা সেই শিক্ষককে মন থেকে শ্রদ্ধা করে যাকে তারা কখনো কিছু দিতে পারেনি, বছরের পরে বছর শুধু তার কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করে গেছে। এমন শিক্ষকের চোখে চোখ পড়লেই ছাত্র নিজেকে ঋণী মনে করে। অকৃত্রিমভাবে তার ভেতরে শ্রদ্ধা জেগে ওঠে। আপনিই বলুন, একজন ছাত্রকে বছরের পরে বছর পড়িয়ে যদি নিজের কাছে ঋণীই করতে না পারেন তবে আপনি কেমন শিক্ষক?
মনে রাখবেন, শিক্ষকতায় অহংকারী হবেন না। অহংকারী শিক্ষকদের কেউ পসন্দ করে না। অহংকার মানে এমন মানসিকতা লালন করা, ‘আমি শিক্ষক হয়ে গেছি। আমি যদি এখন নাহু-ছরফের কোর্স করি তবে ছাত্ররা কি বলবে! আমি সিনিয়র শিক্ষক। আমিই যদি আরবী তারকীবের কোর্স করি তবে ছাত্ররা আমার যোগ্যতা সম্পর্কে কি ধারণা করবে! আমি শিক্ষক হয়ে আরেক শিক্ষকের কাছে পড়া বুঝিয়ে নিলে আমার দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাবে। সবার কাছে আমার অবস্থান নীচে নেমে যাবে’। এগুলো ভেবে আপনি বছরের পরে বছর নিজের ভেতরে দুর্বলতা পুষে রেখে ছাত্রদের ওপরে যুলুম করে যাচ্ছেন। দেখুন! দুর্বলতা ঢেকে রাখা যায় না। সেটা একসময় প্রকাশ পেয়েই যায়। প্রতিকূল পরিবেশে চরম লজ্জিত হওয়ার আগেই নিজেকে সমৃদ্ধ করুন। যেটা জানেন না সেটা জানুন। যেটা পারেন না সেটা শিখুন। শিক্ষা কখনো লজ্জার বিষয় নয়, সেটা যে বয়সেই হোক। যখনই নতুন কোন বিষয় শিখবেন তখনই সেটা ছাত্রদেরকে শিখাবেন। আপনার ভেতরে আল্লাহ যে দক্ষতা দান করেছেন সেই বিষয়গুলোতে সাধারণ দারসের ব্যবস্থা করুন। সেটা সম্ভব না হ’লে নির্দিষ্ট মেয়াদী কর্মশালার ব্যবস্থা করুন। যেন সবাই সেখানে বসতে পারে।
ছাত্রদেরকে বিভিন্ন বিষয় শিখানোর জন্য নতুন নতুন পদ্ধতি বের করুন। এটাই শিক্ষা-উদ্যোক্তার কাজ। আপনার দায়িত্ব হবে, পড়ালেখাকে সহজলভ্য করার উপায় বের করা। প্রাইভেট ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসা। আমাদের অনেক শিক্ষক রয়েছেন, যারা লেখাপড়াকে ব্যবসার মাধ্যম বানিয়েছেন। আমার এই লেখা তাদের কাছে চোখের বালির মত খচখচ করাটাই স্বাভাবিক। আপনাদের কাছে আমাদের অনুরোধ, নিজেদের মেধা দ্বারা জাতির উপকার করার চেষ্টা করুন।
বর্তমানে প্রাইভেট ব্যবস্থা যে কতটা অভিশাপের তা হয়ত আমার ভাষায় আপনি বুঝবেন না। এটা কেবল তারাই বুঝবে যাদের বাবা অনেক কষ্ট করে মাসের বেতন তো চালিয়ে নেয় ঠিকই কিন্তু প্রতিমাসে প্রাইভেট টিউটর রাখার জন্য আলাদা টাকার ব্যবস্থা করতে পারে না। আপনি যদি তাদের সেবা করেন, বিনিময়ে আপনি দো‘আ পাবেন। একজন তালিবুল ইলম যখন মাদ্রাসা থেকে বাড়িতে যায়, তখন বাবা-মা তাদের জিজ্ঞাসা করে, কে কেমন পড়ায়, কে কেমন শিখায়, কে কেমন যত্ন নেয়। যখন তারা কোন শিক্ষকের প্রশংসা শোনে তখন তারা দো‘আ করে। বলে, ‘আল্লাহ যেন তার ভাল করে’। অথচ সেই শিক্ষককে তারা চেনে না। আপনি কি বিশ্বাস করেন না, প্রাইভেটের কয়েকটা পয়সার চেয়ে এই দো‘আ অনেক বেশী দামী? আপনি শিক্ষক হওয়ার পরেও যদি আপনাকে দো‘আর গুরুত্ব বুঝাতে হয় তবে সেটা বড়ই দুঃখজনক।
আপনার প্রতি আমাদের নিবেদন, আপনি নিজ প্রতিষ্ঠানে মানসম্মতভাবে আরবী শিক্ষাকে চালু করুন। এজন্য আপনাকে মাদ্রাসা প্রধান হ’তে হবে না। নিজ স্থান থেকে মাদ্রাসাকে কুরআন-হাদীছের ইলমী মারকায বানানোর জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা ব্যয় করুন। দেশ-বিদেশ থেকে আপনাকে কেন্দ্র করে জ্ঞান পিপাসু তালিবুল ইলমের হিড়িক পড়বে আপনার প্রতিষ্ঠানে। হ্যঁা, সেজন্য আপনাকে আগে যোগ্য হ’তে হবে। আমি তো মনে করি, আমরা পরনিন্দা এবং অপরের দোষ খোঁজায় যে সময় অতিবাহিত করি শুধু ততটুকু সময় সুন্দরভাবে পড়াশুনায় ব্যবহার করলে অল্পদিনেই নিজের যোগ্যতা বাড়ানো সম্ভব।
সবসময় এটা মাথায় রাখবেন, প্রত্যেক বিষয়ে বিশেষজ্ঞের দাম রয়েছে। বিশেষজ্ঞ হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে কোন বিষয়কেই আপনি ছোট করে দেখতে পারবেন না। পড়াশোনার বিষয় তো আছেই, কেউ যদি ভাল মুচি হয় তবুও তার কাছে মানুষ দূর দূরান্ত থেকে জুতা সেলাই করতে আসবে। কোন রেস্তোরাঁর বাবুর্চি যদি ভাল খিচুড়ি রান্না করতে পারে তবে মানুষ সেই রেস্তোরাঁয় সকালের নাশতা করার আশা করবে। এমনকি কোন নাপিত যদি ভাল চুল কাটে তবে একবেলা সিরিয়াল দিয়ে হ’লেও সবাই তার কাছে চুল কাটতে চাইবে। প্রত্যেক সেরার কদর রয়েছে। সুতরাং স্কিল ডেভেলপের চেষ্টা করুন। এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি।
পরিশেষে আবারো আপনাকে অনুরোধ করছি, নিজের যোগ্যতা বাড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করুন। আমরা স্পষ্ট বসন্ত দেখতে পাচ্ছি। আপনি কান পেতে শুনুন! আপনার অঙ্গনে তা উপস্থিতির জানান দিচ্ছে। আপনি নিজের ফুল বাগান উজাড় করে সেই বসন্তকে রুখে দিতে পারবেন না। শিক্ষাধারায় বসন্ত আসবেই। বৃক্ষরাজি নতুন সাজে সাজবেই। সুতরাং বসন্ত উপলক্ষে নিজের ফুল বাগানকে সমৃদ্ধ করুন। সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখুন। ছাত্রদেরকে স্বপ্ন দেখান। উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার গর্বিত শিক্ষা-উদ্যোক্তা হৌন।