প্রাথমিক শিক্ষায় আক্বীদার পাঠ

ভূমিকা :

মুর্খতার দাবানলে ঝলসে যাওয়া এক সমাজে আমরা বসবাস করছি। জাতীয় পরিচয়পত্রে মুসলিম হ’লেও ঈমান ও আমলের পরিচয়ে ভীষণ জরাজীর্ণ অবস্থা আমাদের। অন্তরে নেই আল্লাহর পরিচয়, বিশ্বাস নেই পরকালের প্রতি, আস্থা নেই তাক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি। আমরা সারা জীবন রিযিকের পেছনে দৌড়ে গেলাম, আর এমন এক প্রজন্ম রেখে গেলাম যারা ভাতের জন্য যুদ্ধ করতেই দুনিয়ায় এসেছে। রিযিক নির্ধারিত হওয়ার বিষয়টি না নিজে জানলাম, না পরবর্তী প্রজন্মকে জানাতে পারলাম।

ইবাদত ভেবে সারা জীবন মাজারে সিজদাহ করে গেলাম, রেখে গেলাম মাজারপূজারী এক প্রজন্মকে। যারা আমার মৃত্যুর পরে আমার নামে মাজারে শিরনি দেবে। নিজেও শিরক-বিদ‘আত চিনলাম না, পরবর্তী প্রজন্মকেও চিনাতে পারলাম না। আফসোস! ইবাদত ঠিকই করে গেলাম। তবে তাওহীদের সাথে শিরক মিশিয়ে ফেললাম। আর সুন্নাহকে গুলিয়ে দিলাম বিদ‘আতের সাথে। নতুন বাড়ি বানিয়ে, নতুন দোকান খুলে বরকতের আশায় হুজুর ডেকে মিলাদ করালাম। রাসূল (ছাঃ) আসবেন বলে একটি সুন্দর মযবুত চেয়ার খালি রেখে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকলাম। চেয়ারও শূন্য থাকল, আর এদিকে শূন্য আমলনামা শূন্যই থেকে গেল। আমলনামার শূন্যতা তো চোখে দেখতে পেলাম না, আর চেয়ারের শূন্যতা চোখে দেখেও দেখলাম না। হতভাগ্য আর কাকে বলে! পায়ে কুড়াল মেরে কতটুকু কাটলে সেটাকে নির্বুদ্ধিতা বলে!

এই ফিৎনাময় সমাজে ছেলে-মেয়েকে কুরআন-হাদীছের শিক্ষায় শিক্ষিত করার বাসনা নিয়ে ভর্তি করলাম মাদরাসায়। মাদরাসায় পড়ে এসে ছেলে-মেয়েরাই আমাকে শিখাল, কবরে নাকি গাউছুল আযম পীরবাবা সাহায্য করবে! তারা মাদরাসায় শিখে আসল, অমুক পীর, তমুক বাবা ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে! আমি তো মুর্খ মানুষ, কুরআন হাদীছ বুঝি না। ছেলে-মেয়েরা বোঝে। তারা যা বলে তাই আমল করি। আমি তাদেরকে ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত করেছি। আজ তারাই আমার আক্বীদা হরণ করছে! চোখ থেকে যখন কালো পর্দা সরে গেল তখন বুঝলাম, আমার ছেলে-মেয়েরা মাদরাসায় শুধু ফতোয়াবাজিই শিখেছে। মাসআলা নিয়ে ঝগড়া করা শিখেছে। ঈমান ও আক্বীদা সম্পর্কে তাদের সঠিক কোন ধারণাই তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর কুরআন হাদীছ পড়েও যদি তাওহীদ না শেখে, তাওয়াক্কুল না শেখে, তাক্বদীরের প্রতি আস্থা তৈরি না হয়, কবর-হাশর সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না হয় তবে তারা এতদিন কুরআন হাদীছ পড়ে শিখলটা কী!

প্রাথমিক শিক্ষায় আক্বীদা সংযোজনের প্রয়োজন :

ভূমিকার এই বুকফাটা চিৎকার এক অশিক্ষিত বাবার। দ্বীনের সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে না পারার কষ্ট যে বাবাকে কুরে কুরে খায়। তিনি নিজের আফসোসের জায়গা থেকে ছেলে-মেয়েকে মাদরাসায় ভর্তি করেন। কিন্তু সেখানে তার ছেলে-মেয়ে সঠিক ইসলামী আক্বীদা শিখতে পারে না। এটা যে কতটা আফসোসের, কতটা হতাশার তা সবাই বুঝবে না। ছাগল তো গাছ খাবেই। ছাগলের ধর্মই হ’ল গাছ খাওয়া। তবে যত্নের গাছটি ছাগল দ্বারা ভক্ষিত হওয়া আর বেড়া দ্বারা ভক্ষিত হওয়ার মাঝে আছে অনেক তফাৎ।

এই দুর্ঘটনার কারণ বর্তমানের শিক্ষাব্যবস্থার আক্বীদা বিবর্জিত সিলেবাস। এই সমস্যা এখন প্রায় সকল শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান। আক্বীদার কোন বই নেই, আক্বীদা বিষয়ক কোন আলোচনা নেই, এই বিষয়ে কোন প্রতিযোগিতা নেই, ছাত্রদের মাঝে আক্বীদা সম্পর্কে জানার কোন আগ্রহ নেই। একধাপ এগিয়ে বললে, শিক্ষকদের মাঝেও এটি চরম অবহেলিত একটি বিষয়। তারা আক্বীদার আলোচনা এমনভাবে পাশ কাটিয়ে যান, যেন এটি নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় বিষয়!

দেখুন! একজন শিশুর মন নির্মল, কোমল, সাদা ক্যানভাসের মত। সেখানে যে ছবি এঁকে দেয়া হয় সে ছবি সারাজীবন তার মানসপটে ঝকঝকে প্রভাত ঊষার মত কীরণ ছড়ায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মনের ক্যানভাসে ধুলা-ময়লা জমতে থাকে। একসময় সেই ক্যানভাস আর ব্যবহারযোগ্য থাকে না। সুতরাং যদি কারো মনে বিশুদ্ধ আক্বীদার বীজ বপন করতে হয় তবে তা শিশুকালেই করতে হবে।

আরেকটি কারণ হল, অনেক অভিভাবক চান, তার শিশু প্রাথমিক শিক্ষায় ইসলাম শিক্ষা করুক। মাধ্যমিকে সে স্কুলে লেখাপড়া করবে। ভবিষ্যতে সে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে। তারাও সন্তানকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য মাদরাসায় ভর্তি করেন। কিন্তু আমরা মাদরাসায় তাদের মনে ইসলামী আক্বীদার বীজ বপন করে দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হই। ফলে তারা অদূর ভবিষ্যতে সেক্যুলার পরিবেশে গিয়ে সহজেই ঈমানহারা হয়। আজ আমাদের প্রাথমিক শিক্ষায় আক্বীদার পাঠ যদি পাকাপোক্ত হ’ত, শিক্ষকগণ যদি বিশুদ্ধ আক্বীদা শিখানোর প্রতি যত্নবান হ’তেন, তবে হয়ত আমাদের মাদরাসা পড়ুয়া নাস্তিক দেখতে হ’ত না।

প্রাথমিক শিক্ষায় আক্বীদা কিভাবে ঢোকানো সম্ভব :

প্রসঙ্গ যেহেতু প্রাথমিক শিক্ষা; সুতরাং ছোট বাচ্চাদের জন্য আক্বীদার সহজবোধ্য কোন বই থাকা যরূরী। তবে যেভাবেই হোক, আক্বীদার পাঠ খুব মযবুতভাবে হ’তে হবে। সেটা হ’তে পারে গল্পাকারে। হাদীছে অনেক ঘটনা রয়েছে যেখানে ইসলামের বিশুদ্ধ আক্বীদা শেখানো হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ উটের পিঠে আনাস (রাঃ)-এর রাসূল (ছাঃ)-এর পেছনে বসে কথোপকথনের হাদীছের কথা বলা যায়। আরো অনেক হাদীছই রয়েছে যেগুলো ব্যবহার করে গল্পের ছলে বাচ্চাদেরকে আক্বীদা শিখানো যায়।

আক্বীদা শিক্ষা হ’তে পারে বিভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমেও। যেমন পশ্চিমা পরিচালিত প্রাথমিক স্কুলগুলোতে ম্যাডাম ছোট বাচ্চাদের চকলেটের লোভ দেখিয়ে বলে, চোখ বন্ধ করে আল্লাহর কাছে চকলেট চাও! ছোট বাচ্চা কিছু না বুঝে চোখ বন্ধ করে আল্লাহর কাছে চকলেট চায়। কিছুই পায় না। তারপর আবার ম্যাম বলে, এবার চোখ বন্ধ কর ম্যামের কাছে চকলেট চাও! এবার যখন সে চোখ বন্ধ করে ম্যামের কাছে চায় তখন ম্যাম তার হাতে চকলেট রেখে বলে, এরপর থেকে কার কাছে চকলেট চাইবে? বাচ্চাটি বলে, ম্যামের কাছে! ম্যাম বলে, আল্লাহ চকলেট দেয়? সে বলে, না। ম্যাম দেয়। নাঊযুবিল্লাহ।

দেখুন! এই ছেলেটিকে বস্ত্তবাদী বানাতে কোন পাঠ্য বইয়ের দরকার হ’ল না। সুতরাং যারা শুধু সিলেবাসে নেই বলে বাচ্চাদেরকে আক্বীদা শেখান না তারা যথেষ্ট গাফিলতির মাঝে আছেন। খৃষ্টান মিশনের স্কুলগুলোর নিম্নপদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা যতটুকু সচেতন আমাদের মাদরাসাগুলোর শিক্ষা সচিবগণও হয়তো ততটুকু সচেতন না। দেখুন! শুধুমাত্র সংসার চালানোর জন্য আমরা মাদরাসায় আসি না। আমরা ইলমে ওহীর খিদমাত করতে মাদরাসায় আসি। এটা ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের মাথায় অনেক বড় দায়িত্ব। এই দায়িত্ব সম্পর্কে হাশরের ময়দানে আমাদেরকে জিজ্ঞাসিত হ’তে হবে।

আক্বীদার শিক্ষা হ’তে পারে পাঠ্য বইয়ের মাধ্যমেও। তবে সেটা অবশ্যই পরিকল্পিতভাবে বাচ্চাদের জন্যই লেখা হ’তে হবে। তাদের জন্য আক্বীদার বিষয়টি যেন কঠিন হয়ে না যায়। তারা যেন খুব সহজে আক্বীদার পাঠ গ্রহণ করতে পারে। এক্ষণে আল্লাহর অশেষ রহমতে এই শিক্ষাব্যবস্থা এবং সামাজিক পরিস্থিতিকে সামনে রেখে ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন শিক্ষা বোর্ড’ শিক্ষার সর্বস্তরে বিশুদ্ধ আক্বীদা সমৃদ্ধ পাঠ্যবই প্রকাশের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ফালিল্লা-হিল হাম্দ। ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন শিক্ষা বোর্ড’ চায় এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা, যার মাধ্যমে শিক্ষর্থীরা বিশুদ্ধ ইসলামী আক্বীদা ও আমল শিখবে। যার মাধ্যমে প্রশস্ত হবে জান্নাতের পথ। গড়ে উঠবে সোনালী যুগের তাওহীদী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। আমরা এই বোর্ডের সর্বাঙ্গীণ সফলতা কামনা করছি। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন। আমীন!

শেষকথা : আজ ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলা মানুষের অভাব নেই। আমাদের দেশে যারা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ইসলামকে মুছে ফেলার জন্য ব্যয় করে তাদের নামগুলো আপনি কখনো খেয়াল করেছেন? কত সুন্দর সুন্দর ইসলামী নাম! এদের সকলের জন্ম মুসলমানের ঘরে। তারপরও আজ এরা নাস্তিক। এরা আমাদের ভাই, আমাদের প্রতিবেশী। এদের পথভ্রষ্ট হওয়ায় যদি আমাদের অন্তরে ব্যাথা অনুভূত না হয় তবে কীভাবে আমরা নবীর ওয়ারিছ! উম্মাহর জন্য আমাদের সহানুভূতির জায়গাটা কোথায়! আজ আমাদের আলেমগণ গোড়ার সমস্যা দূর না করে অনলাইনে এদের সাথে বিতর্কে বসছেন। তাদেরকে গালাগালি করছেন। আর আমরাও তাদেরকে গালি দেয়া ছওয়াব মনে করছি!

প্রিয় পাঠক! আজ আমার প্রতিবেশীর ঘর থেকে নাস্তিক তৈরি হয়েছে, কাল হয়ত আমার ঘর থেকেই নাস্তিক তৈরি হবে। এই মহামারী থেকে বাঁচার উপায় কী! তাদের সাথে বিতর্ক করা? তাদেরকে গালাগালি করা? নাকি নাস্তিক তৈরির পথ চিরতরে বন্ধ করে দেয়া? যদি আমরা নাস্তিক তৈরি বন্ধ করতে চাই তবে আমাদেরকে আজ থেকেই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ইসলামের বিশুদ্ধ আক্বীদার চর্চা এমনভাবে প্লাবিত করতে হবে, যেন নাস্তিক্যবাদ খড়কুটোর টুকরার মত ভেসে যায়। আর এই প্লাবনের সূচনা হবে প্রাথমিক শিক্ষা থেকেই। এই লালিত স্বপ্ন একদিন বাস্তবায়িত হবে সমাজে, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। একজন বাচ্চা ভাঙ্গা ভাঙ্গা বানানে পড়বে, আল্লাহ এক, তাঁর কোন শরীক নেই। আমরা তাঁরই ইবাদত করি এবং তাঁর কাছেই সাহায্য চাই। আমাদেরকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে।.

সারোয়ার মিছবাহ

 শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।

..






আরও
আরও
.