
আজকের শিরোনাম দেখে আপনি মনে করতেই পারেন, এই বিষয়েও প্রবন্ধ হয়! দীর্ঘদিন যাবৎ আমরা এমনই মনে করে এসেছি। আমরা সবসময়ই মনে করেছি, শিক্ষক সর্বদা শিক্ষার ওপরে। তিনি শুধু শিখাবেন। কিছু শিখবেন না। এজন্য আমাদের শিক্ষকগণ কোন বই তো পড়েনই না, এমনকি পাঠ্য বইয়ের শুরুতে যে শিক্ষক নির্দেশিকা আছে সেটাও পড়েন না। তারা মনে করেন, জানিই তো! কি আর লিখবে! ৩৫ বছর ধরে শিক্ষকতা করি! চুল-দাড়ি তো আর বাতাসে পাকেনি!
মনে পড়ে, অনেকদিন আগে এক রচনা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। নির্ধারিত বিষয়বস্ত্তর ওপরে উপস্থিত রচনা লিখতে হবে। অনেকটা পরীক্ষার মতই। সময় শুরু হওয়ার সাথে সাথে লেখা শুরু হ’ল। সময় শেষ হ’তেই একজন বয়স্ক শিক্ষক এসে এলোমেলোভাবে সবার কাগজ জমা করা শুরু করলেন। তিনি এমনভাবে এলোপাতাড়ি ভঙ্গিতে খাতা তুলছিলেন যে, আমরা বেশ বুঝতে পারছিলাম, পরবর্তীতে খাতাগুলো সাজানো অনেকটা অসম্ভব হবে। কারণ আমাদের অতিরিক্ত কাগজগুলো মূল খাতার সাথে পিন করা ছিল না। তিনি এভাবেই খাতা টান দিয়ে নিচ্ছিলেন। ছাত্রদের মাঝে চাপা গুঞ্জন শুরু হ’ল।
আমাদের এক বড় ভাই তাকে আদবের সাথে বললেন, হযরত! এভাবে খাতা তো একটা আরেকটার সাথে মিশে যাবে। তখন তিনি খাতা তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত বছর ধরে লেখাপড়া কর’? উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার বললেন, ‘৩৫ বছর ধরে শিক্ষকতা করি’! আমি মনে করলাম, তিনি লেখাপড়ার বয়স জিজ্ঞেস না করে সরাসরি বয়স জিজ্ঞেস করলেও পারতেন। কারণ আমরা সেখানে ২০ বছরের ওপরে কেউই ছিলাম না। তার এই মন্তব্য শোনার পরে আমাদের বলার মত আর কিছুই থাকল না। পরবর্তীতে দেখা গেল, পুরষ্কারপ্রাপ্তদের নাম তাদের প্রতিষ্ঠান থেকেই এসেছে। আমরা সবই বুঝেছি। তবে সেদিন কিছু বলতে পারিনি।
আমার আজকের প্রবন্ধ লেখার কারণও কিছুটা তেমনই। অনেকগুলো বলতে না পারা কথা বলা। আমরা আসলে নিজেদের চিন্তাধারাগুলো সবসময় আপনাদের কাছে পৌঁছাতে পারি না। কারণ আপনারা শিক্ষক। আপনারা আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত চিন্তাধারা লালন করেন। এটা আমরা জানি। এটাও জানি, আপনাদের পাঠদানের কৌশল অনেক ফলপ্রসূ। এতকিছুর পরেও আমাদের কিছু অন্তর দহন রয়েছে। কিছু বোবাকান্না রয়েছে। এগুলো আপনাদের জানা দরকার। কারণ আপনাদের পরে হয়ত আমরাই এই অঙ্গনে আপনাদের উত্তরসূরী হয়ে থাকব। সুতরাং আমরা যদি ভুল পদ্ধতির ওপরে থাকি তবে আপনাদের উচিৎ আমাদেরকে সংশোধন করে দেয়া।
আমাদের মনে হয়, অধিকাংশ মাদ্রাসাতেই ইলমুন নাহুর পাঠদান বেশ হতাশাজনক। কারণ ছাত্রদের কাছে নাহু মানেই যেন হিংস্র বাঘ তেড়ে আসার এক ভয়াবহ চিত্র। না, আমার কথাটা যথাযথ হ’ল না। বরং তারা নাহুকে বাঘের চেয়েও অধিক ভয় পায়। আসলেই কি নাহু এমন ভয়াবহ জিনিস? কই! আমাদের তো কোনদিন মনে হয়নি। আমাদের মনে হয়, কোনটা ‘বাঘের মত’ আর কোনটা ‘পানির মত’ এটা হয়ত শিক্ষকের পাঠদানের ওপরেই নির্ভর করে। তাই বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমরা ইলমুন নাহুর পাঠদান এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশদ আলোচনা করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
একটি ভুল ধারণার অবসান : আমরা মনে করি, ফারসী ভাষায় লিখিত নাহবেমীর এবং মীযানুছ ছরফ কিতাবের পূর্ণাঙ্গ পাঠ একজন অনারব প্রাথমিক ছাত্রের জন্য যথাযথ রয়েছে। তবে এটা সঠিক নয়। এই কিতাবগুলো অনারব প্রাথমিক ছাত্রের জন্য নয়। এই কথার প্রমাণে অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। আমি এখানে আলোচনা সংক্ষিপ্ত করার স্বার্থে শুধু একটি উদাহরণ দেব। আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থায় একজন ছাত্রের আরবী শেখার হাতেখড়ি হয় মীযানুছ ছরফ কিতাবের মাধ্যমে। এটাকে প্রাথমিক ছরফ শেখার জন্য সর্বমহলে গ্রহণীয় কিতাব হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
মীযানুছ ছরফের প্রথম পৃষ্ঠার হাশিয়ায় একটি ফারসী কবিতা দেয়া আছে। ‘আমুদাহ মাযী বিমানা মুযারে চান্দে জা, আতফে মাযী বর মুযারে দর মাকামে ইবতেদা...’। অর্থাৎ ‘ফে‘ল মাযী কয়েক স্থানে মুযারে‘ এর অর্থে ব্যবহৃত হয়। যদি বাক্যের শুরুতে মাযী মুযারের সাথে আতফ হয়....’। এভাবে কয়েকটি জায়গার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যে স্থানগুলো আরবী ভাষা জানে এবং কুরআন-হাদীছ পর্যাপ্ত অধ্যয়ন করা হয়েছে এমন ব্যক্তি ছাড়া বুঝতে পারবে না। আবার সেখানে এর কোন উদাহরণ দেয়া হয়নি। এবার আপনি বলুন! এটা কি প্রাথমিক ছাত্রের জন্য লেখা?
হ্যঁা, এটা এমন প্রাথমিক ছাত্রের জন্য লেখা যে আরবী বোঝে। এজন্য আমরা বলি, আমাদের উচিৎ, এসো আরবী শিখি প্রথম খন্ডের সাথে কোন ব্যাকরণের কিতাব না পড়িয়ে ছাত্রদের আরবী ভাষার সাথে পরিচিত করা। প্রথম খন্ড পড়ার পরে একজন ছাত্র যে কোন বস্ত্ত বা ব্যক্তি সম্পর্কে পনের থেকে বিশটি বাক্য বলতে পারবে। এরপরে যখন দ্বিতীয় খন্ড পড়ানো হবে তখন তার সাথে সাথে প্রাথমিক ছরফের ধারণা দিতে হবে। তবে সেটা ফারসী মীযানুছ ছরফের মাধ্যমে নয়। এমন কোন বইয়ের মাধ্যমে যা বাংলাভাষী বাচ্চাদের বোধগম্য হবে। দ্বিতীয় খন্ড পড়ার পরে সে আরবীতে ছোট খাট মাকালাহ লিখতে সক্ষম হবে। এরপরে তৃতীয় খন্ডের সাথে নাহু চলবে। তবে সেটাও ফারসী নাহবেমীর বা উর্দূ আমীনুন নাহু নয়। সাবলীল বাংলা ভাষায় রচিত নাহু।
আমাদের মাদ্রাসাগুলোতে যেভাবে এসো আরবী শিখি পড়ানো হয় তাতে তিন খন্ড শেষ করার পরেও একজন ছাত্রের আরবীতে প্রাথমিকত্ব কাটে না। এটা অবশ্যই পাঠদান পদ্ধতি না জানার কারণেই হয়।
আমাদের কৈফিয়ত : আমরা শুরুতেই কিছু বিষয়ে কৈফিয়ত দিয়ে সামনে অগ্রসর হবো। আমি এই অংশকে প্রবন্ধের শেষে রাখতে চেয়েছিলাম। তবে সংগত কারণেই এটা শুরুতে আলোচনা করছি। আমরা অনেকেই মনে করি, বাংলায় নাহু পাঠদানে ইলম কম অর্জিত হয়। উর্দূতে পাঠদান করলে তুলনামূলক ইলম অধিক এবং ফারসীতে পাঠদান করলে আরো বেশী ইলম অর্জিত হয়। সকলের সাদামাটা অভিযোগ, আপনারা উর্দূ-ফারসী সব তুলে দিচ্ছেন! ছাত্ররা শিখবে কী! বাংলা পড়ে পড়ে সব ‘তরজমা হুযুর’ হচ্ছে। আলেম হ’তে কি উর্দূ-ফারসীর প্রয়োজন নেই! আরো কত কি!
আমরা বলি, ছাত্রদের ‘তরজমা হুযুর’ হওয়া থেকে রক্ষা করতেই আমাদের সকল প্রয়াস। দেখুন! একসময় বাংলায় রচিত কোন নাহু-ছরফের কিতাব ছিল না। পরিস্থিতি এতটা উন্নত ছিল না যে, প্রয়োজনীয় কিতাব কয়েকমাসে সংকলন করে সেটা পাঠ্যপুস্তক হিসাবে উপস্থাপন করা যায়। তখন আমাদের ওলামায়ে কেরাম বাধ্য হয়ে বিদেশী ভাষা থেকে আরবী ব্যাকরণের পাঠদান করেছেন। তখন আমরা বাংলাভাষী শিক্ষার্থীরা সরাসরি আরবী থেকে ইস্তেফাদা অর্জন করতে সক্ষম হইনি। ইলম আমাদের কাছে উর্দূ বা ফারসী ভাষায় ভায়া হয়ে এসেছে।
আপনারা হয়ত উর্দূ-ফারসীতে আরবী ব্যাকরণ পড়ার সুফল দেখেছেন। সুফল দেখাটাই স্বাভাবিক। কারণ যারা ফারসী ভাষায় আরবী ব্যাকরণ বুঝেছে তারা তো মেধাবী। আপনারা সেই মেধাবীদের দিয়েই আজ দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন। কিন্তু আপনাদের গল্পে স্বল্প মেধাবীদের আলোচনা বাদ পড়ে গেছে। যারা ফারসী দুর্বোধ্য কিতাবগুলোর জন্য মৌলিক ইলম থেকেই বঞ্চিত হয়েছে। তাদেরকে নিয়ে আপনারা কিছু বলেননি। তাদের জন্য আপনারা কিছু করেননি। আপনার যদি বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য থাকে তবে আপনি চাইনিজ ভাষায় নাহু পড়েন। একই কিতাব থেকে ভাষাও শেখেন নাহুও শেখেন। যদিও আমি আজ পর্যন্ত কোন এমন মেধাবী দেখিনি যে, ফারসী নাহু পড়ে ফারসী শিখে গেছে। তারপরও আপনি পড়েন। সমস্যা নেই। তবে একটা কঠিন জিনিসকে সার্বজনীন করার জন্য আপনি কথা বলতে পারেন না। এটা অবশ্যই যুলুম।
বাংলায় নাহু-ছরফ সংকলনের জন্য আপনি আমাদের ওপর অসন্তুষ্ট। অথচ প্রতিটি লেখক তার নিজ ভাষায় কিতাব সংকলন করেছেন। নাহু তো প্রথমে সংকলিত হয়েছে আরবীতে। তাহ’লে আমরা বলতে পারি, যদি মাতৃভাষায় আরবী ব্যাকরণ শিখানোর মাধ্যমে জাতিকে মূর্খ করার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়ে থাকে তবে সর্বপ্রথম তা করেছেন মীর ছাহেব। তিনি কেন আরবী ব্যাকরণ ফারসী অর্থাৎ নিজ ভাষায় রচনা করলেন? এরপরে খেয়ানত করেছেন আবূ মুঈদ বানারসী। তিনি ফারসীকে নিজ মাতৃভাষা উর্দূতে নিজের ইচ্ছামত সাজিয়ে নিয়েছেন। মীর ছাহেব তো আরবী পরিভাষাগুলোকেও ফারসীতে বদলে নিয়েছেন। এটা যদি খেয়ানতই হয় তবে সেই ধারাবাহিকতায় আমরা অনেক পরে আছি।
ভাল আলেম হ’তে আরবী জানার পাশাপাশি উর্দূর প্রয়োজন আছে। এটা আমরাও স্বীকার করি। বিদগ্ধ আলেম হ’তে যতগুলো ভাষায় কুরআন ও হাদীছের খিদমত হয়েছে সেই সকল ভাষার ওপর পান্ডিত্য দরকার। তবে ভাষা শেখারও তো কিছু নিয়ম-কানূন আছে! আপনাকে নাহুর কিতাবেই উর্দূ ফারসী শিখতে হবে কেন? এগুলো শেখার কার্যকরী পন্থা তো আছে। আপনারা সেই পদ্ধতিতে চর্চা করুন। মনে করুন, আপনার ইংরেজী ভাষা শেখা দরকার। এজন্য আমি আপনাকে ইংরেজীতে ফিজিক্স পড়াচ্ছি। এদিকে আপনি না বোঝেন ইংরেজী, না বোঝেন ফিজিক্স। আপনাকে আগে ইংরেজী কথাকে বাংলায় ভাষান্তর করতে হয়। এরপরে আপনি বাংলায় সেটা বোঝার চেষ্টা করেন। ইংরেজী শেখার জন্য এর চেয়ে ভাল পন্থা কি আর ছিল না?
সত্য কথা বলতে কি আমরা কখনো ভাষা শিখতেই চাই না। আমাদের টার্গেটই হ’ল, আমরা এমন কিছু জানব যা অন্যরা জানবে না। সেটা কাজের কোন বিষয় হোক বা না হোক। এটাই আমাদের গর্ব। এজন্যই আমরা সর্বদা সূক্ষ্ম মাসআলা বোঝার চেষ্টা করি। সূক্ষ্ম ইলম যাহীর করে নিজেকে অনন্য মনে করি। আমাদের মাদ্রাসায় একবার কিছু আরব মেহমান এসেছিলেন। তারা আমাদের সিলেবাসে কাফিয়া, শরহেজামী দেখে রীতিমত আশ্চর্য হয়েছেন। তাদের বক্তব্য এমন ছিল যে, আরবে নাকি যারা নাহু নিয়ে গবেষণা করে তারাই কেবল এই সকল কিতাব অধ্যয়ন করে। পাশাপাশি তারা আমাদের আরবী ভাষার স্কিল দেখেও হেসেছেন। এত উচ্চতর নাহু-ছরফ পড়া ছাত্ররা আরবী ভাষায় এতটা কাঁচা কিভাবে হয়, এটাও তারা মেলাতে পারেননি। অবশ্য না মেলাটাই স্বাভাবিক। কারণ নাহু যদি খাবারে লবণের মত হয় তবে আমাদের কাছে কোন খাবারই নেই। রয়েছে বস্তা বস্তা লবণ। আমাদের অঙ্গনে এই লবণ দিয়েই ইলম পরিমাপ করা হয়।
নাহু-ছরফ কখনোই মৌলিক ইলম নয়। এগুলো সহায়ক ইলমের সহায়ক ইলম। অর্থাৎ কুরআন-হাদীছ মৌলিক ইলম। তা বুঝার জন্য আরবী ভাষা সহায়ক ইলম এবং আরবী ভাষা বোঝার জন্য নাহু, ছরফ, বালাগাত হ’ল পরের ধাপের সহায়ক ইলম। আমরা সেটা নিয়েই পড়ে আছি। একজন ছাত্র এই সহায়ক ইলম অর্জনের যাত্রা শেষে কিভাবে দ্রুত মৌলিক ইলম অর্জনে মনোনিবেশ করবে এটা আমরা কেউই ভাবি না। আমরা মনে করি, মুবতাদা খবরের তারকীব মিলানোই একজন আলেমের একমাত্র জীবন-উদ্দেশ্য। আমরা বছরের পরে বছর সময় এখানেই নষ্ট করি। ফলাফলে শিক্ষার্থীরা কুরআন-হাদীছ বোঝে না। কারণ তারা ভাষায় অপরিপক্ক। এদিকে আবার মাদ্রাসায় পড়ার কারণে জেনারেল সাবজেক্টগুলোও বোঝে না। উর্দূতে যাকে বলে, ‘না ইধার, না উধার, দরমিয়ান মেঁ ছদর বদর’।
আমরা সেই গদবাধা নিয়ম থেকে সরে এসেছি। আমরা ছাত্রদের প্রয়োজনীয় ব্যাকরণ শিক্ষা দিয়ে ভাষায় দক্ষ করে তুলে দ্রুত কুরআন-হাদীছ অধ্যয়নের উপযুক্ত করতে চাই। আমরা চাই না, সহায়ক ইলম অর্জন করতেই কারো জীবনের সকল শক্তি ফুরিয়ে যাক। স্পৃহা শেষ হয়ে যাক। আমাদের কাজে ভুল থাকতে পারে। আমাদের পদক্ষেপ সঠিক নাও হ’তে পারে। তবে এটাই আমাদের উদ্দেশ্য। আমরা আমাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সর্বদা আপনাদের পরামর্শ, দো‘আ ও সহযোগিতা কামনা করি।
আমাদের কষ্টের জায়গা : আমরা বাংলাভাষী। জন্মের পর থেকে বাংলা ভাষায় কথা বলে আসছি। পড়ছি, লিখছি, শুনছি ও বলছি। তারপরও আমাদের সামনে যখন বাংলা ভাষার ব্যাকরণ উপস্থাপন করা হয় তখন আমাদের কাছে সেটি দুর্বোধ্য মনে হয়। বাংলাভাষী হয়েও বাংলা ব্যাকরণ কঠিন লাগে। আসলে ব্যাকরণ বিষয়টি এমনই। তাহ’লে যে ছাত্রটি আরবী পড়েনি। আরবী জানে না। তার কাছে আরবী ব্যাকরণ কেমন? অবশ্যই সহজ নয়। একে তো তারা এমন এক ভাষার ব্যাকরণ পড়ছে যে ভাষা তারা জানে না। আবার সেটা এমন ভাষায় লেখা হয়েছে সেটাও জানে না।
সবকিছুর ওপরে আমরা পাঠদানের কৌশলগত দুর্বলতার মাধ্যমে নাহু-ছরফ কঠিন করার ষোলকলা পূর্ণ করেছি। এতটাই কঠিন করেছি যে, ছাত্ররা ব্যাকরণ বোঝার চেয়ে মরে যাওয়াকে সহজ মনে করে। শুধু ব্যাকরণ না বোঝার কারণে শত শত ফুল আমার চোখের সামনে কলিতেই ঝরে যেতে দেখেছি। আমি তাদের জন্য কিছু করতে পারিনি। সর্বশক্তি দিয়েও দ্বীনী শিক্ষায় তাদেরকে আটকে রাখতে পারিনি। তাদের সেই কিতাব না বোঝার হতাশ চাহনি আমি আজও মনের আয়নায় দেখি। তাদের নিরাশার বাক্যগুলো এখনো আমার কানে শুনি।
মাসখানেক আগে তাদের একজনের সাথে দেখা হয়েছিল আমাদের মাদ্রাসার সামনে। সে এখন ট্রাকের ড্রাইভার। আমার চেয়ে বয়সে অনেকটাই ছোট। লেখাপড়ার শুরুটা বেশ ভালোই করেছিল। যখন একটু ওপরের দিকে গেল তখনই এই সকল দুর্বোধ্য কিতাবগুলো তার পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়। কথার পিঠে আমি তাকে বললাম, ‘জানো! আমি এখন ওই বইগুলোর বিকল্প সাবলীল বাংলা বই সংকলনের কাজ করছি’। সে বলল, ‘করেন ভাই! ইলম-কালাম আমাদের কপালে নাই’। তার এই কথা শুনতে আমার কেমন লেগেছে সে অনুভূতি আমি প্রকাশ করতে পারব না। তবে এটাই আমাদের অন্তর দহন।
এই দহনের জন্য সম্পূর্ণ দায়ী আমাদের মুরুববীগণ। যারা মনে করেন, ইলম কষ্ট করেই অর্জন করতে হবে। এখনো অনেক বড় বড় মাদ্রাসা পরিচালক আছেন যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ছাত্রদের দুই বেলা খাওয়ার উপযোগী খাবার দেন না। আর্থিক অবস্থা ভাল থাকার পরেও ছাত্রদেরকে ভাল আবাসনের ব্যবস্থা করে দেন না। বলেন, ‘আমরা কোনদিন তরকারি দিয়ে ভাত খাইনি। আমরা কোনদিন ফ্যানের বাতাসে ঘুমাইনি’।
নাহু মুখস্থ নয়, শেখাতে হবে : এ পর্যায়ে আমরা কিছু দিকনির্দেশনামূলক কথা বলব। আশা করি, এই কথাগুলো আপনার নাহু পাঠদানের অভিজ্ঞতাকে আরো সমৃদ্ধ করবে। শুরুতেই আপনাকে জানতে হবে, কোনটা শিখতে হয় আর কোনটা মুখস্থ করতে হয়। অল্প কথায়, মূলনীতি কেন্দ্রিক বিদ্যা শিখতে হয়। আর যে বিদ্যার মাঝে কোন মূলনীতির উপস্থিতি নেই তা মুখস্থ করতে হয়। যেমন, গণিতের মূলনীতি রয়েছে। যেখানে একটি মূলনীতির আলোকে হাযারটা গণিতের জন্ম হয়। সুতরাং গণিত শিখতে হয়। কবিতা লেখার মূলনীতি রয়েছে। তবে কবিতা মুখস্থের কোন মূলনীতি নেই। তাই কবিতা মুখস্থ করা গেলেও কবিতা লেখা শিখতে হবে। আশা করি বিষয়টি বোঝা গেছে।
নাহু, ছরফ, বালাগাত সবই মূলনীতি কেন্দ্রিক বিদ্যা। সুতরাং এগুলো শিখতে হবে। এবার আপনি বলতে পারেন, তাহ’লে তো মুখস্থ করার কিছুই নেই! না, এমন নয়। আমি আপনাকে মুখস্থের ময়দান দেখাচ্ছি। যে কোন ভাষা শেখার সবচেয়ে মযবূত খুঁটি হচ্ছে শব্দভান্ডার। আরবীতে বলা হয় মুফরাদাত। এই বিদ্যার কোন মূলনীতি নেই। আপনি প্রাণ ভরে মুখস্থ করুন। কোন সমস্যা নেই। আপনি যত বড় শব্দভান্ডারের মালিক; আপনি ভাষায় ঠিক তত বড়ই কিংবদন্তি।
আপনি কুরআনের আয়াত মুখস্থ করুন, হাদীছের মুতূন মুখস্থ করুন। তবে দয়া করে ইলমুন নাহু মুখস্থ করবেন না, করাবেন না। ইলমুন নাহু একটি গভীর মূলনীতি কেন্দ্রিক বিদ্যা। সুতরাং এটা শিখতে ও শেখাতে হবে। ছাত্রদেরকে কখনো বলবেন না, ‘এখন মুখস্থ কর, পরে বুঝতে পারবে’। মাদ্রাসার শতভাগ ছাত্রই এই বাক্যের সাথে পরিচিত। এই বাক্য তারা কেবল ছরফ এবং নাহুর ক্লাসেই শুনেছে। যাদেরকে এই কথা বলা হয়েছে তাদের অনেকেই এখন বড় হয়েছে। লেখাপড়াও শেষ হয়েছে। তারাই বিচার করুক, এই কথার সত্যতা কতটুকু। সত্যি বলতে এটা একটা মিষ্টি ধোঁকা। যা খুব সহজেই শিক্ষার্থীদের খাওয়ানো যায়।
পরিভাষা বোঝার প্রয়োজনীয়তা : আমরা বলি, পরিভাষামূলক শব্দগুলো ছাত্রদের চিনাতে হবে। শুধু সংজ্ঞা মুখস্থ করালে হবে না। আপনি দরসে পরিভাষাগুলো নিজের ভাষায় বুঝিয়ে বলে বাংলা ভাষায় তার উদাহরণ দিন। প্রতিটি পরিভাষায় দশের অধিক উদাহরণ দিন। বলুন, ‘দুইটি শব্দের একটি যদি আরেকটির গুণ বুঝায় তবে তা মুরাক্কাবে তাওছীফী। যেমন : নতুন খাতা, পুরাতন টুপি, সুন্দর কলম ইত্যাদি’। তারা সহজে বুঝে গেলে নিজেদের খাতায় বাংলায় বিশটি উদাহরণ লিখতে বলুন। পরিভাষা বোঝানোর স্বার্থে প্রথম দুয়েকমাস নাহু ক্লাসে আরবী উদাহরণ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। অন্যথা ছাত্ররা সংজ্ঞার সাথে উদাহরণকে মিলাতে পারবে না। তাদের মস্তিষ্কে সেই পরিভাষার চিত্র অঙ্কিত হবে না। তারা মুখস্থ করতে বাধ্য হবে। ফলে যা হবার তাই হবে।
পরিভাষা মুখস্থ করার পরে একজন ছাত্রের নাহু পড়ার অভিজ্ঞতা কেমন হবে তার একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত দেয়া যায়। মনে করুন, একজন ছাত্র তার বইয়ে ডিম ভাজার রেসিপি পড়ছে। সেখানে লেখা আছে, প্রথমে চুলাতে কড়াই গরম করে নিতে হবে। এরপর কড়াইতে তেল দিতে হবে। তারপর তেল গরম হয়ে গেলে সেখানে ডিম ভেঙ্গে দিতে হবে। তবে ছাত্রটি চুলা চিনে না। কড়াই চিনে না। ডিম কাকে বলে সে জানে না। তার কাছে এই নিয়মটি মোটেও সহজ নয়। যদিও নিয়মটি একদম সাবলীল ভাষায় লেখা হয়েছে।
আপনি এই নিয়মটি তার সামনে যতই সহজভাবে ডজন খানেক উদাহরণ দিয়ে উপস্থাপন করেন না কেন, আপনার উপস্থাপনা তার মাথার ওপর দিয়েই যাবে। যতদিন সে রেসিপিতে উল্লেখিত প্রত্যেকটি জিনিস না চিনবে ততদিন সে এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারবে না। হ্যঁা, সে হয়ত বই থেকে মুখস্থ করে নিতে পারবে। তবে এই মুখস্থ রেসিপি দিয়ে সে জীবনে ডিম ভাজতে পারবে না। আর আপনি হতাশ হয়ে বলবেন, ছাত্রদেরকে এত সহজ করে বুঝাই! তারা বোঝে না কেন! এদিকে তারা পরিভাষাগুলোর সাথেই পরিচিত নয়!
মনে করুন, একজন ছাত্রকে আপনি শুধু এই লাইনটা বুঝানোর চেষ্টা করছেন যে, ‘ফায়েল সর্বদা মারফূ হবে’। অথচ সে ফায়েল চিনে না, আবার মারফূও চেনে না। তাহ’লে এটা যত সাবলীল ভাষাতেই লেখা হোক সে বুঝতে পারবে না। তার ওপরে যদি বলা হয়, ‘বা‘দ কেহ ফায়েল মারফূ বাশাদ’! তাহ’লে তো হ’লই। পড়াশোনার কর্মকান্ড এখানেই শেষ! তাই আমরা চাই, ছাত্ররা সহজ বাংলায় নাহুর পরিভাষা- গুলো বুঝতে পারুক। তবে শুধু কিতাব বাংলায় হ’লে হবে না। আমাদের বুঝানোও হ’তে হবে একদম নিজের ভাষায়।
একটি অমার্জিত নাহুর উদাহরণ : নিজের ভাষায় নাহু কাকে বলে তার একটি উদাহরণ দিতেই হয়। প্রতিটি কিতাবেই নাহুর আলোচনা লাফয থেকে শুরু হয়। সে হিসাবে আমি যদি বলি, মানুষের মুখে উচ্চারিত শব্দকে লাফয বলে। সেই লাফযের অর্থ থাকতেও পারে আবার নাও পারে। অর্থ না থাকলে মুহমাল। অর্থ থাকলে মাওযূ‘। এখন মাওযূ‘ যদি একটিই মাত্র শব্দ হয় তবে তাকে মুফরাদ বলে। আর কয়েকটি শব্দ একসাথে হ’লে তাকে মুরাক্কাব বলে। মুফরাদ হয়ত নিজেই নিজের অর্থ প্রকাশ করতে পারবে অথবা পারবে না। যদি না পারে তবে তা হরফ। যদি পারে তবে তা দুই প্রকার। অর্থের ভেতরে সময় পাওয়া গেলে ফে‘ল। সময় না পাওয়া গেলে ইসম।
মুরাক্কাব যদি পরিপূর্ণ বাক্য হয়ে যায় তবে তাকে মুফীদ বলে। আর পরিপূর্ণ বাক্য না হ’লে গাইরে মুফীদ বলে। মুফীদের শুরুর শব্দ যদি ইসম হয় তবে তা ইসমিয়্যাহ। শুরুর শব্দ যদি ফে‘ল হয় তবে তা ফে‘লিয়্যাহ। আর অর্থের ক্ষেত্রে যদি অর্থটি সত্য বা মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা রাখে তবে তা খাবারিয়্যাহ। সম্ভাবনা না রাখলে তা ইনশাইয়্যাহ। গাইরে মুফীদের মাঝে সাধারণত দুইটি করে ইসম হয়। দুইটি ইসমের একটি যদি অপরটির গুণ বুঝায় তবে তা মুরাক্কাবে তাওছীফী। আর যদি একটির সাথে অপরটির মালিকানার সম্পর্ক হয় তবে মুরাক্কাবে ইযাফী।
আমি জানি, এটা আপনাদের কাছে অমার্জিতই মনে হবে। কারণ এখানে ভাষা উন্নত নয়। মার্জিত নয়। তবে আপনি যেভাবে, যে ভাষাতেই পড়ান না কেন, শেষ পর্যন্ত এটাই মূলকথা, যা আমি বললাম। আমার মনে হয়, এভাবেই আমরা নাহুর প্রাথমিক পাঠ শুরু করতে পারি। শুরুতেই তাদেরকে মার্জিতের যাতাকলে পিষ্ট না করি। আমাদের অনেক শিক্ষক তো আবার ‘যথা’র স্থানে ‘যেমন’ লিখলেও পরীক্ষায় নম্বর কেটে নেন। তারাই মূলত সর্ববিদ্যা মুখস্থকরণের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন।
শুরুতে হাঁড়গুলো মযবূত করুন : একজন শিক্ষক হিসাবে আপনাকে জানতে হবে, প্রাথমিক নাহুতে ছাত্রদের শিখানোর বিষয় কোনটি! একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যে কোন শাস্ত্র পড়ার পূর্বে সেই বিষয়ের অস্থিকাঠামোর সাথে পরিচিত হওয়া প্রয়োজন। আপনি যখন ইমারত নির্মাণ করবেন তখন কিছু ভিত্তি স্থাপন করেন যা ইমারতকে টিকে থাকতে শক্তি যোগায়। ঠিক তেমনই কোন শাস্ত্র আয়ত্ব করার পূর্বে আপনার মস্তিষ্কে সেই শাস্ত্রের অস্থিকাঠামো বা কঙ্কালকে মযবূতভাবে ধারণ করুন।
যে কোন শাস্ত্রের অস্থিকাঠামো হ’ল, সেই শাস্ত্রে ব্যবহৃত পরিভাষাসমূহ। যেমন উলূমুল হাদীছের অস্থিচিত্র হ’ল, ছহীহ, যঈফ, শায, মাহফূয ইত্যাদি। ইলমুছ ছরফের জন্য মাযী, মুযারে, ছীগাহ, বাহাছ, গায়েব, হাযের ইত্যাদি। ঠিক তেমনই ইলমুন নাহুর জন্য মুফরাদ, মুরাক্কাব, মুনছারিফ, মাবনী এগুলো অস্থিকাঠামো। এই হাঁড়ের অবয়ব যত মযবূত হবে গোশত লেপনের পরে তা ঠিক ততটাই শক্তিশালী ও স্থায়ী হবে। এই বিষয়টিকে আপনার মাথায় রাখতে হবে। একজন ছাত্র আমীনুন নাহুতে একটিও নাহবী মাসআলা না শিখুক, একটিও তারকীব না পারুক কোন সমস্যা নেই। তবে তাকে আমীনুন নাহুতে উল্লেখিত সকল পরিভাষা চিনতে পারতে হবে। ‘মুবতাদা ও খবর মিলে জুমলা গঠন হয়’ এই কথাটা তার মুখস্থ না থাক, তবে তাকে জানতে হবে, মুবতাদা কী! খবর কী! জুমলা কী!
অনেকে মনে করে, নাহবেমীর মুখস্থ করে ফেলি। হেদায়াতুন্নাহুতে গিয়ে সব বুঝে নিবো। এই চিন্তাধারা ভুল। ওপরের কিতাব কখনো নীচের কিতাবের দুর্বলতা দূর করতে পারে না। তবে নীচের কিতাব ওপরের কিতাবের জন্য ছাত্রদের সবল করতে পারে। কারণ ভিত্তি সর্বদা নীচে থাকে। সেই ভিত্তিকে মযবূত করার জন্য যেমন কার্যকরী পাঠদান পদ্ধতি প্রয়োজন তেমনই প্রয়োজন সঠিক অনুশীলনের।
আমাদের অনেক শিক্ষকই শুধু নাহু মুখস্থ করিয়ে ক্ষান্ত থাকেন। অনুশীলন করান না। যা সঠিক নয়। আমাদেরকে পড়ানোর পাশাপাশি অনুশীলনে সময় ব্যয় করতে হবে। আমীনুন নাহুতে অনুশীলন পদ্ধতি এমন হবে যে, ১৬ প্রকার ইসমে মু‘রাব পর্যন্ত পড়ানোর পরে সর্বনিম্ন এক মাস বিভিন্ন আরবী কিতাব বা কুরআন-হাদীছের নুছূছ পড়ে ছাত্ররা ইবারতের প্রতিটি শব্দের বিশ্লেষণ করবে। তারা বলবে, প্রতিটি শব্দ মুরাব নাকি মাবনী, মু‘রাব হ’লে মু‘রাবের কোন প্রকার এবং মাবনী হ’লে মাবনীর কোন প্রকার। ১৬ প্রকার পর্যন্ত অনুশীলনী এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এরপরে যখন আমেলের আলোচনা শেষ হয়ে যাবে তখন আরবী ইবারতের প্রতিটি শব্দের মু‘রাব-মাবনীর প্রকার নির্ণয়ের পাশাপাশি শব্দটি কোন হালাতে রয়েছে, রাফা, নছব নাকি জার এবং কে তার মাঝে আমল করেছে। এতটুকুও বলবে। এটাই হচ্ছে আমীনুন নাহুতে নাহবী অনুশীলন।
হেদায়াতুন্নাহু পড়ানোর পূর্বে যা অবশ্যই নিশ্চিত করবেন : হেদায়াতুন্নাহু একটি ভারি কিতাব। যা পরিপূর্ণ বোঝার জন্য একটু বয়সের প্রয়োজন। সেদিকে লক্ষ্য করে আমরা অষ্টম বা নবম শ্রেণীতে হেদায়াতুন্নাহু পড়িয়ে থাকি। অনেকেই ক্লাসের পরে ক্লাস পার করে আমাদের সামনে হেদায়াতুন্নাহুর দারসে এসে বসে। অথচ তারা নাহুর পরিভাষাগুলোই বোঝে না। এদিকে হেদায়াতুন্নাহু পরিভাষা বোঝার কিতাব নয়। মাসআলা বোঝার কিতাব। ফলাফলে তাদেরকে যতই সহজভাবে দারস বোঝানোর চেষ্টা করা হোক না কেন তাদের কাছে তা কঠিনই থেকেযায়। এই সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য আমাদেরকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে, হেদায়াতুন্নাহুর দারসে বসা প্রত্যেকটি ছাত্রের নাহবী পরিভাষাগুলো যথাযথ আয়ত্বে আছে কি-না।
আমরা মনে করি, একজন ছাত্র নাহবেমীর বা আমীনুন নাহু পড়েছে মানেই সে এখন হেদায়াতুন্নাহু পড়ার উপযুক্ত। কিন্তু এটা মৌলিক মানদন্ড হ’তে পারে না। কারণ নাহবেমীর হেদায়াতুন্নাহুর প্রথম খন্ড নয়। দুটোই স্বতন্ত্র নাহুর কিতাব। একটি হালকা, অপরটি ভারি। তাই নাহবী পরিভাষাগুলো আয়ত্বে থাকাই হেদায়াতুন্নাহুর উপযুক্ত হওয়ার মৌলিক মানদন্ড হ’তে পারে। যদি আমরা এই বিষয়টি শক্তভাবে নিশ্চিত করতে না পারি তবে আমাদের হেদায়াতুন্নাহুর দারস হতাশায় পরিপূর্ণ থাকবে। এখান থেকে উত্তরণের কোন দ্বিতীয় পথ নেই।
শিক্ষক নির্দেশিকা : পাঠদান কেমন হবে তা বইয়ের ওপর নির্ভর করে না। শিক্ষকের ওপর নির্ভর করে। শিক্ষকের মস্তিষ্কে যদি শাস্ত্রীয় জ্ঞান থাকে তবে দারস হবে শাস্ত্রীয়। যদি তা না থাকে তবে দারস হবে কিতাব কেন্দ্রিক। এটা স্বাভাবিক। সুতরাং আপনি যে বিষয়ে পাঠদান করেন সে বিষয়ে নিজেকে একজন শাস্ত্রীয় ব্যক্তি হিসাবে গড়ে তুলুন। আপনিই আগে ভালভাবে শিখুন। কখনো বলবেন না, আমাদের শিক্ষকগণ এভাবে পড়িয়েছেন। আপনার শিক্ষক বিশ বছর আগে যা পড়িয়েছেন তা তোতাপাখির মত মুখস্থ করে দারসে বসে আওড়াবেন না।
আমরা যখন কাফিয়া পড়েছি তখন ‘লাফয’ নিয়েই আলোচনা হয়েছে এক সপ্তাহ। ‘হাযাজির’ শব্দটি মুনছারিফ নাকি গাইরে মুনছারিফ এই নিয়ে তিন দিন আলোচনা হয়েছে। তানাযু এর বাহাছে বছরাবাসী ও কূফাবাসীকে নিয়ে বিশ্বযুদ্ধ চলেছে সপ্তাহব্যাপী। এত বড় ইলমের সাগর হওয়ার পরেও শতকরা নববইজন ছাত্র হারাকাত ছাড়া আরবী পড়তে পারে না। কারণ মৌলিক ইলম তাদের নেই। সুতরাং আপনি সেই শিক্ষকদের মত হবেন না। লেখক ‘বিসমিল্লাহ’ ছাড়া কিতাব শুরু কেন করলেন এই বিষয়ে দশদিন আলোচনা করবেন না। আপনি প্রথম দিনই মূল আলোচনায় যান। বাকী নয়দিন মাসআলাগুলোর প্রায়োগিক স্থান দেখান।
হেদায়াতুন্নাহুর দারসে বসার আগে আপনিই ভালভাবে বুঝুন, ‘তাক্বদীরে ইনফিছাল’ কাকে বলে! ‘ইযাফতে লাফযী’ কাকে বলে! ছাত্ররা প্রশ্ন করলে আপিন যেন বুঝিয়ে দিতে পারেন। মনে করুন, আপনি ক্লাসে বললেন, নিয়মিত পত্রিকা পাঠ করা ভাল। একজন ছাত্র আপনাকে প্রশ্ন করল, পত্রিকা কি? সে এটা না চিনতেও পারে। আপনার উচিৎ হবে তাকে বিভিন্ন সংজ্ঞার মাধ্যমে বুঝাতে চেষ্টা করা। সে যদি আক্রমণ করার জন্যও প্রশ্ন করে তবুও ধমক দিবেন না। উত্তর দেয়ার মাধ্যমে তাকে প্রতিহত করুন। এমনও বলবেন না যে, আরে পত্রিকা চেন না? ঐযে পত্রিকা আছে না? ওগুলোই তো পত্রিকা! এটাকে বলে গোঁজামিল। যা ছাত্ররা পসন্দ করে না।
আরবী ব্যাকরণের দারসে অবশ্যই ছাত্রদের প্রশ্নকে মূল্যায়ন করুন। দারসের শেষে পাঁচ মিনিট সময় নিয়ে হ’লেও তাদের বলুন, তোমাদের কোন প্রশ্ন থাকলে করতে পারো। ছাত্রদের প্রশ্নের দায়সারা উত্তর দেবেন না। প্রশ্ন এড়িয়ে যাবেন না। আমরা অনেক শিক্ষককে ছাত্রদের প্রশ্নের ভুল উত্তর দিতেও দেখেছি। তারা মনে করেন, ছাত্ররা তো কিছু জানে না। তাদেরকে যা বোঝানো হবে সেটাই বুঝবে। এটা আপনাদের ভুল পদ্ধতি। আপনি না জানলে বলুন, ‘আমি এটা জানি না। তবে জেনে তোমাদেরকে জানাতে পারি’। সর্বোপরি ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবুন। কিভাবে তারা সহজে শিখতে পারে সেটা নিয়ে ভাবুন। আমরা বিশ্বাস করি, কিতাবের মাধ্যমে ছাত্র গড়ে না। ছাত্র গড়েন শিক্ষক। শিক্ষক যদি যোগ্য হোন তবে ফারসী-বাংলা নিয়ে কোন কিলোকাল থাকবে না। এটাই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
সারওয়ার মিছবাহ
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।