
শিক্ষা সংস্কার একটি কঠিন কাজ। কারণ শিক্ষার সাথে জড়িত সবাই শিক্ষিত। আর একজন শিক্ষিত ব্যক্তি আরেকজন শিক্ষিতের সাথে কোন সংস্কারমুখী বিষয়ে একমত হ’তে চান না। তারা মনে করেন, এত বড় বড় ব্যক্তি থাকতে যার তার কথায় সংস্কার আসবে! এটা কি করে হয়! এজন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় আপনি যতই ভাল পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না কেন, তা অধিকাংশের কাছেই উপেক্ষিত হয়, হচ্ছে, হবে। খেয়াল করলে দেখবেন, যারা বিভিন্ন বিষয়ে মন্তব্য করে সকল সংস্কারমুখী পদক্ষেপ বাতিল করতে চান তারা কেউই এর বিকল্প পদক্ষেপ প্রস্তাব করেন না। কারণ শিক্ষার্থীদের সমূহ সমস্যা নিয়ে ভাবার কোন সুযোগ তাদের নেই। তারা যেটা করেন, সেটা হ’ল এই দুনিয়ার সবচেয়ে সহজ কাজ।
সবচেয়ে সহজ সেই কাজটি কী জানেন? অপরের ভুল ধরা। কয়েকজন একত্রিত হয়ে কোন সমস্যার সমাধান নিয়ে ভাবছেন। তাদের ভাবনা থেকে সমাধানের নতুন নতুন প্রস্তাবনা আসছে। আপনি সেই প্রস্তাবনার ওপর মন্তব্য এঁটে দিচ্ছেন, এটা সম্ভব নয়; সেটা সম্ভব নয়। এটাতে এই সমস্যা; ওটাতে সেই সমস্যা। মনে করুন, কয়েক রাত জেগে কেউ একটি কবিতা লিখে নিয়ে আসল। আর আপনি বলে দিলেন, ‘লাইনগুলো একটু ছোট হয়ে গেছে। আরেকটু বড় করা দরকার ছিল’। কারো রাতজাগা পরিশ্রমের ফসলের ওপর এভাবে বাঁকা মন্তব্য করাই হ’ল সবচেয়ে সহজ কাজ। তবে শূণ্য থেকে কোন বস্ত্তকে আকৃতি দান করা অনেক কঠিন।
বক্ষ্যমাণ আলোচনাও একটি সংস্কারমুখী প্রস্তাবনা। এই প্রস্তাবনায় আমরা মাদ্রাসা কারিকুলামে কারিগরী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরব। আলোচনার শুরুতেই আবেদন করছি, আমাদের চিন্তার ভুলগুলো শুধরে দিবেন। কবিতার লাইন যদি ছোট হয়ে যায় তবে নিজ অনুগ্রহে দুয়েক শব্দ লাগিয়ে লাইনগুলো বড় করে দিবেন। দয়া করে সবচেয়ে সহজ কাজটি করবেন না। অন্যথা আমরা চিন্তা করতে ভয় পাবো। ফলাফলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সমস্যাকেই স্বাভাবিক ভেবে বাঁচতে শিখবে। যার জন্য মূলতঃ দায়ী হব আমরা এবং আপনারাও।
একটি কারিকুলামের মেয়াদ কত : আমাদের দেশের শিক্ষা কারিকুলামে যুগের পরে যুগ কোন পরিবর্তন নেই। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় তো বিষয়টি আরো শোচনীয়। তারা মনে করেন, কুরআন-হাদীছ যেমন অপরিবর্তনীয়, তেমনই এর শিক্ষাধারাও অপরিবর্তনীয়। সেই ক্বাদীম কারিকুলামকে তারা আজও অহি-র মতই মেনে চলছেন। তারা বিশ্বাস করেন, কয়েকশো বছর আগের হাতে লেখা কিতাবে তুলনামূলক বেশী ফুয়ূয ও বারাকাহ আছে। সুতরাং কারিকুলাম পরিবর্তন করা যাবে না। সিলেবাসও পরিবর্তন করা যাবে না। এমনকি হাতে লেখা নুসখা রেখে কম্পিউটারে লেখা নুসখাতেও উন্নীত হওয়া যাবে না।
আজকের যুগে সকল পুরাতন কিতাবের স্বচ্ছ কম্পিউটার প্রিন্ট প্রকাশিত হয়েছে। যা হাতে লেখা কিতাবগুলোর চাইতে অত্যধিক সুন্দর, স্পষ্ট ও নির্ভুল। তারপরও অনেক মুরুববী আলেম হাতে লেখা নুসখা ছাড়া দারসে বসতে দেন না। তাতে আমি রীতিমত বিস্মিত হয়েছি। এই বিষয়ে আমি আদব রক্ষা করে দুয়েকজনের সাথে কথাও বলেছি। তাদের কাছে আদবের সাথে জানতে চেয়েছি, হাতে লেখা নুসখাতে অনেক ভুল থাকার পরেও কেন তারা এটাকেই বেশী প্রাধান্য দেন? যা জবাব পেয়েছি তা শুনলে আপনিও রীতিমত আশ্চর্য হবেন।
তারা বলেছেন, এই হাতে লেখা কিতাবগুলোতে অনেক শরাহ-শুরুহাত লেখা হয়েছে। হাতে লেখা নুসখায় যে ভুল রয়েছে, ব্যাখ্যাকার সেটাকে ভুল হিসাবে না ধরে তার একটা ব্যাখ্যা দিয়ে সঠিক করার চেষ্টা করেছেন। এটা অতিরিক্ত ইলম। যা কম্পিউটার প্রিন্টেড নুসখায় নেই। আর হাতে লেখা নুসখায় একটা আলাদা বরকত আছে, যা বর্তমান ছাপায় নেই। চিন্তা করুন! যারা হাতে লেখা থেকে কম্পিউটার ছাপায় আসতে চান না তারা কারিকুলাম পরিবর্তন করবেন কিভাবে?
তাদের সামনে যদি বলা হয়, ফিক্বহের এই কিতাবটি বেশ সেকেলে হয়ে গেছে। এর স্থানে যুগোপযোগী মাসায়েল সমৃদ্ধ অমুক কিতাবটি সিলেবাসভুক্ত করলে কেমন হয়? তারা এই কথার বিরোধিতা করতে কোন কালক্ষেপণ করেন না। ফলাফলে যুগের গায়ে আধুনিকতার হাওয়া লাগতে লাগতে যেখানে দুনিয়া এখন হাতের মুঠোয়, সেখানে আমরা এখনো সেই কারিকুলাম ফলো করি, যা পায়রার পায়ে বেঁধে চিঠি পাঠানোর যুগে সংকলন করা হয়েছে। যে যুগে ব্যবসা মানেই ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট, স্টক, প্লট-ফ্লাট বিজনেস; সে যুগে আমরা কিতাবে শিখছি শুধু কতগুলো উট থাকলে বিনতে লাবুন, বিনতে মাখায যাকাত আসবে। আবার আমাদের পরীক্ষাতেও এগুলোই আসছে! চিন্তা করুন! বাস্তবতা থেকে আমাদের কারিকুলাম ঠিক কতটা পিছিয়ে।
আমরা যে ব্যবসা-বাণিজ্যের অধ্যায় পড়ছি তা শত শত বছর আগে লেখা। সেখানে আধুনিক অর্থনীতি নেই। ব্যাংকিং সিস্টেম নিয়ে কোন আলোচনা নেই। মোটকথা আধুনিক যুগের কিছুই সেখানে নেই। ফলাফলে যদিও আমরা শতভাগ মানুষ মোবাইল ব্যাংকিং এর সাথে জড়িত তবু্ও আমাদের মুফতী ছাহেবগণ জানেন না, বিকাশ বা নগদ তথা মোবাইল ব্যাংকিং এর বিধি-বিধান কী! আধুনিক এই অর্থনীতির আলোচনা সংবলিত কিতাব যে রচিত হয়নি এমন নয়। তবে সেগুলো সিলেবাসে আনা যাবে না। কারণ কারিকুলামের মেয়াদ শেষ হয়নি! আমরা জানি না, আরো কয়টা প্রজন্মকে মূর্খ করার পরে এই কারিকুলামের মেয়াদ শেষ হবে!
কারিকুলামের প্রকারভেদ : আমাদের দেশে বিভিন্ন মেয়াদী লেখাপড়ায় মাওলানা হওয়া যায়। কোন শিক্ষাক্রমে ১৫ বছর। কোনটাতে ১২ বছর। আবার কোনটাতে ৬ বছর। আবার ইদানীং ৫ বছরেও অনেকে মাওলানা বানিয়ে দেয়ার ওয়াদা করে মাদ্রাসায় ছাত্র ভর্তি নিচ্ছেন। আমার মনে হয়, শুধুমাত্র মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া আর কোন শিক্ষাব্যবস্থা এতটা অগোছাল নয়। যেখানে পড়াশোনা শেষ করার কাজটি ৫ বছরেও করা যায় আবার ১৫ বছরেও করা যায়।
আমরা মনে করি, যারা ৫ বছরে দুইটা ছরফের কিতাব, দুইটা নাহুর কিতাব, দুইটা আদব ও ইনশার কিতাব এবং দুইটা হাদীছের কিতাব পড়িয়ে মাওলানার সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছেন তারা জাতির ওপর বেহদ যুলুম করছেন। আপনারা ‘মাওলানা’ বানিয়ে দেয়ার কারণে ছেলেটি মনে করছে, বিশ্বের সব লেখাপড়া শেষ হয়ে গেছে। এখন আমি জাতির কান্ডারী। এখন আমি ওলামায়ে কেরামের অন্তর্ভুক্ত। এখন আমি সাধারণ জনতার মন্তব্যের ঊর্ধ্বে। আবার এদিকে তার না আছে জাগতিক কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা, না আছে কুরআন-হাদীছের গভীর জ্ঞান।
আপনাদের অনুরোধ করছি, দয়া করে জাতির সাথে এই ধরনের খেয়ানত করবেন না। ইলমী ফুনূনাত তাদের শিখাতে না পারলেও অন্তত সেগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিন। যেন তারা ভবিষ্যতে এই সুবিস্তর জ্ঞানের শাখা-প্রশাখায় বিচরণ করতে পারে। বিচরণ করতে না পারলেও বুঝতে পারে, আমার সব পড়া শেষ হয়নি। আমাদের মনে হয়, সাধারণ মেধার অধিকারী কোন ব্যক্তির ন্যূনতম ১২ বছর লেখাপড়া না করে আলেম হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং শর্ট কোর্সের নামে ৫/৬ বছরের সিলেবাস তৈরি করা কোনভাবেই গ্রহণীয় নয়।
আপনি যদি বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরে অনেকের আলেম হওয়ার ইচ্ছা হয়। আমরা তাদের জন্য এই সুবিধা রেখেছি। তবে আমরা বলব, আপনার পদ্ধতি ভুল হয়েছে। কারণ আপনি আগ্রহীদের জন্য সিলেবাস তৈরি করলেন। এদিকে আপনার মাদ্রাসা ফাঁকিবাজ মানসিকতার ছাত্রে ভরা। ফাঁকিবাজ বলছি এজন্য যে, তারা দুই তিন বছর লেখাপড়া করে আলেম হয়ে যেতে চায়। যেখানে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পরে ইলম অর্জনে আসার কথা ছিল, সেখানে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগেই আলেম ডিগ্রি গলায় ঝুলিয়ে তারা পরিবেশ নষ্ট করছে। সুতরাং কারিকুলাম একটাই থাকবে। যা মানসম্মত এবং সার্বজনীন হবে।
যদি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আলেম হওয়ার দুয়ার খুলতে চান তবে কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগুলো থেকে বয়সের সীমারেখা মুছে দিন। যে ১০ বছর বয়সে পড়ালেখা শুরু করেছে সে ২২ বছর বয়সে একাডেমিক লেখাপড়া শেষ করবে। আর যে ২৫ বছর বয়সে শুরু করেছে সে শেষ করবে ৩৭ বছর বয়সে। যদি এভাবে সম্ভব না হয় তবে একাডেমিকের বাইরে পড়ালেখা করে আলেম হ’তে পারে। এটাও যদি সম্ভব না হয় তবে তাদের জন্য দ্বীনীয়াত শিক্ষার ব্যবস্থা করেই ক্ষান্ত থাকুন। তবুও তিন/চার বছরে মাওলানা বানানোর এই পদ্ধতি পরিহার করুন।
স্কিল ডেভলপমেন্ট ইনস্টিটিউট : এখন যেভাবে একাডেমী বেড়েছে তেমনই বেড়েছে যোগ্যতা বর্ধিতকরণ প্রতিষ্ঠান। অনলাইন অফলাইন বিভিন্নভাবে বিভিন্ন কোর্সে যুক্ত হয়ে সবাই স্কিল ডেভলপ করার চেষ্টা করছে। অনেকের কাছে তো একাডেমিক শিক্ষার চেয়ে স্কিল ডেভলপই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা অবশ্য তাদের প্রশংসাই করি। কারণ দিনশেষে যোগ্যতার ওপরেই সবকিছুর বিচার হয়।
আমরা যদি স্কিল ডেভলপমেন্ট ইনস্টিটিউটগুলোর উৎপত্তির দিকে লক্ষ্য করি, তবে সেখানে আমাদের কারিকুলামের মুখ থুবড়ে পড়ার চিত্র ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবো না। আমরা যেখান থেকে অপারগতা স্বীকার করেছি সেখান থেকেই যোগ্যতা বর্ধিতকরণ প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে। যে প্রয়োজনীয় যোগ্যতাগুলো কারিকুলাম আমাদেরকে দিতে ব্যর্থ হয়েছে, সে যোগ্যতাগুলো তারা আমাদের দিয়ে যাচ্ছে। এরপরেও কারিকুলাম সংস্কারের বিষয়ে আর কোন আপত্তি থাকতে পারে না।
একাডেমিক কারিকুলাম আপনাকে সার্টিফকেট দেবে। আর জীবন ধারণে সবকিছু আপনাকে নিজে নিজে শিখে নিতে হবে। এজন্যই স্কিল ডেভলপমেন্ট ইনস্টিটিউট এর কদর বেড়েছে। আসুন! দেখি, মাদ্রাসায় পড়ে কী কী আপনাকে নিজে থেকে শিখে নিতে হবে! প্রথমত ইলমে দ্বীন শিক্ষা করে তা কর্মজীবনে কাজে লাগানোর যতগুলো মাধ্যম রয়েছে সেগুলো আপনাকে শিখে নিতে হবে। আপনাকে গুছিয়ে কথা বলা শিখতে হবে। বক্তব্য দেয়া শিখতে হবে। গুছিয়ে একটা প্রবন্ধ লেখা শিখতে হবে। দাওয়াতী যতগুলো পদ্ধতি আছে সব আপনাকে শিখতে হবে।
এরপরে আপনাকে কম্পিউটার ব্যবহার করা শিখতে হবে। আরবী, উর্দূ, ফার্সী ছাড়া বাকি ভাষাগুলো শিখতে হবে। এমনকি আরবী বা উর্দূতে সাবলিলভাবে কথা বলাও আপনাকে শিখে নিতে হবে। আপনি যে পেশাতেই যান সেই পেশার কাজ আপনাকে শিখে নিতে হবে। এমনকি আপনি যদি শিক্ষক হ’তে চান তবে সুন্দরভাবে পাঠদান আপনাকে শিখতে হবে। আর এই সবগুলো বিষয় আপনি শিখতে পারবেন স্কিল ডেভলপমেন্ট ইনস্টিটিউট এর কোর্সের মাধ্যমে। তাহ’লে বোঝা গেল, যোগ্যতা বর্ধিতকরণ প্রতিষ্ঠানগুলো সাধে তৈরি হয়নি।
মাদ্রাসাগুলোকে স্কিল ডেভলপমেন্ট ইনস্টিটিউট করা কি সম্ভব : এই শিরোনামে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই আমাদেরকে খেয়াল করতে হবে, স্কিল ডেভলপ কোর্সগুলো কোথায় হয়? কারা করায় এই কোর্সগুলো? আপনি দেখবেন, অধিকাংশ কোর্সই প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক হয়ে থাকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার ছুটি বা রামাযান কেন্দ্রিক কোর্স অনুষ্ঠিত হয়। এই কোর্সগুলো করানোর জন্যও আসমান থেকে কোন ফেরেশতা আসেন না। সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাই ক্লাস করান। যে শিক্ষকের কাছে একবছর পড়ার পরেও ছাত্ররা বিভিন্ন বিষয়ে দুর্বল ছিল সে শিক্ষকের কাছেই তারা একমাস কোর্স করে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠছে। একই প্রতিষ্ঠানে একই ছাত্র একই শিক্ষকের কাছে নিজেদের দুর্বলতা কাটাতে পারছে। শুধুমাত্র নিয়ম-কানূন ও সিলেবাসে একটু পরিবর্তন আনায় এই বিষয়টি সম্ভব হচ্ছে। যদি প্রচলিত নিয়ম, সিলেবাস ও পাঠদান পদ্ধতি একটু পরিবর্তন করে ছাত্রদের দুর্বলতা কাটানো সম্ভব হয় তবে আমরা কেন অফলপ্রসূ নিয়মের বেড়াজালে নিজেদের সময় ও মেহনত নষ্ট করছি!
আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ানো হয় সরকারী বা বেসরকারী বোর্ড স্বীকৃত বই। এদিকে কোর্সে পড়ানো হয়, অমুক স্যারের শীট, প্রয়োগ করা হয় তমুক স্যারের ফর্মুলা। শিক্ষাবোর্ড স্বীকৃত বইয়ের তুলনায় অমুক/তমুক স্যারের ফর্মুলাতে যদি ছাত্ররা পরীক্ষিতভাবে বেশী যোগ্য হয়ে ওঠে তবে স্যারের ফর্মুলাকেই স্বীকৃতি দেয়া হোক। ছুঁড়ে ফেলা হোক গদবাধা নিয়মে রচিত পাঠ্যবই। যদি তাদের পাঠদান পদ্ধতিতে ছাত্ররা নিজেদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে তবে তাদের পদ্ধতিকেই সার্বজনীন করা হোক।
রুটিন, সিলেবাস ও কারিকুলাম পরিমার্জনের মাধ্যমে প্রতিটি মাদ্রাসাকে একেকটি স্কিল ডেভলপমেন্ট সেন্টারে রূপান্তরিত করা সম্ভব। তবে সেই সদিচ্ছা হয়ত আমাদের অভিভাবক পর্যায়ের ব্যক্তিদের মাঝে নেই। সবার মাঝেই একটি দ্বিধা কাজ করে। হীনমন্যতা কাজ করে। হয়ত তারা ভাবেন, উদ্যোগ নিয়ে কী হবে! আমাদের তো সামর্থ্যই নেই। উদ্যোগে যদি বিপরীত ফলাফল আসে তবে সবার কাছে আমরা গ্রহণযোগ্যতা হারাবো। আমরা যদি ব্যতিক্রম নিয়ম চালু করি তবে সবাই আমাদের নিয়ে হাসবে ইত্যাদি।
দেখুন! আপনারা হয়ত মাদানী নেসাবের ইতিহাস জানেন। বাংলাদেশে যখন আরবী শিখার বই বাংলায় লেখা হ’ল তখন বড় বড় মাদ্রাসার মুরুবিবয়ানে কেরাম বইটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। কারণ বাংলা হ’ল হিন্দুদের ভাষা। আরবী তো শিখতে হবে উর্দূ থেকে। আজ সেই মুরুববীগণের মাদ্রাসাতেও সেই বাংলা বই পড়ানো হয়। সুতরাং একটা নতুন নিয়ম যতই ভাল হোক, মানুষ প্রথমে সেটাকে মানবে না এটাই স্বাভাবিক। দুনিয়ার বুকে সবচেয়ে নির্ভুল গ্রন্থ, পবিত্র কুরআনুল কারীম যখন অবতীর্ণ হ’ল তখন মানুষ কুরআনকেই মানেনি। আর আপনার সংস্কারমুখী পদক্ষেপ তো অনেক পরের বিষয়।
তবে মানুষ মানবে তখন, যখন দেখবে প্রচলিত ধারা মুখ থুবড়ে পড়েছে। প্রচলিত ব্যবস্থার গাছ মরে শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেছে। এই গাছে আর ফল আসার কোন সম্ভাবনা নেই। তখন তারা মুখ নিচু করে সংস্কারমুখী পদক্ষেপকে মেনে নিবে। তাই আমরা চাই, আমাদের মাদ্রাসাগুলোর পাঠ্যবই, কারিকুলাম, নিয়ম-নীতি ও পাঠদান পদ্ধতি আবারো ঢেলে সাজানো হোক। এমন শিক্ষা ব্যবস্থার আগমন হোক, যেখানে ছাত্রদেরকে রামাযানে নাহু-ছরফের দুর্বলতা কাটানোর জন্য ঢাকামুখী হ’তে হবে না। পড়াশোনার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো শেখার জন্য আলাদাভাবে কোর্সের দরকার হবে না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই হবে একেকটি স্কিল ডেভলপ ইনস্টিটিউট।
বর্তমান বিশ্ব যেমন শিক্ষা চায় : আমরা এতক্ষণ কারিকুলাম পরিমার্জনের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করলাম। এখন আমরা কারিগরী শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার যৌক্তিকতা দেখব। দেখুন! বর্তমান বিশ্ব শুধু কিতাবী যোগ্যতা চায় না। বরং কিতাবী যোগ্যতার পাশাপাশি আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার সক্ষমতা চায়। এটা শুধু বিশ্বের চাহিদা নয়। এটা ইসলামেরও চাহিদা। যে সময় লড়াই হয়েছে তালোয়ার ও তীর-ধনুকের সাহায্যে, তখন মুসলিমরাই ছিল যুদ্ধের কলা-কৌশলে সর্বসেরা। কালের পরিক্রমায় আমরা সেই ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছি। আজ লড়াই হচ্ছে বিভিন্ন আধুনিক মারণাস্ত্রের মাধ্যমে। আমাদের কাছে না আছে রণকৌশল; না আছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। আমরা আধুনিকতা সম্পর্কে আজ কিছুই বুঝি না। কারণ আমাদের বুঝতে দেয়া হয় না। আমাদের কারিকুলাম আমাদের এসব শিখায় না।
দেখুন! আজ বিশ্বে অমুসলিম শক্তিগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে গেছে। তাদের সাথে মোকাবেলা করতে হ’লে আমাদেরকেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হ’তে হবে। আজ যারা বিশ্বের পরাশক্তি হয়ে বসে আছে একসময় তারা মানব সভ্যতা থেকে অনেক দূরে ছিল। মুসলিমদের কাছে তারা সভ্যতা শিখেছে। সে সময়ে মুসলিমগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশ্ব জয় করেছিলেন। আজ জ্ঞান-বিজ্ঞান ইহুদী-নাছারার হাতে। আমরা তাদের মুখাপেক্ষী।
আজ আমরা উন্নত হ’তে গিয়ে আমাদের যুবকদের হাতে ইন্টারনেট দিয়েছি। তবে সাইবার সংক্রান্ত জ্ঞান প্রদান করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমরা হয়ত মনে করেছি, এটা কুরআন-হাদীছে নেই। সুতরাং এটা একজন মুসলিমের শেখার দরকার নেই। ফলাফলে যে সময়ে অমুসলিমরা সাইবার আক্রমণে দক্ষ হয়ে উঠছে তখনই আমাদের মুসলিম যুবকরা টিকটকে ভিডিও আপলোড করে নিজেদের হিরো ভাবছে। আমাদের দেশগুলোতে ইন্টারনেটের সবচেয়ে বেশী অপব্যবহার হওয়ার কারণ হচ্ছে ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব।
কারিগরী শিক্ষা কেন দরকার : বর্তমান বিশ্বে চাকুরীর বাজারে গেলে সর্বপ্রথম আপনাকে সুন্দরভাবে একটি সিভি তৈরি করতে হবে। অথচ আমাদের এই লম্বা কারিকুলাম আপনাকে সুন্দরভাবে একটি সিভি বানানো শিখাবে না। আপনাকে কম্পিউটার ব্যবহার করা শিখাবে না। আপনাকে আধুনিক যুগের প্রয়োজনীয় কিছুই শিখাবে না। ফলাফলে সাধারণ শিক্ষিতরা মনে করবে, হুযুর মানেই সেকেলে। হুযুর মানেই এমন একজন ব্যক্তি, যিনি কিছু পুঁথিগত বিদ্যা ছাড়া কিছুই জানে না। আমরা তো ভবিষ্যতে ইসলামী খেলাফতের স্বপ্ন দেখি। এখন আমরা যদি কারিগরী ও প্রযুক্তিগত শিক্ষাকে আল-বিদা জানিয়ে দেই তবে ইসলামী ইমারতে পারমাণবিক বোমা তৈরি করবে কে? ইসলামী ইমারতে আমাদের প্রযুক্তিগত চাহিদাগুলো মিটবে কিভাবে? নাকি সেদিনও আমরা নিজেদের সকল চাহিদা পূরণের জন্য কাফেরদের দিকে চেয়ে থাকব?
সুতরাং নির্দিষ্ট একটি সময় পর্যন্ত আমরা আমাদের ছাত্রদেরকে সবকিছুই শিখাবো। তাকে যেমনভাবে কুরআন শিখাবো তেমনভাবে বিজ্ঞানও শিখাবো। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক এভাবেই চলবে। মাধ্যমিকের পরে আসবে রাস্তা নির্বাচনের সময়। কেউ কুরআন নিয়ে পড়াশোনা করবে। বিদগ্ধ আলেম হবে। উম্মাহকে জান্নাতের পথ দেখাবে। কেউ বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করবে। যুদ্ধবিমান তৈরি করবে। প্রযুক্তিতে আমাদেরকে এগিয়ে নিবে। আমরা আমাদের স্থান থেকে তাদের সর্বদা ইখলাছ ও লিল্লাহিয়াতের নছীহত করে যাবো।
আমাদের কিতাবী আলেমের প্রয়োজন আছে। সাথে সাথে মুখলিছ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারও দরকার আছে। তবে আমরা চাই না, একজন আলেম ডাক্তারও হোক। আবার একজন ডাক্তার আলেমও হোক। এই ঘোলাটে শিক্ষা আমরা চাই না। আমরা চাই, সবারই প্রতিটি বিষয়ের প্রাথমিক জ্ঞান থাকুক। তবে সবাই নিজ নিজ কাজে সিদ্ধহস্ত হোক। কারণ আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হ’তে চাই। আর স্বয়ংসম্পূর্ণ হ’তে একটি দক্ষ প্রজন্ম দরকার।
সমস্যাটা যেখানে : আমরা আজকাল শিক্ষার্থীদের ইলম অর্জনের প্রতি অনিহা দেখে আশাহত হচ্ছি। এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করছি। কেউ দোষারোপ করছি প্রতিষ্ঠানের। কেউ দোষারোপ করছি শিক্ষকদের। আবার কেউ কারিকুলামের। এই সমূহ সমস্যাগুলোকে সামনে রেখে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপও গ্রহণ করছি। তবে ফলাফল তেমন কিছুই আসছে না। কারণ সমস্যার স্থানে আমরা কেউই হাত দিচ্ছি না। বিষয়টা এমন হয়েছে যে, একজন ক্যান্সারের রোগীকে আমরা ক্যান্সারের চিকিৎসা বাদে সকল চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করছি।
আমার মনে হয়, এটা কোন একক সমস্যা নয়। উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। মনে করুন, কোন নদীর পানি জোয়ারের সময় ১০ ফুট ওপরে উঠে যায়। তাহ’লে সেই নদীর জন্য বাঁধ নির্মাণ করতে হবে ২০ ফুট উঁচু। আর যদি ২০ ফুট ওপরে পানি ওঠে তবে বাঁধ হবে ৩০ ফুট। অর্থাৎ পানির চেয়ে বাঁধ উঁচু হ’তেই হবে। এককালে আমাদের নদীর ঢেউ ছিল ৫ ফুট। বাঁধ ছিল ১৫ ফুট। আজ আমাদের নদীর ঢেউ ৫০ ফুট। বাঁধ হয়ে গেছে ৫ ফুট। যা বাঁধ নামের এক হাস্যকর বস্ত্ত!
আপনি খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, যে সময় একজন ছাত্র কলেজ লাইফে একটা নভেল সবার কাছ থেকে লুকিয়ে পড়ত তখন আমাদের শাসন ছিল পর্যাপ্ত। আর কতইবা এসব কথা গোপন রাখা যায়। নিজের দেহে ঘা হয়েছিল ১৫ বছর আগে। লোক লজ্জায় কাউকে বলিনি। এখন ঘা পঁচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এখন তো বলতে বাঁধা নেই। লুকিয়েও আর লাভ নেই। আজ স্কুল লেভেলের শিক্ষার্থীরাও পর্ণাসক্ত। ক্লাসে বসে তারা একে অপরের সাথে এগুলো বিষয়ে আলোচনাও করে। শিক্ষাঙ্গনগুলো আজ অবাধ যৌনাচারে পূর্ণ। তবে আজ আমাদের শাসন করার অধিকার নেই। শাসন ব্যবস্থা আছে। তবে তা ঠিক ৫০ ফুট উঁচু ঢেউয়ের সামনে ৫ ফুট বাঁধের মত!
দেখুন! যখন গোনাহ তার সীমানা অতিক্রম করে তখন মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যায়। তখন তাকে শাসন করতে হয়। শাস্তিপ্রাপ্ত হওয়ার পরে যখন তার নফস কিছুটা দুর্বল হয় তখন তার জন্য নছীহত কাজে আসে। সবকিছুই আদর করে বুঝানো যায় না। এটাই নিয়ম। তবে এই নিয়ম থেকে আমরা অনেক দূরে। আমরা সর্বদাই অধঃপতনের দিকে ধাবিত হচ্ছি। বরং আমাদের ধাবিত করা হচ্ছে। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। ধাবিত করা হচ্ছে বলার বুদ্ধিবৃত্তিক অনেক কারণ আছে। এটা নিয়ে কথা বললে আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। শুধু এতটুকুই বলি, আমাদের দেশ মুসলিমপ্রধান দেশ। এই দেশে এতকিছু সম্ভব হয় আর পর্ণসাইটগুলো ব্যান্ড করা সম্ভব হয় না? চাইলেই সম্ভব হয়। তবে আমরা করবো না। কারণ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আমরা পরাধীন, শাসিত, শোষিত ও পথভ্রষ্ট এক সম্প্রদায়।
আজ অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শাসন তুলে নেয়া হয়েছে। ছাত্রদের শাসন করলে নাকি তারা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটাও এক বুদ্ধিবৃত্তিক ধোঁকা। আপনি ভেবে দেখুন! আপনি যখন শিক্ষা অর্জন করেছেন তখন প্রতিষ্ঠানে শাসন ছিল। সেই শাসনে মানসিকভাবে আপনার কি এমন ক্ষতি হয়ে গেছে! আর আজকের ছাত্ররা মানসিকভাবে পূর্ণ সুস্থতা নিয়ে কি এমন উন্নতি করে ফেলেছে? আসলে এটা ধূম্রজাল ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা প্রজন্মকে হাতে ধরে নষ্ট করে দেয়ার একটি নীল নকশা। রাসূল (ছাঃ)ও শিষ্টাচারের লাঠি উঠিয়ে রাখতে নিষেধ করেছেন (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১৮)।
এতে বুঝা যায় যে, ইসলামও প্রয়োজনীয় শাসন করতে নির্দেশ দিয়েছে। তবে বেধড়ক পিটানো, মেরে অসুস্থ করে ফেলা বা চোখে-মুখে বা মাথায় মারা মোটেও সমীচীন নয়।
আজ শিক্ষক রেগে ধমক দিলে ছাত্ররা ভয় না পেয়ে ফিক করে হেসে দেয়। কারণ তারা জানে, এই সাপ ফোঁসফাঁস করবে। তবে কামড় দেবে না। আর এটা তারা তাদের বাবা-মায়ের কাছেই জেনেছে। বাবা-মা প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর সময় অভয় দিয়ে বলেছেন, সমস্যা নেই। শিক্ষক তোমাকে কিছু বলবেন না। ছাত্রদের আদর করার দায়িত্ব শিক্ষকদের। তাদের বেআদবী সহ্য করার দায়িত্ব শিক্ষকদের। আবার যখন তাদের কাছে পড়াশোনা মূল্যহীন তখন পরীক্ষার খাতায় পাশ মার্ক দিয়ে দেয়ার দায়িত্বও শিক্ষকদের। দেখুন! যতদিন পর্যন্ত এই পরিবেশ বিরাজ করবে ততদিন পর্যন্ত সিলেবাস গুলিয়ে খাইয়ে দিলেও ছাত্র তৈরির হার শতকরা দুই বা তিনজনের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে। উন্নতির কোন পথ নেই।
এখানে সকল সমস্যা যে সিস্টেমের, বিষয়টা এমন নয়। আমি কারিকুলামের দুর্বলতা নিয়ে আগেই বলেছি। তবে কারিকুলাম পরিমার্জনে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর উদাহরণ আমাদের এই দেশে চলবে না। কারিকুলাম সর্বদা তৈরি করা হয় প্রয়োগের স্থানীয় পরিবেশ, মানুষের মেধা ও ধারণক্ষমতা ইত্যাদির দিকে বিবেচনা করে। বাগানে অধিক ফলের আশায় যদি কাশ্মীর থেকে খয়েরী আপেলের চারা এনে বাংলাদেশে লাগিয়ে খুব যত্ন করেন তবে এই চারা আপনাকে দিনশেষে নিরাশই করবে। কারণ কাশ্মীরের মাটি ও পরিবেশ এবং বাংলাদেশের মাটি ও পরিবেশ কখনো এক নয়। বাংলাদেশে অধিক ফলের জন্য আপনাকে সে সকল ফল চাষ করতে হবে যেগুলো এই দেশের পরিবেশের উপযোগী।
সুতরাং মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর কারিকুলাম আমাদের মাদ্রাসাগুলোর জন্য কখনোই উপযোগী নয়। কারণ তাদের পরিবেশ ও আমাদের পরিবেশ এক নয়। হ্যঁা, আপনি যদি সেই কারিকুলাম থেকে উপকৃত হ’তে চান তবে আপনাকেই সেখানে গিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। অন্যথা সবকিছু নকল করা শুরু করলে আমেরিকার স্কুল পড়ুয়া ছেলের ওয়াই-ফাই ব্যবহার আর আমাদের দেশের স্কুল পড়ুয়া ছেলের ওয়াই-ফাই ব্যবহারে যে পার্থক্য সেটাই ঘটবে। এই বিষয়গুলো সকলের মাথায় না ধরলেও আমাদের শিক্ষাবীদগণ এগুলো ঠিকই বোঝেন। তারপরও তাদের এ বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালনের কারণ আমাদের অজানা।
আসুন সমাধানের দিকে : যে যুগে মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের হওয়ার কারণে আমরা চাকুরীর বাজারে অবহেলিত। আমাদের সিভি বড় বড় টেবিলে উপেক্ষিত। সে যুগে আমরা এই প্রশ্ন করতেই পারি যে, আমার মাদ্রাসা আমাকে স্কিল দিবে না কেন? তারা আমাকে কী দিচ্ছে? তারা তো আমাকে দামী কোন সার্টিফিকেট দিতে পারেনি। তারা যদি আমাকে স্কিল দিতেও অপারগ হয় তবে আমি মাদ্রাসায় লেখাপড়া কেন করব? হ্যঁা, আমরা তাদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দিতে পারি যে, আমরা তাদেরকে আখেরাতে সফলতার পথ দেখাবো। মিথ্যা আশ্বাস বললাম এজন্য যে, আমরা আমাদের ছাত্রদের আখেরাতে সফলতার পথ দেখাতেও ব্যর্থ। কারণ আমরা না পারছি তাদেরকে কুরআন-হাদীছের গভীর জ্ঞান দিতে। না পারছি আদব-আখলাকের শিক্ষা দিয়ে একজন মুখলিছ বান্দা হিসাবে তৈরি করতে। মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেও তাদের বেশভুষা, আচার-ব্যবহার স্কুল পড়ুয়াদের মতই। তালিবুল ইলম হয়েও তারা লালন করে পশ্চিমা চিন্তাধারা। তাহ’লে তাদেরকে আমরা আখেরাত দিলাম কই?
এখন যদি আমি বলি, আমরা ছাত্রদের কুরআন-হাদীছ শেখানোর কথা বলে একযুগ সময় নিয়ে যতটুকু কুরআন হাদীছ শেখাচ্ছি ততটুকু কুরআন-হাদীছের জ্ঞান মাত্র দুই বছর স্টাডি করেই অর্জন করা যায়, তবে অনেকেই আমার কথার বিরোধিতা করবে। এই কথার বিরোধিতা করার আগে আপনারা চোখ খুলে দেখার চেষ্টা করুন। অনেক উদাহরণ পাবেন। অনেকেই জেনারেল শিক্ষাধারা থেকে শিক্ষিত হয়ে দুই তিন বছরের মাঝেই এতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছেন যা একজন আলেমের চাইতে ঢের বেশী।
তারা মাদ্রাসায় না পড়েও উছূল বোঝেন, ফিক্বহ বোঝেন, তাফসীর বোঝেন। অথচ আমরা আমাদের ছাত্রদের এগুলো বিষয়ে ন্যূনতম স্কিল দিয়েও তৈরি করতে পারছি না। কারণ তারা শুধু প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোই শিখেছেন। এদিকে আমরা অপ্রয়োজনীয় পড়ার বোঝা বইতে বইতে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি। তারা আরবী ইবারত পড়ার জন্য যতটুকু ছরফ দরকার ততটুকু তিন মাসে শিখে ফেলেছেন। সাবলীলভাবে আরবী পড়েও যেতে পারছেন। সেখানে আমরা তিন বছর ছরফ পড়ে এসে বলছি, তারা কি ইলমুছ ছীগাহ পড়েছে? বাইন বাইন ক্বারীব কাকে বলে তারা কি তা জানে? তারা কি কাফিয়ার তানাযু-এর বাহাছ বুঝিয়ে দিতে পারবে? তাহ’লে তারা কি শিখেছে?
আপনাদের অনুরোধ করে বলি, নিজেদের শিক্ষিত আর অপরকে মূর্খ ভেবে এমন সুধারণায় (?) জীবন অতিবাহিত করা বন্ধ করুন। তাদের উলূমে আলিয়া অর্জন না হ’লেও বেসিক খুব ভালভাবেই গঠন হয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে আপনারা নিজেদের উলূমে আলিয়ার অধিকারী মনে করছেন ঠিকই তবে আপনাদের বেসিক নেই। আপনারা নূরুল ইযাহ, কানযুদ দাক্বায়েক্ব, ফিক্বহুস সুন্নাহ পড়ে শেষ করেছেন তবে ব্যবসার উদ্দেশ্যে বাড়ি তৈরি করে ভাড়া দিলে তার ওপর কিভাবে যাকাত আসবে সেটা জানেন না। তবে তারা জানে। আপনারা মাক্বামাতে হারীরী পরীক্ষায় ৯৮ পেয়েও অপরিচিত দুই লাইন আরবী পড়ে বুঝতে পারেন না। তবে তারা এটা পারে। এটা আমাদেরই দুর্বলতা। আমরা আমাদের কারিকুলাম আপডেট করতে পারছি না। আর আমরা কারিকুলাম আপডেটের মূল থিমটাই বুঝি না। আমরা কারিকুলাম সহজকরণ বলতে সংক্ষিপ্তকরণ বুঝি। পরিমার্জন বুঝি না। আমাদের মূলনীতি, ‘যেটা কঠিন সেটা বাদ দাও’। এই ধারাতে কারিকুলাম সংস্কার হয় না। সংস্কার করতে হ’লে এই লাইনের ওপর আসতে হবে, ‘যা অপ্রয়োজনীয় সেটা বাদ দাও। যা প্রয়োজনীয় তা যোগ কর। যা কঠিন তা সহজ কর’।
এই তিনটা বাক্যকে সামনে রাখলে আপনি দেখতে পাবেন, আমাদের প্রচলিত কারিকুলামে ঠিক কতগুলো কাজ এখনো করা হয়নি! কত অপ্রয়োজনীয় জিনিস আমরা এমনিই বছরের পরে বছর পড়িয়ে যাচ্ছি। কত প্রয়োজনীয় জিনিস আমরা বিভিন্ন অজুহাতে কারিকুলামের বাইরে রেখেছি। কত কঠিন বিষয় আছে যা সহজ করার কথা ভাবা হয়নি আজও। সবাই যদি ভাবে, আমরা পার হয়ে গেছি। এখন জেনারেশন গোল্লায় যাক! তবে এগুলো কে ভাববে? কে এগিয়ে আসবে এই অলাভজনক বৃক্ষের গোড়ায় পানি ঢালতে?
তাই আসুন! আমরা সবাই মিলে উদ্যোগ গ্রহণ করি। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!
* শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।