
দুনিয়া যেখানে প্রতিনিয়ত সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে পুরাতন দিনের গল্প শোনানো এবং পুরাতন রীতি নীতি গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করা যেন আমাদের নিত্য দিনের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। পাঠকের মনে এই ধারণা সৃষ্টি হয়ে গেছে যে, শিক্ষাঙ্গনের পাতা মানেই প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে তো কিছু একটা বলা হবেই। সে যাই হোক। কি আর করব বলুন! কষ্ট পাই বলেই তো লেখা আসে। এই কথাগুলো কৃত্রিমতা সৃষ্টি করে লেখা হয় না। বস্ত্তত যাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখি, যাদের নিয়ে ভবিষ্যৎ গড়তে চাই, যাদের জন্য শিক্ষকতায় জীবনকে উৎসর্গ করেছি তাদেরকেই যখন নষ্ট হয়ে যেতে দেখি, হারিয়ে যেতে দেখি, বিপথে চলে যেতে দেখি তখনই তো কষ্ট পাই। আফসোস হয়। সেখান থেকেই লেখা আসে।
আজকে যে বিষয়ে বলতে চাচ্ছি সেটা নতুন কোন বিষয় নয়। বেশ পুরোনো এবং আলোচিত। তবু্ও এটার ঘাটতি যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) বলেছেন, ‘ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে এবং মূর্খতা বর্ষিত হবে’। সেটা বর্তমানে হচ্ছেও। তবে বাহ্যিকভাবে নয়, অভ্যন্তরীণভাবে। ইলমের পাশাপাশি আরো একটি জিনিস কিন্তু উঠে যাচ্ছে। আদব। এটা অভ্যন্তরীণভাবে তো অনেক আগেই উঠে গেছে। সাম্প্রতিককালে বাহ্যিকভাবেও তা হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। বিশেষত জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরে যেভাবে বিষয়গুলো সামনে এসেছে তা সত্যিই আমাদের আশার প্রদীপের জন্য হুমকি স্বরূপ।
চবিবশে দেশ স্বাধীনের পর থেকে বাংলার গ্রাম-গঞ্জের তৃণমূল পর্যায়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৩ বছর বয়সী ছেলেটিও নিজেকে দেশের হর্তাকর্তা মনে করছে। তারা ভাবছে, দেশটা এখন ছাত্রদের। তারা একেকজন সমন্বয়ক। তাদের ভাব যেন এমন, শিক্ষক কোন বিষয়ে তাদের ওপরে চাপ প্রয়োগ করলেই তারা শিক্ষকের বিরুদ্ধে এ্যাকশনে যাবে। শিক্ষককে জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে প্রতিষ্ঠান থেকে তাড়িয়ে দিবে। আবার এদিকে ছাত্রদের দেখে ভয় করা যেন একশ্রেণীর শিক্ষকদের দায়িত্ব হয়ে গেছে। কারণ শিক্ষকের পরিবার চলে প্রতিষ্ঠানের বেতনে। চাকুরী গেলে তো পরিবার না খেয়ে থাকবে। সুতরাং তারাও ছাত্রদের কর্মবিধায়ক মনে করতে শুরু করেছে। ফলাফলে প্রতিষ্ঠানে ঝাড়ুদার বা সুইপারের চাকুরীর যতটা নিশ্চয়তা আছে, শিক্ষকের চাকুরীর ততটা নিশ্চয়তা নেই।
বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমি সেই আদব ও আখলাক নিয়েই কথা বলব যে আদব ও আখলাক আজ শিক্ষার্থীদের কাছে ‘পা চাটা’ নামে পরিচিত। যে আদব-আখলাক তাদের কল্পনায় এক যুলুমের যাতাকল। যে আদব আজ শিক্ষার্থীদের কাছে পুরাতন যুগের কল্প-কাহিনীর মত। যে কল্প-কাহিনীর কোন সনদ নেই। যে কল্প-কাহিনীর শারঈ কোন বৈধতা নেই। আমি ধাপে ধাপে সব বিষয়গুলো স্পষ্ট করার চেষ্টা করবো। শিরোনামে দু’টি জিনিসের আদব রক্ষার কথা বলা হয়েছে। আর সব বিষয় থাকতে আমি এই দু’টিকেই কেন প্রাধান্য দিলাম তা বোঝানোর চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
কিতাব ও শিক্ষক ইলমপ্রাপ্তির মাধ্যম। এগুলোকে আরবীতে ‘আ-লাতুল ইলম’ বলা হয়। শুধু শিক্ষক এবং কিতাব নয় বরং কলম, খাতা, প্রতিষ্ঠান এ সবকিছুই ইলমপ্রাপ্তির মাধ্যম। মনে করুন, আপনি পেটের চিকিৎসা করাতে ডাক্তারের কাছে গেছেন। গিয়ে দেখলেন, ডাক্তার নিজেই ফাস্ট ফুড ও ভাজাপোড়ায় আসক্ত। আপনি ভাবলেন, এই লোক কিভাবে ডাক্তার হ’তে পারে! আপনি তার সাথে রূঢ় আচরণ করে বসলেন। হয়ত তর্কের এক পর্যায়ে কয়েক লাইন গালিও দিয়ে দিলেন। এখন এই ডাক্তারের কাছে আপনি কতটুকু সঠিক চিকিৎসা আশা করেন? সে যত ভাল ডাক্তারই হোক না কেন, স্বাভাবিক ভাবেই আপনি তার কাছে আর উপকৃত হ’তে পারবেন না। কারণ আপনার ওপর থেকে তার মন উঠে গেছে। আপনি তার কাছে ইতিমধ্যে ঘৃণার পাত্র হয়ে গেছেন। সে হয়ত আপনার পেসক্রিপশন লিখবে। তবে তা দিয়ে আপনার কোন লাভ হবে বলে আশা করা যায় না। কারণ এখানে আন্তরিকতার একটি বিষয় থাকে। যা আপনি নষ্ট করে ফেলেছেন।
আপনি কিন্তু এই নিয়ম ঠিকই ফলো করেন। আপনি বলেন না, টাকা দিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছি। এখানে আন্তরিকতার কি আছে। ডাক্তারের কাছে আন্তরিকতা না দেখলে কি প্যরাসিটামলে জ্বর সারবে না? এই কনসেপ্ট আপনি বোঝেন। তবে যখনই বলি, শিক্ষকের কাছে পূর্ণ ইস্তেফাদার জন্য তার সাথে ভাল আচারণ করতে হবে। তখনই আপনার হিসাব মেলে না। আপনি দলীল খোঁজা শুরু করেন। বলেন, শিক্ষক শিখাবে; আমি শিখব। এখানে এত বিনয় আর নম্রতার কি আছে! দেখুন! দুনিয়ার সব বিষয় হিসাবে মিলবে না। কিছু বিষয়কে তার নিয়মে রেখেই আপনাকে মানতে হবে।
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের নিকটে শিক্ষক হিসাবে প্রেরিত হয়েছি’। এখানে ‘শিক্ষক’ শব্দে একটি বিশেষ তাৎপর্য লুকিয়ে আছে। আমি নিজে যদি শিক্ষক না হ’তাম তবে হয়ত এটা আমি কখনোই বুঝতাম না। আমি দেখেছি, আমাদের ছাত্রদের বাবা-মা যতই শিক্ষিত হোন না কেন, একই বিষয়ে যদি শিক্ষক এবং বাপ-মায়ের কথা বিপরীত হয় তবে ছাত্ররা সর্বদা শিক্ষকের কথাকেই সঠিক মনে করে। বাপ-মাকে ভুল মনে করে। আমি শতভাগ ছাত্রের মাঝে এই অভ্যাস দেখেছি। হয়ত এজন্যই রাসূল (ছাঃ) নিজেকে শিক্ষক বলেছেন। তিনি জানতেন, তিনি যাদেরকে দাওয়াত দিচ্ছেন তাদের পিতা-মাতার কথার সাথে তার দাওয়াত মিলবে না। আপনারা জানেন, এমন অনেক ছাহাবী রয়েছেন যারা পিতা-মাতার বাঁধা উপেক্ষা করেই দ্বীনের দাওয়াত কবুল করেছেন। রাসূল (ছাঃ) শিক্ষক হিসাবে প্রেরিত হওয়ার আরো অনেক নুছূছ রয়েছে। আমি সেদিকে যাবো না। আমি শুধু ছাহাবায়ে কেরামের ব্যবহার থেকে এটা বোঝানোর চেষ্টা করব, শিক্ষকের সাথে আপনার কেমন আদব প্রদর্শন করতে হবে।
রাসূল (ছাঃ) নিজেকে শিক্ষক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলেও সে সময়ের অনেকেই জানতেন না, শিক্ষকের সাথে কেমন আচরণ করতে হয়। তিনি শিখাবেন আর আমরা শিখবো, এতটুকুতেই সবকিছু সীমাবদ্ধ? নাকি এর বাইরে আরো কিছু মেন্টেইন করার আছে? এটাই ছাহাবায়ে কেরামকে শিখাতে একদিন জিবরীল এলেন। মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে অথচ হাদীছে জিবরীল জানে না এমন খুব কমই পাওয়া যাবে। যদি আমরা হাদীছে জিবরীলের দিকে দেখি, তবে আমাদের কাছে অনেক বিষয় স্পষ্ট হয়ে যাবে। যদিও অনেকেই হাদীছে জিবরীলের ব্যাখ্যায় শুধু ঈমান, ইসলাম ও ইহসানের মাঝেই সীমিত থেকেছেন। তবে আমি মনে করি, এই হাদীছ থেকে আরো কিছু শেখার আছে। শুধু ঈমান, ইসলাম ও ইহসান শেখানোই যদি উদ্দেশ্য হ’ত তবে যুবকের বেশে সবার সামনে উপস্থিত হয়ে বিনম্র্ হয়ে সামনে বসে জিজ্ঞেস করার কোন প্রয়োজন ছিল না। অথচ হাদীছে বসার ধরন, পোষাক ইত্যাদির বিবরণও দেয়া হয়েছে। যা হাদীছে উল্লেখিত ঈমান, ইসলাম ও ইহসানের সাথে সম্পৃক্ত নয়।
জিবরীল (আঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে ছালাতে বসার ন্যায় বসেছেন এবং হাত দু’টোকে নিজের উরুর ওপর রেখেছেন। বোঝা গেল, শিক্ষকের সামনে এভাবেই বসতে হয়। পা দুইদিকে ছড়িয়ে দিয়ে জামাইয়ের মত বসা আদবের খেলাফ। শিক্ষকের অনুমতি সাপেক্ষে তার সামনে চেয়ারে বসা যায়। তবে পায়ের ওপরে পা তুলে চেয়ারে বসা বেআদবী। শিক্ষকের সাথে হাঁটার সময় তার সামনে বা একসাথে না হেঁটে একটু পেছনে থাকাই আদব। একসাথে বাহনে চড়লে তাকে তুলনামূলক ভাল সিট ছেড়ে দেয়াটাই আদব। শিক্ষক ক্লাসে আসার আগে তার বসার চেয়ার এবং টেবিলটা মুছে রাখা আদব। শিক্ষককে কোন কাজ করতে দেখলে কোন আহবান ছাড়াই তার কাজে অংশ নেয়া আদব। তাকে কোন ভারী ব্যাগ হাতে কোথাও যেতে দেখলে তার ব্যাগ বহন করে দেয়া আদব। যে আদবগুলো আমি অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানেও দেখিনি।
এগুলোকে আদব না বলে দো‘আ নেয়ার মাধ্যমও বলা যেতে পারে। এ বিষয়গুলো যদি কোন ছাত্র মেনে চলে তবে তার প্রতি শিক্ষকের একটি দুর্বলতা সৃষ্টি হবেই। এটাই সেই ছাত্রকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের ছাত্ররা তো শিক্ষকদের সালাম দেয়ার আগেও হাদীছ খুঁজে দেখে, হাদীছ কি শুধু ছাত্রদেরকেই সালাম দিতে বলে, নাকি শিক্ষকদেরকেও দিতে বলে? শিক্ষকদের কি কি দায়িত্ব? দেখুন! ছাত্র হয়ে ছাত্রদের দায়িত্ব না খুঁজে সে শিক্ষকের দায়িত্ব জানার চেষ্টা করছে। মূলকথা বলতে গেলে আজ অধিক জ্ঞানই আমাদেরকে অধিকহারে বেআদব বানাচ্ছে। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন- আমীন!
মনে পড়ে, আমি যখন হিফয পড়তাম তখন আমাদের হাফেয উসতায একটি ছোট্ট গদিতে বসে আমাদের পড়া শুনতেন। যখন তিনি থাকতেন না তখন আমি সেই গদি দেখে দেখে ভাবতাম, এখানে বসতে হয়ত খুব আরাম লাগে। কবে যে আমাদের এখানে বসার সুযোগ হবে! কবে হিফয খানার শিক্ষক হব! অথচ আমার কখনো মনে হয়নি, এটা একটা গদিই তো! বসলে তো আর গুনাহ হবে না।
একদিন ছাহাবায়ে কেরাম রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে মসজিদে নববীতে বসে কথা বলছিলেন। তবে রাসূল (ছাঃ)-এর তুলনায় ছাহাবায়ে কেরাম উচ্চ আওয়াযে কথা বলায় তখনই কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়, হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের কন্ঠস্বরকে রাসূল (ছাঃ)-এর কন্ঠস্বরের চেয়ে উঁচু করো না। তোমরা একে অপরের সাথে যেমন উচ্চৈঃস্বরে কথা বল, তাঁর সাথে সেভাবে কথা বলো না। এতে তোমাদের আমল নষ্ট হয়ে যাবে। তোমরা তা বুঝতেও পারবে না (হুজুরাত ৪৯/২)। দেখুন! শুধু শিরক-বিদ‘আতই যে আমল নষ্ট করে এমন নয়। অনেক সময় বেআদবীও আমল নষ্ট করে দেয়। উল্লিখিত আয়াত থেকে এটাও বোঝা যায়, শিক্ষকের সামনে গলা উঁচু করে কথা বলা বেআদবী। আর গলা উঁচু করে কথা বলাই যদি বেআদবী হয় তবে তাকে গালমন্দ করা? তাকে অপমান করা? তার গায়ে হাত তোলা? এগুলো কি সীমালঙ্ঘন নয়? এই সীমালঙ্ঘনের ফলাফল কি কখনো ভোগ করতে হবে না? দেখুন ভাই! শিক্ষকগণ আমাদের ইলমপ্রাপ্তির মাধ্যম। সুতরাং পূর্ণ ইলম অর্জনের জন্য মাধ্যমকে সম্মান করতে হবে।
এবার একটু বই-খাতা-কলম নিয়ে বলি। আমি অনেক ছাত্র দেখেছি, যারা হাদীছের কিতাব মেঝেতে বিছিয়ে পড়তে বসে। অনেকে তো কুরআনকেও মেঝেতে রেখে পড়ে। কারণ ঐ একটাই। তারা হাদীছ-কুরআন অনেক শিখে ফেলেছে। দেখুন! এটা হালাল-হারামের বিষয় নয়। এটা আদব ও ইহতেরামের বিষয়। ফুল গাছ টবে না রেখে পলিথিনে রাখলে আপনার খারাপ লাগে। মনে হয়, সুন্দর একটি ফুল গাছ অবশ্যই একটি টবের হকদার। আপনি একটা টবের ব্যবস্থাও করেন। সুন্দর একটি গোলাপ ফুলের গাছ পলিথিনে রাখা যাবে কি-না এ বিষয়ে কখনো আপনি নুছূছ খোঁজেন না। তবে হাদীছের কিতাব মেঝেতে রাখার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আছে কি না সেটার বিষয়ে আপনি কুরআন-হাদীছ থেকে দলীল খোঁজেন! আপনার মধ্যে যে আদবের ঘাটতি আছে সেটা বুঝতে আর বাকী থাকে কি!
বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ওয়াশরুমে রাখার বিষয়ে আপনি কুরআন-হাদীছে কোন নিষেধাজ্ঞা পাবেন না। ব্যবহৃত কলম পেশাবখানায়, ময়লার ঝুড়িতে বা চলাচলের রাস্তায় ফেলে দেয়ার বিষয়েও কোন নুছূছ পাবেন না। তাই বলে আপনি নিজের বিদ্যা অর্জনের মাধ্যম কলম এমন স্থানে ফেলবেন যেখানে সেটা নাপাকীর সাথে মিশবে, মানুষের পায়ের তলে পড়বে? দেখুন! কলমকে সম্মান করার জন্য আগে কলমের অবদান আপনাকে অনুধাবন করতে হবে। আপনি যে দু’হরফ ইলম অর্জন করেছেন এর পেছনে কলমের ভূমিকা নিয়ে ভাবতে হবে। তবেই আপনি কলমকে সম্মান করতে পারবেন।
আমি আমার ছাত্র যামানায় কখনো কলম ফেলে দিতাম না। এখন অবশ্য সবকিছু ডিজিটালাইজ হওয়ার সুবাদে কলমের ব্যবহার আর তেমন একটা হয় না। তবে একসময় আমার প্রতিমাসে তিন চারটে কলমের কালি ফুরাতো। কালি ফুরানো কলমগুলো একটা ড্রয়ারে রেখে দিতাম। অনেকগুলো কলম জমা হ’লে একদিন পুড়িয়ে ফেলতাম। একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যদি ৫০০ জন ছাত্র হয় আর প্রতিমাসে যদি মাথাপিছু দুইটা করে কলম লাগে তবে প্রতিদিন গড়ে ৩০টি কলম রাস্তাঘাটে পড়বে। চরাফেরায় পায়ের নিচে তো দু’একটা পড়বেই।
সত্য কথা বলতে কি জানেন! এটা কোন দালিলিক বিষয় নয়। আমি যে কলম ব্যবহার করে বিদ্যা অর্জন করেছি সে কলম কারো পায়ের নীচে পড়বে বা তাতে কারো পেশাব অথবা নাপাকী লাগবে এটা আমার আত্মসম্মানে লাগত। এজন্যই আমি এমন কাজ করতাম। আমি চিন্তা করতাম, আমি অতি নগণ্য একজন মানুষ হয়ে যদি আমার কলম কারো পায়ের নীচে পড়া আমার আত্মসম্মানে লাগে তবে কুরআন তো আল্লাহর কালাম, হাদীছ তো রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী। তাঁদের সম্মানবোধ তো অনেক উঁচু। আমি এটা মেঝেতে রাখি কিভাবে! এগুলোর পাতা ছিঁড়ে ওয়াশরুমে রাখি কিভাবে! আমি ভয় পেতাম, যে ইলম অর্জনের জন্য এতটা কষ্ট করছি, দিনশেষে নিজের বেআদবীর কারণে যদি সেটা থেকেই বঞ্চিত হই! তখন আমি নিজেকে সান্ত্বনা দেব কিভাবে!
প্রিয় তালিবুল ইলম! আমরা চাই আপনারা উস্তাযের দো‘আর মাধ্যমে অনেক দূর এগিয়ে যান। সবসময় মনে রাখবেন, পরিশ্রমই সফলতার সোপান। তবুও দো‘আর মাধ্যমে একজন মানুষ যতদূর এগিয়ে যেতে পারে, পরিশ্রমের মাধ্যমে ততদূর এগুতে পারে না। এই বিষয় নিয়ে আরেকদিন বিস্তারিত লিখব ইনশাআল্লাহ। আজকে শুধু এতটুকুই বলব, সবার সাথে আদব প্রদর্শনের মাধ্যমে সকলের দো‘আ নেয়ার চেষ্টা করুন। কখন কার দো‘আয় আল্লাহ আপনার মাধ্যমে দ্বীনের খিদমত নিবেন এটা কেউ জানে না। দেখুন! সব বিষয়ে আপডেট হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিছু বিষয়ে সেই পুরাতনে ফিরে যাওয়াই ভাল। রাস্তাঘাট এখন অনেক যানজটপূর্ণ হয়েছে। তবুও রাস্তায় শিক্ষকের সাথে দেখা হ’লে সাইকেল থেকে নেমে তার সাথে কুশল বিনিময় করাই আদবের পরিচয়। সেই ছোট বেলায় পড়া ছেঁড়া বইগুলো বিক্রি না করে আলমারীতে তুলে রাখুন। এটা ইলমের প্রতি আপনার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
প্রিয় তালিবুল ইলম! ভালোবাসা ও আন্তরিকতা ছাড়া কোন কিছুই লাভ করা সম্ভব নয়। আপনি আপনার প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের ভালো না বাসতে পারেন। সেটা আপনার ব্যক্তিগত বিষয়। তবে আপনাকে ইলম শিক্ষা দেয়ার বিনিময়ে তারা আপনার কাছে ভালো ব্যবহার ও আন্তরিকতা পাওয়ার হকদার। দেখুন! সবার কথা, সবার দোষ এক পাল্লায় ওযন করবেন না। নিজেকে বিচারক ভাববেন না। নিজের ইগো সমস্যার কারণে গুরুজনদের সাথে দুর্ব্যবহার করে তাদের বদদো‘আ কুড়াবেন না। দেখুন! কর্মজীবনে যাওয়ার সাথে সাথেই আপনার হিরোগিরী শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু গুরুজনদের বদদো‘আ আপনাকে সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়াবে। সুতরাং এখনই সাবধান হৌন।
বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমরা যে আদবগুলো উল্লেখ করেছি তার অধিকাংশই কুরআন-হাদীছের নুছূছ দ্বারা প্রমাণিত নয়। এগুলো বিজ্ঞান দ্বারাও প্রমাণিত নয়। আবার এগুলো আদব মেনে না চললে একজন ছাত্র মুহাক্কিক আলেম হ’তে পারবে না, এমনও নয়। কালে-ভদ্রে দু’একজন আলেম হয়েও যেতে পারে। তবে কেউ যদি নিজের ইলমের মাধ্যমে জাতির উপকার করতে চায় তবে তার জন্য শিক্ষক ও কিতাবের আদব রক্ষা করাই হাযার বছরের পরীক্ষিত পথ।
সারওয়ার মিছবাহ
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।