ভূমিকা : এক সময়ে বাবা-মা ছেলে-মেয়েকে জোর করে বিভিন্ন প্রফেশনে যেতে বাধ্য করত। সন্তানের ইচ্ছার কোন মূল্য সেকালে ছিল না। ছেলে খেলোয়াড় হ’তে চায়, তবুও বাবা তাকে ডাক্তার বানাবেই। ডাক্তারী পেশায় রোজগার বেশী। তাই ডাক্তার বানাতে ছেলের ওপরে যত ধরনের চাপ দেয়া যেতে পারে তার সবগুলোই দেয়া হত। চাপাচাপির ফলে ছেলেটি ডাক্তার হয়েও যায়, তবে এই ডাক্তারী পেশা তার জীবনকে ভারি করে তোলে। কারণ তার মেডিকেল ভাল লাগে না, ভাল লাগে খেলার মাঠ। তবুও এই অপসন্দের জায়গাকে আপন করেই তাকে কাটিয়ে দিতে হয় পুরো জীবন। অবশ্য যুগের পরিক্রমায় এই ধরনের বাবা মায়ের সংখ্যা বেশ কমে এসেছে। এখন অধিকাংশ বাবা-মা ছেলে-মেয়ের প্রফেশন বাছাই করার সময় তাদের ঝোঁক, শখ, দক্ষতা ইত্যাদির দিকে লক্ষ্য করে একটি মানসম্মত প্রফেশন নির্বাচন করেন। বাবা-মায়েরা বুঝতে পেরেছেন, মানসম্মত দক্ষতা অর্জন করতে পারলে কোন প্রফেশনই খারাপ নয়।
এবার আসুন! আমরা একটু শখ, টাকা-পয়সা, মান-সম্মান, দক্ষতা ইত্যাদির বিবেচনা থেকে বেরিয়ে আসি। একটু পরকাল নিয়ে ভাবি। পরকাল নিয়ে সচেতন বাবা-মা তাদের সন্তানের প্রফেশন কোন দিকে বিবেচনা করে নির্বাচন করবেন! কোন বিষয়কে প্রাধান্য দিবেন! কোন বিষয়কে অপশনাল হিসাবে রাখবেন! এই সবকিছুকে কেন্দ্র করে আজকের আলোচনা। আপনি যদি প্রফেশন নির্বাচনে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন তবে আজকের লেখা আপনার জন্য। আজকের লেখা তাদের জন্য যারা ইলমে দ্বীন অর্জনে বেশকিছু পথ এগিয়ে এসেও হীনমন্যতায় ভুগছেন। মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশায় আছেন। আসুন! আমরা দুনিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের সুখের স্থানে অনাদী অনন্তকালের সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি নিয়ে ভাবি।
বস্ত্তবাদী প্রফেশনের চেহারা : বর্তমানে মোটিভেশনাল স্পিকাররা জীবনে সফল হওয়ার জন্য পড়ালেখা ছেড়ে ব্যবসায় নামার জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন। উদ্দ্যোক্তা হ’তে বলছেন। তারা বলছেন, ইতিহাসে যারা ‘বড় কিছু’ করেছে তারা উচ্চ শিক্ষিত নয়। উদাহরণ হিসাবে বিভিন্ন ধনী ব্যক্তির জীবনী সামনে রাখছেন। তাদের বক্তব্যে ‘বড় কিছু’ করা বলতে যে ‘টাকা উপার্জন’ বুঝাচ্ছে এটা নতুনভাবে বলার অপেক্ষা রাখে না। এই মোটিভেশনাল স্পিকারদের মেয়েরা যখন রাস্তায় ধর্ষিতা হবে, ছেলেরা রাতে নেশা করে এসে তাদেরকে জুতা দিয়ে মারবে, জীবনের শেষ দিনগুলো বৃদ্ধাশ্রমে ধুঁকে ধুঁকে পার করে মৃত্যুর পরে আবার জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে, তখন এদের বুঝে আসবে যে, টাকা উপার্জনকে তারা জীবনে ‘বড় কিছু’ করা মনে করে ভুল করেছেন এবং আসলেই জীবনে ‘বড় কিছু’ করা বলতে কি বুঝায়।
বলতে দুঃখ লাগে যে, আমাদের সমাজে বহু প্রফেশন আছে যেগুলো আদতে কোন প্রফেশনই নয়। যে ব্যক্তি হাটে- বাজারে জুয়ার লটারী বিক্রি করে সেও নাকি ব্যবসায়ী! যে ব্যক্তি গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন বীমার নামে সূদী কারবার করে বেড়ায় সেও নাকি চাকুরিজীবী! সারাদিন কম্পিউটারের সামনে বসে অর্ধনগ্ন মেয়ের ছবি নিয়ে কাজ করা মানুষটি ফ্রিল্যান্সার! এগুলো কোন প্রফেশন হ’ল? এগুলো দেশ ও দশের কি উপকারে আসে? শয়তান যেমন মানুষকে সঠিক পথ থেকে সরিয়ে জাহান্নামের দিকে ধাবিত করার চুক্তি নিয়েছে, ঠিক তেমনই এরাও দুনিয়ায় মানুষকে পয়সা-কড়ির লোভ দেখিয়ে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তবুও সমাজে আমরা এগুলোকে সম্মানজনক পেশা হিসাবে মেনে নিয়েছি। কারণ একটাই, এগুলোতে টাকা রোজগার হয়। আর আমাদের চোখে যে প্রফেশনে যত বেশী টাকা সেটা তত দামী প্রফেশন। একজন মানুষকে হত্যা করলে সেটা হয় খুন, আর সেই মানুষকেই যখন সূদের যাঁতাকলে পিষ্ট করে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয় তখন সেটা হয় বিজনেস। বড়ই আজব আমাদের নীতি!
প্রফেশন নির্বাচনে যখন হালাল-হারামের প্রশ্ন সামনে আসে তখন অনেকেই দরিদ্রতার দোহাই দেয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে দুবেলা দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার আবেগ মিশ্রিত বাক্য শোনায়। আমিও এটাকে দরিদ্রতাই বলি। তবে সেটা আর্থিক দরিদ্রতা নয়, বরং আত্মিক দরিদ্রতা। যে সমাজে ভিক্ষাবৃত্তি করে মাসে লাখ টাকা রোজগার করা যায়, সেখানে আজও পেটে পাথর বাঁধার পরিবেশ বিরাজ করছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। দুনিয়াবী বিলাসিতার লালসা আমাদেরকে এমন অন্ধ পশুতে রূপান্তর করেছে। আমরা মুখে বলছি, প্রয়োজনই আমাদেরকে দুনিয়াদার হ’তে বাধ্য করছে। কিন্তু আদতে বিলাসিতাকেই আমরা প্রয়োজন বানিয়ে নিয়েছি। এখন প্রতিদিন নদীর মাছ আর খাশির গোশত চিবানোও আমাদের প্রয়োজন। শরীরটাকে বিদেশী দামী কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখাও প্রয়োজন। বহুতল বিশিষ্ট বাড়ির রুমে রুমে এয়ার কন্ডিশনার বসানোও প্রয়োজন। এগুলো আর আমাদের বিলাসিতার মধ্যে পড়ে না। কারণ দুনিয়াদারীর কড়া নেশা আমাদের মস্তিষ্ককে মাতাল করে তুলেছে। আমরা খাঁটি শরিষার তেল চিনি, খাঁটি পদ্মার ইলিশ চিনি, খাঁটি বাসমতি চাউল চিনি। তবে হালাল তেল, হালাল ইলিশ, হালাল চাউল চিনি না। আফসোস! এই চোখ অচিরেই হালাল চিনতে পারবে, যখন সাধের দেহখানা হারামে পুষ্ট হওয়ার জন্য জাহান্নামে জ্বলবে।
মুসলিমের প্রফেশন নির্বাচন : বস্ত্তবাদীদের চোখে দুনিয়াবী জীবন ছাড়া আর কোন জীবন নেই। সুতরাং তারা সেই জীবনকে সুখময় করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তাদের সকল সঞ্চয় সেই জীবনকে ঘিরেই। পক্ষান্তরে একজন মুসলিমের সামনে দু’টি জীবন। একটি দু’দিনের, আরেকটি অনন্তকালের। সুতরাং পেশা নির্বাচনে একজন মুসলিম সেটাকেই প্রাধান্য দিবে, যে পেশায় দু’দিনের জীবন যেমনই কাটুক, অনন্তকালের জীবনের জন্য বড় একটা সঞ্চয় জমা হবে। এটাই যুক্তিযুক্ত। এটা কাউকে বুঝানোর জন্য কুরআন-হাদীছের দলীলের প্রয়োজন নেই। কেউ যদি শুধুমাত্র আখেরাত বিশ্বাস করে তাহ’লেই সে এই কথার সাথে একমত হবে।
কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, মসজিদেরই ঝাড়ু-বরদার (ঝাড়ু বহনকারী) হোক আমার এই হাত। শোন শোন ইয়া ইলাহী! আমার মুনাজাত...। এটা শুধুমাত্র কবিতা নয়। বরং একটি চেতনা, একটি চিন্তাধারা, একটি দৃষ্টিভঙ্গি। একজন মুসলমানের জন্য মসজিদ ঝাড়ু দেয়া যদি সৌভাগ্যের বিষয় মনে না হয়, তবে সে কিসের মুসলমান! যে মুওয়াযযিনের জন্য স্বয়ং রাসূল (ছাঃ) ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। সেই মুওয়াযযিন হওয়া যদি সৌভাগ্যের বিষয় মনে না হয় তবে সে কোন ইসলামী চেতনা বুকে লালন করে! আমরা বলছি না, মুওয়াযযিনই হ’তে হবে। মসজিদের খাদেমই হ’তে হবে। আমরা এগুলোর গুরুত্ব বর্ণনা করছি। কেননা শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সঠিক যে, ইমাম-মুওয়াযযিনের চেয়ে তুচ্ছ পেশা আমাদের চোখে আর নেই। দুঃখ লাগে, যাদের মাধ্যমে ইসলাম দুনিয়ায় টিকে থাকবে তাদের কাছেই যদি এগুলো অনাগ্রহের বস্ত্ত হয়ে যায় তবে এর চেয়ে আফসোসের বিষয় আর কি হ’তে পারে?
একটা সময় আযান দেয়া, ইমামতি করা, মসজিদ ঝাড়ু দেয়া, দ্বীনী জ্ঞান শিক্ষা দেয়ার কোন বিনিময় প্রদান করা হ’ত না। তবে যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে এখন এগুলোর বিনিময় প্রদান করা হয়। এগুলো কাজের বিনিময়ে কেন বেতনপ্রথা চালু হ’ল সেটা ভিন্ন বিষয়। তবে বেতনপ্রথা চালু হওয়ায় ইবাদত করেই জীবন কাটানোর সুযোগ হয়েছে। এটি একটি ভাল দিক। একজন মুসলিম যদি মনে করে, আমি পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতে ইমামতি করব আর দিনের বাকী সময়ও ইবাদতেই কাটিয়ে দিব। তবুও মসজিদ থেকে যে সম্মানী তাকে দেয়া হবে তাতে তার জীবন কেটেই যাবে। তবে হ্যঁা, বিলাসিতা হয়ত হবে না। আমি তো মাঝে মাঝে আশ্চর্যই হই যে, এতগুলো প্রফেশন আমাদের সামনে যেগুলোতে শুধু ইবাদতেই জীবন পার করে দেয়া সম্ভব! অনেক প্রফেশন তো এমনও আছে যেখানে সারা জীবন ইবাদতের মাঝে থেকেও দামী কাপড় পরে, দামী খাবার খেয়ে মানসম্মত একটি জীবন অতিবাহিত করা সম্ভব। তবে এর চেয়েও বেশী আশ্চর্য হই তখন, যখন দেখি এসব প্রফেশনে মানুষের কোন আগ্রহই নেই! বিশেষভাবে আমাদের তালিবুল ইলমরাও এসব পেশা থেকে বিমুখ হচ্ছে। তালিবুল ইলমদের দুনিয়ার প্রতি ঝোঁক দেখলে বুকের গহীন কোণে এক অজানা ব্যথায় যেন দুমড়ে মুচড়ে যায়। সহ্য করতে পারি না।
প্রিয় তালিবুল ইলম! তোমরা আমাদের আশার বাতিঘর। কুরআন-হাদীছের জ্ঞান আহরণ করে পথভ্রষ্ট হয়ো না। প্রফেশন চয়নে সর্বদা পরকালকেই প্রাধান্য দেবে। তোমাদের পেশা যেন অবশ্যই নেকী অর্জনের মাধ্যম হয়। রোজগার কতটুকু হ’ল সেটা পরের বিষয়। পেশা যেন তোমার এবং আল্লাহর মাঝে অন্তরায় না হয়। জীবনে কতটুকু বিলাসিতা হ’ল সেটা পরের বিষয়। প্রফেশন যেন তোমার ফরয ইবাদতে, দাওয়াতী কাজে বাধা না হয়। চিরস্থায়ী সংসার গোছানোর কাজে ব্যস্ত থাকার বিনিময়ে যদি তোমার ক্ষণস্থায়ী সংসার চলে তবে তো তোমার সেŠভাগ্যই! এর চেয়ে শান্তির জীবন আর কি হ’তে পারে!
শেষকথা : প্রিয় তালিবুল ইলম! এখনই তোমার জীবনের লক্ষ্য স্থির করার সময়। আমি বলছি না, তোমাকে মাদ্রাসাতেই শিক্ষকতা করতে হবে, মসজিদে ইমামতি করতে হবে। আমি বলছি, জীবন ধারণের জন্য প্রফেশন হিসাবে এমন একটা পেশা বেছে নাও যেটার মাধ্যমে তোমার দুনিয়াবী জীবন ধারণের পাশাপাশি নেকী উপার্জন হবে। যেখানে দুনিয়া অর্জনকারীরা প্রফেশনের ব্যস্ততায় একটু ইবাদতের সময় পাবে না, সেখানে তোমার প্রফেশনই হবে ইবাদত! তোমার কাজের চাপ যত বেশী হবে, ইবাদত তত বেশী হবে। এর চেয়ে সুখের বিষয় এই দুনিয়ার বুকে আর কিছু হ’তে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না।
শ্রদ্ধেয় অভিভাবকগণ! আপনারাই সন্তানদের চালিকাশক্তি। আপনারা তাদেরকে যে চিন্তাধারায় বড় করে তুলবেন তারা সারা জীবন সেটাকেই বুকে লালন করবে। সুতরাং এমন উত্তরসূরী গড়ে যান, যারা দ্বীন রক্ষার সৈনিক হবে। যাদের মাঝে আবারো খুঁজে পাওয়া যাবে, ইমাম বুখারী, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল। সন্তানদের ওপরে দয়া করে বস্ত্তবাদী চিন্তাধারা তাদের মস্তিষ্কে দিবেন না। পরকালই আমাদের আসল ঠিকানা, এটা যেন তাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রক্তের মত প্রবাহিত হয়। এমন সন্তানাদী যদি দুনিয়ার বুকে রেখে যেতে পারেন তবে ইনশাআল্লাহ এটাই হবে আপনার সবচেয়ে বড় অর্জন।
আমিও জীবন ধারণে এই শক্তিশালী চিন্তাধারা পেয়েছি আমার পিতার কাছে। লেখার শেষ পর্যায়ে এসে আমি আমার পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় না করে পারছি না। আমার কণ্ঠ ভারি হয়ে আসছে। প্রাথমিক শেষ করার পরে আববু যখন মাদ্রাসায় ভর্তি করালেন তখন স্কুলের হেডমাস্টার ছাহেব বলেছিলেন, তোমার ছেলের মেধা ভাল ছিল। ছেলেটাকে নষ্ট করে দিলে? স্যারের সেই কথাকে উপেক্ষা করে তাঁরা আমাকে ইলমে দ্বীন শিক্ষা দিয়েছেন। ২০০৯ সালের ৬ই জানুয়ারী আমাকে নওদাপাড়া মারকাযে ভর্তি করেছিলেন। আমার আববু শিক্ষিত মানুষ নন। তেমন ধনীও নন। খুব কষ্টে চালিয়ে গেছেন লেখাপড়ার খরচ। যখনই আমি আমার এই সৌভাগ্যের কথা ভাবি, তখনই তাঁদের জন্য অন্তর থেকে দো‘আ আসে। এই দো‘আই হয়ত তাঁদের সবচেয়ে বড় অর্জন। তাঁদের সেই দুনিয়াবিমুখ যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের বদৌলতে আজ পরকাল বুঝেছি। হালাল হারাম চিনেছি। ইলমে দ্বীনের খেদমতে নিজেকে নিবেদিত করতে পেরেছি। জানি, প্রবন্ধে এই কথাগুলো প্রাসঙ্গিক নয়। তবুও কখনো শক্তিশালী আবেগের জোর ধাক্কা নিয়মের দেয়ালকে ভেঙ্গে ফেলে। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে দ্বীনের খাদেম হিসাবে কবুল করুন। পরকাল মুখ্য হিসাবে গ্রহণ করে ইহকালীন জীবনে পাথেয় সঞ্চয় করার তাওফীক দিন- আমীন!
* শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।