দেখা হ’লেই মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করেন, কেমন আছ ভাই? আমিও প্রত্যুত্তর দিয়ে হাসি ফিরিয়ে দেই। এলাকার বড় ভাই হিসাবে সামান্য কুশলাদি বিনিময় ছাড়া আর বেশী কথা হয় না। ব্যবসায়িক কারণে তার ছোট ভাইয়ের সাথে আমার হৃদ্যতা। আমার ছোট্ট একটা মুদি দোকান আছে। অবশ্য প্রধান ব্যবসা হচ্ছে এলাকার বিভিন্ন দোকানে বেকারী সামগ্রী সরবরাহ করা। মুসলমান ঘরে জন্মগ্রহণ করেছি। মুসলমান সমাজেই বড় হয়েছি। সেই সমাজের রীতি-নীতি অনুযায়ী জীবন যাপন করি। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মকে বিভিন্নভাবে ভিন্ন ভিন্ন রূপে উপস্থাপন করা হচ্ছে। তাই সাধারণ মানুষের জন্য সঠিক ইসলাম খুঁজে পাওয়াটা দুষ্কর বৈকি! মুসলমান হিসাবে আমরা বিশ্বাস করি মৃত্যুর পর পরকালীন জীবন আছে। যেখানে হিসাব-নিকাশ ও জান্নাত-জাহান্নাম রয়েছে। তাই ব্যক্তিগতভাবে আমরা সবাই জান্নাত কামনা করি।
এই জান্নাত পাওয়ার জন্য বিভিন্ন মাধ্যম খুঁজি। কিভাবে ইবাদত করলে জান্নাত লাভ করা সহজ হবে, সেই মাধ্যম খুঁজতে গিয়ে প্রথমবারের মতো আটরশি পীরের দরবারে গমন করি। তাদের বার্ষিক মাহফিলে অংশগ্রহণ করি। বক্তব্য শুনি, তাদের সাথে সুর মিলিয়ে যিকর করি। কিন্তু হৃদয়ে তৃপ্তি আসে না। নতুন করে পথচলা। কোথায় পাওয়া যাবে সে পথ? পরবর্তীতে চরমোনাই পীর ছাহেবের ছোট-বড় দু’টি মাহফিলে গমন করি। আটরশি থেকে এখানে অবস্থা ভিন্ন। তারা এশকের গযল শোনায়, এশকের যিকর শেখায়। অবশ্য উভয়ই (আটরশি ও চরমোনাই) বারবার ফান্ডে বেশী বেশী টাকা দানে উৎসাহিত করে।
যেহেতু আটরশির চেয়ে চরমোনাইকে পসন্দ বেশী হয়েছে, তাই আগামী বৎসর চরমোনাই যাওয়ার জন্য মানসিক প্রস্ত্ততি নিয়েছি। একদিন সন্ধ্যায় রাস্তার পাশে এলাকার সেই বড় ভাইয়ের সাথে দেখা। সালাম ও কুশলাদি বিনিময়ের পর দাঁড় করালেন। আমি তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। কারণ তার ছালাত আমাদের মতো নয়। আজ তিনি নাছোড়বান্দা হয়েই দাঁড় করালেন। বলতে থাকলেন, চরমোনাই তোমাদের প্রোগ্রাম কবে? বললাম, এই তো কিছুদিন পর ভাই। তুমি নাকি সেখানে যাওয়ার প্রস্ত্ততি নিয়েছ? হ্যাঁ ভাই।
আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয়? গত বৎসর তুমি সেখানে গিয়েছ। সেখানকার কার্যক্রম দেখেছ, তাই না? জ্বি ভাই। চল এবার নতুন একটা স্থানে যাই। দেখ কেমন লাগে। আমতা আমতা স্বরে উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম। তিনি পুনরায় বললেন, আরে ভাই চল। দুনিয়ার সকল বিষয় যাচাই কর, ইসলামও যাচাই করে তারপর মান। একটা জামা ক্রয় করতে কত দোকান ঘুরো। যাচাই কর তাই না? জ্বি।
তাহ’লে ইসলাম যাচাই করবা না? হুযুর তোমাকে বললে কি হুযুরের পসন্দানুযায়ী জামা ক্রয় কর? না। তাহ’লে! সামান্য জামা ক্রয় করার সময় যাচাই করবা আর সর্বশেষ প্রবেশকারীর জন্য যে জান্নাত তা ১০-টা দুনিয়ার সমান। সেটা পাওয়ার জন্য যে ইবাদত তা যাচাই করবা না? একটা সময় রাযী হয়ে গেলাম। চরমোনাই নয়, রাজশাহীতেই যাব ইনশাআল্লাহ। ট্রেনে আমাদের জন্য টিকেট কাটা ছিল। এলাকার আরো কয়েকজন ভাইও ছিলেন। যারা এই প্রথম রাজশাহীতে যাচ্ছেন। রাতের ট্রেনে যাত্রা। ঘুম ঘুম চোখে কত ভাবনা! সমাজে চলে আসা নিয়মের ব্যতিক্রম এক ইজতেমা। সেখানে কি হবে? কারা কথা বলবে? কোন বিষয়ে বক্তব্য হবে? মনকে প্রবোধ দিচ্ছি, আরে যাই তো দেখিই না কি বলে? আমি তো আর সব মানতে বাধ্য নই!
প্রভাতের মৃদু আলোর পরশ গায়ে মেখে পথ চলছি। তাবলীগী ইজতেমা মাঠের দিকে, যেটা আমাদের গন্তব্য। শত শত মানুষও সারিবদ্ধভাবে রাস্তার পাশ দিয়ে চলছে ইজতেমার মাঠ পানে। নান্দনিক দৃশ্য। বিশাল মাঠের নির্ধারিত স্থানে আমরা সকলে অবস্থান নিলাম। এদিক-সেদিক ঘোরাফিরা করলাম খানিকক্ষণ। মনকে জিজ্ঞাসা কেমন বক্তব্য হবে? কেমন যিকর হবে? বাদ আছর। কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হল। ক্ষানিক পরেই উদ্বোধনী বক্তব্য শুরু করলেন ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর আমীর প্রফেসর ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব। কানায় কানায় পূর্ণ মাঠে তিনি যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন পুরো মাঠ নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বিরাজ করছিল পিনপতন নীরবতা।
মহান আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূল (ছাঃ)-এর উপর দরূদ পড়ে অসাধারণ বক্তব্য রাখলেন। বিস্ময়কর অনুভূতি। পীরদের বক্তব্য আর স্যারের তেজস্বী বক্তব্যে কতইনা তফাৎ। একে একে বক্তব্য শ্রবণ করতে থাকলাম। হৃদয়ে পরিবর্তন টের পেলাম। প্রতিটি বক্তব্যে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দলীল উপস্থাপন। এরকম তো কোথাও শুনিনি। মাগরিবের ছালাত আদায় করলাম। ইমাম সূরা ফাতেহা শেষে আমীন বলার সাথে সাথে পুরো মাঠ আমীন ধ্বনীতে গুঞ্জরিত হ’ল! ছালাত শেষে সম্মিলিত কোন মোনাজাত হ’ল না। সকলে বসে বসে তাসবীহ পড়তে লাগলেন। যা আমার এতদিনকার ইবাদতের সাথে বেমানান। নতুন নতুন দৃশ্যে আমি অভিভূত হচ্ছি। ভাবছি আরো শুনতে থাকি। গভীর রাত পর্যন্ত বক্তব্য শ্রবণ করে ফজরের ছালাত আদায় করে পুনরায় শুনতে থাকলাম। আশ্চর্য, একটা বক্তব্যের সাথে অন্য বক্তব্যের মিল নেই। কিভাবে ছালাত আদায় করতে হবে। যখন স্টেজ থেকে তার বাস্তব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেখানো হ’ল এবং ছহীহ হাদীছের দলীলসহ বলা হ’ল নিজের চেতনায় পরিবর্তন টের পেলাম। আলহামদুলিল্লাহ! দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলাম পুরনো সকল নিয়ম-নীতিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে এভাবেই ছালাত আদায় করব ইনশাআল্লাহ। ছহীহ হাদীছ জানার পর আর কোন পিছুটান নেয়ার সময় নেই। পরবর্তী ওয়াক্ত থেকেই চেষ্টা করলাম বুকে হাত বেঁধে, রাফউল ইয়াদায়েন করে ছালাত আদায় করার। নতুন হিসাবে বেখাপ্পা লাগলেও চেষ্টা করতে থাকলাম। কেনইবা চেষ্টা করব না! রাসূল (ছাঃ)-এর পদ্ধতিতে ছালাত আদায়ের প্রমাণ পাওয়ার পর কেন হবে সময়ক্ষেপণ!
দুই দিনের তাবলীগী ইজতেমা শেষে ফিরতি পথে মনে অনাবিল উচ্ছ্বাস বয়ে বেড়াচ্ছিলাম। সাথী এক ভাইকে বলেছিলাম, পুরো ছালাত সঠিকভাবে জানতে আমাকে সাহায্য করবেন। তিনি আমাকে ‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)’ বই দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ! আমি সেটা পড়ে ছালাতের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে নিলাম। মহান আল্লাহ আমাকে সুপথ দেখিয়েছেন। রাসূল (ছাঃ)-এর পথ। যে পথকে ভিন্ন ভিন্ন তরীকার দোহাই দিয়ে নানাভাবে আড়াল করা হয়েছে। জেনে বুঝে এই পথের দাওয়াত দিতে যে যেখানে যে অবস্থানেই থাকুন না কেন, সংকোচকে ঝেড়ে ফেলে সত্যকে জানান দিতে হবে অবশ্যই। এতেই সমাজ পরিবর্তন হবে ইনশাআল্লাহ।
সম্মানিত পাঠক! সকলের নিকট বিনীত অনুরোধ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের এই দাওয়াতকে ছড়িয়ে দিন সাধ্যমতো। বিভ্রান্ত সমাজে বসবাস করেও আপনি আপনার অবস্থান থেকে হয়ে উঠুন দ্বীনের একজন দাঈ। স্রেফ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হউক আমাদের পথচলা। কিছুদিন পূর্বেও যার হৃদয়ে মুখে জাগ্রত হ’ত ইশকের যিকর, আজ সেখানে উজ্জীবিত হয় ‘আসুন পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ি’। মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের পাশাপাশি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’কে। যারা দ্বীনে হকের এই দাওয়াত ছড়িয়ে দিচ্ছেন সংগঠিতভাবে। ফালিল্লা-হিল হাম্দ। আল্লাহ তাদের এ প্রচেষ্টাকে কবুল করুন এবং একে জারী রাখুন ক্বিয়ামত পর্যন্ত-আমীন!
ইকবাল হোসাইন, টংগী, গাযীপুর।