আমি
মুহাম্মাদ নাছিরুল ইসলাম। পঞ্চগড় যেলার তেঁতুলিয়া উপযেলার বাংলাবান্ধা
গ্রামে আমাদের বসবাস। আমি ২০১২ সালের জুন মাসে ছহীহ হাদীছের দাওয়াত পাই।
দিনাজপুর যেলার রাণীর বন্দরের আমার এক বন্ধু আমাকে ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) বই
দেন। বইটি পড়ে আমি সহ আরো দু’জন মুহাম্মাদ হুসাইন ও মাসুদ রানা ছহীহ হাদীছ
মোতাবেক ছালাত আদায় শুরু করি। ফলে আমাদের উপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন।
সবাই বলা শুরু করে, আমরা নাকি অন্য মাযহাবে চলে গেছি। পরে আমি পঞ্চগড়ে আসলে
পঞ্চগড় যেলা ‘যুবসংঘে’র সভাপতি মুহাম্মাদ মাযহারুল ইসলাম প্রধানের সাথে
আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাকে ‘আত-তাহরীক’ পত্রিকা ও আমীরে জামা‘আত ও
অন্যান্যদের কিছু বক্তব্য দেন। তখন আমরা জানতে পারি ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন
বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন আছে। ৩০শে নভেম্বর ২০১২ তারিখে আমীরে জামা‘আত
তেঁতুলিয়া বাংলাবান্ধা সফরে আসেন। পঞ্চগড় থেকে আমাদের এ বিষয়ে অবগত করা
হ’লে আমরা জিরোপয়েন্টে আমীরে জামা‘আত ও তাঁর সফরসঙ্গীদের সাথে সাক্ষাৎ করি।
আমীরে জামা‘আত আমাদের হক পথে টিকে থাকার উপদেশ দেন। তিনি বাংলাবান্ধা
বিওপি জামে মসজিদে জুম‘আর ছালাত আদায় করেন।
পরবর্তীতে আমাদের দাওয়াতে আল-হামদুলিল্লাহ ত্রিশ-চল্লিশ জন ভাই পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসারী হন। তাদের মধ্যে একজন হ’লেন স্থানীয় ইমাম ও হোমিও চিকিৎসক মুহাম্মদ শাহজাহান। ছহীহ হাদীছ গ্রহণ করার কারণে তাকে ইমামতি থেকে বাদ দেয়া হয়। তিনি প্রতি মাসে ২০ কপি ‘আত-তাহরীক’ পত্রিকা নেন। তিনি স্থানীয় সিপাইপাড়া বাজারে ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ প্রকাশিত বই-পুস্তকের একটি লাইব্রেরী দেন। ফলে বিদ‘আতীদের ক্ষোভ আরো বেড়ে যায়। তারা গোপনে ষড়যন্ত্র করতে থাকে কিভাবে আমাদের ঠেকানো যায়। জনাব শাহজাহান ছাহেবের বাসা কাসিমগঞ্জ গ্রামে। তার গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য মুহাম্মাদ সুলাইমান আহলেহাদীছ। তিনি ছিলেন কাসিমগঞ্জ গ্রামের জামে মসজিদের মুওয়াযযিন। তিনি ‘আত-তাহরীক’ পত্রিকা ফেব্রুয়ারী ২০১৫ সংখ্যার প্রশ্নোত্তর বিভাগে দেখেন যে, পাশাপাশি ‘আল্লাহ’ ও ‘মুহাম্মাদ’ মসজিদে লেখা যাবে না। ফলে তিনি শাহজাহান ছাহেবকে জিজ্ঞেস করেন, পাশাপাশি ‘আল্লাহ’ ও ‘মুহাম্মাদ’ লেখা যাবে কি-না? শাহজাহান ছাহেব আত-তাহরীকের প্রশ্নোত্তর বিভাগ দেখিয়ে বলেন যে, পাশাপাশি ‘আল্লাহ’ ও ‘মুহাম্মাদ’ লেখা যাবে না।
এরপর কিছুদিনের মধ্যে মুওয়াযযিন সুলাইমান অন্যদের পরামর্শক্রমে পাশাপাশি ‘আল্লাহ’ ‘মুহাম্মাদ’ লেখাটি কালি দিয়ে মুছে দেন। কিন্তু এর সমস্ত দায়ভার এসে পড়ে শাহজাহান ছাহেবের উপরে। মূলতঃ এটা ছিল বিদ‘আতীদের একটা ষড়যন্ত্র।
বিদ‘আতীরা সবাই একজোট হয়ে মসজিদ কমিটির মাধ্যমে গত ০৫.০৬.২০১৫ ইং রোজ শুক্রবার শাহজান ছাহেবের বিচার করার জন্য তাকে মসজিদে ডেকে পাঠায়। তিনি ছিলেন ঐ মসজিদের প্রাক্তন ইমাম। তিনি সেদিন খুৎবা দিতে চাইলে তাকে খুৎবা দিতে দেওয়া হয়নি। জুম‘আর ছালাতের পর বসলে সবাই উত্তেজিত হয়ে তাকে গালিগালাজ করতে থাকে। তাকে কোন কথা বলতে দেওয়া হয়নি। কে বা কারা পুলিশকে খবর দিয়েছিল। ঠিক ঐ মুহূর্তে সেখানে পুলিশ এসে হাযির হয়। পুলিশ তাদেরকে জিজ্ঞেস করে, আপনাদের সমস্যা কি? তারা বলে, স্যার ঐ যে দেখুন, ‘আল্লাহ’ ও ‘মুহাম্মাদ’কে মসজিদ থেকে মুছে দিয়েছে। তখন পুলিশ জিজ্ঞেস করল, কে এই লেখা মুছে দিয়েছে। তখন সুলাইমান ছাহেব দাঁড়িয়ে বললেন, আমি মুছে দিয়েছি। পুলিশ বলল, আপনি এটা ঠিক করেননি। তিনি বললেন, আমার কাছে দলীল আছে। পরে পুলিশ ওসিকে ফোন দিয়ে বলল, স্যার একদল বলছে পাশাপাশি ‘আল্লাহ’ ‘মুহাম্মাদ’ লেখা যাবে, আর একদল বলছে লেখা যাবে না। ওসির সাথে কথা বলার পর তারা বলল, এটা আল্লাহর ঘর। এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা যাবে না। আপনাদের ইচ্ছা হ’লে আপনারা আবার লিখে দিবেন। এই বলে সেদিনের মতো বিষয়টি মিটমাট করে দিয়ে পুলিশ চলে গেল।
কিন্তু এতে বিদ‘আতীদের মনোবাসনা পূরণ না হওয়ায় পরের দিন শনিবার ০৬.০৬.২০১৫ইং তারিখে তারা অপপ্রচার চালায় যে, জনাব শাহজাহান কালেমা মুছে দিয়েছেন। এই কথা শুনে সমস্ত গ্রামের লোক শাহজাহান ছাহেবকে মারার জন্য ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা সবাই পরিকল্পিতভাবে লাঠিসোটা নিয়ে সিপাইপাড়া বাজারে শাহজাহান ছাহেববের দোকানে গিয়ে তাকে আক্রমণ করে বলে, ‘বেটা তোর এত বড় সাহস। তুই কালেমা মিশিয়ে দিয়েছিস’। এই বলে তাকে মারধর শুরু করে। পাশেই ছিল ইউনিয়ন পরিষদ অফিস। তখন ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদাররা সেখানে উপস্থিত হয়ে তাকে পরিষদে নিয়ে যায়। এছাড়া আমাদের আরো তিনজন সাথী ভাই ঐ বাজারে দোকান করত। হোটেল ব্যবসায়ী মুহাম্মাদ নায়বুল, পান দোকানদার মুহাম্মাদ এরশাদ এবং হার্ডওয়ারের দোকানদার মুহাম্মাদ সিরাজুল ইসলাম ভাই। উত্তেজিত জনতা সেদিন তাদের সকলের উপর হামলা করে। ফলে তাদের চারজনকেই পরিষদে আটকে রাখা হয়। এছাড়া আমাদের অন্যান্য সাথী ভাইদেরকেও খোঁজাখুঁজি করতে থাকে। ইতিমধ্যে সেখানে পুলিশ এসে হাযির হয়। পরিষদের চারপাশে ইতিমধ্যে হাযার হাযার মানুষ জড়ো হয়েছে। পরিষদের গেট ভেঙ্গে এরা বার বার তাদের মারতে এগিয়ে যাচ্ছিল। ফলে চারজনকে টয়লেটে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এদিকে বিদ‘আতী আলেমরা মাইকে আমাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে শুরু করে। তারা বলে, এরা নবীকে মানে না। নবীর নাম তারা মসজিদ থেকে মুছে দিয়েছে। এরা শবেবরাত ও মাযহাব মানে না। এরা কোন পীর, ওলি- আওলিয়া মানে না ইত্যাদি অনেক কিছু। তাদের চারজনকে কোন কথা বলতে দেওয়াও হয়নি। অবশেষে রাত ৯-টার দিকে পিকআপ ভ্যানে তুলে পুলিশ তাদের ৪ জনকে থানায় নিয়ে যায়। পরেরদিন রবিবার ০৭.০৬.২০১৫ইং তারিখে তাদের বিরুদ্ধে ধর্মে বিভ্রান্তির কারণ দেখিয়ে ১৫১ ধারায় মামলা করে কোর্টে চালান করে দেয়। মামলায় ১নং আসামী করা হয় মুহাম্মাদ শাহজাহানকে ২নং মুহাম্মাদ নায়বুল ৩নং মুহাম্মাদ এরশাদ এবং ৪নং আসামী করা হয় মুহাম্মাদ সিরাজুল ইসলামকে। যিনি লেখাটি মুছে দিয়েছিলেন তার নাম মামলায় নেই। জনাব শাহজাহান ব্যতীত বাকী তিনজন ঐ ঘটনার বিষয়ে কোন কথাই বলেননি অথচ তাদের আসামী করা হয়। কারণ তারা ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র শাখা কমিটির সদস্য। ঐ দিনই আমাদের লোকজন গিয়ে তাদের যামিন করে ছাড়িয়ে আনেন। ফালিল্লাহিল হাম্দ। পরেরদিন সোমবার বিদ‘আতীরা তাদের যামিন দেওয়ার প্রতিবাদে মিছিল করে। তখন আমরা সবাই বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে থাকি। পরিস্থিতি এত জটিল যে, আমাদের পেলেই তারা মারবে। ইতিমধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব কুদরতে খোদা মিলন স্থানীয় আলেমদের নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে মিটিং করেন এবং কতগুলো দাবি আমাদের উদ্দেশ্যে পেশ করেন। যেমন আমাদেরকে বাপ-দাদার নিয়মে ছালাত আদায় করতে হবে, সম্মিলিত মুনাজাত করতে হবে, লাইব্রেরী বন্ধ করতে হবে, হুযূরদের সাথে বিভিন্ন বিদ‘আতী কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে হবে। এই দাবিগুলো না মানলে জনাব শাহজাহানকে তার দোকান খুলতে দেয়া হবে না এবং আমাদের সবার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। উল্লেখ্য, শাহজাহান ছাহেবের একমাত্র আয়ের উৎস তার দোকান। আমি গোপনে তাদের বাড়ি গিয়ে তার বাবার সাথে আলাপ করি। তার পরিবারের অবস্থা শুনে আবার বুক ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। তার বাবা বললেন, আমরা গরীব মানুষ। দোকানের আয় দিয়েই আমাদের সংসার চলে। আট দশ দিন হয়ে গেল আমাদের পাশে কেউ নেই। তাই চেয়ারম্যানের দাবি মেনে নিয়ে দোকান খোলা ছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই।
অতঃপর ১৯.০৬.২০১৫ইং রোজ শুক্রবার চেয়ারম্যান আমাদের সবাইকে বই-পুস্তক সহ ইউনিয়ন পরিষদে উপস্থিত হ’তে বলেন। সেদিন ইউনিয়ন পরিষদে আমি এবং যে চারজনের নামে মামলা হয়েছিল তারা এবং আমার এক সাথী ভাই মুহাম্মাদ হোসাইন উপস্থিত হ’লাম। সকাল ১০-টায় আমাদের ছয়জনকে নিয়ে বিচার শুরু হল। সেই বিচারে উপস্থিত ছিলেন চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় সকল মসজিদের ইমামগণ। প্রথমে চেয়ারম্যান বক্তব্য রাখলেন যে, এরা কয়েকবছর ধরে ইসলামে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। এরপর ইমামগণ আমাদের বিরুদ্ধে ন্যাক্কারজনক ভাষায় বক্তব্য রাখলেন। পরিষদের চারপাশে তখন হাযার হাযার মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে আছে আমাদের মারার জন্য। এক পর্যায়ে চেয়ারম্যান বললেন, আমরা যদি তার কথা মেনে না নেই তাহ’লে তিনি আমাদেরকে জনগণের হাতে তুলে দিবেন। অতঃপর আমাদেরকে এক এক করে প্রশ্ন করা হয় যে, তোমরা আমাদের মত নামায পড়বে কি-না? নিয়ত করবে কি-না? মুনাজাত করবে কি-না? আমাদের কোন কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়নি। অবশেষে উপায়ান্তর না পেয়ে আমরা বাধ্য হয়ে হ্যা সূচক জবাব দেই। আল্লাহ তুমি আমাদের ক্ষমা করো! এ সময় আমাদের সাথী ভাই মুহাম্মাদ হুসাইন ‘আমরা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ মতে ছালাত আদায় করি’ বললে জনগণ তাকে মারার জন্য হৈ চৈ শুরু করে দেয়। ফলে চেয়ারম্যান তাকে দুই হাত উঁচু করে সবার কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন। যতক্ষণ আলোচনা চলে ততক্ষণ তাকে দুই হাত উপরে উঁচু করে থাকতে হয়। এরপর আমাদের সবার কাছে ফাঁকা স্ট্যাম্পে সই নেওয়া হয়। এরপর চৌকিদারের মাধ্যমে লাইব্রেরীর সব বই বস্তায় করে মজলিসে হাযির করা হয় এবং শাহজাহান ছাহেবের দ্বারা বিদ‘আতী মুনাজাত করিয়ে নেওয়া হয়। এরপর চেয়ারম্যান বলেন, শাহজাহান আজকে আমাদের বাড়িতে মিলাদ মাহফিল করবে। সমস্ত হুযুরকে চেয়ারম্যান বললেন, এরা যদি আমাদের মত নামায না পড়ে, মুনাজাত না করে তাহ’লে মেরে হাড়-হাড্ডি ভেঙ্গে আমার কাছে নিয়ে আসবেন। এরপর থেকে আমি এবং আমার অন্যান্য সাথী ভাইয়েরা বাড়িতে ছালাত আদায় করছি। সকল দ্বীনী ভাইয়ের নিকটে আমরা দো‘আ প্রার্থী। এতসব হিমাদ্রিসম বাধা পেরিয়েও যেন আমরা হক্বের উপর অটল থাকতে পারি মহান আল্লাহ যেন আমাদেরকে এই বিপদে ধৈর্যধারণ করার তৌফিক দান করেন! আমীন!!
নাছিরুল ইসলাম
বাংলাবান্ধা, তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড়।